স্টিক হাতে নিতে নিতে হেডক বললেন, একদিন আমার এখানে আসুন। ব্লেচলি সম্পর্কে একটা গুজব এখানে চালু আছে, আপনাকে শোনাব।
.
স্মাগলার্স রেস্ট-এ হেডকের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে পরিতৃপ্ত হল টমি। খাদ্য ও পরিবেশনের পরিপাটি, ঝকঝকে টেবিলপত্র বিশেষভাবে তাকে চমৎকৃত করল। হেডক ভাগ্যবান, তার পাঁচক-পরিবেশক কর্মচারীটি অতিশয় নিপুণ।
চেহারায় যেমন পরিপাটি, তেমনি চমক লাগানো আদবকায়দা। লন্ডনে প্রথম শ্রেণির রেস্তেরাঁর ওয়েটারও তার কাছে হার মানবে।
বিয়ারের বোতলে চুমুক দিতে দিতে টমি হেডকের কর্মচারীটির পঞ্চমুখে প্রশংসা করল।
এপেলডোরের সত্যিই তুলনা হয় না, সহাস্যে মন্তব্য করলেন হেডক, ভাগ্যে এরকম কাজের লোক পাওয়া যায়।
–সন্ধান পেলেন কোথায়? জানতে চাইল টমি।
বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। নামিদামি হোটেলে কাজ করে এসেছে।
এভাবে কথাবার্তা চলতে চলতেই অনিবার্যভাবে মেজর ব্লেচলির প্রসঙ্গ উঠল। কিন্তু দেখা গেল, হেডক আজ আর তেমন উৎসাহী নন। তিনি বরং মুখর হয়ে উঠলেন ইংলন্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে।
হেডক বললেন, আমি ভেবে পাই না লিহাম্পটনের মতো এমন একটি সমুদ্র-নিকটবর্তী স্থান কী করে এমন অরক্ষিত রাখা হয়।
জার্মান ডুবোজাহাজ যে কোনো সময় এখানে এসে হানা দিতে পারে। আকাশ থেকে ছত্রীবাহিনী নামিয়ে দিতেও কোনো বাধা নেই।
টমি হেডকের আক্ষেপ শুনে যেতে থাকে। আর এপেলডোরের নীরব আনাগোনা লক্ষ্য করতে থাকে।
এক সময় সে টেবিলে হুইস্কির বোতল সাজিয়ে দিয়ে যায়। তীক্ষ্ণ নজরে টমি তার মুখের দিকে তাকায়। মাথাভর্তি চুল, নীল চোখ। দেখলে ওয়েটার বলে মনে হয় না। চালচলনও অন্যরকম।
সন্দেহ দেখা দেয় টমির মনে। ছদ্মবেশে কেউ হেডককে প্রতারিত করছে না তো?
হেডক সমানে বকবক করে চলেছেন।
এদিকে জার্মানির গুপ্তচরবাহিনী কোথায় না ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের আশপাশেই তাদের নিঃশ্বাস টের পাওয়া যাচ্ছে। সব সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।…ধরা পড়েছে দু-একটা ক্কচিৎ কখনও।
প্রসঙ্গটাকে হাতছাড়া করল না টমি। হেডকের কথায় সুর মেলাল, আমাদের মাথামোটা পুলিশদেরও যা জিজ্ঞাসাবাদের বহর। কোনো স্পাইকে আটক করেই দুম করে জিজ্ঞেস করে বসে, তুমি কে হে? এম না এন?
টমির মুখ থেকে উচ্চারিত কথা যেন মুহূর্তে ঘরের ভেতরে ভূমিকম্প ঘটিয়ে দেয়।
ওয়েটারের হাত থেকে সোডার বোতল ও খানিকটা মিষ্টি রস ছড়িয়ে পড়ে। লোকটি মাথা নিচু করে দুঃখ প্রকাশ করে, আমি দুঃখিত স্যার।
টমি লক্ষ করে লোকটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে।
হেডক হই-হই করে ধমকে ওঠেন। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। কপালে ঘামের রেখা। ফুটে ওঠে।
টমির জামায় হাতে মিষ্টি রস ছলকে পড়েছিল। হেডক বললেন, আসুন বাথরুমে হাতটা ধুয়ে ফেলবেন।
টমিকে বাথরুম অবধি পৌঁছে দিয়ে গজগজ করতে থাকেন, এমন অপদার্থ..লাফঝাঁপ ছাড়া কাজ করতে পারে না…
.
