- বইয়ের নামঃ দি কিং অফ ক্লাব
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
দি কিং অফ ক্লাব
১. ডেইলি নিউজমঙ্গার পত্রিকা
দি কিং অফ ক্লাব (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
এরকুল পোয়ারো ডেইলি নিউজমঙ্গার পত্রিকাটা একবারে সরিয়ে রেখে বলে উঠল, এমন এমন সাজানো ঘটনা আছে যার কাছে সত্য ঘটনা হার মেনে যায়।
এই উক্তিটি সম্ভবত নকল। মনে হয় আমার বন্ধুটি কোনো বিষয়ের ওপর অভিমান করে একথা বলেছেন। ছোটখাটো মানুষটি তার ডিমের মত মাথাটা একপাশে ঘুরিয়ে ট্রাউজারের ভাজ যাতে নষ্ট না হয় তাই খুব সতর্কভাবে ট্রাউজারের ধুলো ঝাড়ল। হেস্টিংস খুবই ভাবনাশীল।
তার এই ধরনের উপহাসসূচক কথাবার্তা শুনে বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ না করে কাগজটার দিকে হাত বাড়ালাম আমি। সকালের এই কাগজটা তুমি পড়েছ?
পড়েছি এবং তারপর সেটা সহানুভূতির সঙ্গে ভাঁজ করে রেখেছি। তুমি যে রকমভাবে মেঝের ওপর সেটা ফেলে দিলে সেরকম আমি করিনি। সমস্ত কিছুরই একটা নিয়মশৃঙ্খলা ও পদ্ধতি আছে। সবচেয়ে বড় দুঃখের কথা কি জানো সেই বোধটুকু তোমার মধ্যে নেই। (পোয়ারোর এটাই খারাপ দিক। নিয়ম আর পদ্ধতি হল তার ঈশ্বর। তার দৌড় এতই যে, সে তার সব সাফল্যই উৎসর্গ করে থাকে এদের উদ্দেশ্যে।)।
ও তাহলে তুমি থিয়েটার হলের কর্মসচিব হেনরী রীডবার্নের খুনের ঘটনাটা পড়েছ? আমার এই মন্তব্যটি খুনের পরিপ্রেক্ষিতেই। অনেক সময় সত্য ঘটনা সাজানো কাহিনীর কাছে শুধু মিথ্যে হয়ে দাঁড়ায় না, নাটকীয়ও হয়ে দাঁড়ায়। সেই সুপ্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত ইংরেজ অগল্যাণ্ড পরিবারের কথা চিন্তা করে দেখ, মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে ও দেশের হাজার হাজার পরিবারের আদর্শ তারা। পরিবারের পুরুষরা শহরে যায় কাজ করতে আর নারীরা বাড়ির কাজ করতে থাকে। তাদের জীবন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। গতকাল রাত্রে তারা তাদের শহরতলীর ডেইজিমেড স্ট্রেথামের বাড়ির ড্রইংরুমে বসে ব্রীজ খেলছিল। আচমকা আগে থেকে কোনো সতর্কবাণী না জানিয়ে জানলার কপাট খুলে গেল এবং একজন মহিলা ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার ধূসর রঙের সার্টিনের ফ্রকে লাল দাগ লেগে থাকতে দেখা যায়। মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হবার আগের মুহূর্তে তার মুখ দিয়ে একটামাত্র শব্দ উচ্চারিত হয়েছিল, খুন! ভ্যালেরি সেন্টক্লেয়ার, সম্প্রতি লণ্ডনে ঝড় তোলা বিখ্যাত নর্তকী সে, তার ছবি দেখেই তারা তাকে চিনে থাকবে!
পোয়ারো জানতে চাইল, দি ডেইলি নিউজমাঙ্গারের রিপোর্ট? না তোমার কথার মারপ্যাঁচ?
সংবাদটা দ্রুত প্রেসে দেওয়ার তাগিদ ছিলো দি নিউজমঙ্গারের –আর প্রকাশিত সংবাদটা নেহাতই ঘটনাভিত্তিক। কিন্তু এ কাহিনীর নাটকীয় সম্ভাবনার কথা সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় খেলে যায়।
পোয়ারো ভাবুক ভাবে মাথা নাড়লো। মানুষ যেখানে সেখানেই মানুষের জীবন এবং তার নাটক। জীবন নিয়ে নাটক? তুমি যা চিন্তা করছ সবসময় তা নাও হতে পারে। তবু তা সত্ত্বেও আমি এই কেসের ব্যাপারে আগ্রহী কেন জানো? এই কেসের সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়তে পারি।
সত্যি তাই?
হ্যাঁ, আজ সকালে একজন ভদ্রলোক আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন যে মাওরানিয়ার রাজকুমার পলের পক্ষে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
কিন্তু এর সঙ্গে তার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
তুমি নিশ্চয় ইংরেজি দৈনিকের কলঙ্কের ঘটনার সংবাদগুলো পড়নি। সে সবের মধ্যে একটা মজাদার ঘটনা হলো একটি নেংটি ইঁদুর শুনেছে– কিম্বা একটা ছোট্ট পাখি শুনতে চায়– এখানে দেখ!
পোয়ারো তার ছোট্ট বেঁটে মোটা আঙুল দিয়ে একটি পরিচ্ছদের ওপর দেখাতেই আমি সেদিকে তাকালাম। বিদেশী রাজকুমার এবং বিখ্যাত নর্তকীর সম্পর্ক কি সত্যি সত্যি অন্তরঙ্গ? আর নতুন হীরের আংটিটা কি মহিলাটির পছন্দ?
পোয়ারো ওই নাটকীয় বিশ্লেষণ প্রসঙ্গ শুরু করতে গিয়ে বলল, তোমার মনে আছে নিশ্চয়, ডেইজিমেডের ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার সবেমাত্র তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে
আমি কাঁধ নাড়িয়ে বললাম, হ্যাঁ মানে আছে বৈকি! সে যখনই ঐ শব্দটা অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল ঠিক তখনই অগল্যাণ্ড পরিবারের দুজন পুরুষ সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, একজন ছুটে যায় মহিলাটির চিকিৎসা করানোর জন্য ডাক্তার আনতে, আর একজন ছুটে যায় পুলিস স্টেশনে সেখানে সে তার আতঙ্কের কাহিনী বলে পুলিসকে সঙ্গে নিয়ে মনডেসারে মিঃ রীভবার্নের চমৎকার ভিলায় যায়, ডেইজিমেড থেকে জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়। সেই বিখ্যাত মানুষটিকে সেখানে তারা দেখতে পায়, এক অপ্রীতিকর ঘটনায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাকে। লাইব্রেরীতে পড়েছিলেন তিনি। দূর থেকে তার মাথার পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছিল, মাথাটা ফেটে চৌচির, ডিমের খোলার মতোন।
পোয়ারো নরম গলায় বলল, আপনার ভাবধারার অনুগামী আমিও, আমাকে ক্ষমা করবেন।
কাউন্ট ফিওডরের ভূমিকায় আমাদের সম্মানিত অতিথির আবির্ভার ঘটল সেখানে। আশ্চর্য চেহারা তার। দীর্ঘদেহী, চোখেমুখে একটা অদৃশ্য ইচ্ছার ছাপ স্পষ্ট, পাতলা চিবুক বিখ্যাত মোরানবার্নের আদলে মুখ, এবং কালো গভীর চোখ থেকে মুঠো মুঠো আগুন ঝড়ে পড়ছিল যেন।
মঁসিয়ে পোয়ারো?
