- বইয়ের নামঃ থ্রি অ্যাক্ট ট্রাজেডী
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ হার্পার কলিন্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী, ভূতের গল্প,
থ্রি অ্যাক্ট ট্রাজেডী
১. প্রথম অঙ্ক–সন্দেহ
থ্রি অ্যাক্ট ট্রাজেডী (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
প্রথম অঙ্ক–-সন্দেহ
০১.
কুলায়
সমুদ্র তীর থেকে চোখে পড়া পাহাড়ের ওপর পাখির নীড়ের মতো ছোট্ট বাড়ি কুলায়। একটি পায়ে চলা পথ সমুদ্র তীর থেকে উঠে গেছে, কুলারের দিকে। ধূসর রঙের ফ্লানেল ট্রাউজার্স আর সোয়েটার পরিহিত এক সম্ভ্রান্ত সুদর্শন চেহারার ভদ্রলোক ঐ পথ ধরে উঠে আসছেন। তার চেহারার বাঁধুনির জন্য বয়স ধরা মুশকিল। প্রথম দর্শনে তাকে নৌ বাহিনীর অফিসার বলে মনে হয়। আসলে তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত অভিনেতা স্যার চার্লস কাটরাইট।
চার্লসের দুজন অতিথি কুলারের বারান্দায় বসে ছিলেন। শিল্প রসিক ও নাট্যমোদী শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট এবং নামজাদা ডাক্তার স্যার বার্থালমিউ স্ট্রেঞ্জ চড়াই বেয়ে উঠে আসা চার্লসকে তারা দেখলেন। তারা নিজেদের মধ্যে স্যার চার্লসের অভিনয় জগৎ থেকে ফিরে এসে এই নির্জন সমুদ্রতীরে বসবাস করার কথা আলোচনা করছিলেন। প্রথমে তাদের ধারণা ছিল, চার্লস তার মঞ্চের নেশা, জনতার প্রশংসা এই সব কিছু থেকে দূরে বেশি দিন থাকতে পারবেন না। অথচ দুবছর এখানে কাটিয়ে দিয়ে প্রমাণ করে দিলো তাদের ধারণা ভুল।
চার্লস কার্টরাইট এসে হাজির হলেন–আপনারা কেবল বসে বসে গল্প করুন। আমি আমার ছোট্ট নৌকোটা নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে ছিলাম।
নিরুদ্দেশ যাত্রায় একাই গিয়েছিলেন, না কি সঙ্গে কেউ ছিলেন? ডাক্তার জানতে চাইলেন।
-না, সঙ্গে ঐ মেয়েটি, মানে শ্রীমতী লিটন গোর ছিলেন। জানো টলি, স্যার বার্থালমিউয়ের ডাকনাম হলো টলি, এই নির্জন জায়গাটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। সারাদিন নৌকো করে ঢেউয়ের ওপরে ঘুরে বেড়ানো। তারপর সূর্যাস্তে কুলায়-এ ফিরে আসা। কেমন সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা।
শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ভাবছিলেন, শুধু কি আকাশ, বাতাস, আর সমুদ্র তাকে আকর্ষণ করে? না কি ঐ কিশোরী মেয়েটির জন্য জায়গাটা তার এত পছন্দ?
শ্ৰীমতী মিলারি ঘরে এসে ঢুকলেন। চার্লসের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। কাগজটা দেখে নিয়ে সম্মতি জানিয়ে সেটা ফেরত দিলেন। খুশী মনে শ্রীমতী মিলারি চলে গেলেন।
বছর ছয়েক আগে শ্রীমতী মিলারি চার্লসের সেক্রেটারি হিসাবে কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমানে ঘর গৃহস্থালির যাবতীয় ভার তার ওপর। তবে উনি কয়েকদিনের মধ্যে চলে যাবেন, কারণ তার মা নাকি অসুস্থ। অবশ্য গত ছ বছরের মধ্যে চার্লস তার মুখে মায়ের কথা একবারও শোনেননি।
–ওঁর চলে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। স্যার বার্থালমিউ-এর ঠোঁটে হাসি। দুয়ে দুয়ে যে চার হয় সেটা তুমি জানো ঠিকই।
–তুমি ভুল বলছো! ওর মুখের দিকে একবার তাকালে তৎক্ষণাৎ কামভাব মন থেকে উধাও হবে। প্রশংসনীয় তাঁর কর্মদক্ষতা, কিন্তু তাই বলে প্রেম চলে না।
শ্ৰীমতী মিলারি আবার এসে ঢুকলেন।
একটা কথা বলতে এলাম। আপনাদের সঙ্গে আমিও ডিনারে বসবো। কারণ অতিথির সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে তেরো। তেরো সংখ্যাটা অপয়া। তাই।
– বেশ, আপনি বসবেন।
শ্ৰীমতী মিলারি চলে গেলেন।
–আপনার অতিথি যারা আসছেন তারা কারা? শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট জানতে চাইলেন।
লণ্ডনের ব্রুক স্ট্রীটের বিখ্যাত পোশাকের দোকান অ্যামব্রোসাইন লিমিটেড-এর মালিক ক্যাপটেন ডেকার্স ও তার স্ত্রী। নাটক লেখিকা শ্রীমতী উইলস। শ্রীমতী এঞ্জেলার খাতিরে তাকে নিমন্ত্রণ করতে হয়েছে। স্থানীয় লোকদের মধ্যে আছেন যাজক শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন ও তার স্ত্রী। লেডি মেরি গোর ও তার কন্যাও আসছেন, এই মেয়েটির সঙ্গে আমি নৌকো করে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ম্যানডার্স নামে এক তরুণ সাংবাদিকও আসছে।
–সাংবাদিক?
–নিজেকে তাই বলে। লেডি মেরির বাড়িতে থাকে এবং তার কন্যার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেড়ায়। লেডি মেরি তাকে খুব স্নেহ করেন তবে তাঁর মেয়ে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।
শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বুঝতে পারলেন চার্লসের বিরূপতার কারণ। ঐ সাংবাদিক ছোকরাটি হলো চার্লসের প্রণয় প্রতিদ্বন্দ্বী! চার্লসের মত ছেলেটির কোনো কিছুই নেই। কিন্তু ছেলেটির আছে যৌবন, যেটি আর ফিরে পাবে না চার্লস। সেই জন্য চার্লসের মনের কোণে ব্যথা প্রকাশ পাচ্ছে।
–স্যার চার্লস, গুনতে আপনাদের মধ্যে যে কারো ভুল হয়েছে, শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বললেন, অতিথির সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে বারো।
একটু ভেবে চার্লস বললেন–ভুলেই গিয়েছিলাম একজনের কথা বলতে। তিনি হচ্ছেন এরকুল পোয়ারো, বিখ্যাত গোয়েন্দা। জাতে বেলজীয়।
–বাড়িতে আবার সখ করে ডিটেকটিভকে ডাকা কেন বাপু। স্যার বাথালমিউ যে খুশী হতে পারেন নি বোঝা গেল। এক একটা মানুষ থাকে যাদের কপালে অঘটন ঘটেই আছে। এরকুল পোয়ারো মানুষটি ঠিক এইরকম। উনি যেখানে যাবেন সেখানেই একটা কাণ্ড ঘটবে। কি জানি বাপু, এখানেও কিছু ঘটবে বলে মনে হয়।
যত সব আজগুবি ধারণা। চার্লস বললেন।
তিনজনে হাসতে হাসতে ঘরে এসে ঢুকলেন।
.
০২.
দর্শকের ভূমিকায়
সন্ধ্যার সময় ছোট্ট নীড় সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। অতিথিরা একে একে আসছেন। তাদের পানীয় পরিবেশন করা হচ্ছে।
মানুষ দেখতে ভালোবাসেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। পুরুষ-স্ত্রী দুই-ই। তিনি দেখছিলেন শ্ৰীযুক্ত ডেকার্সকে যার মধ্যে প্যারিসের কেশবিন্যাসের আধুনিকতম রীতির ছাপ লক্ষণীয়।
অভিনেত্রী এঞ্জেনা সাট ক্লিফের সঙ্গে কথা বলছিলেন স্যার চার্লস। এককালে এই জুটির নামে নাট্যমোদী জনতা পাগল হয়ে যেতো।
এঞ্জেলার বান্ধবী শ্রীমতী উইলস ঐদিকে বসে আছেন। এইসময়ে এসে ঢুকলেন সস্ত্রীক শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন লেডি মেরি গোর। তিনি এককালে সুন্দরী ছিলেন। প্রৌঢ়ত্বে হাজির হয়েও তার মুখের ঔজ্জ্বল্যের ঘাটতি হয়নি। মেয়ে হারমিয়োন যখন তিন বছরের তখন তিনি স্বামীকে হারান। তারপর তিনি চলে আসেন এইখানে।
হারমিয়োন সুন্দরী না হলেও আকর্ষণীয়া। সাংবাদিক অলিভার ম্যানডার্সের সঙ্গে সে তখন কথা বলছিলো।
ওদের দুজনকে আরো একজন লক্ষ্য করছিলেন। তিনি হলেন এরকুল পোয়ারো। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তার মুখ একটু বিষণ্ণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
লম্বা চওড়া সৌম্য শান্ত চেহারা আট বছরের রেভারেণ্ড স্টিফেন ব্যারিংটনের। কিন্তু শ্ৰীযুক্তা ব্যারিংটন সুন্দরী হলেও সাজসজ্জায় অগোছালো ভাব।
পরিচারিকা ট্রে নিয়ে এসে প্রত্যেকের সামনে পানীয়ের গ্লাস ধরলো। সকলেই একটি করে পাত্র তুলে নিলেন। শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন নিলেন না। স্ত্রীর অনুমতি না পেলে তিনি কোনো কাজই করেন না। অগত্যা শ্রীযুক্তা ব্যারিংটন স্বামীকে পানীয় নেওয়ার কথা বললেন। স্ত্রী আজ্ঞা শিরোধার্য করে শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন পানীয়ের গ্লাস হাতে তুলে নিলেন।
ওদিকে শ্রীমতী হারমিয়োন ম্যানডার্সের সঙ্গে তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছে। টুকরো টুকরো কথা শোনা গেল।
–আমার মতো সাধারণ একটা মানুষের জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার অনেক জ্ঞানবৃদ্ধ বন্ধু আছেন, তাদের কাছে যাও।
জ্ঞান বৃদ্ধ। মানে জ্ঞানী এবং বৃদ্ধ। স্যার চার্লসের কথা বলছো?
–আমি কারো নাম করিনি।
করার প্রয়োজন নেই। তবে জেনে রেখো, ওঁর সঙ্গে তোমার তুলনা হয় না।
স্যাটার্থওয়েট ওদের দেখে খুব খুশী হলেন। হারমিয়োন মেয়েটি যে কি। এমন সুন্দর, শান্ত ছেলে ওর পছন্দ হয় না। আশ্চর্য, মেয়েদের মহিমা বোঝা যায়!
হঠাৎ একটা শব্দ শুনে স্যাটার্থওয়েট চমকে উঠলেন। শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন চেয়ারের ওপর ঢলে পড়েছেন।
শ্ৰীযুক্ত ব্যারিংটন, ডাক্তার, শিগগির এদিকে আসুন।
স্যার বার্থালমিউ ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখলেন শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের ধরে থাকা হাতটি। শ্ৰীযুক্তা ব্যারিংটনের দিকে বিষণ্ণ মুখে একবার তাকালেন। মুখ নিচু করে দ্বিধা কাটিয়ে বললেন। দুঃখিত। উনি মারা গেছেন।
–টলি, তুমি এইভাবে পায়চারি করছিলেন গাউনটা চাপিয়ে নিলেন
.
০৩.
স্যার চার্লসের সংশয়
এর পর কেটে গেছে কয়েকটা ঘণ্টা।
অন্ধকার সমুদ্রতীর। অবসাদের শান্তি ঘিরে আছে শান্ত কুলায়কে। লেডি মেরি শোকগ্রস্তা ব্যারিংটনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। অতিথিরা সবাই যে যার ঘরে বসে আছেন।
শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের শুতে ভালো লাগছিল না। মন ভারাক্রান্ত। আকস্মিক মৃত্যুর দৃশ্য মনকে ভীষণ খারাপ করে দেয়। এই বয়সে মৃত্যুর দৃশ্য সহ্য হয় না।
এমন সময় দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন চার্লস।
– আসবেন একটু ও ঘরে। কথা আছে। টলিও ওখানে আছে।
–বেশ তো চলুন। স্যাটার্থওয়েট গায়ে ড্রেসিং গাউনটা চাপিয়ে নিলেন।
অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন স্যার চার্লস।
— টলি, তুমি এইভাবে এত আকস্মিক ভাবে এত দ্রুত কাউকে মারা যেতে দেখেছো?
–আপনি কি এ ব্যাপারে কিছু সন্দেহ করছেন স্যার চার্লস? জিজ্ঞেস করলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট।
স্যার চার্লসের হয়ে জবাব দিলেন স্যার বার্থালমিউচার্লসের ধারণা, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যুতে আমরাও কম দুঃখিত হইনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে আপনার যে ধারণা সেটা আর কারো কাছে বলবেন না। সেটা বিলকুল হতে পারে। শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বললেন।
স্যার বার্থলমিউয়েরও একমত এ ব্যাপারে। –দেখো চার্লস, স্যার স্যাটার্থওয়েট ঠিক কথাই বলেছেন। তোমার এই কথাটা নানান জনের কানে কানে পৌঁছে এমন একটা আকার ধারণ করবে ফলে তোমার শান্তি বিঘ্নিত হবে। তুমি চুপ করে থাকো। পুলিস যা বলে বলুক।
–বেশ, তবে এইবার কি একটা সবিনয়ে নিবেদন করতে পারি?
নিশ্চয়ই।
–কথাটা হলো শ্রীযুক্ত এরকুল পোয়ারো অতিথি হিসাবে এখানে এসেছেন। স্যার চার্লস বলতে থাকেন। এখন শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে ওঁর মতামত জানতে চাইলে সেটা কি শিষ্টাচার সম্মত হবে?
–আমার মনে হয় না, সেটা ঠিক কাজ হবে। শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বলে উঠলেন, এমন সময় দরজায় মৃদু আওয়াজ।
–আসতে পারি?
–আরে এরকুল পোয়ারো। আসুন, আসুন, আমরা আপনার কথাই আলোচনা করছিলাম।
–আপনাদের গল্পের মাঝখানে এসে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করলাম না তো?
–মোটেই না, বসুন।
–এবার সরাসরি কাজের কথায় আসা যাক। স্যার চার্লস বললেন, আজকের সন্ধ্যেবেলার ঘটনার মধ্যে কোনো গোলমাল আছে বলে কি আপনার মনে হয়?
পোয়ারো ভুরু কুঞ্চিত করলেন।
–আমার বন্ধুর ধারণা শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন খুন হয়েছেন। তাই চার্লসের ইচ্ছা গ্লাস পরীক্ষা করা হোক।
পোয়ারো একটু ভেবে বললেন হ্যাঁ, ভদ্রলোকের মৃত্যু আকস্মিকভাবে হয়েছিল। গ্লাস পরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভদ্রলোকের আত্মহত্যার সম্ভাবনা মোটেও ছিল না। আর যদি তার এমন ইচ্ছা থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই এমন সুন্দর একটি পার্টি নষ্ট হতে দিতে চাইতেন না। ওঁর মতো অজাতশত্ৰু মানুষকে কেউ হত্যা করতেও চাইবে না।
.
০৪.
বিচিত্ররূপিণী
শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের কাছে স্ত্রী চরিত্র আজও রহস্যের মধ্যে রয়ে গেছে। যৌবনে এজন্যে কম আপসোস তার ছিল না।
হারমিয়োন-এর মধ্যে তিনি চিরযুগের বিচিত্ররূপিণী নারীর আধুনিক রূপটি প্রত্যক্ষ করলেন। সে স্পষ্ট বক্তা, ছলাকলা জানে না। আধুনিকা। প্রয়োজনে অক্লেশে ব্যবহার করে বলশালী অপভাষা। অথচ ধর্মপ্রাণা ও সরল মনের অধিকারিণী। কিন্তু তা বলে সে কি কম আকর্ষণীয়া, না কম রহস্যময়ী।
সত্যি করে বলুন তো, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যুটা আপনার রহস্যময় বলে মনে হয় না? সমুদ্রের ধারে বসে হারমিয়োন শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট প্রশ্ন করছিল।
বয়েস হয়েছিলো তো…
সার সাটার্থওয়েটের কথা শেষ না হতেই হারমিয়োন বলে ওঠে–থামুন, যত সব বাজে কথা। ডাক্তারগুলোও হয়েছে ধাপ্পাবাজ। ওঁরা কি বলেছে তা আমি জানি। একথা বলার জন্য ডাক্তার হওয়ার দরকার কি ছিল শুনি?
শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট চুপ করে থাকেন।
জানেন, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। উনিও আমাকে স্নেহ করতেন। ওঁর স্ত্রীকেও আমি মায়ের মত দেখি। আর রীনের সঙ্গে ছেলেবেলায় খেলতাম। ওঁদের একমাত্র সন্তান, যুদ্ধের সময় মারা যায়। নিয়মিত বাইবেল পড়া শিখেছি আমি শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের কাছ থেকে। তিনি বলতেন, ধর্ম হলো মানুষের চিরন্তন আশ্রয়। ভাবতেও পারি না যে তিনি আজ নেই।
অনেকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।
–শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয়, তুমি বুঝলে কি করে?
-ওটা হয়তো নিছক অনুমান। তবে একদিন আপনারা বুঝবেন যে আমরা ঠিকই বলেছিলাম।
আমরা মানে?
–আমি আর স্যার চার্লস। এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। স্যার চার্লস বিয়ে করেননি কেন?
–তা জানি না। মুখে বললেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। এদিকে মনে মনে বললেন, ফুলে ফুলে মধু খাওয়ার অফুরন্ত সুযোগ ছিল বলে।
আরো কিছু কথাবার্তা হওয়ার পর হারমিনে প্রায় জোর করে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে তাদের বাড়িতে নিয়ে এলো।
আসার সময় পথে হারমিয়োন একটি মাত্র কথা বললো–এরকুল পোয়ারোকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। বয়েস হয়েছে তো? ওঁর বুদ্ধির ধারা ভোতা হয়ে গেছে।
সাবেকি রুচিতে সাজানো ওদের বাড়ি। শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের বেশ পছন্দ হলো।
লেডি মেরি এগিয়ে এলেন।
আমার মেয়ে নিশ্চয়ই আপনাকে খুব জ্বালিয়েছে?
না না। আপনার মেয়ে খুব ভালো।
–সেটা তো সব নয়। সহবত শিখতে হবে। সমাজে মেলামেশা করার যোগ্যতা লাভ করতে হবে। জানেন, ওকে দুবার লণ্ডনে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। তাই চলে এসেছে। কিন্তু এই বয়সে ওর দেশ দেখা উচিত, মানুষ চেনা উচিত। আর মানুষ চিনতে না পারলে জীবনে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক বিপদ হতে পারে। আমার কেবল চিন্তা, হারমিয়োন ওর পাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের ভুল না করে বসে। হয়তো দেখা গেল, প্রথম যে ছেলেটি ওর কাছাকাছি আসবে, শুধু প্রথম বলেই ও তাকে বিয়ে করতে চাইবে।
–আপনি কি অলিভারের কথা ভাবছিলেন, লেডি মেরি?
–ঠিক অনুমান করেছেন আপনি।
–কিন্তু আপনার মেয়ে ওর বয়সের দ্বিগুণ বড়ো কাউকে যদি বিয়ে করে তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন?
–সেটাই বেশি নিরাপদ আমার কাছে। কারণ তার সম্পর্কে আশা করায় খুব বেশি যদি কিছু না-ও থাকে তবে আশংকা করার কিছু নেই।
লেডি মেরির জবাব শুনে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট তাজ্জব বনে গেলেন।
.
