পোয়ারো এই বলে চিনি গুঁড়োবার মুষলটা রবিনের মাথা লক্ষ্য করে তুললেন।
ভয়াবহতা এতই পুরো ব্যাপারটার নৃশংস যে, চিৎকার করে উঠল রবিন। না না, ওকে আমি মারতে চাইনি। আচমকা মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় ওকে আমি আঘাত করি।
আপনি তারপর রক্ত ধুয়ে ফেলে অস্ত্রটা আগের জায়গাতেই রেখে দেন। কিন্তু বিজ্ঞানের দৌলতে মুছে ফেলা রক্তের দাগও ধরা পড়ে গেছে।
-কিন্তু সত্যিই আমি ওঁকে মারতে চাইনি। আমি…ভুল করে ফেলেছি। আমার রক্তে আছে খুনের বীজ কিন্তু সেজন্য আমাকে শাস্তি দিতে পারেন না আপনারা।
স্পেন্স বললেন, আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি মিঃ আপওয়ার্ড, এখন থেকে যা যা আপনি বলবেন….
.
২৬.
–ওঃ মঁসিয়ে পোয়ারো, ভাবতেই তো আমরা পারছি না যে, আপনি সন্দেহ করলেন কি করে রবিনকে।
সমবেত শ্রোতাদের দিকে পোয়ারো আত্মপ্রসাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
–আমার অনেক আগেই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। একদিন মিসেস সামারহেস বলেছিলেন, রবিন, নিশ্চয়ই আপনার নিজেকে কারও দত্তক সন্তান হিসেবে ভাবতে ভালো লাগে না, তাই না? এর একটাই অর্থ হয় যে, মিসেস আপওয়ার্ড রবিনের আসল মা ছিলেন না। নিজেও মিসেস আপওয়ার্ড এ বিষয়ে যথেষ্ট সাবধান ছিলেন যাতে কেউ এ কথা জানতে না পারে। তাই তিনি পরিচিত গণ্ডী ছেড়ে এতদূরে বসবাস করতে আসেন। এমন কি রবিনকে যারা তার নিজের ছেলে বলে ভাবত, তাদের ভুলও তিনি ভাঙতে চাইতেন না।
প্রথমদিন ল্যাবারনাম এ যা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেটা হল মিসেস আপওয়ার্ডের প্রতি রবিনের ব্যবহার। ঠিক এটা আদুরে ছেলের মত ভাবও নয় আবার কর্তব্যপরায়ণ ছেলের মতও নয়, কেমন যেন প্রতিদান দেবার মত ভাব, যেমন করে আমরা অপরকে নিজের কৃতজ্ঞতা জানাই। যদিও মিসেস আপওয়ার্ড রবিনকে ভালোবাসতেন তবু মনে মনে তার গর্ব ছিল যে, তিনি টাকা দিয়ে একজন প্রতিভাবান ছেলেকে কেমন কিনে নিয়েছেন। তারপর এলেন মিসেস ম্যাগিনটি। রবিন চোখে অন্ধকার দেখল। সে এতদিন মিসেস আপওয়ার্ডকে বুঝিয়েছিল যে তার মা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সুতরাং সে সাহস করল না আর কোনো ঝুঁকি নিতে। একদিন মরিন কথা প্রসঙ্গে মুষলটার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেই সুযোগটাই নিল রবিন। মুষল দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে মিসেস ম্যাগিনটিকে খুন করল আচমকা আর মহিলাটির টাকা পয়সা চুরি করে ব্যাপারটা নিছক চোরের কাণ্ড বলে প্রতিপন্ন করতে চাইল। জেমস বেন্টলীর ওপর খুনের দায় বর্তালো। নিশ্চিন্ত হল রবিন।
