সুযোগ পেয়ে মিঃ ক্লে নিজেও জার্মানদের বিরুদ্ধে অনর্গল বিষোগার করতে লাগলেন।
মিসেস পেরিনার ঘরে আলোচনা যখন জমে উঠেছে, ঠিক সেই সময় মিসেস ক্লে এসে ঘরে ঢুকলেন।
বেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। তারপর পরপর কয়েক কাপ কফি খেলেন আর তার লন্ডন ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা সকলকে শোনাতে লাগলেন।
এরপর সকলে উঠে হলঘরে গিয়ে বসলেন। বেটি নিজের মনে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। একসময় সে সকলের অলক্ষে বাগানে নেমে গেল।…
রাত সাতটার আগে বেটির কথা মনে পড়ে না মিসেস স্প্রটের। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
-সর্বনাশ, বেটির ঘুমোবার সময় হয়ে এল যে, বেটি–বেটি–
সকলেই দেখেছিলেন কিছুক্ষণ আগেও বেটি আশপাশে খেলা করছে। এখন কোথায় গেল? মিসেস স্প্রট গোটা হলঘর চক্কর দিতে দিতে বেটির নাম ধরে ডাকতে থাকেন। কিন্তু বেটির কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
এবার সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বেটির অনুসন্ধানে নেমে পড়েন।
সান্স সৌচির বিভিন্ন ঘর, রান্নাঘর, বাগান–কোথাও খোঁজা বাকি থাকে না।
–বেটি-ই-ই
অস্থির হয়ে চিৎকার করে ওঠেন মিসেস স্প্রট।
কে একজন বললেন, রাস্তার দিকে যায়নি তো?
অমনি টুপেনস আর মিসেস স্প্রট ছুটে পথে নেমে এলেন।
কিন্তু এখানেও নেই বেটি। উঁচু নিচু পাহাড়ি পথের যতদূর দৃষ্টি যায়, কেউ নেই। কেবল দেখা গেল স্থানীয় একটি পরিচারিকা এগিয়ে আসছে।
মিসেস স্প্রট ও টুপেনসের জিজ্ঞাসার জবাবে মেয়েটি বলল, একটা বাচ্চা মেয়ে তো, আমি প্রায় আধঘণ্টা আগে তাকে দেখেছি। সবুজ ফ্রক পরা।
মিসেস স্প্রট সাগ্রহে জানতে চান, সে কোথায়–কোনদিকে গেছে?
মেয়েটি বলে, দেখলাম ঢালু পথ ধরে একজন মহিলার হাত ধরে হাঁটছে।
–মহিলা! মিসেস স্প্রট অস্থিরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, কেমন দেখতে তাকে?
মেয়েটি জানায়, পোশাক দেখে মনে হল বিদেশী। চেহারাও যেন কেমন।
টুপেনসের মনে পড়ল, সান্স সৌচির বাগানে সে এক মহিলাকে উঁকি মারতে দেখেছিল, তারপর তাকে আর কোথাও খুঁজে পায়নি।
কিন্তু বেটি তার সঙ্গে যাবে কেন?
মিসেস স্প্রট আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না।
-আমার বেটি। কি হবে–তাকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। সেই মেয়েমানুষটাকে কি জিপসিদের মতো দেখতে?
মেয়েটি জবাব দেবার আগেই টুপেনস বলে উঠল, তাকে জিপসিদের মতো দেখতে নয় মোটেই–সুন্দর দেখতে নীল চোখ, এক মাথা চুল।
মিসেস স্প্রট কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে টুপেনসের দিকে তাকিয়ে থাকেন। টুপেনস বলতে থাকে, আজই দুপুরে তাকে আমি বাগানের ঝোপে দেখেছি। আড়াল থেকে বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল। আগে একদিন দেখেছিলাম, কার্ল ভন দিনিমের সঙ্গে কথা বলতে। একই লোক সন্দেহ নেই।
পরিচারিকাটি বলে উঠল, আপনি যেরকম বললেন, তেমনি দেখতে তাকে। মাথাভর্তি চুল, নীল চোখ। অদ্ভুত রকম ভাষায় কথা বলছিল।
নিশ্চয় কোনো জার্মান মহিলা। ওহ–আমার বেটিকে নির্ঘাত সে খুন করবে।
–অতটুকু মেয়েকে কে খুন করবে? ধমকে ওঠে টুপেনস, আপনি শান্ত হোন। চলুন ঘরে যাওয়া যাক, পুলিশে খবর দিতে হবে এখুনি–আমরা বেটিকে ঠিক ফিরে পাব।
৩. ক্ষীণ সন্দেহ
টুপেনসের মনে ক্ষীণ সন্দেহ জেগেছিল, কার্ল ভন দিনিম বেটির অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেল ঘটনার কথা শুনে সকলের মতো সে-ও হতচকিত।
মেজর ব্লেচলি এগিয়ে এসে মিসেস স্প্রটকে বললেন, আপনি শান্ত হয়ে বসুন। এক চুমুক ব্রাণ্ডি খেয়ে চাঙা হয়ে নিন, আমি এখুনি থানার সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
মিসেস স্প্রট তাকে বাধা দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি ঘর থেকে আসছি–
কথা শেষ না করেই তিনি একছুটে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলেন। মিনিট দুই পরেই আবার তাকে সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল। লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছেন।
মেজর ব্লেচলি থানায় ফোন করবেন বলে সবে রিসিভার তুলেছিলেন। ঝড়ের বেগে ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরলেন মিসেস স্প্রট।
মেজর ব্লেচলিকে হকচকিয়ে দিয়ে এক ঝটকায় রিসিভারটা কেড়ে নিয়ে শঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ফোন করবেন না–মেজর, পুলিশকে জানাবেন না
বলতে বলতে থপ করে একটা কুশনের ওপরে বসে পড়লেন। জ্ঞান হারালেন মিসেস স্প্রট।
সকলেই অস্থির হয়ে ছুটে এলেন তার কাছে। মিনিট দুই অচৈতন্য থাকার পর সংজ্ঞা ফিরে পেলেন মিসেস স্প্রট। মিসেস ক্লে ধরাধরি করে তাকে সোজা করে বসিয়ে দেন।
মিসেস স্প্রটের চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। কাঁপা হাতে একখণ্ড কাগজ তিনি এগিয়ে ধরেন।
–বেটিকে খোঁজার সময় মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, তখন দেখার সময় পাইনি। আমার সন্দেহ হতে ছুটে গেলাম এখন। একখণ্ড পাথর মুড়ে কেউ আমার জানালা গলে ছুঁড়ে দিয়েছিল সম্ভবত, লেখাটা পড়ে দেখুন
সকলেই এগিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। টমি মিসেস ক্লের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চোখের সামনেই মেলে ধরল।
বড় বড় অক্ষরে লেখা চিরকুট। লেখার ধাঁচে বিদেশী ছাপ স্পষ্ট।
আপনার শিশুটি আমাদের কাছে নিরাপদেই থাকবে। অযথা পুলিশের কাছে গিয়ে আপনার সন্তানের প্রাণ বিপন্ন করবেন না। গোপনীয়তা রক্ষা করবেন। পরে আমাদের নির্দেশ পাবেন, সেই মতো কাজ করবেন। অন্যথা করলে শিশুটি খুন হবে। ধন্যবাদ
চিঠির নিচে কোনো স্বাক্ষর নেই। কেবল আড়াআড়ি দুটো হাড়ের ওপর মানুষের খুলির ছবি আঁকা।