০৫.
সকাল
ঘরে উজ্জ্বল আলো। জানলার কাছে বাইরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্যার চার্লস। শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ঘরে ঢুকলেন।
–কি লেডি মেরির বাড়ি গিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, চমৎকার মানুষ ওঁরা।
স্যার চার্লস চুপ করে রইলেন কয়েক মিনিট। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন–এখানে যদি না আসতাম তাহলে খুব ভালো হতো।
স্যার চার্লসের জন্য করুণা অনুভব করলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। এতদিন তিনি অনেকের হৃদয় হরণ করেছেন, আজ তিনি নিজের হৃদয় হারিয়েছেন, কিন্তু হারমিনে তা গ্রহণ করেনি।
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো। শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট রিসিভার তুললেন। হারমিয়োনের ফোন–স্যার চার্লসকে জানিয়ে দেবেন, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে অলিভার আমাদের সাহায্য করুক। ডিনারের পর আমি ওকে নিয়ে আপনাদের ওখানে যাচ্ছি।
স্যার চার্লসকে জানাতে তিনি আপত্তি করলেন না বটে কিন্তু তার মুখে বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো, সেটা শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের দৃষ্টি এড়ালো না।
ডিনারের পর হারমিয়েন আর অলিভার এসে হাজির হলো। যেমন উৎসাহ নিয়ে হারমিয়োন এই কাজে নেমেছিল তেমন উৎসাহই কারো মধ্যে দেখতে পেলো না। বোঝা গেল, একরম জোর করে সে অলিভারকে এখানে নিয়ে এসেছে। স্যার চার্লসের দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ ওরা উঠলো। শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ওদের বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
হারমিনে সমানে অলিভারের সঙ্গে বগড়া করে চলেছে! ঝগড়ার সুবিধার জন্য বোধ হয়, ওকে আরো নিজের কাছে টেনে আনলো! জোর করে অলিভারের মাথাটা নিজের দিকে নামিয়ে আনলো। অলিভার তার সাধ্যমত বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট আবার ঘরে এসে ঢুকলেন।
–স্যাটার্থওয়েট, স্যার চার্লসের কণ্ঠে বেদনার সুর। আমি ঠিক করে ফেলেছি। কাল ভোর হওয়ার আগেই, এই কুলায় এই সমুদ্রতীর ছেড়ে চলে যাবো। আপাতত দক্ষিণ ফ্রান্সে যাবো। কিন্তু কেউ জানে না, আমার কতখানি এখানে রেখে গেলাম।
প্রথমে খুব বিস্মিত হলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। পরক্ষণে সেটা কাটিয়ে বললেন, তাহলে আমিও ভোরের গাড়িতে লণ্ডনে ফিরে যাই।
না, আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনি অন্ততঃ আর একটা দিন এখানে থাকুন! কুলায় ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আমার বিদায় জানাবার কেউ তো তাহলে থাকবে না। এ আমি ভাবতে পারি না বন্ধু।
কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালে সমুদ্রের ধারে পায়চারি করছিলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট, বাড়ির মালিক না থাকলেও পরিচারিকারা ঠিক মত কাজ করে চলেছে। মনে মনে ভাবছিলেন, বিকেলের গাড়িতে লণ্ডন ফিরে যাবে। জামার হাতায় টান পড়তেই পেছন ফিরে তাকালেন। বিষণ্ণ মুখে হারমিয়োন দাঁড়িয়ে।
–স্যার চার্লস নাকি এখান থেকে চলে যাচ্ছেন? হারমিয়োন প্রশ্ন করলো।
উনি চলে গিয়েছেন এখান থেকে!
অস্ফুটে একটা কাতরোক্তি তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। পরক্ষণে সে খণ্ডিতা নায়িকায় অবতীর্ণ হলো।
–কোন কুত্তীটার সঙ্গে গেছে? সেই নাটক লিখিয়ে ধুমসীটার সঙ্গে না কি বেহায়া নটীটার?
–কি যা তা রলছো? উনি চলে গেছেন তোমার জন্য হারমিয়োন।
–আমি! আমার জন্য উনি চলে গেছেন! স্পল্পজড়িত কণ্ঠে সে বলে উঠলো। তারপর নিজের মনে বলতে থাকে, এখন কি করবো আমি? চিঠি লিখবো? পুরুষ মানুষের মতিগতি আমরা আধুনিকারা একটুও বুঝি না। ওদের মনে প্রেম সৃষ্টি করতে গিয়ে ঈর্ষা সৃষ্টি করি। ব্যর্থ, আমরা ব্যর্থ।
সে বড় বড় চোখে তাকালো, শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের দিকে।
–আপনার কথাই আমি ধরে নিচ্ছি। স্যার চার্লসের এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য আমি দায়ী। তবে আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তাকে আমিই আবার এখানে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। দেখবেন, আমার কথার খেলাপ হবে না।
২. দ্বিতীয় অঙ্ক–নিঃসন্দেহ
দ্বিতীয় অঙ্ক–নিঃসন্দেহ
০১.
একটি চিঠি
মাঝে মাঝে অবকাশ যাপন করতে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরের একটি শহরে আসেন। এবারেও তিনি সমুদ্রে কাছাকাছি ছোট্ট বাড়িটিতে উঠেছেন। বাগানে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন তিনি। হঠাৎ একজায়গায় তার দৃষ্টি আটকে গেল। পরলোকে স্যার বার্থালমিউ। তিনি সম্পূর্ণ খবর মন দিয়ে পড়লেন। কি নিদারুণ দুঃসংবাদ! হাত থেকে কাগজ পড়ে গেল। নানান কথা স্মৃতি হয়ে ফিরে এলো। বারে বারে খবরের কাগজের কয়েকটি কথা মনে পড়লোতর আকস্মিক জীবনাবসান, কফি পান করিতেছিলেন, চিকিৎসক আসিবার পূর্বেই তাহার মৃত্যু
আর একটি আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে আশ্চর্য ধরনের মিল রয়েছে।
স্যার চার্লসকে আসতে দেখে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট আশ্চর্য হলেন। জানা গেল তিনিও কাগজ থেকে এই দুঃসংবাদটি অবগত হয়েছেন।
সত্যি, এভাবে টলি যে চলে যাবে, ভাবতে পারি না শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট।
–স্বৰ্গত ব্যারিংটনের মৃত্যুর সঙ্গে এই মৃত্যুর বিস্ময়কর সাদৃশ্য আছে।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
একসময় চার্লস বললেন– হারমিয়োনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। এর আগে অবশ্য একটা চিঠি পেয়েছিলাম। সেটার উত্তর দিইনি। সকলের পাগলামিতে তো সব সময় প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তবে এই চিঠিটা একটু অন্যরকমের।
-কি রকম?
বলা যেতে পারে, এটি একটি সাহয্যের জন্য আবেদন। চার্লস পকেট থেকে চিঠিটা বের করে দিলেন। নিন, পড়ে দেখুন।
শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট চিঠিটা পড়লেন, তবে চিঠির সারমর্ম ছিলো–
বার্থালমিউয়ের মৃত্যুর দিন হারমিয়োন ও তার মা ইয়র্কশায়ারের বাড়িতে এক পার্টিতে উপস্থিত ছিলো। তাদের চোখের সামনে ঘটেছে সেই নিদারুণ ঘটনা। তার ধারণা, স্যার বার্থালমিউ এবং শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু রহস্য একই সূত্রে গাঁথা। তার ধারণা, একমাত্র স্যার চার্লস এই রহস্য উদঘাটন করতে পারেন?
চিঠির প্রসঙ্গ নিয়ে আর কোনো আলোচনা হলো না।
–আচ্ছা, সেদিনকার পার্টিতে কারা কারা ছিলেন?
–কেন, কাগজেই সবার নাম ছিলো। স্যার চার্লস খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে জায়গাটা দেখালেন।
লর্ড ও লেডি এডেন, লেডি মেরি লিটন গোর, স্যার জোসেলিন ও লেডি ক্যাম্বেল, ক্যাপটেন ও শ্রীযুক্তা ডেকার্স, শ্ৰীমতী এঞ্জেলা সাট ক্লিফ।
–অলিভার ম্যানডার্সের নাম নেই। স্যার চার্লস বললেন।
এমন সময়ে পরিচারক এসে খানকয়েক চিঠি এবং একটি অর্ধ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে দিয়ে গেল। সংবাদপত্রটি স্যার চার্লস হাত বাড়িয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।
একটু পরেই প্রায় চীৎকার করে বললেন–শুনুন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট, কাগজ কি বলছে। বার্থালমিউর মৃতদেহ ময়না তদন্ত করে দেখা গেছে যে নিকোটিন জাতীয় বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
–এখন বসে থাকলে চলবে না। স্যার চার্লস বললেন। ইংলণ্ডে আপাততঃ ফিরে যাবো, তারপর কি করা যায় ভাবা যাবে।
তাহলে আমিও তাই করবো। ঐ অঞ্চলের পুলিসের বড়কর্তা কর্ণেল জনসন আমার বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি। আমি গেলে হয়তো আপনাদের কাজে লাগলেও লাগতে পারি।
শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট সমুদ্রতীরের কাছে একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লেন। একটু দূরে একজন মহিলা একটি সাপ্তাহিকী পড়ছেন। একটি শিশু বালি নিয়ে খেলা করছে। আরো একটু দূরে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন পেছন ফিরে। তবে তাকে চেনা মনে হলো তার।
শিশুটির হাসি শুনে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ফিরে তাকালেন। ঐ ভদ্রলোকও মুখ ফেরালেন। দুজনে চোখাচোখি হলো।
–আরে এরকুল পোয়ারো, আপনি এখানে। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন শ্রীযুক্ত। স্যাটার্থওয়েট। আধঘন্টা আগে স্যার চার্লসের সঙ্গে দেখা হলো। আবার এখন আপনার সঙ্গে। কি ব্যাপার বলুন তো?
স্যার চার্লস, এখানে আছেন নাকি?
হ্যাঁ, উনি বরাবরের জন্য লুমাউন ছেড়ে চলে এসেছেন। আপনার বোধ হয় জানা নেই।
–না, জানতাম না। তবে লুমাউনে তার থাকার একটা কারণ ছিলো। বলা যেতে পারে, একটি সুন্দরীই সেই কারণ। কিন্তু মেয়েটি সত্যিই স্যার চার্লসকে ভালোবাসতো। তাহলে কেন পালিয়ে আসা? অবশ্য কোনো মেয়েকে পিছু ধাওয়া করানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হলো তার কাছ থেকে পলায়ন।
পোয়াবোর অনেক কথার মাথামুণ্ডু শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বুঝতে পারলেন না। তিনি কি ভেবে স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু সংবাদ সম্বলিত সংবাদপত্রটি পোয়রোর হাতে এগিয়ে দিলেন।
গম্ভীরভাবে তিনি খবরটা পড়লেন। পলকের জন্য তার চোখে কাঠিন্য জ্বলে উঠলো। শান্ত ভাবে সংবাদপত্রটি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু একটু আশ্চর্যজনক, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
–স্যার চার্লসের অনুমানের কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে পড়ছে শ্রীযুক্ত পোয়ারো।
–হতে পারে, তিনি শিল্পী মানুষ। শিল্পীদের কল্পনা ও অনুমানশক্তি একটু বেশিই থাকে। অবশ্য এর ফল সবসময় মঙ্গলজনক নাও হতে পারে। বেশ, স্যার চার্লসের খবর কি?
–তিনি আর আমি আজ রাতেই ইংলণ্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি।
–তাহলে তিনি শৌখিন ডিটেকটিভ হতে চলেছেন। নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
–হারমিয়োন তাঁকে ফিরে যাওয়ার জন্য মিনতি জানিয়ে চিঠি লিখেছে।
–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ভাবছি অন্য কথা…মানব প্রকৃতির জ্ঞান কি সাংঘাতিক।
আর ভালো লাগছিল না স্যার স্যাটার্থওয়েটের। লণ্ডনের ঠিকানাযুক্ত একটি কার্ড পোয়ারোকে দিয়ে তিনি ওখান থেকে বিদায় নিলেন।
পোয়ারো চুপ করে বসে থেকে একসময় উঠে দাঁড়ালেন। টিকিটঘরের দিকে এগোলেন।
.
০২.
পলাতক খানসামা
পুলিস অফিসার কর্ণেল জনসন ও তার সহকারী ক্রস ফ্রিল্ড সুবিখ্যাত অভিনেতা স্যার চার্লস কার্টরাইটকে তাদের অফিস ঘরে ঢুকতে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। তাঁকে স্বচোক্ষে দেখতে পারবেন তারা তা স্বপ্নেও ভাবেননি।
শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে সঙ্গে নিয়ে স্যার চার্লস গিয়েছিলেন স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্যাবলী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে।
–আমরা তার হত্যাকারী কে জানতে পেরেছি। স্যার বার্থালমিউ মৃত্যুর দিন পনেরো আগে এলিস নামে এক খানসামাকে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ঐ ঘটনা ঘটার পরদিনই সে নিরুদ্দেশ হয়। সে পালিয়ে গিয়ে আমাদের সন্দেহকে আরো ঘন করে তুলেছে।
–সে পালালো কেন? আপনারা তো বলছেন, পুলিস তাকে সন্দেহ করেনি।
তার ধারণা ছিল, পুলিস তাকে সন্দেহ করছে। আমরা বাড়ির প্রত্যেকটি লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। স্যার জোনেলিন ক্যাম্বেল এবং ডাঃ ডেভিস স্যার বার্থলমিউয়ের মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন।
–খবরে প্রকাশ নিকোটিন জাতীয় বিষক্রিয়ায় স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু হয়, তাই তো?
-হ্যাঁ, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে নিহত ব্যক্তি ঐ বিষ খেয়েছিলেন। যে সব কাপে অতিথিরা এবং স্যার বার্থলমিউ কফি পান করেছিলেন সেগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু কোনোটিতেই নিকোটিন পাওয়া যায়নি।
স্যার চার্লস এবার শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যুর কথা বিস্তারিতভাবে জানালেন কর্ণেল জনসনকে।
–আচ্ছা, কর্ণেল, আপনি স্যার বার্থালমিউয়ের সমস্ত কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখেছেন? শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট জিজ্ঞাসা করলেন।
–হ্যাঁ, আমরা তার সেক্রেটারি শ্রীমতী লিণ্ডনের সহযোগিতায় তার সমস্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি, যার সঙ্গে এই মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক আছে।
-আচ্ছা, ঐ দিন ঐ সময়ে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন, বলতে পারেন?
একটা নাম লেখা কাগজ এগিয়ে দিলেন কর্ণেল জনসন। দেখা গেল, সেক্রেটারি, পাচিকা, পরিচারিকা পাঁচজন, অতিথি সাত জনের নাম রয়েছে।
–দেখছি, ঐ দিন শ্ৰীমন অলিভার ম্যানভার্স হাজির ছিলেন। স্যার চার্লস বললেন।
-হ্যাঁ, সেদিন তিনি ওখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসতে গিয়ে একটা পাঁচিলে ধাক্কা মারেন। ফলে গাড়ি বিগড়ে যায় বাইমিউয়ের সঙ্গে ওর চেনা জানা ছিল। তাই তিনি তাকে তাঁর বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানান। তাই তিনি তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন দুর্ঘটনা ঘটার পর।
–আচ্ছা, আমরা চাই স্যার বাংলিমিউয়ের বাড়িটা একটু পরীক্ষা করে দেখতে। সেখানকার লেবেদের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলবো আপনাদের আপত্তি নেই তো?
–আপত্তি নেই তবে নতুন কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না!
কর্ণেল জনসনের কাছ থেকে ওঁরা বিদায় নিয়ে ফিরে এলেন।
.
০৩.
কোন্ জন?
–আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন যে দুটি মৃত্যুর মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে? স্যাটার্থওয়েট প্রশ্ন করলেন।
–হ্যাঁ, সেই রকম তো আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে আবিষ্কার করতে হবে সেই যোগসূত্রটি কি?
ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। দুটি পার্টিতেই উপস্থিত ছিলেন এমন লোকের সংখ্যা কিন্তু বেশি। এটাকে কি বলবেন?
–সমাগতন।
–না, আমি বলবো পরিকল্পনা। টলির, মানে আপনাদের স্যার বার্থালমিউয়ের পরিকল্পনা। আশা করি, আমি তাকে আপনাদের থেকে বেশি জানতাম। কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে গভীর ভাবে ভাবতো। কোনো কাজ শুরু করার আগে রীতিমত ছক করে কাজে নামতো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ব্যারিংটনকে হত্যা করা হয়েছিল। আমার সঙ্গে টলিও একমত ছিলো, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ না করে আমাকে উল্টে সাবধান করে দিয়েছিলো। আমি জানি, সে ঐ হত্যা রহস্য উদঘাটন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে সে ব্যারিংটনের মৃত্যুদৃশ্য পুনরাভিনয়ের আয়োজন করলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হত্যাকারী ধরা পড়লো না। বরং তার মৃত্যু হলো।
-কিন্তু খানসামাটা যদি দোষ না করে থাকবে তাহলে পালালো কেন?
–হতে পারে। ওর বিরুদ্ধে এর আগে ছোটখাটো কোনো অপরাধের জন্য পুলিসের খাতায় নাম লেখা আছে। তাই পুলিসের হাঙ্গামা এড়াতে সে পালিয়েছে।
–তাহলে আপনার ধারণা, অতিথিদের মধ্যে কেউ একজন এই জঘন্য কাজ করেছে? স্যার স্যাটার্থওয়েট জানতে চাইলেন।
–হুঁ!
কাকে সন্দেহ হয়?
–এর উত্তর দেওয়া মুশকিল। একটু চিন্তা করলে দেখা যায় কাউকেই সন্দেহ করা চলে না। আবার এটাও বোঝা যাচ্ছে, এঁদের মধ্যেই হত্যাকারী লুকিয়ে আছে।
অলিভার ম্যানডার্স সম্পর্কে আপনার কি মনে হয়?
–একথা বলেছেন নে? স্যার চার্লস বললেন। এ ব্যাপারে তাকে আমার সন্দেহ হয় না। কারণ সে সেদিন আচমকা এসে পড়েছিল। সে মোটেও উলির নিমন্ত্রিত ছিল না। আপাততঃ পেটে কিছু না পড়লে বুদ্ধি খুলবে না।
ওঁরা দুজনে একটা বেঁস্তোরায় গিয়ে ঢুকলেন।
.
০৪.
বার্থালমিউয়ের বাসভবন
ইয়র্কশায়ারের এই প্রাসাদের মত পুরোনো বাড়িটি কিনে নতুন করে সংস্কার করেন স্বর্গত বাথালমিভ। কাছাকাছি একটি আরোগ্য নিকেতন গড়ে তুলেছিলেন।
স্যার চার্লস আর শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বার্থালমিউয়ের বাসভবনের বৈঠকখানায় বসে বাড়ির পাচিকা শ্রীযুক্তা মাহালেকির সঙ্গে কথা বলছিলেন। পনেরো বছর ধরে তিনি এখানে রান্না ছাড়া অন্যান্য কাজও করে চলেছেন। অন্যান্য পরিচারিকাদের চালনা করার দায়িত্ব ছিলো তার ওপর।
শ্রীযুক্তা লেকি কেঁদে চোখ ভেজালেন। বললেন–এমন মানুষটা চলে গেল। কোনোদিন কাউকে কড়া কথা বলতে শুনিনি। লোকের উপকার করেছেন অনেক।
–আচ্ছা, এলিস অর্থাৎ যে খানসামাটা পালিয়ে গেছে, তার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
–ওর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না। পনেরো দিন আগে এসেছিল, মাত্র দুমাসের জন্য ওকে বহাল করা হয়েছিল। কারণ ও বেকারের পরিবর্তে কাজ করতে এসেছিল। বেকার সাত বছর ধরে এখানে কাজ করছে। হালে সে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কর্তা ওকে হাওয়া বদলের জন্য পাঠিয়ে দেন। তাই এলিস এখানে কাজ করছিল।
এলিস সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিস ওকে হত্যার দায়ে সন্দেহ করছে। কিন্তু আমার কোনো সন্দেহ হয় না ওর ওপর। তবে ও আমাদের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বা মেলামেশা করতো না। হয়তো নতুন বলে এরকম আচরণ করেছে।
তার চেহারার বৈশিষ্ট্য ছিল?
–একটু কুঁজো, লম্বা, চেহারা খারাপ নয়। বাইরে বেরোবার সময় কালো চশমা ব্যবহার করতো চোখের অসুখ আছে বলে।
ঘটনার দিন তার আচরণ কেমন ছিল? স্যার স্যাটার্থওয়েট জানতে চাইলেন।
–সেদিন আমরা সবাই ব্যস্ত ছিলাম। এলিসও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কর্তার মৃত্যুতে আমরা ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। কান্নাকাটি করেছিলাম। তবে ওকে তেমন মুষড়ে পড়তে দেখিনি। সে আমাদের সাধ্যমত সেবাযত্ন করেছিল।
–সেদিন রাত্রি থেকে সে উধাও তাই না?
–হ্যাঁ।
এবার আমরা অন্যান্য পরিচারিকাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই, আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
–আপত্তি করার কিছু নেই, শ্রীযুক্তা লেকি বললেন। তবে মনে হয় না নতুন কিছু খবর পাবেন। সেদিন খাওয়ার টেবিলের দায়িত্ব ছিল বিয়াত্রিচে আর অ্যালিগের ওপর। আপনারা বরং ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
শ্ৰীযুক্তা লেকির পর এবাড়ির সবচেয়ে পুরোনো পরিচারিকা হলেন বিয়াত্রিচে চার্চ। স্যার চার্লস তার কাছে জানতে চাইলেন, সেদিনকার ঘটনা কোন অতিথির ওপর কি রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
–রীতিমতো ভেঙে পড়েছিলেন এঞ্জেলা সাটক্লিফ। কিছুতেই রাতে কিছু খেলেন না। মাথা ধরার জন্য অ্যাসপিরিন খেলেন। তাঁর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সকালে গিয়ে দেখি, অকাতরে ঘুমুচ্ছেন।
শ্রীযুক্তা ডেকার্সের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়নি। উল্টে তার ফিরে যেতে দেরী হয়ে যাবে ভেবে আপসোস করছিলেন। আর তাঁর স্বামী ব্রাণ্ডি গলায় ঢেলে নিজেকে সামলাচ্ছিলেন।
–লেডি মেরি সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
–ভদ্রমহিলার ব্যবহার যেমন সুন্দর, তেমনি মিষ্টি কথাবার্তা। ওঁর বাপের বাড়ির সঙ্গে আমাদের বাড়ির অনেককালের চেনা পরিচয়। তিনি সেদিন মুষড়ে পড়ে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা প্রকাশ করেননি। আর তার মেয়ে তো ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলো। ছেলেমানুষ কিনা।
শ্ৰীমতী উইলস সম্পর্কে জানা গেল। তিনি কেবল হ্যাংলাপনা করে বেরিয়েছেন। কেমন একটা আদেখলাপনা ভাব।
–এবার বলুন, সেদিন স্যার বার্মালমিউয়ের আচার আচরণ কেমন ছিল?
— পার্টির আয়োজন নিয়ে হৈ হৈ চলছে। কর্তা খুব খুশী। এমন কি একবার এলিসের সঙ্গে রসিকতাও করে ফেললেন। কর্তার কাছে টেলিফোনে জানানো হয়েছিল হাসপাতাল থেকে যে একটি নতুন রোগী এসেছে। ফোনটা ধরেছিল এলিস। রোগী নয় রোগীনীর নামটা ছিল ভীষণ খটোমটো। শ্রীযুক্তা ডি. রাসব্রিজার। এই নামটা নিয়েই কর্তা ওর সঙ্গে মজা করছিলেন।
শ্ৰীমতী চার্চকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন।
বছর তিরিশের সাধারণ চেহারার মেয়ে অ্যালিস। কিন্তু শরীরের যৌবনের যাদু প্রকটিত।
দেখা গেল, এলিস সম্পর্কে তার ধারণা ভালো।
–ও কেমন করে বিষ দেবে? টেবিলের দায়িত্ব ছিলো আমার ওপর। যদি সে বিষ দিতো তাহলে নিশ্চয়ই আমার নজরে পড়তো।
–তার মানে তুমি বলতে চাইছো, প্রত্যেকে যে পট থেকে কফি খেয়েছিলেন, তোমার কর্তাও ঐ একই পাত্রে কফি পান করেছিলেন?
–হ্যাঁ, তাই।
— তাহলে তোমার কর্তাকে কে খুন করেছে বলে তোমার মনে হয়?
–উনি তো খুন হননি। হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যান।
– জানেন স্যাটার্থওয়েট, ব্যারিংটনের মৃত্যুর সঙ্গে টলির মৃত্যুর যোগ না থাকলেও টলির মৃত্যুর জন্য আমি অ্যালিসকেই সন্দেহ করতাম।
– কারণ?
–মেয়েটা যেমন উশৃঙ্খলা, ও অতি সহজেই নিজের শরীরের দিকে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেই অবসরে কোনো কুমতলব হাসিল করা অসম্ভব নয়। তবে মেয়ে দেখে মজার মতো মন বা বয়স– কোনোটাই টলির ছিল না।
–কিন্তু নারীর আকর্ষণ মাথা খারাপ করার বিপদ এই বয়সেই সবচেয়ে বেশি নয় কি? –কি যে বলেন, আমতা আমতা করে বলেন স্যার চার্লস।
.
০৫.
খানসামার ঘর
–চলুন, খানসামার ঘরটা একবার ঘুরে আসি। স্যাটার্থওয়েট বললেন, তবে ভাবছি, পুলিস তো একবার ঘরটা দেখেছে। তারপর আর কিছু লাভ হবে?
–পুলিসের কথা আর বলবেন না। পাকা ডিটেকটিভের মত হেসে উঠলেন অভিনেতা স্যার চার্লস। ওরা খুঁজেছে অপরাধের প্রমাণ, আর আমরা খুঁজবো নির্দোষিতার প্রমাণ।
যে ঘরটিতে এলিস ছিলো সেখানে এসে ঢুকলেন দুজনে। বড় ঘর, এদিকে ফায়ার প্লেস। লোহার খাটে বিছানা পরিপাটি করে পাতা। আলনায় পোশাক সুন্দর করে সাজানো। একজোড়া জুতোও রয়েছে। কিন্তু খানসামার উদিটা আলনায় নেই। টেবিলের ওপর কালিভরা দোয়াত আছে কিন্তু কালি নেই। ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। তেমন কিছু নজরে পড়লো না। তবে ফায়ার প্লেসের কাছে দেওয়ালে একটু কালি ছিটকে পড়ার দাগ নজরে পড়লো।
–না, এখানে কিছু পাওয়া যাবে না। হাতাশার সুর স্যার চার্লসের কথায়।
– এরকম বেতালা কাণ্ডের মধ্যে গল্পের গোয়েন্দারা যদি পড়তেন, তাহলে দেখতাম তাদের কি হাল হতো।
শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের কথা শুনে স্যার চার্লস হেসে উঠলেন।
স্যার বার্থালমিউয়ের বাড়ির বাগানে ওঁরা দুজনে পায়চারি করতে করতে আলোচনা করছিলেন।
–শ্ৰীমতী চার্চ বলছিলেন, স্যার চার্লস খুশীর মেজাজে ছিলো। এলিসের সঙ্গে ঠাট্টাও করেছিল। রোগীনীর নাম কি যেন বলেছিল?
– শ্রীযুক্তা ডি. রাসব্ৰিজার।
– টেলিফোনের খবরটা কোনো সাংকেতিক ব্যাপার বলে আমার মনে হয়। ঐ সঙ্কেতের প্রকৃত অর্থ আমাদের জানতে হবে। হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে যে ঐ নামে কোনো রোগিনী আমাদের জানতে হানে সাংকেতিক।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ওঁরা দুজন আরোগ্য নিকেতনে এসে হাজির হলেন।
হাসপাতালের মেট্রনের সঙ্গে কথা বলছিলেন স্যার চার্লস।
–অনেক কষ্টে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে দিয়ে গেছেন, মেট্রন বলেন, এর বিরাট সুনামের প্রায় সবটুকুই তাঁর দান।
— আপনাদের এখানে নার্ভ কেসের চিকিৎসাই বেশি হয় তাই না?
–হ্যাঁ।
— আচ্ছা, শ্রীযুক্তা ডি. রাসব্রিজার নামে কোনো ভদ্রমহিলা এখানে এসেছেন? মহিলা আমার চেনাজানা। ওঁর সম্পর্কে টলির সঙ্গে আমার আগে কথা হয়েছিল।
–হ্যাঁ, এসেছেন। স্যার বার্থালমিউ যেদিন মারা যান সেদিন বিকালেই উনি ওয়েস্টইণ্ডিজ থেকে এখানে এসে পৌঁছোন। ওঁর স্বামী একজন আত্মীয়ের সঙ্গে এখানে ওঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
–এখন তিনি কেমন আছেন?
— খুব ভালো নয়। নার্ভাস ব্রেক ডাউন, বাইরের লোকজনের সঙ্গে দেখা করা বা চিঠি লেখা সব বন্ধ।
আরো দু একটা সাধারণ গ্রাম প্রকাশ করে ওঁরা আরোগ্য নিকেতন থেকে বেরিয়ে এলেন।
এরপর তারা হাজির হলেন স্থানীয় থানায়। অলিভার ম্যানডার্সের সেদিনের অ্যাকসিডেন্টে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য।
থানায় খোঁজ খবর দিলেন। যেখানে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে জায়গাটিও দেখলেন। দুধারে প্রায় দশ ফুট উঁচু পাঁচিল একেবারে সোজা এবং প্রায় ফাঁকা রাস্তা চলে গেছে। থানা থেকে আশাপ্রদ কোনো ফল পাওয়া গেল না।
স্যার চার্লসের হঠাৎ খানসামার ঘরের দেওয়ালে দেখা কালির দাগ কথা মনে পড়লো। ওটা ভালো ভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
.
০৬.
দেওয়ালে কালির দাগ
দেয়ালের কালির দাগ দেখে কি বোঝা যেতে পারে সেটা বোধগম্য হলো না স্যার স্যাটার্থওয়েটের কাছে।
মনে হয় স্যার চার্লস সেটা বুঝতে পেরেই জিজ্ঞেস করলেন, দেওয়ালের ঐ জায়গায় কালির দাগটা কেমন করে পড়লো বলে আপনার মনে হয়?
— মনে হয়, কলম পড়ার কালির দাগ। স্যাটার্থওয়েট বললেন। এ ঘরে অবশ্য কোনো কলম পাওয়া যায়নি। বুঝতে হবে এলিসের কিংবা তার আগের খানসামার কোনো ফাউন্টেন পেন ছিল।
–কিন্তু কলম পাড়লে টেবিলে বসেই পাড়বে। ফায়ার প্লেসের দেওয়ালে যাবে কি করে?
একটি লেখবার কাগজ আর পেনসিল মার্থা লেকির কাছ থেকে চেয়ে নিলেন স্যার চার্লস। এই ঘরে কি হচ্ছে সেটা জানা এবং দেখার জন্য অল্প বয়েসী পরিচারিকাদের কৌতূহলের শেষ নেই।
ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাগজ পেনসিল টেবিলের ওপর রাখলেন সার চার্লস। তারপর ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়ে মন দিয়ে দাগটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তাঁর নির্দেশ মত স্যার স্যাটার্থওয়েট খাটের ওপর চুপ করে বসে রইলেন।
পাঁচ মিনিট পর স্যার চার্লস উঠে এলেন –আমি এখন এলিস। আর এই পেনসিলটি হবে আমার কলম। অভিনয় হবে বোবা। কয়েক মিনিট লাগবে।
সেই কয়েক মিনিটে স্যার স্যাটার্থওয়েট বুঝতে পারলেন যে স্যার চার্লস সত্যিই কতবড়ো অভিনেতা।
চোখে মুখে দারুণ উত্তেজনা নিয়ে এলিস ঘরে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করলো। কি যেন ভাবছে। এখনই তাকে কি যেন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। একটা শব্দ? না কিছু নয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। টেবিলের কাছে দ্রুত পায়ে এসে চেয়ারে বসলো, কাগজ কলম এগিয়ে নিলো! কি যেন লিখছে দ্রুত হাতে। শব্দে কান খাড়া করে। দরজার কাছ থেকে শব্দটা আসছে। তবে কি পুলিস? ভাষণ ভয় পেয়ে দ্রুত ছুটে গেল ফায়ার প্লেসের কাছে। কাগজটা দলা পাকিয়ে ফায়ার প্লেসের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে হাতের কলমটা ছিটকে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে লাগলো। খুব স্বাভাবিক মুখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল এলিস। দরজা খুলে দেখলো। না, কেউ নেই।
স্যার চার্লস, কালির দাগের রহস্যটা এবার আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। উচ্ছ্বসিত হলেন স্যাটার্থওয়েট।
পেনসিলটা ঘুরিয়ে নেবার জন্য স্যার চার্লস নিচু হলেন।
–মনে হচ্ছে, যা চেয়েছিলাম তার থেকে বেশি কিছু পেয়ে গেছি। স্যাটার্থওয়েট শীগগির আসুন।
স্যাটার্থওয়েট এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। খুব ভালো করে লক্ষ্য করলেন, — মনে হচ্ছে। একটা কাগজ।
– কাগজ নয়। দাঁড়ান একমিনিট।
স্যার চার্লস দরজা খুলে বাইরে বেরোলেন। একটু পরেই একটা বোনবার কাঁটা হাতে নিয়ে আবার ঢুকলেন।
ফায়ার প্লেসের নিচে থেকে দলা পাকানো কাগজগুলো বের করলেন স্যার চার্লস। কয়েকটা চিঠি! মন দিয়ে দুজনে পড়লেন। এগুলি একই চিঠির কয়েকটা খসড়া মাত্র। অতিশয় স্পষ্টভাবে পত্রলেখক এলিস তার বক্তব্যটি জানিয়েছে — ডাক্তার কিভাবে মারা গিয়েছেন সব জানি। পুলিসকে এখনও কিছু বলিনি। শিগগির আমার সঙ্গে দেখা করে….।
হঠাৎ কোনো কারণে লেখাটি অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। হঠাৎ এলিস আচমকা ভয় পেয়ে কাগজগুলো দলা পাকিয়ে ফায়ার প্লেসের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
স্যার স্যাটার্থওয়েট অভিনন্দন জানালেন স্যার চার্লসকে।
–স্যাটার্থওয়েট, আমরা কিন্তু এখনো টলির আসল হত্যাকারী কে জানি না। এলিস নিজে খুন করেনি তবে কে করেছে সেটা সে জানে। ও চেয়েছিল হত্যাকারীর সঙ্গে ব্ল্যাকমেল করতে। কিন্তু গেল কোথায় সে?
— পুলিসকে তাহলে খবরটা জানাতে হয়। স্যাটার্থওয়েট জানালেন। পুলিশের ধারণা এলিসই খুন করেছে। অথচ আসল খুনী গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটা পুলিস বুঝুক।
– পুলিসের ওপর আমার একটুও আস্থা নেই। তাছাড়া পুলিসের কাণ্ডকারখানায় আসল হত্যাকারী হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। অতএব সেটা করা চলবে না।
–কিন্তু সৌজন্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।
–বেশ, জানিয়ে দিন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্যার চার্লস সম্মতি জানালেন।
.
০৭.
মন্ত্রণা
চিঠিগুলোর কথা জানালেন ওঁরা লণ্ডনের পুলিস অফিসার কর্ণেল জনসনকে। তিনি তাদের ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু মনে মনে খুশী হতে পারলেন না এই ভেবে যে দুজন অপেশাদার লোক তাদের ওপর টেক্কা দিচ্ছে।
কালির দাগ লক্ষ্য করে তারা কেমন ভাবে চিঠিগুলো উদ্ধার করলো সেটা বিস্তারিত জানালেন স্যার চার্লস।
চিঠিগুলো পেয়ে পুলিসের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো যে যাজক ব্যারিংটন এবং ডাক্তার বার্থলমিউয়ের মৃত্যু এক অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। কর্ণেল জনসন জানালেন, তিনি লুমাউনের পুলিস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যারিংটনের মৃত্যু সম্পর্কে নতুন করে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করবেন।
খবরের কাগজে যেন এখন চিঠিগুলোর কথা প্রকাশিত না হয় সে বিষয়ে পুলিসকে সাবধান করে দিয়ে স্যার চার্লস ও স্যাটার্থওয়েট থানা থেকে বেরিয়ে এলেন।
চেলাসায় শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের বাড়ি সাজানো গোছানো সুন্দর। বাড়ির মালিক যে শিল্প রসিক, তার পরিচয় ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।
বৈঠকখানা ঘরে বসে আছেন তিনজন– স্যার স্যাটার্থওয়েট, স্যার চার্লস ও হারমিয়োন।
হারমিয়োনকে একটু রোগা লাগছে, কিন্তু তার ঠোঁটে লেগেছে প্রতিজ্ঞার কাঠিন্য, স্যাটার্থওয়েট লক্ষ্য করলেন।
— আপনি ফিরে আসবেন। আমি জানতাম। হারমিয়োন স্যার চার্লসকে লক্ষ্য করে বললো। এবার আর কোনো চিন্তা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওর কথা বলার ভঙ্গীমা দেখে স্যাটার্থওয়েট স্পষ্ট বুঝে নিলেন যে হারমিয়োন স্যার চার্লসকে গভীরভাবে ভালোবেসেছে। আর চার্লসও হারমিয়োনকে ভালোবেসেছেন। একটি অপরাধ, না দুটি অপরাধ মাঝখানে সেতুবন্ধনের কাজ করে চলেছে।
দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরের কথা, বার্থালমউয়ের মৃত্যু সংবাদের কথা, ইয়র্কশায়ারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে বললেন স্যার চার্লস।
সব শুনে হারমিয়োন মাথা নেড়ে বললো, আপনারা আসল কথাটাই বুঝতে পারেননি।
ঘরের বাকি দুজন তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলেন।
–এলিস আর বেঁচে নেই। সে অনেক কিছু জেনে ফেলেছিল। তাই তাকে খুন করা হয়েছে। হত্যাকারী তাকে নিরাপদ মনে করেনি। তার মানে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা হলো তিন।
একটু চুপ করে থেকে স্যার চার্লস বললেন, তোমার কথা হয়তো মেনে নিলাম, কিন্তু এলিসের মৃতদেহটা কোথায় যাবে?
– আছে, ঐ বাড়িরই কোথাও। ঐরকম প্রাসাদের মত বাড়িতে তো চোরাকুঠুরির অভাব নেই। ভালো করে খুঁজলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ভাবলেন, হারমিয়োনের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে হত্যাকারী যে ভীষণ সাংঘাতিক সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তার মানে তিনিও বিপদে পড়েছেন। কেবল তিনি নন, স্যার চার্লস, হারমিয়োনও তার সঙ্গে আছে। প্রয়োজন মনে করলে খুনী আর একটা খুন…..
–আপনাকে এই তিনটি মৃত্যুর রহস্য খুঁজে বের করতেই হবে। হারমিয়োনের কণ্ঠে দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট। এ কাজ অন্য কাউকে দিয়ে হবে না, আমি জানি। আপনি নিশ্চয় ভয় পেয়ে পেছিয়ে যাবেন না। রহস্যের আড়ালে যে সত্য লুকিয়ে আছে সেটা আমরা, মানে আমি আর আপনি খুঁজে বের করবোই।
— আর স্যাটার্থওয়েট?
