পোয়ারো ঈষৎ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, মিঃ শ্যাতানা সেদিন ডিনার টেবিলে যে উক্তি করেছিলেন সেটা কি আপনাকে উদ্দেশ্য করে?
হ্যাঁ, মিঃ শ্যাতানা সেদিন যে বলেছিলেন, মেয়েদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে বিষ, একথা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা।
এ ঘটনা তিনি জানতেন। কখন আপনি তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন?
সিদ্ধান্ত কখন মাথায় এল স্মরণ করা শক্ত, তবে ডিনারে বসবার আগে ছোরাটা আমার নজরে এল কিন্তু ডিনারের পর সবার অলক্ষ্যে ছোরাটা লুকিয়ে রাখলাম। তারপর ব্রীজের আসর বসলো। অবশেষে সুযোগ এসে উপস্থিত হলো। উঠে দাঁড়ালাম। তখন আমি ডামি, ইতস্তত পায়চারি করবার অছিলায় ফায়ারপ্লেসের কাছে হাজির হলাম। শ্যাতানা তখন চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। আমি অন্যদের দিকে তাকালাম, সকলেই তাস খেলায় ব্যস্ত সুতরাং এ সুযোগ হাতছাড়া হতে দিলাম না।
সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তার হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে ছুরি চালালাম। তারপর সন্দেহের হাত থেকে বাঁচবার একটা অজুহাত খুঁজে একটা মন্তব্য ছুঁড়ে দিলাম।
তিনি কি সেসময় কোনো চিৎকার করে ওঠেননি?
না, কেবলমাত্র গলা দিয়ে মৃদু ঘড় বড় শব্দ বেরিয়ে এল।
তারপর আমি আবার ব্রীজের টেবিলে ফিরে গেলাম তখন সেখানে শেষ তাসটা খেলা হচ্ছে।
উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলেন পোয়ারো, চমৎকার, অভূতপূর্ব। এইরকম বিপজ্জনক ঝুঁকি আপনি নিলেন, এবং আশ্চর্যভাবে সাফল্য লাভ করলেন।
মিসেস লরিমার ঠোঁটে একধরনের বাঁকা হাসি বিচ্ছুরিত হলো। আপনি ঠিকই বলেছেন। আরও একটা কথা, আমি অসাধু প্রকৃতির মহিলা নই তাই আমার কৃতকর্মের ফলে কেবল মিঃ শ্যাতানাকেই জীবন থেকে বঞ্চিত করলাম তা নয়, অপর তিনজনের জীবনও দুর্বিপাকের মধ্যে টেনে আনলাম। তাই ঠিক করলাম আমার স্বীকারোক্তির ফলে তারা অন্তত রাহুমুক্ত হবে। ঘরের মধ্যে আবার থমথমে নীরবতা নেমে এলো।
পোয়ারো অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বললেন, এই হত্যা যদি পূর্বপরিকল্পিত না হয় তাহলে এ খুন আপনার দ্বারা আদৌ সাধিত হয়নি।
মিসেস লরিমা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলেন, আপনি সত্যই বদ্ধ উন্মাদ। আমি যখন স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিচ্ছি তখন কিভাবে এটা মিথ্যা হয় আর তাছাড়া আমার এতে স্বার্থই বা কি?
আমাকে মিথ্যা বলে লাভ নেই ম্যাডাম, আপনি অপরাধের বোঝা নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে অল্পবয়সী মেয়েটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন। সে আর কেউ নয়–তিনি হচ্ছেন অ্যানা মেরিডিথ।
আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন, মিসেস লরিমা শুষ্ককণ্ঠে বললেন, আমিও একজন নিরপরাধ মহিলা নই। অনেক বছর আগে আমি নিজে হাতে আমার স্বামীকে খুন করেছিলাম।
পোয়ারো নীরবতার মধ্য দিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করার পর বললেন, খুনটা সর্বদাই খুনই, আপনার সাহস আছে, আপনার দৃষ্টিশক্তিও খুব স্বচ্ছ।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিসেস লরিমা। পোয়ারোর দৃঢ়তায় প্রতিরোধ ক্ষমতার শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত তার দেহ থেকে অপহৃত হয়ে গেছে। তার কণ্ঠস্বর সরল শিশুর মত শোনালো।
.
২৭.
পোয়ারো আচমকা হেসে উঠলেন, হাসতে হাসতেই বললেন, এই হত্যার ব্যাপারে এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী থেকে গেছেন, যার চোখের সামনেই এই রহস্যময় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
তখন বেশ রাত হয়েছে, অ্যানা মেরিডিথ ছিলো ডামি, ঘরের ভেতর ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগলো। তাসটা তেমন ঘোরপ্যাঁচের নয় তাই খেলার দিকে আমারও মন ছিলো না, খেলাটা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এমন সময় মিঃ শ্যানার দিকে আমার নজর গেলো। অ্যানা মেরিডিথ শ্যানার চেয়ারে ঝুঁকে পড়ে কি যেন করছে। তার হাতটা ভদ্রলোকের বুকের উপর ন্যস্ত। চোখেমুখে ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। চকিত দৃষ্টিতে সে একবার আমার দিকে ফিরে তাকালো। সবই বুঝতে পারলাম।
পোয়ারো গম্ভীর ভাবে বললেন, আপনি যে দেখে ফেলেছেন ও সেটা নিশ্চয়ই জানে না।
আহা বেচারী, সমবেদনায় আর্ত হয়ে উঠলেন মিসেস লরিমা। আগে আমি এত সংবেদনশীল ছিলাম না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে এসব অভ্যাস জন্ম নেয়।
পোয়ারো বললেন, সংবেদনশীল কথাটা বেশ শ্রুতিমধুর। উচ্চারণও বেশ গালভরা। তবে ম্যাডাম সেদিন অ্যানা মেরিডিথ কেন মিঃ শ্যাতানাকে খুন করেছিলো জানেন?
বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকালেন মিসেস লরিমা, এসব কি সত্যি মিঃ পোয়ারো?
এর সত্যতা সম্বন্ধে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
মিসেস লরিমা কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ করে বলে উঠলেন, আমি কিন্তু আজকের এইসব কথাবার্তা একেবারে অস্বীকারও করতে পারি। মনে রাখবেন আপনার কোনো সাক্ষী নেই।
পোয়ারো সরল সুরে তাকে আশ্বস্ত করলেন, কোনো ভয় নেই ম্যাডাম। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। গভীর আন্তরিকতায় তিনি মিসেস লরিমার দুহাত চেপে ধরলেন। তারপর করমর্দন করে কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন, আপনার প্রতি আমার সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি রইলো। আমি এখন বিদায় নিচ্ছি। বলে তিনি এগোতে লাগলেন। বেশ কিছুটা এগিয়ে আসবার পর একবার ঘাড় ফিরিয়ে পেছনদিকে তাকালেন। কেউ যেন মিসেস লরিমার বাড়ি প্রবেশ করলেন। তিনি একবার ভাবলেন ফিরে যাবেন কিন্তু তা না করে হেঁটে চললেন ধীরে ধীরে।
নিজের বাড়িতে ফিরে এসে দেখলেন, মিঃ ব্যাটেল বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তার জন্য কোনো খবর রেখে যাননি।