এমনি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে গোপনে নির্জনে মিলিত হয়েছে টমি ও টুপেনস।
যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিপর্যয়ের বিষয়ে চিন্তিতভাবেই।
টমি বলল, আমি নিঃসন্দেহ, এই বিপর্যয়ের পেছনে কাজ করেছে এক বিরাট অন্তর্দেশীয় চক্রান্ত।
–আমি তোমার সঙ্গে একমত, চিন্তিতভাবে বলল টুপেনস, কিন্তু সরকার কী করবে, উপযুক্ত প্রমাণ তো দরকার। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে চক্রান্ত দমন করতে গেলে তা হবে স্বেচ্ছাচারিতা।
-হ্যাঁ, চক্রের নায়ক-নায়িকাদের চিহ্নিত করাটাই হল আসল কাজ। এখানে তবু কিছুটা করতে পেরেছি।
–এখানে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল টুপেনস।
–কার্ল ভন দিনিম ও পলোনস্কার পরিচয় আমরা জানতে পেরেছি।
–ওরা যৌথভাবে কাজ করছিল, আমার ধারণা।
–হ্যাঁ।
–কিন্তু, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। বেটিকে এভাবে অপহরণের চেষ্টা করল কেন?
টমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার কাছেও ব্যাপারটা একটা ধাঁধা হয়ে আছে।
টুপেনস নিশ্চুপ থেকে কী চিন্তা করল। পরে বলল, আমার কী মনে হয় জান, মিসেস স্প্রট সম্ভবত নিজেও জানেন না যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ তার জ্ঞাত রয়েছে। কিংবা তিনি তেমন কিছু বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেটা উদ্ধার করার উদ্দেশ্যেই বেটিকে টোপ করতে চেয়েছিল এজেন্টরা।
–হ্যাঁ, এটা একটা কারণ হতে পারে, বলল টমি, এমন একটা হুঁশিয়ারি লেখা চিঠি তো তিনি পেয়েছিলেন।
টুপেনস চিন্তিতভাবে বলল, মিসেস স্প্রটকে সামনে রেখে একটা ভালো ফঁদ পাতা যেত যদি ভদ্রমহিলা একটু ধীরস্থির চিন্তাশীল হতেন। ওরকম অগভীর মনের মানুষকে নিয়ে কোনো গুরুতর কাজের পরিকল্পনা নেওয়া যায় না। কথা বা ব্যবহারের কোনো লাগাম থাকে না।
-তবে পুলিশের সঙ্গে কথা বলার সময় বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন।
–হ্যাঁ।
–তারপর কী রকম দুম করে পিস্তল চালিয়ে বসলেন, বল, আমি হলে পারতাম না।
-একেবারেই আনাড়ি। আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে সামান্যমাত্ৰ ধারণা থাকলে কেউ ওইভাবে দুম করে ট্রিগার টিপতে পারে না।
খানিক বিরতি নিয়ে টুপেনস ফের বলল, ওই পোলিশ মহিলাকে প্রথম যেদিন দেখি, মুখটা কেমন চেনা মনে হয়েছিল। কিন্তু মনে করতে পারিনি।
–আগে কখনও দেখেছিলে মনে হচ্ছে?
–ঠিক বুঝতে পারছি না।
-একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ, মিসেস পেরিনার চেহারার সঙ্গে তার মেয়ে শীলার কিন্তু কোনো মিল নেই।
-ওভাবে খেয়াল করিনি। আচ্ছা, মিসেস স্প্রটের ঘরে পাথরে মুড়ে ওই চিরকুটটা কে ফেলতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
বেটি চুরি যাবার পরে ঘরে গিয়ে উনি ওটা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?
–আমার ধারণা মিসেস পেরিনাই কাজটা করেছেন।
–তার মানে তুমি বলতে চাইছ, ওই জার্মান যুবক আর পোলনস্কার সঙ্গে মিসেস পেরিনারও যোগসাজস রয়েছে?
