খাবার টেবিলে বসে সবার দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। যদি পোয়ারোর মস্তিষ্ক বিকল না হয়ে থাকে তাহলে উপস্থিত এই সব মানুষগুলোর মধ্যেই খুনীও উপস্থিত। যদিও খুনী পুরুষ না মহিলা তা জানতে পারিনি। তবু অনুমান করতে পারি সে আমারই শ্রেণীভুক্ত।
খাবার ফাঁকে ভাবি নিশ্চয়ই বুড়ো লাটরেল নয় যেরকম দুর্বল আর সদাশিব মানুষ। নরটন, এরকম অস্থির মস্তিষ্কের যেরকম কিন্তু গ্লাস নিয়ে ছুটোছুটি করছিল। বয়েড ক্যারিংটন খ্যাতনামা ব্যক্তি, তার পক্ষে খুনীটুনী সাজা মানায় না। ফ্রাঙ্কলিন ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কারণ জুডিথ যেভাবে তার সঙ্গে মেলামেশা করে, তাহলে ও নিশ্চয়ই কোনো আঁচ পেত। মেজর এলারটনের চেহারার মধ্যে একটা মারকুটে ভাব আছে। দরকার পড়লে নিজের ঠাকুমার চামড়া ছাড়াতেও পিছপা হবে না। আর মেয়েদের সঙ্গে যেভাবে মেলামেশা করে, একটা সুন্দর অজুহাত তাতেই তৈরি করে নেয়া যায়।
পোয়ারোর কথানুযায়ী যদি এলারটনই এক্স হয়, তাহলে ওর নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। যারা মেয়েদের মধ্যে বেশি আনাগোনা করে, তাদের বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পোয়ারো তো জানায়নি এক্স পুরুষ না মহিলা? তাহলে কি মিস কেলি? বেশ চাপা স্বভাবের, একটা কাঠিন্য চেহারার মধ্যে আছে। এই টাইপের মহিলারা ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারে, কিন্তু খাবার টেবিলে ওনার হাসিখুশী মেজাজ দেখে তা মনে হয় না। মিসেস লাটরেল, জুডিথ বা মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ওদের কী খুনী ভাবা যায়?
উদ্ৰান্ত ভাবে ড্রয়িংরুমের জানলা দিয়ে বাইরের বাগানটা দেখতে দেখতে বহুযুগ আগের দিনগুলো মনে পড়তে লাগল। মনে পড়ল সিন্থিয়া মারকরকে, তার পাগলামী সোনালী চুল যেন ধানের শিসের মত হাওয়ায় দুলছিল। সেইসব স্মৃতি আজও আমায় বিচলিত, আনমনা করে…..।
জুডিথ পাশে এসে কী ভাবছ বাবা যখন বলল তখন ঘোর কাটল। বলল, খাবার টেবিলে অত চুপচাপ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কি দেখছিলে? সর্বনাশ, তাহলে কি ও টের পেয়ে গেল। বললাম, কই না তো। হয়তো পুরনো স্টাইলসের ছবি সবার মধ্যে দেখতে চাইছিলাম। ওঃ, ভুলেই গিয়েছিলাম যুবা অবস্থায় তুমি এখানে ছিলে। আচ্ছা বাবা তখন এক বৃদ্ধা মহিলা এখানে খুন হয়েছিলেন না?
বললাম, হ্যাঁ, কেউ মারাত্মক বিষ তাকে দিয়েছিল।
ওকে দেখতে কেমন ছিল কুশ্রী না সুন্দরী?
ঠিক অতটা মনে নেই। তবে মহিলা বেশ দানশীলা ছিলেন, অন্তকরণও ভালো ছিল।
শ্লেষের সঙ্গে বলল, ও-দয়াবতী! আমি ভাবলাম না জানি কী। আন্তরিকভাবে তার পর বলল, আচ্ছা, তখনকার সব মানুষরা সুখী ছিলেন, না বাবা?
একটু আহত হলাম ওর প্রশ্নে। বললাম, মোটেই না।
বলল, কেন?