তাকে মাথা নিচু করে আমার বন্ধুটি অভিবাদন জানাল।
মঁসিয়ে আমি প্রচণ্ড অসুবিধেয় পড়েছি, সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না…আমি খুবই চিন্তাগ্রস্ত।
পোয়ারো তাকে হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিতে চাইল। আপনার দুশ্চিন্তার কথা আমি উপলব্ধি করতে পারছি। মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার প্রিয় বান্ধবী ছিলো আপনার, তাই না?
রাজকুমার খুব সহজভাবে বলল, আশাকরি ওকে আমি আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারব।
পোয়ারো তার দিকে বড় বড় চোখে তাকাল।
রাজকুমার বলতে থাকেন, আমাদের পরিবারের মধ্যে আমিই প্রথম অসবর্ণ বিয়েতে আবদ্ধ হতে যাচ্ছি না। আলেকজাণ্ডারও সাম্রাজ্যকে তুচ্ছ করে দেখেছিল। আমরা এখন সুখে আছি। সাবেকি জাতপাতের সংস্কার থেকে মুক্ত। তাছাড়া সত্যি কথা বলতে কি মাদমোয়াজেল আমার সমগোত্র। আশাকরি আপনি তার ইতিহাস শুনেছেন অথবা কিছু আভাষ পেয়েছেন।
অনেক রোমান্টিক কাহিনী আছে ওকে ঘিরে বিখ্যাত নর্তকীদের কাছে সে কাহিনী একেবারে মানানসই নয়। আমার শোনা কথা তিনি একজন পরিচারিকার মেয়ে, আবার এও শুনেছি তার মা নাকি রুশীয়–ডাচেস ছিলেন।
যুবকটি বলল–প্রথম কাহিনীটি বাজে এবং বানানো গল্প, তবে দ্বিতীয়টি মিথ্যা নয় আর তার পরিচয় গোপন রাখা উচিত। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। আর সে তার অবচেতন মনে সহস্রবার তার প্রমাণ দিয়েছে। আর আপনি এটাও জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি বংশগত ব্যাপারটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি।
পোয়ারো ভাবুক চিত্তে বলল, বংশগত ব্যাপারটায় আমিও অবশ্য অবিশ্বাসী নই। আমি এই ব্যাপারে কিছু কিছু আশ্চর্য জিনিষও লক্ষ্য করেছি। এবার আমি কাজের কথায় আসছি মঁসিয়ে লা প্রিন্স, আপনি আমাকে দিয়ে কি করাতে চান? আপনার কিসের ভয়? আমিও কি ভয় পাচ্ছি না? এই অপরাধের সঙ্গে মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার কি জড়িত? তিনি কি রীডবাকে জানতেন না?
অবশ্যই চিনতেন, কেননা তিনি সকলকে বলে বেড়িয়েছেন যে, তিনি সেন্টক্লেয়ারকে ভালোবাসেন।
আর তিনি?
তাঁকে কিছুই বলার ছিল না।
পোয়ারো তার দিকে কৌতূহল ভরে তাকাল। আচ্ছা তাকে ভয় পাওয়ার মতো কোনো কারণ কি ছিলো সেন্টক্লেয়ারের।
যুবরাজ একটু ইতস্তত করে, এরই মাঝে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যায়। আলোকদৃষ্টি সম্পন্ন জারাকে কি আপনি চেনেন?
না।
তিনি খুব ভালো মহিলা। আপনার একবার তার সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। ভ্যালেরি আর আমি গতসপ্তাহে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাদের কার্ডগুলো পড়ে দেখেন, ভ্যালেরিকে তার বিপদের কথা বলেন তিনি। তার ভাগ্যের আকাশে নাকি মেঘ জমে উঠেছে। তারপর তিনি শেষ কার্ডটি ওল্টান–ওরা যেটাকে তুরুপের তাস বলেন আর কি। চিড়িতনের সাহেব। ভ্যালেরিকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, একটি লোক তার ক্ষমতা দ্বারা আপনাকে বশ করতে চায়। তাকে আপনি ভয় করেন; তার দ্বারা আপনার এমন বিপদ হবে। আমার অনুমান আপনি তাকে চেনেন, চেনেন না? ভ্যালেরির মুখ সাদা ও ফ্যাকাশে হয়ে যায়, তখন সে মাথা নেড়ে বলে, হা হা, আমি অনেক চিনি। তার কিছুক্ষণ পরে আমরা সেখান থেকে চলে আসি। ভ্যালেরির প্রতি জারার শেষ সতর্কবাণী হলো–চিড়িতনের সাহেবকে সাবধান। তার দিক থেকে আপনার বিপদ ঘনিয়ে আসছে! ভ্যালেরিকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু ও কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল সব ঠিক আছে, কিন্তু গতকাল রাতের পর এখন আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, রীডবার্নের মধ্যেই চিড়িতনের সাহেবকে প্রত্যক্ষ করে থাকবে ভ্যালেরি। ও তাকে দারুণ ভয় পেয়েছিল।
তারপর কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থেকে যুবরাজ আবার মুখ খুললেন, আজ সকালে সংবাদপত্রের পাতায় চোখ পড়তেই কেন যে আমি ভয় পাই তার কারণ আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। ধরুন যদি ভ্যালেরির অবস্থা এখন উন্মাদের মতো হয়ে যায়–ওহো, সেটা সম্ভব নয়!
পোয়ারো উঠে দাঁড়ালো। যুবরাজের পিঠের ওপর সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, আমার একান্ত অনুরোধ, দয়া করে আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না। ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।
আপনি কি তাহলে স্ট্রেথামে যাবেন? আমার কাছে সংবাদ আছে, এখনো ও সেখানেই আছে, মানে ডেইজিমেডে–ঘটনার আকস্মিকতায় দারুণ আতঙ্কিত ও এখন।
হ্যাঁ, আমি এখনি যাচ্ছি।
আমি রাষ্ট্রদূতের মারফৎ সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। আপনার প্রবেশাধিকার সর্বত্র থাকবে।
আমরা এখন তাহলে যাচ্ছি। তারপর পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গী হবে নাকি হেস্টিংস?
আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ।
বিদায় মঁসিয়ে লা প্রিন্স।
.
যেন এক অত্যাশ্চর্য চমৎকার ভিলা মনডেসার, আরামদায়ক এবং স্মৃতিবিজড়িত। রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে বাড়িটা। বাড়ির পেছন দিকে কয়েক একর জমি নিয়ে একটি সুন্দর বাগান।
যুবরাজ পলের নাম বলতেই বাৰ্টলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘটনাস্থলে নিয়ে গেল। খুব সুন্দর একটা লাইব্রেরী রুম। সমস্ত বাড়িটার পেছন থেকে সামনে পর্যন্ত জুড়ে এই লাইব্রেরীর রুমটা। দু ধারে একটি করে জানলা–একটা জানলা সামনে গাড়ি চলার পথের দিকে, আর অন্যটি বাড়ির পেছনে বাগানের দিকে। এই লাইব্রেরী ঘরেই মৃতদেহ পড়েছিল। পুলিস তাদের তদন্তের কাজ সেরে কিছুক্ষণ আগে মৃতদেহ অন্য জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করেন।
পোয়ারোকে আস্তে আস্তে বললাম, এটা খুবই অস্বস্তিকর। কে জানে কোন কোন ব্লু তারা নষ্ট করে ফেলেছে?
