–তা হওয়া সম্ভব, বলল টমি, তাহলে বলছেন, ওই জায়গায় গিয়ে আমাকে ঘাঁটি গাড়তে হবে।
-ঠিক তাই। আপনার বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ শক্তি প্রয়োগ করবেন, আমি নিশ্চিত, সঠিক লোকটিকে আপনি পাকড়াও করতে পারবেন।
-বেশ। লিহাম্পটন জায়গাটা সম্পর্কে কিছু বলুন।
–বিশেষত্ব কিছু নেই। কয়েকজন অকেজো বুড়োবুড়ি, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, দু-একজন বিদেশী কিংবা হয়তো ব্যবসায়ী–এরাই রয়েছে সেখানে।
-বলছেন এদের মধ্যেই মিশে আছেন এন অথবা এম?
–অথবা তাদের কোনো সহযোগী।
–চেষ্টা করে দেখা যাক তাহলে।
–ধন্যবাদ, আপনার সাফল্য কামনা করি।
.
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে টমি। স্ত্রীকে রেখে এই প্রথম বাইরে যেতে হচ্ছে তাকে। অথচ আসল কাজের কথাটা গোপন রাখতে হল।
টমিকে বিচলিত দেখে টুপেনস স্বামীকে প্রবোধ দিয়ে বলল, সে-ও এখানে একটা নার্সের কাজ জুটিয়ে নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেবে দিন।
সব গোছগাছ করে নিয়ে তিনদিন পর টমি এবারডিনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়ল। টুপেনস স্টেশনে এসে তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল।
স্কটল্যান্ডে ট্রেন বদল করে ম্যানচেস্টার, সেখানে থেকে তিনদিন পর লিহাম্পটনে পৌঁছানো গেল। একটা হোটেলে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে সান্স সৌচি ভিলা খুঁজে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হল না।
পাহাড়ের পাশেই ভিক্টোরিয় যুগের একটা ভিলা সান্স সৌচি। ওপর তলার যে কোনো জানালা থেকেই অদূরবর্তী তরঙ্গায়িত সমুদ্র চোখে পড়ে।
হলঘরে ঢুকেই একটা ধোঁয়াটে গন্ধ পেল টমি। সরাসরি অফিসঘরে ঢুকে ভিলার মালিক মিসেস পেরিনারের সঙ্গে দেখা করল।
মাঝবয়সি ভদ্রমহিলা। মুখে চড়া প্রসাধনের প্রলেপ। মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল। বেশবাসে। পরিপাটির অভাব চোখে লাগে।
টমি মিঃ মিয়াদো নামে নিজের পরিচয় দিল। যুদ্ধের সময় লন্ডনে থাকা নিরাপদ মনে না করায় এখানে সরে এসেছে। বন্ধুদের কাছে এখানকার ব্যবস্থাপনার প্রশংসা শুনেই এককথায় চলে এসেছে।
প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষ করে উপযুক্ত ভাড়ার বিনিময়ে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে নিল সে এবং পরদিন সকালেই হোটেল ছেড়ে সান্স সৌচিতে এসে উঠল।
মিসেস পেরিনা স্বাগত জানিয়ে হলঘরে নিয়ে গেল টমিকে। অন্যান্য বোর্ডাররা সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। একে একে সকলের সঙ্গেই তাকে পরিচয় করে দেওয়া হল। এরা হলেন, মিসেস ওরুরকি, মেজর ব্লেচলি, মিঃ কার্ল ভন দিনিম; মিস মিন্টন।
মাথায় পরিপাটি ঘন চুল, চুপচাপ বসে উল বুনছেন এক মহিলা। ইনি হলেন মিসেস ব্লেনকিনসপ। সব শেষে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার মুহূর্তে নিঃশব্দে মুখ তুলে নেন তিনি।
চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা দুলে উঠল টমির। প্রচণ্ড বিস্ময়ে হকচকিয়ে গেল। মিসেস ব্লেনকিনসপ–এ যে টুপেনস।
মুহূর্তে সমস্ত হলঘরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে আবার তাকাল, নির্বিকার টুপেনস একাগ্র হয়ে আছে উলবোনা নিয়ে। চেনাজানার আভাসমাত্র তার চোখে নেই।
কিন্তু টুপেনস এখানে কেন? কীভাবে? টমির নিঃশ্বাস প্রশ্বাস মন্থর হয়ে গেল।
.
