- বইয়ের নামঃ অথৈ সাগর ১ (প্রথম খণ্ড)
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প, অ্যাডভেঞ্চার
অথৈ সাগর ১ (প্রথম খণ্ড)
১
দেয়ালে ঝোলানো বিশাল একটা ম্যাপ দেখছিলেন মুসার বাবা রাফাত আমান, প্রশান্ত মহাসাগরের, শব্দ শুনে ফিরে তাকালেন।
ও, এসে গেছ, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন তিনি। মাত্র আধ ঘন্টা আগে মুসাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন কিশোর আর রবিনকে, হাজির হয়ে গেছে। কোন রকম ভূমিকা না করে ছুঁড়ে দিলেন যেন প্রশ্নটা, দক্ষিণ সাগরে যেতে চাও?
বাবাআ! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। সত্যি বলছ!
মাথা ঝাঁকালেন রাফাত আমান। বললেন, আমাজান থেকে জন্তুজানোয়ার ধরে এনে ভালই কামিয়েছি, জানোই তো। আবার কিছু অর্ডার পাওয়া গেছে। ডেভিড লিসটারের নাম শুনেছ?
শুনেছি। ইস্পাতের ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন, কিশোর জবাব দিল।
কিন্তু লোহালক্কড় বাদ দিয়ে হঠাৎ জানোয়ার কেনার শখ হল কেন তার?
নিজের বাড়িতে একটা প্রাইভেট অ্যাকোয়ারিয়াম করেছেন। সাত সাগরের আজব আজব সব জীব এনে ওখানে জিয়াতে চান। আন্দাজ কর তো, কি কি চান?
সী লায়ন, রবিন বলল।
না। জায়ান্ট অক্টোপাস।
হাসি হাসি মুখটা নিমেষে গম্ভীর হয়ে গেল কিশোরের। তিরিশ ফুট লম্বা ওই দানব! কি করে ধরব? অসম্ভবকে সম্ভব করতে বলছেন তিনি।
শুধু তাই না, টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন রাফাত আমানু। প্যাডে পেন্সিল দিয়ে লিখে রেখেছেন নামগুলো। পড়লেন, একটা টাইগার শার্ক চান— বাঘা হাঙর। আরও চান একটা গারনারড, একটা এ্যাম্পাস, একটা সাগরের গিরগিটি, একটা ডুগং, একটা কংগার ইল—বিশাল বান মাছ, ছবি দেখেছ নিশ্চয়; দানবীয় ঝিনুক একটা চান, ওই যে, যেগুলো মানুষের পা আঁকড়ে ধরলে আর ছাড়ানোর সাধ্য হয় না, প্রায়ই ধরে ডুবুরিদের, অনেক ডুবুরি ছুটতে না পেরে ডুবে মারা যায়। একটা ম্যানটা বা সাগরের বাদুড়ও চান…
খাইছে! শুনেছি ওগুলো জেলেদের নৌকা ডুবিয়ে দেয়, হাঁ হয়ে গেছে মুসা। কিভাবে…
একটা সী সেন্টিপেড বা সাগরের শতপদী, বলে যাচ্ছেন রাফাত আমান, ছেলের কথা যেন কানেই যায়নি, একটা করাত মাছ, একটা তলোয়ার মাছ, একটা রাক্ষুসে স্কুইড…হ্যাঁ, যোগ করলেন তিনি। কিশোরের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে দেখে মজা পাচ্ছেন, খুদে যে জীবগুলো সচরাচর দেখ, ওগুলো নয়, চল্লিশ ফুট লম্বাগুলো, শুড়ের মাথায় বাসনের সমান বড় সাকশন কাপ থাকে, পনেরো ইঞ্চি লম্বা চোখ…ওগুলোর হারামিপনায় বিরক্ত হয়ে চমৎকার একটা নাম দিয়েছে। জেলেরা, প্রশান্ত মহাসাগরের দুঃস্বপ্ন।
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেছে ছেলেরা। নিছক আনন্দ ভ্রমণে যাচ্ছে না। ওরা।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ধরতে তো পারব না, জানি। ধরা যাক, ধরলাম। এতগুলো দানবকে বাড়ি আনব কি করে?
একটা স্কুনার ভাড়া করবে, যেটাতে বড় বড় দুতিনটে ট্যাংক আঁটে। ধরে ধরে রাখবে ওগুলোতে। তারপর মালবাহী জাহাজে তুলে দেবে। চলে আসবে, আর কি।
দানব ধরার কথা ভুলে গিয়ে প্রায় নাচতে আরম্ভ করল মুসা। খুশিতে। আহ, কি মজা! নিজের জাহাজে পাল তুলে দিয়ে ভেসে পড়ব সাগরে…
অত খুশি হয়ো না, বাধা দিয়ে বললেন তার বাবা। ইয়ট নিয়ে যাচ্ছ না। একটা ফিশিং বোট ভাড়া করবে, মাঝিমাল্লা নেবে দক্ষ দেখে, সাগর আর মাছ ধরায় যাদের জ্ঞান আছে। লিসটারের অর্ডারগুলো তো ধরবেই, এ ছাড়াও বিচিত্র যা-ই দেখবে, ধরার চেষ্টা করবে, যেগুলোর চাহিদা আছে পাবলিক অ্যাকোয়ারিয়ামে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি। চুপ করে কি ভাবলেন। আবার তাকালেন ছেলেদের দিকে। পারলে আমিও যেতাম, এতবড় একটা সুযোগ…কিন্তু উপায় নেই। হাতে অনেক কাজ। মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার একটা ছবি করছেন। আমাকে ছাড়তেই চান না, পারলে সারাক্ষণ আটকে রাখেন স্টুডিওতে।
আবার জানালার বাইরে তাকালেন তিনি।
কখন রওনা হচ্ছি আমরা? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
যত তাড়াতাড়ি পার, বলে কিশোরের দিকে তাকালেন। আর হ্যাঁ, আজই গিয়ে একবার প্রফেসর এনথনি ইস্টউডের সঙ্গে দেখা কোরো। আগেই বলে রেখেছেন, ওদিকে যদি তোমাদের পাঠাই, তাকে যেন জানাই। তোমাদের কথা সব জানেন তিনি।…তাঁকে চেন?
চিনি, রবিন বলল।
গুড। একটা গোপন কাজ বোধহয় দেবেন তোমাদেরকে। মুক্তো-টুক্তোর ব্যাপারে কিছু হবে।
২
দরজাটা বন্ধ করে দাও, প্রফেসর ইস্টউড বললেন। কেউ শুনে ফেলতে পারে।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে কিশোর আর রবিনের পাশে বসল মুসা।
ডেস্কের ওপাশ থেকে পুরো ঘরে চোখ বোলালেন প্রফেসর, যেন ভয়, দেয়ালগুলোরও কান আছে। কান অনেকগুলো আছে দেয়ালে, তবে ওগুলো বধির এখন, শোনে না। বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানীকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য মৃত জীবের লাশ, স্টাফ করা, দেয়ালে গাঁথা তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে চমৎকারভাবে। ঘরের মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত তাক, সব বোঝাই। উত্তর সমুদ্রের পাখি অ্যাক, পেঙ্গুইন, টার্ন, সামুদ্রিক চাঁদ মাছ, ময়ূর মাছ, সাগর-কই, টিউনা, মুলেট, ঋষি কাঁকড়া, জেলিফিশ, পুফার, পোয়পোয়েজ, শজারু মাছ আর আরও নানারকম সামুদ্রিক প্রাণী।
সাগরের প্রাণীর ওপর গবেষণা করছেন ডক্টর এথনি ইস্টউড। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফিক ইন্সটিটিউটের নির্বাহী সচিব। সাগর চেনেন তিনি। সাগরের মাছ চেনেন। আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড, নরওয়ের বড় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা অনেক কাজ আদায় করে নিয়েছে তাঁর কাছ থেকে, কিছু বিনে পয়সায়, কিছু টাকার বিনিময়ে, মূল্যবান তথ্য কিনে নিয়েছে। তাদের দেয়া সেই টাকাতেই পুরানো বিশাল এই প্রাসাদটা কিনে মস্ত ল্যাবরেটরি বানিয়ে নিয়েছেন। প্রায়, প্রতিটি ঘরেই নানা আকারের নানা ধরনের ট্যাংক রয়েছে, ওগুলো নানা রকম মাছের আঁতুড় ঘর।
মাথা সামান্য নোয়ালেন ধূসর-চুল প্রফেসর, যাতে ট্রাইফোকাল লেন্সের ভেতর। দিয়ে ভালমত দেখতে পারেন কিশোর অতিথিদের।
আমান বলল, প্রশান্ত মহাসাগরে নাকি বেড়াতে যাচ্ছ তোমরা, হাসলেন প্রফেসর। কিছু সামুদ্রিক জীব ধরারও চেষ্টা করবে। খুব কঠিন আর বিপজ্জনক কাজ। বয়েস কম তোমাদের। পারবে?
পারব, স্যার, গভীর আত্মবিশ্বাস ফুটে বেরোলো কিশোরের কণ্ঠে। আমাজানের জঙ্গলে গিয়ে ভয়ঙ্কর অ্যানাকোণ্ডা আর মারাত্মক হিংস্র জাগুয়ার ধরে এনেছি এই আমরা তিনজন। ভীষণ অরণ্যে সেই রোমাঞ্চকর অভিযানের কাহিনী সংক্ষেপে তাঁকে বলল সে।
বেশ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন প্রফেসর। আমানকে আমি বহু বছর ধরে চিনি। তার ওপর আস্থা আছে আমার। তোমাদের কথা বলেছে আমাকে। বয়েস এত কম হবে ভাবিনি…্যাকগে, সে যখন বলেছে, ঠিকই বলেছে। ফিল্ম ডিরেক্টর ডেভিস ক্রিস্টোফারকে ফোন করেছিলাম, সে-ও শতমুখে প্রশংসা করল তোমাদের। ওর মত লোককে অবিশ্বাস করতে পারি না। শোন, হাইলি কনফিডেনশিয়াল একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করব এখন। ডেনজারাস! দুবার মরতে মরতে বেঁচেছি এর জন্যে। তিনবার আমার এই ঘরে হানা দিয়েছে চোর, ফাইলপত্র তছনছ করেছে, রাতের বেলা। খুঁজে পায়নি অবশ্য, কারণ কোন কাগজে লিখিনি ওই তথ্য, লেখা আছে এখানে, নিজের কপালে টোকা দিলেন তিনি।
তোমাদের জানাব সেকথা, বললেন তিনি। জানলেই বিপদ, জীবন বিপন্ন হবার ভয় আছে। যতক্ষণ না জানছ, ভাল আছ। সে-তথ্যের জন্যে হয়ত অত্যাচার করে তিলে তিলে মারা হবে তোমাদের। ভেবে দেখ এখন, ঝুঁকি নেবে কিনা? একে একে তিনজনের মুখের দিকে তাকালেন প্রফেসর।
আড়চোখে একবার দুই বন্ধুর মুখের দিকে তাকাল গোয়েন্দাপ্রদান। রবিন স্তব্ধ, মুসার চেহারা ফ্যাকাসে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর। শান্তকণ্ঠে বলল, সব খুলে বলুন।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত কিশোরের চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর। তারপর হাসি ফুটল মুখে। নাহ, আণ্ডার এস্টিমেট করেছিলাম তোমাদের, কম বয়েসী বলে ভুল করেছি। আমান আর ক্রিস্টোফার ঠিকই বলেছে। মনে হচ্ছে পারবে তোমরা। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা ম্যাপ বের করে টেবিলে বিছালেন তিনি। মেরুদণ্ডে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল কিশোরের। জলদস্যুর গুপ্তধন? সাগরের কোন দুর্গম এলাকায় সেই ধন নিয়ে ডুবে গেছে কোন স্প্যানিশ জাহাজ? ম্যাপটা কি তারই নকশা?
সামনে ঝুঁকে ম্যাপটা দেখল সে। ও, না, নকশা নয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কোম্পানির করা একটা ম্যাপ, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের, হাওয়াই থেকে তাইওয়ান পর্যন্ত আঁকা রয়েছে। ম্যাপটা বেশ বড় আর আধুনিক, ছোট ছোট অসংখ্য দ্বীপ দেখানো রয়েছে, যেগুলো সাধারণ ম্যাপে থাকে না।
চেয়ার থেকে কিছুটা উঠে রবিনও দেখল। কয়েকটা দ্বীপের নাম জানে, হাওয়াই, তাহিতি, সামোয়া, ফিজি। বেশির ভাগই জানে না, বিশেষ করে লাল পেন্সিল দিয়ে গোল দাগ দেয়াগুলো, প্রফেসর দিয়েছেন। যেমন, পোনাপে,ট্রাক, ইয়্যাপ, ওলোল, লোস্যাপ, প্যাকিন, পিনজিল্যাপ। অদ্ভুত আরও কিছু নাম রয়েছে, কতগুলোর নাম উচ্চারণ করাই কঠিন।
কয়েকটা দ্বীপ ঘিরে রয়েছে গোল একটি মাত্র দাগ। সেটাতে পেন্সিল ঠকে প্রফেসর বললেন, এই যে জায়গাটা, একে বলে প্রশান্ত মহাসাগরের অন্ধ অঞ্চল। এখানে রয়েছে পঁচিশ হাজারের মত প্রায় অচেনা দ্বীপ। জাপানীরা দখল করে রেখেছিল এগুলো, বহুবছর বাইরের কোন জাহাজকেই ঘেঁষতে দেয়নি এই এলাকায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এগুলোর হাতে গোনা কয়েকটা দ্বীপে লড়াই হয়েছিল ওদের, মিত্রবাহিনীর সঙ্গে। জাপান হেরে যায়। দ্বীপগুলো দেখাশোনার ভার এখন আমেরিকার ওপর। কয়েকটা দ্বীপে আমেরিকান নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে। হারানো পৃথিবীই বলা চলে অঞ্চলটাকে।
তবে ওই হারানো পৃথিবীই আমার জন্যে স্বর্গ, তোমাদের জন্যেও হবে, কারণ, দুর্লভ জলজ জীব ধরতে যাচ্ছ তোমরা। আমার কাছে প্রিয় হবার আরেকটা বড় কারণ, ওখানেই রয়েছে আমার মুক্তার খামার।
মুক্তা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
আস্তে বল, চট করে ঘরের চারপাশে চোখ বোলালেন প্রফেসর, কেউ শুনে ফেলল কিনা দেখলেন বোধহয়। পেন্সিলের মাথা রাখলেন পোনাপে নামের দ্বীপটার ওপর। এটার উত্তরে—ঠিক কত দূরে বলতে পারব না ছোট একটা অ্যাটুল। আছে। কেউ থাকে না ওখানে। এত ছোট, ম্যাপে দেখানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি। জাহাজ চলাচলের পথ থেকে দূরে, কাজেই নটিক্যাল চার্টেও দেখায়নি। নাম ছিল না। সুতরাং নাম একটা আমিই রেখেছি, পার্ল ল্যাগুন। ওই ল্যাগুনে গবেষণা চালিয়েছিলাম কিছুদিন।
পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর মুক্তা ফলানো হয় পারশিয়ান গালফ-এ। বছর পাচেক আগে ওই গালফ থেকে বিশ হাজার ঝিনুক সংগ্রহ করে পার্ল ল্যাগুনে নিয়ে যাই আমি, প্রাকৃতিক পরিবেশে ওই ঝিনুক থেকে কি-রকম মুক্তা হয় দেখার জন্যে। ওই ঝিনুকের জন্যে প্রচুর খাবারও নিয়ে যাই। পারশিয়ান গালফ-এর পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছি পার্ল ল্যাগুনে। আমার বিশ্বাস ছিল, ওখানেই ওই ঝিনুকের চাষ সফল হলে আরও অনেক জায়গায় করা সম্ভব হবে।
আমার পরীক্ষা সফল হয়েছে কিনা দেখার সময় হয়েছে এখন। সময়ের অভাবে যেতে পারছি না আমি, খরচ দিয়ে যে কাউকে পাঠাব, সে সামর্থ্যও নেই। তোমরা যখন ওদিকেই যাচ্ছ, পারলে একবার পার্ল ল্যাগুনে যেও, আমার ঝিনুক খেত থেকে কিছু নমুনা নিয়ে এস। তোমরা যেখানে যাবে, তার থেকে কিছুটা দূরেই হবে ল্যাগুনটা। তবে ওইটুকু যেতে আসতে যা খরচ লাগে, সেটা আমি দিতে পারব। পারবে যেতে?
শুনে তো ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে, কিশোর বলল। কিভাবে যেতে হবে? কি কি চিহ্ন দেখে বুঝব ওটা পার্ল ল্যান?
বলছি। এটাই আমার সিক্রেট। চারপাশে চোখ বোলালেন আবার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন কিশোরের দিকে। কেউ শুনে ফেলছে না তো? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, শুনছে!
