হেসে উঠল টুপেনস।
-দেখুন কেমন মজা করছে। আপনি ভাববেন না মিসেস ট–ওতে কিছু হবে না। চুপচাপ ছিল বলে আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম।
ওর চুপ করে থাকাটাই তো ভয়ের। কখন কি করে বসবে–আমি আজই আপনার জন্য কিছু উল কিনে আনব।
–আপনি ব্যস্ত হবেন না, মিসেস স্প্রট, ওগুলো শুকিয়ে নিলেই হবে।
বেটিকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মিসেস স্প্রট।
.
-এর মধ্যেই আছে?
টুপেনসের বাড়িয়ে দেওয়া প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সতর্কস্বরে বলে উঠল টমি।
–হ্যাঁ, সাবধানে ধর। নিজের গায়ে ঢেলে দিয়ো না আবার।
প্যাকেটটা নাকের কাছে এগিয়ে নিয়ে চোখ কুঁচকে বলল টমি–ভয়ঙ্কর পচা গন্ধ-বস্তুটা কী?
–পচা হিং।
টুপেনসের কাছ থেকে টমি প্যাকেটটা নেবার পর সান্স সৌচিতে পর পর কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল।
প্রথম ঘটনা মিঃ মিয়াদোর ঘর বদল।
বেচারা নিতান্তই শান্তশিষ্ট মানুষ। অকারণে অভিযোগ তোলার মতো স্বভাব নয় তার। কিন্তু তীব্র গন্ধে টিকতে না পেরে মিসেস পেরিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
মিঃ মিয়াদোর ঘরে উগ্র কটু গন্ধটা অস্বীকার করতে পারলেন না মিসেস পেরিনা। গ্যাসের লাইন লিক হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা হল। কিন্তু কোনো গোলমাল ধরা পড়ল না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত করা হল, ঘরে কোথাও নেংটি ইঁদুর মরে পচে আছে।
টমি বলল, এই ঘরে রাত্রে শোওয়া অসম্ভব। বিকল্প একটা ঘরের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।
মিসেস পেরিনা বললেন, একটা ঘর আছে বটে তবে সেটা এমন ভোলামেলা নয়। মিঃ মিয়াদো সম্মত হলে সেটা খুলে দিতে পারেন।
মিঃ মিয়াদো আপত্তি করলেন না। গন্ধের হাত থেকে মুক্তি পেতে উদগ্রীব তিনি। তার জন্য যে ঘরটি বন্দোবস্ত করা হল তার মুখোমুখিই রয়েছে মিসেস ব্লেনকিনসপের ঘর।
প্রথম ঘটনার সূত্রেই দ্বিতীয় ঘটনার উদ্ভব।
মিঃ মিয়াদো তার নতুন ঘরে আশ্রয় নেবার পরেই চোখ নাক ও গলার রোগে আক্রান্ত হলেন। চোখ নাক থেকে অনর্গল জল গড়াচ্ছে।
আকস্মিক আক্রমণটা অতি দ্রুত তীব্র হয়ে উঠল এবং মিঃ মিয়াদো রীতিমত শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। প্রাতঃরাশ সারবার জন্য নিচে যাবার ক্ষমতা রইল না তার।
সেদিন সকালেই মিসেস ব্লেনকিনসপ তার ছেলে ডগলাসের কাছ থেকে চিঠি পেলেন। রীতিমত হৈচৈ জুড়ে দিল টুপেনস–সবাই জেনে গেল সৈনিক ছেলের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি পেয়েছেন মিসেস ব্লেনকিনসপ।
এবারে চিঠিটা সামরিক বিভাগের নজরে পড়েনি–সেন্সরড হয়নি–সেকারণেই চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ।
ডগলাসের এক বন্ধু ছুটিতে এসেছে, সেই চিঠিখানা হাতে করে নিয়ে এসেছে। এইবারেই প্রথম সরাসরি মাকে নিজের কথা বলার সুযোগ পেয়েছে ডগলাস।
টুপেনস গলার স্বর চড়িয়ে ঘোষণা করল, এই চিঠিটা পড়েই বুঝতে পারছি, যা ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে আমরা কত কম জানি।
