–বেটি–আমার বেটি–
থেকে থেকে কঁকিয়ে উঠছেন মিসেস স্প্রট। নানাজনে নানারকম মন্তব্য করতে লাগলেন। পরামর্শের গুঞ্জনও শোনা যেতে লাগল। সহসা জোরালো গলায় বলে উঠলেন মেজর ব্লেচলি, চুপ করুন তো সকলে। ওসব ছেলেমানুষি হুমকিতে ভয় পেলে চলে না। আমরা এখুনি পুলিশে ফোন করব।
বলতে বলতে সশব্দে রিসিভার তুলে নিলেন মেজর।
ভীত বিহ্বল মিসেস স্প্রট দু-হাতে আঁকড়ে ধরে আগের মতোই বাধা দিলেন মেজরকে।
-না, টেলিফোন করবেন না, ওরা আমার মেয়েকে খুন করবে।
–বোকার মতো কথা বলবেন না, ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন মেজর, ওদের সে সাহস হবে না।
-না, আপনাকে ফোন করতে দেব না। এবারে স্বরে দৃঢ়তা প্রকাশ পেল মিসেস স্প্রটের, আমি ওর মা, পুলিশকে কিছু বলতে হয় আমি বলব।
মিসেস স্প্রটের বক্তব্য অপমানকর হলেও মেজর গায়ে মাখলেন না। মিসেস স্প্রটকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।
আপনি আপনার সন্তানের জন্য বিচলিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি, এখনই আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।
টমি পাশে দাঁড়িয়েছিল। মেজর তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মিঃ মিয়াদো আপনার মতামত কী?
টমি ঘাড় নেড়ে নীরবে মেজরকে সমর্থন জানাল।
মিঃ ক্লেও একই মতামত ব্যক্ত করলেন, ঘটনাটা পুলিশকে জানানোই কর্তব্য।
-কিন্তু না-পুলিশে জানাবেন না–ওরা বেটিকে মেরে ফেলবে।
কথা শেষ করে কাতর দৃষ্টি মেলে মিসেস ক্লে তাকালেন টুপেনসের দিকে।
পরে মেজরকে বললেন, আপনি কেবল পুরুষদেরই মতামত নিচ্ছেন, মেয়েদের কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না।
সকলের দৃষ্টি পড়ে টুপেনসের ওপরে। সে মিনমিনে গলায় বলে, মিসেস স্প্রট ঠিক কথাই বলছেন।
মুখে একথা বললেও টুপেনস বুঝতে পারছিল এই মুহূর্তে পুলিশে খবর দেওয়াই কর্তব্য।
ঘরের অন্যান্য মহিলারাও টুপেনসের বক্তব্য সমর্থন করলেন।
মিসেস পেরিনা এতক্ষণ ছিলেন না। সেই মুহূর্তে এসে সবকিছু শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মন্তব্য করলেন, পুলিশ কি করবে, সব কাজেই ওরা সমান অপদার্থ। পারেন তো নিজেরাই বাচ্চাটাকে খুঁজে বার করুন।
মিসেস পেরিনার ব্যক্তিত্বই শেষ পর্যন্ত কার্যকরী হল। বেটিকে খুঁজতে বেরোনোই সাব্যস্ত হল।
পরামর্শ চলল। টমি ও মেজর ব্লেচলির পরামর্শে স্মাগলার্স রেস্ট-এ কমাণ্ডার হেডককে খবর পাঠানো হল।
হেডকের একটা গাড়ি আছে। তার ওপর তিনি অভিজ্ঞ বলশালী মানুষ। তার সাহায্য সবদিক থেকেই কাজে লাগবে।
মিসেস স্প্রট বললেন, উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে আমিও থাকব।
.
বেটিকে খুঁজতে বেরবার জন্য তৈরি হলেন হেডক, মেজর ব্লেচলি এবং টমি। মহিলাদের মধ্যে মিসেস স্প্রটকে নিয়ে দুজন। অপরজন হল টুপেনস।
উদ্ধারকারী দলের নেতা হলেন হেডক। তারই ছোটো সাদা রং-এর গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে উঠে পড়লেন সকলে। পেছনে রইলেন মহিলারা। দলের মধ্যে একমাত্র টুপেনসই সেই বিদেশিনী মহিলাকে চেনে।
গাড়িতে ওঠার পরে আচমকা একটা ছোটো পিস্তল টমির চোখের সামনে তুলে ধরল। চমকে উঠে বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল টুপেনস।
–মেজর ব্লেচলির পিস্তল, চাপা স্বরে বললেন মিসেস স্প্রট, দরকার লাগতে পারে ভেবে ওর ঘরে ঢুকে নিয়ে এলাম।
এমন একটা অপ্রত্যাশিত সংবাদে অতিমাত্রায় বিস্মিত হল টুপেনস। অন্যের পিস্তল হাতিয়ে নিয়ে এসেছেন মহিলা এ একেবারে অকল্পনীয় ব্যাপার।
উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ ধরে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে কমাণ্ডার হেডকের গাড়ি। সোজা স্টেশনে এসে থামল। নানান জনকে জিজ্ঞেস করা হল।
বেঁটে মতন একটি লোকের কাছে কার্যকরী সংবাদ পাওয়া গেল। লোকটি নিজে থেকেই এগিয়ে এসে জানাল, আপনার একটা বাচ্চা মেয়েকে খুঁজছেন তো? কিছুক্ষণ আগে আমি তাকে দেখেছি, এরনেস ক্লিক রোডে একজন বিদেশিনী মহিলার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। বাচ্চাটার গায়ে ছিল সবুজ ফ্রক।
একেবারে নির্ভুল হদিশ। হেডক গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন সঙ্গে সঙ্গে।
-কী রোড বললেন–এরেনস ক্লিক? কোনো দিক দিয়ে গেলে সুবিধা হবে বলুন তো।
বেঁটে লোকটি বলল, রাস্তাটা শহরের বিপরীত দিকে। এসপ্লানেড ধরে পুরোনো শহর পার হয়ে যেতে হবে। পাহাড়ি পথ ধরে সোজা ওপরে
লোকটির কথা শেষ হবার আগেই গাড়ি চলতে শুরু করল।
ঝড়ের গতিতে ছুটে কিছুক্ষণে মধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গেল এরনেস ক্লিক রোডের খাড়াই পথের প্রান্তে।
খাড়াই এবং সংকীর্ণ পথ হেডকের গতি রোধ করতে পারল না। অবিশ্বাস্য দক্ষতায় তিনি গাড়িটাকে তুলে নিয়ে এলেন এই পথের মাথায়।
এর পরেই শুরু হয়েছে ঢালুপথ। তার শেষ হয়েছে হোয়াইট হেভেন বেতে।
জায়গাটা আগাছা আর ঘাসে ঢাকা হলেও এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। বড় বড় পাথরের চাই আশপাশে থাকলেও দৃষ্টি বাধা পায় না।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন ব্লেচলি। চারপাশে দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি বললেন, এই বিস্তীর্ণ এলাকায় মেয়েমানুষটাকে খুঁজে বার করা কষ্টকর হবে।
হেডক বললেন, কোনো দিকেই তো কিছু নজরে আসছে না।
গাড়িতে ফিরে গিয়ে একটা দূরবিন নিয়ে এলেন তিনি। সেটা চোখে লাগিয়ে চারপাশ জরিপ করতে শুরু করলেন।
দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একজায়গায় এসে স্থির হয়ে গেলেন। দূরে দুটো চলমান বিন্দু লেন্সে ধরা পড়ল
-ওই তো–দেখতে পেয়েছি–পরিষ্কার দেখাচ্ছে।