প্রবল উত্তেজনায় ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন হেডক। অন্য সকলেও ছুটে এলেন। এরপর দক্ষ হেডকের গাড়ির শব্দে নিঝুম পাহাড়ি পথ জেগে উঠতে লাগল।
ঝড়ের গতি গাড়ির চলমান চাকায়। বহু দূরে প্রায়-অদৃশ্য চলমান বিন্দু দুটো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল।
হ্যাঁ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এবারে…এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা–তার হাত ধরে ছোট্ট বেটি হাঁটছে, কখনও লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
অনিবার্য উত্তেজনায় সকলের হাত থেকে থেকে মুঠি পাকাচ্ছে–দাঁতে দাঁত চেপে বসেছে।
উত্তেজনা চাপতে না পেরেই সম্ভবত মিসেস স্প্রট আচমকা চিৎকার করে ওঠেন।
সেই চিৎকারের শব্দ কানে যেতেই সামনের স্ত্রীলোকটি আকৃষ্ট হয়ে পেছনে ঘাড় ঘোরালো।
ধাবমান গাড়িটিকে দেখতে পেয়েই মুহূর্তের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর একঝটকায় বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটতে শুরু করল।
মেয়েমানুষটি বুদ্ধিমতী। সোজা ছুটল না। গাড়ি যাতে তাকে অনুসরণ করতে না পারে সেজন্য এঁকেবেঁকে ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের কাঁধের কাছে চলে যায়।
উন্মাদের মতো গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিসেস স্প্রট সামনে ছুটতে লাগলেন। অন্য সকলে ছুটতে লাগলেন তার পেছনে।
বেটিকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিদেশিনী। দুর্বোধ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে সক্রোধে।
–হুঁশিয়ার, পেছন থেকে চিৎকার করে ওঠেন হেডক, বাচ্চাটাকে পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে ওই মেয়েছেলেটা
সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভয়ে উদ্বেগে জড়সড়। কী জানি কী হয়। সত্যি যদি মেয়েছেলেটা ভয় পেয়ে বেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
হেডক পকেট থেকে পিস্তল বের করে চিৎকার করে উঠলেন, বাচ্চাটাকে নামিয়ে দাও, নইলে আমি গুলি করব।
বিদেশিনীর মুখে দুর্বোধ্য হাসির ঝিলিক খেলে গেল। সে আরও নিবিড়ভাবে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বেটিকে। গুলি করার সুযোগ সে রাখতে চায় না।
হেডক থমকে যান। স্তিমিত কণ্ঠে বলার চেষ্টা করেন, আমি কিন্তু গুলি চালাব…
ঠিক সেই মুহূর্তে গুলির শব্দ হল গুড়ুম
চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকান সকলে। দেখা গেল মিসেস স্প্রটের হাতে পিস্তল ধরা–
সামনের স্ত্রীলোকটি ততক্ষণে বেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেই পাহাড়ের ওপরে আছড়ে পড়ল। থর থর করে কাঁপছে তার শরীর। সকলে এগিয়ে যায় তার দিকে।
হাঁটু গেড়ে বসল টমি। তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে বিদেশিনী। একসময় মাথাটা হেলে পড়ল একপাশে। মাথায় রক্ত। বুলেট কপাল ভেদ করে গেছে।
পেছন থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে বেটিকে কোলে তুলে নিলেন মিসেস স্প্রট।
–আমার বেটি। ওঃ ভগবান, তোমার কোনো আঘাত লাগেনি।
মৃতার নিথর মুখের দিকে চোখ পড়তেই স্তিমিত হয়ে আসে তার কণ্ঠস্বর। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করেন, আমি–আমি খুন করেছি।
-এখন ওসব ভাববেন না। আপনি বেটিকে সামলান। বলল টুপেনস।
হেডক বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, তাজ্জব ব্যাপার, আমি সাহস পেতাম না। কিন্তু আনাড়ি হাতে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করলেন মিসেস স্প্রট। সত্যিই বিস্ময়কর
–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে বাচ্চাটার ক্ষতি হয়নি। বলল টুপেনস।
.
একজন অপরিচিতার মৃত্যুর ঘটনা হলেও, ঘটনাটা মৃত্যুর। হেডক পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। টানাপোড়েন বিশেষ হল না। কেবল সাক্ষী দিতে হয়েছে টমি ও টুপেনসকে।
যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও পুলিশি তৎপরতায় কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল, নিহত মহিলা একজন পোলিশ উদ্বাস্তু। নাম ভান্দা পলোনস্কা। পুনর্বাসন দপ্তরে কাজ করত সে। ধনী আত্মীয়স্বজনের অভাব নেই তার।
মৃতদেহ সনাক্ত করেছেন মিসেস ক্যালফন্ট। তিনি জানালেন, মৃতার মাথায় কিছুদিন থেকেই গোলমাল দেখা দিয়েছিল। পোলান্ডে নির্মম অত্যাচারে চোখের সামনেই সন্তানকে মরতে দেখেছে। তাতেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। তবু তাকে এখানে একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল। গত সপ্তাহে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে হঠাৎ উদ্বাস্তু শিবির থেকে পালিয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকারকে সে মন থেকে ঘৃণা করত।…
এই অনভিপ্রেত ঘটনায় মিসেস স্প্রটের স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছিল। তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তার চোখ বেয়ে দরদর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
–আমি একজনকে খুন করে ফেলেছি–কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না…এত বড়ো একটা অপরাধ আমি করে ফেললাম…বেটিকে ও পাহাড়ের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল…ওকে বাঁচাবার জন্যই…
অফিসার প্রশ্ন করলেন, আপনি কি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার জানেন?
–একদম না। খেলনা বন্দুক ছাড়া কখনও বড়ো কিছু হাতে নিইনি।
-বিস্ময়কর। নিতান্ত আনাড়ি হাতেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন আপনি। মৃতাকে চিনতেন আপনি?
-না, কোনোদিন দেখিনি আগে তাকে।
তার স্বীকারোক্তি থেকে জানা গেল, পোলিশ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি একসময় কিছু উলের জামা বুনে পাঠিয়েছিলেন। ওসব জামা থেকেই সম্ভবত পলোনস্কা মিসেস স্প্রটের নতুন ঠিকানাটা উদ্ধার করে থাকবে।
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত পুলিশি বিচারে রেহাই পেয়ে গেলেন মিসেস স্প্রট। তারপর এই নিস্তরঙ্গ ঘটনার স্মৃতি দুদিনেই সময়ের বুকে ঝাপসা হয়ে গেল।
.
ইঙ্গ-ফরাসি সম্মিলিত বাহিনী ডানক্রিক থেকে পালাতে শুরু করেছে। প্যারির পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। জার্মান বাহিনীর রণকৌশল ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে মিত্রবাহিনীর সমস্ত প্রয়াস।