ইনসপেক্টর ব্লান্ড বললো, আমি তো আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, এ ছাড়া। সর্বত্র খুঁজে দেখেছি আমরা, তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটা এখন বলা মুশকিল যে, সমুদ্রে তার মৃতদেহ সত্যি সত্যি ভেসে গিয়েছে নাকি তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে কোথাও এই এস্টেটে।
বল্ডউইন জানতে চাইলো, আর কিছু জানা গেছে কি অপর মেয়েটি সম্পর্কে? ব্লান্ড বললো, একেবারে শেষে, সেটা জানা। বল্ডউইন বলল, দুজন পুলিশ ইনসপেক্টর এসপারেন্সে গিয়েছিল সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে। ডি সৌউসা সার্চ ওয়ারেন্টের কথা শুনে রুক্ষ স্বরে প্রথমে বলেছিলো– আপনারা বোধহয় ভেবেছেন, যে আমার জ্যাঠতুতো বোন লেডির স্টাবসকে আমি বোধহয় এখানে লুকিয়ে রেখেছি। তাহলেই নিজের চোখে দেখে যান আপনারা লেডি স্টাকসকে পাওয়া যায় কিনা। পুলিশ অফিসার যখন ইয়ট থেকে লঞ্চে করে ফিরে আসছিল, তখন দেখেছিল সৌউসা তাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।
তদন্তের কাজে যখন ব্যস্ত ইনসপেক্টর ব্লান্ড তখন ন্যাসে হাউসে পোয়ারো তার নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ সেরে নিচ্ছিল। সে গিয়ে ঢুকলো ম্যাডাম জ্বলেকার ফরচুন টেন্টে।মিসেস শেলি লেগি গতকাল বিকেলে এখানেই জ্যোতিষী জ্বলেকার ভূমিকায় ঘোষণা করেছিলেন পোয়ারোর ভবিষ্যত কি হতে পারে।
গুটি গুটি পায়ে ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে টেন্টের পেছনের দিকের পর্দা তুলে অবশেষে মানার হাউসে গিয়ে ঢুকলো পোয়ারো। আলোর প্রাচুর্য সেই ঘরে ছিল না, ঘরটা বেশ অন্ধকার। কয়েকটা সরঞ্জাম এবং দুটো ভাঙা হকি স্টিক পড়ে থাকতে দেখা গেল। একটা পুরু ধুলোর আস্তরণ ছিল মেঝেতে। আর তার চোখে পড়ল সেই ধূলিমলিন মেঝের উপর কয়েকটা অনিয়মিত চিহ্ন। সে তার পকেট থেকে একটা টেপ বের করে হাঁটু মুড়ে বসে মাপ নিলো। সাবধানে সেই অনিয়মিত দাগগুলির।
সে মাথা নাড়তে লাগলো তারপর আপন মনেই। একটা আত্মতুষ্টির ছাপ ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। এরপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে এগিয়ে চলল বোট-হাউসের দিকে। চাবি ছিলো তার কাছে। ঘরে ঢুকলো সে দরজা খুলে। বাকি সমস্ত কিছুই তখন বোট-হাউসে আগের মতোই পড়েছিল, শুধুমাত্র সরানো হয়েছিল মারলিন-এর মৃতদেহ, চায়ের কাপ ডিস, ট্রে ইত্যাদি অপসারণ করা হয়েছিলো। পোয়ালরা দেখতে পেল টেবিলের ওপর গাদা করা কমিকস-এর বই পড়ে আছে। সে কমিকস বইগুলোর পাতা একটার পর একটা ওল্টাতে থাকলো। সে লক্ষ্য করল একটা পাতায় মেয়েটি মারা যাবার আগে লিখে গেছে এইরকম সুসান ব্রাউস-এর সঙ্গে গেছে জ্যাকি ব্লেক। পিটার মেয়েদের চিমটি কাটে সিনেমা হলে। জর্জি পেগ অরণ্যে ভ্রমণার্থী মেয়েদের চুমু খায়। ছেলেদের পছন্দ করে বিডিং ফক্স। আলবার্ট সময় কাটায় জোরিনের সঙ্গে।