আমার বেঁটে বন্ধুটি হাসল। হেঁ, হেঁ! আমি বারবার বলেছি যে কোনো পরিস্থিতিতে ঘটনাস্থল থেকে ব্লু খুঁজে বার করা যায়। প্রতিটি রহস্যের সমাধান লুকানো থাকে ছোট ছোট ধূসর মস্তিষ্ক কোণে।
সে বাটলারের দিকে চেয়ে দেখল। আমার মনে হয় মৃতদেহ সরানো ছাড়া ঘরের আর কোনো জিনিষ ছোঁয়া হয়নি?
না স্যার, গতকাল রাত্রে পুলিসের লোক এখানে আসার আগে যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটি আছে।
জানলার ওপরে ওই যে পর্দাগুলো তোলা রয়েছে, গতকাল রাত্রেও পর্দাগুলো সেরকম ভোলা ছিল?
হ্যাঁ, আমি প্রতিদিনই পর্দাগুলো তুলে দিয়ে থাকি কিন্তু গতকাল রাত্রে ওই কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারিনি।
তাহলে মনে হয় মিঃ রীডবার্ন নিজে নিজেই পর্দাগুলো তুলে দিয়ে থাকবেন।
স্যার আমারও তাই মনে হয়।
তুমি কি মনে কর, তোমার মনিব গতকালে অতিথি আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল?
না স্যার, তিনি তো সেইধরনের কোনো কথা আমাকে বলেননি। তবে তিনি আমাকে সাবধান করে বলেছিলেন রাতের খাওয়ার পর আমায় যেন কেউ বিরক্ত না করে, একটা কথা স্যার, বাড়ির একদিকে টেরেসের পথে লাইব্রেরীর থেকে বাইরে বেরুবার একটা দরজা আছে। হয়তো তিনি সেই দরজা পথে কাউকে ডেকে থাকবেন।
তার সেরকম অভ্যাস ছিলো নাকি?
বাটলার একটু কেশে জবাব দিল, আমি তো সেটাই বিশ্বাস করি।
পোয়ারো সেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। টেরেসে সেই দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ডান দিকে গাড়ি চলার রাস্তা আর বাঁ-দিকে লাল ইটের দেওয়াল।
এইদিকটা একটা ফলের বাগান আছে স্যার। আরোও একটা দরজা আছে, তবে সেটা সন্ধ্যে ছটার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পোয়ারো মাথা নাড়ল! সে পুনরায় প্রবেশ করল লাইব্রেরীতে। বাটলার তার পিছু পিছু গেল।
গতকাল রাতের ঘটনার কোনো কিছুই কি তোমার কানে আসেনি?
হা স্যার; ঠিক রাত নটা বাজার কিছুক্ষণ আগে লাইব্রেরী থেকে একটা গলার আওয়াজ আমাদের কানে আসে, তবে সেটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে যখন একজন মহিলার গলার আওয়াজ। তবে অস্বীকার করব না, আমরা যখন সারভেন্টস হলের দিকে চলে যাই তখন আমরা কিছুই শুনতে পাইনি। তারপর ঠিক রাত এগারোটায় পুলিস আসে।
তা তোমরা কতজনের গলার আওয়াজ শুনেছিলে?
তা আমি বলতে পারব না। তবে একটি মহিলার গলার আওয়াজ আমি শুনতে পেয়েছিলাম।
আহ!
আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার, তবে ডঃ রয়ান এখনো এই বাড়িতে আছেন। তার সঙ্গে আপনি দেখা করতে পারেন।
আমরা লাফিয়ে উঠলাম, প্রস্তাবটা অবশ্যই লোভনীয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি মাঝবয়সী, সদাহাস্যময় ডাক্তার এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হল। আর পোয়ারোর সমস্তরকম দরকারী সংবাদই তাকে দিল। রীডবার্ন জানলার ধারে পড়েছিলেন। মাথাটা মার্বেল পাথরের দিকে আর পা দুটো ছড়ানো রয়েছে। মার্বেল পাথরের দিকে তার দেহে দুটো ক্ষতের চিহ্ন লক্ষ্য করা গেল। একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতের চিহ্ন–সেটি মাথার পিছন দিকে। আর দ্বিতীয়টি দুচোখের মাঝখানে।
তিনি কি চিৎ হয়ে পড়েছিলেন?
হ্যাঁ, তার চিহ্ন এখনো দেখা যাচ্ছে। সে এইসব কথা বলতে বলতে পোয়ারোকে মেঝেতে কালচে দাগগুলো দেখাল।
আচ্ছা এওতো হতে পারে যে, পেছন দিক দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে থাকবে।
সেটা সম্ভব নয়। সেই অস্ত্র যেরকমই হোক না কেন, অল্প কিছু দূরত্ব থেকে মাথার খুলিতে বিদ্ধ করা হয়নি সেটা।
পোয়ারো চিন্তিত মুখে সামনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। প্রতিটি জানলার খাঁজে রয়েছে ধনুকের মত মার্বেল পাথর বসানো। তার হাতগুলো সিংহের মাথার মতন।
পোয়ারোর চোখদুটো আলোকিত হয়ে উঠল। তখনি সে বলে উঠল, ধরে নেওয়া যাক, পশ্চাৎ থেকে তিনি সিংহের মাথার উপর ঢলে পড়েন এবং সেখান থেকে তিনি পড়ে যান মাটিতে। আপনি যেভাবে বর্ণনা দিলেন তাতে করে এইভাবে আঘাতের চিহ্নটা হতে পারে না?
হ্যাঁ, তা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু যেভাবে তিনি যে জায়গায় পড়ে ছিলেন তাতে করে এ যুক্তিটা শুধু খাটে না নয়, সম্ভবও নয় বলা যায়। তাছাড়া জানলার মার্বেল পাথরে এতটুকু রক্তের চিহ্ন দেখা যায়নি।
যদি সেখান থেকে রক্তটাকে মুছে ফেলা হয়ে থাকে? ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন তা অসম্ভব কিছু নয়। আর এর ফলে খুনির খুন করবার কথা, উপস্থিতির কথা জানবার কিছু থাকবে না।
পোয়ারো তাকে সমর্থন করে বলল, তা ঠিক। আচ্ছা আপনি কি মনে করেন কোনো মহিলা তাকে ঘুসি মেরে বা আঘাত করে এরকম করতে পারে।
ওহো, আমি বলব এটা একেবারে প্রশ্নের বাইরে। আমার অনুমান, আপনি কি মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ারের কথা চিন্তা করছেন?
