ইতিমধ্যেই বেটির আধোআধো কথা অনেকটাই সড়গড় হয়েছে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে।
বেটিকে নিয়ে মিসেস স্প্রটের ঘরে ঢোকে টুপেনস। একটা একটা করে ছবির বই দেখায়। কিন্তু পুরোনো বই একদম পছন্দ করে না বেটি। নোংরা বই বলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
মিসেস ওরুরকি নিজের ঘর ছেড়ে একদম বেরোন না। লাঞ্চের পর বেটিকে ঘুম পাড়িয়ে উঠতেই মিসেস ওরুরকির ডাক পেল টুপেনস।
ভদ্রমহিলা তার ঘরে নাতি-নাতনি আত্মীয়-স্বজনের একরাশ ছবি টেবিলে ছড়িয়ে নিয়ে বসেছিলেন।
ঘরে ঢুকে কুশল বিনিময়ের স্বরে টুপেনস একথা-সেকথায় কিছু সময় কাটাল। তারপরেই আচমকা একটা প্রশ্ন শুনে প্রবলভাবে চমকে উঠল।
–এবারে বলুন, মিসেস ব্লেনকিনসপ, সান্স সৌচি সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
চোখ তুলে তাকাল টুপেনস। কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটার জবাব দেবে ভেবে পেল না।
মিসেস ওরুরকি নিজেই তাকে সঙ্কটমুক্ত করলেন। বলে উঠলেন, আমি জানতে চাইছি, এখানে খারাপ কিছু আপনার নজরে পড়েছে?
এবারে একটা সূত্র পেয়ে গেল জবাব দেবার। তাই টুপেনস বলল, খারাপ কিছু? তেমন কিছুর আভাস তো পাইনি।
–মিসেস পেরিনা সম্পর্কে নয়? ওর সম্পর্কে আপনার কৌতূহল আমি লক্ষ্য করেছি। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি তাকে সর্বদা অনুসরণ করেন।
সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল টুপেনসের। এমনভাবে ধরা পড়ে যাবে আগে ভাবতে পারেনি। কোনোরকমে সামলে নিয়ে ইতস্তত করে বলল, উনি এক বিচিত্র মহিলা।
-বিচিত্র মোটেই নন, বললেন মিসেস ওরুরকি, আপাতদৃষ্টিতে নেহাত সাধারণ মহিলা বলেই মনে হবে। কিন্তু আমার ধারণা তিনি তা নন। আপনার ধারণা কী?
-আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন আমি ধরতে পারছি না। বলল টুপেনস।
-এ বাড়ির প্রতিটি মানুষকে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নজর করেছি–সবই রহস্যময় চরিত্র। মিয়াদোকে খেয়াল করেছেন কখনও।
সাদামাটা এক ইংরেজ ভদ্রলোক বলেই মনে হবে। কিন্তু মাঝে মাঝে তার কথায় অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ধরা পড়ে। ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয় না আপনার?
-ঠিকই বলেছেন, বলে উঠল টুপেনস, ভদ্রলোক এক অদ্ভুত মানুষ।
–অদ্ভুত একা তিনিই নন, সকলেই। টুপেনসের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসতে লাগলেন মিসেস ওরুকি।
একটা দুর্বোধ্য অসহায়তা ক্রমশ গ্রাস করছিল টুপেনসকে। মিসেস ওরুরকির মুখের দিকে তাকাতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল।
ধীর পায়ে সে জানালার দিকে সরে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার।
জানালাপথে নিচের বাগানে তাকাল টুপেনস। খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছের পাতার জল ঝরছে টুপটাপ শব্দে।
হঠাৎ দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় টুপেনসের। একটা মুখ–সেই বিদেশিনী মহিলার, যে গতকাল রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দিনিমের সঙ্গে কথা বলছিল।
…সহসা একদিকের ঝোপ সরিয়ে এই বাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি মারছে।
টুপেনসের সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, সান্স সৌচির একটা জানালার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে কিছু দেখার প্রত্যাশা করছে। নিষ্পলক দুটি চোখে যেন আকুতি মাখানো, মনে হল টুপেনসের।
চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে মিসেস ওরুরকির দিকে তাকাল। অস্ফুট স্বরে কিছু বলবার চেষ্টা করল।
পরক্ষণেই ক্ষিপ্রবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বারান্দা পার হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ির ধাপ ডিঙিয়ে নিচে নেমে এলো।
ঝড়ের বেগে হলঘর পার হয়ে বৃষ্টিভেজা বাগানে নেমে থামল।
একমুহূর্তের বিরতি নিল। আবার ছুটল বাগানের সেই কোণের দিকে, যেখানে সেই বিদেশিনীকে কিছুক্ষণ আগে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।
কিন্তু কাউকে পেল না টুপেনস। কোথাও নেই সেই মহিলা। এপাশ-ওপাশ ঘুরে খুঁজল সে-কিন্তু আশ্চর্য, ভোজবাজির মতো যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে সেই মূর্তি।
টুপেনস দৌড়ে বাগান পার হয়ে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত ছুটে গেল। কিন্তু জনহীন উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো মানুষের ছায়া পড়ল না।
কোথাও নেই সেই বিদেশিনী মূর্তি। কিন্তু টুপেনসের তো দেখায় কোনো ভুল ছিল না। কোনো মতেই না। স্পষ্ট দেখেছে সেই মুখ। কিন্তু পলকের মধ্যে এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে?
হতাশ বিভ্রান্ত টুপেনস সান্স সৌচির দিকে ফিরে চলল।
টুপেন্সের বুকে সন্দেহ আর ভয় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে ঘুণাক্ষরেও যদি সে জানতে পেত, কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাড়িতে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটতে চলেছে।
কিন্তু জানার উপায় ছিল না তার, কারুরই তা ছিল না।
সমস্যা পাকিয়ে উঠেছে বেটি, স্প্রটকে নিয়ে।
ক্লে দম্পতি অভিযোগ তুলেছেন তার বিরুদ্ধে।
আর তা নিয়ে আলোচনার জন্য সান্স সৌচির বাসিন্দারা মিলিত হয়েছেন মিসেস পেরিনার ঘরে।
মিঃ ক্লে অসুস্থ মানুষ।কিছুতেই ঘুম আসে না চোখে। কখনও সখনো যদি বা একটু ঝিমুনি আসে তা ভেঙ্গে যায় বেটির দাপাদাপিতে।
ছোট্ট বেটির বিরুদ্ধে মিঃ ক্লের এই অভিযোগের জবাবে মিসেস ব্লেনকিনসপ বললেন, ছোট্ট বেটির এখন তিন বছর বয়স পার হয়নি। ওরকম একটা শিশুর বিরুদ্ধে হইচই করে ঘুম নষ্ট করার অভিযোগ হাস্যকর বললেও কমই বলা হয়।
মিষ্টি মেয়েটা আছে বলে সান্স সৌচি আমাদের সকলের কাছেই আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
টুপেনসের ওই জবাবেই আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। সকলেই মূল বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যুদ্ধের বিষয় নিয়েই কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন।