খুব কম দেবেন দুধ মাদমোয়াজেল, আর চার টুকরো চিনির ট্যাবলেট। তার অনুরোধে মিস ব্রেউইসকে তৎপর হতে দেখে পোয়ারো আরো বলল, আপনারা সবাই দেখছি কাজে ব্যস্ত।
হ্যাঁ, তা তো করতেই হবে। যত সব কাজ তো শেষ মুহূর্তেই এসে যায়। টেলিফোন রিসিভ করতেই সকালের অর্ধেক পার হয়ে গেছে–বললেন, মিস ব্রেউইস। পোয়রোর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে মিস্ ব্রেউইস বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, একটা স্যান্ডউইচ দেবো না কি? পরক্ষণেই তার মনে পড়ল চার টুকরো চিনির কথা। সে বলে উঠল, মনে হয় আপনি ক্রীম কেকই পছন্দ করবেন। সত্যিই তাই। বলে, পোয়ারো নিজের হাতেই তুলে নিল এক টুকরো ক্রীম কেক।
তারপর ধীরে ধীরে গিয়ে বসলো সে তার হস্টেস-এর পাশে। তার অলঙ্কার সামলাতেই ব্যস্ত ছিল সে তখন। পোয়ারোর প্রতি দামি অলঙ্কারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজের থেকেই সে বলে উঠল, খুব চমৎকার এগুলোদেখুন, তাই নয় কি? পোয়ারো তাকে নিরীক্ষণ করছিল খুব সাবধানী দৃষ্টিতে। বড় আকারের একটা কুলি টুপী তার মাথায়, মুখ ও গায়ের চামড়া মৃতের মতো সাদা বিবর্ণ।
সে সাজিয়ে তুলেছিল নিজেকে ইংরেজ ফ্যাশানে। অথচ অবাক করে দিয়েছিল তার চোখ দুটো পোয়ারোকে।
অকম্পিত, নিশ্চল, ভাবলেশহীন, চোখ দুটো তার শিশুর মতোই। সেইভাবেই সে তার প্রশ্নগুলো করছিল, বাচ্চাছেলেরা যেমন চুপিচুপি ছেলে মানুষের মতো কথা বলে থাকে।
আংটিটাও সুন্দর, তাই না? ছেলেমানুষের মতো পোয়ারোও তাকে প্রশ্ন করে বসলো।
খুব খুশী দেখালো তাকে। আমাকে এই আংটিটা দিয়েছে জর্জ সবেমাত্র গতকাল, সে বলল।
হয়তো কিছু গোপন কথা বলছে এমনভাবে তার কণ্ঠস্বরকে খাদে নামিয়ে আনল, সে আমাকে অনেক জিনিসই দিয়েছে। খুব ভালো মানুষ সে।
একটা প্রশ্ন জাগল পোয়ারোর মনে : তারা ফাঁদ পাতে না, কিংবা জাল বিস্তারিত করে না তারা-লেডি স্টাবস ফঁদ পাততে পারে; এ কথা হয়তো ঠিক, অথবা জাল বিস্তার করতে পারে, অবশ্যই সে একথা কল্পনাও করতে পারে না, তা সত্ত্বেও কেন যেন তার মনে হয়, তার সবকিছুই যেন কৃত্রিমতায় ভরা। সাধারণভাবেই বলল পোয়ারো, আপনার কি মনে হয় না, চমৎকার দেশ এই ডেভনশায়ার।
হা দিনের বেলায়, অবশ্য বৃষ্টি না হলে, তারপরেই অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাল লেডি স্টাবস, একটা নাইট ক্লাবও নেই এখানে।
ও, তাই নাকি? আপনি বুঝি নাইট ক্লাব পছন্দ করেন। সোৎসাহে বলল স্টাবস, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
আচ্ছা কেন বলুন তো? জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো। কারণ সেখানে গান, নাচ, মিউজিক থাকে। আর সেখানে আমি সুন্দরভাবে সাজগোজ করে যেতে পারি। হাতে সুন্দর আংটি, ব্রেসলেট পরতে পারি। অন্য মহিলারাও সুন্দর পোশাক ও অলঙ্কার পরে থাকে। অবশ্য আমার মতো এত ভালো নয়। নিজেই সে তৃপ্তি বোধ করে হেসে উঠল। পোয়ারো তার জন্য করুণা বোধ করল। আর আপনি খুব আনন্দ পান না ঐসবগুলো দেখে, তাই না। প্রশ্ন করলো পোয়ারো।
