দিনিমের উত্তেজিত মমর্যাতনাক্লিষ্ট রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। সে তার হাত চেপে ধরে বলে, আপনি শান্ত হোন। ধৈর্য ধরুন। এরকম মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নেবেন না। দোহাই।
-ইংরেজের জেলখানায় থাকলে তবুও অনেকটা স্বস্তি পাব আমি। পুলিশ আমাকে কয়েদ করলে খুশি হব।
–আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছেন, তার কথা ভাবুন–বাকি সব কিছু তার কাছে তুচ্ছ। আমি শুনেছি, বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার উপায় খোঁজার জন্য আপনি গবেষণা করছেন। এ তো কেবল ইংলন্ডের নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণকর এই কাজ।
টুপেনসের কথায় দিনিমের উত্তেজনা যেন অনেকটাই প্রশমিত হয়। তার চোখের তারা বাঁকা হয়ে ঘুরে যায়।
-হ্যাঁ, ইতিমধ্যেই অনেকটা সাফল্য অর্জন করেছি গবেষণায়। জিনিসটা প্রস্তুত করা এমন কিছু কঠিন হবে না, ব্যবহারও করা চলবে সহজে।
-তাহলে, ভাবুন তো একবার, কতবড় মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন আপনি। তাই বলি, শান্ত হোন। আমি নিজে জার্মান বিরোধী। তবু বলছি, এমন অনেক দয়ালু জার্মানকে আমি জানি, যাদের শ্রদ্ধা না করে আমি পারি না।
এখানে যেমন আমি রয়েছি, তেমনি মেজর ব্রেচলির মতো মানুষরাও রয়েছে। জার্মানিতেও তাই। এদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
কার্ল ভন দিনিম মাথা ঝুঁকিয়ে টুপেনসের হস্ত চুম্বন করে। বলে, আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাব…আপনার কথা বড়ো সুন্দর…আমি মনে অনেক জোর পেলাম।
টুপেনস বিদায় নিয়ে পথে এসে নামে। চলতে চলতে ভাবতে থাকে দিনিম এমন কর্তব্যপরায়ণ ও সৎ হওয়া সত্ত্বেও কেবল জার্মান পরিচয়ের জন্য কী নিদারুণ মর্ম নিপীড়ন সহ্য করছে। আরও দুর্ভাগ্য যে এখানে এই মানুষটাকেই সে সবচেয়ে পছন্দ করে।
.
কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবুও লন্ডনের একটা টিকিট না কেটে পারল না টুপেনস। লিহাম্পটনে থাকলে কখনও কারও চোখে পড়ে যেতে পারে।
সান্স সৌচির বাসিন্দাদের কে কখন কোথায় থাকে বলা যায় না। তাহলে তার গোটা পরিকল্পনাটাই ভণ্ডুল হবে।
টুপেনসের আশঙ্কাটা অচিরেই সত্য প্রমাণিত হল। শীলার সঙ্গে প্লাটফর্মে দেখা হয়ে গেল। একটা পার্শেলের খোঁজে নাকি বুকিং-এ এসেছিল, জানাল সে।
ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল টুপেনস। দেখতে পেল শীলা প্লাটফর্ম থেকে নেমে যাচ্ছে।
মেয়েটা এ সময় হঠাৎ করে স্টেশনে আসতে গেল কেন? সে কি তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে? না কি তাকে কেউ পাঠিয়েছিল, টুপেনস সত্যি সত্যি লন্ডনে যাচ্ছে কিনা দেখবার জন্য? এ-কাজ মিসেস পেরিনারই হওয়া সম্ভব।
.
সান্স সৌচির আওতার বাইরে নিরিবিলিতে দু-জনে পরদিন দেখা করল। টুপেনস বলল, আমার ঘরে কাকে ঢুকতে দেখেছিলে তুমি?
টমি হেসে উঠল। বলল, প্রথমে দেখলাম সেই ছোট্ট মেয়ে বেটিকে-হাতে একটা উলের গোলা।
তার পরে?
