–আর কথা বলতে পারছি না আমি, বরং চুপ করে একটু শুয়ে থাকি।
-যাই, তোমার খাবার দেবার জন্য মডকে তাড়া দিই গিয়ে। দৌড়ে ঘর থেকে ডীডার বেরিয়ে গেল। ওর কনুইয়ের ধাক্কায় যাবার সময় পেতলের একটা ছোট্ট মূর্তি টেবিলের ওপর থেকে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল।
–এত তাড়াহুড়ো করে মেয়েটা।
মিসেস ওয়েদারবি মন্তব্য করলেন।
খুলে গেল দরজাটা। ঘরে ঢুকলেন মিঃ ওয়েদারবি।
দু-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার পর চোখ খুললেন মিসেস ওয়েদারবি।
-ওঃ, রজার তুমি।
–কিছুতেই আমি ভেবে পাই না এত গোলমাল হয় কেন? নিশ্চিন্ত হয়ে এ বাড়িতে একটু পড়াশুনো করারও উপায় নেই।
যাওয়ার সময় ডীডার টেবিলে ধাক্কা লেগে শব্দ হয়েছে। ও এইমাত্র কুকুর নিয়ে ফিরল।
পেতলের মূর্তিটাকে মিঃ ওয়েদারবি উঠিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, অকারণে হুড়োহুড়ি না করার মত বয়স নিশ্চয়ই ডীডারের হয়েছে।
–জানোই তো, ও একটু অন্যরকম।
হতে পারে। কিন্তু ওর এই বয়সে আর একটু শান্ত, সুশৃঙ্খল হওয়া দরকার। ও কি ওর কুকুরটাকেও একটু চুপ করাতে পারে না?
–ওকে আমি বলে দেব, রজার। যদি এ বাড়িতে ও থাকতে চায়, তাহলে ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলো আমাদের মেনে চলতে হবে। তাছাড়া এ বাড়িটা ওর নিজের বলে মনে করাও বাঞ্ছনীয় নয়। ও যেন না ভাবে যে, ওর যা খুশি তাই করতে পারে এ বাড়িতে।
ডীডার চলে গেলেই হয়ত তুমি খুশি হতে রজার।
অর্ধনিমীলিত চোখে লক্ষ্য করছিলেন ভদ্রমহিলা স্বামীকে।
-না না, তা নয় ও আমাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই থাকবে। ওর কেই বা আছে। ওকে আমি বলবখন একটু ভালোভাবে চলাফেরা করতে। এডিথ তুমি কি বেরিয়েছিলে?
–হ্যাঁ। এই ডাকঘরের দিকে একটু গিয়েছিলাম।
নতুন কোনো খবর পেলে, মিসেস আপওয়ার্ডের ব্যাপারে? এখনো পুলিশ জানতে পারেনি কার কীর্তি এটা।
–কোনো কর্মের না পুলিশ। কোনো কারণ পেয়েছে কি খুন করার? কে পাবে ওঁর টাকা পয়সা?
নিশ্চয়ই ওঁর ছেলে। তাহলে এটা বাইরের কোনো ছিঁচকে চোরের কাণ্ড মনে হয়। তোমার বলে রাখা উচিত কাজের মেয়েটিকে যাতে আমাদের বাড়ির সদর দরজাটা বন্ধ করে রাখে সব সময়। বিশেষত সন্ধ্যের পর কেউ এলে চেন লাগিয়ে তবে যেন ছিটকিনি খোলে দরজার। লোক আজকাল বড় নির্মম হয়ে যাচ্ছে।
-যতদূর শুনেছি মিসেস আপওয়ার্ডের কোনো কিছুই খোয়া যায়নি।
–আশ্চর্য।
–মানে মিসেস ম্যাগিনটির বেলায় যা হয়েছিল; সে ধরনের কিছু নয়।
-মিসেস ম্যাগিনটি? ও সেই মহিলাটি। মিসেস আপওয়ার্ডের ওখানে উনি কাজ করতেন।
–এডিথ বোকার মত কথা বোলো না। তাতে হয়েছেটা কি?