পোয়ারো নিজেকে সংযত করে বলল, আমি অনিশ্চিতের ওপর নির্ভর করে কখনও কারোর কথা চিন্তা করি না।
পোয়ারো তারপর সেই খোলা জানলাপথের দিকে তাকালো। ওদিকে ডাক্তার তখনও বলে চলে–মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার ওই জানলা দিয়েই এখান থেকে পালিয়ে যায়। ভালো করে তাকিয়ে একবার দেখুন গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে ডেইজিমেডের দৃশ্য, রাস্তার ওপর অবশ্য অনেক বাড়ি আছে, কিন্তু ওখান থেকে একমাত্র ডেইজিমেডই চোখে পড়বে, সবথেকে আগে।
পোয়ারো বলল, আপনার আন্তরিক সহযোগিতার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। হেস্টিংস এসো। এখন আমরা মাদমোয়াজেলের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে চলি।
পোয়ারো, ভ্যালেরি সেন্টক্লেয়ারের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। তারপর লোহার গেট পেরিয়ে চলে এল। তারপর তারা সেখান থেকে সবুজ ঘাসের ওপর পা রেখে কয়েকগজ পার হয়ে ডেইজিমেডের বাগানের গেটের সামনে দাঁড়াল।
মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার ওই জানলা দিয়েই ডেইজিমেডে প্রবেশ করে থাকবেন। আমাদের খুব একটা তাড়া নেই এখন কি বলো? অতএব সামনের দরজা দিয়েই ঢোকা ভালো।
একজন চাকরাণী আমাদের দরজা খুলে দিল এবং ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে বসলো। তারপর মিসেস অগল্যাণ্ডের খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গতকাল রাতের পর থেকে ঘরের কোনো কিছুতে যে হাত দেওয়া হয়নি তা বোঝা গেল। ফালতু এবং আজেবাজে জিনিষে ভর্তি ঘরটা। ফায়ার প্লেসে পোড়া ছাই যেমনি পড়েছিল তেমনি রয়েছে। আমি তাসগুলো টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে, অপর তিনজনের হাতের তাসগুলো টেবিলের তিনটে কোণে পড়ে থাকতে দেখা গেল। প্লাস্টার উঠে যাওয়া দেওয়ালের কুৎসিত অংশগুলো ঢাকা পড়ে গেছে অগল্যাণ্ডের পরিবারের অয়েল পেন্টিংয়ের আড়ালে। পোয়ারো আমার চেয়েও তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়ে সেগুলি মনোযোগ সহকারে দেখছিল। মাঝে মধ্যে দু-একটা ছবির তারিফও করছিল সে।
আমি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবারের একটি গ্রুপ ফটোর ওপর দৃষ্টিটা আটকালাম নিপুণভাবে দাড়ি গোঁফ ছাঁটা একজন ভদ্রলোক, মিনি-পাহাড় সমান উঁচু করে চুল বাঁধা একজন মহিলা, একটি মোটাসোটা ছেলে এবং মাথায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত রঙীন ফিতে দিয়ে বাঁধা দুটি ছোট ছোট মেয়ে–এই নিয়ে গ্রুপ ফটোটি তোলা। মনে মনে ভেবে নিলাম, এটা বেশ কয়েক বছর আগের তোলা, তাই খুব মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলাম।
ঠিক এইসময় একজন যুবতী মেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। পোয়ারো সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনিই তো মিস অগল্যাণ্ড। আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আমি খুব দুঃখিত। হাজার হোক গতকাল রাতের ঘটনার পর থেকে আপনারা অল্পবিস্তর এই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছেন। সব ব্যাপারটাই কেমন যেন অস্বস্তিকর।
এই ঘটনার পর সমস্ত কিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। মেয়েটি খুব সাবধানে তা স্বীকার করল। মিস অগল্যাণ্ডকে দেখে আমার মনে হল, গতকাল রাতের সব নাটকীয় ঘটনা তার মুখ থেকে মুছে গেছে আজ। তার প্রমাণ আমি তার কথার মধ্যে পেলাম। ঘরের এই খারাপ অবস্থার জন্যে আমি দুঃখিত। চাকর-বাকররা শুধু উত্তেজিত হতে জানে বোকার মতন। বাড়ির যে আরো অন্য কিছু কাজ থাকতে পারে তা হয় তারা ভুলে যায় নয়তো ভুলে যাবার অভিনয় করে।
পোয়ারো প্রশ্ন করল, আপনারা তো গতকাল রাতে এই ঘরে উপস্থিত ছিলেন?
হ্যাঁ, রাতের আহারের পর আমরা এখানে বসে ব্রীজ খেলছিলাম, তখন
পোয়ারো বাধা দিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, তা কতক্ষণ আপনারা ব্রীজ খেলেছিলেন?
মিস অগল্যাণ্ড মনে মনে চিন্তা করতে থাকল। আমি খুবই দুঃখিত যে, আমি ঠিক বলতে পারছি না। আমার অনুমান তখন রাত প্রায় দশটা হবে। ততক্ষণে আমাদের অনেকগুলো রাবারের খেলা হয়ে গিয়েছিল।
আপনি তখন নিজে কোথায় বসেছিলেন?
সে জানলার দিকে মুখ করে বলল, আমি তখন মার সঙ্গে খেলছিলাম, আর একটা নো ট্রাম্পের ডাক দিয়েছিলাম। আচমকা কোনো সতর্কবার্তা না দিয়েই জানলাটা শব্দ করে খুলে যায় আর মিস সেন্টক্লেয়ার ঘরের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে।
তাকে আপনি চিনতে পেরেছিলেন?
আমি একটা অনুমান করেছিলাম, তার মুখটা পরিচিত।
তিনি তো এখনও এখানেই আছেন, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু তিনি এখনো কারুর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন না। তার সেই অসহায় ভাবটা এখনো কাটেনি।
সে যাহোক, আমার মনে হয় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন। তাকে গিয়ে আপনি বলবেন, মাওরানিয়ার যুবরাজ পলের একান্ত অনুরোধে আমি এখানে এসেছি।
আমার অনুমান যুবরাজের নামটা শোনার পরও মেয়েটার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, সে আগের মতোই শান্ত এবং নিরুত্তাপ রইলেন। তবে সে কোনো মন্তব্য না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সংবাদটা পৌঁছে দেবার জন্য। এবং প্রায় তক্ষুনি ফিরে এসে জানালেন আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার তার ঘরে।
আমরা তাকে অনুসরণ করে ওপরতলার শয়নকক্ষে গেলাম, মোটামুটি মাঝারি আকারের হাল্কা শোবার ঘর। জানলার কাছে থাকা একটা কৌচের ওপর অর্ধেক শোয়া অবস্থায় বসে ছিলেন একটি মহিলা। আমরা ঘরে প্রবেশ করামাত্রই তিনি তার ঘাড়টা ফেরালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার নজরে পড়ল দুটি মহিলার মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল দেখে। মিস অগল্যাণ্ড ও মিস সেন্টক্লেয়ারের মধ্যে রঙ এবং চেহারার একটা পার্থক্য থাকলেও তাদের দুজনের মুখের মধ্যে একটা মিল দেখা গেলো। সেন্টক্লেয়ার ও মিস অগল্যাণ্ডের চাহনি বা আচরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যাহোক ভ্যালেরির মধ্যে এই মুহূর্তে একটা নাটকীয় ভাব প্রকাশ পেতে দেখলাম। তিনি একটা রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছিলেন। তাঁর পা দুটি লাল টকটকে ফ্লানেলের ড্রেসিংগাউনে ঢাকা, এই পোশাকে তার ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
পোয়ারোর ওপর এবার তার বড় বড় দুটি গভীর চোখের দৃষ্টি পড়ল।
আপনি কি পলের কাছ থেকে আসছেন? তার চেহারার সঙ্গে তার গলার স্বর খাপ খেয়ে যাচ্ছে।
হা মাদমোয়াজেল, তার এবং আপনার হয়ে কাজ করতে এসেছি আমি এখানে।
বেশ, কি জানতে চান বলুন?
