-কারণ তাদের অনেকেই লুকোতে চায় কিছু না কিছু। কিন্তু সেটা নাও খুন হতে পারে। পোয়ারো বললেন।
বোধহয় তাই হবে। হয়ত তারা যা করেছে, তা আইনের চোখে অল্পবিস্তর দোষের। হয়ত সাধারণ কোনো ঘটনা। যাই হোক এত কষ্ট করে লোকে তা লুকিয়ে রাখে যে, আসল খবর খুঁজে বের করা ঢের বেশি কষ্টকর।
–কিন্তু অসম্ভব তো নয়।
-না। কিন্তু সময় সাপেক্ষ। ধরুন যদি লিলিই ব্রডহিনিতে থেকে থাকে, তা হলে হয় সে ইভ কার্পেন্টার নয়ত শেলা রেগুল। দুজনেরই রুটিন মাফিক জবানবন্দী নিয়েছি আমি। ওঁরা নাকি খুনের সময় দুজনেই বাড়িতে ছিলেন। সরলতার প্রতিমূর্তি মিসেস কার্পেন্টার আর সত্যিই মিসেস রেগুলের স্নায়ু দুর্বল। কাজেই আমরা সেদিকেও এগোতে পারছি না।
মনে পড়ল পোয়ারোর লং মিডোস-এর বাগানে মিসেস রেগুলের সঙ্গে তার নিজের দেখা হয়ে যাওয়ার কথা। একটা বেনামী চিঠি পেয়েছিলেন ভদ্রমহিলা (অন্তত পোয়ারোকে উনি সেরকমই বলেছিলেন)। এখনো ওই ব্যাপারে পোয়ারোর সন্দেহ কাটেনি।
স্পেন্স বললেন, এবং আমাদের সতর্ক হয়ে চলতে হবে। কারণ যদি দোষীও হয় একজন, অন্যজন তো নির্দোষ।
–আর মিঃ কার্পেন্টারও ভাবী সদস্য লোকসভার এবং বাসিন্দাদের মধ্যে যথেষ্ট নামকরা লোক।
যদি খুনের ব্যাপারে ওঁর স্ত্রী সত্যি জড়িত থাকেন, তাহলে ওঁর সুনাম, প্রতিপত্তি এসব কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে আসবে না।
-আমি তা জানি, কিন্তু সব দিক দিয়ে আপনাদের সতর্ক সন্দেহমুক্ত, নিশ্চিত হতে হবে, তাই না?
–ঠিক কথা। কিন্তু আপনি এটা তো জানেন যে, এই দুজনের মধ্যেই দোষী কোনো একজন।
-না, ঠিক তা বলতে পারি না। অন্য সম্ভাবনাও রয়েছে…
—যেমন?
পোয়ারো এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ বললেন, আচ্ছা, কেন ফটো রাখে মানুষ?
-কেন আপনার সাথে কিছুনেক জিনিস ফেলে কেন মানুষ ফটোগ্রাফ ফটোগ্রাফ মনে
-কেন? ভগবান জানেন। লোকে অনেক আবর্জনাই প্রাণে ধরে ফেলতে পারে না।
–আমি আপনার সাথে কিছুটা একমত। কেউ কেউ অনেক জিনিস জমায়। কেউ বা প্রয়োজন ফুরোলেই টান মেরে অনেক জিনিস ফেলে দেয়। এটা যার যার স্বভাবের ব্যাপার। কিন্তু বিশেষভাবে ফটোর কথাই আমি বলতে চাইছি। কেন মানুষ ফটোগ্রাফ রাখে?
প্রাণে ধরে ফেলতে পারে না বলে : কিংবা হয়ত তাদের পুরনো কথা ফটোগ্রাফ মনে করিয়ে দেয়…ধরুণ স্মৃতি রাখার জন্য…..
–ঠিক তাই। পুরনো কথা মনে পড়ে। আবার জানতে চাইছি আমরা কেন? একজন বিগত যৌবনা ভদ্রমহিলা কেন তার যুবতী বয়সের ছবি রেখে দেন সযত্নে, প্রথম কারণ আত্মতুষ্টি। হয়ত বয়স কালে ভদ্রমহিলা যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন। ফটোতে দেখলে এক ধরনের আনন্দ পান উনি। যখন আয়নায় উনি নিজের চেহারাটায় প্রৌঢ়ত্বের ছাপ লক্ষ্য করেন, তখন ফটোতে যৌবনের সৌন্দর্য ওঁকে উৎসাহিত করে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনো বন্ধুকে বলেন–আমি কি ছিলাম আঠারো বছর হয়সে। মিঃ স্পেন্স, আপনি কি আমার কথা সমর্থন করছেন?