পোয়ারো লেখাগুলির মধ্যে মারলিনের কিশোরী মনের বেদনাদায়ক মন্তব্য লক্ষ্য করল। তার মনে পড়ল মারলিনের সরল মুখের ছবিটা। হয়তো সিনেমা হলের ছেলেরা তাকে চিমটি কাটতো না। তার সেই গোয়েন্দাগিরির মধ্যেই হতাশ মারলিন একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করতো। সম্ভবত ব্যাপারটা মারলিন-এর কাছে জরুরী ছিল, কারণ এটা তার লক্ষ্য করার কথা নয় এইসব ছোটোখাটো ঘটনা এবং যা অতি সাধারণ। আর মারলিনের ধারণা ছিল না, এটা কারো কাছে একান্ত জরুরী বিষয়।
পোয়ারো সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়ল, এ সমস্ত অনুমাননির্ভর বিষয়। যখন সে কমিকসগুলো ঠিকভাবে সাজিয়ে রাখছিলো তখন যেন তার মনে হল, এর মধ্যে থেকে কিছু একটা সরানো হয়েছে।
কিন্তু কি? কি সরানো হয়েছে? যেটা থাকা উচিত ছিলো এখানে…তার অস্পষ্ট অনুভূতিটা ফিকে হয়ে আসছিলো, সে আপন মনে মাথা নাড়লো।
পোয়ারো ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো বিষাদগ্রস্ত মনে বোট-হাউস থেকে। নিজের মনে ভাবতে থাকে অপ্রসন্ন পোয়ারো। খুন প্রতিরোধ করার জন্য এরকুল পোয়ারোকে ডেকে আনা হয়েছিলো এখানে, কিন্তু সে রোধ করতে পারলো না, এটাই সব থেকে তার কাছে বেদনাদায়ক ব্যাপার।
এটা একটা কলঙ্কময় ব্যাপার। আগামীকাল সে লন্ডনে ফিরে যাবে পরাজয় বরণ করে। ভীষণভাবে কমে গেছে তার অহংকারী ভাবটা।–এর ওপর উল্লেখ্য হলো যে তার একান্ত প্রিয় গোঁফটাও নত হয়ে গেছে।
ন্যাসে হাউসের খুনের কেসের ব্যাপার ভাবছিলো এরকুল পোয়ারো, তার লন্ডনের ঘরে একটা চারচৌকো প্লেসের সামনে বসে। তার কাছে এসেছিলো কিছুক্ষণ পূর্বে ইনসপেক্টর ব্লান্ড, সে লন্ডনে এসেছিলো পুলিশের কাজে। সে জানতে এসেছিলো মঁসিয়ে পোয়ারোর কাছে। পোয়ারো কোনোরকম সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে কিনা, ন্যাসে হাউস-এর দুর্ঘটনার ব্যাপারে।
তার নিজের ধারণার কথাও জানাল পোয়ারোকে। পার হয়ে গেলো প্রায় একমাস কি পাঁচ সপ্তাহ, তা সত্ত্বেও জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়নি লেডি স্টাবসকে এখনো পর্যন্ত। অতএব একথা একমাত্র বাতুলরাই চিন্তা করতে পারে যে, সে জীবিত আছে। পোয়ারো ব্লান্ড-এর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হল এ ব্যাপারে।
ব্লান্ড বললো, তবে একথা ঠিক যে নদীর স্রোতে কখনই কোথাও ভেসে যায়নি মৃতদেহ।
জীবিতই হোক আর মৃতদেহই হোক, জলে ডুবলে বেশিক্ষণ সেটা ডুবে থাকতে পারে না। একসময় ভেসে উঠবেই।
পোয়ারো তার মন্তব্য জানালো, তবে তৃতীয় একটা সম্ভাবনা আছে।