- বইয়ের নামঃ কার্টেন
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
কার্টেন
১. পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা
০১.
পুরনো কোনো অভিজ্ঞতায় কে না উদ্বেল হয়ে উঠবে। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে যাবে পূর্বে যা ঘটেছিল…অথবা কি করেছিলাম…।
অতীতের এই মন চঞ্চল করার কারণ কি জানে?
এসেকসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম। আর আমার সেই উদাস চোখের সামনে দিয়ে সবুজের সমারোহ একের পর এক সরে যাচ্ছে। ট্রেন তার আপন ছন্দে-তালে ছুটে চলেছে।
বহুযুগ পূর্বে একদিন এমনই এক ট্রেনে চেপে এই একই পথে আমি গিয়েছিলাম এক পথিকের ন্যায়। তার হিসেবে এখন আর নেই। সেই স্মৃতি শুধু বুকের ব্যথা বাড়ায়। তখন বেশি চঞ্চল হয়ে উঠি। জীবনের সেই সুমধুর, মহান অভিজ্ঞতা–চাওয়া, পাওয়ার সেইসব দিন ঝোড়ো বাতাসের মত উড়িয়ে নিয়ে যায়।
মনে পড়ে ১৯১৫ সালের সেই দিনগুলি। যুবা আর্থার হেস্টিংস নিজেকে তখনই জ্ঞানবৃদ্ধ ভাবতে শিখে গিয়েছিল। যুদ্ধ প্রত্যাগত আর্থার হেস্টিংস কী এখন তেমনই আছে? কিন্তু যখন নিজের বর্তমান চেহারা ভেসে ওঠে তখনই সব ভুল ভেঙে যায়। এখন সূর্যাস্তের মত আমার সেই সৌন্দর্য অস্তমিত, মহাসিন্ধুর ওপারের ডাকে যে কখন সাড়া দিয়েছি খেয়ালই থাকে না। কিন্তু এই চিরন্তন নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। তবুও সেই সুখস্মৃতি আমাকে পিছনে টানে–কেন? যেতে নাহি দিব” বলে যেন টেনে ধরে রাখতে চায় আমাকে। আর এরই টানে ভেসে ওঠে ক্যাভেণ্ডিস-আমার প্রিয় বন্ধু। ওর হাতেই আমার জীবনের শুরু–সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি। যে মাটিতে সে শুয়ে আছে চিরকালের মত সেই টান কী অত সহজে মুছে যাবার। শুনেছি ক্যাভেণ্ডিসের মা-র পুনরায় বিবাহ হয়েছে– বাড়ি কিনেছেন স্টাইলস-এ।
স্টাইলস! আহ! ভাবতেই যেন শিরা-উপশিরার রক্ত কণিকা হাওয়ায় দুলে ওঠে। রোমাঞ্চিত, পুলকিত…. আরো কী সব আছে এই স্টাইলসে। তাকে ভোলা যায় না। তার স্মৃতি আজও মনের মণিকোঠায় জীবন্ত হয়ে আছে। সে কে? কার স্মৃতি? কার আবার? এরকুল পোয়ারো। –আহা! দেহে মনে রোমাঞ্চ জেগে ওঠে। এখন এরকুলই আমার নিকটতম বন্ধু। বেলজিয়ামে ওকে প্রথম চিনেছিলুম, স্টাইলসে তার প্রকৃত স্বরূপটি দেখে এক নতুন পৃথিবীর দ্বারা আমার মনের মলিনতা আলোকের ঝরণা ধারায় এখানেই তো ধুইয়ে দিল। তাই স্টাইলস শুধু একটি নামমাত্র আমার কাছে নয়, এ যেন বহু পথ পরিক্রমার পর এক তীর্থক্ষেত্র।
পূর্বের স্মৃতিগুলো সেলুলয়েডে যখন ভেসে যাচ্ছিল একের পর এক তখন বুঝতেও পারিনি এখানে একটা হত্যা রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়ব। অথচ এই রকম এক রহস্যময় হত্যার মধ্য দিয়েই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু এরকুল পোয়ারোকে পেয়েছিলুম। আর সেই সঙ্গে পেয়েছিলুম তার জীবন সঙ্গিনীকে। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে–হ্যায়। সেই দিন কী আর ফিরে আসবে কোনোদিন?
চতুর্দিকে শুধু পরিবর্তন আর পরিবর্তন আমার প্রিয়তমাশ্রী আর্জেনটিনার নরম মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত। জন ক্যাভেণ্ডিস মারা গেলেও তার জীবিত স্ত্রী মেরী আছে এখন ডেভনশায়ারে। লরেন্স ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকায়। সত্যি! সবকিছুর কী পরিবর্তন! যদি ফিরে আসত সেই উনিশশ ষোল সাল। কিন্তু সে কী আর ফিরবে? পুরানো কথার মধ্যে মনে হয় আর সে সব জেগে উঠবে না।
কিন্তু একটা কথা ভাবলে রোমাঞ্চিত হই যে পুরানো দিন থাক বা না থাক, আমি, স্টাইলস, এরকুল পোয়ারো–আমারা তো আছি। যেদিন পোয়ারোর চিঠি পেলাম সেদিন যেন পাগলের ন্যায় আনন্দে উন্মাদ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। সব প্রভাতের সূর্যোদয়ের মত ঝলমল করছিল। সত্যি বলতে কী, সেই ঠিকানা, স্টাইলস কোর্ট, স্টাইলস এসেক্স প্রেরকের নামের পাশের দেখেই উদ্দাম উত্তাল হয়ে উঠে এক বিরল আচ্ছন্নতায় আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলুম। আমার শিরা-উপশিরায় যে নাম মিশে আছে, সেই নাম আমায় দোলা দেবে এটাই তো স্বাভাবিক।
বিগত একবছর আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। শেষবারের মতন যখন তাকে দেখেছিলুম তখন মনটা শুধু যন্ত্রণায় টন্ করেই ওঠেনি। আঘাতও পেয়েছিলাম। আসলে আমি ওকে অন্য চোখে দেখতাম, ভাবতাম। কিন্তু সেদিন জরাজীর্ণ কুজ বৃদ্ধ পোয়ারোকে দেখে আমার সব কল্পনা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। পুরানো যাইটিস রোগে ও এখন পঙ্গু ও অথর্ব। শুনেছিলাম ঈজিপ্টে গিয়েছিল হৃত স্বাস্থ্য উদ্ধারে, কিন্তু তার বিন্দুমাত্রও দেখতে পেলাম না। এবার চিঠিতেও সেই কথা। যদিও প্রগতা ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে তবুও স্বাস্থ্যের উন্নতি তেমন কিছু নেই।
এবং যে ঠিকানা থেকে চিঠিখানা পাচ্ছ তা দেখে নিশ্চয়ই তোমার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে। ঠিক নয়? সেই স্টাইলস। হাঃ হাঃ। ফেলে আসা দিনগুলো হুড়মুড় করে ছুটে এসে তোমায় নিশ্চয়ই চাবকে দিচ্ছে। আর ঘুরে ফিরে আমিও এসে উঠেছি সেই স্টাইলসে। তবে বন্ধু স্টাইলসের সেই বাড়ি আর নেই। এখন একে বলতে পারো এক পান্থশালা। ভারতবর্ষ আর মুনার কথা তোমার মনে পড়ছে নিশ্চয়ই। সেই সময়কার তোমার এক বন্ধু এখন এর মালিক। খুব ভালো… খুব ভালো তবে কী জানো তোমার এই কর্নেল বন্ধুটির অবস্থা দেখে আমার হৃদয় মথিত হয়। আসলে তার স্ত্রীই প্রকৃত মালিক। হায় কর্নেল! অনেক ভাগ্যে এমন একটি স্ত্রীরত্ন জুটেছে তার কপালে। জিভ তো নয় শানানো ছুরি। কেঁচো হয়ে থাকেন তোমার কর্নেল বন্ধু। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই কর্নেলের জায়গায় যদি আমি হতাম তবে কোনোদিন না জানি কাস্তের এক কোপ বসিয়ে দিতাম তার গলায়।
যাক সে কথা
কাগজে একদিন বিজ্ঞাপন দেখলাম। মনটা কেমন করে উঠল। হাজার হোক পুরনো স্মৃতি তো। কেবল পিছু টানে। এলাম বলে, মারো লাগাম চালাও ঘোড়া। ঠিক তাই না? এখানে এসেই দেখি রাজ্যের সব চেনা মানুষের ভীড়। তোমার মেয়ে আছে। আছে ওর মনিবের বন্ধু। যদিও খুব মাধার শুরের ব্যারন। তার পর ফ্রঙ্কলিন দম্পতি আসছে গরমের ছুটি কাটাতে। দেখে শুনে মনটা তোমার জন্য আনচান করে উঠল। তুমিই বা বাদ থাকবে কেন? একা একা কোথায় ঘুরে মরবে। তাই এই আমন্ত্রণ! সবাই মিলেমিশে খুব হৈ হৈ করে কটা দিন কাটানো যাবে।
কাজেই, চিঠি পাওয়া মাত্র চলে আসবে। কোনো বাধা না মেনে। পিছু সব টান ফেলে। হ্যাঁ ভয় পেও না। তোমার উপযুক্ত একটা ঘরও ঠিক করে ফেলেছি। বাথরুম টাথরুম সহ চমৎকার একঘর। (মনে করো দেখি সেই পুরনো স্টাইলসকে। এতসব আড়ম্বর কী তখন ছিল।) মিসেস কর্নেল লাটরেল অবশ্য এত কম ভাড়ায় ঘর দিতে চায়নি। কিন্তু আমি যে নাছোড়বান্দা। শুনছে কে। সব প্রস্তুত, অতএব হে রথী, চলে এসো মহারণে।
তোমার চিরকালের
এরকুল পোয়ারো
এই দুরন্ত আহ্বান অতিক্রম করা অসাধ্য। রাঁধাবাড়ার জন্য কেউ নেই। মেয়ে-ছেলেদের মধ্যে একছেলে নৌবাহিনীতে, একছেলে আর্জেনটিনায় গরুমোষের খাটাল করে আছে, একমেয়ে গ্রেস সৈন্যবাহিনীর একজনকে বিয়ে করে ভারতবর্ষে ঘর বেঁধেছে। অবশ্য ছোট মেয়ে জুডিথকে নিয়ে মনে একটা অশান্তি আছে। বড় জেদী ও একগুঁয়ে মেয়ে। সব সন্তানদের থেকে ওকে একটু বেশি ভালোবাসারই ফল এটি। সব ছেলে মেয়েদের মধ্যে বেশি সুন্দর হওয়ায় হয় তো বেশিই আদর করে ফেলেছি ওকে। কিন্তু ফলটা হয়েছে এইরূপ কারো কথা শোনে না, কারো যুক্তি নেয় না। নিজের খেয়ালে চলে। অস্বস্তি বোধ হয়েছে; ভেবেছি এই জেদী স্বভাব কোথা থেকে পেল ও। আমি ও জুডিথের মা দুজনেই ছিলাম সরল প্রকৃতির, কিন্তু ও ঠিক উল্টোটা। হয়তো ওর প্রখর বুদ্ধি ও সব কিছু জানার স্পৃহা থেকে এই রকম হয়েছে। ওর পড়াশোনায় আমি বাধা দিইনি, ফলে বিজ্ঞানে ডিগ্রী পেয়েছে অবলীলায়, কিন্তু, তারপর যে কাজ সে নির্বাচন করল তার জন্য একজন আমার মতন বিপত্নীক ভদ্রলোকের দুশ্চিন্তার কারণ। ওর সহজাত জেদী স্বভাবই এর জন্য দায়ী। শুনেছি এক গ্রীষ্মপ্রধান দেশের এক দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কারের নেশায় পাগল হয়ে রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছেন এক ডাক্তার ভদ্রলোক। জুডিথ তারই সেক্রেটারী। এটা মাথাব্যথার কারণ না হলেও ব্যাপারটা হল ওঁর পঙ্গু শয্যাশায়ী স্ত্রীকে নিয়ে। পিতা হিসাবে কর্তব্যের খাতিরে, ওঁর সঙ্গে জুডিথের কোনো বাজে সম্পর্ক আছে কিনা খোঁজ নিয়েছিলুম। কিন্তু তেমন কোনো সংবাদও পাইনি, অথবা তাদের মধ্যে মালিক কর্মচারী ভিন্ন কোনো সম্পর্কও লক্ষ্য করিনি।
জুডিথ আমায় শ্রদ্ধাভক্তি করলেও মাঝে মাঝে ওর ব্যবহারে আমি নার্ভাস হয়ে পড়ি যখন ও আমার কোনো পরামর্শ, স্থিতধী চিন্তাকে সেকেলে বলে উড়িয়ে দেয়।
স্টাইলস সেন্ট মেরী স্টেশনে গাড়ি ঢুকতেই আমি তটস্থ হয়ে উঠি। পুরানো স্মৃতি অন্য খাতে বয়ে চলে। স্টেশনের দিকে মনসংযোগ করতেই বুঝতে পারি সময় চলে গেলেও পুরানো পরিবেশ, সেই ঘর বাড়ি, সে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, গাছের সমারোহ সবই এখনও আছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই ধাক্কা খেলাম, অনেক কিছু বদলে গেছে। একটা পেট্রল পাম্প, একটা সিনেমা হল, গুটিকয় সুদৃশ্য সরাইখানা, কয়েকটি বৃহৎ অট্টালিকা চোখে পড়ল, যা আগে ছিল না।
কিন্তু স্টাইলস-এ এসে মনে হল, এখানে আধুনিকতা প্রবেশ করেনি। সবই এক আছে। বৃদ্ধ বটগাছের মত আমার লীলাভূমি দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে লন ধরে হেঁটে অদুরে চোখে পড়ল এক মহিলা জীর্ণ ফুলচারায় জল দিচ্ছেন। ট্যাক্সির গেট খোলার শব্দেই হয়তো ঘুরে আমার দিকে দাঁড়ালেন।
তাকে দেখে মনে হয়েছিল এভিলিন হাওয়ার্ড। কিন্তু জরাজীর্ণ চেহারা, গালবসা, বাদামী ছোপ হনুর উপর সাদা চুল, গর্তে বসা দুটো নীল চোখ দেখে মনে হল এ এভিলিন নয়। আমাকে দেখে উনি হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।
আহ! যদি ভুল না হয়ে থাকে নিশ্চয়ই মিঃ হেস্টিংস। কী সৌভাগ্য। এতক্ষণ আপনার আলোচনাই হচ্ছিল। ইস! দেখুন আমার দুটো হাতেই কী জঞ্জাল। একটু অভ্যর্থনা করব, উপায় নেই। কিছু মনে করলেন না তো? আমি, আমি মিসেস লাটরেল। আপনি জিজ্ঞেস না করতেই পরিচয় দিলাম। জানেন মিঃ হেস্টিংস, আমি আর আমার স্বামীর কী যে ভুত চাপল কিনে ফেললাম এই নোংরা বাড়িটা। কিন্তু মশাই, আমি একটু গাঁট কাটা বলতে পারেন। পয়সার খোঁজ পেলে ছাড়ি না। কিছু একটা করতে হবে তো। করে দিলাম সারইখানা। দু পয়সা আসবে। বৃদ্ধ বয়সের সংস্থান চাই তো। হিঃ হিঃ
নিজেকে জাহির করছে বুঝতে পারলেও হাসতে হল ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু বুঝতে পারলুম আক্ষরিক অর্থে তিনি ব্যবসায়ী, বাইরে চপলতা প্রকাশ করলেও ভিতরে ভিতরে তিনি ঘাঘু মাল।
জানতে চাইলাম, আমার বন্ধু পোয়ারোর খবর কী? দারুণ দুশ্চিন্তার সঙ্গে উত্তর দিলেন, কী মানুষ হয়ে গেছেন, কেবল আপনার কথাই বলছেন। রোগটাও যন্ত্রণা দিচ্ছে, মনে হচ্ছে বুঝি আপনার সঙ্গে দেখা হলেই পৃথিবীর মায়া কাটাবেন। ততক্ষণে আমরা এগোতে শুরু করেছি। তারপর মিঃ হেস্টিংস, কিসেস লাটরেল শোনাচ্ছিলেন, আপনার মেয়ে জুডিথের কথা কী বলব। এমন সুন্দরী সুশ্রী মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। ওর ব্যবহারে আমরা সবাই মুগ্ধ। তবে কি জানেন, আমরা পুরনো দিনের মানুষ। আজকালকার মেয়েদের ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। এই তো কচি বয়স। কোথায় হৈ হুল্লোড় করে বেড়াবে তা নয় আদ্যি কালের বদ্যি বুড়ীর মত চোখে মাইক্রোসকোপ এঁটে বসে আছে।
কোথায় ও জিজ্ঞেস করলাম, উত্তরে তিনি বললেন, হয় ল্যাবরেটরি বা স্টুডিও ঘরে মুখ থুবড়ে বসে আছে। ডঃ ফ্রাঙ্কলিন ঘর ভাড়া নিয়ে এসব করছেন আমি বাধা দেবার কে? ঐ নিরীহ অবলা গিনিপিগ, ইঁদুরগুলোকে নিয়ে কাটাছেঁড়া নৃশংস কাণ্ডকারখানা দেখলে গা জ্বলে ওঠে। তারপর বললেন আসুন মিঃ হেস্টিংস, আমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
দাঁড়কাকের মত, ছিপছিপে লম্বা, মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোঁফ, কোটরাগত নীলচোখ, গোঁফে অনবরত তা দিচ্ছে, চলাফেরায় অসংবৃত এক বৃদ্ধ সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ওহ-জর্জ, মুখিয়ে উঠলেন লাটরেল, তুমি যেন দিনকে দিন হাঁদাভোঁদা হয়ে যাচ্ছো। বললাম তো ইনিই ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। পাগলের ন্যায় এদিক-ওদিক তাকিয়ে করমর্দন করে বললেন –মানে–পাঁচটা চল্লিশের গাড়িতেই এলেন বুঝি? একটু চড়া গলায়, শাসনের সুরে বললেন, ওই ছাড়া আর কী গাড়ি আছে? আর গাড়ি নিয়ে কী হবে ওঁকে উপরে নিয়ে যাও। পারলে তোমার মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘরটাও বুঝিয়ে দিও। তারপর সুর পাল্টে আমি চা খাব কিনা জিজ্ঞেস করলেন।
করুণ হেসে ঘাড় নাড়লুম। না এখনই আমার চা খাবার প্রয়োজন নেই।
গেটের কাছে আমার নামানো জিনিসপত্রগুলো দেখে মিনমিনে গলায় কর্নেল লাটরেল স্ত্রীকে বললেন- ডেই লি ক্যাপ্টেনের জিনিসপত্রগুলো–সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ওটা কী মেয়েদের কাজ। তাছাড়া চোখের মাথা কী খেয়ে বসে আছো? দেখছো না–কথা শেষ না করে তিনি জোড়া হাত দেখালেন। থতমত খেয়ে মিঃ কর্নেল বললেন, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
ওঁকে দেখে মায়া হল, তাই তাড়াতাড়ি ওঁনাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। ভিতরে ঢুকতে গিয়েই একজন হন্তদন্ত হয়ে আগত–ভদ্রলোকের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিলাম। লোকটির কুঁজো, তোতলা, রোগ, সাদা চুল, হাতে একজোড়া কিন্তু গ্লাভস–তাতেই চলছিল বলে হয়তো দেখতে পায়নি। কর্নেলকে বললেন–ওই যে ডুমুর গা-গাছ, ওটাতে একজোড়া শ্যামা বাসা বাঁধছে, কী সু-সুন্দর। বলেই কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল পরিচয় দিলে-মিঃ নরটন। পাখি দেখলেই পাগল হয়ে যায়। এমনিতে সাধাসিধে।
মস্ত এক হলঘরের ভিতরে মোটাসোটা এক চেহারার ভদ্রলোক টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে হল এই মাত্র কোনো কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে আছেন এবং ঘুরেই তাকালেন। যতদোষ যেন মিঃ লাটরেলের এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিলেন, সব ব্যাটা শয়তান। বুঝেছেন মিঃ লাটরেল। ওই হাড়হাভাতে কনট্রাক্টর আর আর্কিটেক্টরদের টিকির দেখা নেই, ব্যাটারা সব ভেবেছ কী। তাদের ছাড়াব ভেবেছেন––শূন্যে-ওঁনার হাত চালানো দেখে আমরা হেসে উঠলাম। ভদ্রলোকের ঋজু, সুপুরুষ, চেহারা যেমন সমীহ জাগায় তেমনি আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।
কর্নেল বিনীত ভঙ্গিতেই বললেন–ইনি বিরাট ব্যক্তি। স্যার উইলিয়াম বয়েড ক্যারিংটন। যিনি এক প্রদেশের গভর্ণর একসময়ে ছিলেন, ভারতবর্ষে এক কিংবদন্তী ব্যক্তি, নামকরা প্রশাসক ও দক্ষ শিকারী বলে খ্যাত, তিনি আমার সামনে, এ রীতিমত অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তাকে দেখে বাক্যরোধ হল, আজ এঁদের আমরা ভুলতে বসলেও একসময় এঁরা দেশের জন্য অনেক করেছেন।
বলিষ্ঠ হাতে করমর্দন করে বললেন, কী সাংঘাতিক, রক্ত মাংসের সেই মিঃ হেস্টিংস! মঁসিয়ে পোয়ারো তো আপনার নামে পাগল, আর তাকেই আমি দেখতে পেলাম। আর হেসে বললেন, উপরি পাওনা হিসেবে পেয়ে গেছি আপনার মেয়ে জুডিথকে। চমৎকার মেয়ে। অপূর্ব।
লজ্জিত হয়ে বললুম, এতটা বোধহয় আমার পাওনা নয়, মিঃ ক্যারিংটন। তাছাড়া আমার মেয়ে নিশ্চয়ই আমার সম্বন্ধে এত প্রগলভ নয়। ক্যারিংটন বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সম্পর্কে উদাসীন। ওদের চোখে বাবা-মা এখন অবাঞ্ছিত বোঝার মতন। তিনি আরো বললেন, আমার দুর্ভাগ্য বলতে পারেন আমার কোনো সন্তান নেই। জুডিথ সুন্দরী, লাবণ্যময়ী। চলাফেরায় একটু অহমিকা জড়িয়ে থাকে। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে মিঃ লাটরেলকে তেতো তেতো মুখ করে বললেন–কিছু মনে করবেন না, মিঃ লাটরেল। আপনার ফোন যথেচ্ছ ব্যবহার করছি বলে। ঘেন্না ধরে গেছে এখানকার এক্সচেঞ্জের উপর। ব্যাটাদের যদি সামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকে। আমার অত ধৈর্য নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনের জন্য বসে থাকব
লাটরেল বললেন, চেষ্টা করে দেখুন। তারপর লাটরেলের সঙ্গে দোতলায় বা-হাতি একটা ঘরের সামনে থামলাম। বহুবছর পূর্বে এখানে উঠেছিলুম। আসার পথে দেখলাম ঘরগুলোর মধ্যে পার্টিশান করে ঘর বানানো হয়েছে, পরিবর্তন সর্বত্র।
ঘরটা সেই পুরনো দিনের মত বলে একটু ঘিন্ন হলুম। পুরনো একটা চেয়ার টেবিল, সামান্য জায়গা নিয়ে বাথরুম। ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে লাগেজ এসে গেছে। মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘর আমার ঘরের উল্টোদিকে। মাঝখানে শুধু করিডোরের বাবধান। আমি মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘরে যেতে প্রস্তুত কিনা একতলা থেকে নারীকণ্ট ভেসে এল জর্জ। ভয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, মিসেস লাটরেল, মি-মিস্টার হেস্টিংস, যদি কিছু প্রয়োজন হয় জানাবেন– নিচ থেকে সেই ভীষণ কণ্ঠ ভেসে এল জর্জ। যাচ্ছি এই যে, আ–আমি আসছি, মিঃ হেস্টিংসকথা শেষ না করেই দ্রুত তিনি নেমে গেলেন ওকে দেখে খুব কষ্ট হল। মিসেস লাটরেল সম্পর্কে এতটুকু অত্যুক্তি করেননি। ধীরে ধীরে পোয়ারোর ঘরের দিকে গেলুম ও দরজায় আলতো করে ঘা দিলুম…
.
০২.
ঘরে ঢুকে আমার মনে হল দিন-মাস বছরের সঙ্গে মানুষের চেহারার কী আশ্চর্য বিবর্তনই না ঘটে যায়! আমার সেই হতভাগ্য বন্ধু যার কাহিনী আমি এতকাল বিমূর্ত করেছি, শুনিয়েছি তার কীর্তি গাঁথা। আজ এভাবে তাকে দেখব ভাবতে পারিনি। সেই অস্বাভাবিক প্রাণোচ্ছল মানুষটির ছায়ামাত্র। একটা চাকা লাগানো চেয়ারে জড় অথর্বের মত বসেছিল। রোগে চামড়া কুঁচকে গেছে। কিন্তু বিখ্যাত কালো গোঁফ জোড়া এখনও আছে। একসময় বিখ্যাত কোম্পানির কলপ ব্যবহার করত, যদি এখনও সেই কলপ ব্যবহার করে তবে সেই নাটকের কুশীলব সেজে থাকার ইচ্ছেটা মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। কিন্তু আশ্চর্য চর্চকে সেই উজ্জ্বল তীক্ষ্ণচোখ দুটো এখনও আছে। কতক্ষণ নিঃস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না, জ্ঞান ফিরল যখন পোয়ারো পুরানো দিনের মতন আহ! প্রিয় বন্ধু আমার। এসো, কাছে এসো-বলে আহ্বান করল।
আমার বুকের মধ্যে তখন এক ঝড় বইছিল। তবুও তাকে অভ্যাসবশতঃ সম্ভাষণ জানালুম। কাছে যেতেই আগের মতন পরম আশ্বাসে বলতে লাগল, আহ। আমার প্রিয় হেস্টিংস। আমার বন্ধু। ঠিক, ঠিক সেইরকম। সেই ঋজু দেহ। সেই চওড়া কাঁধ। সেই উজ্জ্বল প্রশস্ত ললাট। বন্ধু হেস্টিংস যা শুধু তোমাকেই মানায়। তোমারই বিশেষ গুণবলী। হ্যাঁ পরিবর্তন তো হয়েছেই, তবু বলব মেয়েরা এখনও তোমায় দেখে আকৃষ্ট হবে। উত্তরে বললাম এই বয়সেও? শুধু সে বলল, বন্ধুবর সেটা তোমার পা ফেলার উপর নির্ভর করছে। হাসতে হাসতে ওর কথা জানতে চাইলাম। একটা শ্বাসকে দীর্ঘায়িত করে পোয়ারো বলল, আর আমার কথা দেখতেই পাচ্ছ, একটি ভঙ্গুর, একটি অতীত স্মৃতির ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। সূর্যাস্ত নেমেছে জীবনে। এখন আমি চলচ্ছক্তিহীন পঙ্গু অথর্ব জীবমাত্র। মনের জোরে যা হোক একটু নড়াচড়া করি। একেবারে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তবে কি জানো বন্ধু, এখনও মনের গহনে সেই অন্তঃসলিলা নদীটি তিরতির করে বইছে।
মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, তোমার হার্ট এখনও বেশ মজবুত। মাথানেড়ে বলল, হার্টের কথা বলিনি, আমার এই মস্তিষ্কটি এখনও আগের মত কাজ করে চলেছে। তার এই শারীরিক কষ্ট অথচ বিনষ, অমায়িক ব্যবহার দেখে বললাম, কেমন আছো?
সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মন্দ নয়। তুমি যদি রিৎজ হোটেলের স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে তুলনা করো তবে নিশ্চয়ই হতাশ হবে। খাবার দাবারের কোনো জৌলুষ নেই। রান্না একেবারে যাচ্ছেতাই। আলু সেদ্ধ দেয়, বটে তবে তাতে যে নুন দিতে হবে তা খেয়াল থাকে না। সবকিছুই পানসে। ইংরেজ খানাপিনার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না।
সহানুভূতির সঙ্গে বললাম, তাহলে ভালো কোথায় আছো? থাক, খাওয়ার কষ্ট। কিন্তু আমায় থামিয়ে বললেন, এ কষ্ট আমি ইচ্ছে করেই বয়ে চলেছি। কেউ আমার এখানে এসে দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে বলেনি–ওর কথার মর্মার্থ না বুঝেই বললাম, বুঝেছি। যুদ্ধের পর যে হারে জিনিষপত্রের দাম বেড়েছে এবং তোমার আয়ের পথ
কিন্তু আমায় থামিয়ে বলল, একদিকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে আছি। আমার আর্থিক কোনো কষ্ট নেই বা আর্থিক অনটনের জন্য আমি এখানে থাকছি না। খুশী হয়েই তখন বললাম ভালো লাগল সে সব কিছুই তোমার দুঃখকষ্টের কারণ নয়। ওর পাশে বসে বলতে লাগলাম, পুরনো স্টাইলের একটা মোহ আমার মধ্যে আছে। কতকাল পরে আমরা আবার মিলেছি। সেই পুরনো স্থান, স্মৃতি মনকে ভারাক্রান্ত করবে জেনেও এখানে ফিরে এসে আনন্দ পাচ্ছি, তোমারও নিশ্চয়ই হচ্ছে?
কিন্তু উদাসীনতার সঙ্গে সে বলল, তার তেমন কিছু হচ্ছে না। পুরনো স্মৃতি আমায় তাড়া করে না। ভুলে যেও না আমি বেলজিয়াম ছেড়ে ইংল্যাণ্ডে এসেছিলাম অর্থকষ্টের তাড়নায়, বাঁচার তাগিদে, উদ্বাস্তু হয়ে, ভাবিনি ইংল্যাণ্ড কোনোদিন আমার বাসভূমি হবে। তোমার সুখ আর আমার সুখ হল নদীর এপার ওপার। তোমার সুখ তুমি আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাও-অপ্রতিভ হয়ে বললুম–মোটেই তা নয়। কিন্তু পোয়ারো মুচকি হেসে বলল যে সেই যে আমি একসঙ্গে দুটো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম, সেই স্মৃতিও আমি ওর উপর বহাল করব কিনা? ও ভোলেনি। আরো বলল, তখন তোমার দুটি মেয়েকে ভালোবেসে কী বিড়ম্বনায় পড়েছিলে তা তোমার চেখে মুখে ফুটে উঠেছিল। বিগলিত হয়ে পোয়রোর হাতদুটো ধরে বলি, সেদিন তুমি আমায় না বাঁচালে কে উদ্ধার করত। তোমার ভালোবাসা, তোমায় পেয়ে আমার এ জীবন ধন্য হয়ে গেছে।
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বলল, পিছনে তাকাবে না। সামনে তাকাও পিছনে যেমন দুঃখ আছে, তেমন সুখও আছে। এখনও হয়তো কিছু আছে।
কিন্তু আমি সেইসব সুখস্মৃতি শেষ করে দিতে চাই না বলে বিরক্তির সঙ্গেই বললাম, কী আছে সামনে? এই তো জীবন শেষ করে আনলুম। পোয়ারো হুইল চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, এখনও আমাদের সব কাজ শেষ হয়ে যায়নি, পোয়ারোকে দমিয়ে দেবার জন্য বললুম, দুজনেই বুড়ো হয়েছি। নতুন করে আর কী চাওয়ার বা পাওয়ার থাকতে পারে?
রহস্যময় এক হাসি হেসে বলল, আছে, আছে। বিভ্রান্ত হয়ে যাই, বলি কোথায়? পোয়ারো তখন এই বাড়ির দিকেই আঙুল দেখিয়ে বলল, এখানে।
অবাক হয়ে ভাবি, সত্যিই এখানে কোনো রহস্যময় ঘটনা তো চোখে পড়েনি, তবে কি থাকতে পারে এখানে?