সন্ধ্যা পর্যন্ত একই জিজ্ঞাসা মাথায় নিয়ে ঘুরে ফিরে কোনোরকমে কাটিয়ে দিল টমি। মিসেস ব্লেনকিনসপকে যথাসাধ্য এড়িয়ে থাকবারই চেষ্টা করেছে। কিন্তু থেকেছে কাছাকাছিই।
ডিনারের সময় সান্স সৌচির আরও তিনজন বাসিন্দার সঙ্গে আলাপ হল। এরা হলেন মিঃ ও মিসেস ক্লে এবং মিসেস স্প্রট। এই যুবতী মায়ের সঙ্গে রয়েছে তার ছোট্ট মেয়ে বেটি। অল্প অল্প কথা বলতে শিখেছে সবেমাত্র।
টমির পাশের আসনেই বসে ছিলেন মিসেস স্প্রট। টমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যুদ্ধের সোরগোল কমে এলো, সবাই দেখছি নিজের নিজের জায়গায় ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন!
টমি জবাব দেবার আগেই পাশ থেকে অপর এক মহিলা বলে উঠলেন, কমল কোথায়? দেশের পরিস্থিতি এখনও অস্বাভাবিক। হিটলার বলেছেন, ইংলন্ডের জন্য মজুত রেখেছেন ব্লিটসীগ মনে হয় মারাত্মক কোনো গ্যাস ওটা।
মেজর ব্লেচলি বলে উঠলেন, গ্যাস না হাতি। স্রেফ বোমা মেরেই উড়িয়ে দেবে ইংলন্ড। ফ্রান্সে যা করেছিল।
একপাশ থেকে টুপেনস বলে উঠল, আমার ছেলে ডগলাস তো বলে…
চমকে উঠল টমি। বেশ কৌতুক বোধ করল। নিজে ব্লেনকিনসপ সেজে আবার ডগলাসের নাম করা কেন?
.
ডিনারের পরে লাউঞ্জে জড়ো হয়েছে সকলে। যে যার মতো গল্প করে চলেছেন। মেয়েরা তাদের উল-কাটা নিয়ে ব্যস্ত।
মেজর তার সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বেশ রোমাঞ্চকর ভঙ্গিতে বর্ণনা করে চলেছেন। এমন সময় শ্রোতাদের মধ্য থেকে সুদর্শন যুবক ভন দিনিম উঠে দাঁড়ায়। সকলকে শুভরাত্রি জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
মেজর ঘাড় ঘুরিয়ে তার নিষ্ক্রমণ দেখলেন। তারপর টমিকে বললেন, এ হল জার্মান উদ্বাস্তু, বুঝলেন? যুদ্ধের একমাস আগে জার্মানি থেকে পালিয়ে এসেছে।
–উনি কি জার্মান?
–নির্ভেজাল জার্মান-ইহুদি নয়। ওর দুই ভাই হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর দিন গুণছে। এ কোনো রকমে পালিয়ে এসে বেঁচেছে।
-কী সর্বনাশ!
-তবে বলছি কী। অপরাধ হল ওর বাবা নাৎসি শাসনের সমালোচনা করেছিলেন।
টমি আলোচনার একটা সূত্র পেয়ে নড়েচড়ে বসেছিল। কিন্তু এই সময়ে মিঃ ক্লে এসে জুটে সব ভণ্ডুল করে দিলেন। তিনি শুরু করলেন নিজের শরীর স্বাস্থ্যের ফিরিস্তি।