–আপাতত সেরকমই মনে হচ্ছে। মেজর যখন ব্যাপারটা পুলিশে জানাবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছেন ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখ, মিসেস পেরিনা ছুটে এসে কেমন গোটা ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করলেন। পুলিশের ধারে কাছেই ঘেঁষতে দেন না—
–তাহলে কি মিসেস পেরিনাই M?
–আমার বিশ্বাস। তুমি কী ভাবছ?
–আমি M নয় N-এর গন্ধ পাচ্ছি। এবং আমার নজর মেজর ব্লেচলির ওপর।
.
টুপেনস তীব্র চমকে মুখ তুলে তাকাল, উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে ঘরে ঢুকেছে শীলা। মুখ বিষণ্ণ। কিন্তু চোখ জ্বলছে।
-কী হয়েছে শীলা? উদ্বেগের স্বর ধ্বনিত হল টুপেনসের কণ্ঠে।
–এই মাত্র পুলিশ কার্লকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল।
–সে কী!
ঘটনাটা অজানা নয় টুপেনসের। খানিক আগেই জানালা পথে পুলিশের গাড়ি তার নজরে পড়েছে। তাছাড়া কারণটাও তার জানা। তবু উদ্বিগ্ন হবার ভান করল।
–আমি এখন কী করব? কার্লকে কি আমি আর দেখতে পাব না? আকুল স্বরে জানতে চাইল শীলা।
–অত ভাবছ কেন, শীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল টুপেনস, বুঝতেই তো পারছ, এখন যুদ্ধের সময়, আর কার্ল একজন বিদেশী, কিছু দিনের জন্য হয়তো তাকে আটকে রাখবে, এছাড়া কিছু নয়–
–কিন্তু পুলিশ যে ওর ঘর সার্চ করছে?
–তাতে কী, কিছু যদি পাওয়া না যায়—
কিছুই পাবে না তাঁরা। আপনার কি মনে হয়?
–আমি ঠিক জানি না, তুমি হয়তো জানতে পার।
–আমি! ক্ষুব্ধ দৃষ্টি টুপেনসের মুখের ওপর ফেলল শীলা।
আগের কথার জের টেনে টুপেনস ফের বলল, কিছু পাওয়া না গেলে ও নিরাপদই থাকবে।
-মা বললেন, মিথ্যা মামলা জুড়ে দিতে পারে পুলিশ।
-তোমার মা ভুল বলেছেন। এরকম কাজ তারা করবে না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পার–তবে কি জান, জেনেশুনে তোমার অতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া ঠিক হয়নি।
–আপনি কার্লকে পছন্দ করেন না? আপনি কী ভাবছেন কাল
–অসম্ভব নয় শীলা। কার্ল তার জন্মভূমির হয়ে কাজ করতেই পারে
নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে প্রতিবাদ জানিয়ে শীলা বলে উঠল, না, কখনওই নয়, আমি কার্লকে জানি। ও তার বিজ্ঞানের গবেষণা নিয়েই ডুবে ছিল। এই সুযোগ পাওয়ার জন্য ও ইংলন্ডের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল।
এখানে উদ্বাস্তু হয়ে এলেও তার আত্মসম্মানজ্ঞান ছিল প্রখর। নিজের দেশের প্রতিও মমত্ব ছিল। কিন্তু নাৎসীদের ঘৃণা করত মন থেকে। স্বপ্ন দেখত নাৎসীমুক্ত স্বাধীন জার্মানির।
-হ্যাঁ, ওরকমই বলত সে বলল টুপেনস।
–সে কারণেই কি আপনার ধারণা কার্ল একজন গুপ্তচর?
–সম্ভাবনার কথাই বলছি আমি।
উঠে দাঁড়াল শীলা। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি অন্যদের থেকে আলাদা, তাই আপনার সাহায্য চাইতে এসেছিলাম। আমি দুঃখিত।