হ্যাঁ, অন্যান্য খবরের সঙ্গে এ তথ্যটাও সে সরবরাহ করেছিলো। তাছাড়া প্রকৃত অপরাধী কে সে সম্বন্ধেও আমি মনস্থির করে ফেলেছিলাম। অর্থাৎ মিঃ শ্যাতানার হত্যাকারী কে তা আমি জানতাম এবং সে ব্যক্তি মিসেস লরিমা নন। তবে নিজস্ব পদ্ধতিতে বক্তব্য রাখাই আমার বরাবরের অভ্যাস, সেটা হচ্ছে এক এক করে বাছাই করা। মিসেস লরিমা শ্যানার হত্যাকারী নন। মেজর ডেসপার্ডও তাকে খুন করেননি। এবং শুনলে অবাক হবেন এই হত্যাকাণ্ডটার পেছনে মিস মেরিডিথেরও কোনো হাত ছিলো না।…
সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়লেন তিনি। তাঁর মৃদু কোমল কণ্ঠস্বরে শিকারী বিড়ালের আমেজ।–তাহলে বুঝতেই পারছেন ডাক্তার রবার্টস, একমাত্র আপনিই অবশিষ্ট থাকেন। আপনিই মিঃ শ্যাতানাকে হত্যা করেছেন এবং মিসেস লরিমাকেও।
কম করেও মিনিট তিনেক কারো মুখে কোনো কথা ফুটলো না। একটা অস্বস্তিকর থমথমে নীরবতা। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করলেন ডাক্তার রবার্টস, বীভৎস ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠলেন। আপনি কি পুরোদস্তুর পাগল, মঁসিয়ে পোয়ারো? বলা বাহুল্য, মিঃ শ্যাতানাকে আমি খুন করিনি। মিসেস লরিমাকে খুন করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। মিঃ ব্যাটেল–তিনি তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, আপনি এইসব আজগুবি প্রলাপ শোনাবার জন্যে আমাকে ডেকে এনেছেন।
স্থির হয়ে মিঃ পোয়ারোর সম্পূর্ণ বক্তব্যটা শুনলেই বোধহয় ভালো করবেন।
পোয়ারো বললেন, যদিও কিছুদিন আগেই আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আপনিই মিঃ শ্যাতানাকে খুন করার ব্যাপারে এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী থেকে গেছে যে আদালতে দাঁড়িয়ে আপনার অপকীর্তির সাক্ষী দিতে পারবে।
রবার্টসের হাবভাব ক্রমশ স্থির শান্ত হয়ে এলো। চোখের দৃষ্টিতে একটা উজ্জ্বল চকচকে আভা। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে পোয়ারোর কথার প্রতিবাদ জানালেন। আপনি আবোলতাবোল বকছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
না, মোটেই আমি ভুল বকছি না। আজ ভোরে আপনি বাজে ভাওতা দিয়ে মিসেস লরিমার শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন, গত রাত্রে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে তিনি তখন গভীর নিদ্রায় অচেতন। আপনি প্রৌঢ়া দাসীকে ভাওতা দিলেন, বললেন মিসেস লরিমা খুব সম্ভবত মারা গেছেন। তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবার জন্যে তাকে ব্র্যাণ্ডি আর গরম জল আনতে পাঠান। সেই সময় ঘরের মধ্যে তৃতীয় কোনো প্রাণী উপস্থিত ছিলো না। আর তারপর কি ঘটলো?…
আপনি হয়তো জানেন না ডাক্তার রবার্টস যে জানলায় জমে থাকা বরফ পরিষ্কার করবার জন্য যে সমস্ত কোম্পানি আছে তাদের কেউ কেউ খুব ভোরেই কর্মচারীদের কাজে পাঠিয়ে দেয়। আপনি যখন মিসেস লরিমার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন সেই সময় একজন কর্মচারী মই নিয়ে হাজির হয়েছিলো, ঘটনাচক্রে মিসেস লরিমার ঘরের জানলাটাই সে প্রথম বেছে নেয়। তার ফলেই একটা দুর্লভ দৃশ্য তার চোখে পড়ে। তাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে তার নিজের মুখ থেকেই ঘটনাটা শোনা যাক।
পোয়ারো মৃদু পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন, তুমি ভেতরে এসো।
অনতিবিলম্বে দশাসই চেহারার শ্রমিকশ্রেণীর একজন লোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো। তার মাথার চুল লাল, ডান হাতে ধরা একটা ক্যাম্বিসের টুপি। টুপির গায়ে গোল করে লেখা চেলসি উইণ্ডো অ্যাসোসিয়েশন। পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, ঘরের মধ্যে যাঁরা বসে আছেন, তুমি তাদের কাউকে চিনতে পারছো?
লোকটি একবার সকলকে পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তার রবার্টসের দিকে ইঙ্গিত করলো, এই ভদ্রলোককে চিনতে পারছি।
শেষ কখন তুমি ভদ্রলোককে দেখেছো এবং উনি তখন কি করছিলেন?
আজ ভোরবেলার ঘটনা স্যার, তখন আটটাও বাজেনি। আমি চেইন লেনে এক ভদ্রমহিলার ঘরের জানলায় জমে থাকা বরফ সাফ করছিলাম। ভদ্রমহিলা বিছানায় শুয়েছিলেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। তিনি ঘুমের ঘোরেই একবার চোখ মেলে তাকালেন। ভদ্রলোককেও আমি তখন তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমি তাকে একজন ডাক্তার বলেই মনে করি। তার হাতে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ছিলো। তিনি খুব দ্রুত ভদ্রমহিলার শরীরে ইনজেকশন ছুঁড়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। চোখ বুজে। আমি সেখানে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে নিঃশব্দে দ্বিতীয় জানলার দিকে এগোলাম..মনে হয়, আমি নিশ্চয় কোনো অন্যায় করিনি?
না না, অন্যায় নয়, পোয়ারো উৎসাহের সুরে বললেন, তুমি আমাদের মহা উপকার করেছ। অপূর্ব…অভূতপূর্ব! তারপর রবার্টসের দিকে ফিরে তাকালেন। তাহলে ডাক্তার রবার্টস…?
একটা..একটা অতি সাধারণ শক্তিবর্ধক ওষুধ… তোতলাতে শুরু করলেন রবার্টস। শুধু তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনবার জন্য সর্বশেষ প্রচেষ্টা।
পোয়ারো কথার মাঝখানে বাধা দিলেন। সাধারণ শক্তিবর্ধক।… এন মিথাইল সাইক্লো হেক্সানিল-মিথাইল-ম্যালোনিল ইউরিয়া। কেটে কেটে প্রতিটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেন তিনি। সাধারণ ভাষায় একে এভিপ্যান বলা হয়। ছোটখাটো অপারেশনের সময় সেই জায়গাটা অসাড় করে দেবার জন্য এর প্রয়োজন লাগে। শিরার মধ্যে বেশি পরিমাণ এভিপ্যান ইনজেক্ট করে দিলে সে সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়তে বাধ্য। ভেরোম্যান বা ঐ জাতীয় ঘুমের ওষুধ ব্যবহারের পর এই এভিপ্যানের প্রয়োগ খুব বিপজ্জনক। মিসেস লরিমার বাহুর ওপর আমি একটা ইনজেকশনের চিহ্ন লক্ষ্য করেছিলাম। পুলিশ সার্জেনকে ঘটনাটা জানাবার পর তারা ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখেন এবং প্রধান পুলিস সার্জন স্যার চার্লস ইস্ফেরি-ই আমাকে এই তথ্য সরবরাহ করেছেন।