গতকাল যা যা ঘটেছিল সবকিছুই জানতে চাই আমি।
তার ঠোঁটে একটা করুণ হাসি ফুটে উঠল–আপনার কি মনে হয় আমি সত্যি কথা বলব… না আর সমস্ত কিছুই গোপন রাখব, আমি ঠিক অতটা বোকা নই। আমি জানি এক্ষেত্রে কোনোকিছুই গোপন করা যায় না। ঐ মরা মানুষটি আমার অনেক গোপন খবর জানতেন। তিনি সেই প্রসঙ্গ ধরেই আমাকে ভয় দেখিয়েছিলেন। পলের স্বার্থে আমি তাঁর শর্ত মেনে নিয়েছিলাম। পলকে হারাবার জন্য আমি কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাইনি। তিনি এখন নেই। আমি এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু তা বলে এটা মনে ভাববেন না যে, আমি তাকে খুন করেছি–না, তাকে আমি খুন করিনি।
পোয়ারো মাথা নাড়িয়ে হাসল, মাদমোয়াজেল আমাকে একথা বলার দরকার ছিল না। বরঞ্চ গতকাল রাতে কি ঘটেছিল সেটা মনে করার চেষ্টা করে আমাকে বলুন।
হ্যাঁ, আমার এবার মনে পড়েছে, কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে নিয়ে ভ্যালেরি বলল–আমি তাকে অনেক টাকা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার রকমসকম দেখে আমার মনে হল আমার টাকার প্রতি এতটুকু লোভ নেই, তখন তার মনের মধ্যে শুধু বদ মতলব ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি তখন আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে চাইছিলেন। তিনি গতকাল রাতে আমাকে নটার সময় যেতে বলেছিলেন। আমার মনডেসারে যাওয়ার কথা। আমি জায়গাটা জানতাম। এর আগে বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছিলাম। আমার পাশের দরজা দিয়ে লাইব্রেরীর ঘরে ঢোকার কথা। যাতে করে চাকর-বাকররা আমাকে দেখতে না পায়।
ক্ষমা করবেন, সেদিন অত রাতে ওনার মতো লোকের কাছে আপনার যেতে ভয় করেনি মাদমোয়াজেল।
হয়তো ভয় পেয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার দিকটাও একবার ভেবে দেখুন, আমি একেবারে একা, নিঃসঙ্গ, সেখানে যাওয়ার মতো আমার সঙ্গে কোনো লোক ছিলো না আর তখন আমি মরীয়া হয়ে উঠেছি তার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার জন্য। তিনি আমাকে লাইব্রেরীর ঘরে আহ্বান জানান। ওঃ! সেই নোকটা কী ভয়ংকর! এখন আমি দারুণ আনন্দিত যে, সে এখন মৃত। আমার সঙ্গে ইঁদুর বেড়ালের খেলা খেলছিলেন। তিনি আমাকে ঠাট্টা করেছিলেন, আমি তার কাছে নতজানু হয়ে দয়া ভিক্ষা করেছিলাম। আমি তাকে আমার সমস্ত অলংকার দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সমস্তটাই বৃথা।
তারপর তিনি তার শর্ত আরোপ করতে আমি তা অস্বীকার করি। তার সম্পর্কে আমার ধারণার কথা আমি তাকে বলি। আমি তখন তাঁর ওপর ভীষণ রেগে যাই। তিনি তখন শান্ত হয়ে হাসতে থাকেন। তার শর্তটা যে কি ছিল আপনি নিশ্চয়ই তা অনুমান করতে পারছেন। আমি তখন একেবারে চুপচাপ হয়ে যাই। আমি তখন বুঝতে পারি পাথরের চোখে জল ফোঁটানো গেলেও, ঐ নিষ্ঠুর মানুষটির হৃদয় কিছুতেই টলানো যাবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে জানলার পর্দার ওপার থেকে আচমকা একটা আওয়াজ শোনা যায়। তিনিও উঠে গিয়ে জানলার পর্দাটা তুলে দেন। বোধহয় কোথা থেকে শব্দটা আসছে দেখার জন্য। সেখানে একটা ভয়ংকর বীভৎস আকারের লোককে লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়। সে যেন ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। সে মিঃ রীডবার্নের মাথায় আঘাত করে এবং তক্ষুনি সে পড়ে যায়। ভবঘুরে লোকটি তখন তার রক্তমাখা হাতটা দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরে। তখন আমি কোনোরকমে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে আসি বাঁচার তাগিদে। তারপর এই বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখে ছুটে আসি এখানে। জানলার খড়খড়িগুলো খোলা ছিল। আমি সেখান দিয়ে ভেতরে কয়েকজনকে ব্রীজ খেলতে দেখতে পাই। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ি ঘরের মধ্যে। তখন আমার দম আটকে আসছিল আর চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছিল, কোনোরকমে খুন শব্দটা উচ্চারণ করি।
মাদমোয়াজেল, আপনাকে ধন্যবাদ, আমি বুঝতে পারছি যে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা আপনার স্নায়ুকোষগুলোকে দুর্বল করে দেয়। এখন একটু সেই ভবঘুরে লোকটির কথায় আসা যাক। তার বর্ণনা দিতে পারেন আপনি? সে কি পোশাক পরেছিল, আপনি মনে করতে পারেন?
না–এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটে যে আমি পোশাকটা দেখার সময় পাইনি। কিন্তু একদিন না একদিন নিশ্চয়ই আমি লোকটাকে দেখতে পাব। তার মুখটা এখনও আমার মস্তিষ্কে জ্বলজ্বল করছে।
মাদমোয়াজেল, আপনাকে আর একটা প্রশ্ন করব? আচ্ছা, অন্যদিকের অর্থাৎ গাড়ি চলার রাস্তার দিকের জানলার পর্দাটাও কি ভোলা ছিলো?
পোয়ারোর এই আকস্মিক প্রশ্নের মধ্যে কি ছিলো জানি না, এই প্রথম তাকে হতভম্ব হতে দেখা গেলো। তার মুখের ওপর একটা কালো ছায়া পড়তে দেখা গেলো। মনে হল সে স্মৃতির পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত যে, জানলার পর্দা ভোলা ছিলো না।
এটা খুবই রহস্যজনক, বিশেষ করে অপর জানলার পর্দা ওঠানো ছিল। তার জন্য অবশ্য কিছু নয়। আমি জোর গলায় বলতে পারি, এটা জানা খুব একটা দরকারী কিছু নয়। তা মাদমোয়াজেল, আপনি কি এখানে বেশ কিছুদিন থাকবেন?