আমার অবশ্য তা মনে হচ্ছে না, হাসল কিশোর। তবে বলাও যায় না। যেভাবে জিনিসপত্র গাদাগাদি করে রেখেছেন, বাগ লুকানো থাকতেও পারে। খুঁজে বের করা মুশকিল। স্টাফ করা প্রাণীগুলো দেখাল। ওগুলোর কোনটার ভেতরও থাকতে পারে।
কিশোরের হাসিটা ফিরিয়ে দিতে দিতে চেয়ারে হেলান দিলেন প্রফেসর। যাকগে, অত ভেবে লাভ নেই। আমিও বোধহয় বেশি বেশি কল্পনা করছি। ভয় পাচ্ছি। ভয় পাওয়ার কারণও অবশ্য আছে। হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি আসা, রাতে ল্যাবরেটরিতে চোর ঢোকা.হ্যাঁ, কি যেন বললে? বাগ? এক ধরনের প্রেরক যন্ত্র, স্যার। স্পাইরা বলে বাগ।
অ। পুরানো ডিকটোগ্রাফের মত জিনিস। ওকথা আমিও ভেবেছি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি, পাইনি। থাকলে থাকবে, কি আর করা? যা যা বলেছি তোমাদের, সবই হয়ত শুনে ফেলেছে ব্যাটারা। শুনুর্ক। আসল কথাটা আর শুনতে দিচ্ছি না।
প্যাড থেকে একটানে ফড়ৎ করে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে পেন্সিল দিয়ে লিখলেনঃ নর্থ ল্যাটিচিউড ১১.৩৪। ইস্ট লংগিচিউড ১৫৮.১২।
কাগজটা ঠেলে দিলেন ছেলেদের দিকে।
এই প্রথম এটা লেখা হল, বললেন তিনি। এবং আশা করি এই শেষ। মুখস্থ করে নাও। এই অবস্থানে রয়েছে পার্ল ল্যাগুন। কখনও কোন কাগজে লিখবে না, কারও সামনে ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করবে না।
একবার পড়েই মুখস্থ হয়ে গেল কিশোরের, অসাধারণ তার স্মৃতিশক্তি। কয়েক বার পড়ে রবিনেরও মুখস্থ হল। সময় লাগল মুসার। মনে মনে পড়েই চলেছেঃ উত্তরে ল্যাটিচিউড এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট। পূর্বে লংগিচিউড একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট।
মুখস্থ হয়েছে কিনা, জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর। তিনজনেই মাথা ঝাঁকাতে কাগজটা টেনে নিয়ে উল্টোপিঠে একটা নকশা একে বোঝালেন, এই হল ল্যাগুন। এদিকটা উত্তর। এইখানে রয়েছে ঝিনুকের খেত। ল্যাগুনের উত্তর-পূর্ব কোণে পেন্সিলের মাথা রাখলেন তিনি। দেখে নাও ভাল করে।
নকশাটা মনে গেঁথে নিতে লাগল কিশোর।
হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
ম্যাচের কাঠি জ্বেলে কাগজটার এক কোণে আগুন ধরালেন প্রফেসর। পুড়ে ছাই হয়ে গেল পুরোটা কাগজ। সেটা হাতের তালুতে রেখে আঙুল দিয়ে টিপে টিপে মিহি গুঁড়ো করে ফেললেন। তারপর উঠে গিয়ে হাত ধুলেন বেসিনে। ছাইগুলো পানির সঙ্গে মিশে চলে গেল নর্দমায়।
প্রফেসরের বাড়ি থেকে বেরোল তিন গোয়েন্দা। বাইরে ইয়ার্ডের পুরানো ছোট ট্রাক নিয়ে অপেক্ষা করছে বোরিস। ওটাতে করেই এসেছে ছেলেরা।
ট্রাকে ওঠার সময় খেয়াল করল কিশোর, পাশের বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল একজন লোক। তার চেহারা দেখতে পেল না সে। মনে রাখার মত তেমন কোন বিশেষত্বও নেই শরীরের, শুধু পিঠ সামান্য কুঁজো হাঁটার কারণেও এমনটা হতে পারে। সোজা গিয়ে কালো একটা সেডান গাড়িতে উঠল লোকটা।
লোকটাকে লক্ষ্যই করত না কিশোর, যদি না প্রফেসরের সাবধানবাণী মন জুড়ে থাকত তার—ডেনজারাস! তিনবার মরতে মরতে বেঁচেছি…অত্যাচার করে তিলে তিলে মারা হবে তোমাদের-তার মনেও সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছেন প্রফেসর।
সারাটা পথ চুপ করে রইল কিশোর। একটা কথাও বলল না। স্যালভিজ ইয়ার্ডে পৌঁছল ট্রাক। মোড় নিয়ে গেটে ঢুকছে, এই সময় কালো সেডানটা চোখে পড়ল ওর, রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠল সে।
কি হল? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
উ! না, কিছু না, হাসল কিশোর। প্রফেসরের সন্দেহ রোগে আমাকেও ধরেছে। কালো একটা গাড়ি দেখলাম, কিন্তু তাতে কি? প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করল সে। কালো সেডান আমেরিকায় অনেক আছে, রকি বীচেও।
মনকে বোঝানোর চেষ্টা করল বটে গোয়েন্দাপ্রধান, কিন্তু দুশ্চিন্তা দূর করতে পারল না। হয়ত ওদেরকে প্রফেসরের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে চোরদের কেউ, বেরোতে দেখেছে। ঘরে বাগ লুকিয়ে রেখে তাদের কথাও শুনেছে। আর তা হয়ে থাকলে, প্রফেসরের শত্রু এখন ওদেরও শত্রু হয়ে গেল। কালো গাড়িতে করে ট্রাকের পিছু পিছু এসে জেনে গেল, ওরা কোথায় থাকে।
এরপর কি করবে লোকটা? হয়ত…
দূর! কি আবোল-তাবল ভাবছে? এত হয়ত হয়ত করছে কেন? নিজেকে ধমক লাগাল কিশোর। মন থেকে সমস্ত সন্দেহ আর দুশ্চিন্তা ঝেড়ে বিদেয় করার চেষ্টা করল।
৩
রাজহংসীর মত ভেসে চলেছে মর্নিং স্টার কিশোর বাংলা নাম রেখেছে শুকতারা। ঘোষণা করে দিয়েছে, যতদিন স্কুনারটা তাদের অধিকারে থাকবে, শুকতারা বলেই ডাকবে ওটাকে। রবিন আর মুসা আপত্তি করেনি। ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ গাঁইগুই করে শেষে মেনে নিয়েছে। কিশোর বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে, যেহেতু.জাহাজটা ভাড়া নিয়েছে ওরা, ওটার ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব এখন ওদের।
দুরন্ত গতিতে ছোটার জন্যেই যেন জন্ম হয়েছিল জাহাজটার। সমকক্ষ টিউনা শিকারি আর কোন জাহাজই পারে না শুকতারার সঙ্গে, মাছ নিয়ে বন্দরে ফেরার প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। তিনকোনা মারকোনি পালের কারণেই গতি এত বেড়েছে এটার। এ ধরনের পাল কুনারে সাধারণত দেখা যায় না, সম্রান্ত রেসিং ইয়টগুলোতেই লাগানো হয়। কিন্তু শুকতারা সাধারণ স্কুনার নয়। বোট রেসেও অংশগ্রহণ করেছে। তিনটে পাল ছাড়াও রয়েছে অকজিলারি ইঞ্জিন, বাতাস পড়ে গেল, কিংবা সরু চ্যানেলের ভেতর দিয়ে চলার সময় ওই ইঞ্জিন ব্যবহার হয়সাধারণত পাল যেখানে কাজ করে না। কিন্তু বাতাস থাকলে, আর তিনটে পালেই হাওয়া লাগলে যে গতি পায়, ইঞ্জিনের পুরো ক্ষমতা নিংড়েও তার অর্ধেক হবে না। এই তো এখনই সতেরো নট গতিতে ছুটছে, অথচ যেন গায়েই লাগছে না ওর।
ডেকে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। এরকম একটা জাহাজের সাময়িক মালিক হতে পেরে গর্বে ফুলে উঠেছে বুক। নৌকা-জাহাজ সম্পর্কে মুসার জ্ঞান বেশি, স্কুনারটা সে-ই পছন্দ করেছে। টাকা এসেছে তার বাবার পকেট থেকে অর্ধেক, বাকিটা কিশোরের চাচা রাশেদ পাশার কাছ থেকে। দুজনে শেয়ারে ব্যবসা করে, জন্তুজানোয়ার ধরে বিক্রি করার, স্কুনারটার মালিক ক্যাপ্টেন ইজরা কলিগ। জাতে জেলে, দক্ষ নাবিক, ক্যাপ্টেন উপাধিটা নিজেই নিজের নামের আগে বসিয়ে নিয়েছে।
শুকতারাতেই আছে সে। ক্যাপ্টেন হিসেবে এসেছে, তার জন্যে আলাদা পয়সা দিতে হবে। ষাট ফুটি একটা জাহাজ সামলানো এমনকি মুসার পক্ষেও সবসময় সম্ভব না। তাছাড়া যাচ্ছে ওরা অচেনা সমুদ্রে, দক্ষ একজন নাবিকের দরকার আছে। জাহাজের মাঝি-মাল্লা রয়েছে আরও দুজন, দুজনেই তরুণ। একজনের নাম জামবু, ডাকনাম না ছদ্মনাম কে জানে, আসল নাম বলতে নারাজ। রোদে-পোড়া শরীর, কর্কশ চেহারার মতই যেন চরিত্রটাও। আরেকজন বাদামি চামড়ার এক দানব, নাম কুমালো, বাড়ি দক্ষিণ সাগরের ছোট্ট এক দ্বীপে, রায়াটি। এক বাণিজ্যিক জাহাজের চড়ে এসেছিল আমেরিকায়, স্যান ফ্রান্সিসকোয় নেমেছিল। ঘুরেছে অনেক শহর, স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে, স্বর্গ খুঁজে পায়নি শ্বেতাঙ্গদের দেশে, অথচ গল্প অনেক শুনেছিল। তাই প্রথম সুযোগেই ফিরে চলেছে আবার নিজের দেশে। স্কুনারটা পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দিকে যাবে শুনেই আর দ্বিরুক্তি করেনি, মাল্লার চাকরি নিয়ে উঠে পড়েছে।
সামনের ডেকের নিচে ছোট্ট কেবিনে গাদাগাদি করে ঘুমাতে হবে তিন নাবিককে। তিন গোয়েন্দার থাকার জায়গা আরও কম, পেছনের ডেকের নিচে। জায়গা অনেকই ছিল, ছেড়ে দিতে হয়েছে বিশাল ট্যাংকগুলোর জন্যে, যেগুলোতে, জলজ প্রাণী জিয়ানো হবে। দুটো কেবিনের মাঝামাঝি বসানো হয়েছে ওগুলো।
খুদে গ্যালিটাকে ব্যবহার করা হবে রান্নাঘর হিসেবে। একটা প্রাইমাস স্টোভ আছে। স্টোররূমে আর একরত্তি জায়গা নেই, খাবারের বাক্স, বস্তা, টিনে বোঝাই। আছে মাছ আর অন্যান্য জানোয়ার ধরার নানারকম সরঞ্জাম–জাল, হারপুন, বড়শি, সুতা, আরও অনেক কিছু।
তিনটে মাস্তুলের বড়টাতে, অর্থাৎ প্রধান মাস্তুলের অনেক ওপরে লাগানো রয়েছে একটা মাচামত, ক্রোজ-নেস্ট, কিশোর বলে কাকের বাসা। ওখানে উঠে বসে চোখ রাখা যায় দূরে, শিকার খুঁজে বের করা সহজ হয়। সামনের গলুইয়ে রয়েছে পুলটি– লম্বা একটা তক্তা ঠেলে বেরিয়ে গেছে কয়েক ফুট সামনে, লোহার মোটা পাত দিয়ে ওটাকে জায়গামত ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক ফিশিং বোটেই থাকে ওরকম পুলপিট। হারপুন হাতে ওটার মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় শিকারি, পানিতে মাছের খোঁজ করে। চোখে পড়লেই পলকে ছুঁড়ে মারে হারপুন, গেঁথে তোলে মাছ। ওখানে দাঁড়ালে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়, আশ্চর্য এক ভাল লাগা। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, পায়ের তলায় ছুটন্ত সাগর, মাঝে একটা তক্তা ছাড়া আর কিছু নেই। পানির অনেক নিচে দৃষ্টি যায় এখানে দাঁড়ালে, স্পষ্ট চোখে পড়ে সাগর-জীবন।
পালা করে কয়েকবারই পুলপিটে দাঁড়িয়েছে তিন গোয়েন্দা। অবাক হয়ে ভেবেছে, কি জানি কি চোখে পড়ে যায়? অচেনা কিছু দেখা যেতেই পারে। কারণ প্রফেসর ইস্টউড বলেছেন, প্রশান্ত মহাসাগরে যত প্রাণী আছে, তার অর্ধেকের বেশি হয়ত এখনও অপিরিচিত মানুষের কাছে। মানুষ জানেই না, আছে ওগুলো।
বিশাল এই জলাশয়ের সব চেয়ে বেশি যেখানটায় চওড়া, এগারো হাজার মাইল; গড় গভীরতা তিন মাইল, কোন কোন জায়গা আরও বেশি, ছয়টা গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন একসাথে জোড়া দিয়ে ডোবালেও ডুবে যাবে। লক্ষ লক্ষ দ্বীপ রয়েছে এর বুকে, নামকরণ হয়েছে মাত্র তিন হাজারের। মহাসমুদ্রের এই অসীম জলরাশি কত হাজারো রহস্য এখনও লুকিয়ে রেখেছে বিজ্ঞান আর মানুষের অগোচরে, কে জানে!
হুইল ধরেছে ক্যাপ্টেন ইজরা কলিগ। ছোেট নীল চোখে শেয়ালের ধূর্ততা। রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা মুখের বাদামি চামড়া দেখে আর বোঝার উপায় নেই মূল রঙ কি ছিল। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে বিনাকল-এ রাখা কম্পাসের দিকে।
এই রকম বাতাস থাকলে সহজেই পোনাপের পাশ কাটাতে পারব, একসময় বলল কলিগ।
কেন, বাতাস গোলমাল করার সম্ভাবনা আছে নাকি? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
আছে। একটা অশ্ব অক্ষাংশ। বাতাসের মতিগতি বোঝা মুশকিল। এরকম থাকে না। হাওয়াই ছাড়ানোর পর নিশ্চিন্ত। বাতাস মোটামুটি এক থাকে ওখানে, দুর্ঘটনার ভয় কম।
দুর্ঘটনা? পায়ে পায়ে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে রবিন, কথা শোনার জন্যে। কি দুর্ঘটনা?
হারিক্যান। সর্বনাশ করে ছাড়ে।
এখন কি হারিক্যানের মৌসুম নাকি? মুসা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। থাক, ওসব অলক্ষুণে কথা বলার দরকার নেই। হয়ত কিছুই ঘটবে। কিশোরের মুখের ওপর তীক্ষ্ণ শেয়াল-দৃষ্টি নাচাল কলিগ। এত টাকা খরচ, এত সাজসরঞ্জাম…ওদিকে কি দরকার? শুধুই জানোয়ার ধরা, না অন্য কিছু?
হঠাৎ সন্দেহ হল কিশোরের। তথ্য জানতে চাইছে ক্যাপ্টেন? নাকি জানতে চাওয়ার ভান করছে শুধু, যা জানার জেনে ফেলেছে ইতিমধ্যেই? তাকে তো বলা হয়েছে, জলজ জানোয়ার ধরতে যাচ্ছে ওরা। তাহলে হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? মুক্তা খেতের কথা জানে নাকি লোকটা?
জবাব দিল না কিশোর। সরে এল ওখান থেকে। জাহাজের পালে হাওয়া লাগার পর থেকে যে ভাল লাগাটা ছিল, দূর হয়ে গেছে, মনের কোণে ভারি হয়ে উঠছে সন্দেহের কালো মেঘ।
প্রায় ভুলেই গিয়েছিল কালো সেডানের সেই লোকটার কথা। বাড়ি থেকে বন্দর পর্যন্ত কেউ তাদেরকে অনুসরণ করেনি। জাহাজ খোলা সাগরে বেরিয়ে আসার পর সে মনে করেছিল, শয়তানকে পিছে ফেলে এসেছে। সামনে শুধুই আনন্দ, আর রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার।
এখন মনে হল, ভুল করেছে। নতুন করে তাকে ভাবিয়ে তুলল ক্যাপ্টেন ইজরা কলিগ। জামবুকে সন্দেহ করল, লোকটা কেন আসল নাম বলতে চায় না? সন্দেহ হল কুমালোকে, লোকটা কি সত্যিই দেশে ফিরে যাওয়ার জন্যে শুকতারায় উঠেছে? নাকি দক্ষিণ সাগরে ওদের সঙ্গে চলেছে প্রফেসরের মুক্তা খেতের সন্ধানে? কাকে ছেড়ে কাকে সন্দেহ করবে বুঝতে পারছে না সে। জামবু আর কুমালো, দুজনকেই চাকরি দিয়েছে ইজরা কলিগ। তিনজনই কি একদলে?
কি হল? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
হাসল কিশোর। তার সন্দেহের কথা বলে এখনই দুই সহকারীকে ঘাবড়ে দিতে চায় না। না, কিছু না…ঝড়ের কথা শুনে ভাবছি…ওই দেখ, মেঘ।
বিশেষ সুবিধের লাগছে না, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে একটুকরো কালো মেঘ। নামবেই বোধহয়। তার কথা শেষ হতে না হতেই ঝরঝর করে ঝরে পড়ল কফোঁটা। বোঝা যায়, আরও ঝরবে।
বৃষ্টি! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। তারমানে গোসল। খাইছে, গায়ে যা গন্ধ হয়ে গেছে না। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর আর গা ধোঁয়ার সুযোগ পাইনি।
ছুটে কেবিনে চলে গেল সে। খানিক পরেই বেরিয়ে এল কাপড় খুলে, পরনে শুধু একটা জাঙ্গিয়া। হাতে সাবান।
বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। শরীর ভিজিয়ে নিয়ে সাবান দিয়ে জোরে জোরে গা ঘষতে শুরু করল মুসা। সাদা ফেনায় ঢেকে ফেলল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ইতিমধ্যে কমে গেছে বৃষ্টি। আবার নামার অপেক্ষা করতে লাগল সে উৎকণ্ঠিত হয়ে। চোখ বোজা। দেখতে পেল না, মাথার ওপর থেকে সরে গেছে। মেঘের টুকরোটা। একটা ফোঁটাও পড়ছে না আর।
সাবানের ফেনার একটা স্তম্ভ হয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে মুসা। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে কিশোর আর রবিন। কলিগও তাকিয়ে আছে, মজা পাচ্ছে।
আরেকটু মজা করার লোভ ছাড়তে পারল না রবিন। হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, মুসা, দেখ দেখ!
কি হয়েছে দেখার জন্যে চোখ মেলল মুসা। প্রায় সাথেসাথেই বন্ধ করে ফেলল আবার। চোখে সাবান ঢুকে জ্বলুনি শুরু হল। চেঁচাতে শুরু করল সে, ওরে বাবারে, গেছি! এই এই, আমাকে এক বালতি পানি এনে দাও না কেউ! অ্যাই…।
কেউ পানি আনতে গেল কিনা দেখারও উপায় নেই। সহ্য করতে পারল না আর মুসা। সোজা ছুটে গেল রেলিঙের কিনারে। থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত। তারপরই রেলিঙ টপকে মাথা নিচু করে ঝাপ দিল সাগরে।
ধুয়ে গেল সাবান। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে, পানি বেশ ঠাণ্ডা। কয়েক মুহূর্ত দাপাদাপি করল মুসা। তারপর ওপরে তাকিয়ে রবিনের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, রবিন। পানিতে নামার সাহস করতে পারছিলাম না, নামিয়ে দিয়ে ডর ভেঙেছ। চমৎকার পানি। এই কিশোর, নামবে নাকি?
না, হাত নাড়ল কিশোর। উঠে এস, জলদি। বড় বড় হাঙর থাকে এসব অঞ্চলে।
থাকুকগে। হাঙরকে ভয় পাই না আমি।
হাসল কিশোর। মুসার সাগরপ্রীতির কথা জানা আছে তার। হঠাৎ চোখ বড় বড় করে অভিনয় শুরু করল, ও, জানো না বুঝি? সাগরের পানিতেও ভূত থাকে। ওদের বলে খ্যাংড়া ভূত…
ঠিক এই সময় বোধহয় পায়ে একটা মাছের বাড়ি লাগল, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল মুসা, ওরে বাবারে! খেয়ে ফেলল রে! খ্যা-খ্যা-এ্যাংড়া ভূত…জলদি একটা দড়ি দাও! তোল আমাকে!
৪
রাত নেমেছে সাগরে। ডেকে বসে পড়ছে রবিন আর কিশোর। মাছের আলোয়।
একধারে বসে আকাশের তারা গুনছে মুসা।
ছোট একটা ট্যাংকের দুধারে বসেছে কিশোর আর রবিন। ট্যাংকের পানিতে সাঁতার কাটছে মাছটা, গা থেকে উজ্জ্বল আলো বেরোচ্ছে, চল্লিশ ওয়াট বাল্বের সমান আলো।
কি, পেয়েছ? মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল রবিন। নাম আছে?
আছে, হাতের ম্যানুয়েলটা নেড়ে বলল কিশোর। লণ্ঠন মাছ। বেশ মানিয়ে নাম রেখেছে।
মাছটার শরীরের দুধারে দুই সারি আলো, যেন খুদে একটা স্টিমারের আলোকিত জানালা। পিঠের ঘন কাটার ফাঁকে ফাঁকেও রয়েছে আলো.। নাগাড়ে জ্বলছে, মিটমিটও করছে না। তবে লেজের আলোগুলো স্থির নয়, জ্বলছে-নিভছে, জ্বলছে-নিভছে।
মাছটা ধরেছে কিশোর। ঘন্টাখানেক আগে পুলপিটে দাঁড়িয়েছিল জাল হাতে। পুলপিটের লোহার রেলিঙে হেলান দিয়ে তাকিয়েছিল নিচে, তন্ময় হয়ে দেখছিল নিচের জলজ জীবন। পায়ের তলায় মাত্র কয়েক ফুট নিচে ছুটন্ত সাগর। হঠাৎ দেখেছে আজব আলো। চোখের পলকে লাঠিতে বাঁধা জালটা ডুবিয়ে দিয়েছে পানিতে। চামচ দিয়ে শুরুয়া থেকে গোশতের টুকরো তোলার মত করে জালে করে তুলে এনেছে মাছটা।
এই আলো দিয়ে কি করে ওরা? জিজ্ঞেস করল মুসা। আকর্ষণীয় আলোচনা শুরু হয়েছে, কাজেই তারা গোনা বাদ।
গভীর পানির মাছ এটা, ম্যানুয়েল পড়ে জেনেছে কিশোর। শুধু রাতের বেলা ওপরে ওঠে। দিনে থাকে গভীর পানিতে, অন্ধকারে। সাগরের ওই অতোখানি গভীরে চিরকাল অমাবস্যার অন্ধকার। কাজেই ওখানে যারা বাস করে তাদের আলো দরকার হয়, এই আলোক মাছের মত।
কেন? পানিতে তো রোদের আলো ঢোকে। দিনের বেলা যতবার ডুব দিয়েছি, আলো দেখেছি। অন্ধকার তো ছিল না?