চোখ বন্ধ করলেন মিসেস ওয়েদারবি। ঘর থেকে মিঃ ওয়েদারবি বেরিয়ে যেতে উনি একটু আপনমনেই হাসলেন। খানিকক্ষণ বাদে চমকে চোখ খুললেন। মড একটা গ্লাস হাতে ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে।
মাদাম, আপনার পানীয়। মডের পরিষ্কার চাঁছাছোলা গলা। নিস্তব্ধ বাড়িতে কথাটার প্রতিধ্বনি শোনা গেল স্পষ্ট। ওর দিকে মিসেস ওয়েদারবি সতর্কভাবে ভাবলেন। কি লম্বা, ঋজু এই মেয়েটি। দীর্ঘদেহী ছায়ামূর্তির মত ও দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে–ওঁর মনে হল এ কথায়। আবার এ কথাটা হঠাৎ কেন মনে এল, ভেবে অবাক হলেন নিজেই।
কনুইতে ভর দিয়ে উঠে গ্লাসটা উনি হাতে নিলেন। মড ধন্যবাদ।
ঘুরে দাঁড়িয়ে মড দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মিসেস ওয়েদারবিকে কেন কে জানে, মনে হচ্ছিল একটু চিন্তাক্লিষ্ট বলে।
.
২২.
পোয়ারো ব্রডহিনিতে ফিরলেন একটা ভাড়া গাড়িতে করে। তিনি অসম্ভব ক্লান্তিবোধ করছিলেন অতিরিক্ত চিন্তার চাপে। এত চিন্তা করেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। একটা অদৃশ্য নকশার অস্তিত্ব চোখের সামনে অনুভব করছেন অথচ সেটা সূক্ষ্মতার জন্য কিছুতেই তার চোখে ধরা পড়ছে না। পথে সামারহেসদের স্টেশন ওয়াগানটা বিপরীত দিক থেকে তার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র অন্যমনস্ক থাকার দরুন সামারহেস বা ওর সহযাত্রিনীটিকে তিনি খেয়ালই করলেন না।
লং মিডোস-এ পৌঁছে সোজা বসবার ঘরে ঢুকে গেলেন। একটা শাকের বাটি ছিল চেয়ারের ওপর। ওটাকে সরিয়ে আরাম করে বসলেন।
টাইপরাইটারের খটখট শব্দ ওপর থেকে কানে আসছিল। ওর সদ্য লেখা নাটক নিয়ে রবিন ব্যস্ত। পছন্দ হয়নি বলে তিন তিন বার টাইপ করেও ছিঁড়ে ফেলেছে। ওকে নিশ্চয়ই মায়ের মৃত্যু যথেষ্ট আঘাত দিয়েছে। কিন্তু নিজেকে ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবা স্বভাব নয় ওর। অবশ্য মুখে বলে, চালিয়ে যাচ্ছি নিজের কাজ, দেখলে শান্তি পাবে মায়ের আত্মা। এ ধরনের কথা অনেকেই বলে থাকে। পোয়ারো দেখেছেন নিজের আন্তরিক ইচ্ছেটা অনেকে মৃতের ইচ্ছে বলে চালিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সেটাই সুবিধেজনক। তবে এক্ষেত্রে রবিন একথা বলতে পারে কারণ ছেলের ওপর অগাধ আস্থা ছিল মিসেস আপওয়ার্ডের এবং গর্বও কম ছিল না।
চোখ বুজে পোয়ারো ভদ্রমহিলার কথাই ভাবছিলেন। উনি কেমন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন? ওঁর ওরকম একগুঁয়ে ভাবের কারণটা কি হতে পারে?
হঠাৎ জিনিসপত্র ভাঙার জোরে আওয়াজ হল। আলুথালু বেশে মরিন উপস্থিত হলেন।
–কিছুতেই তো আমি বুঝে উঠতে পারছি না যে কি হল জনির? সেই যে ডাকঘরে পার্সেল নিয়ে গেছে, আর ফেরার নামটি নেই। কাজ তো বহুক্ষণ আগেই হয়ে যাবার কথা, এদিকে আজ মুরগির খোয়াড়ের দরজাটা মেরামত না করলেই নয়।