–কার্ল ভন দিনিম।
–সত্যি? চমকে উঠল টুপেনস, কখন ঢুকেছিল?
লাঞ্চের সময়। ডাইনিং রুম থেকে সবার আগে ওপরে উঠে আসে। দেখলাম চুপচাপ তোমার ঘরে ঢুকে গেল। প্রায় মিনিট পনেরো ভেতরে ছিল।
টুপেনস চিন্তিতভাবে ঠোঁট কামড়ে ধরল। যুবক দিনিম যে একজন দক্ষ অভিনেতা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার ঘরে ঢোকার কোনো কারণ তো কার্লের নেই।
স্বদেশভূমি জার্মানির জন্যই দিনিমের এই গুপ্তচরবৃত্তি। নিঃসন্দেহে সে স্বদেশপ্রেমিক। সম্মানের যোগ্য। কিন্তু সে বিপজ্জনকও বটে। আর সেকারণেই তাকে ধ্বংস করা দরকার।
–খুবই দুঃখের ব্যাপার। চাপাস্বরে বলল টুপেনস। কিন্তু জার্মানিতে থাকলে আমরাও এ কাজই করতাম।
–যথার্থ বলেছ। স্বীকার করল টমি।
-যাইহোক, একটা দিকে পরিষ্কার হওয়া গেল, বলল টুপেনস, মিসেস পেরিনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দিনিম আর শীলা কাজ করে চলেছে।
নেতৃত্বে রয়েছে মিসেস পেরিনা। আরও একজন আছে–এক অপরিচিতা বিদেশিনী মহিলা মাঝে মাঝে নিঃশব্দে এখানে আসে। তার সঙ্গে দিনিমকে কথা বলতে দেখেছি আমি।
-তাহলে এখন কি ভাবে এগুতে হবে বল।
-এখন আমাদের লক্ষ মিসেস পেরিনা। সুযোগ বুঝে তার ঘরে ঢুকতে হবে। নথিপত্র যদি কিছু পাওয়া যায়। তাছাড়া তার গতিবিধির ওপরেও কড়া নজর রাখা দরকার। আর যে মহিলার কথা বললাম, তিনি পোলিশ, তাকেও খুঁজে বার করতে হবে।
এই মিশনের সঙ্গে যোগাযোগটা সেই রাখছে মনে হচ্ছে। গোটা দলটাকেই তাহলে বাগে পাওয়া যাবে।
–ঠিক বলেছ। আবার কখন আসে নজর রাখতে হবে। গোপনে পেছন নিয়ে আস্তানাটা দেখে আসতে হবে।
জার্মান যুবক দিনিমের ঘরেও একবার হানা দেওয়া দরকার মনে হয়। বলল টুপেনস।
–তার ঘরে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ভালোভাবেই জানে যে কোনো মুহূর্তে পুলিশের নজর তার ওপরে পড়তে পারে। কাজেই হাতের কাছে কোনো প্রমাণ ফেলে রাখবে না। মিসেস পেরিনার ঘরে ঢোকাও কষ্টকর হবে।
-কেন?
–তারা মা মেয়ে খুবই সতর্ক। মিসেস পেরিনা যখন থাকেন না, তখন শীলা থাকে। তারপর বেটি তো সারাক্ষণই গোটা বারান্দায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তার পেছনে থাকে মিসেস স্প্রট।
লাঞ্চের সময়েই সুযোগটা নিতে হবে। বলে টুপেনস।
–দিনিমের ঘরেও?
-হ্যাঁ। চুপি চুপি ওপরে উঠে আসব। পরে নেমে গিয়ে বলব, তীব্র মাথা যন্ত্রণায় অসহ্য হয়ে উঠে গিয়েছিলাম।
–তাহলে আর রোগ ধরে রাখি কেন? সারিয়ে তোলাই ভালো–কাজ তো মিটে গেল।