সূর্যের আলো পানিতে হাজার ফুটের বেশি নামতে পারে না, বিদ্যে ঝাড়তে আরম্ভ করল বইয়ের পোকা রবিন। তুমি আর কয় ফুট নাম? বেশি গভীরে নামতে চাইলে, মানে ডীপ-সী ডাইভিঙের সময় আলাদা আলো নিয়ে যেতে হয় সঙ্গে করে। পানির মাইলখানেক নিচে থেকে শুরু হয় অন্ধকারের রাজত্ব, ঘোর কালো অন্ধকার, ওই যে কিশোর বলল, অমাবস্যা। হেসে যোগ করল, শোনের ভূতের মতই ওখানে আলো বয়ে বেড়ায় মাছেরা।
গায়ে কাঁটা দিল মুসার। খানিকটা সরে বসল দুই বন্ধুর কাছাকাছি। লেজের আলো জ্বলে-নেভে কেন?
বোধহয় শত্রুকে ঠেকানোর জন্যে, কিশোর বলল। তোমার চোখে হঠাৎ টর্চের আলো ফেললে কি হয়? অন্ধ হয়ে যাও না? ঠিক তেমনি। শত্রুর চোখে আলো ফেলে তাকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধ করে দেয় আলোক মাছ। ওই সুযোগে পালায়।
মম, খুব চালাক ব্যাটারা।
নানারকম জাল বেঁধে রাখা হয় জাহাজের পেছনে। কখনও ওপরের পানি থেকে মাছ ঘেঁকে তোলার জাল, কখনও গভীর পানি থেকে মাছ ধরার উপযোগী জাল। তাতে প্রতিদিনই ধরা পড়ে নানারকম মজার মজার জীব, মাছ।
গভীর পানির ছোট ছোট জীবগুলোকে ধরে ছোট একটা অ্যাকোয়ারিয়ামে আলাদা করে রেখে দেয় কিশোর।
দাঁড়াও, মজা দেখি, বলে ছোট একটা জাল দিয়ে আলোক মাছটাকে তুলে অ্যাকোয়ারিয়ামে ফেলল সে। সঙ্গে সঙ্গে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হল। তেড়ে এল ওটার চেয়ে বড় প্রজাতির আরেকটা আলোক মাছ, ওটার গায়েও আলো আছে। পাখাগুলোতেও আলো। এমনকি লম্বা লম্বা গোঁফগুলো থেকেও উজ্জ্বল দ্যুতি বেরোচ্ছে।
এটার নাম রাখেকো, কিশোর বলল।
দেখেই বোঝা যায়, জীবনে অনেক তারা গিলেছে, মন্তব্য করল মুসা। তাকিয়ে আছে ট্যাংকের দিকে। জলদি লণ্ঠন বের না করলে একেও খাবে।
লণ্ঠনটাকে প্রায় ধরে ফেলেছে তারাখেকো, এই সময় ওটার চোখের কাছে লেজ নাড়ল লণ্ঠন। দপদপ করে বার কয়েক আলো জ্বলল-নিভল। ধাধিয়ে দিল তারাখেকোর চোখ। দ্বিধায় পড়ে গেল বড় মাছটা। এই সুযোগে ট্যাংকের একেবারে কোনায় চলে গেল ছোটটা, লুকানোর চেষ্টা করছে।
ট্যাংকে আরও অনেক মাছ আছে। কোনটার সবুজ আলো, কোনটার হলুদ, কোনটার লাল। একটার মাথা থেকে বাঁকা হয়ে ঝুলছে সরু একটা আঁকশি, মাথায় খুদে একটা বাল্ব, জ্বলছে।
কিন্তু একটা মাছের কোন আলো নেই, অথচ গভীর পানিতে বাস। ম্যানুয়েল পড়ে জেনেছে কিশোর, ওটা চির অন্ধ। কাজেই কোথায় যাচ্ছে দেখার জন্যে আলো দরকার হয় না, অন্ধ মানুষের মত লাঠি দিয়ে দেখে দেখে চলে। তবে মানুষের হাতে থাকে একটা লাঠি, আর এটার শরীরে রয়েছে বিশটা। লম্বা লম্বা, ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। এগুলো দিয়ে মাছটা বোঝে কে কোথায় রয়েছে, কি করছে। চলার পথে কারও সঙ্গে ধাক্কা লাগায় না, বুঝতে পারে কোথায় রয়েছে খাবার, কোথায় শত্রু।
কিছু কিছু মাছের নাম ম্যানুয়েলেও নেই। একটা খাতায় ওগুলোর ছবি এঁকে রাখে কিশোর, পাশে নোট লেখে। বাড়িতে ফিরে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই ঘেঁটে দেখবে, ওগুলোর উল্লেখ আছে কিনা। না থাকলে বুঝবে, তিন গোয়েন্দাই ওগুলোর আবিষ্কারক। হয়ত ওদের নামেই নাম রাখা হবে মাছগুলোর, কে জানে!
রোমাঞ্চিত হল গোয়েন্দাপ্রধান। ওরা আবিষ্কারক? বিশ্বাসই হতে চায় না। তবে ব্যাপারটা অসম্ভব নয়। উনিশশো একান্ন সালে বিকিনি অ্যাটলের কাছে মাছের ওপর গবেষণা চালিয়েছিল স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন। চারশো একাশি প্রজাতির মাছের নমুনা সংগ্রহ করেছিল ওরা, তার মধ্যে উনআশিটাই নতুন। তারমানে প্রতি ছটায় একটা। ইস, এখনও যদি তাই হত! ট্যাংকের প্রতি ছটা মাছের একটা…
ধুম করে একটা শব্দে চমকে উঠল কিশোর, ছিন্ন হয়ে গেল ভাবনা। মাথার ওপরে মাস্তুলের গায়ে বাড়ি খেয়ে শব্দটা হয়েছে, ডেকে পড়ল কি যেন। ধুম ধুম করে আরও দুবার শব্দ হল।
উড়ুক্কু মাছ! চেঁচিয়ে উঠল সে। ট্যাংকে রাখা লণ্ঠন মাছের আলো গিয়ে পড়েছে সাদা পালে। ওই আলো দেখেই আকৃষ্ট হয়েছে উড়ুক্কু মাছ। উড়ে আসছে। আলো দেখে ছুটে আসা পতঙ্গের মত।
দাঁড়াও, ধরছি ব্যাটাদের! মাস্তুলের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল মুসা। কালো একটা জিনিস ছুটে আসছে। বেসবলের মত খপ করে ধরল ওটাকে। আওয়াজ শুনে ডেকে উঠে এসেছে কুমালো। তার হাতে মাছটা তুলে দিল সে। একইভাবে আরেকটা মাছ ধরল মুসা। তারপর আরেকটা। চমৎকার! সকালের নাস্তা ভালই। জমবে। উড়ুক্কু মাছের স্বাদ ভাল।
একটার পর একটা ধরছে মুসা। এই সময় উড়ে এল যেগুলো ধরেছে তার চেয়ে বড় একটা কিছু। মিস করল মুসা, কারণ শেষ মুহূর্তে গতি পরিবর্তন করেছে ওটা। ধ্যাপ করে পেটে এসে গুতো মারল। মনে হল, যেন হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরেছে। সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল তার শরীর। ডেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। পেট চেপে ধরেছে দুহাতে, প্রচণ্ড ব্যথা।
তাড়াতাড়ি ট্যাংকের ঢাকনা লাগিয়ে দিল কিশোর। ঢেকে দিল আলোক মাছের আলো, যাতে আর কেউ আকৃষ্ট না হয়। ফিরে এসে ঝুঁকল মুসার ওপর।
বিড়বিড় করছে মুসা, আল্লাহ্, মেরে ফেলেছে…।
মুসার পেটের কাছে বড় একটা পাথরের মত জীবকে পড়ে থাকতে দেখল কিশোর। টর্চের আলো ফেলল ওটার ওপর। মাছই। যেন বিচিত্র বর্ম পরে রয়েছে।
গারনারড, বলল সে। ফ্লাইং গারনারড! মুসা, তোমার কপাল ভাল, বেঁচে গেছ। এই মাছের অনেক গল্প পড়েছে কিশোর। রাতের বেলা হুইল ধরে থাকা নাবিকের কপালে এসে বাড়ি খায় এই মাছ। প্রচণ্ড আঘাতে বেহুশ হয়ে যায় নাবিক, মারাও যায় কখনও কখনও।
রক্ত পড়ছে মুসার পেট থেকে। শার্টের বোতাম খুলে দেখা গেল, গারনারডের ছুরির মত ধারালো আঁশ কাপড় কেটে চামড়ায় আঁচড় দিয়েছে।
আলাদা একটা ট্যাংকে গারনারডকে রেখে দিয়ে এল কিশোর। তারপর সে আর রবিন মিলে মুসার সেবা করতে বসল। অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করে তাতে মলম লাগিয়ে দিল।
উঠে দাঁড়াল মুসা। তিনজনে মিলে নতুন প্রাণীটাকে দেখতে গেল।
মিস্টার লিসটারের খুব পছন্দ হবে, খুশি হয়ে বলল কিশোর। আস্ত একটা ভড়। উড়তে পারে, সাঁতরাতে পারে, এমন কি হাঁটতেও পারে।
সত্যি, ট্যাংকের তলায় হেঁটে বেড়াচ্ছে গারনারড। পেটের নিচের দুটো পাখনাকে ব্যবহার করছে পায়ের মত। কয়েকটা শান্ত কদম ফেলেই কুইক মার্চ শুরু করে। তারপর ডাবল মার্চ, তারপর একেবারে দৌড়। দৌড়ানোর সময় সামনে লতা-টতা পড়লে একটা পাকে নিমেষে হাত বানিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয় লতাটা। খাবার দেখলে থমকে দাঁড়ায়। ঠোকর দিয়ে তুলে নিয়ে গল্প করে গিলে ফেলে।
কাণ্ড দেখে হেসে উঠল মুসা, পরক্ষণেই আউক! করে চেপে ধরল পেট। হাসতে গিয়ে ব্যথা লেগেছে। সামলে নিয়ে বলল, একেবারে সার্কাসের ভাড়। ঠিকই বলেছ, লিসটারের পছন্দ হবে। তবে ট্যাংকের মুখ ভোলা রাখলে কাঁদতেও দেরি হবে না, উড়ে এসে যখন পেটে গুতো লাগাবে। পেটে হাত রাখল সে। আল্লায় না করুক, আমার অবস্থা না হোক ভদ্রলোকের। কিন্তু যদি হয়, আল্লাহ্, আমি যেন তখন থাকতে পারি ওখানে।
৫
বাদুড়! বাদুড়! পরদিন সকালে কাকের বাসা থেকে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। গ্যারেজের দরজার সমান একেকটা!
।রবিন মিথ্যে বলে না, তবু বিশ্বাস করতে পারল না মুসা। বাদুড় পানিতে সাঁতার কাটে না। আর গ্যারেজের দরজার সমান বড়ও হয় না। কিন্তু রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হল। বিশাল কালো ডানা নেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠছে প্রাণীটা, আবার ঝুপ করে পড়ছে পানিতে।
ঘোষকের পদটা দেয়া হয়েছে রবিনকে। দিনের বেশির ভাগ সময়ই কাকের বাসায় বসে থাকে, চোখ রাখে সাগরের দিকে। আকর্ষণীয় কোন প্রাণী দেখলেই চিৎকার করে জানায়। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে ছোটে জাহাজ। কাছে গিয়ে, যদি দেখা যায়, ধরার উপযোগী, তাহলে ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়।
হাত তুলে যেদিকে দেখাচ্ছে রবিন, সেদিকে জাহাজের মুখ ঘোরাল কলিগ। বিনকিউলার নিয়ে ছুটে এল কিশোর। মুসা তো বিশ্বাস করতে পারেনি না দেখে, দেখেও করতে পারল না। কী ওগুলো? জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেনকে।
সাগরের বাদুড়। জেলেরা বলে শয়তান মাছ।
কালো একঝাঁক দানব খেলা জুড়েছে পানিতে। দেখেই বুঝল কিশোর, এই জিনিসই চান লিসটার, তার চাহিদার তালিকায় রয়েছে এর নাম। ম্যানটা। আরেকটা নাম আছে এগুলোর, জায়ান্ট রে।
কিন্তু ধরবে কিভাবে? ট্যাংকে জায়গা হবে?
কাছে গিয়ে দেখা গেল, খেলছে না ম্যানটাগুলো। মাছ ধরে খাচ্ছে। কাছের বিশেষ একটা ম্যানটার ওপর নজর দিল ওরা। কাত হয়ে একটা সাঁতার কাটছে পানিতে, একটা ডানা পানির ওপরে, আরেকটা নিচে। এক ডানার মাথা থেকে আরেক ডানার মাথা বিশ ফুটের কম না। মাথা থেকে লেজের ডগা আঠারো ফুট। একঝাঁক মুলেটকে তাড়া করেছে ওটা।
মুখের দুপাশে দুটো লম্বা চ্যাপটা ডানার মত, কিংবা হাতও বলা যায়। ওগুলো দিয়ে মাছ ধরে ধরে ঠেলে দিচ্ছে মুখের ভেতর।
আর কি একখান মুখ! চার ফুট চওড়া। দুটো মানুষকে এক লোকমায় ঢুকিয়ে ফেলতে পারবে মুখের ভেতর।
কিন্তু কিশোর জানে, জায়ান্ট রে মানুষখেকো নয়। মাছই পছন্দ।
মানুষ খায় না বলেই যে নিরীহ, তা নয়। ভীষণ বিপজ্জনক। শোনা যায়, শূন্যে লাফিয়ে উঠে ডানা ছড়িয়ে ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ে নৌকার ওপর। দুই টনী দেহটা দিয়ে চেপে, বাড়ি মেরে গুড়িয়ে দেয় নৌকা, মেরে ফেলে আরোহীদের। চাবুকের মত লেজের বাড়ি ছুরির মত কেটে বসে চামড়ায়। কোন কোন সময় শূন্যে না উঠে নিঃশব্দে নৌকার তলায় চলে আসে ম্যানটা, তারপর ভেসে উঠে নৌকা উল্টে দেয়। আরোহীরা পড়ে গেলে ওদের মাঝে দাপাদাপি করতে থাকে। এতে মারা যায় মানুষ। যাদের ভাগ্য ভাল তারা জখম হয়।
মানুষকে ভয় করে না এরা। হয়ত ভয় করার মত বুদ্ধিই নেই। কিংবা হয়ত নিজের ক্ষমতার ওপর প্রচণ্ড বিশ্বাস। কখনও কখনও নৌকার সঙ্গে সঙ্গে মাইলের পর মাইল সাঁতরে চলে যায়, সামনে আসে, পেছনে যায়, পাশে সাঁতরায়, মাঝে মাঝে লাফিয়ে চলে যায় নৌকার একপাশ থেকে আরেক পাশে, আরোহীদের মাথার ওপর দিয়ে। দাড়ের বাড়ি যেন ওদের গায়েই লাগে না, ব্যথা পায় বলে মনে হয় না।
জাহাজ থেকে একবার একজন লোক একেবারে ম্যানটার মুখের ভেতর পড়ে গিয়েছিল। মানুষের স্বাদ মোটেও পছন্দ হয়নি ওটার, থুথু করে ছিটিয়ে ফেলেছিল। দানবটার নিচের পাটির দাঁতে লেগে চামড়া ছড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি লোকটার।
জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে পালে হাওয়া লাগানো কমালো কলিগ। ধীরে ধীরে ভেসে এসে থামল ম্যানটার ঝাঁকের ভেতর। ঝুলে পড়েছে পাল, পতপত করছে অলস ভঙ্গিতে। দুপাশে পানিতে উঠছে নামছে বড় বড় কালো ডানা। জাহাজটার সান্নিধ্য যেন পছন্দ হয়েছে দানবগুলোর। সঙ্গ ভালবাসে ওরা। সেজন্যেই দলবেঁধে থাকে অনেক সময়। গুনে ফেলল কিশোর। মোট আটাশটা ম্যানটা।
কিশোরের বিস্ময় দেখে হাসল কলিগ। তারপর? কাছে তো এলাম, এখন কি করা?
একটাকে জ্যান্ত ধরতে চাই।
খেত খোত করে নাক টানল ক্যাপ্টেন। তা পারবে না। মেরে হয়ত ভোলা যায়, জ্যান্ত ধরতে পারবে না। হারপুন বের করতে বলব?
না। কিশোর চেঁচিয়ে আদেশ দিতে আরম্ভ করল বড়দের মত করে, মুসা, কুমালো, জলদি নিচে থেকে বড় জালটা নিয়ে এস। জামবু, ডিঙি নামাও। ক্যাপ্টেন, জাহাজ সোজা রাখুন, নড়েচড়ে না যেন।
ভুরু কুঁচকে ফেলল কলিগ। কি করতে চাও?
বড় দেখে একটাকে ধরব। জালের একমাথা জাহাজে বেঁধে, আরেক মাথা। ডিঙিতে ধরে রেখে বেড় দেব।
পাগল…, থেমে গেল ক্যাপ্টেন। তার কথা শোনার জন্যে ওখানে দাঁড়িয়ে নেই কিশোর। বিড়বিড় করল সে, ছেলেটার মাথা খারাপ!