ডাক্তারবাবুর ধারণা, আগামীকাল আমি শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠব। তিনি ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। মিস অগল্যাণ্ড চলে গেছে। এ বাড়ির লোকেরা খুব দয়ালু কিন্তু এরা তো পৃথিবীর মানুষ নন। আমি তাদের ভয় দেখিয়েছি। আমার কাছে এঁদের মতোন গৃহস্থ জীবনে আমার আসক্তি নেই। এক জায়গায় বন্ধ হয়ে থাকার মানসিকতা আমার নেই।
তার কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন তিক্ততার ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
পোয়ারো তার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার এই প্রশ্নে আশাকরি আপনি আঘাত পাননি।
না মঁসিয়ে, একদম নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পল যেন সব ঘটনার কথা জানতে পারে।
তা হলে মাদমোয়াজেল, আজকের দিনটা আপনার কাছে শুভ যাক–এই কামনা করে আপনার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি।
পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটুখানির জন্য থমকে দাঁড়ালো। তার দৃষ্টি তখন আটকে গিয়েছিল ঘরের সামনে খোলা একজোড়া চটির ওপর। এই চটিজোড়াটা আপনার মাদমোয়াজেল?
হ্যাঁ মঁসিয়ে। সবেমাত্র ওগুলো পরিষ্কার করে ওখানে রাখা হয়েছে।
আহ! পোয়ারো সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অস্ফুটে বলল–ফায়ার প্লেসের আগুনের ছাই পরিষ্কার করার কথা এ বাড়ির চাকর-বাকরদের মনে না থাকলেও জুতোজোড়া পরিষ্কার করতে এরা ভুলে যায় না। এতে করে দু-একটা উল্লেখযোগ্য পয়েন্টের কথা মনে হলো। কিন্তু আমার ভয়, আবার এটা আমার অনুমানও হতে পারে। এই কেসের এখানেই শেষ বলে ধরে নিতে পারি আমার। কেসটা আমার অতি সহজ সরল বলে মনে হচ্ছে।
আর খুনী?
পোয়ারো কখনো তার শিকার সন্ধানে ভবঘুরেদের পেছনে সময় খরচ করে না, গলা ফুলিয়ে বলল আমার বন্ধুবর।
আমাদের সঙ্গে হলঘরে মিলিত হলো মিস অগল্যাণ্ড। আপনার সঙ্গে আমার মা কথা বলতে চান। সে পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বলল–আপনারা যদি এক মিনিটের জন্য ড্রইংরুমে অপেক্ষা করেন।
ঘরটা এখনো স্পর্শ হয়নি। আলস্যভাবে তাসের কার্ডগুলো একজায়গায় করে পোয়ারো তার ছেটো ছোট আঙুল দিয়ে সাজিয়ে রাখল।
আমার প্রিয়বন্ধু, তুমি কি জানো এখুনি আমি কি ভাবছি?
আমি কৌতূহলভরে বললাম, না।
আমার অনুমান, মিস অগল্যাণ্ড একটা নো-ট্রাম্প কল দিয়ে ভুল করেছিল। তার তিনটে স্পেড কল দেওয়া উচিত ছিলো।
পোয়ারো তোমার একটা মাত্রা থাকা উচিত।
শোনো বন্ধু, আমি সবসময় রক্ত আর ঝড়ঝাঁপটার কথা বলতে চাই না। তার মুখটা হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠল। দেখ, দেখ হেস্টিংস এই তাসগুলোর মধ্যে থেকে চিড়িতনের সাহেব উধাও।
আমি অস্ফুটে চিৎকার করে বললাম, জারা!
হেঁ, হেঁ! মনে হল সে আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না। সে কার্ডগুলোকে ব্যাগের মধ্যে পুরে রাখল। তার মুখটা খুব গম্ভীর হয়ে উঠল।
হেস্টিংস! অবশেষে সে বলল, আমি এরকুল পোয়ারো। আমি একটা খুব বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। খুব বড় ভুল।
আমি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে, তার সেই কথাটা প্রভাবিত করল বটে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে উপলব্ধি করা যায় না।
হেস্টিংস আমার কি মনে হয় জান, আমাকে আবার পুনরায় প্রথম থেকে চিন্তা করতে হবে তবে এবার আর ভুল করব না।
পোয়ারো আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু একটি মাঝবয়সী সুন্দরী মহিলার প্রবেশে বাধা পেলো। তাঁর হাতে একগাদা গৃহস্থালীর বই। পোয়ারো তাকে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানাল।
স্যার, আপনাকে কি আমি মিস সেন্টক্লেয়ারের বন্ধু ধরে নিতে পারি?
মাদাম আমি ওর এক বন্ধুর কাছ থেকে এসেছি।
ওহো, তাই বুঝি! আমি ভেবেছিলাম হয়তো
পোয়ারো আচমকা জানলার দিকে চেয়ে দেখল। গতকাল রাত্রে আপনার জানলার খড়খড়িগুলো নিচে নামানো ছিল না নিশ্চয়?
না, আমার তো তা মনে হয় না, মনে হয় মিস সেন্টক্লেয়ার ঘরের আলো দেখতে পেয়েছিলো।
গতকাল রাত্রে পূর্ণিমার আলো ছিলো। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি যে জানলার দিকে মুখ করে বসে থাকা সত্ত্বেও আপনি আপনার জায়গা থেকে মিস সেন্টক্লেয়ারকে দেখতে পেলেন না?
আমার মনে হয় আমরা তাস খেলায় গভীরভাবে মগ্ন ছিলাম। তাছাড়া এর পূর্বে আমি কখনো এরকম ঘটনা ঘটতে দেখিনি।
মাদাম, আমি সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আর আমার ইচ্ছা আপনার পরিশ্রান্ত মনটা একটু বিশ্রাম পাক। শুনলাম, মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার কালই নাকি এখান থেকে চলে যাচ্ছেন!
ওহো! তাই বলুন। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হল, সেন্টক্লেয়ার চলে যাচ্ছেন দেখে তিনি যেন একটু চিন্তামুক্ত হলেন।
মাদাম, তাহলে এবার আপনাকে সুপ্রভাত জানিয়ে আমার চলে যেতে হচ্ছে।
অতঃপর আমরা ঘর থেকে চলে গেলাম।
সামনের দরজা দিয়ে বাইরে এসে দেখলাম একজন পরিচারিকা সিঁড়ি বঁট দিচ্ছে, পোয়ারো তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, হ্যাঁ বাছা, তুমিই কি ওপরের ওই যুবতী রমণীর চপ্পলজোড়া পরিষ্কার করেছিলে?
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, না স্যার। আমার তো মনে হয় ওই চপ্পলজোড়া পরিষ্কার করা হয়েছে বলে।
রাস্তায় নেমে পোয়ারোকে জিজ্ঞেস করলাম আমি, তাহলে ওগুলো পরিষ্কার করল কে?
