মিসেস আপওয়ার্ড বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তাদের হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছিলেন। রবিনও, মায়ের যাতে অসুবিধে না হয় কোনো রকম, সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। গাড়ি থেকে দু-একবার নেমে দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দেখে এসেছিল সব ঠিকঠাক আছে কিনা।
বাড়ি থেকে শেষের বার বেরিয়ে রবিন একগাল হসে বলেছিল, মামণিকে দেখলাম, ফোন করছেন যেন কাকে, কাকে কিছুতেই বললেন না। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি কে সে ব্যক্তি।
মিসেস অলিভার বলেছিলেন; আন্দাজ করতে পারছি আমিও।
-বলুন তো কে?
–এরকুল পোয়ারো।
-ঠিক তাই। আমারও তাই মনে হয়। ওঁর পেট থেকে মা সব কথা ঠিক বের করবেন। মা কখনো নিজের ধ্যানধারণাগুলো আমার কাছে ভাঙতেই চান না, যাক, এরিয়েন, আসুন আমরা বরং একটু আলোচনা করি নাটকটা সম্বন্ধে। আমার মনে হয় সিসিল সম্বন্ধে আপনার মতামতটাই ঠিক। সত্যি, সিসিল লীচকে এরিকের ভূমিকায় একেবারেই মানায় না। মন্দ নয় নাটকটা ঠিকই, তবে এ নিয়ে এত দীর্ঘ আলোচনা ক্লান্তিকর।
নিজের মনে রবিন বকবক করে যাচ্ছিল। মিসেস অলিভারেরও ভালো লাগেনি সিসিলকে। তার চেয়ে মাইকেল, যে কিনা এই মুহূর্তে কথা বলছিল তার সঙ্গে, অনেক বেশি প্রাণবন্ত লেগেছে তাকে। একাই মাইকেল অনর্গল অনেক কথা বলে যাচ্ছিল। পিটার নামে একজন টিপ্পনি কাটছিল মাঝে মাঝে।
মাইকেল বলছিল, আমরা খুব খুশী যে, রবিন শেষ পর্যন্ত আসতে পেরেছে, ওর মায়ের যা প্রতিপত্তি, এখনো রবিন মায়ের অনুমতি ছাড়া এক পা বেরোতে পারে না। মায়ের সঙ্গে সঙ্গেই সব সময় থাকতে হবে। অথচ এত প্রতিভাবান রবিন। মায়ের কথা শুনে নিজের আখের নষ্ট করার মানে হয় কোনো? এ ধরনের মহিলারা ভীষণ একগুয়ে হন, জানেন, অ্যালেক্স রসকসের কি অবস্থা করেছিলেন উনি? এক বছর ধরে মাথায় তুলে ছিলেন ওকে রাশিয়ান মনে করে। অবশ্য এও ঠিক যে ওঁকে আগাগোড়া অ্যালেক্স গুল মেরেছিল। তাহলেই বা কি? যেই উনি জানতে পারলেন ও একজন দর্জির ছেলে, দূর দূর করে অমনি তাড়িয়ে দিলেন। এত নাক উঁচু ভদ্রমহিলা। অবশ্য অ্যালেক্স বেঁচে গেছে। ভদ্রমহিলা নাকি সাংঘাতিক রেগে যান মাঝে মাঝে।
-এই যে রবিন, আমরা তোমার মায়ের কথা বলছিলাম। উনি আসতে পারলেন না ভেবে এত খারাপ লাগছে। তবে আমরাও খুব খুশী মিসেস অলিভারকে পেয়ে। উনি কি চমৎকার খুনের গল্প লেখেন।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক একজন মিসেস অলিভারের হাত ধরে বারবার তাকে ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন।
এরপর বাইরে খোলা হাওয়ায় বসে আরও খানিকক্ষণ নাটকের আলোচনা চলল।
মিসেস অলিভার বাড়ি ফেরার পথে খুব ক্লান্তি বোধ করছিলেন। সীটে বসে পেছনে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। সামনে কথা বলেই যাচ্ছিল রবিন।
–এরিয়েন, আপনার কি মনে হয় না এভাবে করলে ভালোই হবে জিনিসটা।
–কি?