বাথরুমে ঢুকে হাত জামা পরিষ্কার করে নিতে থাকে টমি।
হেডক বাইরে দাঁড়ানো। তার তর্জনগর্জন এখনও শেষ হয়নি।
-বুঝলেন মিয়াদো, মেজাজ চড়ে গেলে আমার আর হুশ থাকে না। ভাগ্যে এপেলডোরের মতন কাজের নোক পেয়েছি।
সামান্য ভুলচুক সকলেরই হতে পারে…কিন্তু আমি একেবারে বরদাস্ত করতে পারি না। এপেলভোর অবশ্য আমার মেজাজ বুঝতে পারে…তাই রক্ষে।
বেসিনে হাত ধুয়ে বিপরীত দিকের ভোয়ালেতে হাত মুছবার জন্য এগুতে গিয়েই…একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল…খেয়াল করেনি টমি…বাথরুম পরিষ্কার করবার জন্য একখণ্ড সাবান আর একটা ভোয়ালে ফেলে রাখা ছিল…সেই সাবানের ওপরেই পা চাপিয়ে দিল।
মুহূর্ত মধ্যে যেন প্রলয় ঘটে গেল বাথরুমের ছোট্ট পরিসরে। পিছল মেঝেয় সাবানের টুকরোটি টমিকে যেন উড়িয়ে নিয়ে চলল।
এক-পা শূন্যে আর এক-পা দিয়ে কোনো রকমে চলন্ত দেহের ভারসাম্য ঠেকিয়ে… বেসামাল অবস্থায় টমি গিয়ে ধাক্কা মারল দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটা ছোট্ট কেবিনে।
সঙ্গে সঙ্গে কেবিনের ঢাকনা সরে গেল…অমনি এক ভোজবাজি।
টমির চোখ বিস্ফারিত হল। চোখের সামনে দেখতে পেল…ছোট্ট একটা কুঠুরি…আর তাতে রয়েছে ওয়ারলেসের যন্ত্রপাতি, ট্রান্সমিটার…
.
বাইরে হেডকের বকবকানি ততক্ষণে থেমে গেছে। টমির বিলম্ব হচ্ছে দেখে এগিয়ে এসে বাথরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিয়েছেন।
চোখের সামনে ছোট্ট দৃশ্যটাই টমির বোপোদয় ঘটিয়ে দিয়েছে। নিজের মনেই বলে উঠেছে, ছ্যা ছ্যা…কি আহম্মক আমি..লোকটাকে আমি এতদিন ইংরেজ ভেবে এসেছি..কখনও বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি।
অমন বিশাল চোয়াল…চড়া মেজাজ ধমকধামক সবেতেই জার্মান ছাপ স্পষ্ট। তার ওপরে অমন ফিটফাট চেহারার একজন অনুচর…ওয়েটারের ছদ্মবেশে…এই জন্যই M বা N নাম শুনেই অমন চমকে উঠেছিল দু-জনেই…
নেহাত দৈব বশেই রহস্যটা ধরা পড়ল। এর আগে দু-বার পাখি খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে। নাৎসী এজেন্ট হানকে এখানে পাঠানো হয়েছিল প্রথমে। তারপর তাকে সরিয়ে মঞ্চে হাজির হয়েছে দেশপ্রেমিক কমাণ্ডার হেডক।
পুরো ভুয়ো নাম–জলজ্যান্ত N। নিশ্চিন্তে এমন একটা নিরাপদ স্থানে ডেরা বেঁধে এ দেশের ভাগ্য নিয়ে খেলা জুড়েছে। সান্স সৌচিকে বানিয়েছে দ্বিতীয় শিবির…সহযোগী অফিসাররা কিলবিল করছে সেখানে।…