একটু মদ নিয়ে পোয়ারো বলল, কেন আমি আবার সেই পুরনো স্টাইলস সেন্ট মেরীতে এসে উঠলাম জানো– এখানে একটি হত্যাকারীকে ফাঁদে ফেলব বলে ফাঁদ পেতে বসে আছি।
বৃদ্ধ, অথর্ব পঙ্গু হলেও এখনও রসিকতা আছে ওর মধ্যে। রহস্য জাল গুটিয়ে গুটিয়ে খুনীকে ফাঁদে ফেলার সময় তো অনেককাল আগে চলে গেছে। এ নিশ্চয়ই এর ছলনা মনে হল। আমার উৎসাহে ভাটা পড়তে দিতে চায় না বলে।
মরিয়া হয়ে আসল কথাটা জানতে চাইলুম। গলায় জোর এনে বলল, কাঠ খড় পুড়িয়ে এ বয়সে ছেলেমানুষী করে তোমাকে এখানে ডেকে আনার কোনো সাধ নেই। আমার দেহ পঙ্গু, অথর্ব হলেও মস্তিষ্ক সূর্যের ন্যায় দীপ্যমান। এখনও মস্তিষ্ক আমার আগ্নেয়গিরির মত অগ্ন্যুৎপাতে অভ্যস্ত, প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছে আমার দেহ। এখন তুমি, আমার প্রিয় বন্ধু। আমার হাত-পায়ের কাজটা সারবে।
মনে হল ঠাট্টা করছে। কিন্তু ও বলল ঠাট্টা নয়, আমরা একবার শিকারে নেমে পড়তে চাই
মনশ্চক্ষে পোয়ারোকে আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলুম। তার মধ্যে কোনো ছলনা বা চপলতা নেই। তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল–শেষ পর্যন্ত তুমি আশ্বস্ত হয়েছে। আমাকে ভেবেছিলে হয়তো মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। বললাম-কী এমন গভীর রহস্য আছে এখানে, যেখানে তুমি সেই আগের পোয়ারো হয়ে উঠতে পারো? আমার এখনও এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ পরিচিত হয়ে ওঠেনি।
একটু গম্ভীর হয়ে পোয়ারো জিজ্ঞেস করল, কজনকে এ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছো? উত্তরে বললাম–লাস্টরেল দম্পতি, নরটন এবং বয়েড ক্যারিংটন।
হুম একটা গম্ভীর শব্দ করে, ভেবে পোয়ারো বলল, কিছু কিছু দেখেছো, সবটা নয়, সব দেখলে তখন তোমার মনে হবে চিন্তাভাবনাগুলো সোজা রেল লাইনের মতন। একটু অনুসন্ধিৎসু হয়ে বললাম, আর কে কে আছেন এখানে?
পোয়ারো বলল–ফ্রাঙ্কলিন দম্পতি, ফ্রাঙ্কলিন ডক্টর, তার রুগ্ন স্ত্রী, ডাক্তারের রুগ্ন স্ত্রীকে দেখাশোনার জন্য হাসপাতালের নার্স, তেমার মেয়ে জুডিথ, এক অ্যামারটন নামে ভদ্রলোক। সুন্দর, সুপুরুষ, মেয়েরা সহজেই মজে যাবে তার চেহারা দেখে। আর আছে মিস কেলি।
এবং এদের মধ্যেই একজন হত্যাকারী? –আলতো করে ছুঁড়ে দিলাম আমি।
পোয়ারো মন্তব্য করল, হা, এদের মধ্যে একজন হত্যাকারী।
পোয়ারো বললেন, একটু বিভ্রান্ত হয়েই, তোমার এমন মনে হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। ও শুধু বলল, এককথায় সব শেষ করে দেওয়া যাবে না। তবে প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। একটা ছোট্ট বাক্স ও নিয়ে এল, চাবিটা আমাকে দিল- মনে হল পোয়ারো সেই পুরনো দিনে ফিরে এল। রহস্যের ঝাপি খুলবে। কোনো প্রতিবাদ না করে ঘরের কোণে রাখা বাক্সটার চাবি খুলে পোয়ারোর কোলের কাছে রেখে বসে উদগ্র আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম।
ডালা তুলে বাক্স থেকে ও সংবাদপত্র থেকে বেছে কেটে রাখা একগুচ্ছ কাটিং বার করল। টুকরোগুলো আমার হাতে দিয়ে বলল- ওগুলো তোমার কাছে রাখো। এখন দেখার প্রয়োজন নেই। ওগুলো সময় মত দেখো। ওখানে কখন কখন ঘটে যাওয়া কিছু দুঃখজনক ঘটনার সংবাদ আছে, সব সত্য না হলে, তোমার চিন্তার খোরাক পাওয়া যাবে ওখানে। এবার অন্য কিছু দেখা যাক বলে, একপ্রস্থ কাগজ বাক্স থেকে বার করল যেখানে ওর হাতের লেখা দেখা গেল। বলল, চটপট পড়ে ফেলো। কতকগুলো ঘটনা আমি পর পর সাজিয়েছি। তোমার পড়া হয়ে গেলে আলোচনায় বসব। গভীর উৎসাহের সঙ্গে পড়তে শুরু করলাম। যেভাবে ও সাজিয়েছে ঠিক সেভাবে। ঘটনা ক–এথারিটন।
পৃথিবীর প্রতি অনাসক্ত, মনমরা, বদঅভ্যাসী, মদ ও হাশিসাসক্ত, স্ত্রী-যুবতীর প্রতি আসক্ত। স্বামীকে নিয়ে বড় ঝামেলা। এই মুহূর্তে এথারিটন মারা গেলেন। খাদ্যে বিষক্রিয়া, ডাক্তারেরা খুশী নন, পেটে সেঁকো বিষে মারা গেছে, তদন্তে জানা গেছে। মিসেস এথারিটনকে অ্যারেস্ট করা হল। মামলা রুজু হল হত্যার। কিছুদিন পূর্বে ভারতবর্ষে সিভিলিয়ান ছিলেন। মিসেসের একবন্ধু। চাকরি ছেড়ে ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছেন। মিসেস তার প্রতি আসক্ত এ খবর পাওয়া না গেলেও দুজনের গোপন ভালোবাসার হদিশ মিলল। এই সিভিলিয়ান নাকি ভারতবর্ষ থেকে জাহাজে ফেরার সময় এক মহিলার প্রেমে পড়েন। মিসেস তাতে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। যদিও এ ঘটনা এথারিটনের মৃত্যুর পূর্ব না পরবর্তী ঘটনা তা জানা যায়নি। স্বামীর উচ্চুঙ্খল জীবনযাপন ও স্ত্রীর প্রতি নজর না দেওয়ার অভিযোগে মিসেস এথারিটন ছাড়া পেলেন। এবং খাদ্যে যে মিসেস এথারিটন বিষ মিশিয়েছেন তার প্রমাণও পুলিশ দেখাতে পারেনি। এর ঠিক দু বছর পরে মিসেস তো একদিন ঘুমের মধ্যে মারা যান। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন মৃত্যুর কারণ। ঘটনা খ মিস শার্পলস।
পঙ্গু, বর্ষীয়ান কুমারী। ভাইঝি ফ্রেডা ক্লে দেখাশোনা করে। মিস শার্পলস একদিন মারা গেলেন পেটের যন্ত্রণায়। ময়নাতদন্তে মরফিয়া পাওয়া যায়। তিনি পেটের যন্ত্রণায় প্রায়ই কষ্ট পেতেন। ফ্রেডা ক্লে স্বীকার করে যে অস্বাভাবিক পেটের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পিসি সেদিন বেশিমাত্রায় মরফিয়া নিয়েছিল। পুলিশ বলে এটি ইচ্ছাকৃত ঘটনা নিঃসন্দেহে কিন্তু পিসিকে মেরে ফ্রেডার কি লাভ তা জানতে না পারায় পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।
ঘটনা গ-এডওয়ার্ড রিগস।
কৃষি শ্রমিক। তার সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে জমির মালিকের গোপন প্রণয় ছিল। একদিন হঠাৎ জমির মালিক ক্রেগ ও এডওয়ার্ডের স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেল। রিগসের বন্দুক ছিল। পুলিশ প্রমাণ পেয়েছে সেই বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। রিগসকে অ্যারেস্ট করা হল। প্রথমে মৃত্যুদণ্ড হলেও, মস্তিষ্ক বিকৃতির জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল।
ঘটনা ঘ–ম্যাথু লিচফিল্ড।
নিষ্ঠুর বয়স্ক প্রকৃতির। চার মেয়ে। লিচফিল্ডের দাপটে সবাই তটস্থ। এক কানাকড়িও খরচ করে কাউকে দেয় না। এক সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফেরেন কে যেন হাতুড়ির ঘা বসিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয়। হাসপাতালে মৃত্যু হয়। পুলিশি তদন্ত শুরু হলে, তার বড় মেয়ে মার্গারেট থানায় কবুল করে সেই বাবাকে মেরেছে। কারণ কী? না, বাবা বড় অত্যাচারী ও কৃপণ। পরের বোনেরা যাতে সুখে থাকে, সেই ভেবে একাজ সে করেছে। মিঃ লিচফিল্ড প্রভূত ধনসম্পত্তি রেখে গেছেন। বিচার কালে মার্গারেটের মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা গেল, হাসপাতালে ভর্তি করা হল এবং কিছুদিন পরে মারা গেল।
পর পর সাজানো ঘটনা, সুন্দর হলেও এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না। পোয়ারো চোখ বুজে বসেছিল, আমি থামতেই বলল–কেমন বুঝলে?
বললাম হুঁ যদিও তোমার এই পর্যায় ক্রমিক ঘটনায় কোনো খুঁত নেই, তবে বহুদিন পূর্বের ব্রাডলির মামলার কথা মনে আসছে। কাগজে পড়েছিলাম, ভদ্রমহিলা সুন্দরী ছিলেন।
কোনো কথা না বলে পোয়ারো মাথা ঝাঁকালো।
আমি নাছোড়বান্দা ভাবে বললাম, চুপ করে থাকলে হবে না এর রহস্য আমায় বুঝিয়ে বল।
কিন্তু উল্টে পোয়ারো বলল, ঘটনাগুলো তোমার কেমন লাগল?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, বুঝিয়ে না দিলে বুঝতে পারব না। এখানে শুধু বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া পাঁচটি মৃত্যুর ঘটনাছাড়া কিছু নেই, সূক্ষ্মভাবেও কোনো মিল নেই এদের মধ্যে। একটি হিংসা থেকে, একটি অর্থের লোভে, একটি নির্দয় স্বামীর হাত থেকে মুক্তির জন্য, বাকি দুটোর কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে না পেলেও অতিরিক্ত সুরাপান এর কারণ হলেও হতে পারে। দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, এসব হত্যার মধ্যে কী কোনো যোগসূত্র আছে যা আমার নজর এড়িয়ে গেছে?
পোয়ারো বলল, সুন্দর বিশ্লেষণ। একটা ব্যাপার যা তুমি উল্লেখ করনি তা হল, এসব হত্যার মধ্যে সন্দেহের কোনোকিছুই নেই।
বিমূঢ় হয়ে বললুম, তোমার কথা বুঝতে পারলুম না।
মিসেস এথারিটনের মামলাটিই ধরো। তিনি খালাস পেয়েছেন ঠিকই, যদিও সবার মনেই স্থির বিশ্বাস ছিল তিনিই হত্যাকারী। তার পর ফ্রেডা ক্লে। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কি একটা ভেবে বলল, কেউ কি ওর দিকে কুটি করে বলতে পেরেছে, হা তুমিই খুনী। তুমিই খুন করেছ। না, পারেনি। কারণ জুরীদের হাতে তেমন কোনো অকাট্য সাক্ষ্য ছিল না। রিগস বলছে সে মনেই করতে পারছে না যে সে-ই তার স্ত্রীর হত্যাকারী। অথবা, তার প্রণয়ীর যদিও এক্ষেত্রে সে ছাড়া আর কেউই খুনী হতে পারে না। একমাত্র মার্গারেট লিচফিল্ড বলেছিল সে তার বাবাকে আঘাত করেছে। অথচ সে মানসিক হাসপাতালে মারা গেল। আসলে প্রত্যেকটি ঘটনায় একজন না একজন অপরাধী থেকেই যাচ্ছে। এটা কি তোমার মনেই হচ্ছে না বন্ধু? বললাম, হতে পারে আবার নাও হতে পারে। ঠিক বুঝতে পারছি না। পোয়ারো বলল, আমি ঠিক তোমাকে সত্যের সন্ধানে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ। ধর কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। প্রত্যেকটি ঘটনায় একটা যোগসূত্র আছে।
কিভাবে? ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না।
পোয়ারো আরো রহস্যময় হল। খুব গোপন কথা উচ্চারণ করার ভঙ্গিতে বলল, সেকথা উচ্চারণ করতে আমায় সাবধানী হতে হবে। কারণ অদৃশ্য সূত্রটি ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে। এটাকে আরও স্পষ্ট করতে হবে। সমস্ত ঘটনাকে আমি যেভাবে ভেবেছি, তোমায় বলছি। ধর সমস্ত ঘটনার পিছনে এক্স-এর হাত আছে। কিন্তু সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে শুধু কল্পনামাত্র। আপাত দৃষ্টিতে হত্যার পিছনে তার কোনো উদ্দেশ্য নেই। শুধু একটি ঘটনায় তার ছায়া খুব কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে। তবুও অস্পষ্ট যে সেই ঘটনার সময় এক্স এর খুব কাছে হলেও দু-শো মাইল দূরে থাকার কথা হিসেব মত। এখন এই ভদ্রলোকের পশ্চাৎপদ শুনে যাও। মিঃ এথারিটনের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা ছিল। একসময় রিগসের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকত। মিসেস ব্রাডলি তার খুব কাছাকাছি এসে ছিলেন। একটি ফটো পেয়েছি যেখানে এই ভদ্রলোক ফ্রেডা ক্লের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন। বৃদ্ধ লিচফিল্ড যেদিন মারা যান সেদিন এক্স খুব ধারে কাছেই ছিলেন। হঠাৎ পোয়ারো বলল, কেমন বুঝছো বন্ধু?
ওর দিকে তাকিয়ে বললাম যদিও বাড়াবাড়ি হচ্ছে তবুও বলতে পারি দুই কি তিনটি ক্ষেত্রে এক্স এর আনাগোনা সম্ভব। পাঁচটি ঘটনার ক্ষেত্রে…. না অতটা উদার হতে পারছি না।
পোয়ারো মুচকি হেসে বলল, একেবারে বিশ্বাস না হলেও উড়িয়ে দিতে পারছি না। তারপর বলল, এবার তোমায় একটু চমকে দেব। যদি বলি এক্স ভদ্রলোক এই বাড়িতেই আস্তানা গেড়েছে; তাহলে কেমন হয়?
যেন মহাশূন্যে তুলে, আমায় কেউ আছড়ে দিল। এ-এই বাড়িতে?
পোয়ারো আমার হৃদপিণ্ড মুচড়ে দেওয়ার জন্য যেন থমথমে গলায় বলল, যদি এতদিনের অভিজ্ঞতা মিথ্যে না হয়ে থাকে তবে এখানে আর একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে….
বহুক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারিনি। কে যেন আবার আমায় স্টাইলসের সেই ঘরে পোয়ারোর কাছে টেনে নিয়ে এল। বললাম এ হতে পারে না, যেমন করে থোক এ রুখতেই হবে।
অপার্থিব এক জ্যোতিতে পোয়ারোর মুখ উদ্ভাসিত হল। প্রথমে সস্নেহে পরে গভীর মমতায় বলল, হে আমার প্রিয় সুহৃদ। কী বলে তোমায় শ্রদ্ধা জানাব। এত নির্ভরতা তোমার আমার উপর। যদি তার সামান্যতমও দেখাতে পারতাম। হায় বন্ধু
পোয়ারোকে আমার চেয়ে কেউ বেশি জানে না। বললাম, তুমি পারো না এমন কোনো কাজ নেই। ও বলল, তোমার এই নির্ভরতার মর্যাদা যদি দিতে পারতাম তাহলে আমার চেয়ে কে বেশি সুখী হত? একটু ভেবে দেখ, একজন হত্যাকারীকে ফাঁদে ফেলা যায় কিন্তু হত্যাকে থামানো যায় কী ভাবে? এ কী কখনও সম্ভব?
পোয়ারোর হাত ধরে বললুম, তুমি পারো যদি তুমি আগে থেকে জেনে থাক কে সেই এক্স।
গভীর খেদের সঙ্গে বলল, যতটা ভাবছ, বাস্তবে ততটা স্বচ্ছ নয়। হয়তো তিনরকমভাবে আমরা কিছু একটা করলেও করতে পারতাম। প্রথমতঃ যার উপর আঘাত আসবে তাকে আগে থেকে সাবধান করে। তাকে বলতে পারি হত্যাকারীর অদৃশ্য খাড়া নেমে আসছে তোমার উপর। ভেবে দেখ বন্ধু এভাবে কোনো মানুষকে তুমি বুঝিয়ে উঠতে পারবে না, তোমার জীবন বিপন্ন। যদি বলা যায় হত্যাকারী আপনার খুব পরিচিত তবে সে হেসে উঠবে। ভাববে হয় রসিকতা, নয় তার উপর ঈর্ষান্বিত হয়েছে। তুমিই বল এ কাজ কি সম্ভব?
দ্বিতীয় পথ হল হত্যাকারীকে সতর্ক করে দেওয়া, সাবধান। যদি অমুক সময়ে খুন হয় তবে তুমিই খুনী এবং তখন তোমার জন্য ফাঁসির দড়ি অপেক্ষা করবে। এ তো খুব ছেলেমানুষী ব্যাপার। খুনীরা খুব চালাকচতুর, তখন সে অন্য পথ বেছে নেবে যা শত চেষ্টায় ধরতে পারবে না।
ও সামান্য থামতেই জিজ্ঞেস করলাম, তৃতীয় পথটি কি?
হা। বলল, এই পথটি মোটেই কুসুমাকীর্ণ নয়। তা হবে যেমন বুদ্ধিতে ক্ষুরধার তেমন চিন্তায় থাকবে নব নব উন্মেষণা। দৃষ্টি থাকবে জাগ্রত প্রহরীর মত, মন থাকবে বাতাসের মত গতিময়। প্রতিটি মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যুক্তি তর্ক দ্বারা আততায়ীর গতি প্রকৃতি বুঝতে হবে। তার মানসিক স্থিতিশীলতা বুঝতে হবে। যখনই চরম মুহূর্ত উদিত হবে ঝাঁপিয়ে পড়বে আততায়ীর উপর। যদি সবার প্রত্যক্ষ উপলব্ধির সামনে তার মনের বাসনাকে উন্মুক্ত করে দেখা যায় তবে যে দুটি প্রথমোক্ত কাজ আমরা করতে পারিনি, তা এবার করলেও করতে পারি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এসব ঘটনা ঘটানো মুস্কিল। খুনী তার ইচ্ছেটাকে সবার থেকে গোপন রাখবে, ফলে বাস্তবে কোনো প্রস্তুতি নিতে পারব না। যেহেতু তুমি ভদ্রলোক সেহেতু যিনি ঘটনা ঘটাতে পারেন তার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে পারবে না। তাই তৃতীয় পথ সম্বন্ধে আলোচনা করব কিনা ভাবছিলাম। নিজের সম্পর্কে গর্ববোধ করলেও আমি গর্দভ বনতে রাজী নই।
তাহলে আশু কর্তব্য কী?
হয়তো তিনটি চেষ্টাই চালিয়ে যেতে হবে যদিও প্রথমটা দুঃসাধ্য।
কেন, আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ওটাই সহজতর।
পোয়ারো বলল, হয়তো ঠিক। কিন্তু বন্ধু আসলে আমি এখনও ঠিক সেই লোকটিকে চিনে উঠতে পারিনি।
তুমিও জানো না! এবার রাজ্যের সব বিস্ময় আমার চোখ উপচে পড়ে।
পোয়ারো বলল, শতকরা একশভাগ সত্যি কিন্তু যে খুন হতে চলেছে তার পরিচয়টা জানা নেই। তাহলে বুঝতে পারছ কাজটা খুব সহজ নয়।
কিন্তু পোয়ারো খুনীর উদ্দেশ্য কী? সে কী চায়? কেন চায়?
হঠাৎ খুশী হয়ে উঠে বলল, শেষ পর্যন্ত তুমি ভাবতে শিখেছো দেখে আনন্দ হল।
আমি বুঝতে পারছি যে খুন হতে চলেছে তাকে না চিনলেও, এক্স কে চেনো।
মাথা নাচাতে নাচাতে পোয়ারো বলল, প্রাণসখা হে আমার, সেকথাটি এখনই বলছি না।
গোপন কথাটি গোপনেও শুনিয়ে যাও, ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি।
কিন্তু কাজটি তো মোটেই করতে পারছি না প্রিয়। আমি চাই না দিনরাত তুমি খুনীর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকো, এই সেই খুনী যাকে ইচ্ছে করলে যে কোনো সময়ে ধরিয়ে দিতে পারি। তুমি কি ভেবেছো আমায়? এটুকু চেপে রাখতে পারব না? তুমি হাবে ভাবে দেখাবে আমি কিছুই জানি না–এরকম অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না। তাতে খুব সাংঘাতিক ক্ষতি হবে। তার থেকে এখন অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে থাকা যাক, যখন সময় হবে দুজনে আঁপিয়ে পড়ব।
বললাম, তুমি সেই আগের মতন ঘুঘুই আছো এবং হঠাৎ আমার কথার মাঝে দরজায় ঘা পড়ল। থেমে গেলুম।
পোয়ারো ডাকল–এস। দরজা ঠেলে আমার দুহিতা জুডিথ এল।
যদিও বর্ণনায় আমি চিরকাল কাঁচা তবুও আর সাধারণ পাঁচটা মেয়ের মতন বেশ লম্বা। ও প্রকৃত অর্থে সুন্দরী হলেও ওর সৌন্দর্যে উপচে পড়া যে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে সবসময়, তা বাবা হয়ে আমার ব্যথিত করে।
জুডিথের সেই জেদী স্বভাব এখনও বদলায়নি। আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না বা আদর করল না, শুধু হেসে জিজ্ঞেস করল, কখন এলে?
ওদের আধুনিকতার সঙ্গে কথা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, বললাম, এই তো কিছুক্ষণ।
মিষ্টি অনুযোগের সঙ্গে বলল, বেশ চালাক হয়েছে তো, একটুও খবর দাওনি?
পোয়ারো হঠাৎ জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, এখানকার খাওয়া দাওয়া, রান্নাবান্নার কথা সবই শুনিয়ে দিয়েছি পাছে তোমার পিতাঠাকুরের কষ্ট হয়।
জুডিথের এখানকার রান্না কী যাচ্ছেতাই? প্রশ্নের উত্তরে পোয়ারো বলল, কেন বোকা সাজার চেষ্টা করছ? দিনরাত ঐ খাঁচায় বন্দী হয়ে আছে। নিজের ফুলের মতন আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ, নীলছোপ ধরেছে। তোমার বয়সের মেয়েরা শেখে সুন্দর সুন্দর রান্না করে স্বামীর হজমশক্তি কিভাবে বাড়াতে হয়। সে বয়সে তুমি টেস্ট টিউব নাড়াচাড়া ও মাইক্রোস্কোপে পোকামাকড় খুঁজে বেড়াচ্ছ।
জুডিথ গম্ভীরভাবে বলল, কোনোদিন আমার স্বামীটামী হবে না। বিয়েটা কী? সংসারে মেয়েদের কী আর কিছু করার নেই?
পোয়ারো কড়া অভিভাবকের মত বলল, বিয়েটা সবার আগে। সংসারে তাই হয়ে আসছে
জুডিথ পোয়ারোর সব কথা মেনে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।
পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন নয় বুড়ো বয়সে বুঝবে। এর মধ্যে ডঃ ফ্রাঙ্কলিন এলেন এবং তার সঙ্গে পরিচয় হল। বলিষ্ঠ, বছর পঁয়ত্রিশের যুবক। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল অন্যমনস্ক ধরনের।
ঘরে ঢুকেই পোয়ারোর চেয়ার একপাক ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, আমায় ক্ষমা করবেন।
ওর ছেলেমানুষী দেখে অবাক হবেন।
জুডিথ বলল, আমার বাবাকে নিশ্চয়ই চেনেন?
ফ্রাঙ্কলিন প্রথমে একটু লজ্জা পেয়ে তার পর আমার সঙ্গে করমর্দন করে বলে উঠল, শুনেছিলাম আপনি আসবেন। উত্তরের প্রত্যাশা না করেই জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলল, জুডিথ তাহলে
জুডিথ বলল, এখন সময় দিতে পারছি না, বাবার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
ফ্রাঙ্কলিন সলজ্জ দৃষ্টিতে বলল, সত্যি মাঝে মাঝে আমি ভীষণ স্বার্থপর হয়ে পড়ি। ক্ষমা করবেন। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ হতেই বলে উঠল, বারবারাকে কথা দিয়ে দিলুম ডিনারের আগে উঠে কিছু পড়ে শোনাব, এখন চলি, বলে বেরিয়ে গেল।
জুডিথকে বললাম, মিসেস ফ্রাঙ্কলিন এখন কেমন আছেন? আগের মত নেই। স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছে।
বললাম, এ বয়সে অথর্ব হয়ে পড়া যে কি বেদনাদায়ক।
হঠাৎ জুডিথ ডাক্তারের পক্ষ হয়ে বলল, এ যে কী ভীষণ অবস্থা একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে। যারা রিসার্চ করেন তারা সবসময়ই চান একজন স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীকে পাশে।
আমি উম্মা প্রকাশ করে বললাম তোমরা, এই আজকালের ছেলেমেয়েরা বড় বেশি স্বার্থপর। কোনো দ্বিরুক্তি না করে জুডিথ বলল, আমি শুধু ওঁর প্রকৃত অবস্থার কথা বলেছি।
শুধু পোয়ারো বলল, এই সদাশিব ডাক্তারটির কর্তব্য বোধ আছে বলতে হয়, কেমন তাড়াতাড়ি চলে গেলেন স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু জুডিথ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ডাক্তার যেমন বোকা তেমন তার স্ত্রী। নার্স রাখা হয়েছে, দরকার হলে সে-ই পড়ে শোনাবে। আমি হলে এইসব ছেলেমানুষী বরদাস্ত করতাম না।
যার যেমন ইচ্ছে, বললুম আমি। পোয়ারোও বলল, খুকুমণি, তোমার সঙ্গে আমিও একমত হতে পারছি না। ফ্রাঙ্কলিনের স্ত্রী হয়তো সব সময় স্বামীকে চোখের সামনে রাখতে চান। জুডিথ নিজের মনে বলে গেল…. ভদ্রমহিলাটি কাণ্ডজ্ঞানহীন। না হলে ঐ সব বস্তাপচা উপন্যাস পড়ে শুনবে, ভালো জিনিস শুনবে না। আর দেখা হলেই নিজের স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য। উহঃ। অসহ্য, বড় একগুঁয়ে মহিলাটি। কেবল বেড়ালের মতন মিউমিউ করবে। আমি এইসব ঘ্যান ঘ্যানানি পছন্দ করি না, আর যে করে করুক না কেন।
আমি বলে উঠলুম, জুডিথ তোমার এই খুড়ো মশায় কিন্তু জাঁদরেল মেয়েদের বেশি পছন্দ করেন।
অমনি পোয়ারো ফেঁড়ন কেটে বলল, তোমার বাবা আবার সোনালী নরম চুলের টুসটুসে মেয়েদের বেশি পছন্দ করে। এর জন্য কম বিপাকে পড়তে হয়নি ওকে। জুডিথ হেসে বলল, তোমরা দুজনে কেউই কম যাও না।
জুডিথ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠে পড়লুম, চানটানও সারা হয়নি।
পোয়ারো হুইলচেয়ারে আঁটা বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গেই এক নতুন ভৃত্য এল। ভর্জে কোথায়? বললাম, সে তো বহুকাল তোমার সঙ্গী ছিল।
ও দেশে গেছে, শরীর অসুস্থ। সবদিক দেখে শুনে শীঘ্রই ফিরবে। নতুন গৃহভৃত্যের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল, কারটিস এরপর আমারও ব্যবস্থা করো।
কারটিস হাসল। ওর চেহারাটা গোবেচারা ধরনের হলেও জবরদস্ত। ও চলে যাওয়ার পর পোয়ারো সেই কাগজগুলো বাক্সে তালা দিয়ে রাখল এবং আমিও ঘর ছাড়লাম।
.
০৪.
পোয়ারো আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই খাবার টেবিলে একটু উন্মনা ছিলাম। চিন্তা ভাবনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সারাজীবন রহস্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে শারীরিক অপটুতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বৈকল্য ঘটাটাও ওর পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই রহস্যের ভৌতিক কল্পনা করাটা স্বাভাবিক। হয়তো এথারটিনের স্বামীকে খুন, শ্রমিকের তার স্ত্রীকে খুন… ঐগুলো সবই ঘটেছে, কিন্তু এর মধ্যে নতুনত্ব কোথায়? এসব তো আকছার ঘটে চলেছে। কিন্তু পোয়ারো সেই অদৃশ্য আততায়ীকে মনশ্চক্ষে দেখছে। কে সেই ভদ্রলোক?
পোয়ারোর চিন্তাধারাকে আমি ছোট করে দেখতে চাই না। হয়তো সত্যিই কোনো খুন হবে, আবার হয়তো নয়। ও আমার সাহায্য চাইছে অথছ খুনীর পরিচয় আমাকে জানাতে চায় না। অদ্ভুত! আমার উপর যদি ওর আস্থাই না থাকে তাহলে আমাকে কেন ওর চোখ-কান হতে বলবে? ওর ছেলেমানুষী দেখলে হাসি পায়। আমার মুখ দেখে নাকি সবাই বুঝে ফেলবে আমি কি ভাবছি। এর থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে।
ডিনারের ঘন্টা বাজল। হাসি মুখ নিয়েই ওখানে গেলাম। শুধু কে খুনী তো বোঝার চেষ্টা করব মনে মনে ভাবলাম। অনেক ভেবে মনে করলাম পোয়ারোর চিন্তা ভাবনাকে মর্যাদা দিতে হবে। মনে করে নিই এই একই ছাদের নিচে খুনীও আছে। কিন্তু। কে সে? এটা কি খুব সহজ কাজ?
মিস কেলি এবং মেজর এলারটনের সঙ্গে ডাইনিং রুমে যাওয়ার আগে পরিচয় হল। মিস কেলি দীর্ঘাঙ্গী, সুশ্রী, বয়স চৌত্রিশ হবে। এলারটনের দীর্ঘ দেহ এবং মেয়েদের আকৃষ্ট করার চেহারা দেখেই হয়তো একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। অথবা তার কথাবার্তার ধরন দেখে। যতই ওর পরিচয় আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ততই আমি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছি। হয়তো এর কারণ জুডিথের সঙ্গে ওর অন্তরঙ্গতা। কেন যে মেয়েরা এই সব লোকগুলোকে এত পছন্দ করে ভেবে পাই না। লোকটির বয়স চল্লিশ হবে। মনে হয় মদ্যপান করেন বা রাত জেগে জুয়োটুয়ো খেলেন। কর্নেল লাটরেল, বয়েড ক্যারিংটন সবাই ওকে সমীহ করেন। শুধু এর প্রতিপত্তির জন্য?
খাবার টেবিলে বসে সবার দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। যদি পোয়ারোর মস্তিষ্ক বিকল না হয়ে থাকে তাহলে উপস্থিত এই সব মানুষগুলোর মধ্যেই খুনীও উপস্থিত। যদিও খুনী পুরুষ না মহিলা তা জানতে পারিনি। তবু অনুমান করতে পারি সে আমারই শ্রেণীভুক্ত।
খাবার ফাঁকে ভাবি নিশ্চয়ই বুড়ো লাটরেল নয় যেরকম দুর্বল আর সদাশিব মানুষ। নরটন, এরকম অস্থির মস্তিষ্কের যেরকম কিন্তু গ্লাস নিয়ে ছুটোছুটি করছিল। বয়েড ক্যারিংটন খ্যাতনামা ব্যক্তি, তার পক্ষে খুনীটুনী সাজা মানায় না। ফ্রাঙ্কলিন ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কারণ জুডিথ যেভাবে তার সঙ্গে মেলামেশা করে, তাহলে ও নিশ্চয়ই কোনো আঁচ পেত। মেজর এলারটনের চেহারার মধ্যে একটা মারকুটে ভাব আছে। দরকার পড়লে নিজের ঠাকুমার চামড়া ছাড়াতেও পিছপা হবে না। আর মেয়েদের সঙ্গে যেভাবে মেলামেশা করে, একটা সুন্দর অজুহাত তাতেই তৈরি করে নেয়া যায়।
পোয়ারোর কথানুযায়ী যদি এলারটনই এক্স হয়, তাহলে ওর নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। যারা মেয়েদের মধ্যে বেশি আনাগোনা করে, তাদের বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পোয়ারো তো জানায়নি এক্স পুরুষ না মহিলা? তাহলে কি মিস কেলি? বেশ চাপা স্বভাবের, একটা কাঠিন্য চেহারার মধ্যে আছে। এই টাইপের মহিলারা ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারে, কিন্তু খাবার টেবিলে ওনার হাসিখুশী মেজাজ দেখে তা মনে হয় না। মিসেস লাটরেল, জুডিথ বা মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ওদের কী খুনী ভাবা যায়?