কেউ নয়। চপ্পলজোড়া পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয় না।
আমি মনে করি, চমৎকার জ্যোৎস্নার রাতে পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে জুতো বা চটিজোড়াতে কাদা লাগে না।
পোয়ারো বলল, হ্যাঁ, তার ঠোঁটে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল, আমিও তোমার সঙ্গে একমত।
কিন্তু, বন্ধু, আর মাত্র তিরিশ মিনিট ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা কর। আমরা এখন মনডেসারে ফিরে যাচ্ছি।
বাটলার আমাদের পুনরায় ফিরে আসতে দেখে আশ্চর্য হল কিন্তু লাইব্রেরীতে প্রবেশ করার পথে সে বাধা দিলো না।
পোয়ারোকে গাড়ি চলার পথ ধরে এগিয়ে যেতে দেখে, আমি চিৎকার করে বললাম, ওটা ভুল জানলা।
বন্ধু আমার তা মনে হচ্ছে না। তুমি একবার এখানে এসে দেখ। সে মার্বেলের সিংহের মাথাটার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করাল। তার ওপর একটা অস্পষ্ট আঠালো দাগ, তারপর সে তার আঙুল দিয়ে পালিশ করা মেঝের দিকে দেখাল, সেখানেও ঐ একই দাগ লেগে থাকতে দেখা গেল।
হয়তো কেউই রীডবার্নের দু চোখের মাঝখানে ঘুষি মেরে থাকবে। সেই আঘাতে টাল সামলাতে না পেরে পেছন ফিরে পড়ে যান তিনি ঐ মার্বেল পাথরের সিংহের মাথার ওপর। তারপর মেঝেতে পড়ে যান। এরপর তাকে টানতে টানতে অপর জানলার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাকে শায়িত অবস্থায় দেখা যায়, ডাক্তারের কথামতো যদি জানলার সামনে থেকে পড়ে মেঝের ওপর তাহলে যেখানে পড়া উচিত ছিল সেখানে নয়।
কিন্তু কেন?
সমস্ত কিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছে এর কোনো দরকার ছিলো না।
অপরদিকে আবার এরও দরকার ছিলো। কারণ খুনীকে খুঁজে পাওয়ার এটাই ছিলো প্রধান চাবিকাঠি। যদিও তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য তার ছিলো না। তবু তাকে খুনি বলে ধরে নিতে হবে। সে অবশ্য একজন শক্তসমর্থ লোক।
মেঝের ওপর দিয়ে ভারী দেহটা বয়ে নিয়ে গেছে বলে?
না, ঠিক সেই কারণে নয়। কেসটা খুবই আগ্রহব্যঞ্জক। যদিও আর একটু হলে আমি নিজেকে মূর্খ প্রতিপন্ন করে ফেলতাম।
তার মানে তুমি কি বলতে চাও, এখানে সবকিছুর শেষ। তোমার সব জানা হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
না, আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম। তুমি একটা জিনিষ জানো না!
কি সেটা?
তুমি জানো না, সে হারিয়ে যাওয়া চিড়িতনের সাহেবটা কোথায়!
ওহো, এই কথা? সেটা হাসির ব্যাপার! বন্ধু সেটা খুবই হাস্যকর।
কেন?
কারণ সেটা আমার পকেটেই রয়েছে। সে সঙ্গে সঙ্গে সেটা পকেট থেকে বার করে দাঁড়াল।
ওহে! আমি বোকার মতো বলে উঠলাম, তুমি এটা কোত্থেকে পেলে?
এখানে। এটা কোনো সাড়া জাগানো ঘটনা নয়, এটা আসলে প্যাকেটের ভেতরেই ছিলো। প্যাকেট থেকে বার করা হয়নি।
হুম! এই ঘটনা। তোমার কাছে এটা সূত্র বলে মনে হয়েছে, হয়নি?
হা বন্ধু, এই ঘটনায় মহামান্য যুবরাজকে আমার সম্মান দেওয়া উচিত?
আর মাদাম জারাকে!
ওঃ, হ্যাঁ–সেই মহিলাকেও, ভালো কথা, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি।
এখন আমরা শহরে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে ডেইজিমেডে একজন মহিলার সঙ্গে কিছু কথা বলে নিতে চাই।
সেই ছোটখাটো পরিচারিকা আমাদের এবারেও দরজা খুলে দিলো।
স্যার, ওরা এখন সবাই মধ্যাহ্নভোজ সারতে ব্যস্ত–অবশ্য যদি না আপনারা মিস সেন্টক্লেয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান, এখন তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন।
আমি যে মিস অগল্যাণ্ডের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলতে চাই। তুমি তাকে বলবে?
সে আমাদের ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে বসাল, একটু অপেক্ষা করতে হবে। ডাইনিংরুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ওদের একবার দেখে নিলাম। ওদের মধ্যে দুজন শক্তসমর্থ লোককে দেখতে পেলাম, একজনের মোটা গোঁফ আছে, আর একজনের গোঁফ দাড়ি কিছুই নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে মিসেস অগল্যাণ্ড ঘরে এসে ঢুকল। তিনি জিজ্ঞাসু চোখে পোয়ারোর দিকে তাকালেন।
পোয়ারো তাকে মাথা নিচু করে সম্মান জানাল। মাদাম আমরা আমাদের দেশে মায়েদের খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে থাকি। তিনি আমাদের একাধারে জন্মদাত্রী। এবং পূজনীয়া, সবকিছু!
মিসেস অগল্যাণ্ড পোয়ারোর এমন গদগদ ভাব দেখে আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আর একমাত্র সেই কারণেই আমি আবার এখানে ফিরে এলাম মায়ের চিন্তা একটু কমানোর জন্য। মিঃ রীডবার্নের খুনীকে কখনো চিহ্নিত করা যাবে না। আপনার কোনো ভয় নেই। আমি এরকুল পোয়ারো আপনাকে আশ্বস্ত করছি। আমি ঠিক বলছি, না বলছি না? আমার আগে জানতে হবে আমি কাকে বলছি? মাকে না খুনীর স্ত্রীকে?
কয়েক মুহূর্ত সব চুপচাপ। মিসেস অগল্যাণ্ড তার নিজের চোখ দিয়ে পোয়ারোর মধ্যে যেন কি খুঁজে পেলেন। অবশেষে তিনি শান্তভাবে বললেন, জানি না আপনি কিভাবে এতসব সংবাদ পেলেন–তবে হ্যাঁ, আপনার ধারণাই সত্য!
পোয়ারো গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলল, ব্যস, মাদাম এতেই যথেষ্ট। তবে আপনার অস্বস্তি বোধ করার কোনো কারণ নেই। পোয়ারোর মতো চোখ ইংলিশ পুলিসের নয়। এরপর তিনি দেওয়ালে টাঙানো গ্রুপ ফটোটার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।
এক সময় আপনার একটি মেয়ে ছিল। মাদাম সে কি এখন মৃত?
