শীলার কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে উঠল, কোনো রকমে বলল, আমি জানি কার্লকে ওরা আর বাইরে আসতে দেবে না, একদিন গুলি করে মারবে ঠিক।
.
–বেটিকে অপহরণ করার একটা কারণ আমি খুঁজে বের করেছি।
টমিকে বলল টুপেনস।
–শুনি তোমার যুক্তিটা কী? উদ্গ্রীব হল টমি।
-একদিন দুপুরে আমার ঘরে ঢুকেছিল বেটি, তোমাকে বলেছিলাম, নিশ্চয় মনে আছে, উল লেস জড়ো করে একগ্লাস জলে ফেলে ঘুটছিল…বাচ্চারা যা দেখে তাই অনুকরণ করবার চেষ্টা করে। নিশ্চয়ই ও কোনো দিন কার্লকে ওভাবে রাসায়নিক তরলে কাগজ ফেলে অদৃশ্য লেখা উদ্ধার করতে দেখেছিল। বেটি তো ইদানীং কথা বলতেও শিখেছে। বাচ্চাটাকে তাই সে বিপজ্জনক ভেবেছিল আর তারই ইঙ্গিত পেয়ে পোলিশ মহিলাটি বেটিকে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল।
.
যুদ্ধের অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। ফ্রান্সের ভাগ্যাকাশে চরম সংকট ঘনায়মান। ফরাসি উপকূলভূমি গেস্টাপোেদের অধিকারে চলে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে তারা ইংলন্ড অভিমুখে অভিযান করতে পারে। চতুর্দিকে হতাশা আর আতঙ্ক।
কার্ল ভন দিনিমকে কবজা করা গেছে, টমি বলল, কিন্তু গুপ্তচক্রের আসল মাথাটিই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
–হ্যাঁ–মিসেস পেরিনা-সমস্ত কর্মকাণ্ডের নেত্রী। নাগাল ধরা সহজ হবে না। বলল টুপেনস।
–আর শীলা?
–না, না, ও এসবের মধ্যে নেই।
–তুমি নিশ্চিত?
–হ্যাঁ।
–তাহলে নিজে বেঁচে যাবে। প্রেমিককে হারিয়েছে, এবারে মাকে হারাবে। কষ্ট হয় দুর্ভাগা মেয়েটির জন্য। বলল টমি।
–আমাদের কী করার আছে বল।
–কিন্তু আমাদের ধারণা যদি ভুল হয়? অর্থাৎ M বা N যদি অন্য কেউ হয়?
–পরের কথা এখন ভেবে কী লাভ। আপাতত মিসেস পেরিনার ওপরে নজর রাখাই আমাদের কর্তব্য। পরে যদি ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়, তখন করণীয় ভাবা যাবে।
–আমাদের পুরোনো অনুগত কর্মী অ্যালবার্টকে তুমি এ-ব্যাপারে কাজে লাগাতে পার।
–তোমার বলার আগেই আমি তার কথা ভেবেছি। তাকে খবরও পাঠিয়েছি। কিন্তু তুমি কতদূর কী করলে?
–আমি…আপাতত গলফ ক্লাবে যাতায়াত করছি।
.
যৌবনে টমি ও টুপেনস যখন দুর্বার ছিল, যৌথভাবে বহু দুঃসাহসিক কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে, অ্যালবার্ট সহযোগী হিসেবে তাদের পাশে থেকেছে।
সেই হাসিখুশি বুদ্ধিমান যুবক এখন যৌবনোত্তীর্ণ। শরীরে মেদ জমেছে। দেখতে ভারিক্কি হলেও মনটি আগের মতোই সতেজ আছে।
এতদিন পরে আবার তাকে ডেকে এনে টমি ও টুপেনস একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বে নিয়োগ করল…
.
গলফ মাঠে কমাণ্ডার হেডক আর টমি। একটা জোরালো শট হাঁকড়াবার পর টমি জিজ্ঞেস করল, ব্লেচলির সঙ্গে আপনার অনেক দিনের পরিচয়?