উদ্ৰান্ত ভাবে ড্রয়িংরুমের জানলা দিয়ে বাইরের বাগানটা দেখতে দেখতে বহুযুগ আগের দিনগুলো মনে পড়তে লাগল। মনে পড়ল সিন্থিয়া মারকরকে, তার পাগলামী সোনালী চুল যেন ধানের শিসের মত হাওয়ায় দুলছিল। সেইসব স্মৃতি আজও আমায় বিচলিত, আনমনা করে…..।
জুডিথ পাশে এসে কী ভাবছ বাবা যখন বলল তখন ঘোর কাটল। বলল, খাবার টেবিলে অত চুপচাপ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কি দেখছিলে? সর্বনাশ, তাহলে কি ও টের পেয়ে গেল। বললাম, কই না তো। হয়তো পুরনো স্টাইলসের ছবি সবার মধ্যে দেখতে চাইছিলাম। ওঃ, ভুলেই গিয়েছিলাম যুবা অবস্থায় তুমি এখানে ছিলে। আচ্ছা বাবা তখন এক বৃদ্ধা মহিলা এখানে খুন হয়েছিলেন না?
বললাম, হ্যাঁ, কেউ মারাত্মক বিষ তাকে দিয়েছিল।
ওকে দেখতে কেমন ছিল কুশ্রী না সুন্দরী?
ঠিক অতটা মনে নেই। তবে মহিলা বেশ দানশীলা ছিলেন, অন্তকরণও ভালো ছিল।
শ্লেষের সঙ্গে বলল, ও-দয়াবতী! আমি ভাবলাম না জানি কী। আন্তরিকভাবে তার পর বলল, আচ্ছা, তখনকার সব মানুষরা সুখী ছিলেন, না বাবা?
একটু আহত হলাম ওর প্রশ্নে। বললাম, মোটেই না।
বলল, কেন?
কারণ আছে। সবাই ভাবত, এখানে তারা বন্দী জীবনযাপন করছেন যেমন মিসেস ইঙ্গলথর্পপ, সেই দানশীলা মহিলা, অর্থের উপর কোনো ক্ষমতা ছিল না। তার যে সব সৎ ছেলেমেয়েরা ছিল তাদের নিজেদের ইচ্ছেমত অর্থকড়ি ব্যবহারের অধিকার ছিল না।
জুডিথ তিক্ত কণ্ঠে বলল, এইসব বুড়োবুড়িরা যে নিজে নিজেদের কী ভাবে? এইরকম একজন স্বার্থপর বদমেজাজী একজনকে আমি চিনি।
কার কথা বলছ?
উনি হলেন ফ্রাঙ্কলিনদের জানাশোনা এক ভদ্রলোক, লিচফিল্ড।
নামটা শুনেই চমকে উঠলাম।
ও আমার দিকে লক্ষ্য না করেই বলল, ভদ্রলোক ধনী হলেও নিজেদের মেয়েদের সঙ্গে কসাই-এর মতন ব্যবহার করত। কাউকে কানাকড়িও দিত না।
তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, তখন তার বড় মেয়ে তাকে খুন করল।
জুডিথ অবাক হয়ে বলল, খবরটা তাহলে তুমি পড়েছ। এর পেছনে ছিল না কোনো ঈর্ষা, শুধুই একটা ব্যক্তিগত পারিবারিক, ঘটনা। মার্গারেট লিচফিল্ড থানায় বলল সে তার বাবাকে খুন করেছে। সাহস ছিল, আমি হলে পারতাম না।
নিরাসক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কোনোটা পারতে না? খুন করা না, থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করা?
কোনোটাই নয়।
শুনে খুশী হলাম। ফ্রাঙ্কলিন কী বলে?
উনি বলেন-এ ঠিকই হয়েছে, পৃথিবীতে কেউ কারুর নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়।
শঙ্কিত ভাবে বললাম, জুডিথ এ মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। কে তোমার মাথায় এসব ঢোকাচ্ছে?
জুডিথ ভুরু নাচিয়ে বলল, কেউ না?
এসব আলোচনা মানসিক ও শারীরিক দুদিক থেকেই ক্ষতি করে। জুডিথ কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, যেটা বলতে এলাম; মিসেস ফ্রাঙ্কলিন তোমায় একবার দেখতে চান।
খাবার টেবিলে ওনাকে দেখতে না পেয়ে খারাপ লাগছিল, নিশ্চয়ই দেখা করব। ন্যাকামো, দুচোখে দেখতে পারি না, ঠোঁট বেঁকিয়ে জুডিথ কথাটা বলল।
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছোটরা এতও হৃদয়হীন হয়?
.
০৫.
যখন বয়স তিরিশ-ফিরিস তখন মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। ম্যাডোনার মত মুখশ্রী, উজ্জ্বল বাদামী চোখ, মাঝখানে সিৗথ কেটে চুল আঁচড়ানো, রোগা স্বচ্ছ মসৃণ কাঁচের মত চেহারা। বিছানায় বালিশ নিয়ে শুয়েছিলেন, ঈষৎ নীলাভ পাতলা গাউন পরে।
ডঃ ফ্রাঙ্কলিন ও বয়েড ক্যারিংটন একপাশে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আমি ঢুকতেই উনি উঠে অভ্যর্থনা করলেন। আপনি এসেছেন শুনে বেশ আনন্দ হচ্ছে। জুডিথও খুশি হবে। বড্ড বেশি খাটুনি যাচ্ছে ওর।
খাটের পাশে শূন্য চেয়ারে বসে বললাম, মনে হল এখানে ও বেশ ভালো আছে।
বারবারা ফ্রাঙ্কলিন একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, হয়তো আপনার কথা ঠিক। তবে ঠিক বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে ওকে ভীষণ হিংসে হয়। ও সুস্থ সুখী বলেই হয়তো অসুখটা কী, বুঝতে পারে না। তবে আমাকে চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনার জন্য নার্স-ক্লাভেন আছে। আসুন পরিচয় করিয়ে দিই। আমাকে ও সারাক্ষণ বাচ্চা মেয়ের মত আগলে রাখে।
ক্লাভেনের সঙ্গে পরিচয় হল। আমার দিকে তাকিয়ে সম্ভ্রমে মাথা নোয়ালো। দেখে মনে হল ঘরের সুন্দরী বৌ।
সত্যি বলতে কি জন নিষ্ঠুর জোতদারের মত ওর উপর ভীষণ কাজ চাপিয়ে দিয়েছে। কিছু ভুল বললাম জন। মিঃ ফ্রাঙ্কলিন চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলার ধারে গিয়েছিলেন। চমকে উঠে বললেন, কিছু বললে বারবারা?
হুঁ জুডিথকে ভীষণ খাটাচ্ছো। এখন মিঃ হেস্টিংস এসে পড়েছেন, আমি আর উনি দুজনে এখন জুডিথের সুখ সুবিধার দিকে নজর দিতে পারব।
জুডিথ হঠাৎ ঘরে ঢুকতে ওর দিকে তাকিয়ে ফ্রাঙ্কলিন বললেন, তোমাকে কি ভীষণ পরিশ্রম করাচ্ছি?
আমাদের দিকে এক পলক দেখে জুডিথ বলল, ওরা আপনার সঙ্গে মজা করছে। আমি জানতে এসেছিলাম কাঁচের টুকরোতে যে রক্তের নমুনা নেওয়া হয়েছে তার কী করবেন?
খুব ভালো করেছ মনে করিয়ে দিয়েছ। কিছু মনে করবে না, আমাকে এখনই একবার ল্যাবরেটরিতে যেতে হচ্ছে–আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। তারপর জুডিথ ও ফ্রাঙ্কলিন দুজনে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
সে সময় মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের চেহারা দেখে বড় কষ্ট হল। ক্লাভেন বলল, আসলে মিঃ ফ্রাঙ্কলিনের অত তাড়া থাকে না, মিস হেস্টিংস ওঁনাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে।
লজ্জায় আমার মুখটা লাল হয়ে উঠল। বারবার নিজের মনেই বললেন, হা ঈশ্বর, আমি যদি এদের কোনো কাজে সাহায্য করতে পারতাম, ভীষণ খারাপ লাগে আমার।
ফায়ারপ্লেসের পাশে দাঁড়িয়ে বয়েড ক্যারিংটন বলল, ওসব বাজে কথা ভেবে নিজেকে ব্যস্ত কোরো না, তুমি বেশ সুস্থ আছো।
কান্নার গলায় বারবারা ফ্রাঙ্কলিন বলে উঠলেন, ও সব তুমি বুঝবে না, ঐ সব অবলা গিনিপিগ, ইঁদুর ধরে কেটে ফেলা…., উহঃ কি নিষ্ঠুর, প্রকৃতিতে এই সব প্রাণীদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ আমি কি ভালোবাসি।
বয়েড ক্যারিংটন বারবারার বিছানার কাছে এগিয়ে এলেন। তারপর প্রেমিকের মতন তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন, তুমি একটুও বদলাওনি, সেই সতেরো বছরের কিশোরীর মত আছে। পুরোন স্মৃতিচারণা করতে করতে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানেন আমরা দুজনে ছোটবেলার খেলার সঙ্গী ছিলাম।
বারবারা প্রতিবাদ করলেন, খেলার সঙ্গী
ওহঃ, আমি কি জানি না, তুমি আমার থেকে অন্ততঃ পনেরো বছরের ছোট হবে। বাচ্চা ছেলের মত তোমার সঙ্গে খেলা করেছি। যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে ফিরে এলাম, দেখলাম তুমি এক বিকশিত পূর্ণা যুবতী। তখনও তোমায় নিয়ে গলফ খেলেছি, খেলা শিখিয়েছি তোমার মনে নেই?
লজ্জায় বারবারার গাল লাল হয়ে উঠল, বেশ বুঝতে পারলাম।
সে ভুলবার কথা নয়। জানেন মিঃ হেস্টিংস, আমার পরিবারের লোকেরা একসময় এদিকটায় বাস করতেন। আর তখন বিল আসত ন্যাটনে ওর কাকা স্যার এভার্ডের কাছে বেড়াতে
ন্যাটন যাচ্ছেতাই। আমার মনে হত ওটা একটা কবরখানা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বারবারা আহত হলেন। বললেন, একটা কবরখানাকেও ইচ্ছে করলে মোহনীয় করে তোলা যায়
হয়তো যায়। আমার অত ধৈৰ্য্য বা কল্পনাশক্তি কোনোটাই নেই। ওসব সাজানো গোছানো মেয়েদের কাজ, পুরুষের নয়।
কেন আমিতো সব গুছিয়ে সুন্দর করে দেব বলেছি।
ক্লাভেনের দিকে তাকিয়ে ক্যারিংটন বললেন, যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে ওকে নিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।
সে তো, ভালো কথা। তাহলে ওঁরও একঘেয়েমী কাটবে। কিন্তু যেন বেশি পরিশ্রম না হয়–
আনন্দে লাফিয়ে উঠে ক্যারিংটন বললেন, তাহলে কাল আমি তোমায় নিয়ে যাব।
আমি এক নির্বাক শ্রোতা ও দর্শকের মত সব দেখতে শুনতে লাগলাম। তারপর আমি ও ক্যারিংটন বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। ক্যারিংটন আমার পাশে বসে বলল, জানেন সতেরো বছর বয়সে ও কত প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল। যখন বার্মা থেকে ফিরেছি দেশে, তখন স্ত্রী মারা গেছেন। কিছু মনে করবেন না, ওকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু সুখী হল না। ও একটু আবেগপ্রবণ। সামাণ্য আঘাতে নুইয়ে পড়ে। ওকে নিয়ে একটু বেড়াতে গেলে খুশীতে ভরে উঠে। কিন্তু স্বামীটা একটা হনুমান। দিনরাত টেস্টটিউব আর ল্যাবরেটরি নিয়ে পড়ে আছে…।
আড়চোখে একবার ক্যারিংটনকে দেখলাম। এই হাড় সর্বস্ব মহিলার মধ্যে তার মত দশাসই দেহের পুরুষ কি দেখতে পেয়েছে। ব্যবস বলতে অজ্ঞান।
নিচে নেমে আসার সময় লাটরেল পাকড়াও করল। বলল, একহাত ব্রিজ খেলা যাক।
সবিনয়ে জানালাম, ওটা আমার ধাতে সয় না। তাছাড়া অথর্ব পঙ্গু বন্ধুকে সঙ্গ দেওয়াটা জরুরী বলে মনে করি।
পোয়ারো বিছানায় বসে। কারটিস আমাকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। বললাম, কোথায় তুমি সাড়া বাড়ি তোলপাড় করে বেড়াবে, না বিছানায় বন্দী। আমি কিন্তু তোমার এক্স-এর পিছনে লেগে পড়েছি।
মুচকি হেসে বলল, ভালো, শুনে আশ্বস্ত হলাম। ইতিমধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে।
শুনে লজ্জা পেলাম, আন্দাজ করে ফেলেছো, জুডিথের কথা মনে হল কিন্তু কি করে সেকথা বলি?
কোনো সমাধানে পৌঁছতে পেরেছ কী?
না। তবে তোমার ওই নরটন মিঃ এক্স হতে পারে। তবে এটা অনুমান। অস্পষ্ট ভাবে একটা চিন্তা করেছি মাত্র। কিন্তু এই অস্পষ্ট বা ছায়া নিয়ে খেলারও রকমফের আছে।
কী রকম?
কোনো ঘটনা ঘটেনি এরকম একটা ঘটনার কথা ভাবা যাক। ধরো এক সাদাসিধে লোকের আবির্ভাব হল সেই খুনী। খুব মিশুকে, শোনা যাচ্ছে তার মাছ ধরার একটা নেশা আছে।
অথবা পাখি ধরার পোয়ারোর কথা মাঝে জুড়ে দিলাম।
পোয়ারো বলল, অন্য ভাবেও বলা যায়। মাংস বিক্রি করে। আর সেই ছুরিটি একদিন মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠবে ভাবা যায়নি
বাধা দিয়ে বললাম, বড্ড খাপছাড়া শোনাচ্ছে। যদি কোনোদিন ঐ মাংস বিক্রেতার সঙ্গে বিস্কুটওয়ালার তুমুল ঝগড়া হয়।
যদি না এই মাংস বিক্রেতা ঐ বিস্কুটওয়ালাকে খুনের পরিকল্পনা করে থাকে। তবে তা নয়। আমাদের ব্যাপারটা অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে।
পোয়ারোর কথা বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য। কর্নেল লাটরেল কি তাহলে কাউকে খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে অতিথিশালা খুলে বসেছেন? এমন ঘটনা তো আগেও ঘটেছে।
আমার বোকার মত মুখ দেখে পোয়ারো বলল, বন্ধু যদি আমার মুখ দেখে সব কথা বুঝে যাবে ভাবো, তাহলে ভুল করবে।
সত্যি পোয়ারো, আজও তোমায় বুঝতে পারলাম না। শুধু নরটনই নয়, এলারটনও আমার সন্দেহের উর্ধ্বে নয়
ও নিশ্চয়ই তোমার পছন্দ নয়।
নিশ্চয়ই নয়–বললাম।
এদের আমরা ভালো চোখে দেখি না। ওরা মেয়েদের নিয়ে বড্ড বেশি মাতামাতি করে।
কেন যে মেয়েরা ঐ সব ফেরেববাজ লোকগুলোর দিকে আকৃষ্ট হয় বুঝি না।
এটাই পৃথিবীর বিস্ময়কর নিদর্শন।
কেন এমন হয় বলতো?
সেটাই তো আমি তোমার কাছে জানতে চাই।
পোয়ারো বলল, এটাই পার্থিব জীবনের ভয়ঙ্কর খেলা। দেখো অনেকে ষাঁড়ের লড়াই দেখে মজা পায় আবার অনেকের কাছে তা দৃষ্টিকটু। মেয়েদের মধ্যে একটা বাঁধন ছেঁড়ার প্রবণতা আছে। তাই এই টাইপের পুরুষেরা ওদের বেশি টানে। অথচ কত ভালো ছেলে সুন্দরী মেয়ের পাণিপ্রার্থী হয়ে ফিরে আসে।
এবার যেমন করে তোক আমি এক্সকে বার করবই। এলারটনই আমাকে জেদী করে তুলল।
বন্ধু তোমাকে ডেকেছি বিপাকে পা ফেলার জন্য নয়। একসময় আমরা একসাথে হেঁটেছি, এ পথটা যতটা সহজ ভাবছ ততটা নয়। এখানকার কেউ বরাহুত অথবা যে অর্থে আমরা হোটেল বুঝে থাকি, এখানকার স্টাইলকে সেভাবে দেখলে ভুল হবে। লাটরেল অর্থ সংকটে পড়েই এই অতিথিশালা খুলেছেন। এখানে যারা আছেন তারা ওদের বন্ধু বা বন্ধুদের পরিচিত। বয়েড ক্যারিংটন ফ্রাঙ্কলিনদের এখানে এনেছেন। আবার ফ্রাঙ্কলিনরা নরটনের জন্য সুপারিশ করেছেন। মনে হয় মিস কেলিও এই একই ভাবে এসেছেন। এখানে সবাই আত্মীয়ের মত আছে। তাহলে দেখ এক্স-এর এখানে কত সুবিধে। সে এল এবং অন্যকেও আসতে প্রলোভিত করল। এবার শ্রমিক রিগসের কথা মনে কর। যে গ্রামে সেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল তা বয়েড ক্যারিংটনের কাকার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। ফ্রাঙ্কলিনরাও কাছাকাছি বাস করতেন। সেখানকার ঐ সরাইখানাটিতে অনেক মানুষের আনাগোনা ছিল। মিসেস ফ্রাঙ্কলিনদের পরিবারের লোকেরা এখানে বেড়াতে আসতেন। তিনি নিজেও কখনও কখনও এসেছেন। নরটন ও মিস কেলি ঐভাবেই ওদের কাছাকাছি এসেছে। না বন্ধু তোমাকে যে অগ্নিকুণ্ডের খোঁজ আমি দিইনি, তাতে তুমি অজান্তে হাত দিলে পুড়বে, তা হতে দিতে পারি না।
কী করব বল। ক্ষোভের সঙ্গে বললাম, তুমি আমায় এখন বিশ্বাস করে উঠতে পারছ না।
তুমি বুঝতে পারছ না বন্ধু। তোমার নিরাপত্তা আমার কাছে কতটা জরুরী যে পাঁচটা খুন করেছে সে যদি টের পায় কেউ তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে তাহলে সে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করবে।
পোয়ারোকে চেপে ধরে বললাম, তুমি কী এসবের উর্দ্ধে?
পোয়ারো গভীর দুঃখের সঙ্গে বলল, আমার চেয়ে তা আর কে বেশি জানে? সেইজন্যই তো তোমাকে তাড়াতাড়ি ডেকে এনেছি।
২. পোয়ারোর চিরদিনের অভ্যাস
পোয়ারোর চিরদিনের অভ্যাস তাড়াতাড়ি শয্যায় গমন ও তাড়াতাড়ি শয্যাত্যাগ। তাই ওকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
সিঁড়ির মুখে কারটিসের সঙ্গে দেখা। একটা দুটো কথা বলে বুঝলাম লোকটা কর্মঠ ও বিশ্বাসী। জানাল এর মধ্যে দুবার পোয়ারোর হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। ঈজিপ্টে গিয়ে বিশ্রাম নিয়েও ফল হয়নি। ওঁকে ছাড়া কিভাবে জীবন কাটাব আমি।
ড্রয়িংরুমে আমাকে দেখেই ক্যারিংটন হৈ হৈ করে উঠল। ব্রিজ খেলতে আমায় আহ্বান করল। মনটা বিক্ষিপ্ত হলেও ওদের খেলার পার্টনার হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক তার স্ত্রীকেই সঙ্গী করেছেন। কর্নেলের কাছে এ এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। মাঝেমাঝে ভুল হলেই মিসেস লাটরেল মুখিয়ে উঠছিলেন স্বামীর প্রতি। তিনি ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছিলেন। এভাবে খেলা যায় না, একটা অজুহাত করে উঠে পড়লাম। নরটনও একই কারণ দেখিয়ে বেরিয়ে এল।
বারান্দা দিয়ে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে জানালেন, এ সহ্য করা যায় না। ভাবা যায় না কিভাবে তিনি ভারতবর্ষে একসময় দাপটের সঙ্গে সৈন্য পরিচালনা করে ছিলেন, আর এখন কিভাবে বেড়াল ছানা হয়ে থাকেন।
আমি ওনাকে সাবধান করে দিই, কারণ মিসেস লাটরেলের থেকে আমরা বেশি দূরে এখনও যেতে পারিনি।
তবে বললুম, আপনার সঙ্গে আমিও একমত। তবে এ বয়সে তিনি কিভাবে স্ত্রীকে কচুকাটা করবেন? যা বলেছেন, এই বয়সে হা প্রিয়তমা, না প্রিয়তমা না বললে স্ত্রী কি আর বশে থাকে?
নিরীহ নরটনের জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ ছাড়া কি করতে পারি?
হলঘরে ঢুকে নরটনকে বললুম, ব্যাপার কি এত রাতে দরজা খুলে বসে আছেন হাওয়া আসছে। বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ বলে মনে হয়।
না, তা নয়। তবে বাড়ির সবলোক ঘরে ফিরেছে বলে মনে হয় না।
এ সময় আবার কে বাইরে থাকতে পারে?
জুডিথ ও এলারটনের কথা–ওরা মাঝে মধ্যে রাত করে বাড়ি ফেরে।
লোকটার নাম শুনেই হাড়পিত্তি জ্বলে ওঠে। পোয়ারোকে বলে দিলাম ঐ লোকটা মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। বন্ধু আমার সে কথা শুনতেই চায় না। এখন আমার ভদ্র নম্র মেয়েটা জুটেছে ওর সঙ্গে।
রাগে বিছানায় শুয়ে রইলাম। ঘুম এল না। উঠে পড়ে ভাবলাম এক ডোজ অ্যাসপিরিন নেব। তবে কাজ হবে বলে মনে হয় না। এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। এর আগে একটা পোয়ারোর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। শেষে রাতের পোষাক চাপিয়ে ওপরে চলে এলাম।
অসুস্থ পোয়ারোকে এই সময় বিরক্ত করব কিনা ওর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এমন সময় পিছনে পায়ের শব্দে চমকে উঠে দেখি এলারটন হাসতে হাসতে উপরে উঠে আসছে।
আমার সামনে এসে হেসে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার মিঃ হেস্টিংস এখনও শুতে যাননি?
দাঁত কিড়মিড় করে বললুম, ঘুম আসছে না।
আসুন আমার সঙ্গে ঘুমের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, মানুষটাকে বোঝার জন্য ওর আহ্বান পেতেই চলে গেলাম, একটু ঝালিয়ে দেখবে বলে।
দুজনের ঘর একেবারে পাশাপাশি। বললুম, আপনিও দেখছি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। এলারটন উত্তর দিল, বিছানায় শুয়ে সুন্দর সন্ধ্যাটা নষ্ট করতে চাই না। আলমারি থেকে একটা শিশি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার নিচ্ছিদ্র ঘুম হবে এতে। ডাক্তারি নাম প্লাম্বারিন।
ভুরু কুঁচকে বলি, তাই কী? খেলে বিপদও হতে পারে।
নির্দ্বিধায় বলল, হতে পারে তবে পরিমাণটা বেশি হলে। খলনায়কের মত একটা বাঁকা হাসি হাসল। মনে হল লোকটা কোনোদিক দিয়েই সুবিধের নয়।
প্রতিবাদ করে বললাম, ডাক্তারের অনুমোদন ছাড়া এসব ব্যবহার করা যায়; জানা ছিল না।
তবে, এসব ব্যাপারে আমার একটু পড়াশুনা ছিল।
বেমক্কা একটা প্রশ্ন করে বসলুম, এথারিটনকে আপনি চেনেন? তাই না?
প্রশ্নটা ভুল হয়নি বুঝলাম যখন দেখলাম এলারটন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল, তবে মুহূর্তের জন্য। চিনি, বেচারা নিজের ভুলে মৃত্যু ডেকে আনল। তবে ওরস্ত্রীর ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হয়। জুরীরা নিরপেক্ষ না হলে ওকে ফাঁসি কাঠে ঝুলতে হত।
শিশি থেকে কয়েকটা বড়ি বার করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এথারিটনকে আপনি চেনেন বলে মনে হচ্ছে?
বড়িগুলো নিয়ে বললাম না, চিনি না।
মানুষ হিসেবে তিনি খুব আমুদে ছিলেন, বলল এলারটন।
ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। আবার চিন্তা করতে লাগলাম, ভুল করলাম না তো? প্রশ্নটা কি বোকার মতন হল? পোয়ারো আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল বটে। কিন্তু হঠাৎ মনে হল এই এক্স। পরক্ষণেই ভয়। না বুঝেই কী নিষিদ্ধ ফলে হাত দিয়ে ফেলেছি?
.
০৭.
(ক)
স্টাইলসের এর পরের দিনগুলো তুলতে গেলে হয়তো এলোমেলো হবে, হয়তো কোনো ধারাবাহিকতা থাকবে না। তবু চেষ্টা করছি……
বৃদ্ধ, অথর্ব, পঙ্গু পোয়ারোর সঙ্গে তার বশম্বদ অনুচর কারটিস বেশ মিলেমিশেই আছে। ক্ষণিকের জন্য পোয়ারো মুক্ত বাতাস সেবন করে যখন কারটিস তাকে বাগানের এককোণে রেখে আসে। হাওয়া খারাপ হলে, হয় ড্রয়িংরুমে নয় নিজের ঘরে শুয়ে থাকে। সেই সময়ে আমাকে ওর চোখ কান হয়ে চারদিকে দেখতে শুনতে হয়। কোনো সুফল না হলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এরপর ফ্রাঙ্কলিন, ভদ্রলোক তার ছোট ল্যাবরেটরির ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। নানারকম গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। অনভিজ্ঞ লোকের পক্ষে কাজকর্ম অনুধাবন করা অসম্ভব। আনাড়ির মত কাজকর্ম বোঝার চেষ্টা করছিলাম। উৎসাহভরে তিনি সব পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তবে ঐ সব বিদঘুঁটে নাম মনে নেই। তবে যা শুনেছি, তা মনে রাখতেই হবে আমায়। জুডিথও সেখানে ছিল। ও আরো বেশি উৎসাহের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক নামগুলো আমাকে শোনাচ্ছিল। এইটে কিমোষ্টিগ মাইন, ওটা এসরিন, এটা ফিমোভেইন, জেনেসেরিনা, ড্রিহাই-ড্রোস্ফিফিল ট্রিমিফাইল ল্যামোনাম ইত্যাদি। দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তাই নেমে এলাম।
বিরক্ত হয়ে জুডিথকে প্রশ্ন করেছিলুম, মানুষের কোনো উপকারে ফলপ্রসু হবে তোমাদের এ সাধনা। প্রকৃত বিজ্ঞানির মত কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন বেণু বনে মুক্ত ছড়ানো হয়েছে এতক্ষণ। তখন আমায় ছেড়ে নিজেদের মধ্যে ওরা আলোচনা শুরু করল। সেই আলোচনা থেকে উদ্ধার করলাম। পশ্চিম আফ্রিকার আদিবাসীদের মধ্যে একধরনের অদ্ভুত রোগ আছে যার প্রতিষেধক আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। এখন সেই প্রতিষেধকই আবিষ্কার করতে হবে।
ওরা আসতেই বললুম, তোমরা বাপু যদি হামের পরে মানুষের দেহে যে বিষটুকু থাকে তার প্রতিকারের জন্য কোনো প্রতিষেধক ওষুধ বার কর তাহলে মনুষ্য জাতি তোমাদের দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করবে।
জুডিথ রেগে গিয়ে একপ্রকার যা বলল তা এইরকম–এই সব বুড়ো হাবড়াদের জন্য বিজ্ঞান সাধনা এতটা পিছিয়ে পড়েছে। এই তিরস্কার আমাকে নীরবে হজম করতে হয়েছিল।
খাঁচার ভেতরে একটা ইঁদুরের ছটফটানি দেখে বুঝলুম ওর গবেষণা চলছে।
ওদিকে কানে যা এল তাতে মনে হল, ফ্রাঙ্কলিন পোয়ারোকে তার সাধনার কথা শোনাচ্ছিলেন।
বুঝলেন মঁসিয়ে পোয়ারো, পশ্চিম আফ্রিকার আদিবাসীরা জীবনধারণের জন্য এমনসব গাছের শেকড় খাচ্ছে যার ফলে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অপরিণত বয়সে মৃত্যু হচ্ছে তা ওরা জানতে বা বুঝতে পারছে না। পোয়ারো সহজ মন্তব্য করেছিল এবং তাতে মৃত্যুর সংখ্যাও অস্বাভাবিক।
না, খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তবে ধীরে ধীরে তাদের জীবনী শক্তি, প্রতিরোধ ক্ষমতা, হারিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা করে দেখেছি এই সব গাছের মধ্যে দু বর্ণের প্রজাতি আছে, একটি বিষাক্ত অন্যটি ততটা নয়। এই শিকড় থেকে এক ধরনের সুরাসার তৈরি করার চেষ্টা করছি যা যুগান্তকারী সৃষ্টি হয়ে থাকবে মানব জাতির ইতিহাসে।
পোয়ারো বলল, জেনে ভালো লাগল যে আপনি দুটো প্রজাতির মধ্যে কোনোটা ভালো, কোনোটা মন্দ তা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। হা ভগবান, যদি মানুষের মধ্যে এই রকম কোনো ব্যবস্থার দ্বারা ভালো-মন্দটুকু চটপট জানা যেত!
আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না মঁসিয়ে পোয়ারো।
হেসে পোয়ারো বলল, আপনার মত বিজ্ঞানীর পক্ষে এই সহজ কথাটা বোঝা উচিৎ ছিল। ধরুন কোনো অত্যাচারী, উৎপীড়ককে খুন করার পূর্বে আপনার ঐ সব কোনো আবিষ্কারের দ্বারা কি খুনের পূর্বে খুনীকে চিনে ফেলা যাবে?
পোয়ারো থামতেই বলে উঠলুম, এর জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার প্রয়োজন কী। তার মনের মধ্যে সে অপরাধ বোধতো থেকেই যাবে।
হঠাৎ অত্যুৎসাহে ফ্রাঙ্কলিন বলে উঠল, পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে তোলার জন্য আমি অনেক মানুষকে মেরে ফেলতে চাই। তার জন্য আমার সারা রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না। বলেই শিস্ দিতে দিতে ঘর থেকে প্রস্থান করলেন।
তারপর পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললাম, মনে হয় বন্ধু অজান্তেই সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছি।
পোয়ারো বলল, এটা হয়তো ডাক্তারের কথা, মনের কথা নয়।
নিরাশ হয়ে বললুম তাই যেন সত্যি হয়।
.
(খ)
নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করার পর সিদ্ধান্তে এলাম জুডিথকে এলারটন সম্পর্কে একটু সতর্ক করে দিতে হবে। জানি জুডিথ অন্য পাঁচটি মেয়ের চেয়ে আমার কাছে আলাদা। ও বুদ্ধিমতী, কোনো কাজ কিভাবে করা উচিৎ সে জ্ঞান আছে। তবুও ছেলে নয়, মেয়ে মেয়েই।
তবু ওর সঙ্গে যখন কথা বললাম যথেষ্ট সজাগ ছিলাম। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েরা বয়োঃজেষ্ঠ্যদের সম্মান দিতে জানে না।
আমার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, এ সবের মানে কী? সন্তানের ওপর পিতা মাতার সেই চিরন্তন অধিকারের পরাকাষ্ঠা দেখানো?
না, আমায় ভুল বুঝো না, আমি সেকথা বলতে চাইনি।
জানি এলারটন কে তুমি দু চক্ষে দেখতে পারো না।
তা অস্বীকার করছি না। তবে তুমিও আমার সঙ্গে একমত হবে।
কেন?