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। তিনি পোয়ারোকে তার চোখ দিয়ে একবার ভালো করে মাপলেন। তারপর উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, সে মৃত।
পোয়ারো আহা! বলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। ঠিক আছে। আমাদের এখনি আবার শহরে ফিরে যেতে হচ্ছে! তাসের প্যাকেটে চিড়িতনের সাহেবটা রেখে দেওয়ার অনুমতি দেবেন আমাকে? আপনার গলতি একটাই মাদাম, কেবল ৫১টা কার্ড নিয়ে একঘন্টা কি আরও বেশি সময় ধরে ব্রীজ খেলা–যাইহোক খেলা সম্বন্ধে যার কোনো ধারণাই নেই, মুহূর্তের জন্য বাহবা দেবে সে আপনাদের। বাঃ বাঃ বেশ!
পোয়ারো স্টেশনের পথে যেতে গিয়ে বলল, বন্ধু, তুমি তো সবই দেখলে।
না, আমি কিছুই দেখিনি! স্পষ্ট করে বলল, কে খুন করেছে রীডবার্নকে?
জুনিয়র জন অগল্যাণ্ড, সে তার বাবাকে খুন করেছে, এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই। তবে তাদের মধ্যে শক্তি ও কম বয়সের দিক থেকে আমি এক্ষেত্রে তাদের ছেলেকেই খুনী হিসাবে চিহ্নিত করতে চাই। ওই জানলার ঘটনার জন্য তাদের দুজনের মধ্যে যে কেউ একজন মিঃ রীডবার্নের খুনী।
কেন?
লাইব্রেরী থেকে বেরোবার চারটি রাস্তা খোলা ছিল–দুটি জানলা, ও দুটি দরজা। তবে একটি পথই ব্যবহার করা হয়, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে বলতে পারি বেরোবার তিনটি পথই বাড়ির সামনের দিকে ছিলো। এই বিয়োগান্ত নাটকের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলো বাড়ির পিছনের দিকে জানলাটা। এর থেকে বোঝা যায় যে, হঠাৎই কোনো কিছু চিন্তা না করে, পেছনের জানালা দিয়ে টপকে সে ডেইজিমেড়ে গিয়ে উপস্থিত হয়। তিনি অবশ্য সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে যান। আর জন অগল্যাণ্ড তাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসে। আর সেই কারণবশতঃ আমি বলেছিলাম যে খুনী একজন শক্তসমর্থ লোক।
সেখানে তাহলে তারা কি দুজনে একসঙ্গে গিয়েছিল?
হ্যাঁ, বন্ধু তোমার মনে আছে নিশ্চয়, ভ্যালেরিকে যখন আমি জিজ্ঞেস করি, সেখানে তার একলা যেতে ভয় করেনি? তখন সে একটু ইতস্তত করেছিল? জন অগল্যাণ্ড তার সঙ্গে গিয়েছিল–তাতে আমার অনুমান, রীডবার্নের তেজ বা ঔদ্ধত্য এতটুকু কমেনি। তারা ঝগড়া করে এবং ভ্যালেরিকে কিছু অসম্মানজনক উক্তি করে থাকবেন। এর ফলে রাগে উত্তেজনায় অগল্যাণ্ড আচমকা তাকে আঘাত করে থাকে। তারপরের ঘটনা তো তোমার জানা।
কিন্তু ওই ব্রীজ খেলার ব্যাপার?
আমরা প্রত্যেকে জানি, চারজন খেলোয়াড় ছাড়া ব্রীজ খেলা যায় না। এই তুচ্ছ ব্যাপারটায় মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় সেই ঘরে মাত্র তিনজন ছিল, তার খবর কেই বা রাখে?
আমি এখনো সেই একই ধাঁধায় পড়ে আছি।
আমি একটা জিনিষ এখনো কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, নর্তকী ভ্যালেরি সেন্টক্লেয়ারের ব্যাপারে অগল্যাণ্ড পরিবারের এত কৌতূল কেন?
পোয়ারো বলল, আহ! তুমি আমাকে অবাক করে দিলে। কেন ড্রইংরুমে তুমি অগল্যাণ্ড পরিবারের গ্রুপ ফটোটা দেখনি। অনেকদিন আগের তোলা ছবি তাতে একটি মেয়ের ছোটবেলার ছবি ছিলো, সেই মেয়েটি তাদেরই মিসেস অগল্যাণ্ড অপর মেয়েটি তার পরিবারের কাছে মৃত হলেও, সেই মেয়েটি হলো মিস ভ্যালেরি সেন্টক্লেয়ার!
কি, কি বললে?
একসঙ্গে দুইবোনকে দেখেও তুমি তাদের চেহারার মধ্যে মিল খুঁজে পাওনি?
আমি অকপটে স্বীকার করলাম যে, না, আমি তখন চিন্তা করছিলাম তাদের দুজনের মধ্যে কি আশ্চর্যরকম অমিল।
এর কারণ কি জান বন্ধু, তোমার মনটা এতই উদার যে, তোমার মনে সবসময় একটা রোমান্টিক ভাব জেগে ওঠে। শোনো ওদের দুজনের শরীর এবং মুখের গড়ন একই। রঙটা শুধু আলাদা। একটা মজার ব্যাপার হলো, ভ্যালেরি তার পরিবারের কাছে লজ্জাকর, আর তার পরিবার তার জন্য লজ্জিত। সে যাইহোক, বিপদে পড়ে সে সাহায্যের জন্য ভায়ের শরণাপন্ন হয়। আর ঘটনাটা যখন গোলমালের রূপ নেয়, তখন তারা একে একে সবাই জড়িয়ে পড়ে। পারিবারিক শক্তি এক অভূতপূর্ব জিনিষ, একই পরিবারের সকল সদস্য বিশেষ ক্ষেত্রে একসঙ্গে লড়তে পারে তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে। তখনি নিজেদের মধ্যে যত ঝগড়া বা রেষারেষিই থাক না কেন। আর ভ্যালেরি তার পরিবারের কাছ থেকে সেই ঐতিহাসিক দক্ষতা লাভ করে। যুবরাজ পলের মত আমি বংশগত ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করি। আমাকে ওঁরা ঠকিয়েছেন? তবে ভাগ্য ভালো যে, একটা ব্যাপারে মিসেস অগল্যাণ্ডকে জিজ্ঞাসা করার মাধ্যমে সেদিন সন্ধ্যায় ড্রইংরুমে তাদের অবস্থানের ব্যাপারে মা ও মেয়ের বক্তব্যের মধ্যে আমি পার্থক্য খুঁজে পাই। এক্ষেত্রে এরকুল পোয়ারোর কাছে অগল্যাণ্ড পরিবার অবশ্যই হার মেনেছে।
পোয়ারো, তুমি এবার যুবরাজ পলকে কি বলবে?
বলব, ভ্যালেরি সম্ভবত কোনো দোষ করেননি, আর এই বলব যে, আমার অনুমান–সেই ভবঘুরে লোকটার খোঁজ কোনোদিন পাওয়া যাবে না। এবং জারাকে জানাব আমার অভিনন্দন। একটা আশ্চর্য রকমের মিল রয়েছে জারার ভবিষ্যৎ বাণীর সঙ্গে এই ঘটনার। আমার তো মনে হয় এই ছোট্ট ঘটনাকে চিড়িতনের রাজার অভিমান বলে আখ্যা দিলে খারাপ হবে না, তুমি কি বলো, বন্ধু?