সহসা অজানা এক আশঙ্কা ভর করল টুপেনসকে। তার মনে হল, মিসেস পেরিনার মুখে হিংস্র হাসি, তিনি যেন লোলুপ থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন তার দিকে।
সিঁড়ির বাঁকের মুখেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল মিসেস ওরুরকির সঙ্গে। তার চোখেও যেন শিকারি বেড়ালের চাউনি।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল টুপেনস। সে তার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় পরিবেশটাকে বুঝে নেবার চেষ্টা করল। সত্যিই কি সে কোনো ফঁদে পড়েছে?
মিসেস ওরুরকি পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল টুপেনস। সে তার ভয় পাওয়ার কারণটা বুঝতে পারল। ফোনে আড়িপাতা সামাজিক অপরাধের মধ্যে গণ্য।
সেই কাজটা করেই মানসিক ভীতির শিকার হয়েছে সে।
তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বোর্ডিংহাউসের নির্জন পরিবেশ।
নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ওপরে উঠতে লাগল সে।
টেলিফোনে শোনা সংক্ষিপ্ত কথাগুলো কানের উপর ভাসছে এখনও-সবকিছুই ঠিক ঠিক আছে। ব্যবস্থা অনুযায়ী চার নম্বরে…
শব্দগুলো যদি কোনো অর্থবহন করে থাকে তবে তা টুপেনসের কাছে একেবারেই অপরিচিত।
চার নম্বর…এর অর্থ কী? তারিখ না মাস…কি বোঝাতে পারে? ল্যাম্পপোস্ট বা চার নম্বর ব্রিজ-এরকম তাৎপর্য হওয়াও অসম্ভব নয়। টুপেনসের মনে পড়ল, ওই ব্রিজটা জার্মানরা একবার উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে এসে ঢুকল টুপেনস।
স্মাগলার্স রেস্ট-অদ্ভুত নাম। নামের মধ্যেই যেন অপরাধের গন্ধ লুকনো। এই বাড়িতেই কমাণ্ডার হেডকের বাস।
এটা অবশ্য ঠিক, ভৌগোলিক দিক থেকে বাড়িটির অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হেডকের বাড়িতে মদের আসরে এসেছে টমি। ঘুরে ঘুরে বাড়িটা তাকে দেখালেন হেডক।
এই বাড়ির ইতিহাসটাও চমকপ্রদ। হান নামে এক জার্মান স্পাই বাড়িটার মালিক ছিল। বছর চারেক আগের কথা–হেডক সেই সময় লিহাম্পটনের একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
হানের বাড়িতে তার বিদেশী বন্ধুদের ভিড় লেগে থাকত সারাক্ষণ। হেডকের সন্দেহ হয়। এরা সকলেই গুপ্তচর। যথারীতি তিনি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তার কথার গুরুত্ব দেয়নি।
পরে যখন তাদের টনক নড়ল, তখন আর করার কিছু ছিল না। পাখি পালিয়েছে। অনুসন্ধান করে ওই বাড়িতে পাওয়া গেল ট্রান্সমিটার আর সংযোগরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি।
হেডকের মুখে বাড়ির ইতিহাস শুনতে শুনতে টমি লক্ষ্য করল, এ বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের সমুদ্রে অনায়াসে সার্চ লাইটের সংকেত পাঠানো যায়। বাড়ির মুখ সমুদ্রের দিকে পেছন থেকে কেউই কিছু টের পাবে না।
জার্মানরা বেছে বেছে বেশ নিরাপদ একটি জায়গা বেছে নিয়েছিল।
লিহাম্পটনের নির্ভুল পরিচয় জানতে পেরেছিলেন প্রয়াত মিঃ ফারকুয়ার–ভাবল টমি। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি নির্দিষ্টভাবে এই বাড়ির নাম উল্লেখ না করে সান্স সৌচির কথা বললেন কেন?
…জার্মান গুপ্তচরদের এই ঘাঁটিটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন কমাণ্ডার হেডক। কিন্তু শত্রুপক্ষের অন্য কোনো আস্তানা কি আশপাশে নেই? হয়তো সান্স সৌচিই সেই ডেরা।
জার্মান স্পাইদের কার্যকলাপ ধরাপড়ার পরে চার বছর আগে ঠিক কাছাকাছি সময়েই লন্ডন থেকে এসে মিসেস পেরিনা বাড়িটি কিনে নেন। এই ঘটনা কি একেবারেই তাৎপর্যহীন?
লিহাম্পটন যথার্থই একটি অরক্ষিত এলাকা। এর পেছনে রয়েছে বিস্তৃত ঘাসের মাঠ। শত্রুসেনা অনায়াসে সেখানে ঘাঁটি গাড়তে পারে।
টমি সজাগ হয়ে ওঠে–মিসেস পেরিনা সম্পর্কে সে নতুন করে আগ্রহ বোধ করে।
.
বিদেশী পাতলা কাগজের চিঠিটা সকলকে শুনিয়েই পড়তে শুরু করেছে টুপেনস তথা মিসেস ব্লেনকিনসপ।
আসলে বিশেষ ব্যবস্থায় আসা এটা একটা নকল চিঠি। তার পেছনে রয়েছে বিচক্ষণ সরকারি গোয়েন্দা মিঃ গ্রান্টের পরিকল্পনা।
টুপেনসের সঙ্গে তার মাঝে মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ হয়–সে মিঃ গ্রান্টকে মিঃ ফেরাডে নামে সম্বোধন করে থাকে।
সামরিক বিভাগ থেকে সেন্সরড হয়ে আসা চিঠিটা পড়তে থাকে টুপেনস—
প্রিয় মা,
মিশরে আমরা তাকে নিয়ে বেশ জমে গেছি। চারদিকের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সবকিছুই গোপনীয়–তিনি কিছুই বলতে চাইছেন না। দারুণ একটা পরিকল্পনা রয়েছে সামনে–চমকে দেবার মতো কিছু কাজ আমার জন্যও রাখা হয়েছে…জেনে ভালোই লাগছে… কোথায় চলেছি…
টুপেনসকে বাধা দিলেন মেজর ব্লেচলি। অসহিষ্ণু কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, আপনার ছেলের চিঠি হতে পারে, কিন্তু এসব কথা লিখে জানাবার তার কোনো অধিকার নেই।
ব্রেকফাস্টের টেবিলে সকলেই সমবেত হয়েছেন। এই সুযোগটাই কাজে লাগাবার উদ্দেশ্য নিয়ে চিঠি পড়া আরম্ভ করেছিল টুপেনস।
বাধা পেয়ে বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণায় দেখা দিল তার। পলকে চারপাশটা দেখে নিয়ে বুঝতে পারল, সকলেরই মনোযোগ তার দিকে।
–আমাদের মা-ছেলের চিঠির মধ্যে একটা বিশেষ কৌশল থাকে, গম্ভীর স্বরে বলল টুপেনস, কিছু সংকেতের রহস্য কেবল আমরা দুজনই জানি।
আমি এখন নির্ভুল বলে দিতে পারি তারা কোথায় আছে..কী করতে চলেছে…কিন্তু এই চিঠি পড়ে সেসব বোঝার সাধ্য আর কারো নেই।
ব্লেচলি অপ্রস্তুত হেসে বললেন, আপনি যাই বলুন না কেন মিসেস ব্লেনকিনসপ–এভাবে চিঠি আদানপ্রদান সমর্থন করা যায় না। মিত্রপক্ষের গতিবিধি জানার জন্য জার্মানরা চারপাশে যেভাবে ওঁত পেতে রয়েছে–