-তা থাক না, চড়া গলায় বলল টুপেনস, আমি তো কাউকে কিছু বলি না। ভাববেন না আমি অসাবধানী।
-তাহলেও এটা ঠিক নয়। এসবের জন্য কোনোদিন দেখবেন আপনার ছেলেই বিপদে পড়ে গেছে।
-না, তা হবে না। আমি তার মা, আমার সন্তান কখন কোথায় আছে তা জানার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে।
–হ্যাঁ, আপনার দাবি আমি সমর্থন করছি, বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন মিসেস ওরুরকি, আপনার কাছ থেকে খবর বার করে নেওয়া কারো সাধ্য হবে না তা আমরা জানি।
–কিন্তু ওই চিঠি তো বেহাত হতে পারে। ব্লেচলি বলার চেষ্টা করলেন।
–অসাবধানে চিঠি ফেলে রাখলে তো বেহাত হবে, বলল টুপেনস, এগুলো সব সময়েই তালাবন্ধ অবস্থায় রাখি।
মেজর ব্লেচলি তবুও গজগজ করতে থাকেন।
.
টুপেনসের কাজ চলছে চক্রবৎ। চিঠি পড়ছে, নিজে চিঠি লিখছে, তারপর সেগুলো গোয়েন্দা দপ্তরের সংগৃহীত বিদেশী খামে ভরে সান্স সৌচির ঠিকানায় পোস্ট করা–আবার চিঠি পড়া…
সেই চক্রবৎ নিয়মেই একটা চিঠি ডাকঘরে ফেলে দিয়ে হালকা মনে সান্স সৌচিতে ফিরছে টুপেনস।
গেটের কাছাকাছি এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অদূরে দাঁড়িয়ে মূর্তি-কার্ল ভন দিনিম আর সেই মধ্যবয়স্কা মহিলা
এক মিনিট দাঁড়িয়ে তাদের নিরীক্ষণ করল টুপেনস। দিনিম ঘাড় ঘোরালে…টুপেনসের ওপর দৃষ্টি পড়তেই দুই মূর্তি সরে দাঁড়াল।
অপরিচিত মহিলাটি ক্ষিপ্রগতিতে রাস্তায় নেমে অন্য পাড় ধরে টুপেনসকে অতিক্রম করে চলে গেল।
টুপেনস তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারল না।
দিনিম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মোলায়েম স্বরে বলল, সুপ্রভাত।
-ওই মাঝবয়সি মহিলাটিকে, আপনি যে কথা বলছিলেন? টুপেনস সরাসরি জানতে চাইল।
-উনি একজন পোলিশ মহিলা।
–আপনার বান্ধবী?
কঠিন স্বরে জবাব দিল দিনিম, না, না, বান্ধবী কেন, এর আগে তাকে কখনও দেখিনি।
–তাই বুঝি।
–ভদ্রমহিলা এ জায়গা সম্বন্ধে জানতে চাইছিলেন।
পথ ভুল করেছিলেন বোধ হয়? সতর্ক কণ্ঠে প্রশ্ন করল টুপেনস।
-না, উনি জানতে চাইছিলেন মিসেস গেটানির নামে কাউকে চিনি কিনা।
–ও। টুপেনস গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। কিন্তু চোখের কোণে দিনিমের মুখভাব দেখে নিল।
দু-জনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। টুপেনসের মাথায় ঘুরছে দুটি নাম–মিঃ রোসেনস্টাইন …মিসেস গেটানির…নামের রহস্যময়তা।
কিন্তু মহিলা কি দিনিমের কাছেই আসে? না অন্য কোনো উদ্দেশ্য?
টুপেনস ভাবতে থাকে, শীলাকে বলতে শুনেছিল–খুব সাবধানে থেকো। এরা দুজন নাৎসী এজেন্ট নয় তো? কিন্তু টমি বলেছিল শীলা জার্মান স্পাই নয়। সে তত ভুলও করতে পারে।
টুপেনস তার সামনে সন্দেহভাজন তিনজনকে দেখতে পাছে–কার্ল, শীলা আর মিসেস পেরিনা। এদের সম্পর্কে আরও বেশি সজাগ থাকবে সে।
.
সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়েছে অনেকক্ষণ। ইতিমধ্যেই অনেকে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছে। টুপেনসও তার ঘরের দরজা বন্ধ করে একটি বিশেষ পরীক্ষার কাজে রত হল।
ড্রয়ার টেনে ছোট্ট একটা জাপানি বাক্স বের করে আনল। বাক্সের গায়ে পলকা তালা ঝুলছে। তালা সরিয়ে বাক্স খুলতেই ভেতরে দেখা গেল একগুচ্ছ চিঠি বাণ্ডিল করা।
ওপরের চিঠিটা আজই সকালে এসেছে। টুপেনস সতর্কভাবে চিঠির ভাজ খুলল।
তার চোখের দৃষ্টি ঝলসে উঠল…ঠোঁটের কোণে দেখা দিল বাঁকা হাসি। সকালে এই চিঠির ওপরেই চোখের ভুরু থেকে একটা চুল ছিঁড়ে আটকে রেখেছিল, সেই চুলটা এখন অদৃশ্য।
বাক্সটা হাতে করে হাত ধোবার বেসিনের কাছে এগিয়ে যায় টুপেনস। Grey powder রাখা আছে একটা বোতলে। সামান্য পরিমাণ পাউডার চিঠির ওপর ঢেলে দিল। কিছুটা ছড়িয়ে দিল জাপানি বাক্সটার ওপর।
বস্তুটার রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে টুপেনস আশ্বস্ত হল-চিঠি বা বাক্স কোথাও কোনো আঙুলের ছাপের চিহ্ন নেই। এই বাক্স থেকে যে চিঠিটা নাড়াচাড়া করেছে সে অতিশয় সাবধানী–হাতে গ্লাভস ব্যবহার করেছে।
টুপেনস ভাবনায় পড়ল লোকটি কে হতে পারে? মিসেস পেরিনা নয় তো? না কি শীলা? অন্য কেউও হতে পারে, যার সন্ধান এখনও সে জানে না। পুরুষ বা মহিলা যে কেউ একজন যে চিঠিগুলো নাড়াচাড়া করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
উদ্দেশ্য?
ব্রিটিশবাহিনীর গতিবিধির হদিস জানা।
.
দুপুরে নিজের বিছানায় শুয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে আছে টুপেনস। এমন সময় টলমল পায়ে ঘরে ঢুকল ছোট্ট বেটি। টুপেনসকে খুব পছন্দ মেয়েটির। তাকে দেখলেই তার উচ্ছ্বাস বেড়ে ওঠে।
ঘরময় ঘুরে বেড়াতে থাকে বেটি–এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে থাকে।
টুপেনস মাথা ঝুঁকিয়ে ছড়া কাটতে থাকে–
ওরে বোকা চললে কোথা
সর ওপাশে সর–
উঁচু নিচু ধাপ পেরিয়ে।
ঢুকলে রানির ঘর।
ছড়া শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল বেটি। টুপেনস তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আবোলতাবোল বকল। তারপর আবার নিজের চিন্তায় ডুবে গেল।
বোর্ডিং হাউসে অনেক মুখ। কিন্তু কোনো মুখ সনাক্ত করতে পারছে না সে। কে হতে পারে? যেই হোক, তাকে আবার ঘরের ভেতরে টেনে আনার ফঁদ পাততে হবে। কিছু বুঝতে দেওয়া চলবে না।
টুপেনসের চিন্তায় ছেদ পড়ল-মিসেস ম্প্রট হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন।
–বেটি এখানে–ওমা…দেখ কি শুরু করেছে–কখন বেরিয়ে এসেছে একদম টের পাইনি। মিসেস ব্লেনকিনসপ, দেখুন কি সর্বনাশ করেছে–ছিঃ ছিঃ…আমি ভীষণ দুঃখিত।
টুপেনস উঠে বসল। বেটির কীর্তি চোখে পড়ল তার। উল লেস সব এক জায়গায় করে একটা জলের পাত্রে ফেলে ঘোরাচ্ছে আর নিজের মনে হাসছে।