ভারি জালের একমাথা শক্ত করে বাঁধা হল জাহাজের ক্যাপস্ট্যানের সঙ্গে। জালের বাকি অংশ ডিঙিতে ফেলে তাতে উঠে বসল কিশোর, মুসা আর কুমালো। দাঁড় বেয়ে সরে যেতে লাগল জাহাজের কাছ থেকে, ধীরে ধীরে পানিতে পড়ছে জাল।
জালটা যখন পুরোপুরি পড়ে সারল, ডিঙি তখন জাহাজ থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে। জালের আরেক মাথা শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল ডিঙির ছোট একটা খুঁটির সঙ্গে, নোঙরের দড়ি বাঁধা হয় যেটাতে।
চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে জালে এসে ঠেকল বড় একটা ম্যানটা, ওটাকে নিশানা করেই ফেলা হয়েছে জাল। এরপর যা ঘটল এমনটি ঘটবে কল্পনাও করতে পারেনি কেউ।
ঘুরে এল ম্যানটা। নৌকাটাকে দেখলই না যেন। কাছে থেকে আরও বড় আরও ভয়ঙ্কর মনে হল ওটাকে। পানি থেকে উঠে রয়েছে জালের ওপরের অংশ।
কি করে যেন বুঝে গেল শয়তান মাছ, বাধা আছে সামনে। গতি কমাল না, বরং বাড়িয়ে দিল। বাড়ছে, বাড়ছে…স্পীডবোটের মত শা শা করে ছুটছে পানি কেটে।
তারপর হঠাৎ লাফ দিল শূন্যে। নিখুঁতভাবে জালটাকে পেরিয়ে গেল দশ ফুট ওপর দিয়ে। মনে হল, ঝড়ে উড়ে গিয়ে পড়ল একটা গ্যারেজের দরজা। বুমম করে বিকট শব্দ হল পানিতে পড়ার, যেন নেভির পাঁচ ইঞ্চি কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে।
পানিতে পড়েই আবার ছুটতে শুরু করল ম্যানটা, নতুন একটা চক্র রচনা করছে। তার উত্তেজনা সংক্রমিত হল অন্য দানবগুলোর মাঝেও, একের পর এক শূন্যে লাফিয়ে উঠতে লাগল ওগুলো, পানিতে পড়ছে প্রচণ্ড শব্দ তুলে। পড়েই, ডিগবাজি খেয়ে চিত হয়ে যাচ্ছে কোন কোনটা, রোদে ঝিক করে উঠছে সাদা পেট।
কৌতূহলী হয়ে উঠেছে নৌকাটাকে দেখে, দেখতে আসছে কাছে থেকে।
ব্যাটারা দল বেঁধে হামলা চালাবে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
ক্যাপ্টেনের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে কিশোর। বন্ধ উন্মাদই কেবল ডিঙি নিয়ে আটাশটা শয়তান মাছের ঝাঁকে নামার কথা ভাববে। কিংবা বোকা লোকে, জায়ান্ট রে সম্পর্কে যার কোন জ্ঞান নেই।
আরেকটা ম্যানটা এগোচ্ছে জালের দিকে। কাছাকাছি গিয়ে লাফিয়ে না পেরিয়ে শাঁ করে মোড় নিয়ে সোজা ছুটে আসতে লাগল নৌকার দিকে। হঠাৎ বুঝি চোখে পড়ল সামনের ডিঙিটাকে। লাফ দিল শূন্যে।
আরোহীদের চোখের সামনে থেকে সূর্য আড়াল করে দিল যেন একটুকরো কালো মেঘ। মাথা নিচু করে ফেলেছে কিশোর। ভাবছে, এখুনি বিশাল বপু নিয়ে ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে দানবটা। মুসাও মাথা নুইয়ে ফেলেছে। শুধু কুমালো পাটাতনের ওপরে বসে আছে হাসিমুখে, শান্ত। কারণটা বোঝা গেল। ডিঙিতে পড়ল না ম্যানটা। উড়ে গিয়ে পড়ল আরেকপাশে পানিতে। চাবুকের মত লেজটা বাড়ি লাগল নৌকার পাশে, গভীর একটা ক্ষত করে দিল।
কাছে এসে গভীর আগ্রহে নৌকাটাকে দেখছে আরেকটা শয়তান মাছ। আস্তে ডানা তুলে ছুঁয়ে দেখল, তাতেই থরথর করে কেঁপে উঠল ডিঙি। জোরে বাড়ি দিলে কি হত কে জানে! হঠাৎ ছুটতে শুরু করল, ঘুরে এগিয়ে যাচ্ছে জালের দিকে।
পেয়েছি ব্যাটাকে! চিৎকার করে বলল কিশোর।
যদি নতুন কোন কাণ্ড না করে, মাথা তুলল মুসা।
আমার মনে হয় শুধু এগোতেই পারে ওরা, পিছাতে পারে না।
পিছানোর কোন লক্ষণও দেখাল না ম্যানটা। তবে জালের কাছে গিয়ে মসৃণ ভঙ্গিতে তুলে ফেলল একটা ডানা, তারপর আরেকটা, নিখুঁত ভাবে জাল এড়াল। কিন্তু লেজটা বাঁধল বিপত্তি। জালের খোপে ঢুকে গেল। লেজের ডগায় বসানো কাঁটাগুলো আটকে গেল বড়শির মত।
বাও! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
ঝপাত করে পানিতে পড়ল দুই জোড়া দাঁড়। প্রাণপণে বেয়ে চলল মুসা আর কুমালো, জাহাজের দিকে ছুটল ডিঙি নিয়ে। দানবটার ওপর দ্রুত চেপে আসতে লাগল জাল।
কিন্তু এত সহজে ধরা দেয়ার পাত্র নয় শয়তান মাছ। দাপাদাপি শুরু করল। সে তো আর চুনোপুঁটি নয়, পানির মহারাজ। তার দাপাদাপিতে ফুলেফেঁপে উঠল পানি, প্রচণ্ড ঘূর্ণি, অসংখ্য ফোয়ারা, ভিজিয়ে চুপচুপে করে দিল ডিঙির তিন আরোহীকে। দেখতে দেখতে পানিতে ভরে গেল ডিঙির খোল ডুবে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে এখন খুদে নৌকা।
ভাগ্য ভাল, বুদ্ধি করে নৌকার সঙ্গে জাল বাধা হয়েছিল। ধরে রাখলে সর্বনাশ হত। হ্যাঁচকা টান লেগে একবার এদিকে ঘুরছে ডিঙি, আবার ওদিকে। কয়েকবার কাত হয়েও সোজা হয়ে গেল। আর সামান্য কাত হলেই যেত উল্টে।
অবশেষে জাহাজের কাছাকাছি চলে এল নৌকা। রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে ক্যাপ্টেন, চোখ বড় বড়, কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে বুঝি। জালের দড়িটা দাও আমার হাতে! চেঁচিয়ে বলল সে। কুইক!।
ডিঙির সঙ্গে বাঁধা দড়িটা খুলে ছুঁড়ে দিল কিশোর। খপ করে ধরল ক্যাপ্টেন। তাড়াতাড়ি নিয়ে গিয়ে পেঁচিয়ে ফেলল ক্যাপস্ট্যানে।
জালের দুই মাথা-ই এখন শক্ত করে বাঁধা হয়েছে ক্যাপস্ট্যানের সঙ্গে। আটকা পড়েছে দানবটা, পালানোর পথ বন্ধ।
কারগো বুমটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সরিয়ে আনছে জামবু। প্রধান মাস্তুলের সঙ্গে লাগানো রয়েছে ওটা, এক মাথায় একটা বড় আঁকশি লাগানো। আঁকশিটা জালে আটকে দিল কিশোর।
চাল হয়ে গেল ইঞ্জিন। আঁকশিটা ওপরে উঠতে লাগল, সেই সাথে টেনে তুলতে লাগল জাল।
হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল কাকের বাসায় বসা রবিন। তার সঙ্গে গলা মেলাল বোটের আরোহীরা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খুশি হওয়া উচিত হয়নি ওদের। জালের মধ্যে ভীষণ দাপাদাপি শুরু করেছে ম্যানটা, এখন আর খেলাচ্ছলে নয়, মুক্তির জন্যে। ডানা ঝাড়ছে, লেজ দিয়ে বাড়ি মারার চেষ্টা করছে। শপাং করে এসে বোটে লাগল লেজের বাড়ি। নৌকার যেখানে লাগল, গুড়িয়ে গেল ডিমের খোসার মত।
কখন পানিতে পড়ল, বুঝতেও পারল না মুসা। মাথা তুলে চেয়ে দেখল, তার পাশেই হাবুডুবু খাচ্ছে কিশোর। দ্রুত ওকে টেনে নিয়ে সাঁতরে ম্যাটার কাছ থেকে সরে এল সে। ওপর থেকে দড়ি ছুঁড়ে দিল কলিগ। সেটা ধরে বেয়ে ডেকে উঠে এল দুজনে।
এতক্ষণে কুমালোকে দেখতে পেল ওরা। শয়তান মাছের লেজের বাড়ি খেয়ে বোধহয় বেহুঁশই হয়ে গেছে বেচারা। ভাসছে। রক্ত বেরোচ্ছে ক্ষত থেকে। ইতিমধ্যেই রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছে হাঙরেরা, দূরে ভেসে উঠেছে ওদের পিঠের পাখনা। পানি কেটে ছুটে আসছে তীব্র গতিতে।
একটানে কোমরের খাপ থেকে বড় ছুরি বের করল মুসা।
বাধা দিল ক্যাপ্টেন, যেও না! বাঁচাতে পারবে না।
দূর, মরুক না ডুবে, ঘৃণায় মুখ বাঁকাল জামবু। একটা কানাকার জন্যে মরবে নাকি গিয়ে?
দ্বিধা যাও বা সামান্য ছিল মুসার, জামবুর কথায় একেবারে দূর হয়ে গেল। রাগে জ্বলে উঠল সে। ডাইভ দিয়ে পড়ল রক্তাক্ত সাগরে। দড়িটা নিতে ভুলল না। ওটার মাথা কুমালোর বুকে পেঁচিয়ে বাঁধল।
হাজির হয়ে গেল একটা হাঙর। হাত লম্বা করে ছুরিটা সোজা করে ধরে রাখল মুসা। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় লাগল হাঙরের শরীরে। ওটার ঘাড়ের নিচ থেকে লেজের কাছাকাছি লম্বা হয়ে ফেড়ে গেল গভীরভাবে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। খাবি খেতে খেতে দৌড় দিল একদিকে, যন্ত্রণায় শরীর মোচড়াচ্ছে। মানুষের দিক থেকে নজর সরে গেল অন্যান্য হাঙরগুলোর। ছুটে গেল জাতভায়ের মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে।
দড়ি ধরে টেনে তুলে নেয়া হল কুমালোকে। পানিতে অপেক্ষা করছে মুসা, আবার দড়িটা এলে তারপর উঠবে। চোখ হাঙরগুলোর দিকে। কয়েক গজ দূরে আহত হাঙরের গা থেকে মাংস খুলে নিচ্ছে অন্যগুলো। দেখতে দেখতে শেষ করে ফেলবে।
মুসার মনে হল, কয়েক যুগ পরে তার পাশে এসে পড়ল দড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে ধরল। টেনে তুলে নেয়া হল ওকেও।
একবার মাত্র চোখ খুলল কুমালো, মুসাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্যে, তারপরই মুদে ফেলল। পড়ে রইল মড়ার মত। কাকের বাসা থেকে নেমে এসেছে রবিন। সে আর কিশোর মিলে কুমালোর জখম ধুয়ে মুছে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতে লাগল।
গেল একটা চমৎকার ডিঙি, পানির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যাপ্টেন। জালের মধ্যে এখনও দাপাচ্ছে ম্যানটা। পানিতে আলোড়ন তুলেছে। তাতে ডুবছে ভাসছে নৌকার ভাঙা কাঠগুলো। নৌকা ভাঙার সমস্ত ঝাল গিয়ে ওটার ওপর পড়ল কলিগের। চেঁচিয়ে বলল, তোলো ব্যাটাকে! যেন তুললেই বেত দিয়ে পেটানো শুরু করবে।
উঠে যাচ্ছে জাল। ওপরে, আরও ওপরে। কামড়ে কয়েক জায়গায় জাল কেটে ফেলেছে শয়তান মাছ। এছাড়া আর কোন ক্ষতি করতে পারেনি সাংঘাতিক শক্ত জালটার। দানব ধরার জন্যেই যেন তৈরি হয়েছে ওটা। জালটাকে নামিয়ে আনা হল ট্যাংকের মুখের কাছে।
ট্যাংকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আন্দাজ করে ফেলল কিশোর। নাহ, অসুবিধে কিছুটা হলেও জায়গা হয়ে যাবে ম্যানটার। সত্যিই হয়ে গেল। কিন্তু নতুন বাড়ি মোটেও পছন্দ হল না শয়তান মাছের। আবার শুরু করল দাপাদাপি। ছিটিয়ে সমস্ত পানি ফেলে দিতে লাগল বাইরে। চালু করে দেয়া হল পাম্প, পালি, ভরতে লাগল ট্যাংকে। বড় ঢাকনাটা লাগিয়ে দেয়া হল, যাতে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারে অতিকায় প্রাণীটা।
ট্যাংকের দেয়ালে মোটা কাচে ঢাকা জানালা রয়েছে। সবাই হুড়াহুড়ি করে এসে চোখ রাখল তাতে, ভেতরে শয়তান মাছ কি করে দেখার জন্যে।
শান্ত হয়ে গেছে জায়ান্ট রে। ট্যাংকের তলায় বিছিয়ে রয়েছে মস্ত এক কালো চাঁদরের মত। জালটা এখনও জড়ানোই রয়েছে শরীরে।
খুলবে কি করে ওটা? রবিন জিজ্ঞেস করল।
দানবটার সঙ্গে আরেকবার ধস্তাধস্তি করার কোন ইচ্ছেই নেই কিশোরের। বলল, থাক, জালের মধ্যেই। বের করতে সুবিধে হবে। আশা করি দিন দুয়েকের মধ্যেই হনুলুলু পৌঁছবে। তখন কোন একটা মালবাহী স্টীমারে তুলে দেব, লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছে দেবে। ট্যাংকটা দরকার আমাদের। আরেকজনের জন্যে খালি করতে হবে।
কার জন্যে? অক্টোপাস?
হয়ত। মুসা, জনাব শয়তানের বাবুর্চি নিযুক্ত করা হল তোমাকে। জন্তুজানোয়ারকে খাওয়ানোর ব্যাপারটা তুমিই ভাল বোঝ। যত পার মাছ খাওয়াবে।
ডিঙি তো নেই, মাছ ধরব কিভাবে? বলেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুসার চোখের তারা। আছে, উপায় আছে!
কিভাবে? রবিন জানতে চাইল। রাতেই দেখবে।
রাতে, ডেকে বসে পালের ওপর টর্চের আলো ফেলে রাখল মুসা। আলো দেখে পাগল হয়ে গেল যেন উড়ুক্কু মাছের দল। একের পর এক এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল মাস্তুলে, পালে। বাড়ি খেয়ে অবশ হয়ে পড়ল কোনটা, কোনটা পাল থেকে গড়িয়ে পড়ল ডেকে। জমাতে শুরু করল মুসা আর কুমালো। মজা পেয়ে রবিন আর কিশোরও হাত লাগাল। দেখতে দেখতে মাছের ছোটখাট একটা স্থূপ দিয়ে ফেলল।
নিশ্চিন্ত হল তিন গোয়েন্দা। খাবারের অভাব হবে না জনাব শয়তানের।
৬
স্বর্গ যে বলে, ভুল বলে না! হাঁ করে তাকিয়ে আছে কিশোর। সৌন্দর্য যেন গিলছে। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে সুন্দর চোখের তারা। ডায়মণ্ড হেড ঘুরে এসেছে। শুকতারা, ওয়াইকিকির ধবধবে সাদা সৈকতের পাশ কাটাচ্ছে। সবুজ নারকেল গুচ্ছ মাথা দোলাচ্ছে বাতাসে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে জানা-অজানা অসংখ্য গাছ। ঘন। নীল সাগরের পানিতে সার্ফিং করছে সাফাররা। সাবোর্ডে টান টান হয়ে আছে। ওদের বাদামি শরীর। বিশালদেহী একেকজন।
হনুলুলু বন্দরে নোঙর ফেলল শুকতারা।
স্বপ্নের জগতে চলে এসেছে যেন ছেলেরা। পৃথিবীতে এত সুন্দর জায়গা থাকতে পারে, ভাবেইনি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারল না ওই স্বর্গে। বড় দেখে ট্যাংক কিনল, তাতে ম্যানটাটাকে ভরে তুলে দিল লস অ্যাঞ্জেলেসগামী একটা স্টীমারে।
হাওয়াইকে যে এত ভাল বলছে ছেলেরা, এটা পছন্দ হল না কুমালোর। কথায় কথায় জানিয়ে দিল, তার বাড়ি যে দ্বীপে, সেটা আরও অনেক ভাল। ছেলেরা যখন বিশ্বাস করতে চাইল না, বিশেষ করে মুসা, রেগে গেল সে। বলল, দাঁড়াও না, গিয়ে নাও আগে। ওখানকার প্রবাল অ্যাটল দেখলে চোখ ফেরাতে পারবে না। ওরকম কোথায় পাবে তোমাদের এই হাওয়াই? চওড়া বাদামি কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাওয়াইকে বুড়ো আঙুল দেখল দক্ষিণ দ্বীপবাসী।
।নতুন আরেকটা ডিঙি কিনে তোলা হল স্কুনারে। তারপর আবার রওনা হল শুকতারা।
মারশাল দ্বীপপুঞ্জের ছোট-বড় অসংখ্য দ্বীপের কাছাকাছি এসে তাজ্জব হয়ে গেল ছেলেরা। জলজ জীবের ছড়াছড়ি এখানকার পানিতে। তাকালেই চোখে পড়ে। জাহাজের পেছন পেছন দল বেঁধে আসছে ডলফিন। শাঁ করে জাহাজের পাশ কাটিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ফিরে আসছে আবার। লং জাম্প দিচ্ছে, হাই জাম্প দিচ্ছে, যেন একেকটা ভড়।
মস্ত এক স্পার্ম তিমি পুরো একটা দিন সঙ্গী হয়ে রইল শুকতারার।
আরেক দিন এল একটা হোয়েল শার্ক বা তিমি-হাঙর, জাতে ওটা হাঙরই, কিন্তু তিমির মত বড়। কুৎসিত চেহারা হলেও জীবটা নিরীহ, সমগোত্রের অন্যান্য প্রজাতির মত রক্তপিশাচ নয়। খেলার ছলে মাঝে মাঝেই এসে ধাক্কা মারল জাহাজের গায়ে।
রবিন জানে, জীবটা নিরীহ। ক্যাপ্টেন কলিগও বার বার বলেছে একথা। কিন্তু চেহারা এমনই বাজে তিমি-হাঙরের, ভুলতে পারেনি সে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। আতঙ্কে চেঁচাতে শুরু করল ঘুমের মধ্যে। জেগে উঠে দেখল ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। বদ্ধ কেবিনে দম বন্ধ হয়ে এল তার। খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে উঠে এল ডেকে।
রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রাতের সাগর দেখছে মুসা। ফিরে তাকাল। কি হল, ঘুম আসছে না?
এসেছিল, হেসে বলল রবিন। তিমি-হাঙরে গিলতে এল, তাই জেগে উঠে পালিয়ে এসেছি।
চকচক করছে রাতের সাগর, যেন একটা রূপালি চাদর। এর কারণ কোটি কোটি প্ল্যাঙ্কটনের সমষ্টি, ওগুলোর শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হয় একধরনের উজ্জ্বল আভা।…
জাহাজের পেছনে জাল বাধাই রয়েছে। তাতে ধরা পড়ছে নানারকম বিচিত্র প্রাণী। বদমেজাজী একটা কংগার ইল ধরা পড়ল অবশেষে। তারপর একটা তলোয়ার মাছ।
মাছটাকে নিয়ে সমস্যা হল। ওপরের ঠোঁটে লাগানো মারাত্মক তলোয়ারের জন্যেই মাছটার এই নামকরণএই অস্ত্র দিয়ে ইচ্ছে করলে এক খোঁচায় নৌকার তলা এফোঁড় ওফোড় করে দিতে পারে প্রাণীটা।
ধরার পর যথারীতি নিয়ে ট্যাংকে রাখা হল তলোয়ারকে। কিন্তু এক ঘন্টা যেতে না যেতেই জেল থেকে ছাড়া পাবার প্রয়াসে ট্যাংকের দেয়াল ফুটো করে দিল ওটা। সব পানি পড়ে যেতে লাগল। পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর চোখে পড়ল ব্যাপারটা। শুকনো ট্যাংকের তলায় পড়ে খাবি খাচ্ছে তখন বন্দি। তাড়াতাড়ি পাম্প ছেড়ে আবার পানি ভরে বাঁচানো হল তাকে। ফুটোটাও বন্ধ করা হল অনেক। চেষ্টা করে। কিন্তু আবার ঘটতে পারে ওরকম ঘটনা। কি করা যায়?
বুদ্ধিটা বাতলাল রবিন। বক্সিং গ্লাভস পরিয়ে দিলে কেমন হয়?
ইদানীং বক্সিং প্র্যাকটিস করছে মুসা। কয়েক জোড়া গ্লাভস কিনেছে। একজোড়া অন্তত সঙ্গে নিয়ে যায় যেখানেই যায়।
কেবিনে গিয়ে গ্লাভস বের করে আনল মুসা। রবিন আনল একটা থিমবল।
মুচকি হেসে ঠাট্টার সুরে বলল জামবু, এসব দিয়ে ওই তলোয়ার ঠেকাবে নাকি?