— হ্যাঁ।
শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট মনে মনে হেসে উঠলো, হারমিয়োন না চাইলেও তিনি ওদের সঙ্গে থাকবেন। কারণ তিনি রহস্য ভালোবাসেন। ভালোবাসেন মনুষ্য প্রকৃতির সমীক্ষা। এই সুবর্ণ সুযোগ তিনি কখনোই ছাড়বেন না।
অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে কি যেন ভাবলেন স্যার চার্লস। বোঝা যাচ্ছে, তিনি এখন পরিচালকের ভূমিকা গ্রহণ করবেন।
–আমরা বিশ্বাস করি যে দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি প্রথম হত্যাকাণ্ডটির থেকেই উদ্ভূত। অর্থাৎ ব্যারিংটনের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে বার্থালমিউ যা জেনেছিলেন, সেটা যেন আর কেউ না জানতে পারে সেইজন্য হত্যাকারীটি চিরদিনের জন্যে তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল, তাই তো?
হারমিয়োন ও স্যাটার্থওয়েট ঘাড় কাত করে তাদের মত জানালো।
— অতএব হত্যাকারীর উদ্দেশ্য কি ছিল সেটা জানতে হবে? প্রথমতঃ ব্যারিংটনকে হত্যা করে কেউ আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হবে এমন কোনো সম্ভাবনা কি আছে?
–মনে তো হয় না। স্যাটার্থওয়েট বললেন।
–তিনি তার অজ্ঞাতসারে কোনো ক্ষতি কারো করেছিলেন কিনা সেটা জানতে হবে। তৃতীয় কারণ ধরা যেতে পারে জিঘাংসাবৃত্তি। এটাও একধরনের পাগলামি। এক্ষেত্রে সেটাও প্রযোজ্য নয়।
একটু থেমে স্যার চার্লস আবার বলতে থাকেন– ভয়ও আর একটি কারণ হতে পারে। মনে করুন, ব্যারিংটন কোনো একটি লোককে কোনো এক বিশেষ সময়ে কোনো একটি জায়গায় দেখেছিলেন। হয়তো লোকটি এমন একটি অ্যালিবাই সৃষ্টি করে রেখেছে যে সেই সময়ে সে সেখান থেকে শখানেক মাইল দূরে আছে। যদি ব্যারিংটন সরল, মনে লোকটির সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা কারোকে বলে ফেলেন তাহলে?
– হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। স্যাটার্থওয়েথ বললেন।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, দুই পার্টিতে যাঁরা নিমন্ত্রিত ছিলেন তাদের নামের একটি তালিকা তৈরি করে কাকে কি কারণে সন্দেহ করা যায় সে বিষয়ে বিবেচনা করে দেখা।
তালিকা লিখতে বসলো হারমিয়োন, কার নাম আগে লিখবে, কার নাম লিখবে না এসব নিয়ে স্যার চার্লসের সঙ্গে প্রায় তর্ক লেগে গেল। একটা খণ্ড প্রলয় শুরু হওয়ার সম্ভাবনা করে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বেল বাজিয়ে কফির হুকুম দিলেন। স্যার চার্লস উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন একটা নিগ্রো-ভাস্কর্যের সামনে। গম্ভীর মুখে বসে রইলো হারমিয়োন।
কফি পান করার পর সবার মেজাজ স্বাভাবিক হলো। এবার ঠিক হলো –স্যার চার্লস কুলায় ফিরে যাবেন আর হারমিয়োন তার মাকে নিয়ে লুমাউথের ব্যারিংটনের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে।
৩. তৃতীয় অঙ্ক–আবিষ্কার
তৃতীয় অঙ্ক–আবিষ্কার
০১.
শ্রীযুক্তা ব্যারিংটন
গির্জার লাগোয়া যাজকের বাড়িটিতে সতেরো বছর ধরে বাস করছিলেন ব্যারিংটন দম্পতি। স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে শ্ৰীমতী ব্যারিংটন মনে মনে ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়লেন। ঠিক করলেন, এই বাড়ি ছেড়ে সমুদ্রের কাছাকাছি একটি ছোট বাড়ি কিনে নেবেন, এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাগান সমেত একটি বাড়ি কিনে ফেললেন।
স্যার চার্লস আর হারমিয়োন যখন ঐ বাড়িতে প্রবেশ করলেন তখন শ্ৰীমতী ব্যারিংটন বাগানে কাজ করছিলেন। ওদেরকে নিয়ে তিনি বসার ঘরে এলেন।
–আপনাকে এ অবস্থায় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। স্যার চার্লস বললেন, পুলিসের কাছ থেকে কোনো রিপোর্ট বা চিঠিপত্র পেয়েছেন শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে।
–হ্যাঁ, পেয়েছি। পুলিস জানিয়েছে, নিকোটিন জাতীয় বিষক্রিয়ায়…বলতে বলতে শ্ৰীযুক্তা ব্যারিংটন চোখের জল মুছলেন। হারমিয়োন ওঁকে জড়িয়ে ধরলো।
— আর একটা কথা আপনাকে জানাই, এখান থেকে আমি চলে গিয়েছিলাম দক্ষিণ ফ্রান্সে। ওখানে বসে আমি খবরের কাগজ থেকে আমার বন্ধু ডাক্তার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু সংবাদ জানতে পারি। তবে মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় এবং দুটি মৃত্যুর ঘটনা একই রকম। তারও মৃত্যুর কারণ হিসাবে পুলিস নিকোটিন জাতীয় বিষক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছে।
– শ্ৰীযুক্তা ব্যারিংটন, আপনার কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই রহস্য উদঘাটন করবোই।
–প্রার্থনা করি, আপনার চেষ্টা যেন সার্থক হয়।
— সেই জন্য আপনার সাহায্য প্রয়োজন।
— বলুন, কি ধরনের সাহায্য আশা করেন?
স্যার চার্লস একের পর এক প্রশ্ন করে জেনেছিলেন, শ্রীযুক্ত ব্যারিংটন সিগারেট খেতেন কিনা, কোনো শত্রু তাঁর ছিল কিনা, আর্থিক সঙ্গতি কেমন ছিলো ইত্যাদি ব্যাপারে।
শ্ৰীযুক্তা ব্যারিংটন, আপনার কি মনে পড়ে, ঘটনার আগের দিন পার্টির কোনো লোকের সঙ্গে আপনাদের দেখা হয়েছিল কিনা?
–তার আগের দিন হারমিয়োন আর অলিভার এসেছিল। হারমিয়োনের মা-ও এসেছিলেন। এটা তো প্রায়ই রোজের আসা। আর কেউ আসেনি।
— পার্টির কাকে কাকে চিনতেন?
–বিশেষ কাউকে চিনতাম না। তবে ডাক্তার বার্থালমিউ, অভিনেত্রী এঞ্জেলা সাটক্লিফ আর নাটক লেখিকা শ্ৰীমতী উইলসের নাম শুনেছিলাম।
– গিলিংয়ে, মানে যেখানে আপনাদের বিয়ে হয়েছিলো, সেখানেও খোঁজ খবর নিতে হবে। আসল রহস্য আমাকে জানতেই হবে।
.
০২.
লেডি মেরি
শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট স্যার চার্লসের অতিথি হিসাবে কুলায় অবস্থান করছিলেন, হারমিয়োন আর স্যার চার্লস বেরিয়ে যেতেই তিনি পায়ে পায়ে এসে হাজির হলেন হারমিয়োনদের বাড়িতে।
লেডি মেরি শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। চা পরিবেশন করলেন। ধীরে ধীরে দুজনে জমিয়ে গল্প শুরু করলেন। ওঁরা দুজনেই একই রকম জীবনদর্শনে বিশ্বাসী। তাই শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে পারিবারিক বন্ধু হিসাবে মেনে নিতে লেডি মেরির দেরী হলো না।
কথায় কথায় হারমিয়োনের কথা উঠলো। লেডি মেরি বললেন– মেয়েটা কি যে রহস্যভেদের চেষ্টায় মেতেছে জানি না। বড্ড খেয়ালী মেয়ে। তবে স্যার চার্লস সঙ্গে আছেন জেনে একটু বাঁচোয়া।
স্যার স্যাটার্থওয়েট চুপ করে থেকে ভাবতে থাকেন, হারমিয়োন কি সত্যিই দুটি হত্যাকাণ্ডের রহস্যভেদেই ব্যস্ত রয়েছে?
–শ্রীমতী ব্যারিংটনের কথা ভেবে ভীষণ দুঃখ হয়। বলতে থাকেন লেডি মেরি। অবস্থা ওঁদের কোনোদিন ভালো ছিল না। যুদ্ধে ওঁদের একমাত্র ছেলে মারা যায়। তবু তাদের সংসারে সুখ ছিলো। সব সময় ওঁদের ঠোঁটে হাসি দেখেছি। হারিমযোনকে ওঁরা দুজনেই ভালোবাসতেন।
কথায় কথায় শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট জানতে পারলেন যে বিবাহিত জীবনে লেডি মেরি কিন্তু সুখী ছিলেন না। অবশ্য ভালোবেসে বাড়ির অমতে তিনি বিয়ে করেছিলেন।
এবার স্যাটার্থওয়েট অলিভার সম্পর্কে দু চারটি প্রশ্ন করলেন।
–ছেলেটি এমনিতে বুদ্ধিমান। তবে ও এমন সব কথাবার্তা বলে যাতে মনে হয় যে, ঐতিহ্য বলে কোনো কিছু জানতে সে রাজী নয়। স্বৰ্গত ব্যারিংটনকে সে কটু কথা বলতেও পেছপা ছিল না। ওর ধারণা ছিল, ধর্ম অতি বাজে জিনিস। গির্জাগুলোর প্রয়োজন নেই।
–সেকি ব্যারিংটন রেগে যেতেন না?
–না, একটু বিরক্ত হতেন না, বরং বলতেন, পৃথিবীর সমস্ত গির্জা যদি তুমি বন্ধ করে দাও, সব যাজকদের বন্দী করো, তারপরেও ঈশ্বর যেমন আছেন তেমনিই থাকবেন।
– সুন্দর কথা।
–হাঁ, তবে মনে হয় কাকা-কাকিমার বেশি আদরেই অলিভারের এই হাল হয়েছে। কারণ ও জন্মানোর পরেই ওর মা মারা যান। তারপর থেকে কাকার কাছে মানুষ হয়।
–আপনি তাহলে জামাই হিসাবে অলিভারকে নির্বাচন করছেন না? হেসে বললেন স্যাটার্থওয়েট।
— না, লেডি মেরি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন। অবশ্য মেয়ে যদি মেনে নিতো তাহলে আমি হয়তো আপত্তি করতাম না। কিন্তু এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হারমিয়োন এমন করবে বলে মনে হয় না।
.
০৩.
পোয়ারোর পুনঃপ্রবেশ
কুলারের বৈঠকখানা ঘর। আরামপ্রদ উচ্চ। স্যার চার্লস, শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ও হারমিয়োনের মধ্যে কথা হচ্ছিল।
হারমিয়োন বললো –আমরা এখনো আপরাধী কে, জানতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু রহস্যটা আমাদের কাছে আগের মত ঝাপসা আর নেই। এটাই আমাদের লাভ।
স্যার চার্লস ওর বক্তব্য বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলেন।
–ব্যারিংটনের হত্যার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে বলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম। সেগুলি হতো, অর্থলাভ, প্রতিহিংসা এবং ত্রাস।
– হারমিয়োন, তুমি খুব ভালো বলেছো, স্যার চার্লস বললেন। এখন প্রথম দুটো আমরা বাদ দিতে পারি। তাহলে পরে যে কারণটি সেটি হলো ভয়। ব্যারিংটনকে না মেরে ফেলা পর্যন্ত কেউ একজন নিরাপদ বোধ করছিল না। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমরা কিভাবে ধীরে ধীরে সত্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
— হ্যাঁ, এবার বুঝতে পারছি। স্যার চার্লস হেসে জবাব দিলেন।
ওঁদের কথার মাঝখানে সহাস্য বদনে শ্রীযুক্ত পোয়ারো এসে ঢুকলেন। তার আকস্মিক আবির্ভাবে ঘরের অন্যান্যরা মনে হয় বিস্মিত ও নির্বাক হয়ে গিয়েছেন।
–আমি লণ্ডনে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে উনি লুমাউনে আছেন। তাই দেরী না করে চলে এলাম। আপনাদের মধ্যে নিশ্চয়ই একটাই আলোচনা চলছিল, হারমিয়োন বললেছি। পোয়ারো কথাশ করেছিলেন। আনবে, কিন্তু
–কিন্তু আপনি, হারমিয়োন বললো, বিশেষ কোনো কারণে নিশ্চয়ই এসেছেন?
— হ্যাঁ, ভুল স্বীকার করতে এসেছি। পোয়ারো কথাটা বলে স্যার চার্লসের দিকে তাকালেন। ব্যারিংটনের মৃত্যু সম্পর্কে স্যার চার্লস সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। আমি সেটাকে গুরুত্ব দিইনি। কারণ আমি জানতাম ব্যারিংটনের মৃত্যু হয়েছে আকস্মিক ভাবে, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু আমার ধারণা পাল্টে দিয়েছে। আপনারা যদি অনুমতি করেন তাহলে আমি আপনাদের সাহায্য করতে রাজী আছি। আর আপনারা যদি আপত্তি করেন তাহলে আমি আবার ফিরে যাবো।
— ফিরে যাবেন কেন? হারমিয়োন বাদে বাকি দুজন একসঙ্গে বলে উঠলেন।
–তুমি কিছু বললে না? পোয়ারো হারমিয়োনকে জিজ্ঞেস করলেন।
সে চুপ করে মাথা নামিয়ে বসে রইলো। তার নীরবতা বুঝিয়ে দিলো যে সে পোয়ারোর সাহায্য চায় না।
স্যাটার্থওয়েট কারণটা বুঝলেন। রহস্যের টানে হারমিয়োন আসেনি। সে এই সুযোগে স্যার চার্লসের মন জয় করে নিতে চায়। এটা হারমিয়োনের সাধনা, তৃতীয় ব্যক্তি এসে তার সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাবে সেটা সে হতে দিতে চায় না। অবশ্য সে জানে, স্যাটার্থওয়েট আছে দর্শকের ভূমিকায়। তার কাজে কোনো বাধা দেবে না। আসল ভূমিকা গ্রহণ করবে পোয়ারো, ফলে হারমিয়োনের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
ধীরে ধীরে একসময় মাথা তুললো হারমিয়োন। সে কি বলবে, আমার স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে দিন। আপনি এখনই চলে যান। কিন্তু সে কথা বলতে পারলো না। শিষ্টাচারে বাধলো। হেসে বললো, আমাদের সঙ্গে আপনি থাকলে আমি খুশী হবো।
.
০৪.
পোয়ারোর ভূমিকা
–এখন থেকে আমরা তাহলে পরস্পরের সহকর্মী হলাম। পোয়ারো বললেন। এবার হালের খবরগুলো আমার জানা দরকার।
শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট আপনাকে সব বুঝিয়ে বলতে পারবেন। হারমিয়োন বললো।
অতএব শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট সুন্দর ভাবে গুছিয়ে সব কিছু বললেন। কি কি জেনেছেন, কি কি দেখেছেন ইত্যাদি।
সব শুনে পোয়ারো খুব খুশী হলেন। স্যাটার্থওয়েটকে ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, যদি আগে বার্থালমিউয়ের মৃত্যু হতো, পরে ব্যারিংটন মারা যেতেন এই রহস্য সমাধানের কাজ অনেক সোজা হয়ে যেতো।
–একথা বলার কারণ?
–কারণ হলো, স্যার বার্থালমিউ একজন নামকরা নার্ভ স্পেশালিস্ট ছিলেন। তাদের অজ্ঞাতসারে অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়ে থাকে। ডাক্তারের একটি কথার ওপর রোগীর সবকিছু নির্ভর করে। কোনো রোগীর আকস্মিক মৃত্যুর পেছনে যদি কোনো রহস্য থাকে, তাহলে ডাক্তার সহজেই তা ধরতে পারেন। ফলে ডাক্তারদের অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। এবার ধরে নেওয়া যেতে পারে হত্যাকারী প্রথম পার্টিতে বার্থালমিউকে খুন করতে চেয়েছিল এবং সেই মত পানীয়তে বিষ মিশিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে ঐ গ্লাসটি তুলে নিয়েছিলেন ব্যারিংটন। ফলে তার মৃত্যু ঘটলো।
— আপনার ব্যাখ্যা অতি চমৎকার। স্যার চার্লস বললেন। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। পানীয়ের গ্লাস যখন পরিবেশন করা হয় তখন ট্রে থেকে অনেকেই খুশী মতো গ্লাস তুলে নেন। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছনো কি সম্ভব?
একটু চুপ করে থেকে পোয়ারো বললেন– আপনার যুক্তি ঠিক। আচ্ছা, সেদিন পানীয় পরিবেশন কে করেছিলৈন?
পানীয় প্রস্তুত করেছিলাম আমি। আর টেম্পল নামে একজন পরিচারিকা পরিবেশন করেছিলো।
–পানীয় প্রস্তুতের কাজে, বলতে পারেন মিশ্রণের কাজে স্যার চার্লসের জুড়ি মেলা ভার। এই বিদ্যে রপ্ত করে এসেছেন তিনি ফ্রান্স থেকে। বললেন– শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট।
– আপনার কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। গম্ভীর ভাবে পোয়ারো বললেন।
–তার মানে?
–স্যার চার্লস যে অতি সুন্দর পানীয় তৈরি করতে পারেন সেটা চোখে দেখে এবং চেখে দেখতে চাই।
সকলে একসঙ্গে হেসে উঠলেন।
–এবার বলুন টেম্পল নামের পরিচারিকাটি এ বাড়িতে কিভাবে বহাল হলো?
–আমার সেক্রেটারি শ্রীমতী মিলারি এ সব দেখাশোনা করেন। টেম্পলকে তিনিই কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।
–সেদিন খাবার টেবিলে তিনি তো বসেছিলেন তাই না?
সাধারণতঃ উনি কি বসেন?
–না, তিনি সেদিন নিজে থেকেই টেবিলে বসতে চেয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে টেবিলে অতিথির সংখ্যা হতো তেরো।
এবার টেম্পলের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাকে ডাকা হলো।
বাইশ-তেইশ বছরের ছিমছাম চেহারার টেম্পল ঘরে এসে ঢুকলো। সকলকে অভিবাদন জানিয়ে স্যার চার্লসের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ইনি এরকুল পোয়ারো। স্যার চার্লস বললেন, তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবেন। পোয়ারো প্রথমে তাকে কয়েকটি মামুলি প্রশ্ন করলেন। তারপর তিনি জানতে চাইলেন, ট্রে থেকে স্বর্গত ব্যারিংটন নিজে হাতে গ্লাস তুলে নিয়েছিলেন কিনা?
–আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমিই তার হাতে গ্লাস তুলে দিয়েছিলাম। উনি গ্লাসটি হাতে নিয়ে সামনের টেবিলে নামিয়ে রেখেছিলেন।
–সেই টেবিলের কাছাকাছি তখন কেউ যায়নি?
না, কেউ গেলে আমার নজরে পড়তো।
–তুমি এখন আসতে পারো।
সকলকে অভিবাদন জানিয়ে টেম্পল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ময়না তদন্তে জানা গেছে যে মৃতদেহে বিষ ছিল, তাই সন্দেহ হয়, গ্লাসটায় নিশ্চয়ই কেউ বিষ দিয়েছিল। কখন সেই বিষ মেশানো হয়েছিল সেটা জানতেই হবে। বললেন স্যাটার্থওয়েট।
–ঠিক বলেছেন আপনি। পোয়ারো বললেন। তবে বিষ দেওয়ার ফলে আমাদের সন্দেহের চক্রটা ছোট হয়ে গেল। অর্থাৎ পার্টির বাইরের কাউকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই।
– যদি নিকোটিন না হয়ে অন্য কোনো বিষ হতো তাহলে আপনি কি সন্দেহ করতেন?