হেডকও কম যান না। অধিকতর জোরালো শটে বাজিমাত করলেন। মুখময় হাসি ছড়িয়ে বললেন, ব্লেচলির কথা বলছেন? গত শরতে এখানে এসেছে–তার সঙ্গে আমার জানাশোনা এই নমাস হল।
–উনি আপনার বন্ধুদের বন্ধু–এরকম বলেছিলেন।
মিথ্যা হলেও জোরের সঙ্গেই মন্তব্যটা উচ্চারণ করল টমি।
–এরকম বলেছিলাম? থমকে যান হেডক, না, না, তা কী করে হয়? এই গলফ ক্লাবেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়? কিন্তু ও-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
মানুষটাকে কেমন রহস্যময় মনে হয়, তাই না?
অবাক চোখে তাকান হেডক। তরল হেসে বলেন, ধ্যাৎ, কিসের রহস্য ওর মধ্যে?
স্টিক ঘুরিয়ে আর একটা সুন্দর শট নিল টমি। হেডক নিজের স্টিক বাগিয়ে ধরলেন। বললেন, বুড়ো ব্লেচলি সোজাসাপ্টা সৈনিক মাত্র। তাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে কেন আপনার?
–আসলে এই এলাকায় হঠাৎই এসে উদয় হয়েছেন তোতার অতীত সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না।
খেলা চলল আরও কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত জিত হল কমাণ্ডারের। সাফল্যের আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে বললেন, ব্লেচলি আগে রাগবিশায়রে ছিল।
–আপনি ঠিক জানেন?
জবাব দিতে গিয়েও থমকে গেলেন কমাণ্ডার। দ্বিধাজড়িত স্বরে বললেন, না–মানে ঠিক নিশ্চিত নই। তবে, ঠিকই, একটু কেমন যেন।
দুজনে হেঁটে এসে দুটো চেয়ার নিয়ে পাশাপাশি বসলেন।
–আমিও তাই বলতে চাইছি।
টমি তীক্ষ্ণ চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে হেডককে।
–আপনার কথা শুনে মনে পড়ল, চোখ পিটপিট করে বলতে থাকেন হেডক, ব্লেচলিকে আগে থেকে চেনে এমন কাউকে এখানে নজরে পড়েনি। ওর সম্পর্কে কিছু কানে এসেছে নাকি?
-না, সেসব কিছু নয়।
–আমাকে গোপন করার কিছু নেই মিয়াদো। এখানে সকলেই আমার কাছে আসে, সবকথাই কানে আসে।
–সেটা জানি বলেই তো আপনার অভিমত জানতে চেয়েছি।
হেডক নড়েচড়ে বসলেন। তার চোখে পিটপিটানি ঘন হল।
–ব্লেচলি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? ওকে জার্মান বলে সন্দেহ করলে কিন্তু ডাহা ভুল হবে। আমার মতোই একজন খাঁটি ইংরেজ ব্লেচলি।
-না, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
জার্মানদের ও মন থেকে ঘৃণা করে। দেখেছেন তো কার্লকে দেখলেই কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠত…স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে কালের বিষয়ে আমি জেনেছি। সবাই জানত সে গ্যাস সম্পর্কে গবেষণা করছে, আসলে তার আসল মতলব ছিল এখানকার জলের ট্যাঙ্কটাকে বিষাক্ত করে তোলা।
টমি যেন স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কিছু। নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, না, ব্লেচলি সম্পর্কে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।
–আমারও তাই অভিমত। বলেন হেডক।
আলোচনার এখানেই ইতি পড়ল। গলফ ময়দানে ততক্ষণে অনেক খেলোয়াড় জমায়েত হয়েছে। আর-এক প্রস্থ খেলার জন্য হেডক আর টমিও উঠে পড়ল।