জবাব দিল না কেউ।
থিমবলটা বেশ বড়, নাবিকরা ব্যবহার করে এই জিনিস। দরজিরাও আঙুলে পরে, তবে ওগুলো ছোট। তলোয়ার মাছের তলোয়ারটা শক্ত করে চেপে ধরতে বলল রবিন। মুসা ধরলে, থিমবলটা তলোয়ারের মাথায় পরিয়ে দিল সে। গ্লাভস পরাল তার ওপর। তলোয়ারের মাথায় ছুরি দিয়ে ছোট একটা খাজ কেটে গ্লাভসের ফিতে শক্ত করে গিঁট দিয়ে বাঁধল। ব্যস, আর ছুটবে না গ্লাভস।
কয়েকবার ঝাড়া দিয়ে অস্বস্তিকর এই জিনিস খুলে ফেলার চেষ্টা করল। তলোয়ার। ব্যর্থ হয়ে শেষে খোঁচা মারতে শুরু করল ট্যাংকের দেয়ালে। লাভ হল না।
এতে আরও রেগে গেল তলোয়ার। চারশো পাউণ্ড শরীরটা নিয়ে বার বার গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল ট্যাংকের দেয়ালে। আঘাতের পর আঘাত হানল তলোয়ার দিয়ে। কিন্তু আগায় গ্লাভস আর থিমবল নিয়ে অস্ত্র এখন বাতিল। দূর, মরুকগে, বলেই যেন সরে এল তলোয়ার। নতুন মাছ ছাড়া হয়েছে ট্যাংকে। মহানন্দে সদ্ব্যবহার শুরু করল সেগুলোর।
ডাঙা! ডাঙা! কাকের বাসা থেকে চেঁচিয়ে বলল কুমালো।
কপালে হাত রেখে ভালমত তাকাল কলিগ। হ্যাঁ, ডাঙাই মনে হচ্ছে।
তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেলল তিন গোয়েন্দা, কিন্তু ডাঙা চোখে পড়ল না ওদের। দেখল অদ্ভুত এক দৃশ্য। একেবারে দিগন্তরেখার কাছে সবুজ, উজ্জ্বল একটুকরো মেঘ। না, মেঘ বলা বোধহয় ঠিক না, বরং বলা উচিত উজ্জ্বল একধরনের সবুজ আভা।
সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের কালে অনেক সময় সবুজ আভা চোখে পড়ে সাগরের আকাশে, কিন্তু এই মাঝ সকালে ওই সবুজ রঙ কিসের?
যেন জ্বলছে রঙটা। একবার মনে হচ্ছে সবুজ আগুনের শিখা, একবার সবুজ মেঘ, তারপর আবার সবুজ পানির ঢেউ। গায়েব হয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে আবার আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে।
ব্যাপারটা কি! তাজ্জব হয়ে দেখছে কিশোর। বুঝতে পারছে না।
কাকের বাসা থেকে নেমে এসেছে কুমালো। কিশোরের বিস্ময় দেখে হাসল। ওটা বিকিনি অ্যাটল। দেখা যাচ্ছে না এখনও, আকাশের ওই সবুজ রঙ দেখে বুঝেছি।
জ্বলছে কেন? আলোর কারসাজি। ধবধবে সাদা বালিতে ঢাকা ওখানকার ল্যাগুনের তলা। রঙিন প্রবাল আছে অনেক। পানির গভীরতাও মাঝে মাঝে খুব কম। সব কিছু মিলিয়ে ওখানকার পানির রঙ হয়ে গেছে হালকা সবুজ, ওটারই ছাপ পড়েছে আকাশে। মরীচিকাও বলতে পার। দ্বীপটা দেখার আগে অন্তত ছসাত ঘন্টা ধরে দেখা যাবে ওই মরীচিকা।
শেষ বিকেলে দিগন্তে উদয় হল বিকিনি। নারকেল বীথির মাথা দেখা যাচ্ছে শুধু, নিচটা এখনও অদৃশ্য। এগিয়ে চলেছে জাহাজ। রেলিঙে দাঁড়িয়ে অ্যাটলের সৌন্দর্য দুচোখ দিয়ে পান করছে যেন তিন গোয়েন্দা। এই প্রথম দেখছে প্রবাল অ্যাটল।
দূর থেকে মনে হয়, মুক্তার একটা হার যেন অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে নীল চাঁদরের বিছানায়। ওটা আর কিছু না, ল্যাগুনকে ঘিরে রাখা বিশাল প্রবাল প্রাচীর। সগর্জনে দেয়ালে আছড়ে পড়ে সাদা ফেনা সৃষ্টি করেছে ঢেউ, কিন্তু দেয়ালের ভেতরে ঢোকার অধিকার আদায় করতে পারছে না কিছুতেই। ভেতরের পানি শান্ত, স্থির, আকাশের রঙের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে। সাগরের মধ্যিখানে যেন দেয়ালে ঘেরা এক মস্ত হ্রদ। কলিগ জানাল ল্যাগুনটা বিরাট, বিশ মাইল চওড়া।
এতবড় প্রাচীরটার স্রষ্টা প্রবাল নামের এক অতি ক্ষুদ্র কীট। বীজ, ফল, উদ্ভিদের চারা ভেসে ভেসে গিয়ে ঠেকেছে ওই প্রাচীরে, আটকে গেছে পচা প্রবাল আর বালিতে। ফলে যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে মোহনীয় সবুজ দ্বীপ। সাদা প্রবাল পাথরের মাঝে ফুটে উঠেছে সবুজ।
এসব দ্বীপের কোনটা খুবই ছোট, বড় জোর ওদের স্কুনারটার সমান। কোন কোনটা আবার বেশ বড়, মাইলখানেক লম্বা। তবে চওড়ায় অনেক কম। সব চেয়ে বড়টাও মাত্র কয়েকশো গজ।
তিনটে জায়গায় ফাঁক আছে দেয়ালে। ওগুলো দিয়ে জাহাজ ঢোকানো সম্ভব। দক্ষিণ-পুবের পথটার দিকে এগিয়ে গেল শুকতারা। ভালই চলছিল, হঠাৎ পড়ে গেল বাতাস। ঘুরে গেল জাহাজের নাক। পাশ থেকে ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে শুরু করল ঢেউ। ভীমগর্জনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গায়ে। দেয়ালের ফাঁক দিয়ে তীব্র গতিতে ঢুকছে জোয়ারের পানি। পরস্পর বিরোধী স্রোতের মাঝে পড়ে প্রায় নাকানিচোবানি খেতে শুরু করল জাহাজটা।
অভিজ্ঞ নাবিক ক্যাপ্টেন কলিগ। দক্ষ হাতে জাহাজের হুইল ধরে ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল শুকতারাকে। পরিশ্রম করতে হল অনেক, কিন্তু নিরাপদেই অবশেষে জাহাজটাকে নিয়ে এল ল্যাগুনের ভেতরে। শান্ত নিথর পানিকে মনে হচ্ছে এক বিশাল সবুজ আয়না। নারকেল গাছে ছাওয়া ছোট্ট একটা দ্বীপের সাদা সৈকত থেকে একরশি দূরে নোঙর ফেলা হল।
গভীর মনোযোগে ক্যাপ্টেনের চার্ট দেখছে কিশোর। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, এই প্রবাল প্রাচীরে দ্বীপ মোট বিশটা। সব চেয়ে কাছেরটার নাম এনিও। তারপরে রয়েছে বিকিনি, অ্যাওমোয়েন, ন্যামু, রুকোজি, এনিরিকু। আরেকটা আছে, নাম উচ্চারণ করতে গেলে চোয়াল ভাঙার অবস্থা—ভোকোরোরাইওরো।
উত্তর-পূর্ব কোণে একটা ক্রসচিহ্ন। ম্যাপে দেখানো ল্যাগুনের ওই জায়গায় আঙুল রেখে কিশোর জিজ্ঞেস করল, এখানে কি?
আণবিক বোমার পরীক্ষা হত ওখানে, জবাব দিল ক্যাপ্টেন। রেডিও অ্যাকটিভিটির ভয় নেই?
নাহ, এখন আর নেই। শেষ পরীক্ষা হয়েছে ঊনিশশো ছেচল্লিশ সালে। তেজস্ক্রিয়তায় ছেয়ে গিয়েছিল তখন সবকিছু, মাটিতে, নারকেলে, এমনকি মাছেও। অনেক পরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে ঘোষণা দিয়েছেন, তেজস্ক্রিয়তা কমে গেছে। এখন আর মানুষের জন্যে তেমন ভয় নেই, যদি বেশিদিন না থাকে এখানে।
স্থানীয় অধিবাসীদের কি হল? পরীক্ষার আগে নিশ্চয় ছিল ওরা?
ছিল, একশো পঁষট্টি জন। তাদের রাজার নাম জুডা। রংগারিক আইল্যাণ্ডে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল ওদের, এখান থেকে একশো তিরিশ মাইল পুবে।
কাজটা উচিত করেনি। বাপদাদার জায়গা থেকে তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে। নতুন জায়গায় গিয়ে মানিয়ে নিতে নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়েছে।
খুর। মানাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। রংগারিকে মাছ নেই, ফলের গাছও খুব কম। শেষে বাধ্য হয়ে আমেরিকান নেভির কাছে আবেদন করেছে রাজা, তাদের খাবার ব্যবস্থা করার জন্যে। তাই ওখান থেকেও সরাতে হয়েছে ওদেরকে, উজিলং আইল্যাণ্ডে।
এখন তাহলে ওখানেই আছে?
আছে। তবে সুখী নয়। তাদের শত শত বছরের পুরানো জীবনধারা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। উজিলাংও এখানকার তুলনায় ভাল না। খাবারের জন্যে তাদের নির্ভর করতে হয় আমেরিকান নেভির ওপর। ফলে জীবনের ওপরই ঘেন্না ধরে গেছে ওদের।
দুঃখজনক। বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকেই অনেক শয়তানী করেছে। এখনও কি কোন পরীক্ষা চলছে নাকি এখানে?
বলা কঠিন। তবে এখন বেশি পরীক্ষা চলছে এনিউইটক অ্যাটলে, এখান থেকে দুশো মাইল পশ্চিমে। ওটার পাশ দিয়েই যাব আমরা।
ওখানকার আদিবাসীদেরও নিশ্চয় দেয়া হয়েছে?
হয়েছে। একশো সাতচল্লিশ জন। নীল চোখের চারপাশে রোদে পোড়া চামড়া হাসিতে বঁচকে গেল ক্যাপ্টেনের। আরি, কেঁদে ফেলবে নাকি! সাধারণ কয়েকটা কানাকা। সব সময়ই শাসন করা হয়েছে ওদের, ভবিষ্যতেও করা হবে।
ভারতবর্ষ আর আফ্রিকায় ইংরেজ শাসনের ইতিহাস মনে পড়ল কিশোরের। কঠিন একটা কথা চলে এসেছিল মুখে, অনেক কষ্টে সামলাল।
ডিঙি নামিয়ে তীরে উঠল সবাই। অনেক দিন পর পায়ের তলায় মাটি বেশ ভাল লাগল। দ্বীপ না বলে ওটাকে চমৎকার একটা বাগান বলা উচিত। তেজস্ক্রিয়ায় কোন এক সময়ে গাছপালার ক্ষতি হয়ে থাকলেও এখন তার চিহ্ন নেই। মানুষের ভয়াবহ আঘাত সামলে নিয়েছে প্রকৃতি।
পুরো দ্বীপটা ঘুরে আসতে মাত্র আধঘন্টা সময় লাগল। রাতে খাবার খেল অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে। কিশোর লক্ষ্য করল, বারবার সৈকতে চলে যাচ্ছে কুমালো, কি জানি, বোধহয় ল্যাগুনে রাতের স্তব্ধ আকাশ ভাল লাগছে। গত কয়দিনে লোকটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে তার। শান্ত, হাসিখুশি। সাহস, ধৈর্য, সবই আছে লোকটার। স্কুনার চালানো দেখেই বোেঝা যায় জাত নাবিক। পছন্দের জায়গায় এসে কেমন লাগছে এখন তার?– খুব জানতে ইচ্ছে হল কিশোরের।
আগুনের ধার থেকে উঠে সৈকতে রওনা হল সে। একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে ল্যাগুনের দিকে তাকিয়ে আছে কুমালো। পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর, কিন্তু নীরবতা ভাঙতে ইচ্ছে হল না। চুপ করে রইল।
ল্যাগুনটা এখন কালো। দিনে ছিল সবুজ, এখনকালো আয়নার মত। তাতে আকাশের প্রতিবিম্ব। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীলচে-সাদা অভিজিৎ নক্ষত্র, হলদে স্বাতীনক্ষত্র, আগুন-লাল অ্যানটারিস। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই উঠবে সাদার্ন ক্রস, রকিবীচের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট দেখা যাবে এখানে, কারণ বিষুবরেখার কয়েক ডিগ্রি উত্তরে রয়েছে এই বিকিনি।
প্রবাল প্রাচীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের চাপা গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ল্যাগুনের ওপাশে অন্যান্য দ্বীপগুলো সব অন্ধকার।
আমার বাবা একবার এসেছিল এখানে, বহুদিন আগে, কথা বলল কুমালো। শুনেছি, তখন মানুষ থাকত এখানে। দ্বীপে আনন্দ ছিল। এখন নেই।
নিশ্চয় অ্যাটম বোম…
হ্যাঁ…
পাশাপাশি বসল ওরা। এই সময় মুসা আর রবিনও এসে বসল ওখানে।
কুমালো, কিশোর বলল। এত ভাল ইংরেজি কোথায় শিখলে তুমি? এদিকের লোকে তো ভাল ইংরেজি জানে না শুনেছি।
হাসল কুমালো। তারার আবছা আলোতেও চকচক করে উঠল তার সাদা দাঁত। আমার ইংরেজি তোমার পছন্দ হয়েছে? খুশি হলাম। এক আমেরিকান মিশনারি মহিলার কাছে লেখাপড়া শিখেছি। খুব ভাল মানুষ ছিলেন তিনি। যত্ন করে কত কিছু শিখিয়েছেন আমার দেশের লোককে। ভাল বিদেশী খুব কমই যায় ওখানে।
কুমালো কি বলতে চায়, বুঝল কিশোর। ইউরোপিয়ান আর আমেরিকানরা আগে দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলোতে আসত নারকেলের ছোবড়া আর মুক্তার লোভে, করুণা খুব কমই মিলত তাদের কাছে। স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে ওরা ছড়িয়েছে মারাত্মক রোগ, শিখিয়েছে কড়া মদে নেশা করা, খুন করেছে পাইকারি হারে, নির্মমভাবে, কারণ ওদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র।
গত কয়েক দিনে একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেছে সে, ক্যাপ্টেন আর জামবু দেখতে পারে না কুমালোকে। তারমানে ওদের দলে নেই লোকটা। তথ্য বের করার জন্যে বলল, কুমালো, তোমার দেশের কথা বল।
শুনবে! অবাক মনে হল দ্বীপের বাসিন্দা মানুষটাকে। আমাদের কথা শুনবে তুমি?
বল, রবিন বলল।
অনেক কথাই বলল কুমালো। ওদের সমাজের অনেক কিছু জানল ছেলেরা। বন্ধুত্ব পাতানোর অদ্ভুত একটা রীতি রয়েছে ওখানকার দ্বীপগুলোতে। বন্ধুকে বন্ধু বলে না ওরা, বলে রক্তে-পাতানো-ভাই। এক বন্ধুর জন্যে আরেক বন্ধু নির্দ্বিধায় জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
শুনতে শুনতে হঠাৎ বলে উঠল মুসা, কুমালো, আমার সঙ্গে নাম বিনিময় করবে তুমি?
আবেগে গলা রুদ্ধ হয়ে এল কুমালোর। তারার আলোয় দেখা গেল তার বাদামি গালে চিকচিক করছে পানির ধারা, দুগাল বেয়ে নেমেছে অশ্রু। আচমকা বিশাল দুই থাবার মধ্যে চেপে ধরল মুসার একটা হাত। নিশ্চয় করব, মুসা! আমার হৃদয়ে আমি এখন মুসা, তোমার হৃদয়ে তুমি কুমালো। তুমি আমার রক্তেপাতানো-ভাই। একজনের জন্যে আরেকজন দরকার হলে জীবন দিয়ে দেব আমরা। ইতিমধ্যেই সেটা তুমি করতে চেয়েছে নিজের জীবনের পরোয়া না করে হাঙরের মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছ আমাকে।
৭
কয়েক দিন সাগরে কাটিয়েও আশ মিটিয়ে সাঁতার কাটতে পারেনি সাগরপাগল মুসা আমান। প্রথম সুযোগটা পেয়েই তার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না। পরদিন সকালে জামাকাপড় খুলে ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে।
দেখে হাসল রবিন আর কিশোর কুমালো, জামবু আর ক্যাপ্টেনকে নিয়ে প্রবাল প্রাচীরের কিনার ধরে হেঁটে চলল ওরা।
চলতে চলতে থেকে থেকেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কিশোর। উঁকি দিয়ে দেখছে পানিতে। ধরার মত কিছু মেলে কিনা দেখছে। অল্প পানিতে একটা অক্টোপাসের বাচ্চা চোখে পড়ল। আরেকটা। তারপর আরেকটা। খুব ছোট ছোট, বাসনের সমান। কয়েকটা ধরল কুমালো। জানাল, খেতে নাকি দারুণ লাগে, বিশেষ করে অক্টোপাসের শুড়ের কাবাব।
মুসা ওদিকে শুরু করেছে তুমুল দাপাদাপি। ডুবছে, ভাসছে। দেখলে এখন মনে হবে পানিরই ছেলে সে, পানিতে তার ঘর। কয়েকবার ডুবে, ভেসে শরীরটাকে গরম করে নিয়ে সাঁতরে চলে এল অপেক্ষাকৃত গভীর পানিতে। খাড়া ডুব দিয়ে চলে এল বারো-তেরো ফুট নিচে। চোখ দিয়ে যেন গিলছে প্রবালের। অপূর্ব রূপ। পানির নিচ দিয়েই সাঁতরে চলে এল দেয়ালের কাছে। ভাসল। লম্বা দম। নিয়ে আবার ডুব দিল।
দেয়ালের এক জায়গায় একটা ফোকর চোখে পড়ল। ঢুকে পড়ল ওটার ভেতরে। একটা সুড়ঙ্গ। ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে সাঁতরে চলে এল পানির তলার একটা গুহায়। সূর্যের আলো এসে পড়েছে প্রবালের গায়ে, প্রতিফলিত হয়ে মিষ্টি কোমল নীল আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে গুহাটা। এই সৌন্দর্য বর্ণনা করা কঠিন, যেন এক পরীর রাজ্যে চলে এসেছে সে। অসাধারণ শিল্পীর পরিচয় রেখেছে এখানে। প্রবালকীট। দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে ওদের রঙিন শিল্পকর্ম। শুধু রঙ আর রঙ, নীলসাদা, গোলাপী, সবুজ, চোখ জুড়িয়ে যায়।
দম ফুরিয়ে আসছে। পরীর বাগান দেখার জন্যে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না মুসা। সাঁতরে বেরিয়ে আসতে যাবে, এই সময় লক্ষ্য করল, ছাতটা পানির ওপরে। মাঝে ফাঁকা। তারমানে বাতাস আছে। না-ও থাকতে পারে, একথাটা একবারও মনে এল না তার। ভুস করে মাথা তুলল। ফাঁক বেশি না। কাঁধ পর্যন্ত ভাসাতে পারল সে।
হঠাৎ একটা দুষ্টবুদ্ধি মাথাচাড়া দিল মনে। যদি এখন না ফেরে, দেরি করে যায়, কি ঘটবে? সবাই তাকে ডুব দিতে দেখেছে। ভেসে না উঠলে ওরা ভাববে ডুবে মরেছে সে। পানিতে নেমে খোঁজাখুঁজি করবে তাকে। তবে পাওয়ার আশা কম। কারণ সে রয়েছে গুহার ভেতরে।
ওরা যখন তাকে মৃত ধরে নিয়ে হাহুতাশ শুরু করবে, তখন ভাসবে সে। বুঝতে পারবে, সত্যি সত্যি সে মারা গেলে কিশোর, রবিন, কুমালো কে কতটা শোক করবে।
নাক উঁচু করে ভেসে আছে মুসা। সহজেই শ্বাস নিতে পারছে। তারমানে প্রবালের মাঝে সূক্ষ্ম ছিদ্র রয়েছে, অনেকটা স্পঞ্জের মত, সেই ছিদ্রপথে গুহায়। ঢুকছে বাতাস।
ওপরে চেঁচামেচি শুরু হল, গুহায় থেকেই শুনতে পাচ্ছে মুসা। পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার শব্দ হল।
দশ মিনিটের মাথায় লম্বা দম নিয়ে ডুব দিল সে। বেরিয়ে এল গুহা থেকে। ভাসল না। ডুব সাঁতার দিয়ে সরে এল প্রায় বিশ গজ দূরে। পানির কিনারে ওখানে জন্মে আছে একগুচ্ছ নারকেল গাছ। আস্তে পানি থেকে উঠে ওটার ভেতরে ঢুকে বসে রইল সে।
কানে এল কিশোরের কথা, কি করে যে গিয়ে ওর বাবাকে বলব! হায় হায়রে, কেন যেতে দিলাম! কেন মানা করলাম না!