–তাহলে ধরে নিতাম যে এমন কোনো বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে যেটা দেরীতে কাজ হয়। এমনভাবে সময় হিসেব করে সেটা দেওয়া হয়েছিলো যে পার্টিতে আসার পর বিষের কাজ শুরু হয়।
– তাহলে কাকে সন্দেহ করতেন?
–একজন্যকে সবচেয়ে আগে সন্দেহ করতাম। তিনি হচ্ছেন শ্রীযুক্তা ব্যারিংটন। হারমিয়োন খেঁকিয়ে উঠলো– আপনি আর গোয়েন্দাগিরি করবেন না। জানেন, ওঁদের সম্পর্ক কত সুন্দর ছিলো।
-হত্যা জিনিসটা এমনই বিশ্রী যে সত্য হলেও সুন্দর নয়। তবে হারমিয়োন, তুমি বৃথাই রাগ করছে। এক্ষেত্রে ব্যারিংটন যেভাবে মারা গিয়েছেন তাতে শ্রীযুক্তা ব্যারিংটনকে সন্দেহ। করা চলে না।
যাক, ওসর কথা বাদ দিন। হারমিয়োন বললো, এবার বলুন, আপনি কিভাবে কাজ করতে চান।
–যে ভাবে কাজ করলে শ্রীমতী হারমিয়োন আমার ওপর খুশী থাকবে সেই ভাবে আমি কাজ করতে চাই।
–বারে, আপনাকে আমি…হারমিয়োন ইতস্ততঃ করে জবাব দিল।
–শোনো, প্রধান ভূমিকায় থাকবে তুমি আর স্যার চার্লস। আর আমি থাকবো নেপথ্যে। বলা যেতে পারে, পরিচালকের ভূমিকায় থাকবেন স্যার চার্লস, আর তুমি ও স্যাটার্থওয়েট হবে সহকারী পরিচালক। আমার প্রতিজ্ঞা আমি কখনোও প্রকাশ্যে কাজ করবো না। আমার ধারণা, পৃথিবীতে এমন কোনো সমস্যা নেই যা চিন্তা দিয়ে সমাধান করা যায় না।
বুঝলাম না।
–সময় মত বুঝবে।
–আপনি ভীষণ হেঁয়ালি করে কথা বলেন। হারমিয়োন বললো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠলো, বড্ড দেরী হয়ে গেছে।
হারমিয়োনকে সঙ্গে নিয়ে স্যার চার্লস বেরিয়ে গেলেন।
.
০৫.
শ্রমবিভাগ
অবশেষে আপনার জালে মাছ ধরা পড়লো। পোয়ারো বললেন, তার মানে আপনি চেয়েছিলেন যে এই কেসটা আমি তদারকি করি তাই তো?
–হ্যাঁ, স্যাটার্থওয়েট জবাব দিলেন।
–আর সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আপনি সেদিন আমায় পুরোনো খবরের কাগজ থেকে স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু সংবাদ দেখিয়েছিলেন। ঠিক বলেছি?
–হ্যাঁ। কিন্তু এই দুটো হত্যা রহস্যের বা এই দুটো অপরাধ সম্বন্ধে আপনার ধারণা কি, শ্ৰীযুক্ত পোয়ারো?
এক্ষেত্রে রহস্য বা অপরাধ একটাই। একে অপরের পরিপূরক। এই দুটি হত্যাকাণ্ডের পিছনে কি উদ্দেশ্য আছে এবং অপরাধী কিভাবে সেই কাজ হাসিল করেছে সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে গ্লাস বা কাপ পরীক্ষা করে কোনো ক্ষেত্রেই বিষ পাওয়া যায়নি, অথচ মৃতদেহে বিষ ছিল। মজার ব্যাপার দেখুন, একই জিনিস সকলে খেয়েছিলেন, অথচ আর কারো কিছু হয়নি।
–প্রথম ও দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটু তফাৎ আছে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। পোয়ারো বলতে থাকেন, প্রথম ক্ষেত্রে মনে হয় না, যে কেউ ব্যারিংটনকে খুন করতে পারতো। ইচ্ছে করলে স্যার চার্লস যে কোনো একজন অতিথিকে হত্যা করতে পারতেন বা টেম্পল ইচ্ছে করলে শেষের গ্লাসটিতে বিষ মিশিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু ব্যারিংটন শেষ গ্লাসটি নেননি। যত ভাববেন তত মনে হবে ব্যারিংটনের মৃত্যু আকস্মিক এবং স্বাভাবিক। কিন্তু ময়না তদন্তের রিপোর্ট সব জট পাকিয়ে দিয়েছে।
..দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যে কেউ বার্থালমিউয়ের কফির কাপে বিষ মিশিয়ে দিতে পারতো, এটা আপনাকে একটা পরীক্ষার সাহায্যে পরে বুঝিয়ে দেবো। তার আগে আপনি একটা কথা জেনে রাখুন। আপনি আমার কথাটা বুঝবেন কারণ আপনার মনস্তত্ত্ব ও সহানুভূতিপ্রবণ মন আছে।
–বুঝলাম। এখন কথাটা কি বলুন?
–এই কেসের অনুসন্ধানের ব্যাপারে মুখ্যভূমিকা আমি নিতে চাই না। ওটা স্যার চার্লসের মতো অভিনেতার জন্য থাক। এতে উনি অভ্যাস্ত। তাছাড়া আর একজনও খুশী হবে।
–বাঃ, ভারি চমৎকার বলেছেন। স্যাটার্থওয়েট হাসতে হাসতে বললেন।
–আসলে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ওপর আমার একটু দুর্বলতা ও সহানুভূতি আছে। এ ব্যাপারে কাউকে সাহয্যে করতে পারলে খুশী হই। শ্ৰীমতী হারমিয়োনের মনোভাব আমার অজানা নয়। এবং তার প্রতি কার হৃদয় সমর্পিত, তাও আমি বুঝি।
তাই বলছি, এই রহস্যের সমাধান যখন হয়ে যাবে তখন আপনারা দেখবেন, স্যার চার্লসই এর সমাধান করেছেন। আমি মাঝে মাঝে দু-একটা কথা বলবো। ইঙ্গিত দেবো এই পর্যন্ত। আসলে জীবনে অনেক সম্মান ও যশ পেয়েছি। এই দুটির প্রতি আমার আর কোনো মোহ নেই।
পোয়ারোর কথা শুনে স্যাটার্থওয়েট ভাবলেন, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই দাম্ভিক কিন্তু সত্যবাদী। মুখে বললেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপনাকে?
– বলুন।
— আপনি কেবল কৌতূহলের টানে এই পর্যন্ত ছুটে এসেছেন?
কৌতূহল তো আছেই। তাছাড়া আছে সত্যান্বেষণের নেশা। সত্যের মতো এমন কৌতূহলোদ্দীপক, এমন বিচিত্র, এমন সুন্দর আর কিছুই নেই।
পোয়ারো সামনের টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ তুলে নিলেন যার ওপরে স্যাটার্থওয়েট সাতজনের নাম পর পর লিখে রেখেছিলেন।
নামগুলো যে ভাবে সাজানো হয়েছে, তার মধ্যে একটা তাৎপর্য আছে।
–তাৎপর্য? স্যাটার্থওয়েট বলে উঠলেন। আমি কী সেরকম কিছু ভেবে লিখিনি।
–আমিও তাই বলছি। কিন্তু নামগুলো লেখার সময় আপনার অবচেতন মন কাজ করেছে। যেমন ধরুন, প্রথমে শ্রীযুক্তা ডেকার্সের নাম রয়েছে। তার মানে আপনার অবচেতন মন বলছে, ইনিই আসল হত্যাকারী। অর্থাৎ আপনি আশা করছেন শ্রীমতী ডেকার্সই যেন অপরাধী বলে ধরা পড়েন।
একটু চুপ করে থেকে স্যাটার্থওয়েট বললেন –হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন।
–আচ্ছা, শ্রীমতী ব্যারিংটনের সঙ্গে স্যার চার্লস আর হারমিয়োন দেখা করতে গিয়েছিলো?
হ্যাঁ।
আপনি যাননি কেন?
ভিড় বাড়িয়ে লাভ কি?
কিন্তু তথ্যের সন্ধানে, কৌতূহলের প্ররোচনায় আপনি অন্য কোথাও গিয়েছিলেন। তাই না?
–হ্যাঁ, লেডি মেরির বাড়ি গিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে কিছু ঘরোয়া কথা হয়েছিল।
– অলিভার সম্পর্কেও আপনাদের মধ্যে কথা হয়েছিল। আপনি ভাবছেন, আমি জানলাম কি করে? ওর সম্পর্কে কথা বলার জন্যই আপনি সেদিন লেডি মেরির বাড়ি গিয়েছিলেন। আপনি আশা করছেন যে শ্রীযুক্তা ডেকার্স বা তার স্বামী হত্যাকারী বলে প্রমাণিত হন। কিন্তু আপনার আশঙ্কা এই যে, অলিভারই প্রকৃত হত্যাকারী।
…শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট আপনি অত্যন্ত চাপা স্বভাবের লোক। পাঁচজনের কাছে বলে না বেড়িয়ে নিজেই নিজের ধারণার স্বপক্ষে সত্য খোঁজেন। এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমার খুব মিল আছে।
–কিন্তু আমার কোনো সন্দেহ হয়নি ওকে নিয়ে। স্যাটার্থওয়েট বললেন। তবে ওর সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল।
–তার মানে কৌতূহল জেগেছিল আপনার। আমিও স্যার চার্লসের পার্টির দিন ওকে লক্ষ্য করেছিলাম। সেদিন অন্ততঃ দুজন অভিনয় করে যাচ্ছিলেন। এক, স্যার চার্লস। নৌবাহিনীর অফিসারে ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন। তবে উনি করতে পারেন। কারণ অভিনয় তার নেশা। কিন্তু সেদিন অলিভার মোটেও ক্লান্ত বা বিরক্ত ছিলো না। কিন্তু এমন ভাব ফুটিয়ে তুলেছিল। ক্লান্তির অভিনয়ের আড়ালে তার প্রাণচঞ্চল ভাবটা প্রকাশ হয়ে পড়ছিলো বারে বারে।
–আপনি কি করে বুঝলেন যে অলিভার সম্পর্কে আমি কৌতূহলী?
–স্যার বার্থালমিউয়ের বাড়ির পার্টিতে আকস্মিকভাবে অলিভারের আবির্ভাব আপনাকে বিস্মিত করেছিলো, কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনি সকলের অগোচরে লেডি মেরির কাছে যান, অলিভার সম্পর্কে জানতে। আবার সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নামের তালিকায় একেবারে শেষে রেখেছেন অলিভারের নাম। আপনি ইচ্ছে করে ঐ নামটিকে আড়াল করতে চান।
…পর্যবেক্ষণের শক্তি এবং বিচারবুদ্ধি–এই দুটি আপনার মহৎ গুণ। মন্ত্রগুপ্তির কৌশলও আপনার জানা আছে।
বারান্দায় পায়ের শব্দ শুনে এরকুল পোয়ারো চুপ করে গেলেন।
ঘরে এসে প্রবেশ করলেন স্যার চার্লস।
–আপনারা দিব্যি বসে গল্প করছেন। আর বাইরে যা ঠান্ডা। এক পেয়ালা কফি না খেলে চলবে না।
অতএব তিনজনে কফি খেতে খেতে কথা শুরু করলেন।
–আমাদের কাজের একটা ছক করে ফেলা দরকার। স্যার চার্লস বললেন।
–স্যাটার্থওয়েট একটা নামের তালিকা তৈরি করেছেন। সেটা দেখলে আমাদের পরিকল্পনা করে নিতে সুবিধা হবে।
এই বলে পোয়ারো নামের তালিকাটি স্যার চার্লসের দিকে এগিয়ে দিলেন। ঠিক হলো শ্রীমতী ডেকার্স সম্পর্কে যা কিছু জানার সেটা সংগ্রহ করবে হারমিয়োন। ক্যাপ্টেন ডেকার্স এবং শ্রীমতী উইলসের দায়িত্ব রইলো স্যার চার্লসের ওপর। অলিভারের ভাব নেবেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। এবং লেডি মেরি ও হারমিয়োন রইলো সন্দেহের বাইরে।
শ্ৰীযুক্ত পোয়ারো, আপনি আর কিছু বলবেন?
না। তবে আপনারা কে কতটা অগ্রসর হলেন সেটা আমি জানতে চাইবো।
–সেটা ঠিকই আছে। তবে আমি এই কজনের একটা করে ফটো চাই। তাহলে গিলিং জায়গাটার সঙ্গে এঁদের কারো কোনো যোগাযোগ আছে কিনা জানা সহজ হবে।
-খুব ভালো কথা। পোয়ারো বললেন।
.
০৬.
সিম্বিয়া ডেকার্স
ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলা হলো পোশাকের কাজ। আর কার ব্যক্তিত্ব কোন ধরনের পোশাকে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটবে, এটা যিনি যত ভালোভাবে বুঝতে পারবেন তিনি হলেন তত উঁচু দরের পোশাক শিল্পী।
যেমন আপনি, তাই না শ্রীযুক্তা ডেকার্স? হারমিয়োন বললো। সবার বাড়িতে পার্টিতে শুনি এককথা–অ্যামব্রোসাইনের পোশাক সকলের নজর কেড়ে নেয়। পর পর দুটি পার্টিতে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লেগেছিল। আজ তো ভয়ে ভয়ে আপনার দোকানে ঢুকলাম। প্রথমতঃ চিনতে পারবেন কিনা, দ্বিতীয় কারণ হলো, এত বড় দোকান, আপনি কাজে ব্যস্ত। এখানে বসে কথা বলা মানে সময় নষ্ট করা।
-না না, তুমি সময় সুযোগ মত আমার বাড়িতে বা দোকানে চলে আসবে। তুমি ভারী লক্ষ্মী মেয়ে। তুমি এলে আমি খুশী হবো।
এর মাঝে একজন কর্মচারিণী কোকো দিয়ে গেল।
কোকো খেতে খেতে আলাপ আরো জনে উঠলো। শ্রীমতী ডেকার্স এরই মাঝে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন চতুর্দিকে। মস্ত বড় দোকান। আধুনিকতম ধরনে সাজানো গোছানো। বাইরে ইউনিফর্ম পরা দারোয়ান ভিতরে সুসজ্জিত কর্মচারিণীর দল।
কথায় কথায় হারমিয়োন প্রশ্ন করলো– সেদিনের পার্টির আগে আপনি যাজক ব্যারিংটনকে আগে কোথাও দেখেছিলেন?
না তো?
–আপনি গিলিংয়ে ছিলেন কখনো?
গিলিং? না।
–আচ্ছা, ডাক্তার বার্থালমিউয়ের মৃত্যুটাও আশ্চর্য রকমের তাই না?
–ঠিকই বলেছো।
–খবরের কাগজে বেরিয়েছিল কি কি কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন?
–না, সময় হয়নি। যা কাজের চাপ। কি বেরিয়েছিল কাগজে?
ডাক্তার বাথলমিউ বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিলেন।
–বিষ!!! শ্রীযুক্তা ডেকার্স বড় বড় চোখ মেলে তাকালেন।
এমন সময় একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে ঢুকলেন। বোঝা গেল খুব ধনী এবং নিয়মিত এখানে আসেন। শ্রীমতী ডেকার্স ব্যস্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। হারমিয়োন ওখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো।
সে ঐ বনেদী দোকান পাড়াতে শো কেস দেখে দেখে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দিলো।
ঘড়ির দিকে তাকালে। একটা বাজতে পনেরো। তার মানে লাঞ্চ হতে এখনো পনেরো মিনিট বাকি।
এ তল্লাটের সবচেয়ে বড় অভিজাত রেস্টুরেন্ট রীজের উল্টোদিকের ফুটপাথে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো।
শ্ৰীযুক্তা ডেকার্সের দোকানে যে মেয়েটিকে কোকো দিয়ে যেতে দেখেছিল তাকে সে লক্ষ্য করলো। ডোরিস একটা সস্তা রেস্টুরেন্টের দিকে এগোচ্ছে।
হারমিয়োন তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
–তুমি আমাকে চেনো না, ডোরিস। চলো রীজে যাই। পেট ভরে খাওয়া যাবে আবার পরিচয়ও হবে।
ডোরিস আপত্তি করলো না। বীজের মত রেস্টুরেন্টে খাওয়ার আকর্ষণ। এছাড়া কৌতূহল তো আছেই।
খেতে খেতে হারমিয়োন নিজেকে ডোরিসের মত খেটে খাওয়া সাধারণ মেয়ে বলে পরিচয় দিলো। একটু আধটু লেখে। দোকান কর্মচারিণীদের নিয়ে একটা লেখার ব্যাপারে সে ব্যস্ত। তাই ডোরিসের সাহায্য সে আশা করে।
আলোচনা অন্তরঙ্গতায় এসে পৌঁছোলে শ্রীমতী ডেকার্সের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে, ডোরিস জানালো, ভদ্রমহিলার মুখে মধু বুকে বিষ। সবসময় আমাদের পেছনে লেগে থাকবে। এক মিনিট দেরী করে ঢুকেছো তো কি রেগে আগুন। পয়সা করেছেন যথেষ্ট তবে
তবে কি?
তুমি আবার কাউকে বলে দিয়ো না। দোকানের মর্যাদা বাড়ানোর জন্যে ঘটা করে কয়েকটা নতুন বিভাগ খুলেছেন। ফলে আর্থিক ব্যাপারে টানাটানি পড়েছে।
–তাঁর স্বামীর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক?
খুব খারাপ। পানদোষ তো আছেই। এছাড়া আর একটা দোষ আছে যা নিয়ে সম্প্রতি দুজনের মধ্যে অশান্তি চরমে উঠেছিল। তুমি কাউকে বলো না। তাহলে আমার চাকরি আর থাকবে না।
–তুমি এ নিয়ে একদম চিন্তা করো না ডোরিস। তুমি বল।
–কর্তার ওপর শোধ নেওয়ার জন্য কর্তী বেশ বড় ঘরের, বয়সে তাঁর চেয়ে ছোট এক বন্ধু জুটিয়ে ফেললেন। কর্তা মুখ ভার করে রইলেন। ভদ্রলোক রোজ বাড়িতে দোকানে আসতো। তারপর, আসা বন্ধ হয়ে গেল। শুনলাম নার্ভের অসুখে তিনি ভুগছেন। নার্ভ স্পেশ্যালিস্ট স্যার বার্থালমিউয়ের উপদেশ মতো তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি এ ডাক্তার মারা গিয়েছেন একটা পার্টিতে। আমাদের কর্তা ও কত্রী দুজনেই সেই পার্টিতে ছিলেন।
একসময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ডোরিস বিদায় নিলো– তোমার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগলো। দোকানে এসো, এখন চলি।
হারমিয়োন তার নোট বইয়ে সংক্ষেপে সব লিখে নিলো। এইসব কিছু পোয়ারোকে জানাতে হবে। তার আগে ক্যাপ্টেন ডেকার্সের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
.
০৭.
ক্যাপ্টেন ডেকার্স
সেন্ট জেমস হাউসের তিন নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন ডেকার্স দম্পতি।
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ গাড়ি থেকে নেমে ক্যাপ্টেন ডেকার্সকে তার ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখে হারমিয়োন এগিয়ে গেলো।
হারমিয়োনকে ন্যাপ্টেন ডেকার্স চিনতে পারলেন। তাকে ঘরে ডেকে বসতে বললেন। তারপর তিনি ভেতরে গেলেন।
হারমিয়োন আপনমনে ভাবছিল, ভদ্রলোকের স্বরে মনে হচ্ছে উনি মদ্যপ। তার মানে মদ্যপানের কালাকাল নেই তাঁর কাছে। মাত্র দুবার তাকে তিনি দেখেছেন। তাতেই তাকে কি করে স্পষ্ট ভাবে মনে রাখলেন?
