চেঁচিয়ে উঠলেন ইভ কার্পেন্টার।
-মিথ্যে কথা, একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। আদৌ আমি যাইনি। গী, কেন তুমি বলছ না যে সত্যিই সেই রাতে আমি বাড়ির বাইরে বেরোইনি?
রাগে গী কার্পেন্টারের মুখ লাল হয়ে গেল।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনি অত্যন্ত অপমানজনক কথা বলছেন।
–কি আশ্চর্য! শুধু আমি বলছি যে, আপনার স্ত্রী ওই একই সেন্ট আর লিপষ্টিক ব্যবহার করেন। তাতে হয়েছেটা কি?
–কি বকছেন যা তা। যে কেউ আমার সেন্ট নিয়ে এসে ওঁর ঘরে ছড়াতে পারেন।
হঠাৎ পোয়ারো একগাল হাসলেন।
–ঠিক তাই মাদাম, যে কেউ সেন্ট ছড়াতে পারে ওভাবে, আমাকে এই ধারণাটাই প্রথম আশার আলো দেখায়। কফির কাপ থেকে লিপষ্টিকের দাগ তুলে ফেলা বা কাপটা ধুয়ে রাখা–দুই-ই খুব সোজা কাজ, বিশেষত যখন কেউ বাড়িতে ছিল না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা করা হয়নি। কেন? একমাত্র এর উত্তর হল–কেউ দেখাতে চেয়েছিল হত্যাটা কোনো মহিলাই করেছে।
যে তিনজন মহিলা ফোন পেয়েছিলেন, তাঁরা কেউই কিন্তু মিসেস আপওয়ার্ডের সংগে সোজাসুজি কথা বলেননি। সুতরাং এমনও হতে পারে যে আদপেই ভদ্রমহিলা কোনো ফোন করেননি। কেউ এমন ফোন করেছিল যার মূল উদ্দেশ্য ছিল কোনো একজন মহিলাকে এই ঘটনার সাথে জড়িত করা। কিন্তু কেন? উত্তরও এর একটাই। মিসেস আপওয়ার্ডকে কোনো মহিলা খুন করেননি যে করেছে নিঃসন্দেহে সে একজন পুরুষ।
এরকুল পোয়ারো সমবেত শ্রোতাদের দিকে তাকালেন। ইভ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। পোয়ারো বলে চললেন, সুতরাং কোনো একজন পুরুষ মিসেস আপওয়ার্ডকে খুন করেছে এবং মিসেস ম্যাগিনটিকেও। এবং তার জিম্মাতেই নিশ্চয়ই ইভা কেনের ছবিটা ছিল। মিসেস ম্যাগিনটিকে খুন করার পর খুনী ঐ ছবিটা নষ্ট করার প্রয়োজন বোধ করেনি কিন্তু মিসেস আপওয়ার্ডকে হত্যা করার পর তোক জানাজানি হবার ভয়ে সেটা নষ্ট করে ফেলার দরকার হয়ে পড়েছিল। তবু তা নষ্ট করা হয়নি। এ বাড়িরই একটা দেরাজে সেটা আমি খুঁজে পেয়েছি। এই দেখুন, ইভা কেনের ছবি। এর পেছনে আড়াআড়ি ভাবে লেখা আছে দুটো কথা আমার মা।
-মরিন সামারহেসের ওপর স্থির হল পোয়ারোর দৃষ্টি।
মরিন অবাক হল।
–এসব তো কিছুই আমি বুঝছি না।
–না, মিসেস সামারহেস। এসব সত্যিই আপনার বুঝতে পারার পর ছবিটা রেখে দেবার দুটো মাত্র কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, নিছক আবেগপ্রবণতা। কোনোরকম অপরাধবোধই আপনার মনে নেই। কাজেই আপনি ছবিটা রেখে থাকলে সেটা আশ্চর্যের কিছু ছিল না। নিজের মুখেই আপনি ইভ কার্পেন্টারের বাড়িতে আমাদের বলেছিলেন যে ছেলেবেলায় আপনাকে দত্তক নেওয়া হয়। বোধহয় আপনি আপনার প্রকৃত মায়ের আসল নাম পর্যন্ত জানেন না। কিন্তু আর কেউ সেটা জানেন যিনি কিনা বংশগৌরব, চক্ষুলজ্জা, এসবের ভয়ে আপনার পরিচয় গোপন করতে একটা খুনের দায়ও নিজের ঘাড়ে নিতে প্রস্তুত।
এবার চেয়ার ছেড়ে জনি সামারহেস উঠে দাঁড়ালেন।
–কি বাজে বকছেন। আপনার সবই তো মনগড়া কথা। আমার স্ত্রীর সম্বন্ধে এত অসম্মানজনক কথা বলতে আপনার বাধছে না?
