- বইয়ের নামঃ কার্টেন
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
কার্টেন
১. পুরনো কোনো অভিজ্ঞতা
০১.
পুরনো কোনো অভিজ্ঞতায় কে না উদ্বেল হয়ে উঠবে। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে যাবে পূর্বে যা ঘটেছিল…অথবা কি করেছিলাম…।
অতীতের এই মন চঞ্চল করার কারণ কি জানে?
এসেকসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম। আর আমার সেই উদাস চোখের সামনে দিয়ে সবুজের সমারোহ একের পর এক সরে যাচ্ছে। ট্রেন তার আপন ছন্দে-তালে ছুটে চলেছে।
বহুযুগ পূর্বে একদিন এমনই এক ট্রেনে চেপে এই একই পথে আমি গিয়েছিলাম এক পথিকের ন্যায়। তার হিসেবে এখন আর নেই। সেই স্মৃতি শুধু বুকের ব্যথা বাড়ায়। তখন বেশি চঞ্চল হয়ে উঠি। জীবনের সেই সুমধুর, মহান অভিজ্ঞতা–চাওয়া, পাওয়ার সেইসব দিন ঝোড়ো বাতাসের মত উড়িয়ে নিয়ে যায়।
মনে পড়ে ১৯১৫ সালের সেই দিনগুলি। যুবা আর্থার হেস্টিংস নিজেকে তখনই জ্ঞানবৃদ্ধ ভাবতে শিখে গিয়েছিল। যুদ্ধ প্রত্যাগত আর্থার হেস্টিংস কী এখন তেমনই আছে? কিন্তু যখন নিজের বর্তমান চেহারা ভেসে ওঠে তখনই সব ভুল ভেঙে যায়। এখন সূর্যাস্তের মত আমার সেই সৌন্দর্য অস্তমিত, মহাসিন্ধুর ওপারের ডাকে যে কখন সাড়া দিয়েছি খেয়ালই থাকে না। কিন্তু এই চিরন্তন নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। তবুও সেই সুখস্মৃতি আমাকে পিছনে টানে–কেন? যেতে নাহি দিব” বলে যেন টেনে ধরে রাখতে চায় আমাকে। আর এরই টানে ভেসে ওঠে ক্যাভেণ্ডিস-আমার প্রিয় বন্ধু। ওর হাতেই আমার জীবনের শুরু–সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি। যে মাটিতে সে শুয়ে আছে চিরকালের মত সেই টান কী অত সহজে মুছে যাবার। শুনেছি ক্যাভেণ্ডিসের মা-র পুনরায় বিবাহ হয়েছে– বাড়ি কিনেছেন স্টাইলস-এ।
স্টাইলস! আহ! ভাবতেই যেন শিরা-উপশিরার রক্ত কণিকা হাওয়ায় দুলে ওঠে। রোমাঞ্চিত, পুলকিত…. আরো কী সব আছে এই স্টাইলসে। তাকে ভোলা যায় না। তার স্মৃতি আজও মনের মণিকোঠায় জীবন্ত হয়ে আছে। সে কে? কার স্মৃতি? কার আবার? এরকুল পোয়ারো। –আহা! দেহে মনে রোমাঞ্চ জেগে ওঠে। এখন এরকুলই আমার নিকটতম বন্ধু। বেলজিয়ামে ওকে প্রথম চিনেছিলুম, স্টাইলসে তার প্রকৃত স্বরূপটি দেখে এক নতুন পৃথিবীর দ্বারা আমার মনের মলিনতা আলোকের ঝরণা ধারায় এখানেই তো ধুইয়ে দিল। তাই স্টাইলস শুধু একটি নামমাত্র আমার কাছে নয়, এ যেন বহু পথ পরিক্রমার পর এক তীর্থক্ষেত্র।
পূর্বের স্মৃতিগুলো সেলুলয়েডে যখন ভেসে যাচ্ছিল একের পর এক তখন বুঝতেও পারিনি এখানে একটা হত্যা রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়ব। অথচ এই রকম এক রহস্যময় হত্যার মধ্য দিয়েই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু এরকুল পোয়ারোকে পেয়েছিলুম। আর সেই সঙ্গে পেয়েছিলুম তার জীবন সঙ্গিনীকে। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে–হ্যায়। সেই দিন কী আর ফিরে আসবে কোনোদিন?