অবশ্যই। আমি খুব পছন্দ করি ক্যাসিনোও। আচ্ছা বলুন তো কেন ইংল্যান্ডে একটা ক্যাসিনোও নেই? প্রশ্ন করল লেডি স্টাবস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোয়ারো বলল, অনেক সময় আমার অবাক লাগে, তবে এ বিষয়ে যতদূর সম্ভব অনুমতি পাওয়া যাবে না, ইংরাজদের চরিত্র অনুযায়ী। পোয়ারো আবার বলল, তাছাড়াও ম্যাডাম এক সর্বনেশে খেলা, লোকসানই বেশি হয়, লাভের থেকে
না না, আমাদের কাছে সেটা কেনো ব্যাপার নয়। জর্জ-এর বেশ অর্থ আছে। আপনার কি মনে হয় না, বিত্তবান হওয়া খুব সুখের ব্যাপার। বলল, লেডি স্টাবস! নম্বভাবে বলল পোয়ারো, হ্যাঁ সত্যিই ভালো হয়।
আমি যদি ধনী না হতাম, তবে আমাকে এলিতেলীর মতো দেখাত। এবার তার দৃষ্টি পড়ল চায়ের টেবিলে বসে থাকা মিস ব্রেউইস-এর দিকে। আচ্ছা আপনার কি ওকে খুব কুৎসিত মনে হয়না? সঙ্গে সঙ্গে মিস ব্রেউইস চোখ তুলে তাকাল তাদের দিকে। তার চোখ দুটো ঝলসে উঠল হঠাৎ। খুব একটা জোরে কথা বলেনি লেডি স্টাবস। পোয়ারো কিন্তু আশঙ্কা করলো, যে আমাদ্দা ব্রেউইস হয়তো তাদের কথা শুনে ফেলেছে।
যেইমাত্র পোয়ারো তার দৃষ্টির পরিবর্তন করলো তার চোখাচোখি হয়ে গেল ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটনের সঙ্গে। বিদ্রুপে ভরা ছিল ক্যাপ্টেনের দুচোখের দৃষ্টি। তাকে দেখে মনে হল, সে বোধহয় বেশ কৌতুকবোধ করছে।
পোয়ারো প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করল।
সে প্রশ্ন করল, আপনি খুবই ব্যস্ত উৎসবের কাজে?
মাথা নেড়ে হ্যাটি স্টাবস জানাল, না না, খুবই বিরক্তিকর সব কিছু করা এবং বোকামিও বটে। বাড়িতে চাকর-বাকর, মালিরা থাকতে আমি কেন এসব কাজ করতে যাব। হঠাৎ মিসেস ফোলিয়াট কথা বলল তাদের কথাবার্তার মাঝখানে। আমার প্রিয় মহিলা, ওসব কথা এখন অচল হয়ে গেছে। তোমার এইরকম মনোভাব আইল্যান্ড এস্টেট থেকে আমদানী করা। ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রা এখন সেরকম নয়, যা তুমি ভাবছে। অনেক বদলে গেছে এখন। ওসব মান্ধাতা আমলের সব ব্যাপার হয়ে গেছে এখন, আমার যা মনে হয়। মিসেস ফোলিয়াট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন সকলেই নিজের হাতে নিজের কাজ করে থাকে। লেডি স্টাবস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমার মনে হয় এসব বোকারাই করে থাকে। তাহলে ধনী হওয়ার মানে কি, যদি নিজেই সব করতে হবে?
হয়তো কেউ কেউ এটা মজার ব্যাপার মনে করতে পারে, মিসেস ফোলিয়াট হাসতে হাসতে বলল। তবে সব বাজে নয়, কিছু কিছু কাজ আমি নিজের হাতে অবশ্যই করে থাকি। বাগানের পরিচর্যা আমি নিজের হাতে করি, আমি উৎসবের কাজ করতে ভালোবাসি নিজের হাতে, যেমন আমি আগামীকাল করব। মিসেস ফোলিয়েট একটু থামলো, তারপর বলল, শোন হ্যাটি, তুমিও এই গ্রাম্য পরিবেশে এখানকার কিছু কিছু কাজ করো। এটা আমি আশা করি। আনন্দ উপভোগ কর এই গ্রাম্য পরিবেশের। তুমি সকালবেলায় বিছানায় না পড়ে থেকে আমাদের সাহায্য করবে এটাই আশা করেছিলাম।