কারণ আছে। সবাই ভাবত, এখানে তারা বন্দী জীবনযাপন করছেন যেমন মিসেস ইঙ্গলথর্পপ, সেই দানশীলা মহিলা, অর্থের উপর কোনো ক্ষমতা ছিল না। তার যে সব সৎ ছেলেমেয়েরা ছিল তাদের নিজেদের ইচ্ছেমত অর্থকড়ি ব্যবহারের অধিকার ছিল না।
জুডিথ তিক্ত কণ্ঠে বলল, এইসব বুড়োবুড়িরা যে নিজে নিজেদের কী ভাবে? এইরকম একজন স্বার্থপর বদমেজাজী একজনকে আমি চিনি।
কার কথা বলছ?
উনি হলেন ফ্রাঙ্কলিনদের জানাশোনা এক ভদ্রলোক, লিচফিল্ড।
নামটা শুনেই চমকে উঠলাম।
ও আমার দিকে লক্ষ্য না করেই বলল, ভদ্রলোক ধনী হলেও নিজেদের মেয়েদের সঙ্গে কসাই-এর মতন ব্যবহার করত। কাউকে কানাকড়িও দিত না।
তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, তখন তার বড় মেয়ে তাকে খুন করল।
জুডিথ অবাক হয়ে বলল, খবরটা তাহলে তুমি পড়েছ। এর পেছনে ছিল না কোনো ঈর্ষা, শুধুই একটা ব্যক্তিগত পারিবারিক, ঘটনা। মার্গারেট লিচফিল্ড থানায় বলল সে তার বাবাকে খুন করেছে। সাহস ছিল, আমি হলে পারতাম না।
নিরাসক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কোনোটা পারতে না? খুন করা না, থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করা?
কোনোটাই নয়।
শুনে খুশী হলাম। ফ্রাঙ্কলিন কী বলে?
উনি বলেন-এ ঠিকই হয়েছে, পৃথিবীতে কেউ কারুর নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়।
শঙ্কিত ভাবে বললাম, জুডিথ এ মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। কে তোমার মাথায় এসব ঢোকাচ্ছে?
জুডিথ ভুরু নাচিয়ে বলল, কেউ না?
এসব আলোচনা মানসিক ও শারীরিক দুদিক থেকেই ক্ষতি করে। জুডিথ কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, যেটা বলতে এলাম; মিসেস ফ্রাঙ্কলিন তোমায় একবার দেখতে চান।
খাবার টেবিলে ওনাকে দেখতে না পেয়ে খারাপ লাগছিল, নিশ্চয়ই দেখা করব। ন্যাকামো, দুচোখে দেখতে পারি না, ঠোঁট বেঁকিয়ে জুডিথ কথাটা বলল।
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছোটরা এতও হৃদয়হীন হয়?
.
০৫.
যখন বয়স তিরিশ-ফিরিস তখন মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। ম্যাডোনার মত মুখশ্রী, উজ্জ্বল বাদামী চোখ, মাঝখানে সিৗথ কেটে চুল আঁচড়ানো, রোগা স্বচ্ছ মসৃণ কাঁচের মত চেহারা। বিছানায় বালিশ নিয়ে শুয়েছিলেন, ঈষৎ নীলাভ পাতলা গাউন পরে।
ডঃ ফ্রাঙ্কলিন ও বয়েড ক্যারিংটন একপাশে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আমি ঢুকতেই উনি উঠে অভ্যর্থনা করলেন। আপনি এসেছেন শুনে বেশ আনন্দ হচ্ছে। জুডিথও খুশি হবে। বড্ড বেশি খাটুনি যাচ্ছে ওর।
খাটের পাশে শূন্য চেয়ারে বসে বললাম, মনে হল এখানে ও বেশ ভালো আছে।
বারবারা ফ্রাঙ্কলিন একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, হয়তো আপনার কথা ঠিক। তবে ঠিক বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে ওকে ভীষণ হিংসে হয়। ও সুস্থ সুখী বলেই হয়তো অসুখটা কী, বুঝতে পারে না। তবে আমাকে চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনার জন্য নার্স-ক্লাভেন আছে। আসুন পরিচয় করিয়ে দিই। আমাকে ও সারাক্ষণ বাচ্চা মেয়ের মত আগলে রাখে।