চতুর্দিকে শুধু পরিবর্তন আর পরিবর্তন আমার প্রিয়তমাশ্রী আর্জেনটিনার নরম মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত। জন ক্যাভেণ্ডিস মারা গেলেও তার জীবিত স্ত্রী মেরী আছে এখন ডেভনশায়ারে। লরেন্স ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকায়। সত্যি! সবকিছুর কী পরিবর্তন! যদি ফিরে আসত সেই উনিশশ ষোল সাল। কিন্তু সে কী আর ফিরবে? পুরানো কথার মধ্যে মনে হয় আর সে সব জেগে উঠবে না।
কিন্তু একটা কথা ভাবলে রোমাঞ্চিত হই যে পুরানো দিন থাক বা না থাক, আমি, স্টাইলস, এরকুল পোয়ারো–আমারা তো আছি। যেদিন পোয়ারোর চিঠি পেলাম সেদিন যেন পাগলের ন্যায় আনন্দে উন্মাদ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। সব প্রভাতের সূর্যোদয়ের মত ঝলমল করছিল। সত্যি বলতে কী, সেই ঠিকানা, স্টাইলস কোর্ট, স্টাইলস এসেক্স প্রেরকের নামের পাশের দেখেই উদ্দাম উত্তাল হয়ে উঠে এক বিরল আচ্ছন্নতায় আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলুম। আমার শিরা-উপশিরায় যে নাম মিশে আছে, সেই নাম আমায় দোলা দেবে এটাই তো স্বাভাবিক।
বিগত একবছর আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। শেষবারের মতন যখন তাকে দেখেছিলুম তখন মনটা শুধু যন্ত্রণায় টন্ করেই ওঠেনি। আঘাতও পেয়েছিলাম। আসলে আমি ওকে অন্য চোখে দেখতাম, ভাবতাম। কিন্তু সেদিন জরাজীর্ণ কুজ বৃদ্ধ পোয়ারোকে দেখে আমার সব কল্পনা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। পুরানো যাইটিস রোগে ও এখন পঙ্গু ও অথর্ব। শুনেছিলাম ঈজিপ্টে গিয়েছিল হৃত স্বাস্থ্য উদ্ধারে, কিন্তু তার বিন্দুমাত্রও দেখতে পেলাম না। এবার চিঠিতেও সেই কথা। যদিও প্রগতা ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে তবুও স্বাস্থ্যের উন্নতি তেমন কিছু নেই।
এবং যে ঠিকানা থেকে চিঠিখানা পাচ্ছ তা দেখে নিশ্চয়ই তোমার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে। ঠিক নয়? সেই স্টাইলস। হাঃ হাঃ। ফেলে আসা দিনগুলো হুড়মুড় করে ছুটে এসে তোমায় নিশ্চয়ই চাবকে দিচ্ছে। আর ঘুরে ফিরে আমিও এসে উঠেছি সেই স্টাইলসে। তবে বন্ধু স্টাইলসের সেই বাড়ি আর নেই। এখন একে বলতে পারো এক পান্থশালা। ভারতবর্ষ আর মুনার কথা তোমার মনে পড়ছে নিশ্চয়ই। সেই সময়কার তোমার এক বন্ধু এখন এর মালিক। খুব ভালো… খুব ভালো তবে কী জানো তোমার এই কর্নেল বন্ধুটির অবস্থা দেখে আমার হৃদয় মথিত হয়। আসলে তার স্ত্রীই প্রকৃত মালিক। হায় কর্নেল! অনেক ভাগ্যে এমন একটি স্ত্রীরত্ন জুটেছে তার কপালে। জিভ তো নয় শানানো ছুরি। কেঁচো হয়ে থাকেন তোমার কর্নেল বন্ধু। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই কর্নেলের জায়গায় যদি আমি হতাম তবে কোনোদিন না জানি কাস্তের এক কোপ বসিয়ে দিতাম তার গলায়।