তারপর সেই নারকীয় রাত্রি। জন আর টিমোথি দুজনে ঝগড়া করছিল। আমি তাবু থেকে বেরিয়ে এলাম…। দেখলাম সে তখন প্রচণ্ডভাবে জনকে শাসাচ্ছে অবশেষে জন গুলি চালালো। একটা গুলির আঘাতেই টিমোথি মারা গেল। সেদিনের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না।
সমস্তই জনকে বুঝিয়ে বললাম যে এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গ কেউ না জানতে পারে; তাহলে লোকনিন্দা, পুলিসী ঝামেলা অনেক কিছু হতে পারে। সুতরাং টিমোথি তখন জ্বরে ভুগছিলো তাই সবাইকে বলা হলো যে টিমোথি জুরে মারা গেছে। আমাজনের তীরে ওকে কবর দেওয়া হলো। নীরব হয়ে গেলেন মিসেস ল্যাক্সমোর। চোখের কোণে মুক্তোর মতো দু ফোঁটা জল টলটল করছে।
পোয়ারো আবার কথা শুরু করলেন। আপনার ইতিহাস খুবই করুণ।
মিসেস ল্যাক্সমোর বললেন, মিঃ জন আত্মরক্ষার জন্যই এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সব দিক বিচার বিবেচনা করে আপনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন, টিমোথি যে জুরে মারা গেছে সেই কথাটাই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়া সর্বতোভাবে শ্রেয়। মিসেস ল্যাক্সমোর এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
পোয়ারোও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে বললেন, ম্যাডাম, এমন মহান আত্মোৎসর্গের কোনো প্রয়োজন দেখি না। এই করুণ ব্যাপারটা যাতে বরাবর গোপন থাকে সেটা আমি চেষ্টা করবো। বিদায় ম্যাডাম।
৩. ক্রম্পটন রোড
২১.
পোয়ারো এখন ক্রম্পটন রোড দিয়ে হাঁটছেন। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ঘড়ি বার করলেন। এখনও সময় আছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে কোনো ক্ষতি হয় না।
পোয়ারো এদিকে গান গাইতে গাইতে দ্রুত এগিয়ে চললেন। হঠাৎ একটা স্টেশনারী দোকানে ঢুকলেন সিল্কের মোজা কিনতে। তরুণী সেলসলেডী বললেন, আসুন আসুন মোজা খুঁজছেন? এখানে ফরাসী দেশের তৈরি সিল্কের মোজা আছে।
পোয়ারো বললেন, এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু আমি আরো ভালো উৎকৃষ্ট জিনিষ চাইছি। এর সমস্তটাই ভালো সিল্কের তৈরি। ঠিক আছে আমাকে উনিশ জোড়া মোেজা ভিন্ন ভিন্ন রঙের দিন।
মিঃ পোয়ারো, সাড়ে সাঁইত্রিশ শিলিং একটা মোজার দাম সুতরাং উনিশ জোড়া মোজার দাম আপনি দেবেন আমাকে, তরুণী সেলসলেডী বললেন।
বাড়িতে পৌঁছবার পর সবে আধঘণ্টাও অতিবাহিত হয়নি। এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠলো। অনতিবিলম্বে মেজর ডেসপার্ড এসে প্রবেশ করলেন। তার চোখেমুখে ক্রোধের স্পষ্ট ছায়া। ভদ্রলোক যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছেন।
কি উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি মিসেস ল্যাক্সমোরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? ঘরে পা দিতে না দিতেই ক্রুদ্ধ প্রশ্ন করলেন ডেসপার্ড।
পোয়ারো মৃদু হেসে বললেন-অধ্যাপক ল্যামোরের মৃত্যুরহস্যের প্রকৃত তথ্য আপনি আমার কাছেই পাবেন।
মেজর ডেসপার্ড কণ্ঠে কুদ্ধ ব্যঙ্গের ঝাঁঝ, প্রকৃত তথ্য আপনি আমার কাছেই পাবেন।
মেজর ডেসপার্ড অল্প থামলেন, তারপর আরম্ভ করলেন তার কাহিনী। অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের অভিযানের ব্যবস্থা আমিই করি। কিন্তু সারা অভিযানটাই আমার কাছে বিরাট এক দুঃস্বপ্ন। মিসেস ল্যাক্সমোরের প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা ছিল না। কিন্তু ভদ্রমহিলা আমার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, এইসব কারণে আমার খুবই অস্বস্তি হতো।
যা হোক, প্রথম দু সপ্তাহ একরকম ভালোয় ভালোয় কেটে গেলো। তারপর আমরা তিনজনেই জুরে পড়লাম। এবং কিছুদিনের মধ্যে ভদ্রমহিলা এবং আমি সেরে উঠলাম কিন্তু অধ্যাপকের জ্বর বেড়েই চলল। এই জ্বরের ঘোরে টলতে টলতে একদিন অধ্যাপক নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে বেহুঁশ হয়ে এইসব করছেন অল্প সময়ের মধ্যে আমি বুঝতে পেরে ভদ্রলোকের চলার গতি রোধ করতে চাইলাম গুলি করে। ভদ্রমহিলা কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে বাধা দিলেন, দোহাই আপনার আমার স্বামীকে যেন গুলি করবেন না। তিনি এমনভাবে হাত টেনে ধরলেন যে নিশানা ভুল হয়ে গুলি সোজা পিঠে গিয়ে বিধলো।
ভদ্রলোক মারা গেলেন। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, ভদ্রমহিলা ভাবলেন আমি তার প্রেমে পড়ে মিঃ ল্যাক্সমোরকে খুন করেছি। শেষে তিনি আমাকে বললেন, লোক জানাজানির প্রয়োজন নেই, ভদ্রলোক জুরে মারা গেছে বলে প্রচার করলেই হবে। অবশেষে তাকে আমরা নদীর ধারে কবর দিলাম। তারপর থেকে অনেকবারই আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ঘটেছে কিন্তু আমি তাকে সভয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।
মেজর ডেসপার্ড শান্ত কণ্ঠে বললেন, এই হচ্ছে আমার কাহিনী।
পোয়ারো গভীর মনোযোগ সহকারে সমস্তটা শুনে ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন, কাহিনীটা আপনার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক বিশেষ করে শ্যাতানার মত লোক যখন এর সন্ধান পেয়েছিলেন।
ডেসপার্ড অবহেলা ভরে মাথা নাড়লেন, আমি শ্যাতানাকে ভয় পাই না।
পোয়ারো কোনো জবাব দিলেন না। এবার উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের অভিপ্রায় নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, তারপর বললেন, আপনার ঘটনাটা হয়তো এইরকমই ঘটেছিলো।
ডেসপার্ডের মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অসংখ্য ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতায় দুহাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।
.
২২.
ইনসপেক্টর হার্পার সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেলকে বললেন, এই হচ্ছে স্যার প্রকৃত ঘটনা। এর মধ্যে কোনো ধোঁয়াটে ভাব নেই। সরকারি ডাক্তারও সন্তুষ্ট চিত্তে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। কারও মনে কোনো অসন্তোষ ছিল না।
এই বোতল দুটো সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য খুলে বলুন। আমি সমস্তটা বিশদভাবে জানতে চাই।