–মেজর, শান্ত হোন। কিছুটা শান্ত হলেন মেজর জনি সামারহেস।
–দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, যে কেউ আমাদের দেরাজে ফটোটা রেখে যেতে পারে।
–ঠিক তাই, মেজর। আর মজাটা হল যে এই ফটোটার ওপর কোনো আঙুলের ছাপ নেই। যদি মরিন রাখতেন তাহলে ছবির ওপর তার আঙুলের ছাপ থাকত।
মরিন চেঁচিয়ে উঠলেন।
–কিন্তু মঁসিয়ে, আমি এ ছবি দেখিনি কখনো জীবনে, একমাত্র সেদিন মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়িতে ছাড়া।
-হ্যাঁ মাদাম, ঠিকই বলেছেন আপনি। আমার চোখে পড়ার ঠিক আগেই এখানে রাখা হয়েছে ফটোটা। আমি দু-দুবার দেরাজের ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্র গুছিয়েছি। প্রথমবার ছবিটা ছিল না, কিন্তু দ্বিতীয়বার ছিল। তার মানে দুবার দেরাজ গোছানোর মাঝের সময়টুকুতে কোনো এক সুযোগে ছবিটা ওর মধ্যে রাখা হয় এবং আমি জানি কে এই কাজটা করেছে।
এখন যেন পোয়ারোর চোখে শিকারীর ধূর্ততা।
–এখানে একজন অপরাধী পুরুষ। নিছক টাকার জন্যই খুন করা হয়েছে। মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়িতে পাওয়া গেছে একটা বই। তাতে নাম লেখা ছিল ইভলিন হোপ, যে নাম ইভা কেন নিয়েছিল, ইংল্যাণ্ড ছাড়ার সময়। ইভা কেন তার বাচ্চার নামও বোঝা যাচ্ছে নিয়মানুযায়ী ইভলিন রাখে। কিন্তু ইভলিন যেমন মেয়েদের নাম হয়, তেমন আবার ছেলেদেরও হতে পারে। সানডে কম্প্যানিয়ন জানায় যে ইভা কেনের সন্তান ছিল মেয়ে। বাজে কথা। কারণ ইভ তার সন্তানের জন্মের আগেই ইংল্যাণ্ড ছাড়ে। সুতরাং নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না যে, সে কন্যা সন্তানেরই জন্ম দিয়েছিল। আমিও কাগজের খবরে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। প্রকৃত ঘটনা–ওই ইভা কেনের ছেলে ইভলিন হোপ, ইংল্যাণ্ডে আসে। সে যথেষ্ট প্রতিভাবান সুতরাং একজন বিত্তশালিনী মহিলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যিনি ওর প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সদ্যপুত্র বিয়োগ হয়েছিল ভদ্রমহিলার। ধনী মহিলাটি আইনসঙ্গত ভাবে এই ছেলেটিকে দত্তক নেন। আচ্ছা, মিঃ আপওয়ার্ড, আপনার আসল না তো ইভলিন হোপ। তাই না?
তীক্ষ্ণস্বরে রবিন চেঁচিয়ে বলল, নিশ্চয়ই না। কি বলতে চান আপনি?
-আর অস্বীকার করে লাভ নেই। আপনার আসল নাম বেশ কয়েকজন জেনে ফেলেছে। বইয়ে ইভলিন হোপ নামটা আর ছবির পেছনে আমার মা লেখাটা একই হাতের এবং তা আপনার। আপনার জিনিসপত্র গোছানোর সময় ছবিটা মিসেস ম্যাগিনটির নজরে পড়ে। উনি ছবির পেছনের লেখাটাও পড়েন।সানডে কম্প্যানিয়ন পড়ার পর ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও বলেন। কিন্তু উনি জানতেন না যে, আপনি মিসেস আপওয়ার্ডের দত্তক নেওয়া ছেলে। উনি ভেবেছিলেন মিসেস আপওয়ার্ডই সেই ইভা কেন। পরিষ্কার আপনি বুঝতে পারেন যে মিসেস আপওয়ার্ডের কানে এ কথা উঠলে তিনি আপনাকে সত্য গোপন করার অপরাধে কখনোই ক্ষমা করবেন না আর আপনাকে তার বাড়িতেও স্থান দেবেন না। তাই খুন করার সংকল্প নিয়ে আপনি মিসেস ম্যাগিনটির বাড়ি যান এবং ওঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। ঠিক এইভাবে…।