ছটা দশে তিনি হাত মুখ ধুয়ে সান্ধ্য পোশাক পরে বসার ঘরে এসে ঢুকলেন।
–ছটা বেজে গেছে। সিন্ধিয়া এখনো এলো না। আমি বরং ওকে একটা ফোন করি।
-না না, তাকে ব্যস্ত করে লাভ নেই। আমি বরং আর একদিন এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করবো।
–বেশ, তবে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। তুমি এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলে। এক কাপ চা-ও যদি না খেয়ে চলে যাও, তাহলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে। তাই যদি কিছু না মনে করো, তাহলে আমার সঙ্গে ক্লাবে যেতে পারো।
–অবশ্য খাওয়ার দরকার নেই আমার। তবে আপনার সম্মান রক্ষার জন্য আমি আপনার সঙ্গে ক্লাবে যেতে রাজি। হারমিয়োন হেসে জবাব দিলো।
ক্লাবের একটা ঘরে গিয়ে ওরা দুজনে বসলো। ক্যাপ্টেন ডেকার্স খাবার অর্ডার দিলেন এবং সেই সঙ্গে নিজের জন্যে কড়া এবং হারমিয়োনের জন্য ঠান্ডা পানীয় আনতে বললেন।
দুজনের নানাধরনের কথার মাঝখানে স্বাভাবিক ভাবে দুটি মৃত্যুর ঘটনা এসে পড়লো।
–যাজক ভদ্রলোকের মৃত্যুর ব্যাপারটা আকস্মিক হলেও বিস্ময়জনক বটে। ক্যাপ্টেন ডেকার্স বললেন।
–আর ডাক্তারের মৃত্যুও তো অবাক হওয়ার মত ছিল, তাই নাকি?
হারমিয়োন, ডাক্তারদের খুন হওয়াটা আশ্চর্যের নয়। অনেক কারণে ওদের অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়। অন্যায় তারাও করে। আর ডাক্তার বার্থালমিউ মোটেও ভালোমানুষ ছিলেন না। আর ওর যে স্যাটেরিয়াম না হাসপাতাল, ওটা আসলে কি? ওটা একটা কয়েদখানা।
–একথা বলছেন কেন?
–কারণ ওখানে রোগী নাম দিয়ে কতকগুলো সুস্থ মানুষকে নিয়ে আটকে রাখে। তাদের ওপর চলে মানসিক উৎপীড়ন। তারপর ধীরে ধীরে নিজেদের স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলে। তারা মনে করে, তারা সত্যিই অসুস্থ। মেনে নেওয়া ছাড়া ওদের কিছু করার থাকে না। তুমি নিশ্চয় অবাক হচ্ছো? আরে আমি সব জানি, আমাকেও নার্ভের রোগী বলে আমার স্ত্রী আর ডাক্তার বার্থালমিউ মিলে ষড়যন্ত্র করে ঐ কয়েদখানায় আটক করতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি তো বোকা ছেলে নই।
তিনি কথা বলতে বলতে পানীয় পান করছিলেন। ক্রমশঃ তার দৃষ্টি হয়েছে লালবর্ণ, গলায় জড়তা।
—-আমার ওপর আবার মেয়ে গোয়েন্দা লাগিয়েছিল। নাটক লেখেন নাকি। খুব ভালো কথা। কিন্তু সেদিন বার্থালমিউয়ের বাড়িতে ভোর রাত্রে আমার ঘরে মরতে ঢুকেছিলিস কেন?
আরো কয়েকটা মামুলি কথাবার্তা বলে হারমিয়োন ওখান থেকে চলে এলো।
সে বাস ধরবে বলে হাঁটতে লাগলো। স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু রহস্য তখন তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বড়ো রাস্তায় হৈ চৈ শুনে হারমিয়োন সচকিত হলো। সাপ্তাহিক সংবাদপদ্র বিক্রি হচ্ছে। কানে এলো কয়েকটা শব্দ। সে একটা কাগজ কিনে নিলো। বার্থালমিউয়ের মৃত্যুর সঙ্গে ব্যারিংটনের মৃত্যু জড়িয়ে বেশ রসালো খবর পরিবেশন করেছেন কাগজের বিশেষ প্রতিনিধি।
বাসে উঠে এক মহিলার পাশে সে বসলো। তার চিনতে দেরী হলো না যে ইনি শ্ৰীমতী মিলারি। তার চোখে জল, কোলের ওপর ঐ কাগজ, বাইরে দৃষ্টি। হারমিয়োনকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন। চোখ মুছে তিনি কৈফিয়ত হিসাবে জানালেন যে, স্বর্গত ব্যারিংটনকে আমি অনেকদিন ধরে জানি। আমার মা এখনও গিলিং-এ থাকেন। সেখান থেকেই ব্যারিংটনের যাজক জীবন শুরু হয়। সেই সূত্রে ওদের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
কিছুক্ষণ পর শ্রীমতী মিলারি বাস থেকে নেমে গেলেন।
নিশ্চয়ই এই কান্নার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে, হারমিয়োন ভাবে। নতুবা যা শক্ত প্রকৃতির মহিলা তিনি, তীব্র আঘাত না পেলে কাণ্ডজ্ঞান শূন্য হয়ে কেঁদে ফেলতেন না।
.
০৮.
এঞ্জেলা সাটক্লিফ
শ্ৰীমতী এঞ্জেলার চটুল চাউনি, হাস্য ও লাস্যে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে বড়ই অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। খাতির করে তাকে নিয়ে বসালেন বসার ঘরে।
–একটা দরকারে আপনার কাছে এসেছিলাম। স্যাটার্থওয়েট বললেন।
দরকারে? ব্যথা পেলাম মনে। ভেবেছিলাম, আপনি আমার চাঁদের মত মুখটি দেখার জন্য এসেছেন। খিল খিল করে হেসে উঠলেন এঞ্জেলা।
–একটা খুনের ব্যাপারে আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো। অবশ্য এতে আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই।
-খুন? ভয় পাবো না? তার মানে? এখন বুঝতে পারছি, আপনি গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছেন। হয়তো আমাকেই খুনী বলে ধরে নিয়েছেন, এঞ্জেলা অর্থপূর্ণ হাসি হাসলেন। তাছাড়া আপনার মত মানুষেরা ওপরে শান্ত আর ভালো। ভেতরে উদ্দাম, চঞ্চল।
লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন স্যাটার্থওয়েট। কফি খেতে খেতে ওঁরা স্যার চার্লসকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন।
–চার্লসের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। এঞ্জেলা বলতে থাকেন। মঞ্চের বাইরেও আমাদের প্রেম ছিল। কিন্তু সেদিন ওঁর মধ্যে সংসার করার ইচ্ছে দেখিনি। তবে তার যদি ইচ্ছে হতো তাহলে আমিও ঘর, বর, সন্তান পেতাম। ঐটুকু পুঁচকে মেয়ে হারমিয়োনের ওপর আমার সত্যিই হিংসা হয়। হারমিয়োনও আমাকে পছন্দ করে না সেটা ওর দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারি। আমি ওর কাছে হেরে গিয়েছি। এঞ্জেলার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।
খানিকবাদে নিজেকে সামলে নিয়ে এঞ্জেলা বললেন, বলুন, আপনি কি জানতে এসেছিলেন?
–যেদিন বার্থালমিউ মারা যান সেদিন ওঁর ঐ পার্টিতে আপনি উপস্থিত ছিলেন। সেদিন আপনার নজরে এমন কিছু কি পড়েছিলো যা থেকে তার মৃত্যু কাণ্ডের রহস্য বোঝা যায়?
–এ প্রসঙ্গে যা বলার পুলিসকে বলেছি। নতুন করে কিছু বলার দরকার নেই।
–বার্থালমিউয়ের মনমেজাজ সেদিন কেমন ছিল?
–খুব ভালো।
আরো কয়েকটি প্রশ্ন করলেন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। কিন্তু আশা করার মত জবাব তিনি পেলেন না এঞ্জেলার কাছ থেকে।
.
০৯.
শ্রীমতী জুরিয়েল উইলস
শহর থেকে দূরে ছোট একটা বাড়িতে থাকেন নাট্যকার শ্রীমতী উইলস। ব্যঙ্গ নাটক রচনা করে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি ও অর্থ লাভ করেছেন।
কিন্তু তিনি দেখতে সুশ্রী নন। মুখে সর্বদা একটা বাঁকা হাসি। সংসার সম্পর্কে তিনি বীতশ্রদ্ধ। যে পৃথিবীকে তিনি ভালোবাসতে পারেননি এবং যে পৃথিবী তাকে ভালোবাসতে পারেনি তাকে তিনি ব্যঙ্গের চাবুক মেরে জর্জরিত করে দিয়েছেন তার নাটকগুলিতে।
স্যার চার্লসকে দেখে স্বাগত জানালেন তিনি। তাঁর হাড্ডিসার চেহারায় লালিত্যের অভাব। তার মধ্যে চোখে পড়েছেন প্যাসনে চশমা। ফলে তাকে আরো হাস্যকর মনে হচ্ছে।
আজকাল নতুন কোনো লেখা শুরু করেছেন নাকি?
–হ্যাঁ, একটা রহস্য নাটক লিখছি, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের।
হঠাৎ এমন ইচ্ছে হলো কেন?
মনে হয় দু দুটো রহস্যময় মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখার জন্যে।
–কিন্তু ও দুটোর রহস্যের কোনো কিনারা তো এখনও হয়নি।
–তাতে কি হয়েছে? আমি যা দেখেছি ও জেনেছি সেইটুকু নাটক লেখার পক্ষে যথেষ্ট। তারপর বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল ঘটবে। নাটক তার নিজস্ব ধারায় এগিয়ে যাবে।
শ্ৰীমতী উইলস, স্যার চার্লস গম্ভীর ভাবে বললেন, সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে আপনার এমন কিছু যদি জানাবার থাকে যা জানতে পারলে স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু রহস্যের কিনারার ব্যাপারে সাহায্য হয়, তা হলে তা জানালে খুশী হবো।
একটু চুপ করে থেকে শ্রীমতী উইলস বললেন–হ্যাঁ, কথাটা আগে মনে পড়েনি আমার। পুলিসকে তাই জানানো হয়নি। সেই খানসামাটা যে পরে পালিয়েছে–
–হ্যাঁ, এলিস।
–ওর হাতের কবজিতে একটা জডুল ছিল। সম্ভবতঃ বাঁ হাতে। ছোটো পয়সার মাপের মতো দাগটা।
সত্যি, আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তিকে প্রশংসা করতে হয়। এই চিহ্নটার কথা আপনিই প্রথম বললেন। কোনো মানুষকে আমরা সত্যিই ভালো করে লক্ষ্য করি না। মনে করুন, স্বর্গত ব্যারিংটনের কথা। ওঁর মধ্যে কি এমন বৈশিষ্ট্য ছিল?
–স্বর্গত ব্যারিংটনের হাত দুটি ছিল পণ্ডিতের উপযুক্ত। বাতের জন্য ঈষৎ আড়ষ্ট। কিন্তু তার আঙুলের গড়নগুলি ছিল অপরূপ আর নখগুলি সুন্দর।
-কি অভাবনীয় আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি! আপনি নিশ্চয়ই আগে তাকে চিনতেন?
না।
–তাকে কি হত্যা করা হয়েছিল বলে মনে হয়?
–না, তা মনে হয় না।
অতিথিদের সম্পর্কে আপনি কিছু বলবেন? স্যার চার্লস একটা একটা করে নামগুলো বলতে থাকেন।
–না, আমার এ বিষয়ে আর কিছু বলার নেই। বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
শ্ৰীমতী উইলসের হাসিটা স্যার চার্লসের মোটেও সহ্য হয় না।
–ভালো কথা, শ্রীমতী উইলস বললেন, আপনার সেক্রেটারি শ্রীমতী মিলারি কেমন আছেন? ভারি ভালো ভদ্রমহিলা, তবে বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ।
-আবেগপ্রবণ? ছিটে ফোঁটাও আবেগ নেই তার মধ্যে।
–মানুষ আমি চিনি। যা বলেছি তা ঠিক বলেছি। আবার বাঁকা হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে।
–আচ্ছা, আপনি ঠিক করে ভেবে বলুন তো, খানসামার কোন হাতে জডুলটা দেখেছিলেন?
অনেক ভেবে চিন্তে বললেন, ঠিক মনে পড়ছে না। হা, হা মনে পড়েছে, ডান হাতেই দাগটা দেখেছিলাম।
স্যার চার্লসের কাজ শেষ। তিনি এবার বেরিয়ে পড়লেন। একবার পেছন ফিরে তাকালেন। শ্ৰীমতী উইলসের ঠোঁটে সেই বাঁকা হাসি তবে তৃপ্তিপূর্ণ। মনে হয় কোনো কাজ হাসিল হয়েছে তাই তার মুখে প্রসন্নতার ছাপ। ওঁর বাঁকা হাসির একটা অর্থ আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা কি?
.
১০.
অলিভার ম্যানডার্স
বিরাট অফিস বাড়ির লিফটে করে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট তিনতলায় সে হাজির হলেন। অলিভারের কাকা এই অফিসের মালিক। ভবিষ্যতে অলিভার তার জায়গায় বসবে। অলিভারের সুসজ্জিত অফিস কামরায় এসে প্রবেশ করলেন স্যাটার্থওয়েট।
স্যাটার্থওয়েটকে যথোচিত শিষ্টাচারের সঙ্গে অলিভার স্বাগত জানালো।
–তুমি নিশ্চয়ই মানো যে ব্যারিটনের মৃত্যু বিষক্রিয়ার ফলেই হয়েছিল বলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ে তোমার কি ধারণা?
কাগজে খবরটা দেখেছিলাম বটে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার রুচি স্কুল নয়। একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে অলিভার বললো, এসব বিশ্রী ব্যাপার।
–তা বটে। তবে সূক্ষ্ম ধরনের হত্যাকাণ্ডও যে হয়, এটা বোধ হয় জানবে। এবার তিনি গম্ভীর কণ্ঠে পোয়ারোর শেখানো কথাটা বললেন, সেদিন তুমি যে অ্যাকসিডেন্টটা বানিয়েছিলে সেটা মোটেও কিন্তু সূক্ষ্ম হয়নি।
নীরবতা নেমে এলো। অলিভারের হাত থেকে কলমটা পড়ে গেল মাটিতে।
পুলিস কি সন্দেহ করছে? ধরা গলায় অলিভার বললো।
তাতো করছেই। তবে আসল ব্যাপারটা কি খুলে বলো তো।
-বলবো, সত্যি কথাই বলবো। তবে বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ওপর নির্ভর করছে। আপনারা ভাবছেন, আমি গল্পটা নিজেই বানিয়েছিলাম। কিন্তু না, স্যার বার্থালমিউয়ের নির্দেশে এবং অনুরোধে আমি একাজ করেছিলাম।
–আশ্চর্য। স্যাটার্থওয়েট রীতিমত অবাক হলেন।
-হ্যাঁ, তিনি আমাকে একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে একটা বিশেষ গোপন কারণে আমাকে একাজ করতে বলছেন। কারণটা আমাকে পরে বলবেন জানিয়েছিলেন। গাড়ি কিভাবে অ্যাকসিডেন্ট হবে সেটাও তার পরিকল্পনা মাফিক হয়েছিল। তবে তিনি কারণটা আমাকে জানিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি।
–চিঠিটা কোথায়?
–সেটা পড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।
–এমন বিচিত্র নির্দেশ তুমি পালন করতে গেলে কেন?
–কৌতূহলের বশে।
—আর কিছু ঘটেছিল যা তোমার বিরুদ্ধে যেতে পারে?
–একটা তুচ্ছ ঘটনা। বার্থালমিউয়ের বাড়িতে যে ঘরে আমি রাতে ছিলাম পরের দিন সকালে ওখানে বসে আমার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। একজন পরিচারিকা আমায় সাহায্য করছিল। এমন সময় আমার ডায়েরী থেকে একটা খবরের কাগজের কাটিং মেঝেতে পড়ে যায়। সেটি পরিচারিকাটি আমার হাতে তুলে দেয়। তবে সেটির একপিঠে মানুষের দেহে নিকোটিন জাতীয় বিষের ক্রিয়া সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ ছিল। এই দিকটা পরিচারিকাটি দেখে ফেলেছিল। আর অন্য পিঠে রাজনৈতিক বইয়ের বিজ্ঞাপন ছিল।
–সেটি কি আছে?
–আছে। এই দেখুন।
কাগজটি দেখলেন স্যাটার্থওয়েট তারপর ফিরিয়ে দিলেন।
–আপনি নিশ্চয়ই আমাকে সন্দেহ করছেন? আপনি না হলে আমার কাছে এসেছেন কেন? তবে বিশ্বাস করুন, আমি নিরাপরাধ। অলিভারের বিষণ্ণ মুখ।
–আমি এসেছি একজন বন্ধুর নির্দেশে, তিনি হলেন এরকুল পোয়ারো।
–তিনি কেন ফিরলেন?
–শিকারী তো শিকারের পেছনে ছুটবেই।
–অলিভারের মুখ দিয়ে আর কথা বেরোলো না।
.
১১.
পোয়ারোর পার্টি
আরামকেদারায় বসে আছেন এরকুল পোয়ারো ঐ চেয়ারের হাতলের ওপর বসেছিল হারমিয়োন। স্যার চার্লস এবং শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট কাছাকাছি চেয়ারে বসেছিলেন।
–অলিভারের অ্যাকসিডেন্ট সম্পর্কে আপনার ধারণা কি শ্রীযুক্ত পোয়ারো? স্যাটার্থওয়েট প্রশ্ন করলেন।
–আমি মনে করি, বার্থলমিউ এমন কোনো চিঠি পাঠাননি যেটি পেয়ে অলিভার তার বাড়িতে গিয়েছিল। কারণ এরকম বিচিত্র চিঠি স্যার বার্থালমিউয়ের পক্ষে পাঠানো অসম্ভব। আবার একথাও বিশ্বাসযোগ্য যে অলিভার ঐ ধরনের একটি চিঠি পেয়েছিল। আচ্ছা, শ্ৰীমতী উইলস একটা নতুন নাটক লিখছেন, তাই না?
–হ্যাঁ, রহস্য নাটক।
এরপর কিছুক্ষণ নীরবতার মধ্যে কাটলো।
এখন আমরা কি করবো বলুন? নিস্তব্ধতা ভেঙে হারমিয়োন বলে উঠলো।
–চিন্তা করতে পারো। আর কোনো কাজ নেই এখন। তবে তুমি গিলিংয়ে যেতে পারো। সেখানে শ্রীমতী মিলারির মা আছেন। তার সঙ্গে দেখা করতে পারো। হয়তো কোনো ভালো খবর পেয়ে যেতে পারো।
–আর আপনি কি করবেন? আপনি কি কেবল এই ঘরের মধ্যে বসে থাকবেন?