কারণ তোমার সঙ্গে ওর কোনো চারিত্রিক মিল নেই।
এ তোমার শাসন, আমি এখন সাবালিকা। বিদ্রুপের সঙ্গে হেসে বলল, এখন আমার, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তোমার নতুন কি ধারণা জন্মাল শুনি? যদিও তুমি ওকে পছন্দ কর না, তবে উনি বেশ মিশুকে এবং ফুর্তিবাজ।
হ্যাঁ মেয়েদের কাছে উনি আকর্ষণের বস্তু হলেও ছেলেদের কাছে নয়।
এটা তো স্বাভাবিক।
তবে তোমাদের ওভাবে রাত অব্দি ঘুরে বেড়ানো ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না।
আগুনে ঘি পড়ার মত জ্বলে উঠে বলল, ওহ-কী নিচ! তোমার মতন এমন পরস্ত্রীকাতর অভিভাবক দুটো দেখিনি। তুমি কি আমায় কচি খুকী মনে করেছ? দ্বিতীয় মিঃ ব্যারেট সাজতে যেও না–
সত্যিই এবার ভীষণ আঘাত পেলুম। শরবিদ্ধ আহত পাখির মতন মেয়ের এই ব্যবহারে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ক্লাভেন আসতে নিজেকে একটু সামলে উঠলুম।
কী-ব্যাপার! মুখখানা অমন পাচার মত করে আছেন কেন?
হেসে বললাম এবার, এমনিই।
ক্লাভেন সহানুভূতির সঙ্গে বলল, না, গুরু গম্ভার ভাবে থাকবেন না, আপনাকে মানায় না।
হেসে বললাম, ধন্যবাদ।
ক্লাভেন মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, সেকথা আর বলবেন না, এই সব মহিলারা কোনোদিনই সুখী হতে পারে না। বলছি মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের কথা। একেবারে বোকার হদ্দ।
বললুম, যা বলেছেন।
ক্লাভেন আমাকে শ্রোতা পেয়ে বলল, মিসেস ফ্রাঙ্কলিন সবসময় খিটমিট করে, এতে স্বামী বশে থাকে? সত্যি মিঃ ফ্রাঙ্কলিন ভালো মানুষ, ওর জন্য কষ্ট হয়।
না জানার ভান করে বললুম, আপনার দুঃখের কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আহ। সাধারণ কথা–স্বামী-স্ত্রীর মনের মিল না থাকলে সংসারে সুখ থাকে না।
আচ্ছা আপনি কি মনে করেন, মিঃ ফ্রাঙ্কলিন ওনাকে বিয়ে করে ভুল করেছেন?
কেন? আপনার তা মনে হয় না? দেখছেন না দুজনের মধ্যে মিল নেই।
চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলি, বাইরে থেকে ওদের সুখী মনে হয়। স্বাস্থ্যের নজর রাখেন, ভালোবাসেন।
মেয়ে মানুষের মনের কথা কে বোঝে বলুন?
তবে তার অসুখটা তাহলে সত্যি নয়।
নার্স ক্লাভেন সুচতুর হেসে বলল, বড় বেয়াড়া প্রশ্ন করেন আপনি। সেকথা আমি বলতে চাইনি। এই সংসারে নানাধরণের মহিলা আছে। তবে মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের ধাতটা আলাদা, সারারাত জেগে থাকেন, দিনে ঝিমিয়ে কাটান। কে জানে কেন?
মিসেস ফ্রাঙ্কলিন অসুস্থ বলেই হয়তো এইসব উপসর্গ।
অদ্ভুত ভঙ্গি করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ অসুস্থ যখন উপসর্গ থাকবেই।
এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে দরকার নেই। তবে আপনি তো এখানে অনেকদিন আগে ছিলেন?
হা। ফিসফিস করে ভয়ার্ত গলায় বলল তখন আপনি এই স্টাইলসে ছিলেন?
হ্যাঁ ছিলুম। নিজের মনেই কেঁপে উঠে বলল, ঠিক যা ভেবেছি।
আপানার সবকিছু হেঁয়ালী বলে মনে হচ্ছে। নতুন করে আবার কী ভাবলেন?
হিমশীতল গলায় বলল, এখানকার থমথমে, গা কাঁপানো পরিবেশ দেখে মনে হয় কোথায় একটা গণ্ডগোল আছে। আপনার মনে হয় না?
এটাও কি সম্ভব, সেই বহুকাল আগের হত্যার রেশ এখনও রয়েছে।
আমায় চিন্তান্বিত দেখে উৎসাহিত গলায় ক্লাভেন বলল, এইরকম আমার জীবনে এক ঘটনা ঘটেছিল। আমার এক রোগী হঠাৎ রোগ শয্যায় খুন হল। সেকী ভয়ংকর দৃশ্য, সে কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।
ঠিক, আমার জীবনেও একবার, কথা শেষ হতে না হতেই, বয়েড ক্যারিংটন হৈ হৈ করে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই বললেন, সুপ্রভাত মিঃ হেস্টিংস। সুপ্রভাত নার্স। বারবারাকে তো ঘরে দেখলাম না?
ক্লাভেন বিনয়ের সঙ্গে বলল, উনি নিচে বাগানে মুক্ত বাতাস সেবন করছেন। আমিই বসিয়ে এসেছি।
সহাস্যে ক্যারিংটন বললেন, নিশ্চয়ই একা।
ক্লাভেন মাথা নাড়ল হা।
ফ্রাঙ্কলিন কোথায়? সেই বদ্ধ খাঁচায় ডাক্তার, অবশ্য একা নন। মিস হেস্টিংস আছেন।
মিঃ হেস্টিংস আপনি তো একটু বাধা দিতে পারেন, যৌবনের মুহূর্তগুলো ঐ বদ্ধ ঘরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মোটেই তা নয়, বরঞ্চ ঐটাতেই উনি আনন্দ পান। ডাক্তারেরও ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না।
জানেন জুডিথের মতন একজন সেক্রেটারী পেলে আমি ঐ বিচ্ছিরি গিনিপিগগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতাম না–ক্যারিংটন বলল।
ঐ কথা বলবেন না, মিঃ ফ্রাঙ্কলিন অন্যধাতের মানুষ। কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। নার্স ক্লাভেন দুঃখের সঙ্গে বললেন।
বয়েড মুচকি হেসে বলল, খুব ভালো। বারবারাও যে পিছিয়ে নেই তা দেখেও ভালো লাগছে। ঠিক সময় মত ঠিক জায়গাটি বেছে নিয়ে বসেছে। স্বামীর ওপর তদারকিটা ভালোই চলবে। হা ঈশ্বর, মেয়েদের কি হিংসুটে করেই না পাঠিয়েছে পৃথিবীতে।
রূঢ় কণ্ঠে ক্লাভেন বলল, আপনি দেখছি সব জেনে বসে আছেন, বলেই চলে গেল।
ক্যারিংটন ক্লাভেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ঈশ্বর এই সোনালী চুলের সুন্দরী মেয়েকে দিয়ে তুমি নার্সের কাজ করাচ্ছ।
আমি চকিত কণ্ঠে বললুম, আপনি কি ভাবছেন জীবনে কোনোদিন আর ওর বিয়ে হবে না?
হলেই ভালো।…যাবেন নাকি আমার সঙ্গে ন্যাটনে বেড়াতে?
ভালো প্রস্তাব, তবে এখন নয়। পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
দেখলুম ও ওর ঘরের সামনের বারান্দায় বসে। ওকে বয়েডের প্রস্তাবের কথা জানাতে বলল, নিশ্চয়ই যাবে, ঐ বিশাল অট্টালিকা ও প্রভূত সম্পত্তি দেখতে না পেলে তোমার জীবন বৃথা যাবে।
কিন্তু তোমাকে যে একা ছেড়ে যেতে হবে
তোমার কাছে অনেক পেয়েছি। একবার ঘুরে এসো। ওর সঙ্গে তোমার ভীষণ মিল আছে। সময়টাও তো কাটানো চাই।
.
(গ)
বয়েড ক্যারিংটন প্রকৃত অর্থেই মানুষ। বেশ সুন্দর কিছু মুহূর্ত ওঁর সঙ্গে কেটে গেল, ন্যাটনের প্রাসাদোপম অট্টালিকায়।
দেখুন গৃহকত্রী না থাকায় এ সব অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্ত্রী বিয়োগে সত্যিই বয়েড কাতর হয়ে পড়েছে। দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর বলার কিছু নেই। বললুম দ্বিতীয় বার বিবাহ করলেন না কেন?
অনেকেই সেকথা বলেন। তবে ব্যাচেলার জীবন ভালো লাগছে।
তখনকার মতন এই প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে পোয়ারোর কথা তুললাম। ওর প্রাণশক্তির কথা বললাম।
ভাবতে রোমাঞ্চ লাগে আমাদের মধ্যেই আছেন সেই এরকুল পোয়ারো। তারপর সকৌতুকে বলল, যদি এখনই খুব চটপট একটা খুন করে ফেলি?
নির্দ্বিধায় বললুম, দেহ পঙ্গু হলেও মস্তিষ্ক ওর সতেজ। তাই ধরে ঠিকই ফেলব।
সত্যিই ওঁর মতন মানুষ দুটো জন্মাবে না। ও সব খুনখারাপী আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু যদি কেউ ব্ল্যাকমেল করে, আমি তাহলে তাদের চোখবুজে খুন করে ফেলতে পারি। মনে হয় রাস্তার কুকুরের মতন ওদের মেরে ফেলা উচিৎ।
স্বীকার করতেই হল ওর কথা।
এর পর এই অট্টালিকার প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তার প্রসঙ্গ উঠল। বয়েড ক্যারিংটনের খুল্লতাত স্যার এভার্ট ভোগ করবে। সেইসব সম্পত্তি অন্যকে দান না করে তার ভাইপোকে দান করে গেছেন।
কথায় কথায় লাটরেলের কথা উঠল। বয়েড ছোটবেলা থেকে জানে। কেমন যেন হয়ে গেছেন। স্ত্রীর কথায় ওঠেন বসেন। অবস্থার বিপাকে অতিথিশালা খুলেছেন।
ক্যারিংটন সুপুরুষই নয়, সুবক্তাও। স্টাইলের অনেক ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর ঘটনায় সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা দিলেন। নরটন বদ্ধ পাগল। পাখি দেখার আনন্দের থেকে শিকারে বেশি আনন্দ-বললেন বয়েড।
সেদিন আমরা ঘৃণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি নরটনের এই পাখি দেখার আগামী দিনে এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবে…..
.
০৮.
(ক)
পোয়ারো আশাবাদী হলে আমার চারপাশে নিরাশার একটা প্রাচীর গড়ে তুলেছে।
সহজাত উৎসাহে বলল, বন্ধু কোনো মেলা কী জলসা নয়। অথবা, কোনো শিকার খেলাও নয়। এভাবে অনেক কিছু আমাদের বুদ্ধি দিয়ে দেখতে হবে।এক্সকে দেখতে পাচ্ছ না বলে হয় তো তুমি ধৈৰ্য্য হারাচ্ছ। এক্স আমাদের চোখের সামনে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল কে সেই : ব্যক্তি যে অনতিকালের মধ্যে এক্স এর শিকার হতে চলেছে? জানতে পারলে নিশ্চয় তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম। পোয়ারোর স্থৈর্য দেখে বললাম, তোমার অনুশোচনা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা এখনও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি।
পোয়ারো হঠাৎ বলল, বলতে পারো কে খুন হতে পারে?
এ আবার কী প্রশ্ন? এ তো তুমি জানো।
পোয়ারো হঠাৎ ধমক দিয়ে বলে উঠল, এতদিন এসেছ এটা বুঝতে পারছ না?
তুমি এখনও জানালে না যে কে সেই এক্স…. কতদিন আর এরকমভাবে নাচাবে?
বিরক্ত হয়ে পোয়ারো বলল, এক্স-এর মৌলিকত্ব তো ওখানেই, ও জানতে দেবে কেন, আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
এক্স এর অতীত আলোচনা করলেও কী তা বুঝতে পারবে না?
অসম্ভব। প্রায় ভবিষ্যৎবাণীর মত পোয়ারো বলল, তুমি ভাববার অবকাশও পাবে না যে কখন হত্যা হবে।
মানে এই বাড়ির কেউ খুন হবে?
হা
তুমি তাকে চেনো না।
যদি জানতাম তাহলে তোমাকে এখানে আনার প্রয়োজন কী ছিল?
তাহলে, তুমি শুধুমাত্র এক্স এর উপস্থিতি থেকে, খুন হতে যাচ্ছে ধরে নিচ্ছ?
পূর্বের পোয়ারো হলে রাগে ফেটে পড়ত, কিন্তু শারীরিক পঙ্গুতার কারণে তা দেখাতে পারছে না। শুধু বলল, হ্যাঁ। যদি দেখা যায় কোন দেশে যুদ্ধ বিশারদ সাংবাদিক বা কোনোদেশে বহু ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটেছে, তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে সেখানে হয় যুদ্ধ হবে নয় তো কোনো মেডিকেল কনফারেন্স হতে চলেছে। যেমনভাবে বোঝ শকুনির ঘোরা ফেরা দেখে প্রাণীর শবদেহের অবস্থানের কথা।
কিন্তু সাংবাদিকদের দলের উপস্থিতি দেখে একথা হলফ করে বলা যায় না যে, ওখানে যুদ্ধ হবে।
ঠিকই। কিন্তু হত্যাকারীর বেলায় এ ইঙ্গিত আশ্চর্যের নয়।
কিন্তু খুনী যে আরেকটা খুনের জন্যই আসবে তা না হতেও পারে। হয়তো অবকাশ জীবন যাপনের জন্য আসতে পারে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য হয়তো পোয়ারোর এই আবোল তাবোল চিন্তা।
পোয়ারো কিন্তু অস্থির। ওসব বুজরুকি আমার সহ্য হয় না। মনে নেই সেই বিগত যুদ্ধে মিঃ অ্যাসকুইয়ের কীর্তি কাহিনী? আমি অবশ্য তোমাকে জোর দিয়ে বলিনি আমি কৃতকার্য হব বা খুনীকে খুঁজে বার করতে পারবই। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা আমার ধাতে সয় না। তোমার সামনের এই জোড়াজোড়া তাসগুলো দেখে বল, কোনো দল জিতবে।
কিন্তু পোয়ারো আমি যতক্ষণ না এক্স কে চিনতে পারছি
রাগে ফেটে পড়ল পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে, বোকা, গর্দভ কোথাকার! পোয়ারোর এই চিৎকারে কারটিস ঘরে এসে ঢুকল। কিন্তু কারটিস আসাতে ও সংযত হয়ে, ওকে হাত নেড়ে বাইরে যেতে বলল। পরে ক্ষোভকে চেপে রেখে বলল, তুমি নিজেকে বোকা ভাবলেও তা তুমি নও, বুদ্ধি খরচ কর। এক্স কে না চিনলেও সব ঘটনা শোনার পর নিশ্চয়ই তার কলাকৌশল কিছু ধাতস্থ করতে পেরেছো?
হতে পারে।
হতে পারে নয়–নিশ্চয়ই বুঝেছো। মনের অলস প্রকৃতির জন্য তুমি খেলতে ভালোবাসলেও বুদ্ধি খরচ করো না। আমি বলতে চাই যে যখন সে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবে, তখন এমন একটা পরিবেশ, বা পরিস্থিতি তৈরি করবে যাতে সে হত্যা করেনি করতে পারে না, তার মনে হবে বুঝি সেই এই গর্হিত কাজটি করে ফেলেছে, মাথায় ঢুকছে?
সত্যিই এদিকটাতো ভাবিনি। সত্যি তোমার তুলনা হয় না পোয়ারো।
তবুও পোয়ারোর মন পাওয়া গেল না। শুধু বলল, কেন যে ঈশ্বর আমার পা দুটো অকেজো করে দিলে? কারটিসকে পাঠিয়ে দাও। তুমি নিজে কিছু করবে না শুধু কে কি করছে, বলছে চোখ-কান সজাগ রেখে দেখে-শুনে যাবে। গোপনে অন্যের দরজায় চোখ রেখো।
আতে ঘা লাগল। সব কিছু বললে করতে পারব, কিন্তু কারোর দরজায় চাবির ফুটোয় চোখ রাখতে পারব না।
ওহঃ, ভুলে গিয়েছিলাম তুমি এক ইংরেজ ভদ্রলোক। যতটুকু পারো তাহলে তাই কারো, একজন অথর্ব পঙ্গু বৃদ্ধ আর কি এর থেকে বেশি আশা করতে পারে।
.
(খ)
পরদিন একটা বুদ্ধি এল মাথায়। ওর ঘরে গিয়ে বললাম, সারা রাত কাল তোমার কথাগুলো ভেবেছি। আমি তোমার মত গুণসম্পন্ন নই। সিণ্ডারস মারা যাবার পর সব বুদ্ধি সুদ্ধি যেন লোপ পেয়েছে, আমার কথাগুলো পোয়ারো মনে হল খুব সহানুভূতির সঙ্গে শুনছে।
সাহস পেয়ে বললাম, আমাদের সাহায্য করার জন্য এখন একজন করিতকর্মা লোক চাই। বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা সবই আছে–বয়েড ক্যারিংটন। বিশ্বাস করে ওকে নিলে মনে হয় কাজ হবে।
হঠাৎ চমকে উঠে বলল, না কখনো না।
কেন নয় পোয়ারো?
না। এসব আবদার আমার কাছে আর কোনোদিন করো না। কতটুকু জানো ঐ ভদ্রলোককে? তোমার যেটুকু আছে ওর তার কণামাত্র নেই।
হে বন্ধু ভুলে যেও না আমি এখনও বেঁচে আছি, যদিও পঙ্গু। পোয়ারোর শেষ কথাটা আমার মনে ব্যথার ঝড় তুলল। চোখের কোণে জল টলমল করে নড়ে পড়ার আগেই ছুটে পালালাম।
.
(গ)
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পোড়োবাড়ির শেষ প্রান্তের বেঞ্চটাতে বসে পড়লাম। নির্জন হলেও শহরটি ভোরের আলোয় মনোরম। মনটা যেন বাতাসে ক্রমশ ভেসে যেতে লাগল…
এই স্টাইলসেই কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করার এক স্পষ্ট পরিকল্পনা আছে। কিন্তু কে সে? সে কাকে খুন করবে? মিঃ লাটরেল… তবে কি নিজে। স্ত্রীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য?….
নাহ। সেরকমভাবে কাউকে কাউকে চিনি না। যেমন মিসেস নরটন।-এদের কি মোটিভ থাকতে পারে হত্যার? অর্থ? এখানে প্রভূত অর্থের বয়েড ক্যারিংটন, যদি ক্যারিংটনই হয় হত্যাকারীর উদ্দেশ্য? আর তাহলে ফ্রাঙ্কলিন কি সেই সম্ভাব্য খুনী? তাছাড়া যদি মিস কেলি বা নরটন, ক্যারিংটনের দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয় হন, তাহলে ওকে পৃথিবী থেকে সরাবার কারণ আছে। কর্নেল লাটরেল ক্যারিংটনের বন্ধু। যদি কোনো উইল করার সম্ভাবনা থাকে তাহলে কর্নেল লাভবান হচ্ছে। এভাবে ভাবলে ক্যারিংটন খুনের একটা মোটিভ তৈরি হয়। আবার যদি কাল থেকে চলে আসা সেই ত্রিকোণ প্রেমের কথা মনে হয়। ফলে এখানে ফ্রাঙ্কলিনরা এসে পড়েন, মিসেস ফ্রাঙ্কলিন অসুস্থ, বিষ খাইয়ে তাকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে চায়, স্বয়ং মিঃ ফ্রাঙ্কলিন। মিঃ ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে জুডিথের সম্পর্কের ছবিটা ভেসে উঠল। সুন্দরী সেক্রেটারী; এখানে পৃথিবী থেকে মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে সরিয়ে ফেলাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই সম্ভাবনার কথায় মনটা ভারাক্রান্ত হল। অবশ্য এলারটনকেও বাদ দেওয়া যায় না। কেউ তাকে হত্যা করতে চায়। হঠাৎ মনে হল যদি কোনো হত্যাকারী এখানে থেকে থাকে তবে এলারটনই তার লক্ষ্য, কেন এমন মনে হচ্ছে? তার হদিশ পোলাম না। মিস কেলি তরুণী না হলেও পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। যদি মিস কেলি ও এলারটনের মাঝখানে জুডিথ কাঁটার মত এসে পড়ে, তাহলে তাদের মাখামাখিতে ঈর্ষণ নামক বস্তুটি তো থেকেই যায়। কিন্তু…যদি এলারটনই এক্স হয়?
প্রকৃতপক্ষে কোনো সমাধানেই আমি পৌঁছতে পারলাম না। হঠাৎ ঝোঁপের পাশে একটা শব্দে চটকা ভাঙে। পোয়ারোর কথা অনুযায়ী নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে রেখে ঝোঁপের আড়াল থেকে লক্ষ্য করলাম। ডঃ ফ্রাঙ্কলিন হেঁটে যাচ্ছে। দুহাত অ্যাপ্রনের পকেটে। চোখ মাটির দিকে। বিষাদগ্রস্ত চেহারা।
ফ্রাঙ্কলিনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে মিস কেলি কখন পিছন থেকে এসেছে বুঝতে পারিনি।
টের পেতেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম, আমার কথায় উনি তেমন আমল দিলেন না। পুরোনো বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, যেন ভিক্টোরিয়া আমলের স্থাপত্য শৈলী। কি সুন্দর!
তাকে ভালো করে জানার জন্য বললাম, বসুন না। বসে পড়ে বললেন, কী সুন্দর! কিন্তু যত্ন না নিলে যা হয়।
হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এত কি ভাবছিলেন যে আমি এলাম টেরই পেলেন না? বললাম। মিঃ ফ্রাঙ্কলিনকে দেখছিলুম।
আমিও তাই ভেবেছি–কেন বলুন তো অত বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল?
ঠিকই দেখেছেন।
না–মানে থতমত খেয়ে বললুম, হাজার হলেও কাজের মানুষ তো, তার এমন বিষণ্ণতা ঠিক যেন মানায় না।
হতে পারে। নিস্পৃহ কণ্ঠস্বর শোনা গেল মিস কেলির।
অর্থাৎ আপনিও বলছেন উনি অসুখী। যে যা চায় তা করতে না পারলে অসুখী হয়।
ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা।
গত হেমন্তে মিঃ ফ্রাঙ্কলিন একটা গবেষণার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু স্ত্রীর জন্য তা করতে পারেননি। অসুস্থ স্ত্রী, স্বামী ছেড়ে থাকতে পারবে না। আর যদি যানও তবে এই সামান্য মাইনেয় তাদের চলবে না।
বুঝলুম, অসুস্থ অবস্থায় একা ফেলে যেতে পারেন না ডক্টর।
অসুস্থ! তার অসুস্থতা সম্পর্কে কতটুকু জানেন আপনি?
সবটা জানি না। তবে দেখে মনে হয় তো তিনি অসুস্থ।
অদ্ভুত এক হেসে বললেন, এই অসুখ নিয়েই তিনি সুখী। চমকে উঠলাম, বুঝতে অসুবিধা হল না ডাক্তারের প্রতি তার সহানুভূতি রয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ আমরা নীরব। তারপর নিরবতা ভঙ্গ করে বললাম, মনে হয় দুর্বল, অসুস্থ স্ত্রীরা স্বাভাবিক কারণেই স্বার্থপর হয়ে পড়েন।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।
এটা কি মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য?
আসলে ব্যাপারটা কি জানেন, মিসেস ফ্রাঙ্কলিন সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকার মহিলা নন। তিনি নিজের খেয়ালখুশিতে চলতে ভালোবাসেন।
গম্ভীর ভাবে মিস কেলির কথায় ভাববার চেষ্টা করলুম ফ্রাঙ্কলিনদের পরিবারে জটিলতা আছে।
আপনি নিশ্চয় ডঃ ফ্রাঙ্কলিনকে ভালোবাসেন? কৌতূহলের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম।
মোটেই না। এর আগে দু-একবার মাত্র দেখা হয়েছে ওদের সঙ্গে।
তখন নিশ্চয়ই মিঃ ফ্রাঙ্কলিন তার দুঃখের কথা বলেছেন?
কোনোদিন না। এসব কথা আমি আপনার মেয়ে জুডিথের কাছেই শুনেছি।
শুনেই বেদনায় ভরে ওঠে মনটা। ওর সব কথা অন্যের সঙ্গে, তবু পিতার সঙ্গে নয়। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবার মত বলে গেলেন, আপনার মেয়ের তার মনিবের উপর যথেষ্ট আস্থা, বলতে গেলে উনি হাত। ও একদম মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে সহ্য করতে পারে না।
গভীর বেদনায় বলি, তাহলে আপনার মতে জুডিথ স্বার্থপর।
হুঁ, সে কথা বলতে পারেন। প্রকৃত অর্থে জুডিথ একজন দক্ষ বৈজ্ঞানিক। কাজেই মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ওদের পথে বাধা স্বরূপ।
খারাপ বলেননি, আমি জুডিথকে জানি ভারী একগুঁয়ে। ভীষণ ঘর কুনো এই বয়সে। আমাদের যৌবনে আমরা অনেক হৈ হুল্লোড় করেছি তাই নয়?
ও সম্বন্ধে আমার কোনো সম্যকজ্ঞান নেই ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল।
একটু অবাক হয়ে তাকালাম। হয়তো কোনো ক্ষত স্থানে আঘাত দিয়েছি। ও দশ বছরের ছোট হবে। আমরা সমসাময়িক নই। তাই আমার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলুম।
না, না, আপনি লজ্জিত বা কুণ্ঠিত হবেন না। আসলে আমার জীবনে কোনোদিন সে সময় আসেনি
দুঃখিত-মিস কেলি–আপনি বড্ড বেশি ছেলে মানুষ। ছাড়ুন তো ওসব কথা।
অন্যান্যদের সম্পর্কে একটু কিছু বলবেন। আসলে এখানকার কাউকে তো সেভাবে আমি চিনি না।
তা বটে। যদি লাটরেল পরিবারের কথা বলেন, তাহলে ওদের বহুদিন ধরে জানি, সদবংশ। সপরিবার। দুঃখের বিষয় শেষ পর্যন্ত ওদের অতিথিশালা খুলে বসতে হল। কর্নেল গোবেচারা নিরীহ লোক। সাংসারিক বিপর্যয়ে হয় তো মিসেস লাটরেল স্বামীকে পীড়ন করেন, এইরকম হয় বিপর্যয়ে পড়লে মেয়েদের।
মিঃ নরটন সম্পর্কে কিছু জানেন?
বেশি কিছু না। লাজুক স্বভাবের চমৎকার মানুষ। বেশিরভাগ সময় কেটেছে মায়ের হেফাজতে, তাই বোধহয় এমনটি হয়েছেন। সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস ওনার।
আপনি বোধহয় ঐ ফিল্ড গ্লাস থাকার জন্য একথা বলছেন।
না ঠিক সে কথা ভেবে বলিনি, যারা শান্ত প্রকৃতির, সংসার থেকে দূরে থাকতে চান, তারা মনে হয় এই ভাবেই নিজেদের ব্যস্ত রাখেন।
বুঝেছি।
এই হচ্ছে আমাদের জীবন ও ছোট জায়গার ইতিবৃত্ত। যেখানে অতি ভদ্র প্রকৃতির মানুষ অতিথিশালা চালায় সেখানে বোধহয় যত পঙ্গু, বৃদ্ধ এসে ভিড় করে। নতুন করে সে জায়গা সম্বন্ধে তার কী বলার আছে?
ওর কথায় শ্লেষ থাকলেও সত্য। পোয়ারোর, যার উপস্থিতি একদিন চাঞ্চল্যের ছিল, আজ তার আর কোনো মূল্য নেই, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
মিস কেলি অবাক হয়ে বললেন, আপনার আবার কি হল?
বললাম, কিছু না, আপনার কথাগুলো ভাবছিলাম। শুনেছেন নিশ্চয় যৌবনে একবার এখানে এসেছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে এখনকার কোনো মিল নেই।
মিস কেলি নড়েচড়ে বসে বললেন, তখন নিশ্চয়ই সবাই সুখী ছিল, সুন্দর পরিবেশ ছিল?
যদিও এক এক সময় তাই মনে হয়। তবে মনে হয় কখনও কোনো অবস্থাতেই আমরা সুখী নই। এখন মনে হয় তখনও অনেকে অসুখী ছিলেন এখানে।
জুডিথ বোধহয় অসুখী নয়। ভালোই আছে–
কি জানি? উদাসীন ভাবে বলি, ক্যারিংটনের কথাই ধরুন না, কি একাকীত্মভাবে দিন কাটান।
মোটেই তা নয়। ফোঁস করে ওঠেন। তিনি অন্য জগতের মানুষ। বিত্তের মধ্যে মানুষ হয়েছেন। তিনি জীবনে অসুখী হতে পারেন না
আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।
একটু ঝাজের সঙ্গে বললেন, জীবনে সুখ কাকে বলে জানি না। আমার দিকে দেখুন
বুঝতে পারছি, আপনার কোথাও একটা ব্যথা আছে।
কোনো কথা না বলে আমার দিকে মিস কেলি তাকিয়ে রইলেন, তারপর চোয়াল চেপে বললেন, আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
না, মানে, আপনার নাম শুনেছি—
কেলি আমার পদবী নয়। তা কী জানেন? ওটা আমার মায়ের পদবী। আমি এখন এটাই ব্যবহার করি।
হকচকিয়ে উঠি, তাহলে এর আগে?
আমার আসল পদবী হচ্ছে লিচফিল্ড।
লিচফিল্ড! চট করে ঘুরে বললুম, ম্যাথিউ লিচফিল্ড!
বিচলিত না হয়ে বললেন, জানেন দেখছি। আমার বাবা ছিলেন ভয়ঙ্কর স্বার্থপর। বহু অত্যাচার করতেন। সামান্যতম স্বাধীনতাও আমাদের ছিল না। বন্দীজীবন কাটিয়েছি, তারপর আমার বোন-কথা শেষ করতে পারলেন না। বেদনায় কণ্ঠ রুদ্ধ হল ওর।
বললুম, কষ্ট হচ্ছে আপনার, থাক ওসব কথা।
সকরুণ ধরা গলায় বলল, আমার বোন ম্যাগীকে যদি দেখতেন। কী যে হল তার। পুলিশের কাছে হঠাৎ ধরা দিল। আমি জানি একাজ ও করতে পারে না–ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল মিস কেলি।
ওর কাঁধে আলতো হাতের চাপ দিয়ে বললুম, শান্ত হোন মিস কেলি। আমি তো জানি, ও একাজ করেনি।
.
০৯.
তখন প্রায় ছ-টা। ঝোঁপের ওপাশ দিয়ে কর্নেল লাটরেল ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন। একহাতে বন্দুক ও অন্য হাতে দুটি গুলিবিদ্ধ বুনো পায়রা।
ডাক শুনে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা দুজনে এখানে কি করছেন? এই পোড়ো বাড়ির সামনে আমরা কখন আসি না। কি জানি কখন ভেঙে পড়ে। এলিজাবেথ–আরে তোমার জামা কাপড় নোংরা হয়ে যাবে যে।
এলিজাবেথ কেলি হেসে বললেন, মিঃ হেস্টিংস এর জন্য ওনার রুমালটা নোংরা করেছেন।
খুব ভালো, খুব ভালো। বলেই চলতে আরম্ভ করলেন। আমরাও ওনার সঙ্গী হলাম। আপন মনে বলতে লাগলেন, এই বুনো পায়রাগুলো এমন নোংরা করে যে ঘর দোর, কী বলব।
আপনার বন্দুকের হাত বেশ ভালো বুঝলুম।
কে বললে? বয়েড বুঝি।
চোখে কেমন দেখছেন আজকাল। কথার পিঠে কথা। যেন কিছু বলতেই হবে।
চোখে? মন্দ নয়। দূরের জিনিস ভালো দেখি কাছের জিনিস দেখতে চোখে চশমা লাগে। আজকের সন্ধ্যাটা বেশ ভালো লাগছে বলুন?
সত্যিই সুন্দর উত্তর করল মিস কেলি?