আমি তারপর মিসেস আপওয়ার্ডকে সানডে কম্প্যানিয়ন এর চারখানা ছবি দেখালে উনি সেগুলোর মধ্যে ইভা কেনকে পরিষ্কার চিনতে পারলেন। কারণ তিনি আগেই এ ফটোটা দেখেছেন রবিনের কাছে। তার মায়ের ফটো সে দেখিয়েছে, তার সঙ্গে এ ছবি হুবহু এক। সন্দেহে রাগে ভদ্রমহিলা দিশেহারা হয়ে গেলেন। অথচ রবিনকেও পুরোপুরি তিনি অবিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
ব্যাপারটা জানতে পারার পর আর দেরি করতে পারল না রবিন। থিয়েটারে যাওয়া, জ্যানেটের ছুটি নেওয়া, টেলিফোন, কফির কাপ, লিপষ্টিক, সেন্ট সবই পূর্ব পরিকল্পিত। যখন রবিন মিসেস অলিভারকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে বাড়িতে ঢোকে দ্বিতীয়বার, তখনই সুযোগটা নেওয়া হয়। তার সময় লাগে খুন করতে মাত্র কয়েক মিনিট। আর মৃত্যুর পর মিসেস আপওয়ার্ডের স্বাভাবিকভাবে সব সম্পত্তির মালিক রবিনই। সকলেই ভাববেন যে, একজন ভদ্রমহিলা খুন করেছেন। সব সন্দেহের ঊর্ধে থাকবে রবিন।
কিন্তু মারাত্মক ভুল করেছিল সে দুটো।
প্রথম বই আর দ্বিতীয় ছবিটার ব্যাপারে। তার দুটোই নষ্ট করে ফেলা উচিত ছিল। রবিন ভেবেছিলেন মরিন পালিতা কন্যা সুতরাং ওঁর কাছে ছবিটা পাওয়া গেলে ইভা কেনের মেয়ে বলে ভাবা শক্ত হবে ওঁকে। অবশ্য যখন রবিন জানতে পারল মিস হেণ্ডারসন অকুস্থলে সেই রাতে গিয়েছিলেন, তখন ওর বাড়িতেই ছবিটা রাখা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করে। কিন্তু মই বেয়ে উঠে জানলা খোলার চেষ্টা করার সময় মড উইলিয়ামসের নজরে পড়ায় তাকে সেই চেষ্টা বাতিল করতে হয়। এরপর মরিনের দেরাজে সে ফটোটা রাখার সুযোগ পায়। বুঝেছিলাম আমি, যে দুবার আমি দেরাজ দেখেছিলাম তার মধ্যবর্তী সময়ের স্বল্প ফাঁকটুকুতে একজনের পক্ষেই ফটোটা রাখা সম্ভব সে হল রবিন। সেই সময় ও বাড়ির বৈঠকখানার ঠিক ওপরের ঘরটাতেই রবিন ছিল।
ইভলিন হোপ বইতে নামটা দেখে আমি মিসেস আপওয়ার্ড আর রবিন দুজনকেই সন্দেহ করি। পরে অবশ্য একবার যে ইভ কার্পেন্টারের কথা মনে হয়নি তা নয়। তবু শেষ পর্যন্ত হঠাৎ খেয়াল হল যে ইভলিন নামটা, ছেলে বা মেয়ে যে কারুরই হতে পারে।
কালেনকোয়েতে মিসেস অলিভারের সাথে মাইকেল নামে একজন উদীয়মান অভিনেতার আলাপ হয়। ওঁদের দুজনের কথাবার্তার বিবরণী শুনে মনে হয় আমার হয়ত সত্যি কথাটা মাইকেল জানে। যাই হোক আদত ব্যাপারটা অনেক আগেই ধরতে পারা উচিত ছিল আমার। একজন কেউ আমাকে একবার রেল লাইনের ওপর ধাক্কা দিয়েছিল, ভেবেছিলাম ধাক্কা দিয়েছে মিসেস ম্যাগিনটির হত্যাকারীই। কিন্তু স্টেশনে ওই সময় রবিনের উপস্থিতি একান্তই অসম্ভব ছিল।
হেসে উঠলেন জনি সামারহেস, হয়ত ধাক্কাটা কোনো বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা অসতর্কভাবে দিয়েছিলেন।