প্রাতরাশের টেবিলে এইভাবে হৈচৈ বাঁধানোর পরে নিজের ঘরে এসে জাপানি বাক্সটার ভেতরে চিঠিটা রেখে দিল টুপেনস। তারপর চিঠির ভাঁজের ওপরে ছড়িয়ে দিল অদৃশ্য রাসায়নিক গুড়ো।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুখে টুপেনস শুনতে পেল মিঃ মিয়াদোর ঘর থেকে তার কাশি ও গোঙানি শোনা যাচ্ছে।
চকিতে তার মুখে হাসির রেখা খেলে যায়। কোনো দিকে নজর না দিয়ে সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।
সকলকে আগেই সে শুনিয়ে রেখেছে তার উকিলের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সে এ বেলা লন্ডন যাচ্ছে। সেই সুবাদে সান্স সৌচির বাসিন্দাদের অনেকেই কিছু কেনাকাটার দায়িত্ব দিয়েছে তাকে। অবশ্য টুপেনস গেয়ে রেখেছে, তার দরকারি কাজ সেরে সময় পেলেই ওসব করবে সে।
মিসেস স্প্রট বিদায় জানাল টুপেনসকে। ছোট্ট বেটির গাল টিপে আদর করল সে। বলল, ছোট্ট সোনা, তোমার জন্য লন্ডন থেকে রঙিন চকখড়ি নিয়ে আসব।
বাগান পার হয়ে রাস্তার দিকে যেতে গিয়ে আচমকা মোড় ঘুরে টুপেনস বাগানের কোণে চলে এলো। ওখানে কার্ল ভন দিনিম পাঁচিলে হেলান দিয়ে আপন মনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে মৃদু উত্তেজনার ছায়া।
টুপেনস কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, এখানে একা, কি ব্যাপার? কিছু ঘটেছে?
ক্ষোভে ফেটে পড়ল দিনিম, কী আবার, যা ঘটবার তাই ঘটছে।
টুপেনস তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তুলে ধরে।
-ওসব নিন্দা কটুক্তি আর সহ্য করতে পারছি না, বলল দিনিম, সব কিছুরই এবার একটা হেস্তনেস্ত করব।
হয়েছে কী বলবেন তো।
-এতগুলো মানুষের মধ্যে কেবল যা আপনিই আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করেন। আপনি হয়তো আমার মর্মর্যাতনা কিছুটা বুঝতে পারেন…দেশে আমার ঠাই হয়নি-নাৎসীদের অন্যায় নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেছিলাম বলে দেশত্যাগী হতে হয়েছে। নাৎসী জার্মানিকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি।
ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে পারব বলে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে জার্মান পরিচয়টাকেই সকলে বড়ো করে দেখছে।
–হ্যাঁ, আপনার অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারি। সহানুভূতির স্বরে বলল টুপেনস।
–সামান্য অসুবিধা আমি মানিয়ে নিতে জানি। কিন্তু ওখানেই তো শেষ হচ্ছে না। আমি একজন জার্মান–আপনার কাছে আমি স্বীকার করেছি। খবরের কাগজে যখন চোখে পড়ে জার্মান সৈন্যরা অকাতরে দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছে, একটার পর একটা জার্মান প্লেন গুলিবিদ্ধ হচ্ছে, শহরের পর শহর বোমা বিধ্বস্ত হচ্ছে–মনের অবস্থা কেমন হয় বলুন। তার ওপর যখন ওই বুড়ো মেজর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জার্মান উদ্বাস্তুদের উদ্দেশ্যে গালাগালি ছুঁড়তে থাকেন আমি পাগল হয়ে যাই। বিশ্বাস করুন, আমি সইতে পারছি না–এসবের সমূহ অবসান আমি চাই।