একমাত্র ভারতবর্ষেই এমন সন্ধ্যা দেখেছি, তারপর এই স্টাইলসে। চাকরার শেষে অবসর যাপনের জন্য এই রকম জায়গা বেশ ভালো। কি বলুন মিঃ হেস্টিংস।
উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়লুম। বাড়ির কাছাকাছি এসে বয়েড ও ক্যারিংটনকে দেখতে পেলাম বারান্দায়। মিস কেলি পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
বারান্দায় বসে গল্প চলল বেশ কিছুক্ষণ। নরটন একসময় প্রস্তাব করল, যা গরম, একটু ঠান্ডা পানীয় পেলে মন্দ হত না।
এ আর বেশি কি আর, ব্যবস্থা করছি। সহানুভূতির সঙ্গে কর্নেল বলল।
আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে গেলাম।
বারান্দার পাশেই ড্রয়িংরুমের ভেতর থেকে আলমারি খোলার শব্দ পেলাম। তার পরেই এক মেয়েলী কণ্ঠ, চিৎকার করে উঠল, এখানে কী করছ?
শুধু এটুকু শুনতে পেলাম, বা-বাইরে ওরা একটু ঠান্ডা পানীয়…।
মামার বাড়ি? এজন্য বলেছি তোমাকে দিয়ে এসব কাজ চলবে না।
না।
চোপ। এখানে দানছত্র খুলে বসেছি? হবে না। বোতলটা দাও বলছি।
কর্নেল নিচু গলায় কি বোঝাতে চাইল।
মিসেস লাটরেল ধমকানি দিল, পোয় থাকবে, না পোষায় চলে যাবে। সখের আবদার
আলমারিতে তেমনি আটকাবার শব্দ এল, তখন মিসেস লাটরেলের সোচ্চার উচ্ছ্বাস, যেমন কুকুর তেমনি মুগুর।
কর্নেলের সামান্য জোরালো প্রতিবাদ শোনা গেল, এ তোমার ভীষণ বাড়াবাড়ি ডেইজি, এতটা ভালো নয়।
বাড়াবাড়ি? এবাড়ি কে চালায়? তারপর আবার নিস্তব্ধতা। কিছু পরেই স্খলিত পায়ে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। সামান্য সময়ের মধ্যে কী পরিবর্তন।
আমরা এমনভাবে তাকালুম যেন কিছুই শুনিনি।
কর্নেল অপ্রতিভের হাসি হেসে বলল, দেখলাম বোতলে আর তেমন হুইস্কি নেই।
বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন আর হুইস্কিতে প্রয়োজন নেই।
মিসেস লাটরেল হনহন করে ওপাশের দরজা দিয়ে বাগানে নেমে গেলেন। ওকে দেখে ঘেন্নায় ভেতরটা রিরি করে উঠল। এমন নিষ্ঠুর মহিলা আর দ্বিতীয় নেই।
কর্নেলের ঐ অস্বস্তিকর অবস্থাটা হাল্কা করার জন্য নরটন কথার ফুলঝুরি ফোঁটালো। নিজের কৈশোর। কর্নেলের বুনো পায়রা…ইত্যাদি অনেক কথা বলে গেল। মৃত্যু তার কাছে। বিশ্রী ব্যাপার তাই, লিকারে তার কোনো স্পৃহা নেই।
কর্নেলের বুকের ভার নামাতে ক্যারিংটনও যোগ দিল। তিনি বললেন, আমার এক আইরিশ বন্ধু ছিল। বেশ বেপরোয়া। একবার ছুটিতে আয়ারল্যাণ্ডে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাকে কেমন ছুটি কাটল জানতে চাইলে যে ঘটনা সে বলল, শুনবেন নাকি সেই ঘটনাটা?
আমরা সবাই বললাম, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, বয়েড বলল এটা ঠিক গল্প নয়, এক নিষ্ঠুর সত্য ঘটনা। অনেকে আছে যারা নির্দয়তার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। আমার বন্ধুটি তাদেরই একজন। শিকারে পারদর্শী। বন্দুকের হাত চমৎকার। তার এক ভাইও সে শিকারে গিয়েছিল। তার ভাই তার আগে আগে পথ পরিষ্কার করে চলে। হঠাৎ বন্ধুটি বলে যখন এগোতে এগোতে অনেকদূর চলে গেছে, তখন মনে হল জন্তু জানোয়ারের আর কী প্রয়োজন? সামনেই তো শিকার রয়েছে। যেই ভাবা অমনি কাজ। শুনেই হৃদকম্প হল। কিন্তু বন্ধুটি অমায়িকভাবে হেসে বলল কোনো বন্য প্রাণীর চেয়ে মানুষ শিকার অনেক আনন্দের। সে নিষ্কম্প চিত্তে গুলি চালাল। তাই তার প্রাণ নিয়ে পালাবার সময় পেল না। হঠাৎ থেমে গিয়ে লাফিয়ে উঠে বলল, কিছু মনে করবেন না, আমার কাজ আছে, এখন চলি বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আমরা নিশ্বাস ফেলার সময় পেলাম না। কি নাটকীয়তার মধ্যে একটি খুনের কাহিনী শুনিয়ে গেল।
নরটন বলল, কী ভয়ঙ্কর। ভাবতেই পারি না।
আমরা চুপ করেই রইলুম।
নরটন আবার বলল, কিছু মানুষ আছে যারা অনেক সুখ নিয়ে জন্মায়।
কার কথা বলছেন বয়েড না তার বন্ধুর?
আমি স্যার উইলিয়ামের কথাই বলছি। দূরে এক পায়রার শব্দ শুনেই কর্নেল বন্দুক তুলে নিলেন।
কিন্তু বন্দুক তাক করার আগেই ঝোঁপঝাড় কাঁপিয়ে পায়রাটা উড়ে গেল।
গোঁফ চুমরে বললেন, ব্যাটা খরগোস কচি ফুলের গাছের রস পেয়েছে। রোসো মজা দেখাচ্ছি। বলেই বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়লেন।
আর সঙ্গে সঙ্গে গুলির শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যেতে না যেতেই এক নারী কণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ শোনা গেল।
কর্নেল লতানো গাছের মত কেঁপে উঠলেন। বন্দুক হাত থেকে খসে পড়ল। এ যে ডেইজির কণ্ঠস্বর।
আমি আগেই ছুটে ঝোঁপের দিকে ছুটলুম, পেছনে নরটন। ঝোঁপ সরিয়ে দেখলুম– মিসেস লাটরেল উবু হয়েছিলেন। খরগোস ভেবে গুলি চালিয়ে দেন কর্নেল। জ্ঞান হারিয়েছেন মিসেস লাটরেল। নরটনকে বললাম শীঘ্র ডঃ ফ্রাঙ্কলিন অথবা নার্সকে ডাকুন
নরটন স্বগতোক্তি করল, উফ, এত রক্ত সহ্য করতে পারি না।
নার্স ক্লাভেন এলেন। ফ্রাঙ্কলিনও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এলেন।
ক্লাভেন ও ফ্রাঙ্কলিন মিসেস লাটরেলকে কোল পাঁজা করে তার ঘরের দিকে ছুটে গেল। তার পর প্রাথমিক শুশ্রূষা সেরে ফোন করতে ছুটলেন। রিসিভার নামিয়ে বললেন, খুব অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন।
ছোট করে তাকে ঘটনাটা জানালুম। বললেন, দুর্ভাগ্য, ভয়টা কর্নেলকে নিয়ে, দুর্বল মানুষ, মনে হয় এখন স্ত্রীর চেয়ে স্বামীর দিকে বেশি নজর দিতে হবে।
কর্নেল একটা ছোট্ট বৈঠকখানায় বাচ্চার মতন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আ-আমার ডেইজি ডেইজি।
ওঁনাকে সান্ত্বনা দিলাম। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আসলে অল্প আলোয় আমি মনে করেছিলাম খরগোস।
এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। ভুল মানুষ মাত্রেরই হয়। আপনার হার্ট দুর্বল অত ভেঙে পড়বেন না। ভালো হয় একটা ইনজেকশন নিয়ে নিন।
না, না, আমি বেশ সুস্থ আছি। ডেইজির কাছে যেতে পারি একবার?
ফ্রাঙ্কলিন বললেন, ঠিক এখন নয়, ক্লাভেন ওর কাছে আছে। ডঃ অলিভারকে ফোন করেছি, এখনই এসে পড়বেন।
ওদেরকে বৈঠকখানায় রেখেই চলে এলাম।
হঠাৎ কয়েকজন মেয়ে পুরুষের গলার শব্দে তাকিয়ে দেখি এলারটন ও জুডিথ নবদম্পতির মত গায়ে গা লাগিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। পূর্বের এই বিয়োগান্ত ঘটনার রেশ মাত্র ওদের মধ্যে নেই, অসহ্য। একটু ঝাঁঝালো কণ্ঠে জুডিথকে ডাকতেই দুজনে থমকে দাঁড়াল। সন্ধ্যার ঘটনাটা জানিয়ে ওদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে লাগলাম।
জুডিথ সহজভাবেই বলল, কি সব যাচ্ছেতাই ঘটনা এখানে ঘটে।
এলারটন বিষোদগার করে বলল, যা প্রাপ্য বুড়ির তাই পেয়েছে। যেমন হিংসুটে তেমন বদ মেজাজী। যেকোনো স্বামীই একাজ করতে পারে। আপনি কি মনে করেন এটা বুড়োর ইচ্ছাকৃত?
ধমকের সুরে বলি, না, এটা নিছকই দুর্ঘটনা।
ধমক শুনে, গলা নামিয়ে এলারটন বলে, হয়তো ঠিক। তবে এইরকম দুর্ঘটনা মাঝে মাঝে সংসারে শান্তি আনে। এটা আপনি হয়তো মানবেন না। আর যদি কর্নেল ইচ্ছাকৃত এটা করেন, তাহলে আমি তাকে বাহবা দিই।
এ অন্যায়, প্রগলভতা, ও সব কিছু নয়।
এলারটন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, যেহেতু আমরা সমস্ত ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছে জানি না, তাই এখন কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। দুটো ক্ষেত্রেই দুই ভদ্রলোক স্ত্রীর হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে। প্রথম ভদ্রলোক রিভলবার পরিষ্কার করতে উপরে আচমকা গুলি ছুঁড়ছেন, যা দুর্ঘটনা হলে আসলে খুন। দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি আরো সরেস। খেলা খেলতে গিয়ে গুলি ফস্কে গেল। এদের দুজনের স্ত্রীরাই জীবন অতিষ্ট করে তুলেছিল।
কিন্তু কর্নেল সে ধাতের লোক নয়। এলারটন বলল, এরকম চিন্তা করা আপনার মত ভদ্রলোকের পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ দিনরাত দেখছি শুনছি উনি স্ত্রীর হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন। এ যে বিধাতার আশীবাদ নয় তার পক্ষে সেকথা কে বলতে পারে।
এদের সঙ্গে কথা বলতে প্রবৃত্তিতে বাধছিল। তবে ওর কথার মধ্যে যে সত্যি নিহিত নেই, তা নয়। সেটাই আমার বিভ্রান্তির কারণ হল।
ফেরার পথে আবার ক্যারিংটনের সঙ্গে দেখা হল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, মিঃ হেস্টিংস, কি মনে হয় উনি কি অজ্ঞাতসারেই করেছেন?
শেষ পর্যন্ত আপনিও একথা বলছেন? অবাক হয়ে বললাম।
না, আসলে সেকথা বলতে চাইনি। আসলে মিসেস লাটরেলের বিশ্রী ব্যবহারের কথাও যে ভুলতে পারছি না।
এটা সত্য। কারণ সেদিন সামান্য হুইস্কি নিয়ে যা করলেন। অবশেষে বিদায় নিয়ে পোয়ারোর কাছে গেলাম। ওখানে গেলেই হয়তো শান্তি পাব।
হয়তো কারটিসের কাছে পোয়ারো সব কথা শুনেছে। একের পর সবার প্রতিক্রিয়া, চলন বলন সব বললাম।
পোয়ারো আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। ও কিছু বলার আগেই ক্লাভেন ঘরে ঢুকল।
বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ভেবেছিলাম ডঃ ফ্রাঙ্কলিন এখানে আছেন হয় তো, মিসেস লাটরেল এখন কিছুটা সুস্থ। কর্নেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। তিনি কোথায় জানেন মিঃ হেস্টিংস?
পোয়ারোকে জিজ্ঞেস করলাম, খুঁজে দেখব কিনা, ও নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। ক্লাভেনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
মিঃ লাটরেলকে দেখে বললাম, মিসেস লাটরেল এখন বেশ সুস্থ, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
ওঃ, ডেইজি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়? মায়ের ডাক শুনে শিশু যেভাবে উৎফুল্ল হয়, সেভাবে কর্নেল আনন্দে বললেন, নিশ্চয়ই যাব। যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। আপন মনে কি বলতে বলতে ছুটে গেলেন, ফলে মাঝে হোঁচট খেলেন। হাত বাড়িয়ে না ধরলেই পড়েই যেতেন। ডঃ ফ্রাঙ্কলিন ঠিকই বলেছেন, আঘাতটা শেলের মত বিঁধেছে। এতে সন্দেহ নেই।
কর্নেলকে একেবারে টেনেই আনতে হল আমাকে। ক্লাভেন সাদর আহবান জানাল, ভেতরে আসুন।
আমরা দুজনে খাটের পাশে এলুম পর্দা সরিয়ে। মিসেস লাটরেল সম্পূর্ণ সুস্থ নন, তবু স্বামীকে দেখে বিচলিত হলেন। এক হাতে ব্যাণ্ডেজ অন্য হাত বাড়িয়ে জর্জ–জর্জ?
ডেইজি, ডেইজি, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, যে তুমি সুস্থ হয়ে উঠেছে। আমায় ক্ষমা করো ডেইজি।
কর্নেলের আবেগ জড়ানো চোখের জল দেখে মনে হল এই নিরীহ মানুষটাকে সন্দেহ করতে যাচ্ছিলাম। কি অন্যায়! স্বস্তিতে বুক ভরে গেল, যেন বুকের ওপর থেকে বোঝাটা নেমে গেল।
বাইরের ঘড়ির ঢং ঢং শব্দে চমকে উঠলাম। পাঁচক ঠাকুর খাবারের ডাক দিল। কত সময় হু হু করে বেরিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।
যে যেমনভাবে ছিলাম ডাইনিং রুমে সেই পোষাকে দেখা হল। পোষাক পাল্টাবার কথা অবশ্য তেমন নেই। প্রথমবার দেখলাম মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বেশ সেজেগুজে এসেছেন আজ। বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। কর্নেল আসেননি, স্বাভাবিক।
খেতে খেতে কেউ আজ বিশেষ কথা বলেনি। পরিস্থিতিটা পরিবেশের সঙ্গে বেশ পরিপাটি, মানানসই।
লনে এসে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। শুধু জুডিথ ও এলারটনের জল খাওয়াটা আমাকে পীড়া দিল। অবাধ্য ছেলেমেয়েদের শাসনের হাতিয়ার এখনকার পিতা-মাতাদের নেই, হায় পিতা!
ফ্রাঙ্কলিন ও নটনের মধ্যে গ্রীষ্ম প্রধান দেশের রোগের ব্যাধি নিয়ে কথা হচ্ছিল। মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ও বয়েড পাশাপাশি কিন্তু একটু দূরে।
এলিজাবেথ একটা বই-এর মাঝে এমনভাবে নিবিড় হয়েছিল যে কথা বলার সাহস পেলাম না।
একা তো আর বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। অবশেষে পোয়ারোর কাছেই গেলাম। দেখা গেল পোয়ারো একা নয়, কর্নেলও আছে। কর্নেলের চেহারার কোনো উন্নতি হয়নি। এখনও বিবর্ণ, অনুতাপে দগ্ধ।
গভীর বেদনার সঙ্গে বলে গেল, ওকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। যেমন সুন্দর দেখতে ছিল, স্বভাবটিও মিষ্টি মধুর। কী বলব মঁসিয়ে পোয়ারো। ওকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন মনে হয়েছিল, এই সেই মেয়ে যাকে আমি দীর্ঘকাল খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পোয়ারো ইশারায় বসতে বলল। কর্নেলের বক্তব্যের সঙ্গে আমার মনশ্চক্ষে যুবতী ডেইজি ও প্রৌঢ়া ডেইজির ছবি ভেসে উঠল। সত্যি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কত পরিবর্তন হয়। কত ফারাক।
কর্নেল আমার অনেক আগে এসেছিল, মনে হয়, তাই আমার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্থান করল।
পোয়ারো আমার কাছে আবার সব পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চাইল, বললাম। কিন্তু কোনো মন্তব্য করল না। ওর মুখের ভাব আমি কোনো কালই বুঝতে পারিনি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে পোয়ারো বলল, তাহলে তুমিও ভেবেছিলে, গুলি ছোঁড়াটা ইচ্ছাকৃত।
অকপটে স্বীকার করলুম, হ্যাঁ, সেজন্য ক্ষমা চাইতে আমার কোনো লজ্জা নেই।
এটাকি তোমার নিজের ধারণা না কেউ তোমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে? জিজ্ঞেস করল পোয়ারো।
সে রকম কিছু নয়। তবে এলারটনও এই রকমই বলছিল। অবশ্য ওর মতন অসভ্য লোকের একথাটা বলা কিছু বিচিত্র নয়।
আর কেউ, পোয়ারোর টুকরো জেরা চলছে।
বয়েড ক্যারিংটন। তিনিও এইরকম কিছু বলেছিলেন।
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ওহ, বয়েড ক্যারিংটন।
হাজার হলেও ভদ্রলোক অভিজ্ঞ। মানুষের চরিত্র সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান। অনেক জানেন।
স্বাভাবিক। পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঘটনার সময় যদিও তিনি উপস্থিত ছিলেন না।
হুঁ। শুধু ওরাই নন, আমারও যেন মনে হয়েছিল। অবশ্য এখন
ঠিক আছে। বারবার ক্ষমা চাইতে হবে না। এটা একটা ধারণা মাত্র, ওরকম পরিস্থিতিতে যে কেউ তাই করে থাকে।
মাঝে মাঝে গিয়ে তারিয়ে তারিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। ঠিক বুঝতে পারি না ওর মনের কথা।
ইতস্ততঃ করে বললাম, হয়তো ঠিকই বলেছ, ও সব দেখে শুনে—
ঠিক। তোমার কোনো দোষ নেই। এরকম পরিস্থিতিতে ওরকম মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।
পোয়ারোর ঘর থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম হায় বিবাহিত জীবন! কিন্তু পোয়ারো কী বলতে চায়? কিছুই তো বলল না। হঠাৎ মনে হল যদি মিসেস লাটরেল মারা যেতেন! তাহলে? কেঁপে উঠলাম পোয়ারোর সেই টুকরো খবরগুলোর মধ্যে এ ঘটনাটি অন্য রকম কিছু? বাইরে থেকে মনে হত মিঃ লাটরেল ওনার স্ত্রীকে খুন করেছেন, কিন্তু ইচ্ছাকৃত নয় বলে বিচারে শাস্তি হল না। নিছকই দুর্ঘটনা, ঘটনা প্রবাহই তার প্রমাণ দিত। তাহলে এটা পোয়ারোর বিচিত্র খুনের ঘটনাগুলোর মধ্যে নবসংযোজন হত।
সত্যিই তো, একটু বুদ্ধি খরচ করলে এরও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ হত্যার নায়ক কর্নেল লাটরেল হলেও, আড়াল থেকে পোয়ারোর সেই এক্সই এই কাজ করেছে।
নাঃ কিন্তু যখন কর্নেল গুলি ছুঁড়েছেন আমি তো কাছেই ছিলাম। যদি না-নাঃ, তাহলে মিঃ লাটরেলের সঙ্গে সঙ্গেই কেউ তাক করে গুলি ছুঁড়েছে? প্রতিধ্বনি হ্যাঁ, এখন যেন মনে হচ্ছে একটি প্রতিধ্বনি শুনেছি আমি–
অসম্ভব। ফরেনসিক এক্সপার্টরা নিশ্চয়ই বার করবেন। পরবর্তী পর্যায়ে কি কি করা হয়েছে। পুলিশের দোষ নেই, কারণ আমরাই বলেছিলাম অজ্ঞানবশত হঠাৎ গুলি ছুঁড়েছেন, তাই বন্দুক সম্বন্ধে, খোঁজ খবর নেননি। কিন্তু মজার ব্যাপার এখানেই যে এ ব্যাপারটাতে কেন যে আমরা সবাই এত নিশ্চিত ছিলাম? পোয়ারোর সেবারের মত সেই ঘটনার সঙ্গে আর একটি হত্যা নিছক দুর্ঘটনা বলে যোগ করে দিয়েছি। হঠাৎ মনে হল পোয়ারো যেন আমার কর্ণকুহূরে বলে গেল, কেমন বন্ধু তোমার মস্তিষ্ক এবার সাবালক হয়ে উঠেছে…
৩. পোয়ারো লাফিয়ে উঠল
(ক)
সব শুনে পোয়ারো লাফিয়ে উঠল। সাবাস! এই রকমই চেয়েছিলাম, আমি চেয়েছি, তুমি নিজেই বিশ্লেষণ করে সত্য উদ্ধার করো।
তাহলে বন্ধু ঠিক বিশ্লেষণ করেছি? এটাও তোমার সেই এক্স নামীয় ব্যক্তিটি দ্বারা সংঘটিত আরো একটি ঘটনা!
প্রশ্নাতীত ভাবে সত্য! নির্দ্বিধায় পোয়ারো বলে গেল।
এই হত্যার উদ্দেশ্য কি, তাহলে?
কিছুই কি তোমার মাথায় ঢুকছে না?
নাঃ!
একটা ধারণা আমি করতে পারছি, সব ঘটনাগুলোর মধ্যে কি সেই একই যোগসূত্র?
ঠিক তাই।
কী সেই যোগসূত্র? অধীর হলাম আমি। হঠাৎ সে প্রথম দিনের পোয়ারোর মত খোলসে ঢুকে গিয়ে বলল, ভালো হয়, যদি তুমি এখনই না জানো।
অস্ফুট চিৎকার করে বলি, না–আমায় এখনই জানতে হবে। আমায় ভুল বুঝো না। শুধু জেনে রাখো তোমার বিশ্লেষণ মিথ্যে নয়।
থ্রাইটিসে কষ্ট পাচ্ছ, পঙ্গু শরীর তবু একা লড়ে যেতে চাও। তোমাকে শোধরানো যাবে না।
ভুল-ভুল। প্রিয়বন্ধু আমার। তুমি তো আমার হয়ে লড়ে যাচ্ছে। আমি তো তোমার চোখে, তোমার কানেই দেখছি, শুনছি। শুধুমাত্র সেই কথাটা বলে একটা বিপদ ডেকে আনতে চাই।
বিপদ। কার? আমার?
হত্যাকারীর।
আশ্চর্য। তুমি তাকে ধরতে চাও কিন্তু ধরা দাও না। অথবা, তুমি এখনও ভাবছো এমন আমি দুর্বল যে নিজেকে রক্ষা করতেই পারব না।
মনে রাখবে একটা কথা হেস্টিংস যে একবার খুন করেছে, প্রয়োজনে সে দ্বিতীয়, তৃতীয়, …..অজস্র খুন করতে পারে।
হুঁ, গুম হয়ে বলি, কিন্তু আরেকটা হত্যার ঘটনা ঘটতে পারেনি এখানে, নিশানা ব্যর্থ হয়েছে।
হ্যাঁ, খুব সৌভাগ্য, এসব ব্যাপার আগে থেকে আঁচ করা যায় না। তাই তো আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
ওর সকরুণ কণ্ঠ আমার ব্যথিত করল। তবে একথা বলতে পারি, আগের পোয়ারো এখন থাকলেও, পোয়ারোর বর্তমানের উপস্থিতিই হত্যাকারীর হৃদ কম্পন বাড়িয়ে তুলেছে নিশ্চয়ই।
বিষণ্ণ মনে পোয়ারোর ঘর ছাড়লুম, কে সেই এক্স? একটু অস্পষ্ট সন্দেহ আমার মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই সময় জুডিথকে পাকড়াও করলাম।
গত সন্ধ্যায় এলারটনের সঙ্গে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
জানতাম ও একটা চোখা কোনো উত্তর দেবে যার জন্য আমাকে প্রশ্ন থেকে শত দূরে ছিটকে ফেলে দেবে। তাই হল…..। ঝাজের সঙ্গে উত্তর এল, সত্যি বাবা, বুঝে পাই না তোমরা অত আমাদের পেছনে লেগে থাকো কেন?
না- মানে কেবল জানতে চাইলাম।
কিন্তু কেন? কেন এসব প্রশ্ন করে আমাকে তুমি খোঁচাও?
আমি ওর কাছে এলারটনের খোঁজ পেতে চেয়েছিলাম। তাই ঠান্ডা মেজাজে বললাম, বললাম, রাগ কোরো না জুডিথ। এই সামান্য উত্তর পাওয়ার অধিকারটাও কি আমার নেই?
বুঝি না, কেন এসব জানতে চাও।
আসলে আমিও তো সবকিছু জানি না, তাই একটু জানার আগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম। তুমি তো একেবারেই নিস্পৃহ, দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে।
মিসেস লাটরেলের দুর্ঘটনার কথা বলছ, সে তো শুনেছি। আমি তো তখন গ্রামের বাইরে স্ট্যাম্প আনতে গিয়েছিলাম। শান্ত গলায় জুডিথ উত্তর দিল।
মেজর এলারটন তোমার সঙ্গে ছিলেন না?
না। গতকাল রাতে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার দু-তিন মিনিট আগে আমরা একসাথে হয়েছিলাম। এবার হলো তো? কোথায় কার সঙ্গে কখন যাব, এসব জানতে চেয়ে আমাকে বিরক্ত করো না। আমি আমার মতন চলব।
তা, ঠিক। এটা আমাদের মেনে নিতেই হবে। মেজাজ না হারিয়ে বললাম।
লক্ষ্য করলাম ওর একগুঁয়েমি ভাবটা কাটছে।
শুনে খুশি হলাম। সবসময় ঐ রকম হেডটিচারের মতন শাসন করবে না তো।
ঠিক এমন সময় ডঃ ফ্রাঙ্কলিন এসে উপস্থিত হলেন।
বলে জুডিথ, আমাদের এর মধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ফ্রাঙ্কলিনের কথাগুলো শুনে মনে হল উনি যেন ওর অভিভাবক। জুডিথ ওঁর সেক্রেটারী হলেন, হুকুম চালাবার তো একটা শালীনতা থাকা দরকার। এ বরদাস্ত করা যায় না। তবে ফ্রাঙ্কলিনের বিদ্যের বোঝা দেখে সবসময় নিশ্চয়ই মেয়েরা কাত হয়ে পড়বে না। এলারটন ও ফ্রাঙ্কলিনের মধ্যে তফাৎটা বড্ড বেশি প্রকট হয়ে উঠল। জুডিথের জন্য কষ্ট হল। বেচারা, দু-নৌকায় পা দিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তবুও এলারটনকে ও পরিত্যাগ করুক–এটা আমি চাই না।
জুডিথ স্ট্যাম্প কিনতে গিয়েছিল, তাহলে এলারটন কোথায় ছিল? যদি ধরি ও গুলি ছুঁড়েছে, তাহলে উদ্দেশ্যবিহীন এই গুলি ছোঁড়ার কারণ কী? এলারটনের তো মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়নি, কি জানি ওর মধ্যে কি দেখেছে জুডিথ।
.
(খ)
জুডিথের সুখ-দুঃখ আমায় আহত করে। কিন্তু যখনই অদৃশ্য এক্স-এর ঘোরাফেরা এবং একটা হত্যাকান্ড ঘটতে চলেছে–এরূপ একটা চিন্তা আমায় তাড়া করে, তখন যে ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো বা জুডিথের কাছ থেকে আমায় অনেক দূরে টেনে নিয়ে যায়।
সে আঘাত এসে গেলেও সৌভাগ্য ক্রমে তা মারাত্মক হয়নি। মনে পড়ে ক্যারিংটনের উচ্ছ্বাসের বসে বলে ফেলা একটি ঘটনার কথা। এলারটনেরও স্ত্রী বর্তমান। বয়েড খোঁজ খবর রাখেন। হয়তো জুডিথের জন্যই এলারটনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চুলচেরা বিচার করতে শুরু করেছি।
বয়েডের কাছে জেনেছি এলারটনের স্ত্রী একজন খোঁড়া রোমান ক্যাথলিক। তাই ওদের ডিভোর্স হয়নি। একজন অসূয়া কন্যার পিতার কাছে এ সুখবর বটে।….।
পরের কয়েকটি দিনে সেরকম কিছু ঘটেনি। কর্নেলও বেশিরভাগ সময় তার স্ত্রীর পাশেই কাটান। তার জন্য এখন নতুন নার্স নিয়োগ করার ফলে ক্লাভেন তার নিজের জায়গায় ফিরে গেছে।
এর মধ্যে একদিনের কথা বলা যাক–
পোয়ারোকে মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের ঘরে পেলাম। ওর নির্দেশ মতই কারটিস মাঝেমাঝে পোয়ারোকে ওখানে নিয়ে যায়। ওদের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
পোয়ারোকে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন তার সুখ-দুঃখের কথা শোনাচ্ছিলেন। তিনি কাতর ভাবে বলছিলেন, নিজের শরীর নিয়ে আমি ভীষণ বিব্রত, সেজন্য নিজেরই ভীষণ লজ্জা হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এইরকম ভাবে অন্যের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকাটা অপরাধ। এর চেয়ে পৃথিবীর থেকে বিদায় নেওয়া ভালো।
উঁহু ম্যাডাম, এ আপনার ভুল ধারণা, একটা সুন্দর ফুলকে বাঁচাতে হলে আচ্ছাদনের প্রয়োজন কিন্তু বনফুলের বেলায় তার প্রয়োজন হয় না। আমার বলতে গেলে কারোর কাছেই মূল্য নেই, অথচ বেছে থাকার কী অপরিসীম আগ্রহ।
মিসেস ফ্রাঙ্কলিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার কথা আলাদা। কারোর জন্য আপনাকে দুশ্চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু আমার জনের জন্য চিন্তা হয়। একটা বোঝা হয়ে আছি।
তিনি কি হাবভাবে সেরকম কিছু প্রকাশ করেছেন?
না-না। মুখেও নয়, হাবভাবেও নয়। কিন্তু ওর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি ও কত অসুখী। আরো ভয়ের কারণ হচ্ছে ও ভীষণ বেপরোয়া।
বেপরোয়া? না ম্যাডাম এ ব্যাপারে আপনার সাথে একমত হতে পারছি না।
না পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ আমি যতটা ওকে চিনি, আপনি ততটা নয়। বুঝি যে আমি না থাকলে ওর জীবন আরো স্বচ্ছন্দময় হয়ে উঠবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মাঝে মাঝে মনে হয় আমার চলে যাওয়াই ভালো।
এ আপনার অসুস্থ মনের চিন্তা, একদম এ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। পোয়ারো কথাগুলো মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে বলে উঠলেন। মিসেস ফ্রাঙ্কলিন কিন্তু গম্ভীর হতাশার সঙ্গে বলে চললেন, এ সংসারে আমি কার উপকারে লাগব? কার জন্য বেঁচে থাকব?
সেদিন ক্লাভেনের সঙ্গে কথা বলার সময় সে বলছিল, জানেন মিঃ হেস্টিংস, যারা বলে আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাই, জানবেন সেটা ওদের মনের কথা নয়।
হায় সংসার, কী বিচিত্র তার গতি প্রকৃতি!…
এই মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে একদিন অন্য চেহারায় দেখলাম।
সেদিন ভোরে কারটিস ভোরের মুক্ত বাতাস সেবনের জন্য পোয়ারোকে বাগানে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আমি সেখানে পৌঁছলাম। সদ্য ফোঁটা ফুলের মত হাসতে হাসতে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ওনার স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। এমনটি আর কখন চোখে পড়েনি।
আহ! মঁসিয়ে পোয়ারো! সাদা ঝকঝকে দাঁতে হাসি ছড়িয়ে বললেন, বয়েডের সঙ্গে ও বাড়ি যাচ্ছি। জানালা দরজায় পর্দা পছন্দ করে সাজিয়ে দিয়ে আসব।
তারপর পোয়ারোর পাশে একচেয়ারে বসে বললেন, গতকাল জনের ল্যাবে দস্তানাটা ফেলে গিয়েছিলাম। শুনলাম ও আর জুডিথ ল্যাবরেটরির জন্য কি কেমিকেল কিনতে বেরিয়েছে। তারপর একটা হাওয়া ফুসফুস ভর্তি করে নিয়ে বললেন, ভাগ্যিস বিজ্ঞানী হইনি, নইলে ভোরের এই মুক্ত বাতাস সেবন করতে পারতাম না।
পোয়ারো রসিকতা করে বললেন, দেখবেন ম্যাডাম সব বিজ্ঞানীরা যেন আপনার কথা না শুনে ফেলে।
নিশ্চয়ই না। আপনি ভাববেন না যে আমার স্বামীর প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই। ওর মত এমন সাধনা কজনের থাকে বলুন তো?