ক্যাপ্টেন বলল, বেচারা! ছেলেটা ভাল ছিল। সত্যি দুঃখ হচ্ছে ওর জন্যে।
রবিন বলল, কেঁদে কেঁদেই মরে যাবে ওর মা!
আমাদের তিন গোয়েন্দাগিরি এখানেই শেষ! আফসোস করল কিশোর। মুসাকে ছাড়া কিছুই করতে পারব না আমরা।
জামবুও দুঃখ প্রকাশ করল। আন্তরিক কিনা বোঝা গেল না যদিও।
কুমালো নেই ওখানে। খানিক পরে উঠে এল পানি থেকে। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছে, মিশনারি মহিলার কাছেই শিখেছে নিশ্চয়। কিশোরের কাঁধে হাত রেখে কাঁদো কাঁদো গলায় সান্ত্বনা দিল, দুঃখ কোরো না। যে মরে গেছে, তার জন্যে আফসোস করতে নেই, তাহলে তার আত্মার অকল্যাণ হয়, পাখিকে শেখানো বুলি ঝাড়ছে যেন। আবার ওর সঙ্গে দেখা হবে আমাদের। স্বর্গে…
আর থাকতে পারল না মুসা। হো হো করে হেসে উঠল। বেরিয়ে এল নারকেল গাছের আড়াল থেকে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। কুমালো হাসল। রবিনও। কিশোর গম্ভীর। শুধু বলল, কাজটা ভাল করনি।
ছিলে কোথায় এতক্ষণ? রবিন জিজ্ঞেস করল। গাছের আড়ালেই?
না, কয়েক মিনিট ধরে আছি। এর আগে পানিতেই ছিলাম।
এতক্ষণ?
বিশ্বাস না হলে আবার দেখ। প্রমাণ করে দিচ্ছি। যতক্ষণ বল ততোক্ষণ পারব।
ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ল মুসা।
আবার গুহায় ঢুকল। মোটা সাপের মত কি যেন একটা পড়ে আছে মেঝেতে। ওটার আরেক মাথা গিয়ে ঢুকেছে গুহার দেয়ালে একটা কালো বড় ফোকরে। শ্বাস নেয়ার জন্যে ভেসে উঠল সে। দম নিয়ে সাপের মত জিনিসটা ভালমত দেখার জন্যে আবার ডুব দিল সে। পরিষ্কার দেখা যায় না। কারণ একটা জিনিসেরই একেক জায়গায় একেক রকম রঙ। পটভূমি, অর্থাৎ যেটার ওপর পড়ে আছে তার যে-রকম রঙ ঠিক সে-রকম। যেখানে প্রবালের রঙ লাল, সেখানে ওটাও লাল, যেখানে নীল সেখানে নীল, সাদা হলে সাদা, কালো জায়গা কালো।
এইসময় একই রকম আরেকটা সাপ চোখে পড়ল তার। তারপর আরও দুটো। সব কটাই গিয়ে ঢুকেছে সেই কালো ফোকরে।
কি আছে কালো গর্তটার ভেতরে? আরও কাছে গিয়ে দেখার পর নজরে পড়ল। কালো গর্তের মতই কালো একটা জিনিসের অর্ধেক বেরিয়ে আছে ফোকরের বাইরে, বাকি অর্ধেক ভেতরে। ফোলা একটা বস্তার মত। দুটো চোখও লাগানো বস্তার গায়ে। ছোট ছোট চোখ, শয়তানি ভরা তির্যক চাহনি, তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। আশেপাশের রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে ঘাপটি মেরে রয়েছে ওটা, শিকারের জন্যে ওত পেতেছে। বিশাল এক অক্টোপাস!
অবাক নয় সে, আতঙ্কিত। বোঝা উচিত ছিল, অল্প পানিতে যখন অসংখ্য বাচ্চা রয়েছে, বুড়োটাও রয়েছে কাছাকাছি কোঞ্চও। কল্পনাই করেনি গুহার মধ্যে বসে আছে ওটা।
আস্তে ভেসে উঠে ফুসফুস ভর্তি করে বাতাস নিল মুসা। জানে, সময়মত বেরোতে না পারলে, জানোয়ারটার সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লে অক্সিজেন দরকার হবে। পানিতে সামান্যতম আলোড়ন না তুলে আবার ডুব দিল সে। সোজা এগোল সুড়ঙ্গের দিকে। সরে যাচ্ছে…যাচ্ছে…আর একবার পা নাড়া, তাহলেই ঢুকে যাবে সুড়ঙ্গে…
ঠিক এই সময় আলতো করে তার গোড়ালি জড়িয়ে ধরল কোন কিছু। খুব দ্রভাবে টেনে নেয়া হতে লাগল তাকে গুহার ভেতরে। ছাড়ানোর জন্যে ঝাড়া মারল সে, ছুটতে পারল না। ধরেছে নরমভাবে, কিন্তু বাঁধন ভীষণ শক্ত।
ছুরির জন্যে হাত বাড়াল মুসা। ধক করে উঠল বুক। নেই! মনে পড়ল, প্যান্টের বেল্টে আটকানো রয়েছে ছুরির খাপ, কাপড় খোলার সময় ওটা খুলে রেখে এসেছে সৈকতে।
দুহাতে ধরে তঁড়টা ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। চ্যাপ্টা হুঁড়, পেটের দুই কিনারে দুই সারি সাকশন কাপ। চামড়া থেকে ওগুলোর তীব্র আকর্ষণ ছুটানোর সাধ্য তার হল না। বরং টের পেল, আরেক হুঁড় দিয়ে আরেক পা জড়িয়ে ধরা হচ্ছে, তৃতীয় আরেকটা ঔড় খুঁয়োপোকার মত তিরতির করে হেঁটে যাচ্ছে কাঁধের ওপর দিয়ে।
সাহায্যের জন্যে চিৎকার শুরু করল মুসা। এখন হয়ত তার মাথার ওপরেই রয়েছে সবাই, তার বেরোনোর অপেক্ষা করছে, তাকিয়ে আছে পানির দিকে। তার ডাক ওদের কানে গেলে নিশ্চয় দেখতে আসবে।
চিৎকার করায় অতি মূল্যবান অক্সিজেনের অনেকটাই বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। আর আধ মিনিটের মধ্যে যদি দম নিতে না পারে, জ্ঞান হারাবে। শুড় ছাড়ানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রাণপণে গুহার ওপরে ভেসে উঠতে চাইল সে। দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে থাকা প্রবাল ধরে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করল শরীরটা।
ভারি একটা শুড়ের চাপ রয়েছে কাধে। ওটা কিছুতেই সরাতে পারল না সে। শেষে মরিয়া হয়ে কাধ নিচু করে চোখা প্রবালে ঘষা মারল শুড়টা।
গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস, একেবারে মানুষের মত। কাঁধের ওপর শুড়ের চাপ কমার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়া দিয়ে ওটাকে নামিয়ে দিল মুসা দুই পায়ের বাঁধন আগের মতই রয়েছে। তবু কাধ থেকে শুড়টা সরাতে পারায় ভেসে উঠে দম নেয়া সম্ভব হল।
তারপর শুরু করল চিৎকার। গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল, কিশোর! রবিইন! দোহাই তোমাদের! আমাকে বের কর! অক্টোপাসে ধরেছে!… কুমালোওওও…
চেঁচিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলল সে। কোন সাড়া এল না।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে চাইল তার, ভয়ে। রসিকতা করেছে ওদের সঙ্গে একটু আগে। ওরা হয়ত ভাবছে আবার নতুন কোন রসিকতা। মনে পড়ল সেই মেষ পালকের কথা। বাঘ এসেছে! বাঘ এসেছে! বলে অযথা। চেঁচিয়ে সত্যি সত্যি বাঘ যখন এল কেউ এল না তাকে সাহায্য করতে পায়ে টান লাগল।
কিশোওর! দোহাই তোমাদের! প্রায় কেঁদে ফেলল মুসা। আল্লার কসম, অক্টোপাস…
কথা শেষ করার আগেই টান মেরে পানির তলায় নিয়ে গেল তাকে জীবটা। এগিয়ে এল বাকি গুঁড়গুলোও। এক এক করে জড়িয়ে ধরতে লাগল কাঁধ, বুক, পেট।
আমাজানের জঙ্গলের বোয়া-কনসট্রিকটরের কথা মনে পড়ল। ভয়ঙ্কর সাপ। একেকটা শুড়কে একেকটা সাপ বলে মনে হল এখন, তারমানে মোট আটটা সাপ। একযোগে আক্রমণ করেছে। শক্ত হচ্ছে চাপ, আগের মত আলতো ভাব আর নেই। পেট বসে যাচ্ছে চাপের চোটে, হাঁসাস করছে ফুসফুস, পাগল হয়ে এলোপাতাড়ি বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ড।
ছায়া নামল এই সময় গুহার ভেতরে, সূর্যকে মেঘে ঢেকে দেয়ায় রোদ পড়ে গেল যেন। তারমানে সুড়ঙ্গে ঢুকেছে কেউ, আলো আসায় বাধা পড়েছে। আশার আলো জ্বলল মুসার মনে। নিশ্চয় কুমালো! অনেক কষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, সে, কে এসেছে দেখার জন্যে। কুমালো নয়, সুড়ঙ্গমুখে দেখা দিল মস্ত এক হাঙ্গরের মাথা, টাইগার শার্ক। রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছে সাগরের কসাই। প্রবালের ঘষায় মুসার শরীরের কয়েক জায়গা কেটে রক্ত বেরোচ্ছে।
অনাহূত আগন্তুককে দেখেই রেগে লাল হল অক্টোপাস। ঢিল হল শুড়ের বাঁধন। সত্যি সত্যি লাল রঙ এখন শরীরের।
এমনিতেই ফোলা ঢোল, পানি টেনে নিয়ে আরও ফুলে পিপা হয়ে যেতে লাগল বস্তার মত শরীরটা। হঠাৎ বেরিয়ে গেল টেনে নেয়া সমস্ত পানি, শত্রুর দিকে টর্পেডোর মত ছুটে গেল অক্টোপাস। এত জোরে গেল, ওটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হেরে গেল মুসার দৃষ্টি।
জেট প্লেন বা রকেটের সঙ্গেই শুধু তুলনা করা চলে ওই গতিকে। ব্যতিক্রম শুধু, ওগুলোর পেছনের ফুটো দিয়ে বেরোয় গ্যাস, আর এটার বেরোল পানি। শুড়গুলো লম্বা হয়ে ছুটে গেল বস্তাশরীরের পেছনে, যেন ধূমকেতুর পেছনে তার ছড়ানো ফোলা লেজ।
আটটা শুড়ের শতশত সাকশন কাপ দিয়ে কষে চড় লাগাল অক্টোপাস বেহায়া মাছের গায়ে যত্রতত্র। ব্যাটা, আমার শিকার ছিনিয়ে নিতে আস! এত্তো সাহস! বেরিয়ে গেল হাঙর। ছাড়ল না অক্টোপাস। সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়েই রুখে দাঁড়াল বাঘা হাঙরের বাচ্চা, সে-ও কম শক্তিশালী নয়। গুহার ভেতরে জায়গা কম, নড়তে চড়তে অসুবিধে, তাই বের করে নিয়ে গেছে অক্টোপাসটাকে।
সুড়ঙ্গের এপাশে থেকে ওপাশে ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছে মুসা, পলকের জন্যে মাঝে মাঝে শুধু চোখে পড়ছে পাখনা কিংবা শুড় নড়ানো। দৃষ্টি আরও অচল হয়ে গেল, যখন কালির থলে থেকে একরাশ কালো কালি ছুঁড়ে মারল অক্টোপাস। পানিতে কালো মেঘের মত ছড়িয়ে পড়ল কালি।
এখন বাইরে বেরোনো আত্মহত্যার সামিল। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে মুসা। প্রার্থনা করছেঃ আল্লাহ্, সরে যাক ব্যাটারা, খালি একটু দূরে সরুক! আমি বেরোতে পারলেই হয়! আল্লাহ…
আবার চেঁচাতে শুরু করল সে। কাছাকাছি কি কেউ নেই নাকি? ভয়াবহ লড়াই চোখে পড়ছে না কারও? পানিতে ওই আলোড়ন দেখতে পাচ্ছে না?
পানিতে এখন কালি গোলা। কিছু দেখতে পাচ্ছে না মুসা। দানব দুটো আছে না গেছে, বোঝার উপায় নেই।
ঠিক করল সে, ঝুঁকি নেবে। লম্বা দম নিয়ে ডুব দিল। কিন্তু ফিরে এসে ভেসে উঠতে বাধা হল আবার। কারণ, সুড়ঙ্গমুখে চকিতের জন্যে আবছাভাবে চোখে পড়েছে বস্তা-শরীরের মুখ। ওপাশের কালো মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
একা। তাড়িয়ে দিয়ে এসেছে শত্রুকে। আট পায়ে ভর দিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাঁটছে গুহার মেঝেতে, বিরাট এক মাকড়সার মত।
শিকারের দিকে তাকিয়ে নাচ জুড়েছে যেন। আটকা পড়া ইঁদুরকে ধরার আগে ঠিক এরকম ভাবভঙ্গিই করে বেড়াল। সারা শরীরে ওটার এখন রামধনুর সাত রঙ। কুমালো আর কলিগের কাছে জেনেছে মুসা, খুব বেশি রাগলে শরীরের রঙ ওরকম হয়ে যায় অক্টোপাসের।
আবেগ বোঝার ক্ষমতা আছে এদের। বাচ্চাকে কাছে টেনে আদর করে, শত্রু দেখলে খেপে যায়। মাছের চেয়ে অক্টোপাসের মগজ অনেক উন্নত। মানুষের মত চোখ, আর শেয়ালের মত ধূর্ত।
আবার ফুলতে শুরু করেছে ওটা। আবার চিৎকার করে সাহায্যের আবেদন জানাল মুসা। বুঝতে পারছে, সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর বড় জোর কয়েক সেকেণ্ড।
তীব্র গতিতে পানি বেরোতে লাগল বস্তার ভেতর থেকে। ছুটে এল অক্টোপাস। জড়িয়ে ধরল শিকারকে।
অন্য কেউ হলে হয়ত হাল ছেড়ে দিত এতক্ষণে, কিন্তু মুসা ছাড়ার পাত্র নয়। মরতে হলে লড়াই করে মরবে। দ্রুত ভাবনা চলেছে মাথায়। অক্টোপাসের ব্যাপারে আর কি কি বলেছিল কুমালো? সাগরের এই আতঙ্ককে খালি হাতে লড়াই করেই অনেক সময় হারিয়ে দেয় দ্বীপবাসীরা। দুই চোখের মাঝখানে রয়েছে এদের সব চেয়ে দুর্বল জায়গা, একটা বিশেষ নার্ভ সেন্টার। ওখানে আঘাত লাগলে অবশ হয়ে যায় অক্টোপাসের শরীর।
আশা হল মুসার। শুধু হারানোই নয়, এই দানবটাকে জ্যান্তই ধরে নিয়ে যেতে পারবে হয়ত সে। বড় একটা অক্টোপাস চেয়েছেন মিস্টার লিসটার। কিশোরও খুশি হবে, মুসার ওপর থেকে রাগ কমবে তার।
প্রবাল আঁকড়ে ধরে পানির ওপরে মাথা তুলে রাখল মুসা, যতক্ষণ পারল। শ্বাস টানল জোরে জোরে। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে পানির নিচে নামিয়ে নেয়া হল তাকে। কিন্তু এখন আর আগের মত আতঙ্কিত নয় মুসা। ফুসফুসে বাতাস ভর্তি, মনে দুর্জয় সাহস। এখন তাকে দেখলে ভাবতেই পারবে না কেউ, এই সেই মুসা আমান, ভূতের নাম শুনলেই যে ভয়ে কাবু হয়ে যায়। শরীর থেকে শুড় ছাড়ানোর জন্যে এখন আর ধস্তাধস্তি করছে না সে। কাজ হয় না, তাতে শক্তিই খরচ হয় অহেতুক।
ধীরে ধীরে তাকে কাছে টেনে নিচ্ছে অক্টোপাস। শয়তানি ভরা চোখ দুটোর কাছে, আরও কাছে। আফ্রিকায় রেগে যাওয়া গণ্ডার দেখেছে মুসা। গণ্ডারের কুতকুতে চোখের চাহনির সঙ্গে অক্টোপাসের চাহনির অনেক মিল।
এতক্ষণ বস্তা-শরীরের ভেতরে লুকিয়ে ছিল অক্টোপাসের চোয়াল দুটো। বেরিয়ে এল এখন। তোতাপাখির ঠোঁটের মত বাঁকা, কিন্তু অনেক অনেক বড়। প্রচণ্ড শক্তি ওই চোয়ালের, এক চাপ দিয়ে পাকা নারিকেল গুঁড়িয়ে ফেলতে পারে। মুসার মাথাটা গুড়ো করতেও এক চাপের বেশি লাগবে না।
তবু নড়ছে না মুসা।
এমন ভাব দেখাচ্ছে, দুর্বল হয়ে গিয়ে নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সে। দানবটাকে বোঝাতে হবে, হাল ছেড়ে দিয়েছে। ততো শক্ত করে আর তাকে, ধরেনি অক্টোপাসটা, ধরার দরকার মনে করছে না। এটার ওপর এত বল প্রয়োগ করে লাভ নেই। খাবারকে আস্তে আস্তে মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে শুড়গুলো।
দম ফুরিয়ে এসেছে মুসার। বাতাসের জন্যে আকুলি বিকুলি করছে ফুসফুস। কিন্তু চুপ করে রইল সে। জায়গাটা কোথায়? কুমালো বলেছে, দুচোখের মাঝখানে, শরীরের সমস্ত স্নায়ু ওখানে এক জায়গায় মিলিত হয়ে একটা গুটি তৈরি করেছে, মটরদানার সমান।
হ্যাঁ, আছে, ওই তো! উঁচু হয়ে আছে, ছোট্ট ফেঁড়ার মত। মন শক্ত করল মুসা। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে কুতকুতে চোখ দুটো। তার মনের কথা বুঝে ফেলছে না তো? পেশী ঢিল করে দিল সে।
অক্টোপাসটাও চাপ আরও কমাল। এইই সুযোগ। হঠাৎ সামনে ঝাঁপ দিল সে। দানবটার মাথা খামচে ধরে কামড় বসালো ফোঁড়াটায়।
যন্ত্রণায় মানুষের মত গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস। দুর্বল ভঙ্গিতে শরীর ঝাঁকিয়ে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করল। কালি দিয়ে কালো করে ফেলল পানি। নিয়ন্ত্রণ হারাল সাকশন কাপগুলো। মুসার শরীর থেকে খসে পড়ল সব কটা শুড়।
কামড় ছাড়ল না মুসা। চাপ দিল আরেকটু জোরে। আবার গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস। ধস্তাধস্তি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।
আর থাকতে পারছে না মুসা। এখুনি দম নিতে না পারলে ফেটে যাবে যেন ফুসফুস। অক্টোপাসটাকে ছেড়ে পানির ওপর ভেসে উঠল সে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ ভেসে থেকে বিশ্রাম নিল। নিচে, পানিতে নিথর হয়ে ঝুলে রয়েছে দানবটা।
মরে গেল নাকি ব্যাটা! শঙ্কিত হল মুসা। কুমালো বলেছে, জোরে এক কামড় দিয়েই মেরে ফেলা যায় এতবড় দানবকেও। বিন্দুমাত্র নড়ছে না ওটা। মরেই গেছে। বোধহয়!