–ঠিকই বলেছে। আমি একটা পার্টি দেবো। সেখানে উপস্থিত থাকবেন শ্রীযুক্তা ডেকার্স, ক্যাপটেন ডেকার্স, শ্রীমতী উইলস, শ্রীমতী এঞ্জেলা, অলিভার আর তোমার মা লেডি মেরি। এছাড়া আমরা এখানে যাঁরা আছি তারাও থাকবেন।
উঃ, ভীষণ মজা হবে, হারমিয়োন খুশীতে উপছে উঠলো। ঠিক যেন ডিটেকটিভ গল্প। সবার মাঝখান থেকে আপনি খুনীকে ধরবেন।
–তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে নিঃসন্দেহে। কিন্তু বেশি আশা করে ফেলেছে। তারপর পোয়ারো স্যার চার্লসের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে একটু গোপন পরামর্শ আছে।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে হারমিয়োন আর স্যাটার্থওয়েট ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
একটি সুন্দর সন্ধ্যা। সকলেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
পরিচারক পানীয়ের ট্রে নিয়ে এলো। পোয়ারো নিজের হাতে প্রত্যেককে পানীয় পরিবেশন করলেন–আজ আমি নিতান্তই একটি সান্ধ্য সম্মিলনির আয়োজন করেছি। হালকা মনে কিছুক্ষণ একসঙ্গে সময় কাটাবো বলে। আজ আর কেউ খুন, হত্যা, বিষ, এসব আলোচনা করবেন না। এতে খিদেও নষ্ট হয়।
নাট্যকার শ্রীমতী উইলস গম্ভীর মুখে অন্যমনস্ক হয়ে একটু তফাতে বসেছিলেন। ঘরের আর এক কোণে বিষণ্ণ মুখে বসেছিলেন শ্রীমতী মিলারি।
সবাই কথা বলার মাধ্যমে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পোয়ারো ছিল এর ব্যতিক্রম।
সকলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা বলছিলেন স্যার চার্লস। হঠাৎ তার পা টলতে লাগলো। কথা যেন জড়িয়ে এলো। কার্পেটের ওপর পড়ে গেলেন তিনি, হাতের গ্লাস ছিটকে পড়লো।
ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে সকলেই হকচকিয়ে গেল।
একসময় তীব্রকণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো হারমিয়োন–চার্লস।
এঞ্জেলা ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্যার চার্লসের বুকে। অজ্ঞান হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। শ্রীমতী মিলারি নিজের চেয়ারে বসে কাঁদছেন। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে।
পোয়ারো এগিয়ে এসে স্যার চার্লসের নাড়ী দেখলেন। তারপর গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন।
বন্ধুগণ..কি যেন বলতে গিয়ে পোয়ারো থমকে গেলেন।
খবরদার, আপনি একটা কথাও বলবেন না। হারমিয়োন চিৎকার করে উঠলো। আপনাকে পুলিসে দেওয়া উচিত। আপনি চার্লসকে খুন করেছেন। আপনি….
পোয়ারো স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন–তুমি আমাকে খুনী বলে ঠিকই করেছে। তবে আমি সাধারণ খুনী নই।
এবার তিনি চার্লসের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন স্যার চার্লস, আপনার অভিনয় অপূর্ব হয়েছে। আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
স্যার চার্লস লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। উপস্থিত অতিথিদের উদ্দেশ্যে মিষ্টি হেসে অভিনন্দন জানালেন।
হারমিয়োন হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। শ্রীমতী মিলারির মুখে হাসি ফুটলো। শ্রীমতী এঞ্জেলার জ্ঞান ফিরে এলো।
–বন্ধুগণ…পোয়ারোর গুরু গম্ভীর আওয়াজে ঘরের সবাই সচকিত হয়ে উঠলো। স্যার চার্লস এবং আমি, দুজনে মিলে আমরা এই ছোট্ট সান্ধ্য অভিনয়ের আয়োজন করেছিলাম। এই অভিনয়ে স্যার চার্লসের কৃতিত্ব সবটুকু। এবং তার ভূমিকা কি ছিল তা-ও আপনারা বুঝতে পেরেছেন। এই পালায় আমারও একটি ভূমিকা ছিল। আপনাদের সেটা জানা দরকার। নাহলে আজকের এই আয়োজনের উদ্দেশ্য আপনারা বুঝতে পারবেন না।
এবার পোয়ারো মেঝেতে পড়ে থাকা গ্লাসটা হাতে তুলে নিলেন। তারপর বললেন, আপনারা বলছেন, এটি স্যার চার্লসের গ্লাস, তাই তো? কিন্তু আমি বলবো, না। কারণ, পকেট থেকে অন্য একটি গ্লোস বের করে বললেন, এটি হলো স্যার চার্লসের গ্লাস। যখন আপনারা সবাই স্যার চার্লসকে নিয়ে ব্যস্ত তখন খুনী অর্থাৎ আমি হাতসাফাই করে গ্লাসটা পাল্টে দিয়েছিলাম। আপনারা কেউ সেটা দেখতে পাননি।
–এতে কি প্রমাণিত হলো? হারমিয়োন জানতে চাইলো।
–এর ফলে বোঝা যাচ্ছে যে ব্যারংিটন এবং বার্থালমিউয়ের গ্লাসে বা কাপে কেন কোনো বিষ পাওয়া যায়নি অথচ তাঁদের দুজনের মৃতদেহে বিষ পাওয়া গেছে। তার মানে এই দুটি ক্ষেত্রেই হাতসাফাইয়ের ফলে কাজ বা গ্লাস বদল হয়েছিল। কিন্তু কে বদল করেছিল, সেটাই জানতে হবে।
পার্টি শেষ হলো। হতাশা, ক্লান্তি এবং বিরক্তি নিয়ে অতিথিরা ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ করলো। পোয়ারো তাদের উদ্দেশ্যে শেষবারের মত অনুরোধ করলেন, যদি তারা দুটি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সন্দেহজনক কিছু জেনে থাকেন তাহলে অবশ্যই তারা যেন বলেন। কারণ তার আশঙ্কা, হত্যাকারী তৃতীয় বার আঘাত হানার চেষ্টা করছে।
অতিথিরা এ ব্যাপারে কেউ কিছু বললো না। তারা এক এক করে বিদায় নিলেন।
–নিছক হাত সাফাইয়ের ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যেই কি আপনি আজকের অভিনয়ের আয়োজন করছিলেন, না কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল?
–আরো একটা উদ্দেশ্য ছিল। ঐ সময় আমি বিশেষ একজনের মুখের ভাব লক্ষ্য করতে চেয়েছিলাম।
–সে কে? হারমিয়োন বলে উঠলো।
–মাপ করো। এই প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দিতে পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারি। তার মুখে নিদারুণ বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠেছিল।
একটা টেলিগ্রাম পড়ে স্যার চার্লসকে দিলেন। তারপর আবার স্যাটার্থওয়েটের কাছ হয়ে পোয়ারোর কাছে ফিরে গেল।
বার্থালমিউয়ের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য জানাতে চাই। শিগগির আমার সঙ্গে দেখা করুন। –মার্গারেট রাসব্রিজার।
.
১২.
গিলিংয়ে একদিন
শ্ৰীযুক্ত পোয়ারো, হারমিয়োন বললো, আপনার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইয়র্কশায়ারের নার্সিংহোমে গিয়ে ঐ ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করা উচিত।
–কাল সকালের ট্রেনে যাবো বলে ঠিক করে রেখেছি। পোয়ারো বললেন, শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন।
স্যাটার্থওয়েট রাজী হয়ে গেলেন।
আরো কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে কথাবার্তা চললো।
স্যার চার্লসের মোটর হারমিয়োনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গিলিং-এর উদ্দেশ্যে। ভোরের বাতাসের মিষ্টি হাওয়া লাগছে তাদের গায়ে। বেলা এগারোটা নাগাদ ওংরা গিলিংয়ে এসে পৌঁছোলেন।
গ্রামের মধ্যে বাড়ি। শ্রীমতী মিলারির মা ওঁদের দেখে খুব খুশী হলেন। বয়েস হয়েছে। জানলার ধারে আরামকেদারায় বসে তার দিন কাটে।
কিছুক্ষণ এঁদের মধ্যে শ্রীমতী মিলারি সম্পর্কে আলোচনা হলো। স্যার চার্লসের মুখে শ্রীমতী মিলারির প্রশংসা শুনতে ভালো লাগছিল না হারমিয়োনের। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করলো–আপনি শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনকে তো চিনতেন, তাই না? এখানে একসময় তিনি যাজক ছিলেন। তিনি মারা গিয়েছেন, এটা নিশ্চয়ই শুনেছেন।
নিশ্চয় চিনতাম। কি ভালো লোক ছিলেন। বৌটিও বেশ ভালো। ওঁদের এখানেই বিয়ে হয়েছিল। মেয়ে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, খেতে গিয়ে বিষম লেগে তিনি মারা গিয়েছেন।
–না, ওটা ভুল। ওঁকে পানীয়ের সঙ্গে বিষ খাইয়ে…
শ্ৰীমতী মিলারির মা আঁৎকে উঠলেন।
–আমরা অপরাধীকে ধরার চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে আপনি যদি সাহায্য করেন—
–কি সাহায্য করবো বলো তো। পনেরো বছর আগে আমি ওঁকে শেষবার দেখেছিলাম।
তিনি শ্রীযুক্তা রাসব্রিজারকে চেনেন কিনা বলাতে জানালেন এ নাম কখনো শোনেননি। অতিথিদের কয়েকজনের ফটো তাকে দেখানো হলো। কিন্তু বৃদ্ধা কাউকেই চিনলেন না।
অতঃপর ওঁরা বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
দুজনে ওখান থেকে বেরিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় সামান্য কিছু খেয়ে নিয়ে গির্জার কাছে এলেন। ঘুরে ফিরে দেখলেন। তারপর গির্জার লাগোয়া বাগানে নির্জন দুপুরে দুজনে বেড়াতে লাগলেন।
–কি অদ্ভুত পদবী দেখুন। একটি সমাধি ফলকে উৎকীর্ণ একটি নামের প্রতি স্যার। চার্লসের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো হারমিয়োন–মেরি অ্যান স্টিকলপাথ।
–আমার আসল পদবী শুনলে তো তুমি এই ভাবেই হাসবে।
–কেন? আপনার পদবী তো কার্টরাইট। কত গুরুগম্ভীর সম্ভ্রান্ত পদবী বলুন তো।
না, ওটা আমার আসল পদবী নয়।
–তবে আসল পদবী কি? বলুন।
হারমিয়োন নাছোড়বান্দা, সে শুনবেই।
–এখনও যদি না বলেন তাহলে এমন মজা দেখাবো–হারমিয়োনের কণ্ঠে কৃত্রিম কোপ।
–শোন তাহলে। আমার আসল পদবী ছিল–মাগ।
মাগ? তা বদলালেন কেন?
–সে এক হাসির ব্যাপার। অভিনয় জগতে ঢুকেছি। কর্তৃপক্ষ আমার কাজ কর্মে খুব খুশী। একদিন ম্যানেজার ডেকে পাঠালেন। বললেন, অভিনয় করে তুমি যদি খেতে চাও তাহলে তোমার পদবী পালটাও। তিনি অভিধান খুলে ধরলেন আমার সামনে। দেখেছো, মাগ মানে কি? মাগ মানে বুন্ধু। বোকারাম নায়কের অভিনয় কেউ পয়সা খরচ করে দেখবে না। তোমার পদবী পাল্টে রাখা হলো কার্টরাইট।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে স্যার চার্লস বললেন, হারমিয়োন, আমি এতদিন দ্বিধার মধ্যে ছিলাম। কারণ তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট। ভেবেছি, তুমি অলিভারকেই বেশি ভালোবাসো। কাল প্রথম আমার মনে হলো যে তুমি আমাকেই, যখন তুমি আমাকে চার্লস বলে ডেকে উঠেছিলে।
-আপনি ঠিকই বলেছেন।
–হারমিয়োন আমার হারমিয়োন।
হারমিয়োন বাধা দিলো–এটা গির্জার জায়গা। এখানে নয়।
–যেখানে খুশী আমি তোমাকে আদর করবো।
গাড়ি গিয়ে থামলো স্যার চার্লসের ফ্ল্যাটে। চায়ের সময় হয়ে গেছে।
শ্ৰীমতী মিলারি ওঁদের অভ্যর্থনা জানালেন।
শ্ৰীমতী মিলারি, একটা সুখবর আছে। আপনাকে প্রথম জানাচ্ছি। খুব শিগগিরই আমি আর হারমিয়ান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছি।
কথাটা শুনে শ্রীমতী মিলারি বিস্মিত হলেন। কিন্তু মুখে বললেন–খুব ভালো, আপনারা সুখী হোন।
তারপর তিনি একটা টেলিগ্রাম স্যার চার্লসের দিকে এগিয়ে দিলেন। পাঠিয়েছেন, শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট।
স্যার চার্লস হারমিয়োনের হাতে ওটি দিয়ে বললেন– দেখতে হারমিয়োন।
টেলিগ্রামটি পড়ে হারমিয়োনের চোখ নিদারুণ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠলো।
.
১৩.
শ্ৰীযুক্তা রাসব্রিজার
বেলা বারোটা নাগাদ এরকুল পোয়ারো শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে সঙ্গে নিয়ে ইয়র্কশায়ারের স্যার বার্থালমিউয়ের আরোগ্য নিকেতনে এসে হাজির হলেন। একটি কার্ড বের করে স্যাটার্থওয়েট সেটি মেট্রনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মেট্রন এসে হাজির হলেন–আপনারা টেলিগ্রাম পেয়ে এসেছেন? সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। পুলিসও ঘণ্টা দুই আগে এসে পড়েছে।
–পুলিস? কেন? পোয়ারো প্রশ্ন করলেন।
–সেকি, আপনারা জানেন না? শ্রীযুক্তা রাসব্রিজার মারা গিয়েছেন।
-বলেন কি, আমরা তো তার তার পেয়ে এসেছিলাম। কয়েকটা কথা বলেই চলে যেতাম। স্যাটার্থওয়েট বললেন।
–তিনি কিভাবে মারা গেলেন?
পোয়ারো জানতে চাইলেন।
–কাল ডাকে ওঁর নামে একটা কোকোর কৌটো এসেছিল। আজ সকালে তিনি নিজের হাতে কোকো তৈরি করে চুমুক দেন। মনে হয় বিস্বাদ লেগেছিল। তাই তিনি কাপটা সরিয়ে রাখেন। কিন্তু মুখের জিনিস থু করে ফেলে দেওয়া শিষ্টাচার বিরোধী বলে হয়তো মনে করে গিলে ফেলেছিলেন। মিনিট দুইয়ের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।
–কোকোর কৌটো এবং কাপ নিশ্চয়ই পরীক্ষা করা হয়েছে। কি পাওয়া গেছে?
–নিকোটিন জাতীয় বিষ।
শ্রীযুক্ত রাসব্ৰিজার যা বলতে চেয়েছিলেন সেটা যদি এখানকার কাউকে বলে যান এটা ভেবে আরোগ্য নিকেতনের সমস্ত নার্স এবং ডাক্তারদের সঙ্গে ওঁরা কথা বললেন। কিন্তু শ্ৰীযুক্তা রাসব্রিজার কাউকে কিছু বলে যাননি।
চুপ করে বসে আছে পোয়ারো। তার মুখ ভার।
হঠাৎ একসময় বলে উঠলেন পোয়ারো চলুন, স্যাটার্থওয়েট, এখানে বসে থেকে লাভ নেই। অনেক কাজ করার কাছে।
আরোগ্য নিকেতন থেকে বেরিয়ে স্যাটার্থওয়েট প্রশ্ন করলেন–কি কাজ করার আছে?
আর একটি হত্যাকাণ্ড যাতে না ঘটে সেদিকে প্রথমে নজর রাখতে হবে।
–মানে, আপনি জানেন…
–আমি অনেক কিছুই জানি। তবে বুঝতে পারিনি, হত্যাকারী এত ভয়ঙ্কর, এত বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
ওঁরা থামার এলেন। তাদের পূর্ব পরিচিত সুপারিন্টেন্টে ক্রসফিল্ডকে সঙ্গে নিয়ে পোস্টঅফিসে এলেন? জানা গেল একটি ছোট ছেলে টেলিগ্রামটি করতে এসেছিল। সন্ধান করে সন্ধ্যার সময় ছেলেটিকে পাওয়া গেল। সে জানালো, একটি আধময়লা পোশাক পরা লোকের কথাতে টেলিগ্রামটি করেছে। পরিবর্তে চকোলেট খাওয়ার জন্য পাঁচটা টাকা পায়। টেলিগ্রাম করে রসিদটা সে পোস্টাফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে দিয়ে দেয়। লোকটি দেখতে লম্বা, অল্প দাড়ি, চোখে কালো চশমা, ছাই রঙের পোশাক। অনেকটা মোটরা কারখানার মিস্ত্রির মতো।
সুপারিনটেনডেন্ট ক্রসফিল্ড লোকটিকে সন্ধান করার নির্দেশ দিলেন।
প্রায় মধ্যরাত্রি।
এরকুল পোয়ারো ও শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট লণ্ডনে ফিরে এলেন। স্যার চার্লস ওঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
কিছুক্ষণ তিনজনের মধ্যে নতুন করে আলোচনা হলো।
–আপনারা বরং ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। সমস্ত ঘটনাগুলো এখন গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। প্রকৃত ব্যাপারটা এইভাবেই জানা যাবে।
–বেশ, আপনার যেমন খুশী করুন। কিন্তু আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়। তবে কেবল চিন্তা করেই যদি আপনি রহস্যের জাল খুলতে পারেন তাহলে আপনাকে আমিই প্রথমে অভিনন্দন জানাবো।
ফিরে আসার জন্য স্যার চার্লস পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়ালেন–শ্রীমতী উইলসের জন্য আমি খুব চিন্তিত।
-কেন? পোয়ারো চমকে উঠলেন।
–তিনি কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গিয়েছেন। আপনাদের ফোন পেয়ে আমি তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। উনি একটা কিছু চেপে যাচ্ছেন এটা প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছিলাম। এতে তার বিপদ হতে পারে। আর একবার বোঝাবার চেষ্টায় তার বাড়ি গিয়ে শুনি, উনি আজ সকালে চলে গিয়েছেন। বিকেলে ওর পরিচারিকা একটা টেলিগ্রাম পেয়েছেন যে শ্রীমতী উইলস দুএকদিনের মধ্যে লণ্ডনে ফিরবেন না। তিনি কোথায় আছেন তার কোনো হদিস ছিল না টেলিগ্রামের মধ্যে। তাছাড়া কোনোদিন এভাবে তিনি কোথাও যান না বলে পরিচারিকাটি চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
স্যার চার্লসের কথা খুব মন দিয়ে শুনলেন পোয়ারো। তারপর বললেন, আমি তাকে বার বার সাবধান করে দিয়েছিলাম। বার বার বলেছিলাম কোনো কিছু যেন গোপন না করে। আমার কথা তিনি শুনলেন না। যাই হোক, আমি একদিন সময় চাইছি আপনাদের কাছে।
–বেশ, আপনি নিরিবিলিতে বসে চিন্তা করুন। আমি এখন আসি। স্যার চার্লস বললেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে স্যার চার্লস বললেন– পোয়ারো নিজেকে একটা মস্ত মানুষ বলে মনে করেন, তাই না স্যাটার্থওয়েট?
–ভদ্রলোক একটু অদ্ভুত ধরনের মানুষ। স্যাটার্থওয়েট এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন– আপনি তখন আপনার কোনো চিন্তার কথা বলছিলেন, জানতে পারি?
–মনে রেখেছেন সেটা। মানে…লজ্জাও পেলেন যেন স্যার চার্লস, আমি আর হারমিয়োন…
–এ তো সুখের খবর। আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি, স্যার চার্লস।
.
১৪.
শ্রীমতী মিলারি
পরের দিন সকালে পোয়ারোর ঘরে ঢুকে অবাক হলো হারমিয়োন। টেবিলের ওপর এক প্যাকেট তাস নিয়ে বাড়ি তৈরি করছেন।
–ভাবছো, আমি ছেলেমানুষ হয়ে গেছি। আসলে কি জানো হারমিয়োন, তাসের বাড়ি তৈরি করা খেলাটা আমার চিন্তায় ভীষণ সাহায্য করে। সামনের দোকান থেকে এক প্যাকেট তাস কিনে নিয়ে এলাম। কিন্তু এনে দেখছি, এগুলো কেবল মজার ছবিতে ভরা, এগুলোতে তাসের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। যাই হোক, এতেই কাজ চলে যাবে।
–দেখি ছবিগুলো, হারমিয়োন হাত বাড়িয়ে তাসগুলো নিলো। এগুলো দিয়ে একটা মজার খেলা হয়। খেলটার নাম সুখী পরিবার। কয়েকটা ছবি নিয়ে একটা পরিবার হবে। যেমন, দেখুন ডাক্তার কোয়াক, এই ছবিটা শ্ৰীযুক্ত মাগের। আর বিশ্রী চেহারার ভদ্রমহিলা হলেন শ্রীমতী মাগ। তার মানে আমি? হারমিয়োন হেসে লুটিয়ে পড়লো।
পরে হাসি থামিয়ে সে জানালো, স্যার চার্লসের সঙ্গে তার আসন্ন বিয়ের কথা এবং অভিনয় জগতে এসে স্যার চার্লসের পদবী পরিবর্তনের কথা।
–আপনাকে একটা কথা জানাতে এসেছিলাম। আপনারা অলিভারকে সন্দেহ করছেন। এমন কি পুলিসও। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, ও নির্দোষ।
–বিশ্বাস করলাম।
–আপনি আমাকে কথা দিন, অলিভার যেন কোনো বিপদে না পড়ে আপনি দেখবেন?