–হ্যাঁ-হ্যাঁ। আমি মানি যে, এটা সত্য।
–তাহলে প্রথম কারণ আত্মতুষ্টি। আমার মতে দ্বিতীয় কারণ অবেগপ্রবণতা।
–দুটোই তো এক।
-না, ঠিক এক নয়। কারণ দ্বিতীয় কারণটা শুধু আপনাকে নিজের নয়, অন্য লোকেরও ছবি রাখতে বাধ্য করে। যেমন ধরুণ আপনার মেয়ের ছোটবেলার ইজের পরা ছবি, যে মেয়ে হয়ত এখন বিবাহিতা।
–হ্যাঁ, হা, আমি এ-রকম অনেক দেখেছি। স্পেন্স হাসতে হাসতে বললেন।
–ছেলেমেয়েদের অনেক সময় অস্বস্তি লাগে কিন্তু এ ব্যাপারে মায়েরা অত্যুৎসাহী। আবার ছেলেমেয়েরাও ছবি রাখে মায়ের, যদি অল্প বয়সে তাদের মা মারা যান। এই আমার মা, অল্প বয়সে…তারা ভাবে।
–বোধহয় আমি আঁচ করতে পারছি মিঃ পোয়ারো, কোন দিকে এগোচ্ছেন আপনি।
–আর তৃতীয় কারণ, আত্মতুষ্টি নয়, আবেগও নয়, নিছকই ঘৃণা।
–ঘৃণা?
-হ্যাঁ। ধরুন চরিতার্থ করতে হবে প্রতিহিংসা। হয়ত কেউ অনেক ক্ষতি করেছে আপনার। তার একটা ছবি আপনি নিজের কাছে রেখে দিলেন যাতে আপনি কোনোদিনও তার কথা না ভোলেন। এমন কি হয় না, বলুন?
-কিন্তু, নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য হতে পারে না।
পারে না বুঝি?
–আপনি কি ভাবছেন ঠিক বলুন তো?
বিড়বিড় করে পোয়ারো বললেন, অনেক সময় খবরের কাগজে ভুল তথ্য ছাপা হয়। সানডে কম্প্যানিয়ন বলছে যে ইভা কেনকে মিঃ ক্রেগের বাড়িতে নিযুক্ত করা হয়েছিল বাচ্চার দেখাশুনোর জন্য। কিন্তু আসল ঘটনাটা কি?
–আসল ঘটনা ওটাই। এখানে কাগজের তথ্য ঠিকই আছে। কিন্তু আমরা তো লিলি গ্যাম্বলকে খুঁজছি।
হঠাৎ চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন পোয়ারো। স্পেন্সকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন, লিলির দিকে আপনি ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। মোটেই সুশ্রী না লিলি, এবড়ো খেবড়ো দাঁত, কাঁচের মোটা চশমা, সব মিলিয়ে প্রায় কুৎসিতই বলা চলে। সুতরাং আমার বক্তব্যের প্রথম কারণটার জন্য ওর ছবি কেউই রাখবে না। ইভা কার্পেন্টার, শেলা রেগুল দুজনেই যথেষ্ট সুন্দরী। যদি সত্যিই ওদের মধ্যে কেউ লিলি হন, তাহলেও কারও হাতে পুরনো ছবি পড়ার আগে ওরা দুজনেই তো ছিঁড়ে ফেলবেন টুকরো টুকরো করে।
এবার ভাবুন দ্বিতীয় কারণটির কথা। স্নেহ, ভালোবাসা ইত্যাদি আবেগের কথা ধরা যাক। লিলি ছোট ছিল যখন, কেউ কি তখন স্নেহ করত ওকে, যা চরিত্র লিলির তাতে তা অসম্ভব। ও চিরদিনই অনাদর পেয়েছে। যিনি ওকে একমাত্র ভালোবাসতেন, সেই ওর পিসী, তার পরিণতি হয় অত্যন্ত করুণ। সুতরাং দ্বিতীয় কারণে ওর ছবি কেউ রাখবে না। তৃতীয় কারণ? কেউ ওকে ঘৃণাও করত না। যে পিসীকে ও মেরে ফেলে, তার স্বামী বা স্বজন বলতে কেউ ছিল না। ঘৃণা নয়, সকলে ওকে করুণা করত।