হঠাৎ নার্স ক্লাভেনের কথা মনে পড়তে মনে হল মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের পতিভক্তি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে পড়ছে না?
মিসেস ফ্রাঙ্কলিন পোয়ারোকে বললেন, জানেন জর্জ আসলে এত ভালো মানুষ তার জন্যই ওকে নিয়ে বেশি ভয়। মানুষের উপকারে লাগবার জন্য যে কোনো কাজের ঝুঁকি নিতে উনি প্রস্তুত।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, সে কথা বলতে
কিন্তু এসব কথা কেউ বোঝেন না জানেন। কোনোদিন না নিজের উপরে গবেষণা করে বসেন।
বললুম। তখন নিশ্চয়ই নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি সজাগ থাকবেন।
ম্লান হেসে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বললেন, একবার এক বিষাক্ত গ্যাস নিয়ে কি কাণ্ডটাই না বাঁধিয়ে দিলেন কী বলব।
তাই নাকি?
তবে আর বলছি কী। দুঃখের সঙ্গে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বললেন। ওকে একটা ট্যাঙ্কের মধ্যে বসিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা ধরে মানুষের দেহে ঐ গ্যাসের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তার পরীক্ষা করেছিলেন। উনি তো মারাও যেতে পারতেন। একজন প্রফেসরের মুখে আমি এসব কথা শুনেছি। সাহস থাকা ভালো কিন্তু বেপরোয়া হওয়া ভালো নয়। আমি হলে তোত পারতামই না।
পোয়ারো ধীর স্থির গলায় বললেন, এর জন্য প্রয়োজন অত্যাধিক সাহস ও মনসংযোগ যা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে কল্পনা করাই অসম্ভব।
তাহলেই বলুন আমার ভয় থাকবে না। ঐ গিনিপিগ, ইঁদুর ওদের উপর পরীক্ষা চালাবার একটা সীমা আছে। যার পর আর কাজ হয় না। তখন প্রয়োজন হয় মানুষের দেহে তার প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা। জন হয়তো নিজেরই উপরই কোনোদিন সে পরীক্ষা করে বসবে।
সেই মুহূর্তেই বয়েডের আবির্ভাব ঘটল।
আমি প্রস্তুত আছি। বারবার বলে উঠল।
বয়েড তৎক্ষণাৎ বললেন, আশাকরি তোমার কোনো কষ্ট হবে না।
মোটেই না। বরং অন্যদিনের চেয়ে আমি অনেক বেশি সুস্থ। তারপর দুজনে চলে গেলেন। পোয়রো গভীরভাবে বললেন, তাহলে ফ্রাঙ্কলিন আমাদের আধুনিক সন্ন্যাসী, কী বল বন্ধু?
একটু ভেবে বললাম, তাই দেখছি। কিন্তু আমার মনে হয় ভদ্রমহিলা এই রকম—
কোনোরকম?
নাটকীয় চরিত্র বলতে যেরকম, সেরকম। একদিন প্রত্যাখ্যাতা স্ত্রীর চরিত্র, কখনও ভুল বোঝাবুঝির জন্য ক্ষিপ্ত, অন্য সময় আত্মপ্রত্যয়ের চরম পরকাষ্ঠার প্রতীক। আজ দেখলাম,বীর পূজায় আত্মাহুতি পর্যন্ত দিতে পারে এমন এক মহীয়সী নারীর জমিদার। তবে কী, সব কিছুতেই নাটকীয়তা থেকে যাচ্ছে।
তোমার কি মনে হয় না হেস্টিংস আসলে উনি যেভাবে নিজেকে জাহির করতে চান, বরং সেরকম নয়, একটু নির্বোধ প্রকৃতির মহিলা।
নির্বোধ কিনা বলতে পারি না, তবে চালাক নয়–
আমার মত? সে আবার কী?
আহ! চোখ বুজে দেখবেন আকাশের পরীরা এসে কানে কানে গান শুনিয়ে যাচ্ছে।
আমি বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠতে গিয়েছিলাম। কিন্তু নার্স ক্লাভেন আসতে থামতে হল। আমাদের দেখে হেসে ল্যাবরেটরিতে ঢুকেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা হাত ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দস্তানা নিয়ে গেছেন। হঠাৎ মনে পড়েছে হাত ব্যাগটা ফেলে গেছেন। যাই ওরা অপেক্ষা করছেন।
হঠাৎ ক্লাভেনের চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হল, হয়তো এভাবে জীবন কাটাতে কাটাতে উনি ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তাই মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের এদিকে একটু নজর রাখা ভালো।
হুম। চোখ বুজিয়েই পোয়ারো বলল, তার আবার সোনালী সুন্দর কেশদাম–
আমি একুট অবাক হয়েই তাকালাম। কেনই বা এই মুহূর্তে ওর কেবল চুলের কথা মনে পড়ল বুঝলাম না। তাই উত্তর খুঁজে না পাওয়াতে চুপ করেই রইলাম।
.
১১.
যতদূর মনে পড়ল পরের দিন কিন্তু আলোচনা আমার মনের প্রশান্তি নষ্ট করছিল।
আমি, জুডিথ, বয়েড ও নরটন চারজনে ছিলাম। বিষয় বস্তু ছিল অদ্ভুত। রোগে ভুগে ভুগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে যে মানুষ, তার যন্ত্রণাবিহীন উপশমের ব্যবস্থা করার ডাক্তারি শাস্ত্রের নাম উইথ্যানেজিয়া। কেন এরকম বিষয়বস্তু এসে পড়েছিল বলতে পারি না। তবে আমরা দুজন পক্ষে ও দুজন বিপক্ষে যুক্তি দিচ্ছিলাম। বয়েড ক্যারিংটন বক্তা, নরটন আগ্রহী শ্রোতা, জুডিথ নির্ভর যোগ্যহীনভাবে ভীষণ মনোযোগী।
আমি এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারলেও, এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারছিলাম না। তখন ভাবপ্রবণতার বশে রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা যেমন খুশী তেমন ব্যবহার করবেন।
আমার যুক্তিতে নরটনেরও সায় ছিল। শুধু সে বলল, যদি অবশ্য রুগীর মত থাকে তবেই এরকম কিছু করা যেতে পারে।
ক্যারিংটন বলে উঠল, কেউ তো আর স্বইচ্ছায় জীবন ত্যাগ করতে চায় না। এরপর তিনি শোনালেন যে একজন ক্যান্সার রোগী ভীষণ ভাবে ভুগলেও শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন ত্যাগ করতে পারেনি। তিনি শুধু ডাক্তারকে ডেকে বলেছিলেন এমন কোনো ব্যবস্থা কি করা যায় না, যাতে পৃথিবী থেকে নীরবে চলে যাওয়া যায়? ডাক্তার বলেছিলেন তা সম্ভব নয়। ডাক্তারও জানতো তার বাঁচার থেকে মরে যাওয়াই ভালো। তাই তিনি কৌশল করে টেবিলে মরফিন বেশি করে রেখে দিয়ে বলেছিলেন, খুব কষ্ট হলে খেতে। তাহলে প্রকারান্তরে ডাক্তার তাকে মারণাস্ত্র দিয়ে গেছেন। কিন্তু রোগী সব জেনে তো নিজের মৃত্যুর ব্যবস্থা নিজে করতে পারেনি।
তাই বয়েড বলছিলেন কেউ নিজেকে মারতে পারে না।
এবার জুডিথ বলে উঠল, তিনি অসুস্থ বলে রোগীর ভালোমন্দ ভাববার দায়িত্ব অন্যদের। এ সিদ্ধান্তের ভার রোগীর ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। আসলে এই সব রোগীদের তাদেরই নিতে হবে, যারা এর মঙ্গল চায়। কাউকে চিরকালের জন্য শাস্তি দিতে গেলে একাজ তো কাউকে না কাউকেই করতে হবে।
বয়েড বললেন, যদি এর জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তবেও?
তা কেন? আমি যদি ভালবেসে কারোর জন্য একাজ করি, তাহলে এ ঝুঁকি নিতে নিশ্চয়ই পিছপা হব না।
বয়েড বলল, অত সহজ নয় যেখানে বাঁচা মরার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে, আইন সেখানে হাতে নেওয়া কঠিন।
নরটন বলে, ছেলেমানুষ বলে হয়তো জুডিথ একথা বলছে।
মোটেই নয়। আসলে আপনারা ভাবছেন ওভাবে কাউকে মেরে ফেলা যায় না, কিন্তু আমি বলছি তা নয়, আমি তার মঙ্গল চাই, আমি তো হত্যা করার উদ্দেশ্যে কাউকে মুক্তি দিতে চাইছি না।
কিন্তু আসল ঘটনার সময় দেখবে কেউ তোমাকে ছাড়ছে না। নরটন তর্ক করে চলতে লাগল।
কে বলল? আমি জীবনে আপনাদের মত মহত্ত্বর বা অপরিহার্য ভাবিনি যার জন্য একজন অসুস্থ, পঙ্গু মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করব। এতে আমার কিছু মাত্র হাত কাপবে না।
সত্যি একথা যে, যারা সমাজকে কিছু দিতে পারবে তাদেরই বেঁচে থাকা উচিৎ।
তাহলে আপনারা সমাজের জন্য এ ঝুঁকি নেবেন না কেন?
হয়তো পারবো, প্রয়োজন হলে, বয়েড উত্তর করলেন।
কিন্তু নরটন বললেন, যা খাতার পাতায় লেখা তা কখন হাতে কলমে করা যায় না।
বয়েড বলে উঠলেন, ভুল করছেন নরটন। জুডিথ আসলে ততটা দুর্বল নয়, ওরকম পরীক্ষা ওকে কখনই দিতে হবে না।
বাড়ির ভেতর থেকে ঘণ্টার আওয়াজ আসতেই জুডিথ দাঁড়িয়ে নরটনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সম্বন্ধে আসলে কোনো ধারণাই আপনাদের নেই। প্রয়োজন হলে আমি ভীষণ কঠোরও হতে পারি। বয়েড বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে যাব, দাঁড়াও, বলেই দুজনে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।
হয়তো আমার দীর্ঘশ্বাস ফেলা দেখে নরটন বুঝেছেন আমি কতটা আঘাত পেয়েছি। আমাকে বললেন, অত কাতর হবেন না, আসলে ওগুলো জুডিথের মনের কথাই নয়। যৌবনের ধর্ম।
নরটনের কথা জুডিথের কানে যেতেই ও কটাক্ষপাত করে চলে গেল। নরটন গলার স্বর নিচু করে বললেন, স্যার এই এলারটন সম্পর্কে আপনার ধারণা কতটুকু?
এলারটন? চমকে উঠলাম।
কিছু মনে করবেন না স্যার। ওর সাথে জুডিথের মেলামেশা দেখলে ভয় হয়। একটা মেয়ের কথা বলি, শেষ পর্যন্ত তার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথই তার ছিল না।
শিউরে উঠলাম। একজন অনূঢ়া কন্যার পিতার কাছে এযে কী দুঃসংবাদ তা কী আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয়। লাঞ্চে বসেও সুখ পেলাম না।
.
১২.
সেদিন বিকালে পোয়ারো আমায় জিজ্ঞেস করল, প্রিয় বন্ধু কোনো কিছু কি তোমার মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে?
কোনো উত্তর না দিয়ে সরে গিয়েছিলাম। এই দুঃখ আমাকেই বহন করে চলতে হবে। কিন্তু আমার কন্যা সে ব্যথা বুঝল না…।
সেই স্টাইলস, সেই পুরনো স্মৃতি, কিন্তু কেন যেন ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে। কোনো এক অশরীরী আত্মা যেন এখানকার আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার রূপ একজন হত্যাকারীর। অবয়ব একটা নিষ্ঠুর ঘাতকের। আর যখন জুডিথের জন্য মন পীড়িত হয়, তখন মনে হয়, সেই ঘাতক বা হত্যাকারীর রূপ, এলারটনের রূপ ধারণ করছে। এ যেন মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়ে বেশি।
সেদিন ক্যারিংটনের এত নিদানের কথাটা মনে পড়ল, কিন্তু জুডিথের মত একটা মেয়ে থাকলে, এই যন্ত্রণা বুঝতে পারতেন, আমি আমার মেয়ের অধঃপতন চোখের সামনে দেখছি। যদি ওর মা বেঁচে থাকত? কিন্তু না–
একটা কিছু তো করতেই হবে। কিন্তু যখন আমার প্রতি মেয়ের চোখে ঘৃণা দেখি, তখনই যেন কেমন অসাড় হয়ে পড়ি।
ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বাগানে এসে উপস্থিত হয়েছি বুঝতে পারিনি। সম্বিত ফিরতে দেখি, মেয়েটা আমার মনমরা হয়ে বসে আছে। সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে?
জুডিথ সোজা হয়ে বসে বলে, কখন এলে? এই মাতৃহীনা কন্যার বিষণ্ণতায় ভেতরটা যেন টনটন করে ওঠে। বেদনাঘন কণ্ঠে বলি, এই ভদ্রলোক তোমার উপযুক্ত নয়। আমার উপর ভরসা, বিশ্বাস রাখো।
অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল চেপে বলল, তুমি কী তা ঠিক জানেনা বাবা
জানি, আমি তোর পিতা। আমি কি তোর দুঃখের কথা বুঝতে পারব না?
সে যেন আপন মনেই বলল, তুমি যেমন তাকে জানো, বোধহয় আমিও ততটাই জানি
কিছুতেই তুমি সব জানো না। তুমি সংসারের কিছুই দেখনি। জানো, এলারটন বিবাহিত? ওর স্ত্রী বর্তমান, এইরকম কোনো ভদ্রলোককে বিয়ে করে কোনো মেয়ে সুখী হতে পারে? একে বিয়ে করে ভবিষ্যতে দুদিনে সব রঙ ফিকে হয়ে যাবে।
হঠাৎ হেসে বলল, দেখছি তুমি সব জেনে বসে আছে।
নিশ্চয়ই
না।
ছেলেমানুষী কোরো না, এখনও সময় আছে।
আবার আগের মতন ভয়ঙ্করী, প্রলয়ংকরী হয়ে জুডিথ বলল, তুমি আমার ব্যাপারে নাক গলিয়ো না। আমি কায়মনবাক্যে ওকে প্রার্থনা করি। ও আমার হৃদয়ের কামনাবাসনা। তুমি এখান থেকে চলে যাও, তোমার এই বিচ্ছিরি ঘটনাকে আমি ঘৃণা করি–আমায় উঠতে হল না, জুডিথই চলে গেল।
কতক্ষণ পাথরের মত বসে ছিলাম জানি না। নরটন ও এলিজাবেথ কেলি এসে আমার সম্বিত ফিরিয়ে আনল। হয়তো জুডিথকে দেখে বা আমাদের কোনো কথা শুনেই আমার দুঃখের কারণ বুঝতে পেরেছে। তাই শালীনতা বজায় রেখে হৈ হৈ করে প্রসঙ্গ বদল করতে চাইল।
ওদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আমি কিছুটা হাল্কা বোধ করছিলাম। হঠাৎ একটা দূরবীন নাকের খাঁজে আটকে আমাদের দিকে তাকিয়ে করুণস্বরে বললেন, ভেবেছিলাম বুঝি কাঠ-ঠোকরা পাখি-না, তা নয়।
তার ব্যবহার দেখে বুঝতে পারলাম কিছু একটা তিনি লুকোতে চাইছেন। কেন তিনি এরকম আচরণ করলেন? হঠাৎ জেদের বশে বললাম, দেখি, দূরবীনটা আমায় দিন।
নরটন একলাফে দূরে সরে গিয়ে বললেন, না কিছু নয়। তার এই একগুয়েমী দেখে মনে হল সে যা দেখছে তা আমাকে দেখাতে চায় না। তিনি অন্য কিছু দেখেছেন। তিনি ঐ ঘন ঝোঁপটার দিকে নিশানা করেছিলেন। সেজন্য আরো উৎকণ্ঠিত হলাম।
তাকে বাধা দেবার সুযোগ না করে দিয়েই দূরবীনটা কেড়ে নিলাম। কিন্তু নরটন হাত পা ছুঁড়ে বললেন, পাখি উড়ে গেছে, মিছে চেষ্টা করছেন।
সত্যিই পাখি উড়ে গেছে। প্রখর আলোয় ওড়নার মত মেয়েদের স্কার্টের অংশ বিশেষ দেখতে আমার ভুল হয়নি।
দুজনকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল ভেবে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
যখন বাড়ির কাছাকাছি এলাম তখন বারবারা ও ফ্রাঙ্কলিনরাও এসে পড়লেন। শুনলাম জিনিসপত্র কিনতে টেড কাস্টার পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।
যখন গাড়ি থেকে সমস্ত জিনিসপত্র নামানো হচ্ছিল তখন মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের চোখে মুখে উত্তেজিত আনন্দ লক্ষ্য করলাম। বয়েডের হাতে একটা শৌখিন প্যাকেট দিয়ে ওপরে পাঠিয়ে দিলেন। আমরাও জিনিসপত্র নামাতে ওদের সাহায্য করলাম।
উত্তেজনা বজায় রেখে ক্লান্ত ভাবে বারবারা বললে, উফ কী গরম! একপশলা বৃষ্টি হয়তো স্বস্তি আনতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মিস কেলিকে পাকড়াও করে বললেন, জনের কি খবর? শুনলাম ওর মাথা যন্ত্রণা হচ্ছিল? সারা দিনরাত মাথাগুঁজে বসে থাকলে হবে না, তার পরেই নরটনকে বললেন, কী ব্যাপার ভূতটুত দেখেছেন নাকি? অমন পাচার মতন মুখ করে বসে আছেন?
না-আসলে অন্য কথা ভাবছিলাম।
কারটিসের সঙ্গে পোয়ারো এসে উপস্থিত হল। আমার থমথমে মুখ দেখে উদগ্রীব হয়ে বললেন, কী ব্যাপার সবাই এত গম্ভীর, কোনো অঘটন ঘটেনি তো?
আমি কিছু বলার পূর্বেই বারবারা বলে উঠল, না, ওসব কিছু নয়। হয়তো ঝড়ের পূর্বাভাস।
ভালো–ভালো, বলেই চলে গেল।
বারবারা আমাকে একটু সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। ওপরে ওনার পিছন পিছন আসতেই ঘরের দরজা খুলে দেখি ঘরের এক প্রান্তে বয়েড ক্যারিংটন ও তার পাশে দাঁড়িয়ে নার্স ক্লাভেন।
ক্যারিংটন মুখ তুলে বললেন, নার্স ক্লাভেন হাত দেখতে জানেন।
তাই নাকি?–একটা বাঁকা হাসি হেসে বললেন, এখন হাত দেখা ছেড়ে এই জিনিসপত্রগুলোয় একটু হাত লাগান।
ক্লাভেন দ্রুত কাজ করতে চলে গেল।
বয়েড বলে উঠল, সত্যি তোমাকে দিয়ে বড় বেশি পরিশ্রম করিয়ে নিলাম, আমার উচিৎ হয়নি হয়তো।
অত ভেবো না বয়েড।
খুব ভালো, বিশ্রাম কর। অনুতাপের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলল যে, আমার বারবারার শরীরের দিকে নজর রাখা উচিত ছিল।
বললাম, ও কিছু নয়, বিশ্রাম পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
পোয়ারোর ঘরে যাওয়ার পথেই এলারটনের ঘর, অজান্তেই কখন ওর ঘরের সামনে থেমে পড়ি, ভেতর থেকে কথোপকথন ভেসে আসছিল। হঠাৎ জুডিথ বেরিয়ে এসে আমাকে ভূত দেখার মতন লাফিয়ে ওঠে। ওকে কোনো বাধা না দিয়েই আমার ঘরে একেবারে টেনে আনি।
ঘরে ঢুকেই ও চেঁচিয়ে ওঠে। ওর সঙ্গে এত মাখামাখি কেন? অনেক সহ্য করেছি, আর নয়।
জুডিথ আমায় ঠান্ডা গলায় বলে, তোমার মন এতটা নোংরা জানা ছিল না।
আচ্ছা আমি বাজে, নোংরা, পাজি। কিন্তু আমাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য আছে তো।
ও-এই কথা!
হা-এই আমার বক্তব্য, তুমি কি অস্বীকার করতে পারো যে তুমি লোকটির প্রেমে পড়োনি?
না।
ওর অতীত ইতিহাস জানিয়ে দিয়ে বলি, বুঝেছ লোকটা কত ধুরন্ধর, শয়তান?
হ্যাঁ। আমি ওকে সাধু বলে ভাবিনি, এটা জেনে রাখো।
এভাবে তুমি তোমার নিজের সম্মান নষ্ট কোরো না।
আমি কখনও অত তলিয়ে দেখিনি।
আমার ব্যাপারে তুমি নাক গলিয়ো না।–শান্ত ভাবে বলেই ঘর থেকে ও বেরিয়ে গেল।
কীভাবে এই অবাধ্য সন্তানকে রক্ষা করব ভেবে পেলাম না।
আমি যথা সম্ভব আমার ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্ট, পারিবারিক হীনতা লুকিয়ে রেখে আমার মনের মধ্যে, সর্ব সম্মুখে এমন মুখের ভাব দেখালাম যাতে ভদ্র মহোদয়গণই শুধু নয়, জুডিথও অবাক হয়ে গেল। কিভাবে এতটা আমি সহজ হলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি জুডিথের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম।
এর পরেই একটা ঘটনা ঘটল। রাতে খাওয়ার পরই আমরা সবাই বাগানে জটলা হই বা পায়চারি করি। হঠাৎ বাগানে সেদিন জুডিথ, যেদিকটা গোলাপ ফুলের ঝাড়, সেদিকে চলে গেল। এলারটনও তার পিছু পিছু গেল। ওদের সাহস দেখে আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম।
হয়তো আমার অবস্থা আঁচ করতে পেরে নরটন আমাকে বললেন, উত্তেজিত হবেন না, বাধা দেবেন না, ওদের নিজের পথে চলতে দিন। বাধা দিলেই বাঁধ ভাঙবে। সত্যকে মেনে নিলে শান্তি পাবেন।
কোথায় শান্তি। সে বহুকাল আগে স্টাইলস ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। নরটনকে ফেলেই আমি ঝোঁপের দিকে উন্মাদের মত ছুটে গেলাম। আড়াল থেকে যা দেখলাম তাতে লজ্জায়, ক্ষোভে আমার মুখ লাল হয়ে উঠল।
উহঃ, কি দুঃসাহস, কপোত-কপোতির মত ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে গাছের লতার মত। বাধা দেবার শক্তি হারিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। এলারটনের উত্তেজিত কথা কানে আসতেই সম্বিত পেলাম।
তাহলে ও কথাই ঠিক রইল প্রিয়তমা। দুজনে কাল লণ্ডনে মিলিত হচ্ছি। লাঞ্চ সারছি আমার বাসায়। দেখবে কেউ যেন জানতে না পারে। যাহোক কোনো অজুহাতে এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে।
হঠাৎ পেছন থেকে কোনো কথা না বলে নরটন আমায় টেনে নিয়ে গেলেন।
যেতে যেতে বিকারগ্রস্ত রোগীর মত বললাম, ভয় নেই নরটন। এই আমাদের জীবন। জন্মদাতা পিতারও অধিকার নেই নিজের সন্তানের উপর। এবার আমার কী কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছি।
চুপিচুপি এলারটনের ঘরে চোরের মতন থামলাম। কাছাকাছি কেউ আছে কিনা দেখে নিলাম। এতকাল পোয়ারোর সঙ্গে থেকে কোথায় কী সাবধনতা অবলম্বন করতে হবে জেনেছি। এখন আমার কাজ হল এলারটনকে কিছুতেই বেরিয়ে যেতে না দেওয়া এবং কাজটা যে পারব তা ভাবতে পারিনি।
বেশ কিছু অ্যাসপিরিন বড়ি সঙ্গে এনেছি। আমি জানি ওর ক্লান্তি হয় সেই স্লাম্বারিনের শিশি কোথায় থাকে। টেবিলের ওপর থেকে বোতলটা তুলে দেখি লেখা আছে। নির্দেশিত মাত্রার বেশি সেবন নিষিদ্ধ। আঙুলের ছাপ যাতে না থাকে, তাই রুমাল দিয়ে চেপে শিশির মুখটা খুললাম, আটটা বড়ি তুলে নিয়ে সমপরিমাণ অ্যাসপিরিনের বড়ি শিশির মধ্যে ফেলে দিলাম। তারপর শিশি রেখে চটপট করে নিজের ঘরে চলে এলাম।
এরপর ঠিক করলাম ঘুমাতে যাওয়ার আগে হুইস্কির প্রস্তাব দেব এলারটনকে, ও অরাজি না হয়ে খেলেই আর ঘুম ভাঙবে না।
এখন শুধু অপেক্ষা। হঠাৎ কারটিস ঘরে ঢুকল। চমকে উঠলাম। কি ব্যাপার সারাদিনে একবারও বন্ধুর কথা মনে পড়েনি–ওর কথায় লজ্জিত হলাম। ছুটে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে।
কৃত্রিম অভিমানে পোয়ারো আমাকে বলল, এই তোমার বন্ধু প্রীতি? তোমার সাহচর্য পাওয়ার জন্য ডেকে আনলাম আর আমায়ই ভুলে গেলে
ভুল বুঝো না বন্ধু, শরীরটা আসলে ভালো যাচ্ছে না।
এই বয়সে অত রোদে ঘুরলে শরীরের আর দোষ কী। নিশ্চয়ই মাথারও যন্ত্রণা হচ্ছে?
হা তাও হচ্ছে।
কারটিসকে ডেকে আমাকে কয়েকটি অ্যাসপিরিন দিতে বলল।
খেয়েছি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি, বলে উঠি।
হুঁ, তাহলে দুটো মিশিয়ে সেই চকোলেট দাও।
চকোলেট! সে আবার কী? এই প্রশ্ন করার মতন মানসিক অবস্থা নেই, কারণ, তখন মাথায় এলারটন ঘুরছে, বিনাবাক্যে বিশ্রী দুর্গন্ধ যুক্ত দুধটা খেয়ে নিলাম।
যাও, আর ঘোরাঘুরি কোরো না, শুয়ে পড়। পোয়ারো আমায় নির্দেশ দিল।
ঘরে এসে দরজা একটু ফাঁক করে রেখে এলারটনের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
একা বসে থাকলেই আমার স্ত্রী সিণ্ডারস-এর কথা মনে পড়ে। আমাদের সন্তানকে বাঁচাতেই হবে প্রিয়তমা, আমাকে ক্ষমা করো…..
হঠাৎ মনে হয় অন্ধকারে আমার স্ত্রী–আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিড় বিড় করে বলি…. সিণ্ডারস.সিণ্ডার…সিণ্ডা…..সি-ই-ই।
.
১৩.
পাখির কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভাঙে। কোথায় একটা রোমহর্ষক মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারতো, তা নয় একটা রোদ ঝলমলে দিন। ছি ছি! এই কি পিতার প্রতিভা? নিজের ওপর ধিক্কার এসে যায়।
পরক্ষণেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সত্যিই তো আমি কি করতে যাচ্ছিলাম! ঠান্ডা মাথায় একজনকে খুন করতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ টেবিলের ওপর হুইস্কির গ্লাস ও বোতল চোখে পড়তেই ওগুলো বেসিনে ফেলে দিয়ে আসি। তারপর পরিপাটি হয়ে পোয়ারোর ঘরের দিকে যাই।
সব শুনে পোয়ারো বলেন, কি কাণ্ডটাই না তুমি করতে যাচ্ছিলে বন্ধু, কাল রাতে কেন আমায় জানালে না?
অন্যায় হয়েছে পোয়ারো।
আমি নিঃসন্দেহে তোমায় বাধা দিতাম। ভেবে দেখো, ঐ ইতর শ্রেণীর লোকটার জন্য তোমায় ফাঁসির কাঠে তো আমি ঝুলতে দিতাম না।
না, তা হত না, কারণ আমি সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম, আচ্ছা বন্ধু তুমি কি সত্যিই অতটা বুদ্ধিমান হতে পেরেছো? পোয়ারো আমায় জিজ্ঞেস করল।
কেন নয়? আমি তো আঙুলের ছাপ যদি না পড়ে তার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।
আচ্ছা, তা নয় নিয়েছিলে, ভাবো যদি এলারটন মারা যেতো তাহলে কি কি হতে পারতো। পুলিশ ময়না তদন্ত করে জানতে পারলো স্লাম্বারিনের কারণে মৃত্যু হয়েছে। তখন ওটি দুর্ঘটনা না ইচ্ছাকৃত এটা প্রমাণ হত। তাহলে এখানে প্রশ্ন উঠত যদি এলারটন আত্মহত্যা করে থাকে, তাহলে ওকে কে শিশিটা এনে দিল? কারণ শিশিতে তো কারুর আঙুলের ছাপ নেই।
মিনমিনে গলায় বললাম, অনেকে তো মৃত্যুর পূর্বেও আঙুলের ছাপ মুছে ফেলে।
হুঁ, রাখে। কিন্তু অনেকেরই এখানে তেমন কোনো বিবাহযোগ্য কন্যা নেই যার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য এলারটন ঘুর ঘুর করছে, কারণ এ নিয়ে তুমি কালই জুডিথের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। ক্যারিংটন, নরটন এরা জানেন তুমি তোমার মেয়ের জন্য সহ্য করতে পারতে না ওকে। তখন সন্দেহ পড়ত তোমার কাজকর্ম কেউ লুকিয়ে দেখে ফেলেছে। না, তা সম্ভব নয়।
হয়তো কেউ ও পাশের ঝুলন্ত বারান্দায় লুকিয়ে থেকে দরজার চাবির ফুটো থেকে লক্ষ্য রাখতে পারে।
কারো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, ওকাজ করবে।
না হলেই ভালো। তবে তোমাকে বলে রাখি ওই দরজার চাবির ওপর এখানে অনেকেরই নেক নজর আছে। কারটিসও ঘরের পাশেই থাকে।
গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলি, তোমার কী মনে হয় না, এখানে সেই বহুপূর্বের হত্যার বীজ প্রোথিত আছে।
আসলে তুমি বলতে চাও সংক্রামক রোগের মতন হত্যার ব্যাপারটা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
হা এ বাড়ির একটা বদনাম রয়ে গেছে। হা তা অস্বীকার করা যায় না। আচ্ছা, এখন জুডিথ ও এলারটনকে আসবার একটা বুদ্ধি দাও।
৬৬২
চুপ করে থেকে পোয়ারো বলল, এখন তার কোনো দরকার নেই।
নেই?
ভুলে যেও না জুডিথ নাবালিকা ও নিজে রোজগার করে। আমি যতটা জানি এলারটন লোকটা অসম্ভব ধূর্ত ও শয়তান, তোমার মতন নির্বোধ পিতাদের পাঠিয়ে ও মজা দেখে। আর জুডিথকেও তুমি বাগে আনতে পারবে না। তার থেকে এখন চুপ করে থাকাই ভালো। আমি এখন পঙ্গু, তাই অতটা ঝুঁকি তুমি এখন নিতে যেও না। বিপদ বেশি দূরে নয়, ধীরে ধীরে হত্যাকারী তার জাল গুটিয়ে আনছে। সাবধান হেস্টিংস।
অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
গতকাল রাতের টুকরো ভেসে আসা কথাতেই বুঝতে পারলাম বিপদ ঘনিয়ে আসছে। পোয়ারো জুডিথের উপর আস্থা রাখতে বলছে। হঠাৎ জুডিথের ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে ল্যাবরেটরিতে মনসংযোগ আমাকে কিছুটা শান্তি দেয়। এলারটন কিন্তু প্রাতঃরাশের পরই লণ্ডনের পথে রওনা হয়ে যায়।
হয়তো জুডিথের সঙ্গে মিলনের আশা নিয়ে। দেখে মনে মনে হাসলাম।
বয়েড ক্যারিংটন আমার মুখ চোখ দেখে বললেন, আপনাকে ভীষণ খুশী মনে হচ্ছে, কী ব্যাপার? নার্স ক্লাভেন আসাতে আমাদের কথোপকথনে বাধা পড়ল। সে আমাদের জানালো মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের শরীর আবার বেশ খারাপ হয়েছে। শুধু এটা-ওটা চাইছিলেন। উদ্বিগ্ন হলেও বয়েডের মুখ দেখে তা বোঝা গেল না। বয়েড তবুও তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
এই ফাঁকে ক্লাভেন আমাকে জানাল, বুঝলেন না এসবই একরকমের চাল। স্বামীকে পাশে পাশে রাখা। এর মধ্যেই ডক্টর এসে গেছেন।
কিন্তু দেহের উত্তাপ?