–চমকে চোখ খুললেন মিসেস অলিভার। এতক্ষণ তিনি কিছু শোনেননি। বাড়ির (নিজের) কথা ভাবছিলেন। বাড়ির ওয়াল পেপার, টাইপরাইটার, কফি, গাদাগাদা আপেল –ওঃ কি আরাম! শান্তিতে বাড়ি ফিরতে পারলে।
রবিন বলল, আপনাকে খুব পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে।
-না, ঠিক তা না। আমি আসলে ঠিক মিশতে পারি না অচেনা মানুষদের সঙ্গে।
–আমি আবার লোকজন খুব পছন্দ করি, আপনি?
দৃঢ়স্বরে মিসেস অলিভার বললেন, না।
–কিন্তু অত সুন্দর করে বইতে লোকচরিত্র বিশ্লেষণ করেন।
–সেটা আলাদা। আমি গাছপালা বেশি ভালোবাসি মানুষের চেয়ে। তাতে অনেক কম চঞ্চলতা।
–লোকজন আমি ভালোবাসি। আমাকে ওরা উৎসাহ দেয়, গাড়ি এসে দাঁড়ালো ল্যাবারনাম এর গেটে।
–ভেতরে চলে যান আপনি, গাড়ি রেখে আসছি আমি।
গাড়ি থেকে নেমে মিসেস অলিভার এগিয়ে গেলেন। রবিন চেঁচিয়ে বলল, খোলাই আছে। দরজা।
খোলাই ছিল দরজা, ভেতরে ঢুকলেন মিসেস অলিভার। আলোগুলো সব নেভানো। মিসেস অলিভার তার গৃহকত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট হলেন একটু। হয়ত এও এক ধরনের মিতব্যয়িতা। বড়লোক হলে মিতব্যয়ী হয় আবার।
হলে দামী সেন্টের একটা হালকা গন্ধ পাওয়া গেল। অবাক হলেন মিসেস অলিভার। ভাবলেন, ঠিক বাড়িতে এলাম তো।
তিনি সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন, হলঘর আলোকিত হয়ে উঠল। বসবার ঘরের দরজাটা ফাঁক করা ছিল।
এক জোড়া পা দেখতে পেলেন মিসেস অলিভার।
ওঃ, তাহলে মিসেস আপওয়ার্ড এখনো শুতে যাননি, দেখো কাণ্ড, নাকি চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আলো নেভানো বসার ঘরেও। কে জানে কতক্ষণ ধরে ঘুমোচ্ছেন?
মিসেস অলিভার এইসব ভাবতে ভাবতে ঘরের আলোটা জ্বালালেন।
ফিরে এসেছি আমরা, মাঝপথেই কথা থেমে গেল। গলা দিয়ে তার আর শব্দ বেরোল না। বন্ধ হয়ে আসছে গলা, চিৎকারও বের হচ্ছে না। ফিসফিসিয়ে ডাকলেন, রবিন রবিন।
রবিনের পায়ের শব্দ একটু পরেই পাওয়া গেল। শিস দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। দৌড়ে গেলেন মিসেস অলিভার। হলেই তিনি মুখোমুখি হলেন রবিনের।
-যেও না ভেতরে। তোমার মা… মারা গেছেন….ওঁকে খুন করা হয়েছে মনে হচ্ছে।
৫. বেশ পাকা হাতের কাজ
১৮.
বেশ পাকা হাতের কাজ। সুপারিন্টেডেন্ট স্পেন্স মন্তব্য করলেন। ওঁর লালচে গ্রাম্য মুখে সুস্পষ্ট রাগের আভাস। এরকুল পোয়ারো এতক্ষণ যেদিকে চুপচাপ বসে ওঁর কথা শুনছিলেন, সেদিকে ফিরে তাকালেন।–খুব পরিচ্ছন্ন আর নিষ্ঠুরভাবে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। সিল্কের স্কার্ফভদ্রমহিলার নিজের স্কার্ফ দিয়েই বোধহয় সারা হয়েছে কাজটা–সেটা উনি সেদিন পরেছিলেন। পরিষ্কার, দ্রুত, তৎপর কাজ। শুনেছি ভারতবর্ষে এই ধরণের ঠগীর ফঁসের প্রচলন ছিল। ক্যারোটিড ধমনীতে চাপ পড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মরক্ষা করার বা চেঁচাবার কোনো সুযোগই পায় না।