দম নিয়ে ডুব দিল মুসা। একটা শুড় ধরে অক্টোপাসটাকে টেনে নিয়ে চলল গুহার বাইরে। শুড়-টুড় মিলিয়ে আকারে বিশাল হলেও ওজন ততটা নয়। তাছাড়া পানির নিচে হওয়ায় ভার আরও কমে গেছে। হাড়ও নেই শরীরে, শুধু ঠোঁটটা ছাড়া।
গুহার বাইরে বেরিয়ে তবে স্বস্তি। উজ্জ্বল রোদে আলোকিতপানি। পৃথিবীটাকে আর এত সুন্দর মনে হয়নি কখনও মুসার। আধ ঘন্টা আগে যা ছিল, তার চেয়ে অনেক জ্ঞানী মনে হচ্ছে এখন নিজেকে। কারণ খানিক আগে মৃত্যুর করাল রূপ দেখে এসেছে সে। বুঝেছে, মৃত্যু কত ভয়ঙ্কর, বেঁচে থাকা কতটা আনন্দের।
পানির ওপরে মাথা তুলল সে। ধারেকাছে কেউ নেই। সবাই দূরে। চেঁচিয়ে ডাকল সে। ফিরে তাকাল ওরা। দুহাতে তুলে ধরে একটা শুড় নাচাল মুসা। থমকে দাঁড়াল সবাই, তারপরই দৌড় দিল এদিকে।
সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কাকে ধরেছ! মরা নাকি?
মনে হয় না। জাহাজে তোলা যায় কিভাবে?
তুলো না তুলো না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল কুমালো। পানির ওপরে তুললে রোদ লাগলেই মরে যাবে।
নৌকা আনতে গেল কুমালো। এই সময়ে সবাইকে তার কাহিনী শোনাতে লাগল মুসা। শুনতে শুনতে ফ্যাকাসে হয়ে গেল কিশোর আর রবিনের চেহারা। আর জামবুর চোখ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে।
যাক, খুশি হলাম, ক্যাপ্টেন কলিগ বলল। দুষ্টুমি করে বটে। সাহসও আছে। এরকম ছেলেই আমার পছন্দ।
দাড় বেয়ে নৌকা নিয়ে হাজির হল কুমালো। বলল, শুড় ধরে বসে থাক কোয়। টেনে নিয়ে যাব। দেখ, পানির ওপরে না ভেসে ওঠে।
জাহাজের কিনারে ভিড়ল নৌকা। দড়ি নামিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা হল তুলতুলে শরীরটা। তারপর যত তাড়াতাড়ি পারা গেল চালান করে দেয়া হল ট্যাংকে, যতটা সল্ক রোদ বাঁচিয়ে।
ট্যাংকটা ছোট হয়ে গেল অক্টোপাসের জন্যে। শরীরটা ঠিকই আঁটে, গুঁড়গুলো। বেশি লম্বা। সোজা করা যায় না ট্যাংকের ভেতরে। বারো ফুট লম্বা একেকটা।,
কুমালো বলল, সোজা করার দরকার নেই। করে না সাধারণত। গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে।
হুঁশ ফিরছে দানবের। আলো দেখা দিল চোখ দুটোয়। শুরু হল সারা শরীরে রঙের খেলা। কিলবিল করে উঠল শুড়গুলো।
পানি খেয়ে ফুলছে বস্তা-শরীর। হঠাৎ লাফ দিল ওটা, বাড়ি খেল গিয়ে আরেক পাশের দেয়ালে। আবার লাফ দিল আরেক পাশে, বাড়ি খেল এবারও। বুঝল আটকা পড়েছে। ট্যাংকের ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করল পাগলের মত প্রচণ্ড রাগে শেষে শুড় কামড়াতে শুরু করল।
বেশি রেগে গেলে ওরকম করে ওরা, কলিগ জানাল ধরা পড়লে কামড়ে নিজের শুড়ই খেয়ে ফেলে। শুড়-ছাড়া-অক্টোপাস বেচতে পারবে কাস্টোমারের কাছে?
শঙ্কিত হয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা। এত কষ্ট করে ধরে এনে তাহলে লাভটা কি, শুড়ই যদি খেয়ে ফেলে?
সমস্যার সমাধান করে দিল কুমালো। বড় দেখে একটা লোহার ড্রাম এনে রাখল ট্যাংকের ভেতর, কাত করে। খোলা মুখটা রইল অক্টোপাশের দিকে।
নিমেষে রাগ দূর হয়ে গেল দানবটার। সুড়ুৎ করে গিয়ে ঢুকে পড়ল ড্রামের ভেতরে। শুড়গুলো ভেতরে গুটিয়ে নিল, যতটা জায়গা হল।
সাগরের নিচে, কুমালো বলল। অন্ধকার গর্তে বাস করে ওরা। গর্তে ঢুকলে নিরাপদ মনে করে। আর গণ্ডগোল করবে না। বাড়ি পেয়ে গেছে।
৮
ভোর থেকেই উত্তেজিত হয়ে আছে শুকতারার যাত্রীরা। অস্বস্তিতে ভুগছে।
বিকিনি ছেড়েছে শুকতারা। এগিয়ে চলেছে পোনাপের দিকে। চমৎকার হাওয়া লাগছে পালে, সাগর শান্ত, অস্বস্তি বোধ করার কারণ নেই। তবুও করছে
ওরা,কারণ, বাতাস গরম। অসহ্য। বাষ্প মিশে রয়েছে যেন বাতাসের সঙ্গে।
নিষ্প্রাণ এই বাতাসে শ্বাস নিয়েও শান্তি নেই। বমি বমি লাগে। আকাশও নীল নয়। কেমন যেন কালচে-সাদা।
একই সাথে একটা বিশেষ কিছুর রঙ কালো আর সাদা হতে পারে না, অথচ আকাশের বেলায় তাই হয়েছে। ফ্যাকাসে কালো অন্ধকার ধীরে ধীরে চেপে আসছে যেন জাহাজের ওপর, মলিন করে দিয়েছে সবার মুখ। বেলা বাজে বারোটা, অথচ দেখে মনে হয় কাকডাকা ভোর।
বিনাকলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। হাতে সেক্সট্যান্ট। দুপুরের রীডিং নেয়ার চেষ্টা করছে। তাহলে নটিক্যাল অ্যালম্যানাকের সাহায্য নিয়ে জাহাজের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে।
খুব আগ্রহ নিয়ে ক্যাপ্টেন কলিগের কাছে নেভিগেশন শিখছে কিশোর। যেকোন কাজ জানা থাকলে অনেক সুবিধে। আর এটা জানা তো এখন তিন গোয়েন্দার জন্যে বিশেষ জরুরি, কারণ, প্রফেসর ইস্টউডের গোপন মুক্তার খামারে যেতে হবে। কখন কি ঘটে যায়, ঠিক আছে?
মনে যেন জুলজুলে অক্ষরে লেখা হয়ে আছে পজিশনটাঃ নর্থ ল্যাটিচিউড এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট, ইস্ট লংগিচিউড একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট।
একটা সমস্যার সমাধান এখনও করতে পারেনি সে। আসল অবস্থানের কথা কাউকে না জানিয়ে কি করে সেখানে পৌঁছবে? সঙ্গে যে-ই যাক, জেনে যাবে, জামবু, কুমালো, কলিগ, তিনজনেই।
কুমালোকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন আর জামবুকে? প্রফেসরকে হুমকি দিয়েছে যারা, চুরি করে ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছে, তাদের সঙ্গে কি যোগাযোগ আছে দুজনের? কি করে জানা যাবে? ওদের কিছু কিছু মন্তব্য সন্দেহ জাগিয়েছে তার মনে।
পার্ল অ্যাটলে ওরা তিন গোয়েন্দার সঙ্গে না গেলেই খুশি হত সে। কিন্তু ওদেরকে ছাড়া, কিংবা দক্ষ অন্য কোন নাবিকের সহায়তা ছাড়া যেতে পারবে না কিছুতেই।
পারবে, যদি সে নিজে নাবিক হতে পারে, নেভিগেশন শিখে নিতে পারে। সূর্য, তারা, আর ক্রনোমিটারের সাহায্যে জাহাজের গতিপথ নির্ধারণ করা জানতে হবে। হিসেবে সামান্যতম ভুল করা চলবে না। তাহলেই চলে যাবে একদিক থেকে আরেক দিকে, আসল জায়গায় যাওয়া আর হবে না।
বুদ্ধি আছে তার। চেষ্টা করলে শিখতে পারবে না তা নয়, বরং অন্য অনেকের চেয়ে দ্রুতই পারবে। কিন্তু আরও একটা সমস্যা রয়ে যায়, কলিগ আর জামবুকে কোথায় নামিয়ে রেখে যাবে? কিভাবে? কি বলে বোঝাবে…
ভাবনায় বাধা দিল কলিগ, কি ভাবছ?
সূর্যটা ধরতে পারছি না ঠিকমত।
ওপরে তাকাল কলিগ। সূর্য যেখানে থাকার কথা, সেখানে শুধু একটা সাদাটে আভা। আকাশের কালো ভূতুড়ে মুখটা অন্ধকার হচ্ছে আরও।
ব্যারোমিটার দেখল ক্যাপ্টেন। সাধারণত তিরিশের ওপরে থাকে, এখন উনত্রিশের কাছাকাছি নেমে এসেছে।
মনে হচ্ছে, বড় রকমের বাড়ি খাব, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কলিগ। মন্তব্যটা অদ্ভুত লাগল কিশোরের কাছে। তার ধারণা ছিল বাতাস বাড়বে, তা হয়ে কমছে। খুব সামান্য, ঝিরঝির করে আসে, যায়, আসে, যায়। স্কুলে পড়েছে পাল। প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে হাওয়া।
ঘটনাটা কি? কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে মুসা। ঘুমাচ্ছিল। আগের দিন অক্টোপাসের সঙ্গে লড়াইয়ের পর বিশ্রাম দিচ্ছিল শরীরটাকে। সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ, অক্টোপাসের সাকশন কাপের শোষণের স্বাক্ষর। শ্বাসই নিতে পারছি না!
বিশাল এক কম্বল ছড়িয়ে দিয়ে যেন চেপে ধরা হয়েছে শুকতারার যাত্রীদের, শ্বাসরুদ্ধ করে মারার পায়তারা চলছে।
হারিক্যান! ঘোষণা করল কলিগ। কুমালো, আলগা যা যা আছে, শক্ত করে বাঁধ। জামবু, পাল খোল। প্রধান মাস্তুলের নিচে গিয়ে দাঁড়াল সে। আরে, বাবা, একটু জলদি কর না! হাত চালাও। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে, তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে। এই তোমরাও এস, ধর, ধর! আর সময় নেই!
তাড়াহুড়ো করে নামাতে গিয়ে, পুলিতে দড়ি পেঁচিয়ে আটকে গেল একটা পালের ওপরের দিকটা।
ইসসিরে, আর সময় পেল না আটকানোর! উঠে গিয়ে এখন খুলতে হবে, উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে ক্যাপ্টেন। মাল্লাদের দিকে তাকাল। কুমালো আর জামবু দুজনেই ব্যস্ত। সে নিজে বয়স্ক লোক, ভারি শরীর, মাস্তুল বেয়ে এত ওপরে উঠতে পারবে না। মুসা পারবে, কিন্তু ঘষা লাগলেই চাকা দাগগুলোতে ব্যথা পায়।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল রবিন। সারা দিনে কয়েকবার করে কাকের বাসায় উঠে উঠে মাস্তুল বাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে তার। বেয়ে উঠতে শুরু করল আরেকবার। নিচের দিকের ক্রসট্রীগুলো পেরিয়ে উঠল কাকের বাসায়। জিরানোর সময় নেই। উঠে গেল আগায়। পুলি থেকে দড়ির জট ছাড়িয়ে দিতেই হড় হড় করে নামতে শুরু করল পাল।
ডেকে তখন তুমুল ব্যস্ততা। দড়ি দিয়ে হ্যাচের মুখগুলো বেঁধে ফেলেছে কুমালো, ডিঙি বাঁধছে। অক্টোপাসের ট্যাংকটা জায়গামত আটকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে জাহাজের দুলুনির সময় না নড়ে! ছোটবড় সব কটা ট্যাংকের ঢাকনা শক্ত করে লাগাতে হবে। ইচ্ছে করলে খুবই দ্রুত কাজ করতে পারে জামবু, কিন্তু তাকে কেউ কিছু করার আদেশ দিলেই চিটাগুড়ের মত আঠা হয়ে যায় যেন তার শরীর, নড়তেই চায় না আর। কয়েকটা পাল গুটিয়ে নিয়ে নিচের তলায় রাখতে এল। স্টোররুমে ঢুকেই যেন আর কাজ পেল না, এই জরুরি মুহূর্তে মদ খাবার ইচ্ছে হল।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ক্যাপ্টেন। বিপদের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে সবরকমে তৈরি করছে জাহাজটাকে।
পালে হাওয়া লাগলে সহজেই সাড়া দেয় শুকতারা, কিন্তু ইঞ্জিনের সঙ্গে সমঝোতা হতে সময় লাগল। সাড়া দিতে সবে শুরু করেছে। ঠিক এই সময় এল ঝড়।
মাস্তুলের ওপরে থেকে আসতে দেখল প্রথম রবিন। ডেকে নামার সুযোগ পেল না। কাকের বাসায় মাস্তুল আঁকড়ে বসে থাকতে বাধ্য হল সে।
বিশাল এক ঢেউ, তার মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেক ওপরে। একটা মাত্র ঢেউ, আসার কোন ইঙ্গিতই দেয়নি, জন্মাল কখন তা-ও বোঝা যায়নি। হঠাৎ চোখে পড়ল ঢেউটা, পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে গেছে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল রবিন। ঢেউয়ের চূড়ায় সাদা ফেনা নাচছে। দেখে মনে হচ্ছে সাগরের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক নেই ঢেউটার, পানি আর আকাশের মাঝে শূন্যে ঝুলে ঝুলে ছুটে আসছে শুকতারাকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যে।
ঢেউয়ের দিকে পাশ ফিরিয়ে আছে জাহাজ। ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করল পাহাড়ে। পানির ঢলে পড়ে কাত হয়ে যাচ্ছে। এত বেশি কাত হয়ে গেল মাস্তুল, নিচে তাকিয়ে ডেক দেখতে পেল না রবিন, চোখে পড়ল আয়নার মত চকচকে সাগর।
হাত ছেড়ে লাফিয়ে পড়বে পানিতে? তার মনে হল, এই ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সাধ্য দুনিয়ার কোন জাহাজের নেই, এখুনি উল্টে যাবে শুকতারা। তখন আর মুক্তির উপায় থাকবে না। পানির তলায় চলে যাবে সে।
কিন্তু কি ভেবে শেষ পর্যন্ত ছাড়ল না রবিন। কুঁচকে ফেলল নাকমুখ, যখন ঢেউয়ের চূড়াটাকে তার ওপর ভেঙে পড়তে দেখল। পনি এরকম আঘাত করতে পারে, জানতই না সে। মনে হল কঠিন কিছু দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে তাকে। পানির চাপে কাকের বাসার রেলিঙ আর মাস্তুলের সঙ্গে এমনভাবে আটকে গেল, চাইলেও এখন আর নিজেকে ছোটাতে পারবে না।
ফুসফুসের সমস্ত বাতাস নিঙড়ে বের করে নিয়ে গেছে যেন পানি। হাঁ করে দম টানতে গিয়ে নাকমুখ দিয়ে ঢুকল নোনা পানি। নিঃশেষ হয়ে আসছে শক্তি। পুরো ব্যাপারটাই কেমন অবাস্তব লাগছে। ডেকের চল্লিশ ফুট ওপরে বসে থেকে পানিতে ডুবল কিভাবে?