আমি দেখেছি, নাড়ির গতি স্বাচ্ছন্দ্য, দেহও স্বাভাবিক নিরুত্তাপ, আসলে কারোর মুখ উনি সহ্য করতে পারেন না।
বেলা একটা নাগাদ ফ্রাঙ্কলিন ও জুডিথ এল। জুডিথকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাই ও সোজা নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। হয়তো স্ত্রীর শরীরের অবনতির কারণে ফ্রাঙ্কলিন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। নরটন এক বাক্স চকলেট নিয়ে বসেছিলেন, হঠাৎ উঠতে গিয়ে তিনি নরটনের সব চকলেট মেঝেয় ফেলে দেন। তারপর ওগুলো কুড়োতে কুড়োতে বলেন, দুঃখিত, খুবই দুঃখিত।
নরটন ভুরু কুঁচকে বলেন, আপনাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
হুঁ। তা বলতে পারেন। আসলে একটা পরীক্ষা ঠিক ভাবে শেষ করতে পারলাম না।
বিকেল বেলা একটু যেন সুখের পরশ এল। মিঃ ও মিসেস লাটরেল দুজনেই বেশ আনন্দিত বলে মনে হল, ব্রিজ খেলার প্রস্তাব করলেন হঠাৎ।
নরটন কিন্তু দ্বিখণ্ডিত হয়ে বলে, এতটা ধকল তোমার সইবে কি?
উনি বললেন, একবার খেলব। আর জর্জকে আমি মোটেই জ্বালাতন করব না।
ডেইজি-তুমি তো জানো আমি ব্রিজে কতটা কাঁচা
ভালোই তো, তোমার ঐ হেরে যাওয়া মুখটা দেখে আমি মজা পাব। বলেই হেসে ফেললেন।
বিকেলে লাটরেলরা বাদে আমরা সবাই বাগানে বসেছিলাম। কথায় কথায় স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতার প্রসঙ্গ উঠল। মনে হল যতদিন সিণ্ডারস বেঁচে ছিল, আমারও সুখ ছিল।
নরটন বলে, খুব দেরিতে এটা বুঝতে পারলাম।
তাই নাকি? বয়েড একেবারে ভুরু কুঁচকে বলে। একেবারে প্রাণের কথা?
ঠিক এই সময় মিস কেলি এলেন। নরটনের দিকে ওর চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হল, গোপনে ওদের মন-দেওয়া নেওয়া চলছে। এর মধ্যেই হৈ হৈ করে জুডিথ এসে পড়ল। এসে ঘোষণা করল, এখন মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বেশ সুস্থ। তিনি সবাইকে ঘরে কফি খেতে ডাকছেন।
আমরা সবাই আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে গেলাম।
মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের বিভিন্ন সময়ের গতি প্রকৃতির সঙ্গে এখনকার কোনো মিল নেই। হয়তো নার্সের সঠিক মূল্যায়নের ফল এটি। ঘরের মধ্যে ফ্রাঙ্কলিন একটু দূরে চেয়ারে বসে। বয়েড দাঁড়িয়ে আছে মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের পাশেই। আর মিস কেলি ও নরটন পাশাপাশি জোড়া পায়রার মত বসে। নার্স ক্লাভেন বিছানার এক প্রান্তে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি দ্য টাইমস কাগজটা পড়ছিলাম। হঠাৎ সবার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললাম। এখানে একটা বাঁধা দিয়েছে। টেনিসনের একটা পংক্তি। বলছি শুনুন প্রতিধ্বনি যেভাবেই উঠুক, তার একটি মাত্র উত্তর শেষ শব্দটা নেই। কী হবে বলুন তো?
মিসেস ফ্রাঙ্কলিন কিছু না ভেবেই বললেন, ওখানে হবে কোথায়।
মিস কেলি বললেন, লাইনটা এরকম–প্রতিধ্বনি যেভাবে উঠুক তার একটি মাত্রই উত্তর মৃত্যু।
ঠিক আছে। এবার বলুন তোকে বলেছে–ঈর্ষা একটি হরিৎ চক্ষু দানব-ক্যারিংটন বলেন –শেক্সপীয়র।
মিসেস ফ্রাঙ্কলিন সঙ্গে সঙ্গে বলেন এর সঙ্গে বলতে হবে এটা কোনো চরিত্রের সংলাপ।
ইয়াগো।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ওথেলো।
না। আমি বললাম ওটা রোমিও বলেছে জুলিয়টকে। হঠাৎ বাচ্চা মেয়ের মতন জুডিথ বারান্দা থেকে বলল, দেখুন, কী সুন্দর একটা ধূমকেতু।
সবাই দেখতে গেলাম। বয়েড হঠাৎ বারবারাকে কোল পাঁজা করে নিয়ে বারান্দার দিকে গেলেন। আমি শুধু উঠলাম না। একটু পরেই সবাই ফিরে এল, শুধু এলিজাবেথ ও নরটন কফি শেষ করে বিদায় নিল।
কফি শেষ করেই মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বললেন, আমার ওষুধ, বাথরুমে রেখেছিলাম
জুডিথ-বাথরুম থেকে এনে দিল। ফ্রাঙ্কলিন উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। আর সেজন্য হঠাৎ টেবিলে ধাক্কা খেলেন।
বারবারা চিৎকার করে ওঠে–কী হচ্ছে কী?
লজ্জিত হয়ে, বাগান থেকে একটু বেরিয়ে আসি, বলেই বেরিয়ে গেলেন। জুডিথও চলে গেল। বয়েড বলল একহাত তাস খেললে কেমন হয়?
চমৎকার!
বারান্দায় শুনতে পেলাম ফ্রাঙ্কলিন জুডিথকে বলছে একটু বাগানে বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু জুডিথ ভীষণ ক্লান্ত বলে যেতে অস্বীকার করাতে ফ্রাঙ্কলিন একাই চলে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত খুশী দেখাচ্ছে আপনাকে–
ফ্রাঙ্কলিন তখন বললেন, আসলে অনেক দিন আগের একটা কাজ শেষ করতে পেরেছি।
পোয়ারোর ঘরে দেখি জুডিথ বসে। ঘরে ঢুকতেই পোয়ারো আমাকে বলল, দেখ, ও ঐ রকম মেয়েই নয়, তোমায় আগেই বলেছি, ও তোমায় ক্ষমা করেছে।
তাই নাকি?
বাবা তুমি আঙ্কল পোয়ারোর কথায় কিছু মনে কোরো না, আসলে তুমিই আমায় ক্ষমা কর। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। আমি কিছু বলার আগেই ও ঘর থেকে চলে গেল।
এবার পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল-ওহে হেস্টিংস বিকেলের ব্যাপারটাও তো আমার জানতে ইচ্ছে করে।
বললাম, নতুন কোনো সংবাদ নেই। মনে হচ্ছে কোনো অঘটন এখানে ঘটছে না।
কিন্তু রাতেই যে অঘটন ঘটল তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। মিসেস ফ্রাঙ্কলিন হঠাৎ শেষ রাতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত দুজন ডাক্তারও তাকে বাঁচাতে পারেনি, এবং চব্বিশ ঘন্টা পরে জানতে পারলাম বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে, এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
৪. অনুসন্ধান শুরু হল
১৪.
দুদিন পর অনুসন্ধান শুরু হল। ফরেনোর এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এ তদন্তের জন্য মনোনীত হয়েছেন। যেমন কুটিল চাউনি, তেমন জটিল জেরা।
ডাক্তারের সাক্ষাৎ থেকে জানা গেল শেকড় বাকড়ে প্রাপ্ত ক্ষার যুক্ত রাসায়নিক রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। এর পর ডঃ ফ্রাঙ্কলিন সাবলীল ভাবে যে সাক্ষ্য দিলেন তাতে পুলিশ সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি বললেন যেখানে বোতলে ক্যালাবার জাতীয় বিষাক্ত গাছের সারাৎসার ছিল, সেখানে তা নেই। জল ভরা আছে। তিনি এ বোতল সাত-আট দিন হল স্পর্শও করেনি। তার ল্যাবের দুটো চাবির মধ্যে একটা থাকে মিস হেস্টিংসের কাছে। যদিও তার স্ত্রী মাঝে মাঝে আত্মহত্যার কথা বলতেন তবুও এত মানসিক শক্তি তার ছিল না। অসুস্থ বলেও তিনি মৃত্যুর রাতে বেশ খোসমেজাজেই ছিলেন।
এর পর নার্স ক্লাভেন বললেন, উনি মাঝে মাঝে বলতেন স্বামীর বোঝা হয়ে তিনি বেঁচে থাকতে চান না।
কেন? এ নিয়ে কি তার স্বামীর সঙ্গে কোনো বাগবিতণ্ডা হয়েছিল?
না, না। আসলে ওনার জন্যই ওর স্বামী বিদেশে এক চাকরী গ্রহণ করতে পারেননি। এজন্য মাঝে মাঝে দুঃখ পেতেন।
একথাও ফ্রাঙ্কলিন জানতেন?
না, মনে হয় না।
আচ্ছা কখনও কি ওনার কোনো কথায় মনে হয়েছে যে উনি আত্মহত্যা করতে পারেন?
নিজেকে শেষ করে দিতে পারলেই ভালো হয়, এরকম কথাই উনি মাঝে মাঝে বলতেন।
তিনি কি কখনও বলেছেন কি ভাবে নিজের জীবন নষ্ট করতে চান?
না। ভাসাভাসা বলতেন। আচ্ছা ডঃ ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে কি আপনিও একমত যে উনি মৃত্যুর রাতে হাসিখুশি ছিলেন?
হ্যাঁ, তবে সামান্য উত্তেজিত ছিলেন, আপনি কি এমন কোনো বোতল দেখেছেন যা ওষুধ না হয়ে অন্য কিছু হতে পারে?
না। তবে তিনি সেদিন এক পেগ বারগাণ্ডি মদ খেয়েছিলেন।
কোথায় পেলেন?
নিজের কাছেই রাখতেন।
আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, ঐ ওষুধটা ঐ মদের সঙ্গে মিশে গেছে?
অসম্ভব নয়। হয়তো মিশিয়েও নিতে পারেন।
আচ্ছা বোতল নিয়েছেন ধরে নিলে, নেওয়ার পর তিনি কোথায় ফেলতে পারেন?
ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে, জানালা দিয়ে ছুঁড়ে বা ধুয়ে আলমারিতে রেখে দিতে পারেন। ওখানে অনেকগুলো শিশি বোতল আছে যা আমরা অন্য কাজে লাগাই।
শেষবারের মতন তাকে কখন দেখেছেন?
যখন ওষুধ দিতে যাই। সামান্য উত্তেজিত ছিলেন। তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন এই রকম হলে কিনা জানতে চাইলে, ক্লাভেন বলেন, ঠিক বলতে পারি না।
বয়েড ক্যারিংটনকে দেখে মনে হল বেশ আঘাত পেয়েছেন। তিনি বললেন, যখন রাতে তিনি তাস খেলছিলেন তখন কোনো হাতাশার ভাব দেখা যায়নি।
জুডিথকে ডাকাতে ও বলল, ল্যাবে কেউ যে ক্যালাবার গাছের বিষাক্ত সারাৎসারটা সরিয়েছে সে সম্পর্কে তার কোনো সম্যকজ্ঞান ছিল না।
এর পর এরকুল পোয়ারো। তিনি বললেন মৃত্যুর আগের দিন রাতের আলোচনায় তার মনে হয়েছে, তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ মহিলা, স্বামীর জন্য গভীর প্রেম, স্বামী স্বনামখ্যাত হোক এরকমও তিনি চাইতেন। তাই তিনি চাইতেন নিজের স্বাস্থ্যের জন্য চিরকালের জন্য সরে যেতে।
আচ্ছা দশই জুন যখন আপনি ল্যাবরেটরির খোলা দরজার সামনে বসে ছিলেন তখন কি ওনাকে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলেন?
হা।
হাতে কিছু ছিল?
একটা ছোট্ট বোতল লুকিয়ে আনছিলেন, ঠিক লক্ষ্য করেছেন?
হা।
আপনাকে দেখে কোনো ভাবান্তর হয়েছিল?
একটু চমকে গিয়ে ছিলেন মাত্র। তারপর ফরেনোর রিপোর্ট থেকে জানা গেল এখন স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। সবার রায় একসঙ্গে শোনার পর সিদ্ধান্তে আসা গেল অপ্রকৃতিস্থ অবস্থার জন্য তিনি নিজের জীবন শেষ করে দিয়ে দেন।
পোয়ারোর সঙ্গে যখন মিলিত হলাম তখন ওকে কারটিস সেবা করছিল।
কারটিস চলে যেতে বললাম, সত্যিই কি তুমি মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে বোতল হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন?
তুমিও কি তা দেখনি বন্ধু?
না। কখনও নয়।
হয়তো তুমি লক্ষ্য করনি প্রিয়তম।
এ তুমি কি বলছ এ যে অসম্ভব। তুমি কি সত্যি বললে?
কেন? মিথ্যে বলেছি মনে হয়।
তোমাকে কখনই অবিশ্বাস করতে পারি না।
তোমার কথায় হেস্টিংস আঘাত পেলাম। তাহলে এখন আমায় অবিশ্বাস করছ কেন?
হঠাৎ বলি, এ আমি কখনই বিশ্বাস করব না যে তুমি হলফ নিয়ে সাক্ষী দেবে।
এ মোটেই হলফ নিয়ে সাক্ষ্য নয়। কারণ সাক্ষ্য দেবার সময় আমাকে দিয়ে কোনোরকম শপথ করিয়ে নেয়া হয়নি।
তাহলে তুমি মিথ্যে বলছ, তোমায় আজও আমি বুঝে উঠতে পারলাম না।
কোনো জিনিষটা?
তোমার সাক্ষ্য, তোমার বলা, এইসব।
হায় বন্ধু কী আর বলব। তাহলে তুমি কি চেয়েছিলে জুরীরা সব আত্মহত্যা বলে রায় দিক?
মনে হয় হেস্টিংস তুমি বর্তমান অবস্থার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে পারছ না। আসলে আমি ও তুমি সবাই জানি এটা হত্যা।
তাহলে এত একটা সাংঘাতিক ব্যাপারকে তুমি ধামাচাপা দিতে চাইছ?
পোয়ারো শুধু বলল, আগেই তোমাকে বলেছি হত্যাকারী শুধু ধূর্তই নয়, নির্মমও। এটা একটা হত্যা। এখনকার মত একটা হত্যার ঘটনা শেষ হল। এবার আমরা ঘটনার গভীরে প্রবেশ করব ও এক্স-এর মুখোমুখি হব।
যদি এর মধ্যে আরেকটি হত্যা ঘটে যায়?
আপাততঃ সেরকম সম্ভাবনা নেই।
.
১৫.
মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের তদন্ত শেষ হবার পর তার শ্রাদ্ধ শান্তি হয়েছিল। ওনার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার দিন এক কুশ্রী মহিলা হঠাৎ আমায় বলেছিলেন–আপনাকে আমি চিনি–কী বলেন চিনি না?
থতমত খেয়ে বলছিলাম, মানে–ইয়ে, তিনি বলে গেলেন, মনে নেই যেবার বৃদ্ধা ইঙ্গলথর্পকে তার স্বামী খুন করেছিল, এবারও সেইরকম কিছু হতে পারে।
রেগে গিয়ে বলেছিলাম, শুনেছেন তো এটা একটা আত্মহত্যা। কিন্তু উনি বললেন, জানেন তো স্বামীর সঙ্গে ওনার বনিবনা ছিল না, যেখানে স্বামীই ডাক্তার-এরপর কারটিসের সঙ্গে দেখা হতে সে বলল, মনে হয় স্যারকে একবার ডাক্তার দেখানো ভালো। ছুটে গিয়ে পোয়ারোকে বলতেই, ও আশ্চর্যভাবে আপত্তি জানাল। যে পোয়ারো এমনি সামান্য সর্দি কাশিতেও ডাক্তার দেখাতো। রেগে গিয়ে বলল, কত নামী ডাক্তার দেখিয়েছি, হাওয়া বদল করেছি। কিন্তু কি হল তাতে, বরঞ্চ মাঝে যেটুকু সুস্থ ছিলাম তাও হারিয়ে এলাম। আসলে বন্ধু আমার প্রাণবায়ু ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে।
আসলে কারটিস বলছিল–
কি বলছিল কারটিস? হার্ট অ্যাটাকের কথা, হেস্টিংস দুঃখ কোরো না। এই জীবনের এই শেষ হত্যার ঘটনা। আমি শেষ করে যেতে চাই। এখনও আমি পাঁচজন সুস্থ ব্যক্তির চেয়ে একটু বেশিই করতে পারি। আমার অঙ্গ পঙ্গু হলেও মস্তিষ্ক পঙ্গু নয়।
সেদিনের মতন ওর ঘর ছেড়ে চলে এলাম।
ঠিক পরের দিনই পোয়ারো আবার ডাক্তারের প্রসঙ্গ তুলল। ভাবছি ডঃ ফ্রাঙ্কলিনকে দেখাবো।
ফ্রাঙ্কলিন। অবিশ্বাসী দৃষ্টি আমার চোখে।
অবাক হওয়ার কিছু নেই। উনিও তো ডাক্তার। তাছাড়া এখানে একসঙ্গে আছি। আমার ধাত ওনার অজানা হয়। বাইরের ডাক্তারের চেয়ে উনিই ভালো।
ফ্রাঙ্কলিন চিকিৎসা জগতের সঙ্গে এখন সম্পর্কহীন। আর পোয়ারোর মতন খুঁতখুঁতে লোক কিনা ওকেই বেছে নিল।
ফ্রাঙ্কলিন পোয়ারোকে দেখা করার পথে আমি সংগোপনে আলোচনার জন্য আমার ঘরে টেনে নিয়ে গেলাম।
কেমন দেখলেন?
একজন অসাধারণ মানুষ। তা জানি। স্বাস্থ্য কেমন দেখলেন? ওহ স্বাস্থ্য! শরীরে পদার্থ বলতে কিছু নেই, তিনি এখন ডাক্তারী চিকিৎসার বাইরে।
কম্পিত কণ্ঠে বলি অর্থাৎ আপনি! উনি সব জানেন, যে কোনো সময়ে মারা যেতে পারেন, কিন্তু ওনার সঙ্গে কথা বলে ভীষণ উৎকণ্ঠিত মনে হল। একটা কী কাজ হাতে নিয়েছেন, সেটা শেষ না করে ইহজগৎ থেকে যেতে চান না, কী কাজ আপনি জানেন?
হা।
ওনার কথা শুনে মনে হল বাঁচা মরা ওনার নিজের উপর নির্ভর করছে।
কোনোভাবেই কি রোগ সারানো যায় না?
সম্ভব নয়। যেভাবে হার্ট থেকে রেহাই পেতে অ্যাসিল নাইট্রেট ক্যাপসুল খাচ্ছেন। তার পরই একটা মজার কথা বললেন–প্রত্যেকটি মানুষের জন্য তার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে, তাই না?
বোধহয় তাই।
ওর সঙ্গে মনে হয় আমাদের এইখানেই পার্থক্য।
বিরক্ত হয়ে বলি, বাঁচা মরা সম্পর্কে এমন ঠুনকো ধারণা তো, ডাক্তার হয়েছিলেন কেন?
আমাদের শুধু রোগ সারানো কাজ নয়, রোগের জীবাণু উৎপাদন করাও আমাদের সাধনা। ফ্রাঙ্কলিনকে দেখে মনে হল স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি নতুন উদ্যমে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
আচ্ছা আপনার আর জুডিথের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলটাই বেশি না?
না! আমার তা মনে হয় না, আমি একটু বেশি কাজের ভার দিয়ে ফেলাতে হয়তো ও এইরকম হয়েছে। হঠাৎ একটু থেমে উনি বললেন, এবার আমি সত্যি মুক্ত বিহঙ্গ। যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। ভাবছি সেই চাকরীটা নেব।
সেই আফ্রিকায়?
হা। আসলে আমার কোনো ভণ্ডামি নেই, স্ত্রী মারা গেছে বলে যে সব ছেড়ে দেব, ভালোবেসে বিয়ে করেছি বলে ওর কথায় ওঠা বসার বান্দা আমি নই। নিজের পছন্দসই ভাবে : আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই। আমি বারবারার পছন্দ-অপছন্দ সবদিকে নজর রাখতাম।
আপনি আপনার স্ত্রীর মৃত্যু নিছক মৃত্যু নয় জেনেও বিচলিত নন?
এবার চিন্তিত মনে হল তাকে। বললেন, হুঁ হতে পারে ও আত্মহত্যা করেনি, এটা ওর ধাত নয়।
তা হলে কী আপনার–ওসব নিয়ে আমি কিছু জানাতে বা বলতে চাইনা। বুঝেছেন?
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বারবারার মৃত্যুর পর নরটন একটু বেশি চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। যেন সবসময় চিন্তায় কুঁদ হয়ে আছেন।
তিনি তার মাথার চুল খাড়া করে বলতে লাগলেন, কোনো জিনিষটা ভালো বা মন্দ তা চট করে বলে দেওয়া যায়। কিন্তু যেটা সাধারণের মধ্যে পড়ে না, সেটার বেলায় বিচার করা মুস্কিল। ধরুন, যদি কেউ কারোর চিঠি ভুলবশত পড়ে ফেলে তখন কি করবে সে?
উত্তরে বলি, কী আর করবে, গর্হিত কাজ হলেও ক্ষমা চেয়ে নেবে।
একটু ভেবে নরটন বলেন, যতটা সোজা ভাবছেন ততটা নয়। আসলে আমি ঠিক আপনাকে বোঝাতে পারছি না। হয়তো চিঠির মধ্যে এমন কিছু থাকতে পারে যা অন্যের কাছে বেশি মূল্যবান। আসলে আমি যেটা বলতে চাই সেটা অন্য কিছু। চিঠির কথা বলে আমি আপনাকে ব্যাপারটা শুধু বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম। ধরুণ এমন কোনো কথা আপনি জেনেছেন যাতে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য আছে যা কাউকে না কাউকে বলা জরুরী হয়ে পড়ে। বললেন, ধরুন, কেউ যদি দরজার চাবির ফুটো দিয়ে কিছু দেখে ফেলে।
চাবির ফুটো! পোয়ারোর কথাটা মনে পড়ে।
নরটন বলে চলল, আসলে চাবিটা আটকে গিয়েছিল, তাই খুলতে গিয়ে আপনি আচমকা কিছু দেখে ফেলেছেন।
আমি ঘুরে প্রশ্ন করি আপনি কি বলতে চাইছেন?
আপনি দূরবীণ দিয়ে সেদিন এমন কিছু দেখেছিলেন যা আপনার দেখা উচিত হয়নি।
-বললাম।
আঁ, আপনি কি করে এটা অনুমান করলেন।
বললাম, এর সঙ্গে কি মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক আছে?
না, সোজাসুজি বলতে গেলে কিছু নেই। আবার থাকতেও পারে। এর বেশি আমায় কিছু আর জিজ্ঞেস করবেন না।
কি করি, জানাও প্রয়োজন অথচ ওনাকে বেশি চাপ দিতেও পারছি না। বললাম এবিষয়ে আপনি পোয়ারোর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
পোয়ারো? শত হলেও তিনি বিদেশী।
বললাম, উনি আপনার সব কথা শুনবেন, নিশ্চয়ই সদুপদেশও দেবেন।
পোয়ারোকে ঘটনার বর্ণনা দিতেই বিস্মিত হয়ে বলল, সাংঘাতিক, চটপট বলে ফেললো।
সব ঘটনা বিস্তারিতভাবে বললাম।
হঠাৎ পোয়ারো আমার হাত চেপে ধরে বললেন, উনি একথা কাউকে বলেননি তো?
অবাক হয়ে বললাম, মনে হয় না।
দেখো হেস্টিংস একথা উনি আকারে ইঙ্গিতে বললেও বিপদ।
বিপদ!
হা। ও যেন সন্দেহ না করে এইরকম ভাবে একটা ব্যবস্থা কর যাতে আজ বিকেলেই আমার সঙ্গে দেখা করে। আচ্ছা সেদিন কে ছিল বললে?
এলিজাবেথ কেলি।
.
১৬.
পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করার কথা নরটনকে বলতে উনি বললেন, মনে হয় আপনাকে বলেও কথাটা ঠিক করিনি।
আশাকরি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলেননি?
না।
এরপর যখন আমি উঁচু ঢিবিটার উপর বসতে যাই ওখানে মিস কেলিকে দেখে একটু অবাক হই। আমাকে দেখে বললেন, নতুন কিছু ঘটল নাকি?
না, না, ওসব কিছু নয়। মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি হবে–কথার কথা বললাম।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। তারপর আমরা সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম। তারপর পোয়ারোর দুঃখের কথা বলতে উনি বললেন, তাহলে আমি যে এখানে একেবারে একা হয়ে যাব।
সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, কেন জুডিথ আছে তো।
ওতো নিজের কাজ নিয়ে থাকে। আমার কে আছে?
কেন মিঃ নরটন আপনাকে দেখবেন।
উনি শুধু আমার বন্ধু মাত্র। আমার এক বোন হত্যাকারী না হলেও, বিকৃত মস্তিষ্ক। অসম্ভব!
কিন্তু আপনিই তো বলেছিলেন, ম্যাগী খুন করতে পারে না।
অনেকে মনে করে। আর এই মনে করাটা অনেক সময় সত্য হয়ে যায়।
আমি শান্ত কণ্ঠে বলি, আপনার বোন, আপনার বাবাকে খুন করেনি।
কে বলছে একথা, বিস্ফারিত চোখে উনি জানতে চান।
সময় হলে প্রমাণ দেব, উত্তেজিত হবেন না।
বাড়ির কাছাকাছি বয়েডের সঙ্গে দেখা হতে উনি বললেন, আজই এখানে আমার শেষ দিন, কালই চলে যাচ্ছি।
কোথায়? ন্যাটনে? হয়তো ভালোই হবে।
হা। বোধহয় তাই। আসলে এ বাড়িটা দিনকে দিন ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। যেখানে একবার খুন হয়েছে সেখানে আবার ঘটতে পারে। মিসেস লাটরেল মোটেই আত্মহত্য করার মতন মেয়ে না।
হু-তবে ও নিয়ে আর আলোচনা না করাই ভালো।
আপনি না চাইলেও আমি করব, শুধু জনের জন্যই ওর একমাত্র দুঃখ। আমার মনে হয় ওর মৃত্যুর জন্য ওর স্বামীই দায়ী। উনি খুনী প্রমাণিত হলে আমি মোটেই আশ্চর্য হব না।
এটা নিশ্চয়ই কথার কথা।
মোটেই নয়। যদিও যেভাবে ওর মৃত্যু হয়েছে তাতে এটা প্রমাণ করা মুস্কিল, কিন্তু আমি গোপন সূত্রে কিছু আভাস পেয়েছি।
কী সেই গোপন সূত্র?
কাউকে বলবেন না, নার্স ক্লাভেন।
কে!
চেঁচাবেন না। ওই সব বলেছে।
শুনেছিলাম উনি রোগীকে দেখতে পারতেন না, কিন্তু এখন বলছেন ফ্রাঙ্কলিনকে।
হা। সেই শেষকৃত্যের সময়ই তো উনি কর্মচ্যুত হয়ে বিদায় নিয়েছেন।
হতে পারে। তীক্ষ্ণ স্বরে বলি, কিন্তু ওর সাক্ষ্যতেই তো পুলিশ একে আত্মহত্যা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাছাড়া পোয়ারোও ওনাকে একটা বোতল নিয়ে আসতে দেখেছিল।
আরে মশাই মেয়েরা নয় তেলের, নয় নখ পালিশ ইত্যাদি নানা কাজে বোতল ব্যবহার করে। ওসব অঙ্গের ভূষণ। কি বোতল নিয়ে আসছিল কে বলতে পারে?
খলনায়কের মত হন্তদন্ত হয়ে এলারটনকে আসতে দেখা গেল।
পোয়ারোর ক্ষুরধার বুদ্ধির জোরেই আমার বিশ্বাস যে এক্স কে ও বার করবেই।
সেদিন খাওয়ার আগে পোয়ারোর কাছে যেতেই ও বলল, যদি আমার কিছু হয়?
হায় বন্ধু, তুমি কি ডঃ ফ্রাঙ্কলিনের কথা মনোযোগ দিয়ে শোননি? আজ তোমায় বলি এক্স এর সামনে আমি এখন প্রতিরোধের দেওয়াল, যে করেই হোক, আমাকে টপকে যেতে হবে ওকে।
একথার মানে কি পোয়ারো? এক্স বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ চতুর ও ধূর্ত। ও ভাবতে পারে যদি আমার স্বাভাবিক মৃত্যুর দু-চার দিন আগে আমার মৃত্যু ঘটে যায়, তাহলে ওর সুবিধেই হবে।
তাহলে কি হবে পোয়ারো? আকুল হয়ে বলি।
যুদ্ধে কর্নেল মারা গেলে তার দ্বিতীয় পদাধিকারী হয়। তুমিও তাই হবে।
না, বন্ধু না।
আমি কিন্তু নিশানা রেখে যাব। যাতে তুমি সত্যের কাছাকাছি পৌঁছবে।
জানি না, নিজেকে পীড়ন করে তুমি কি সুখ পাও।
এ আমার জীবনের গভীরতাবোধ। কিন্তু আমার উপর আস্থা রাখো। আমার রেখে যাওয়া নিশানায় তুমি সত্যের আলোয় পৌঁছবে।
.
১৭.
অনেক দিন পরে আবার সবাই খাবার টেবিলে বেশ আনন্দে ছিলাম। সবাইকে যেন ভালো বেশ খুশী দেখাচ্ছিল।
মিসেস লাটরেল তাসের প্রস্তাব রাখতে আমরা খেলতে বসলাম, আবহাওয়াও ভালো ছিল। হঠাৎ নরটন বললেন, পোয়ারোর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। উনি কেমন আছেন দেখে আসতে যাচ্ছেন।
বললুম, এখন কথা বলা মনে হয়, ওনার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো হবে না।
নরটন আমার ইঙ্গিত বুঝে বললেন, খুব বেশি বিরক্ত করব না। একটা বই চেয়েছিলেন ওটা দিয়েই চলে আসব।
আমাকে নরটনের পিছনে পিছনে যেতে দেখে বয়েড বললেন, মিঃ হেস্টিংস আপনি ফিরে আসছেন তো?
নিশ্চয়ই। নরটনের সঙ্গে গেলাম, দু-চারটে কথা বলেই বিদায় নিলাম। আমরা আরো কিছুক্ষণ তাস খেলোম।
রাত এগারোটা বাজতে পনেরোয় আমি শুতে গেলাম। পোয়ারো নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে করে আর দেখা করলাম না।
সবে মাত্র বিছানায় উঠেছি দরজায় কার টোকা দেবার শব্দে আহ্বান জানাই, ভেতরে আসুন। কেউ না আসাতে আলো জ্বেলে দেখি নরটন দরজা খুলে নিজের ঘরে ঢুকলেন। মাথা চুলকোতে চুলকোতে ঘরে গিয়ে দরজায় তালা দিলেন শুনতে পেলাম।
নরটন কী প্রতিরাতেই এমন করেন না আজ পোয়ারোর কাছে কোনো সাবধান বাণী শুনে এমন করলেন? বিছানায় শুয়ে স্বস্তি এল না।
প্রাতঃরাশে যাওয়ার আগে পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম, কেমন আছো, বুড়ো খোকা?
আছি, এখনও বেঁছে আছি।
যন্ত্রণা নেই তো?
না।
নরটন কি সব কথা বলল?
হ্যাঁ।
কী বললে? কী দেখেছে?