–দিলাম।
এবার আমি নিশ্চিন্ত। আমি এখন উঠি।
হারমিয়োন চলে যাওয়ার পর পোয়ারো আবার তাসের বাড়ি তৈরি করায় মন দিলেন। একসময় সুন্দর বাড়ি তৈরি হলো। তিনি বাচ্চা ছেলের মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন কেসটা যে বিচিত্র; সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে সমস্যার সমাধান আমি পেয়েছি। এবার চিন্তা ছেড়ে কাজ শুরু করার পালা।
চটপট পোশাক পরে পোয়ারো তৈরি হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। একটা ট্যাক্সি ধরলেন।
স্যার চার্লসের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে চমকে উঠলেন পোয়ারো। শ্রীমতী মিলারি হাতে একটা ছোট সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে আসছেন।
পোয়ারোকে সামনাসামনি দেখে একটু হকচকিয়ে গেলেন।
–আপনি। কিন্তু স্যার চার্লস তো শ্রীমতী হারমিয়োনকে নিয়ে কোথায় বেরিয়েছেন।
আমার ওঁকে দরকার নেই। কদিন আগে আমার ছড়িটা এখানে ফেলে রেখে গিয়েছিলাম। সেটা নিতে এসেছি।
–তা বেশ। আপনি তাহলে ভেতরে যান। আমি আর দেরী করতে পারছি না। কিছু মনে করবেন না যেন। আমি আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিলিংয়ে যাচ্ছি।
শ্ৰীমতী মিলারি দেরী না করে দ্রুত রাস্তায় নেমে একটা ট্যাক্সি ধরলেন। পোয়ারোও আর একটি ট্যাক্সি নিয়ে তাকে অনুসরণ করলেন।
প্যাডিংটন স্টেশনে নেমে শ্রীমতী মিলারি টিকিট ঘরে গেলেন। তারপর লুমাউথে যাওয়ার একটি গাড়িতে উঠে বসলেন।
পোয়ারোও প্রথম শ্রেণীর একটি টিকিট কেটে ঐ একই গাড়িতে উঠে বসলেন।
সন্ধ্যা ছটা নাগাদ লুমাউথে পৌঁছে শ্রীমতী মিলারি হেঁটে রওনা হলেন কুলার-এর দিকে। নিঃশব্দে পোয়ারো তার পেছন ধরলেন।
শ্রীমতী মিলারি কুলায় ঢুকলেন। পাঁচ মিনিট পর তিনি বেরিয়ে এলেন একটি টর্চ এবং একটা বেঢপ ধরনের চাবি হাতে নিয়ে। পোয়ারো একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করতে লাগলেন।
একটা ছোট্ট ঘেরা মাঠে এসে ফটক খুলে ভেতরে ঢুকলেন। ঝোঁপঝাড়ে ভরা, পুরোনো ধরনের পাথরের মিনারের নিচে মস্তবড় দরজাটা চাবি দিয়ে খুললেন। ভেতরে ঢুকে আবার দরজা ভেজিয়ে দিলেন। টর্চ জ্বেলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন।
ছোট্ট একটি ঘর। চারদিকে জানালা। এটিকে দেখলে মনে হবে ছোটখাটো একটি রাসায়নিক পরীক্ষাগার। তারপর অনেক খুঁজে পেতে একটা শিশি বের করলেন। আরো টুকিটাকি সব একজায়গায় জড়ো করে একটা পুঁটিলিতে বাঁধলেন। তারপর একটা হাতুড়ি দিয়ে পুঁটুলিটার ওপর
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বজ্রমুষ্টি শ্রীমতী মিলারির হাত ধরে ফেললো। চমকে ঘাড় ঘোরালেন শ্রীমতী মিলারি।
–আপনাকে আমি অপরাধের সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট করতে দেবো না শ্রীমতী মিলারি, বললেন পোয়ারো।
.
১৫.
যবনিকা
একটি আরাম কেদারায় বসে আছেন এরকুল পোয়ারো। স্যার চার্লস, শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট আর হারমিয়োন বসে আছেন রহস্য সমাধানের প্রত্যাশায়।
আপনমনে পোয়ারো বলে চললেন–প্রথমে ব্যারিংটনের মৃত্যু দিয়ে শুরু করি। তিনি যে সন্ধ্যায় মারা যান সেদিনই স্যার চার্লস জানিয়েছিলেন যে এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমি সেদিন ভুল করেছিলাম। অর্থাৎ যে দৃষ্টিকোণ দিয়ে সেদিন দেখেছিলাম, সেটা ছিল ভুল। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে আমি সেই দৃষ্টিকোণটি খুঁজে পেয়েছি।
..তারপর দক্ষিণ ফ্রান্সে সমুদ্রতীরে যেদিন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত পুরোনো খবরের কাগজটি দেখালেন সেদিন বুঝেছিলাম, স্যার চার্লস ঠিকই বলেছিলেন। একই সূত্রে গাঁথা হয়েছে ব্যারিংটনকে, স্যার বার্থালমিউকে, এবং শ্রীযুক্তা রাসব্রিজারকে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, একই লোক আছে এই তিনটি হত্যাকাণ্ডের আড়ালে।
…রহস্য সম্পর্কিত অনুসন্ধানের ব্যাপার আমার নীতি হলো, সবচেয়ে সরল এবং সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রেও সেই নীতি প্রয়োগ করেছি। আপনাদের তৈরি করা সন্দেহভাজন নামের তালিকা থেকে আমি প্রথম চারজনকে একেবারেই বাদ দিয়েছিলাম। তারা হলেন, ডেকার্স দম্পতি, অভিনেত্রী এঞ্জেলা আর নাটক লেখিকা শ্রীমতী উইলস। এছাড়া তালিকায় আরো তিনটি নাম ছিল– লেডি মেরি, হারমিয়োন ও অলিভার। এদেরকে সন্দেহ করিনি ঠিকই আবার সন্দেহের বাইরেও রাখিনি। পরে অবশ্য প্রমাণের অভাবে সেই সন্দেহ থেকে ওঁরা মুক্তি পেয়েছিল।
…স্যাটার্থওয়েট অলিভারকে সন্দেহ করেছিলেন। অবশ্য তার সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ ছিলো, সেটা আপনারা জানেন।
হত্যাকারী জানতো যে ঐ সাতজনকে অনিবার্যভাবে সন্দেহ করা হবে। তাই সে বুদ্ধি খাঁটিয়ে দুটি পার্টিতেই এমনভাবে উপস্থিত ছিলো যাতে সে দুজায়গাতেই হাজির ছিলো সেটা ধরা না পড়ে যায়।
…এবার দেখা যাক, কারা কারা প্রথম পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় পার্টিতে ছিলেন না। তারা হলেন, স্যার চার্লস, শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট, শ্রীমতী মিলারি, শ্রীযুক্তা ব্যারিংটন, এবং স্বর্গত ব্যারিংটন।
এঁদের মধ্যে দ্বিতীয় পার্টিতে ছদ্মবেশে বা নিজের পরিচয় গোপন রেখে হাজির থাকার সম্ভাবনা ছিল কার কার মধ্যে সেটা লক্ষ্যণীয়। দক্ষিণ ফ্রান্সে তখন ছিলেন স্যার চার্লস এবং শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট। শ্রীমতী মিলারি ছিলেন লণ্ডনে। শ্রীযুক্তা ব্যারিংটন ছিলেন লুমাউথে। এই দুজনের ছদ্মবেশে দ্বিতীয় পার্টিতে উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা ছিলো না। স্যাটার্থওয়েটের পক্ষে ছদ্মবেশ ধরা অসম্ভব নয়। কিন্তু নানা কারণে সেটা সম্ভব নয়। এবার বাকি রইলেন স্যার চার্লস। তিনি অভিনেতা। ছদ্মবেশ ধারণে অভ্যস্ত। চরিত্রাভিনয়েও তার দক্ষতার কথা সবাই জানেন। এবার দেখুন দ্বিতীয় পার্টিতে তিনি কোন চরিত্র রূপায়ণের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন?
….এবার আসি, এলিসের কথায়। এলিস নামের কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব কখনো ছিলো না। সে বানানো বাস্তব। অর্থাৎ এলিস বাস্তব নয়। তাছাড়া প্রতিটি পরিচারক বা পরিচারিকাই সাক্ষ্যে বলেছে, এলিসের চালচলন ছিলো ভদ্রলোকের মত। অন্য কোনো খানসামার সঙ্গে তার তুলনা হয় না।
…আরো প্রমাণ আছে। বিয়াত্রিচে তার সাক্ষ্যে জানিয়েছে যে এলিস যখন টেলিফোনে আসা একটা খবর বার্থালমিউকে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে জানিয়েছিল তখন তিনি মজা করে বলেছিলেন–আচ্ছা কাজের লোক আমাদের এলিস…মোট কথা স্যার চার্লস এবং বার্থালমিউ দুজনে একটি গোপন ও কৌতুকজনক পরিকল্পনার প্রকৃত উদ্দেশ্য জানতেন।
..যাই হোক এরপর বার্থালমিউ মারা গেলেন। এলিস এবং অন্যান্য সকলকে পুলিস জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তারপরেই এলিস হাওয়া হয়ে গেল। অতঃপর এলিস-ছদ্মবেশ ত্যাগ করে আপন রূপ ধারণ করে দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরে হাওয়া খেতে এবং বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ পুরোনো খবরের কাগজে দেখে ব্যথিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।
…এর পর এলিসের ঘর থেকে চিঠিগুলি আবিষ্কার করেছিলেন স্যার চার্লস স্বয়ং। বার্থালমিউয়ের নাম দিয়ে স্যার চার্লস-ই অলিভারকে রহস্যময় চিঠিটা পাঠিয়ে ছিলেন।
…শ্রীযুক্তা রাসব্রিজার একজন রোগিনী ছিলেন এবং স্যার চার্লসের অপরিচিতা। স্যার চার্লস চেয়েছিলেন আমাদের মনকে বার্থালমিউ ও এলিসের কাছ থেকে রাসব্ৰিজার রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হোক।
…এরপর আসছি শ্ৰীমতী উইলসের ভূমিকায়। তিনি কুরূপা হলে বুদ্ধিমতী ছিলেন। আর আছে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। বার্থালমিউর পার্টিতে তিনিই একমাত্র খানসামাটিকে ভালো করে লক্ষ্য করেছিলেন এবং তাকে অসাধারণ মনে হয়েছিল। শ্রীমতী উইলস এলিসের হাতের জড়লটার উল্লেখ করায় খুব খুশী হয়েছিলেন স্যার চার্লস। কারণ ঐ চিহ্ন দেখে কোনোদিনই ঐ লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু স্যার চার্লসের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার মনে কেমন সন্দেহ জাগলো। তখন তিনি তরকারি পরিবেশন করার ছুতোয় স্যার চার্লসের হাতদুটি ভালো করে পরীক্ষা করেছিলেন। দেখতে চেয়েছিলেন, স্যার চার্লসের হাত দুটিই খানসামা এলিসের হাত কিনা সেটা চেপে রেখে দিলেন মনের মধ্যে। স্যার চার্লস তার বাঁকা হাসি লক্ষ্য করে কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু কিছুটা কি সেটা উদ্ধার করতে পারেননি।
…এবার স্যার চার্লস নতুন একটি রহস্য সৃষ্টি করার জন্য আবার ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। একটি ছোট ছেলেকে দিয়ে শ্রীযুক্তা রাসব্রিজারের নাম করে আমাকে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন এবং একটি কোকোর কৌটো ডাকযোগে তাকে পাঠালেন উপহার হিসেবে যাঁর সঙ্গে স্যার চার্লসের কোনো পরিচয় ছিল না। এবং তাকে কোনোদিন তিনি দেখেননি।
…তারপর আমার ডাকা পার্টিতে স্যার চার্লস মৃত্যুদৃশ্য অভিনয় করেছিলেন। আমি তখন শ্ৰীমতী উইলসকে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করেছিলাম। ঐ সময় তার চোখে চরম বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। তখনই আমার বুঝতে দেরী হলো না যে শ্রীমতী উইলস স্যার চার্লসকে হত্যাকারী হিসাবে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন।
…ফলে শ্রীমতী উইলসের সমূহ বিপদ বুঝে আমি তাকে বাড়ি ছেড়ে কয়েক দিনের জন্য অন্যত্র থাকার উপদেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার আশঙ্কা যে ঠিক ছিল তার প্রমাণ পরের দিন সন্ধ্যায় শ্রীমতী উইলসের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার উদ্দেশ্য নিয়ে স্যার চার্লস তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। কিন্তু তাকে তিনি পান না।
..স্যার চার্লসের মতো বুদ্ধিমান লোক একটা ভুল করেছিলেন। তিনি শ্রীযুক্তা রাসব্রিজারের নামে আমাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই কেসটা যে আমি হাতে নিয়েছি সেটা শ্ৰীযুক্তা রাসব্রিজার জানতেন না কারণ সে সম্ভাবনা মোটেই ছিল না।
স্যার চার্লস গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের মধ্যে পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন শ্রীযুক্ত পোয়ারো, আপনার কল্পনাশক্তি অপূর্ব। আপনার ধারণা আমিই হত্যাকারী। কিন্তু দয়া করে কি বলবেন, আমার আজীবনের বন্ধু বার্থালমিউকে কেন আমি হত্যা করলাম?
–আমি জানি, এ প্রশ্ন আপনি করবেন। উত্তরও আমার জানা আছে। স্যার চার্লস, বহু নারী সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা আছে যথেষ্ট। ফুলে ফুলে মধু খেয়েছেন অনেক। হারমিয়োন আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, এটা আমার অজানা ছিল না। সে আসলে ভালোবেসেছিল আপনার খ্যাতিকে। আপনি হারমিয়োনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিয়ে করতে পারেননি। কারণ আপনি বিবাহিত ছিলেন। বিখ্যাত হওয়ার আগে আপনি বিয়ে করেছিলেন। তাই আপনি বিবাহ বিচ্ছেদ না করে বিয়ে করতে পারছিলেন না। আইন অনুসারে বিবাহ বিচ্ছেদ মঞ্জুর হয় না দুটি ক্ষেত্রে, এক, স্ত্রী যদি দীর্ঘ মেয়াদী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে থাকে এবং দুই হলো, সে যদি পাগলা গারদে থাকে।
…আপনার ক্ষেত্রে এই দুটির একটি ঘটেছিল। একথা একমাত্র স্যার বার্থালমিউ জানতেন। তিনি এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেননি, বলতেনও না। বহু মেয়ের সঙ্গে আপনার অতিরিক্ত মেলামেশা তিনি মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু হারমিয়োনের ক্ষেত্রে তিনি সেটা হতে দিতেন না। আমার ধারণা, তিনি এ ব্যাপারে আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন।
..তাই হারমিয়োনকে বিয়ে করার জন্য বার্থালমিউকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন।
..ব্যারিংটনের মৃত্যু হলো দ্বিতীয় মৃত্যুর মহলা বা রিহার্সাল। স্যার চার্লস জানতেন অভিনয় মঞ্চস্থ করার আগে মহলা ফিরে নিতে হয়। মহলা নিখুঁত হলো। স্যার চার্লস ধরে নিলেন যে মঞ্চে নাটকটা উতরে যাবে!
…একজন কিন্তু স্যার চার্লসকে হত্যাকারী হিসাবে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি হলেন শ্ৰীমতী মিলারি। তিনি মনে মনে স্যার চার্লসকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তিনি জানতেন, তিনি কুরূপা। তাই মনের ভালোবাসা নিজের অন্তরের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি জানতেন, রাসায়নিক জিনিসপত্র নিয়ে স্যার চার্লস পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। বাগানের গাছপালার জন্য নানারকম রাসায়নিক পদার্থ তিনি আনতেন। গোলাপ গাছের জন্য এক ধরনের স্প্রে আনতেন। শ্রীমতী মিলারি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে এই জিনিসটি নিকোটিন থেকে তৈরি হয়। তিনি সব কিছু আন্দাজ করে স্যার চার্লসকে বিপদমুক্ত করতে চাইলেন, হারমিয়য়ানকে বিয়ে করে তিনি যাতে সুখী হন এটা চেয়েছিলেন। তাই স্যার চার্লসের অপরাধের প্রমাণ লোপ করার জন্য শ্রীমতী মিলারি কাউকে কিছু না জানিয়ে লুমাউথে চলে যান। আমি তাকে অনুসরণ করি এবং বলা বাহুল্য, তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলি।
..এছাড়া স্যার চার্লসের অপরাধের বিরুদ্ধে আরো প্রমাণ আছে। ইংল্যাণ্ড থেকে ফ্রান্সে আপনার আসা যাওয়ার হিসেব আপনার পাশ পোর্ট থেকে পাওয়া যাবে। এছাড়া এদেশের একপ্রান্তে একটি পাগলা গারদে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন শ্রীযুক্তা গ্ল্যাডিস মেরি মাগ। চার্লস মাগ নামের একটি লোকের স্ত্রী তিনি।
হারমিয়োন কাঁদতে লাগলো। সে থরথর করে কাঁপছে। পোয়ারার একটি হাত ধরে বললো আপনি ঠিক বলছেন?
–হ্যাঁ, হারমিয়োন, আমি সত্যি বলছি, হারমিয়োন অজ্ঞান হয়ে গেল।
স্যার চার্লস যেন হঠাৎ বুড়ো হয়ে গেছেন। তার মুখে সর্বস্ব হারানোর ছাপ ফুটে উঠেছে। শেষবারের মত হারমিয়োনের দিকে তাকালেন। তারপর পোয়ারোকে লক্ষ্য করে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ওঁর এখন মহাপ্রস্থানের পালা। কিভাবে সেটা সম্পন্ন হবে সেটা নিজেই উনি ঠিক করে নেবেন, পোয়ারো বললেন।
ইতিমধ্যে হারমিয়োনের জ্ঞান ফিরে এসেছে। পোয়ারো তাকে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে বললেন। নিচু গলায় কথাবার্তা বলছিলেন পোয়ারো এবং স্যাটার্থওয়েট।
এমন সময় দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে এসে ঢুকলো অলিভার।
হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আপনার ফোন পেয়ে এসেছি। হারমিয়োনের কি হয়েছে?
–কিছু হয়নি। পোয়ারো হারমিয়োনের কাছে এগিয়ে গেলেন। তার চোখে জল টলটল করছে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে পোয়ারো বললেন, হারমিয়োন, আমি চাই, তুমি শক্ত মাটির ওপর সুখের বাসা তৈরি করো।
অলিভারের বুঝতে বাকি রইলো না কিছু। সে পোয়ারোর কাছে এগিয়ে এসে বললো– আপনার কথার অবাধ্য হবো না আমি।
তারপর হারমিয়োনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। হারমিয়োন তার হাত শক্ত করে ধরলো। ওরা চলে গেল। পোয়ারো আর স্যাটার্থওয়েট মুগ্ধ দৃষ্টিতে শেষ দৃশ্যটি দেখলেন, মিষ্টি হাসি দেখা দিলো তাদের ঠোঁটের কোণে।