সেকথা তোমায় বলা ঠিক হবে না। দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, বললেন তিনি দুজনকে সেখানে
বুঝেছি। আর বলার দরকার নেই।
জুডিথ আর এলারটন।
উতলা হয়ো না বন্ধু। মোটেই জুডিথ আর এলারটন নয়।
নয়? তবে?
আজ নয় কাল বলব, একটু চিন্তা করে, গুছিয়ে নিয়ে বলব।
বারবারার হত্যা রহস্যে এ কী কোনো সাহায্যে আসবে?
হুঁ। মাথা নাড়লও। তারপর বলল যাও, প্রাতঃরাশ সারো, আর কারটিসকে পাঠিয়ে দাও।
নরটন তখনও প্রাতঃরাশে আসেনি বলে অপেক্ষা করতে হল।
বয়েডের সঙ্গে দেখা হতেই বললাম, নরটনকে দেখছি না?
দেখুন গে মৌজ করে ঘুমোচ্ছে।
আমরা একসঙ্গে ওনাকে ডাকতে উপরে গেলাম। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় দু-একবার ঘা দিলাম।
কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
পরিবেশটা যেন থমথমে হয়ে উঠল। যখন কোনো সাড়া পেলাম না, তখন ছুটলাম কর্নেল লাটরেলের কাছে। মিসেস লাটরেল বললেন, দরজা ভেঙে ফেলতে হবে। যাও শীগগির।
দরজা ভেঙে ভেতরে দেখি এক কঠিন মৃত্যুর চিত্র। রাতের পোষাক পরে। দরজার চাবিটা ছিল পকেটে, হাতে ছোট পিস্তল, কপালের মাঝে এক ছোট্ট রক্তাক্ত গর্ত।
পোয়ারো কী ভেবে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কী হয়েছে নরটনের? মৃত! কেমন করে? কখন?
সবাই বলছে আত্মহত্যা, কারণ কাল রাতে আমি ওকে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখি।
সত্যিই তুমি ওকে দেখেছিলে?
হা। ভদ্রলোকের ওই বিচিত্র রাতের পোষাক জঙ্গলে গেলেও আমি চিনতে পারব।
হুঁ। রাতের পোষাক। যে কোনো লোকই ঐ রকম পোষাক পরতে পারেন কী, ঠিক নয়?
যে কেউ ওর চলার ভঙ্গী নকল করতে পারে।
হুঁ, হতে পারে। তবে কি বলতে চাও আমি নরটনকে দেখিনি?
না, তেমন কিছু বলতে চাই না, আমি বিশ্বাস করি না, এটা আত্মহত্যা, এটা সুপরিকল্পিত হত্যা।
একটা ঘোরের মধ্যে নিচে নেমে এলাম, বিদায় বন্ধু বিদায় নরটনের এই দুটো কথা আমার মনে বাজছে। কারণ কারটিস যখন তার প্রভুর সেবা করতে ঢুকেছিল, তাকে সে জীবিত পায়নি। আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে…..।
এরকুলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই আর্থার হেস্টিংসেরও মৃত্যু হয়ে গেছে। তাই আর কিছু লেখার প্রবৃত্তি নেই। শুধু আসল ঘটনাটি জানিয়ে যাই
অন্য সকলের মতন হার্ট অ্যাটাকেই তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। শুধু হার্টের জন্য, যে অ্যাসিল নাইট্রেটের শিশিটা ব্যবহার করত সেটা পাওয়া যায়নি। তবে কি কেউ এটা সরিয়ে দিয়েছে?
কিন্তু এটা নিশ্চিত যে পোয়ারোর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। বারবারা, নরটনের মৃত্যুর মতও তার মৃত্যুও অস্বাভাবিক, কেন, কোনো উদ্দেশ্যে ওদের খুন করা হল?
নরটনের মৃত্যুতে পুলিশী তদন্তে জানা গেল, মানুষ আত্মহত্যা করার সময় তার কপালের ঠিক মাঝখানে গুলি ছুঁড়তে পারে না। কিন্তু মৃত্যুর দিনের নরটনের যে চিত্র দেখা গিয়েছিল তাতে আত্মহত্যার সপক্ষে যুক্তি যায়। তথ্য, নিদর্শন, জুরীর রায়, পিস্তল সব থেকে প্রমাণ হল এ নিছকই আত্মহত্যা।
পোয়ারোর ঘরে এলাম। যে বাক্সে কল্পিত এক্স-এর কাগজগুলি রাখা ছিল সেগুলো বার করলাম। কিন্তু বাক্স খুলে দেখি সেখানে কাগজের ছিটে ফোঁটাও নেই। কিন্তু সব কাগজগুলো পোয়ারো এখানেই রেখেছিল। হয় পোয়ারো নিজে নষ্ট করেছে কাগজগুলো। নয় এক্স-এর হাত এখন পর্যন্ত পৌঁচেছে।
হঠাৎ পোয়ারোর নিশানার কথা মনে পড়ল। বাক্সে কাগজগুলো না থাকলেও সেখানে দুটো বই ছিল। একটি শেক্সপীয়রের ওথেলোর সুলভ সংস্করণ অন্যটি সেন্ট জন আরভিনের নাটক জন ফার্গুসন। এই নাটকের তৃতীয় অঙ্কের আরম্ভে দুটো পাতার মাঝখানে একটুকরো কাগজ দিয়ে দৃষ্টি গোচর চিহ্ন দেওয়া রয়েছে।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর মনে হল হয়তো নাটকের কোনো সংলাপে পোয়ারো রেখে গেছে পথের নিশানা। শব্দের মধ্যে নিঃশব্দ ইঙ্গিত।
কিন্তু কোনো লাইনেও দাগ কাটা দেখতে পেলাম না। এই অঙ্কে যুবক ফার্গুসন যে তার বোনকে নষ্ট করেছে সে মানুষের খোঁজ করছে। কিন্তু পোয়ারো কেন এই নাটকের বই রেখে গেল। তারপর
পরের অংশ যেতে একটা টুকরো কাগজ বই থেকে পড়ল যেখানে লেখাছিল –আমার ভৃত্য জর্জের সঙ্গে কথা বোলো।
এই তো ইঙ্গিত।
প্রিয়তম বন্ধুকে এখানে সামধিস্থ করলাম, সঙ্গে ছিল জুডিথ, মিস কেলি, ও বয়েড। এখানে জুডিথ একেবারে অন্য রকম। ও আমায় একসময় বলল, আমি আর এখানে থাকছি না বাবা, হয়তো দুঃখ পাবে। কিন্তু না বললেই নয়। আমি ডঃ ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে আফ্রিকায় চলে যাচ্ছি।
না, এ হতে পারে না, অসংখ্য যুক্তি দেখালাম। কিন্তু ও প্রতিবাদ করল না। শেষে সামান্য হেসে বলল, ভুল করছ বাবা, আমি যাচ্ছি ফ্রাঙ্কলিনের স্ত্রী হয়ে, সহকারী হয়ে নয়।
তাহলে এলারটন?
আমায় অবাক হতে দেখে ও বলল, ওর সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা কোনোদিনই ছিল না। আসলে আমি জানতে দিতে চাইনি আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক।
কিন্তু তোমাকে যে এলারটনের সঙ্গে ঝোঁপের ধারে ঘনিষ্ঠ হতে দেখলাম। নির্লজ্জের মত বললাম।
মাঝেমাঝে ওরকম ঘটে যাবে। তবে কি নরটন সেদিন দুজনকেই একসঙ্গে দেখেছিল? না, না, আমার সন্তান এমন জঘন্য কাজ করতে পারে না। সেদিন কি উনি এই কথার জন্য ঘর থেকে জুডিথকে ডেকেছিলেন?
হঠাৎ আমার চিন্তা এক নতুন মোড় নিল, তাহলে কি এখন এক্স সুদুর নীহারিকা আর জুডিথ-বিয়োগান্তক ঘটনার নায়িকা? হা ঈশ্বর!
.
১৮.
এবার ইস্টবোর্নে বসে কাহিনী লিখছি। এখানে জর্জের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। পোয়ারোকে ও ভালোভাবে জানত। পোয়ারোর মৃত্যু সংবাদ দিতে দুঃখিত হল। জিজ্ঞেস করলাম, পোয়ারো কি কোনো সংবাদ রেখে গেছে তোমার কাছে?
আপনার জন্য স্যার? না তো? অবশেষে বললাম, তোমার বাবার অসুখ করলে তুমি যদি শেষ পর্যন্ত ওর কাছে থাকতে তাহলে ভাল হত।
আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার–বিস্ময়াভিভূত হয়ে আমাকে জর্জ বলল, আমাকে তো উনিই ছাড়িয়ে দিয়েছেন, আসলে আমাকে উনি চাকরী থেকে বরখাস্ত করেননি। বলেছিলেন কথা হয়েছিল, দরকার হলেই আমাকে উনি ডাকবেন।
কিন্তু কেন একাজ করবে জর্জ?
আমি ঠিক জানি না। আমি কোনোদিন প্রভুর বিরুদ্ধাচারণ করিনি। এটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। আমি ওনাকে যথেষ্ট সমীহ করতাম।
হুঁ ঠিক তাই।
স্যারের মতন লোক দ্বিতীয় দেখা যায় না। যেমন সাজগোেজ, আর ওনার গোঁফের কথা কি বলব?
আচ্ছা উনি কি গোঁরে মত চুলেও কলপ লাগাতেন?
না, চুলে কোনোদিন না। তাহলে এই বয়সে ঐ রকম চুল কালো ছিল ওর।
আসলে ধৃষ্টতা মাফ করবেন, উনি পরচুলা ব্যবহার করতেন।
একটু আহত হলাম। একজন ভৃত্য যা জানে আমি ওর নিকটতম, প্রিয়তম বন্ধু হয়ে তা জানি না। যতদূর স্যার মনে পড়ে, কারটিসকে বহাল করার সময় আমায় উনি সাময়িকভাবে চলে যেতে বলেছিলেন।
তুমি থাকতে কারটিসকে কেন কাজ দিতে যাবেন?
কিছু বলতে পারব না স্যার। হয়তো কারটিস আমার চেয়ে শক্তিমান, শুনেছি একসময় ও মানসিক হাসপাতালে সহকারীর কাজ করত।
তাহলে কি কারটিসই খুনের পর খুন করেছে? এর কথাতো আমি ভাবিনি।
.
যবনিকা
ক্যাপ্টেন আর্থার হেস্টিংস এর সংযোজন–এক আইনজীবী একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালো যে, তার মক্কেল স্বর্গীয় মঁসিয়ে পোয়ারোর শেষ ইচ্ছানুযায়ী একটি মোহরাঙ্কিত লেফাফা আপনার হাতে তুলে দিতে চাই।
এরকুল পোয়ারোর স্বহস্ত লিখিত পাণ্ডুলিপি :
প্রিয় বন্ধু আমার,
যখন তুমি এই লেখা পড়বে, তখন আমার মৃত্যুর চার মাস অতিক্রম হয়েছে, নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে, আমায়–এই সব লিখে রেখে যাওয়া ঠিক হবে কিনা! শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখলুম, লিখে যেতে হবে, কারণ কাউকে না কাউকে স্টাইলসের এই দ্বিতীয়বারের ঘটনার অন্তনিহিত গূঢ় রহস্যাবলীর সঠিক মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তবুও আমি সম্পূর্ণ অনুমান নির্ভর বিবেচনা করছি। এই চিঠি পড়া পর্যন্ত সে সময় চলে গেছে তার মধ্যে তোমার নিশ্চয়ই মনে পড়বে এমন কিছু অযৌক্তিক ধ্যান ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকবে যা এই চিঠি পড়ার পর নিজেই অনুশোচনায় পীড়িত হবে, যা ভেবেছ তা শুধুমাত্র কল্পনা বিলাসমাত্র।
কিন্তু প্রিয় আমার, তবু আমাকে বলতে হবে যে, একটু বুদ্ধি খরচ করলে নিশ্চয়ই সত্য তুমি অনুধাবন করতে পারতে। তোমার মধ্যে যে সম্ভাবনা আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি এবং তা যদি না হয়ে থাকে তার জন্য দায়ী সুকোমল এবং সব কিছুতেই নিশ্চিন্ত ভাবে সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠা তোমার এই মন।
তোমার জানা উচিত ছিল, নরটনের হত্যাকারী কে? দোষ দেব না যদি না বুঝতে পেরে থাকো বারবারা ফ্রাঙ্কলিন কিভাবে নিহত হল। কে হত্যাকারী? শেষেরটা তোমার কাছে চরম আঘাত হানতে পারে।
তবে প্রথম থেকেই শুরু করা যাক। তোমাকে আমিই স্টাইলসে ডেকে আনি, বিশেষ প্রয়োজন বলে, তোমাকে আমি আমার চক্ষু কর্ণ হতে বলেছিলাম। যদি যথার্থতা অনুধাবন করে থাকো ভালো। আমি যা যা দেখতে বা শুনতে চাই, তুমি শুধু তাই দেখবে বা শুনবে। এই ঘটনা আদ্যোপান্ত আমি ঠিক ভাবে তোমাকে বলিনি বলে তুমি অনুযোগ করেছে। কারণ আমি এক্স সম্পর্কে নিজেই বেশি অগ্রসর হতে পারিনি। এবার প্রথমে এক্স সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। তোমাকে যে বিক্ষিপ্ত ঘটনার সারসংক্ষেপ দেখিয়েছিলাম সেখানে যে ব্যক্তি অপরাধী বা অপরাধ করে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, সেই একাজ করেছে বলেছিলাম। এই এক্স তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে ছিল। তুমিই তখন সিদ্ধান্ত করে বসলে তাহলে এক্সহ এ কাজ করেছে।
কিন্তু বন্ধু একটু মন দিয়ে ভেবে দেখো, সেই ঘটনাগুলোতে এক্স এর উপস্থিতি ছাড়া অপরাধ ঘটা সম্ভব হতো না। কেবলমাত্র যদি কোনো ব্যক্তি পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে এ কাজ করে থাকে অথবা একদল অপরাধ সংক্রান্ত মামলা করে এমন ওকালতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে থাকে, তাহলেই হয়তো একজন মাত্র লোকই এই বিভিন্ন এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্ভব। এখানে আমরা একটা কৌতূহলোদ্দীপক এমন একটি ঘটনা দেখতে পাচ্ছি যার সঙ্গে তুলনা করা চলে সেই রাসায়নিক সংমিশ্রণের ব্যাপারটা, যেখানে দুটি পদার্থের মধ্যে একটি অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় যায় ফলে তার প্রকৃত চেহারাটা পাল্টে যায় একমাত্র তৃতীয় কোনো পদার্থের উপস্থিতিতে। অথচ সেই তৃতীয় পদার্থটির কোনো পরিবর্তন হয় না বা তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় না। এক্স এর বেলায়ও ঠিক এইরকম ঘটেছে।
আমার শেষ জীবনের এই অপরাধীর বুদ্ধি কলাকৌশল। সে পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ফলে, কেউ তাকে ধরতে পারছে না। রহস্য সমাধানের জন্য ওথেলোর চমকপ্রদ রেখাচিত্র দেখতে পাচ্ছি সেখানে এক্স এর সমাধান মেলে। সেখানে ডেসডেমনা, ক্যাসিও এবং ওথেলোর মৃত্যুর পেছনে ছিল ইয়াগোর চাতুরি, পরিকল্পনা, বুদ্ধিমত্তা। কেউ তাকে ধরতে পারেনি। কিন্তু তার রুমালটির জন্য সে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ল।
ঠিক এইরকম চতুরতা দেখা যায় জন ফার্গুসন নাটকের তৃতীয় অঙ্কে। যেখানে নির্বোধ কুটি জন অন্যকে অনুপ্রাণিত করছে সেই লোকটিকে হত্যা করতে থাকে সে মনে প্রাণে ঘেন্না করে। সবার মধ্যেই একটা অপরাধ বোধ কাজ করে। আমাদের এক্স এর চাতুর্য সেখানেই, যেখানে সে কাউকে হত্যা করার জন্য উত্তেজিত করছে না কিন্তু সুচতুরভাবে মনের সুকোমল বৃত্তিগুলোকে কলুষিত করে হত্যা করার একটি সুন্দর প্রবণতা সৃষ্টি করে দিচ্ছে হত্যাকারীর অন্তরে।এক্স জানে কখন কোথায় ঠিক সময়মত ঠিক কথাটি ব্যবহার করা দরকার। মনে আছে নিশ্চয়ই তোমার বেলায়ও হয়েছিল….
এবার তোমার মনে হবে অনেক সময় আমার সৎ যুক্তি পরামর্শ তোমার পছন্দ হয়নি। হ্যাঁ, বন্ধু! এটা শুনতে বিসদৃশ লাগলো, হাস্যকর মনে হচ্ছে, শুধু তাই নয় একটি দণ্ডই অপরাধ করতে যাচ্ছে কে না এরকুল পোয়ারো, যে কিনা চিরকাল মানুষের হত্যার বিরুদ্ধে লড়েছে, মনুষ্য জীবনকে স্বর্গীয় আশীর্বাদ বলে মনে করেছে–সেই আমি শেষ জীবন পর্যন্ত এই জীবন শেষ করলাম একটা নিটোল হত্যা করে! হয়তো নিজের ওপর অত্যাধিক বিশ্বাস, ন্যায়পরায়ণতাই অবশেষে আমার অন্তিম লগ্নে এমন একটি সমস্যার মুখোমুখি অমায় দাঁড় করালো। এর দুটো কারণ। এক আমার চিরকালের সাধনা নিরীহ মানুষকে রক্ষা করা, দুই যে করেই হোক হত্যা ঘটতে না দেওয়া। হয়তো দ্বিতীয় কারণটাই আমাকে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করালো। যখন ভাবছি করব, না করব না, ঠিক তখনই মিসেস লাটরেলের ঘটনাটা ঘটল….।
তখন তুমি নরটনকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছিলে। আর তোমার এ সন্দেহ মোটেই অসঙ্গত হয়নি। আমি নরটনের অতীত জীবন থেকে জানতে পেরেছি ও এক জবরদস্ত মহিলার পুত্র ছিল। ফলে হুকুম পেলে কাজ করতে ও দ্বিধা করবে না। তাছাড়া বাল্যাবস্থায় পা খোঁড়া থাকায় কোনো খেলায়ও যোগ দিতে পারেনি। বড় হয়ে একটা বীরের মতন কাজ করব–এ জিনিসটা সকলের মধ্যেই কাজ করে। কেউ কাপুরুষের বদনাম মাথায় নিতে ভালোবাসে না। যখন ছোট বেলা মৃত খরগোস দেখে নরটন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এবং ছেলেদের ঠাট্টা তামাসার পাত্র হয়েছিল, তখনও প্রতিজ্ঞা করেছিল ও এমন নির্দয়তার কাজ করে দেখাবে যাতে প্রমাণ হয় ও-কতটা নিষ্ঠুরও হতে পারে। এটা ও সারা জীবনের দ্বারা বুঝতে পেরেছিল ঠিক সময় মতো। পরিবেশ অনুযায়ী উপযুক্ত কথা যদি কারোর মনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাকে দিয়ে অনেক কিছু করানো যায়। এই ভদ্রলোকটি ধর্মকামী হওয়ায় মনের মধ্যে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা পাওয়ার একটা অতৃপ্তি ছিলই। তাই মাদকদ্রব্যের নেশার মত শিকারের সন্ধানে ঘুরে থাকেন।
যে পাঁচটি খুনের ঘটনা তোমায় পড়িয়েছি তার প্রত্যেকটিতে তিনি একই ধরনের অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি এথারিটনকে চিনতেন, এক গ্রীষ্মে তিনি রিগনের সঙ্গে থেকেছেন এবং প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন। জাহাজে ভ্রমণ করতে গিয়ে ফ্রেডা ক্লে-এর সঙ্গে সখ্যতায় আবদ্ধ হন। তিনি ফ্রেডাকে খুড়ীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলেন এবং খুড়ীর মৃত্যুতে যে তার অগাধ সুখ তাও বুঝিয়ে দেন। তারপর লিচফিল্ড পরিবারের বন্ধু হন।
এরপর আমি ওর পিছু নিই। যখন উনি নরটন পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন, তখন বিপদের গন্ধ পাই, ফ্রাঙ্কলিন পরিবারও নরটনের পরিণত কূটবুদ্ধির শিকার হন। আবার জুডিথ যখন দেখল ফ্রাঙ্কলিন নয়, এলারটনকে নিয়ে তুমি ভাবছ, তখন ও তোমাকে আরো বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিল, কারণ জুডিথ সহানুভূতি বা অনুকম্পা সহ্য করতে পারে না। তখন সুযোগ বুঝে নরটন ফ্রাঙ্কলিনকে টোপ গেলাবার চেষ্টা করল, কিন্তু সেদিকে পা না দিয়ে ফ্রাঙ্কলিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকল। তাই সুবিধে হবে না বুঝতে পেরে ও জুডিথের পঙ্গু অথর্ব মানুষের পৃথিবীতে থাকবার অধিকার নেই মতটাকে কাজে লাগিয়ে দিল। যদি বারবারা বেঁচে না থাকে তাহলে ওর আর ফ্রাঙ্কলিনের মিলনের কোনো বাধা থাকবে না।
তোমার মনে থাকবে একবার ও উচ্চস্বরে এমন কোনো কথা বলেছিল যাতে তুমি মনে করেছিলে হয়তো কর্নেল লাটরেল শুনতে পাবেন। কিন্তু ওটাকেই নরটন কাজে লাগিয়েছিল। আর বয়েড রসিয়ে যে গল্প লাটরেলকে বলেছিল ওটা আসলে নরটনের কাহিনী। এখানে নরটন বয়েডকে তার পাতা ফাঁদে জড়িয়ে দিলেন। ঐ যে গুলিটা মিসেস লাটরেলকে বিদ্ধ করল তাতে তিনি ওনাকে আহত করতেই চেয়ে ছিলেন। কারণ উনি ওনার মিসেসকে খুবই ভালোবাসতেন। তাই নরটন এখানে বিশেষ সাফল্য লাভ করল না।
এরপর তুমি ওর শিকার। তুমি এক স্নেহময়, শোকে মুহ্যমান, বিবেকবান পিতা তাই জুডিথের ব্যাপারে তোমাকে এলারটনের উপর রাগিয়ে দিয়ে একটা নিটোল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নিতে চেয়েছিল। ও এলারটনের অতীত জীবন সম্পর্কে বলে তোমাকে বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছিল ও সব মানুষের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তাই সেদিন ঢিবির পাশে মেয়েদের জামা দেখে তুমি ভেবেছিলে জুডিথ আর এলারটন। তুমি রাগের মাথায় জানতেই পারলে না যে সেদিন লণ্ডনে যাবার কথা ছিল নার্স ক্লাভেন ও এলারটনের। কারণ এলারটনের মতন পুরুষের পক্ষে একটা মেয়ে নিয়ে চলে না। সেখানে জুডিথও খেলার পুতুল মাত্র। কিন্তু জুডিথের পরের দিনের সকালের কথা শুনেই মনে করেছিলে, ও ওর মত পরিবর্তন করেছে। এটাও নরটনের একটা কূট চাল।
সেদিন তুমি ক্ষিপ্ত থাকায় এলারটনের সঙ্গে মিলিত হতে দেখে ভেবেছিলে জুডিথ কিন্তু ও ছিল নার্স ক্লাভেন। তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে টেনে এনে ও তোমাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। আর তুমি তখনই সঙ্কল্প করলে যে এলারটনকে মারা ছাড়া তোমার পক্ষে জুডিথকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
গভীরভাবে ভাবলে তুমিও বুঝতে পারবে কেন আমি জর্জকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি? কেন আমি একজন ভালো ডাক্তার ডেকে শরীর পরীক্ষা করাচ্ছি না? আসলে আমি চেয়েছিলাম এমন একজনকে পাশে রাখতে যে আমার সব কথা বিশ্বাস করবে। তুমি বিশ্বাস করেছিলে ঈজিপ্ট থেকে আসার পর আমার শরীর আরো খারাপ হয়েছে। আসলে তা নয়। ঐ পঙ্গু, অথর্ব আমার ভান মাত্র। খুঁড়িয়ে হলেও আমি দিব্যি চলাফেরা করতে পারতাম।
তাই যখন দেখলাম কারটিস নিচে, এলারটন বাথরুমে এবং তোমার অপছন্দ অনুযায়ী দরজার ফুটো দিয়ে ভেতরের সব দেখে বুঝলাম, তুমি করতে যাচ্ছে। তাই তখন কাজে নেমে গেলাম। কারটিসকে দিয়ে তোমায় ডেকে পাঠিয়ে তোমার মাথা যন্ত্রণা জেনে চকলেটের রসে ঘুমের বড়ি দিয়ে তোমায় খাইয়ে দিলাম।
তুমি আমার প্রিয়তম বন্ধু। আর ঐ জন্য তুমি ঠিকানা ফাঁসির কাঠে ঝুলবে আর, ঐ শয়তানটা দাঁত বার করে হাসবে।
আমি জানতাম এবার আমায় কাজে নামতেই হবে। কারণ আমি কবে আছি কবে নেই, তার কোনো ঠিক নেই। তাই হত্যার অপরাধবোধ আমায় চিরকাল পীড়ন করবে না।
এবার বারবারার মৃত্যুর কথা ধরা যাক, এর কারণ তুমিই যে ওর হত্যাকারী।
অবাক হয়ো না। বারবারা, জুডিথ ও ফ্রাঙ্কলিনের মধ্যে যে এক চতুর্থ কোণ বিরাজ করছে তা কেউ ধরতে পারিনি।
তাহলে শোন, বারবারা এমন কিছু সুন্দরী নয়। সতেরো, আঠারো বছর বয়সে বয়েডের শৌর্য ও প্রাচুর্য বিহ্বল করলেও ফ্রাঙ্কলিনের মত কৃতি ছাত্রের প্রস্তাবে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল। বারবারা ভাবতো জন একদিন কৃতীবিজ্ঞানী হবে কিন্তু বাস্তবে তা রূপায়িত হওয়া সম্ভব নয়। তাই যখন প্রৌঢ় বয়েডের সঙ্গে এখানে দেখা হল তখন ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যু হলে বয়েডের সঙ্গে ঘর বাঁধার এক স্বপ্ন তার মনে এল। এখানেও নরটন উপস্থিত।
আসলে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন নিজের মৃত্যুর কথা বললেও, মনে মনে চাইতেন কি করে জনকে শেষ করা যায়। তাই ছল করে উনি জানালেন কিভাবে প্রয়োজন হলে উনি নিজের উপর পরীক্ষা চালান। আমাদের বোঝা উচিত ছিল জনের জন্যই আসলে উনি এভাবে মরণফাঁদ পাতছিলেন। তাই তাড়াতাড়ি কাজটা সারতে চাইছিলেন কারণ, জীবনের আরো বেশি দিন বাকি নেই। ওদিকে নার্স ক্লাভেন জনকে মোহিত করতে চাইছিলেন। কিন্তু জন অন্য ধাতের মানুষ হওয়ায়, ক্লাভেন বয়েডকে তখন আকর্ষণ করল। এইজন্যই বারবারা আরো মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
তাই একদিন কফির আসর ঠিক করে নিজের পেয়ালা কাছে রেখে, জনের পেয়ালাটা রাখলেন বুক সেলফের পাশে। হঠাৎ ধূমকেতু দেখার ধাঁধায় তুমি বুক সেলফ থেকে ছন্দ মেলাতে শেক্সপীয়ার তুলে নিলে। কিন্তু ছন্দ পতন ঘটল। ফলে দুজনের কফি বদল হয়ে যায় এবং অপরাধীই বিষাক্ত পানীয় পান করে।
কিন্তু মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যু আত্মহত্যা না হয়ে অন্যরকম ভাবে হলে জুডিথের ঘাড়ে চাপত। কাজেই বাধ্য হয়ে আমাকে সাক্ষ্য দিতে হল আত্মহত্যা। কিন্তু এই আত্মহত্যা বলে প্রমাণিত ঘটনাটাতে নরটন একমাত্র খুশী হয়নি। যখন বুঝলেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তখন এক নতুন পথের সন্ধান করছিল। তাই ফ্রাঙ্কলিন ও জুডিথকে ডেকে অশান্তির ভয়ে তখন তা চেপে গিয়েছিলেন। এটা প্রকাশ হলে বারবারার মৃত্যু নতুন ভাবে হত্যা কিনা প্রমাণ করার ভাবনা শুরু হত।
তাই অবস্থা বুঝেই আমি তোমার মারফৎ নরটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই। সেদিন সাক্ষাতে আমি ওকে ওর সব পরিচয় জানিয়ে দিলাম, ও অস্বীকার করল না এতে। বললাম আসুন আমরা একসঙ্গে বিষপান করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিই। কিন্তু মুচকি হেসে বললেন, আমি আপনার জন্য নির্দিষ্ট কাপটিই বেছে দিতে চাই। আপনার আপত্তি আছে। আপত্তি জানালাম না। কারণ দীর্ঘদিন ঘুমের ওষুধ পান করার ফলে ধীরে ধীরে আমার প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠেছে, তাই নরটন আমার পাত্রটি ও আমি ওর পাত্রটি পান করলাম। আমার পাশেই হার্টের স্ট্রাইপ নাইন টনিক থাকে যা ঘুমের ওষুধের বিষময় ফল সময় মত নিলে নষ্ট করে দিতে পারে।
নরটনের প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল। আমি ঠিক যে ভাবে বসে জানলা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখতাম সেভাবে ঐ জায়গায় ওকে বসিয়ে দিই। কারটিস আমি ভেবে ওকে শুইয়ে দেয় যেহেতু আমার পরচুলা ও গোঁফটি নকল বলে হয়তো। কারটিস চলে যেতে নরটনের মতন পোষাক চাপিয়ে সাদা চুল, গোঁফ নিয়ে সোজা ওর ঘরে চলে যাই। তোমার খুঁটিয়ে দেখার সময় নেই বলে আমাকে বুঝতে পারনি।
এবার সবার থেকে লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা কাজে লাগিয়ে ওর রাতের পোষাক পরিয়ে শুইয়ে দিলাম। আর ওর হাতে পিস্তল ও পকেটে চাবিটা দিলাম। নরটনের পিস্তল আছে জানলেও আমার পিস্তল আছে, একথা জর্জও জানতেন না।
আসলে আমি খেলিয়ে খেলিয়ে নরটনকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম। অবশেষে তাকে আমি হত্যা করেছি কিন্তু তাকে কোনো আঘাত বা কষ্ট দিইনি। তাই গভীর নিদ্রায় ওকে হত্যা করেছিলাম। তোমার বোঝা উচিৎ ছিল।
এবার বলি যদি জুডিথ ফ্রাঙ্কলিনকে বিবাহ করে তাহলে ওরা সুখী হবে, তুমি ওদের বাধা দিও না। আর এ কাহিনী পড়া শেষ হলে সোজা মিস কেলির কাছে চলে যাবে, ও লিচফিল্ড। বলো, ওর পিতার খুনী ওর বোন নয় নরটন।…একবার পুলিশে চাকরীর সময় একজনকে গুলি করে হত্যা করেছিলাম যে ছাদে বসে এক নিরীহ পথচারীকে, অবিশ্রান্ত গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল।…. তাই ঐ ভাবেই নরটনকে হত্যা করে নিরীহ মানুষের প্রাণ বাঁচালাম।….
শেষে বলি আমি ইচ্ছে করেই হার্টের ওষুধের শিশিটা ফেলে দিয়েছিলাম যাতে জীবনের লোভ এসে আমার চিরকালের সকর্মকে কলঙ্কময় করে দেয়।
সেসব কত সুখ স্মৃতিময়…।
হ্যাঁ। কত স্মৃতি বিজরিত মধুর সব দিন
(এরকুল পোয়ারোর স্মৃতিচারণ এখানেই শেষ।)
ক্যাপ্টেন আর্থারের শেষ সংযোজন….
হ্যাঁ, পোয়ারো ঠিকই বলেছে। গুলির চিহ্ন… সুন্দর সামঞ্জস্য….এগুলো দেখে আমার জানা বা বোঝা উচিত ছিল।
আশ্চর্য! এতদিন পরে সে দিনের কালো যবনিকা সরে গেল চোখের সামনে থেকে….সেই চিহ্ন! নরটনের কপালের ঠিক মাঝখানে যে ক্ষতচিহ্ন….সে তো আর কিছু নয়…কেন্টনের পরশ ছোঁয়া চিরন্তন এক কলঙ্কচিহ্ন!….