কিশোর কই? আর মুসা? ডেক থেকে ধুয়ে নিয়ে গেছে ওদেরকে পানি? এই তাহলে হারিক্যান! মাস্তুলটা আবার সোজা হয়েছে বলে মনে হল। নিচে তাকাল সে। ডেকটা যেখানে থাকার কথা সেখানে শুধু পানির ঘূর্ণি।
সরে গেল পানি। লাফ দিয়ে আবার বেরিয়ে এল যেন ডেকটা। কিশোর আর মুসাকে দেখা গেল। দুই মাস্তুলের সঙ্গে যার যার শরীর বেঁধে নিয়েছে। মরে গেছে
বেঁচে আছে বোঝার জো নেই। তবে আছে জাহাজেই, সাগরে ভেসে যায়নি, এটুক নিশ্চিত হওয়া গেল। ককপিটের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে ক্যাপ্টেন। মহাপ্লাবনের ভেতর থেকে যেন একটা সীমাছের মত বেরিয়ে এল কুমালো। এগিয়ে গেল হালের দিকে, জখমী হালটাকে মেরামত করার জন্যে।
জামবুর ছায়াও চোখে পড়ল না।
কিন্তু জামবু আছে। মাত্র চুমুক দিয়েছে বোতলে। পানীয়টা পেটে গিয়েও সারতে পারেনি, মাথায় লাগল প্রচণ্ড বাড়ি। তুলে নিয়ে বাল্কহেডের গায়ে ছুঁড়ে মারল যেন তাকে কেউ। গায়ের ওপর এসে পড়ল, বাক্স, টিন, বস্তা আর আরও নানারকম জিনিস। একটা ময়দার বস্তা ছিঁড়ে গিয়ে ময়দায় মাখামাখি হয়ে গেল তার সমস্ত শরীর। জিনিসপত্রের স্তুপের নিচে, দেয়ালে উপুড় হয়ে পড়েছে সে, মাথা ঠেকে আছে ছাতের সঙ্গে। খানিক পরে গড়িয়ে সরে গেল জিনিসগুলো, মুহূর্ত পরেই ফিরে এল আবার দ্বিগুণ বেগে, বাড়ি মেরে, চাপ দিয়ে, নীল করে দিল তাকে।
অনেক কষ্টে চার হাতপায়ে ভর দিয়ে টেনে তুলল শরীরটা। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। শক্ত হয়ে লেগে গেছে পাল্লা। খুলতে পারল না। তালা। লাগেনি। তালা নেই-ই, লাগবে কি করে? কিন্তু তবু খুলতে পারল না। দরজার ওপাশে প্রচণ্ড গর্জন।
বাতাস তাহলে এল অবশেষে। এমনভাবে ঠেলে ধরে রেখেছে পাল্লা, যেন পেরেক দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ওটাকে। কাত হয়ে আছে ঘরটা। দেয়ালে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল জামবু।
জিনিসপত্র ওড়াউড়ি থেমেছে। এখন বাইরে বেরোনো গাধামি হয়ে যাবে, ভাবল সে। এখানেই আরাম করে বসে থাকতে পারে, শুয়েও থাকতে পারে ইচ্ছে হলে। কাজ যা করার অন্যেরাই করুক না, সে কেন অযথা খাটতে যাবে? দরজাটা আটকে গেছে, বেরোতে পারেনি, এটা তার দোষ নয়। দরজা খোলার। চেষ্টা বাদ দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল দেয়ালে।
বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়। মস্ত ঢেউটা সরে যাওয়ার পর, বাতাস আসার আগে, মাঝখানে একটু সময় পেয়েছে রবিন। নেমে চলে এসেছে কাকের বাসা থেকে। কাত হয়ে শুয়ে আছে যেন শুকতারা, বাতাসের দিকে পিঠ দিয়ে। কাত হয়ে আছে ডেক, টিনের ঘরে চালার মত। গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে না। যেন শক্তহাতে ধরে রাখা হয়েছে জাহাজটাকে। পানি আগের মতই মর্সণ। তবে বাতাস আসার পর থাকবে এরকম। লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
প্রাণপণে লড়ে চলেছে দুর্বল ইঞ্জিন। ঢেউয়ের চূড়া পেরিয়ে এসে আরেক পাশের ঢালে রয়েছে এখন জাহাজ। নিচ দিয়ে ঢেউটা গড়িয়ে সরে যাওয়ার পর সোজা হল। কিন্তু হয়েও সারতে পারল না, ঝাপটা মারল বাতাস।
রবিনের মনে হল, বাতাস নয়, ইটের দেয়াল এসে ধাক্কা মারল তাকে। বাতাসের মুখোমুখি হয়ে আছে সে। আপনাআপনি বুজে গেছে চোখের পাতা, জোর করে বাতাস ঢুকে গেছে ফুসফুসে, ফোলাতে ফোলাতে যেন ফাটিয়ে ফেলবে। এখনই মাস্তুলের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলতে না পারলে একটা পাতার মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাকে হাওয়া। শুধু হাত দিয়ে মাস্তুল আঁকড়ে ধরে রেখে বাঁচতে পারবে না।
ঝড় আরও দেখেছে সে, কিন্তু এমন অবস্থা দেখেনি। হারিক্যান নামটা কোথা থেকে এসেছে, জানে। বই পড়ে জেনেছে। নামটা এসেছে মধ্য আমেরিকার ইনডিয়ানদের বজ-বিদ্যুতের অপদেবতা হারাকান থেকে। এই একই ঝড়কে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম অঞ্চলের লোকেরা বলে টাইফুন, নামটার উৎপত্তি চীনা শব্দ টাইফুং, অর্থাৎ প্রচণ্ড বাতাস থেকে। আরও অনেক নাম আছে এই ঝড়ের। কেউ বলে চাব্যাসকো, কেউ সিক্লোন, কেউ হারাকান। বলে টরবেলিনো, টরমেনটা, কিংবা ট্রপিক্যাল। কিন্তু যে যে নামেই ডাকুক, একবার যে এর মধ্যে পড়েছে, জীবনে ভুলবে না আর।
মাস্তুলের একদিক থেকে ঘুরে আরেক দিকে চলে এল রবিন। শ্বাস নিতে কষ্ট হল এভাবেও।
জাহাজের সামনের পাটাতনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানি। সেখান থেকে খানিকটা খাবলা মেরে তুলে পেছনে ছিটিয়ে দিল বাতাস। তালু ছড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাসের জোর পরীক্ষা করতে গিয়েছিল রবিন, প্রচণ্ড ঝটকায় হাত সরে গেল পেছনে। হাতের তালুতে পানির কণা সুচের মত এসে বিঁধে রক্তাক্ত করে ফেলল চামড়া। অবশ হয়ে গেল হাতটা, যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। আন্দাজ করল সে, ঘন্টায় দেড়শো মাইলের কম হবে না বাতাসের গতিবেগ।
বিশাল ঢেউটা যাওয়ার পর যে শান্ত হয়ে গিয়েছিল সাগর, এই বাতাসে সেটা আর থাকতে দিল না। জ্যান্ত হয়ে উঠল যেন পানি। লাফিয়ে উঠতে লাগল বড় বড় ঢেউ। কয়েক মুহূর্ত শান্ত হয়ে ছিল জাহাজটা, এখন পাগলের মত নাচতে শুরু, করল ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে। ঢেউয়ের মাথায় ওঠার সময় ওঠে নাক উঁচু করে, নামার। সময় নামে নিচু করে, বিপজ্জনক ভঙ্গিতে।
ভাগ্যিস সময়মত মাস্তুলের সঙ্গে শরীরটা পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলেছিল পালের দড়ি দিয়ে! আরও দুটো মাস্তুলে বাঁধা অবস্থায় মুখ গুঁজে রয়েছে কিশোর আর মুসা। কুমালো মুক্তই রয়েছে, জাহাজের সঙ্গে তাল রেখে একবার এদিকে কাত হয়ে। যাচ্ছে, একবার ওদিকে, বাতাসে ঝুলন্ত ডালে আঁকড়ে বানর যে-রকম করে ঠিক তেমনি। ককপিটের মেঝেতে শুয়ে আছে ক্যাপ্টেন, এক হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে হুইলের নিচের দিকের একটা স্পেক। জামবু নেই। নিশ্চয় নিচের মালপত্র সামলাতে ব্যস্ত, ভাবল রবিন।
কিন্তু মাল নয়, নিজেকেই এখন আর সামলাতে পারছে না জামবু। ভেবেছিল আরাম করে শুয়ে থাকবে। ঝড় বাড়তেই বুঝল, মস্ত ভুল করে ফেলেছে। সাগর যেন বল খেলতে শুরু করল তাকে নিয়ে। দেয়াল থেকে একবার মেঝেতে ছুঁড়ে মারে, আবার মেঝে থেকে দেয়ালে। ঘরের একপাশে একটা বাংক আছে। কোনমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে গিয়ে উঠল ওটাতে। ধার খামচে ধরে উপুড় হল। ভাবল, যাক বাঁচা গেল। কিন্তু বাঁচতে পারল না। ওটাও ছুঁড়ে মারল তাকে। আরও দুঃখ যোগ হল তার কপালে, জীবন্ত হয়ে উঠল যেন মালপত্রগুলো। সে যেদিকে যায়, ওগুলোও ছুটে যায় সেদিকে, কে কত জোরে এসে তার গায়ে লাগতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় মেতেছে যেন।
আতঙ্কে, ব্যথায় প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হল জামবুর। মেঝেটা আরেকবার সোজা হতেই ঝাঁপিয়ে এসে দরজায় পড়ল সে। পাল্লা খোলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। জোরে জোরে ধাক্কা মারতে লাগল কাঁধ দিয়ে। ব্যথাই পেল শুধু কাঁধে, পাল্লার কিছু করতে পারল না। আগের মতই অনড় রইল ওটা।
উড়ে এসে মাথায় লাগছে নানারকম বাক্স, টিন। পাগলের মত দরজায় কিল মারতে মারতে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে শুরু করল সে। ঝড়ের এই ভয়াবহ শব্দের মাঝে তার ডাক কারও কানে পৌঁছবে না, বুঝল। বড় একটা বাক্স তুলে গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল দরজায়। কিন্তু অন্যপাশে বাতাসের হাত আরও শক্ত, বিন্দুমাত্র নড়তে দিল না পাল্লাটাকে। ভাল জেলখানাতেই আটকে পড়েছে সে!
ভীষণ অনুশোচনা হল তার, কাঁদতে শুরু করল। জোরে জোরে বলতে লাগল, এখান থেকে যদি জীবন্ত বেরোতে পারে, মদ খাওয়া ছেড়ে দেবে, জীবনে আর বোতল ছুঁয়ে দেখবে না। আর কখনও কাজে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে না। খারাপ কাজ করবে না। একেবারে ভাল হয়ে যাবে, দুধে ধোঁয়া, বিমল, পরিষ্কার।
যেন তার ডাক শুনতে পেলেন ঈশ্বর, করুণা করলেন ক্ষণিকের জন্যে। ঝটকা দিয়ে হঠাৎ খুলে গেল পাল্লা। ওটার ওপরই কাত হয়ে হেলান দিয়ে ছিল জামবু, পড়ে গেল করিডরে। জোর বাতাসে পেছনে আবার দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা। মালপত্রের মার খাওয়া থেকে বাঁচল অন্তত সে।
উপুড় হয়ে পড়ে থেকে খুব অল্প সময়েই প্রতিজ্ঞা ভুলে গেল জামবু। কাজ করে মরুকগে কুমালো, তার কি? সুবিধেমত একটা জায়গা বেছে নিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। অনেক ধকল গেছে, জিরিয়ে নেয়া দরকার।
একটানা বাতাস বওয়া বন্ধ হল, থেকে থেকে আসছে এখন ঝাপটা। কমছে বাড়ছে, কমছে বাড়ছে, এরকম করতে করতে থেমেই গেল একেবারে। কানফাটা গর্জনের পর এই স্তব্ধ নীরবতা আরও ভয়ঙ্কর মনে হল রবিনের। ছেড়া ছেড়া মেঘগুলো অদৃশ্য হয়ে গিয়ে ফুটে বেরোলো নীল আকাশ।
আল্লাহ্, বাঁচলাম! চেঁচিয়ে বলল মুসা। গেছে মরার তুফান!
রবিনের তা মনে হল না।
কলিগ বলল, অর্ধেকটা গেছে।
পানির ঘূর্ণির মতই পাক খেয়ে খেয়ে চলে হারিক্যানের বাতাস। একশো থেকে দুশো মাইল গতিতে। ঘোরার গতি প্রচণ্ড, কিন্তু সরার গতি খুব কম, বড় জোর ঘন্টায় বারো মাইল।
এই ঘূর্ণির মাঝখানে রয়েছে ঝড়ের চোখ, খুব শান্ত, বাতাস প্রায় থাকেই না কেন্দ্রবিন্দুতে।
বেশি হলে আধ ঘন্টা, ক্যাপ্টেন বলল। তারপরই অন্যপাশের দেখা পাব আমরা।
যার যার বাঁধন খুলে কুমালোর কাজে সাহায্য করতে গেল তিন গোয়েন্দা। জাহাজের ভেতরে বাইরে সব তছনছ করে দিয়েছে ঝড়। আরেকটু হলেই দড়ি ছিঁড়ে সাগরে পড়ে যেত ডিঙিটা, কোনমতে আটকে আছে।
কাজ করতে করতে ঘামছে ওরা। বাতাস খুব পাতলা, গরম, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
ঝড় নেই, তবুও জাহাজটা এত দুলছে কেন প্রথমে বুঝতে পারল না কিশোর। ঝড় যখন ছিল, তখনকার চেয়ে বড় আর এলোমেলো ঢেউ এখন সাগরে। আসলে তখন বাতাসের গতি একটা বিশেষ দিকে ছিল, নিয়ন্ত্রণ ছিল পানির ওপর। এখন নেই। ফলে উত্তাল হয়ে উঠেছে পানি, যেন যা-ইচ্ছে-করার খেলায় মেতেছে। লাফিয়ে উঠছে ঢেউ, পঞ্চাশ ফুট, ষাট ফুট ওপরে গিয়ে ফাটছে, ঝরে পড়ছে। ফোয়ারার মত। যেন পানির নিচে জাহাজ বিধ্বংসী টর্পেডো ফাটানো হচ্ছে একের পর এক।
চারদিকে দাপাদাপি করছে পানি, ঢেউ আছড়ে ভাঙছে ঢেউয়ের ওপর, সৃষ্টি করছে হাজারো ফোয়ারা, অসংখ্য জলপ্রপাত।
পানির এই অস্থিরতার কারণও এখানে বাতাস নেই বলে। প্রচণ্ড গতিতে। চরকির মত পাক খেয়ে বাতাস ঘুরতে ঘুরতে মাঝখানে সৃষ্টি করেছে ফাঁপা শূন্যতা। বাতাসের চক্র ভেদ করে বেরোতে পারছে না ঢেউ, ফলে সবদিক থেকে ধেয়ে আসছে কেন্দ্রের দিকে, মহা-অনর্থ বাধিয়েছে এসে এই শূন্যস্থানে।
বড় যাত্রীবাহী জাহাজ কিংবা মালবাহী স্টীমার হলে এই অত্যাচার সহ্য করতে পারত না, ঠাই নিত গিয়ে এতক্ষণে সাগর দেবতার ভঁড়ারে। শুকতারা ছোট বলেই পারছে। এ-ধরনের আবহাওয়া সহ্য করার ক্ষমতা বড়গুলোর চেয়ে ছোট জলযানগুলোর বেশি।
প্রথম কারণ, স্কুনারটা কাঠের তৈরি। কাঠ পানিতে ভাসে, ইস্পাত ভাসে না। বড় যে-কোন একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে যেতে পারছে ছোট বলে। বড়গুলো পারে না, ওগুলোর নিচে পড়ে একাধিক ঢেউ। ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথায় চড়ে বসতে পারে না, ফলে মার হজম করতে হয়। ভয়ঙ্কর চাপে বেঁকেচুরে ফেটে যায় খোল। – শাঁ করে একবার ঢেউ-পর্বতের চূড়ায় উঠে যাচ্ছে শুকতারা, তীব্র গতিতে আবার নামছে অন্ধকার উপত্যকায়। এদিকে কাত হচ্ছে, ওদিকে কাত হচ্ছে, দুলছে, গড়াচ্ছে, কিন্তু ডুবছে না, ভেসে রয়েছে কোনমতে।
শত শত পাখি এসে ঢুকেছে,এই কেন্দ্রবিন্দুতে। নাগালের মধ্যে যতগুলোকে। পেয়েছে, ঝেটিয়ে সব নিয়ে এসেছে যেন বাতাস। নুডি, বুবি, গাল, ডানা কাপাতে কাপাতে এসে বসছে ডেকে, ওপর থেকে খসে পড়ছে যেন। ডিঙির ওপরে এসে ঠাই নিল দুটো মস্ত ফ্রিগেট পাখি। শুধু পাখিই না, পাখাওয়ালা আরও জীব এসেছে, হাজারে হাজারে পতঙ্গ প্রজাপতি, মথ, মাছি, মৌমাছি, বোলতা, ঘাসফড়িং। ঝাকে ঝাকে এসে ছেয়ে ফেলছে মাস্তুল, পালের দড়ি। হাতে লাগছে, মুখে লাগছে, কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে বিচিত্র সুরে।
উত্তর-পুবমুখো এগোচ্ছে জাহাজ। হঠাৎ ওটার নাক দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরিয়ে ফেলল ক্যাপ্টেন।
এরকম করলেন কেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
করলাম, যাতে ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে এগোতে পারে।
ঝড়টা এল আবার, আচমকা। আরেকটু হলেই উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল কিশোরকে। আবার শুরু হল বাতাসের গর্জন। হাতে মুখে বিধছে পানির কণা। অদৃশ্য হয়ে গেছে নীল আকাশ, মাথার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে যেন কালো ভূতুড়ে অন্ধকার।
আগের বারের চেয়ে ঢেউগুলো, এখন ছোট, মাস্তুল ছাড়িয়ে যাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর কোন উদ্দেশ্য নিয়েই বুঝি ছুটে চলেছে একদিকে।…
একটা ব্যাপার পরিষ্কার, হারিক্যানের প্রথম আঘাতের চেয়ে দ্বিতীয়টা খারাপ : হবে।বাতাস এবং ঢেউ, দুটোরই জোর বেশি। উধাও হয়ে গেল পাখি আর পতঙ্গ, যেন ভেল্কিবাজি। টুকরো টুকরো হয়ে গেল মাস্তুল, পাল যে কটা ঝুলছিল, ছিঁড়ে ফালাফালা। বুমটা ভেঙে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ঝুলতে লাগল ডেকের ওপর।
ভাঙা মাস্তুলের গোড়ায় নিজেদেরকে বাঁধার সাহস আর হল না তিন গোয়েন্দার। কুমালোর পদ্ধতি অনুকরণ করে টিকে রইল কোনমতে। জামবু কোথায় ভেবে অবাক হচ্ছে।
জাহাজটাকে দুদিক থেকে ধরে ভীষণ ভাবে আঁকাচ্ছে যেন কোন দানব। মড়মড় করে শব্দ হল পেছনে, টিল হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের হাতের হুইল।
হালটা গেল! চিৎকার করে বলল কলিগ।
বাতাসের দিকে পেছন করে আর থাকতে পারল না শুকতারা। নিজের নিয়ন্ত্রণ শেষ। বাতাস এখন যেদিকে ঘোরাচ্ছে সেদিকেই ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে। টেউয়ের তাথৈ নাচের মাঝে পড়ে বাদামের খোসার মত দুলতে লাগল, অসহায়।
প্রতিবার গড়ানোর সময় কয়েক টন করে পানি বয়ে যাচ্ছে ডেকের উপর দিয়ে, নিচে নামার পথ বেয়ে নেমে চলে যাচ্ছে খোলে।
পাম্প চালু করে দিয়েছে ক্যাপ্টেন, কিন্তু সেঁচে সারতে পারছে না। কুলিয়ে উঠতে পারছে না পাম্প, ফলে জমে যাচ্ছে পানি।
ঘুমিয়ে পড়েছিল জামবু। নাকে পানি ঢুকতে জাগল। দেখল, নোনা পানিতে। ডুবে আছে সে, ফুসফুসে ঢুকতে শুরু করেছে পানি। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটল। হাঁসফাঁস করছে, কাশছে। কত তাড়াতাড়ি এখন ডেকে উঠবে কেবল সেই চেষ্টা।
প্রকৃতিও যেন খেলতে আরম্ভ করেছে দুষ্ট জামবুকে নিয়ে। ডেকে উঠেও সারতে পারল না সে, প্রচণ্ড এক ঢেউ এসে তাকে ভাসিয়ে নিল রেলিঙের দিকে।
পড়ে গেল! পড়ে গেল! চিৎকার করে উঠল ক্যাপ্টেন।
চিৎকারটা সবে বেরিয়েছে তার মুখ থেকে, এই সময় ফিরতি আরেকটা ঢেউ আবার জামবুকে এনে ডেকে আগের জায়গায় ফেলল। তার বোকা-হয়ে-যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল ছেলেরা।
জলদি উঠে ধর কোন কিছু, তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল ক্যাপ্টেন। নইলে আবার নিয়ে যাবে। সাগরে পড়লে আর উঠতে হবে না।
জামবুর দিকে বেশিক্ষণ নজর দেয়ার সময় কারও নেই। খুনী বাতাস পলিনেশিয়ানরা বলে হারিক্যানকে—শুকতারাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যেন।
ভীষণ ভাবে দুলে উঠল জাহাজ। গোড়া থেকে মড়মড় করে ভাঙল প্রধান মাস্তুল। দড়িদড়ায় আটকে থাকায় পানিতে পড়ল না, ওটার ভারে বাঁ পাশে কাত হয়ে গেল জাহাজ। কয়েক মুহূর্ত পরে সামনের মাস্তুলটা ভাঙল, ডিঙির ওপর পড়ে গুঁড়িয়ে দিল ডিঙিটাকে।
আনন্দ ভ্রমণ শেষ। এখন আর জাহাজ বলা যাবে না শুকতারাকে, জাহাজের ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। যাত্রীরা প্রাণে বাঁচবে কিনা এখন তার আর বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই।
নোঙর ফেলো, নোঙর! চেঁচিয়ে উঠল কলিগ।
থোলের মধ্যে পানি। প্রতিটি ঢেউ এখন গড়িয়ে যাচ্ছে জাহাজের ওপর দিয়ে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত যোগ হল এর সঙ্গে বৃষ্টি। এক ফোঁটা দুফোঁটা নয়, মুষলধারে। অবিশ্বাস্য রকমের বড় বড় ফোঁটা।
এতক্ষণে বিশ্বাস করল কিশোর, হারিক্যানের ভয়াবহতা আর বৃষ্টি সম্পর্কে যা শুনেছে, সব সত্যি। হারিক্যানের সময় ফিলিপাইনে মাত্র চারদিনে যা বৃষ্টিপাত হয়, তা ইউনাইটেড স্টেটস-এর পুরো এক বছরের বৃষ্টিপাতের সমান।
এই বৃষ্টির চেয়ে মাথার ওপর ঢেউ ভেঙে পড়া অনেক আরামের ছিল।
কোথাও গিয়ে মাথা গোঁজার সময় নেই, উপায়ও নেই। এক্ষুনি নোঙর ফেলতে না পারলে বাঁচানো যাবে না জাহাজটাকে। কিন্তু কিশোর বুঝতে পারল না এই গভীর পানিতে নোঙর ফেলবে কি করে?
বাতলে দিল ক্যাপ্টেন। কুমালোকে নিয়ে কাজে লেগে গেল ছেলেরা। ছোট মাস্তুলটাকে টেনে-হিঁচড়ে প্রধান মাস্তুলের কাছে নিয়ে গিয়ে এক করে পেঁচিয়ে বাঁধল। তারপর দুটোর মাঝামাঝি জায়গায় শক্ত দড়ি বেঁধে দড়ির, আরেক মাথা বাঁধল গলুইয়ের কাছে নোঙর বাধার খুঁটিতে। যেসব দড়িতে মাস্তুলগুলো আটকে রয়েছে ওগুলো কেটে দিতেই পিছলে গিয়ে পানিতে পড়ল মাস্তুল দুটো। সোজা হয়ে গেল জাহাজ।
আরেকটা ব্যাপার ঘটল। ভারি মাস্তুলগুলো ডুবে ডুবে ভেসে রয়েছে পানিতে। বাতাস লাগছে না, ঘোরাতেও পারছে না ওগুলোকে, কিন্তু জাহাজটাকে ধাক্কা দিয়ে সহজেই ঘুরিয়ে ফেলছে। নোঙরের কাজ করছে এখন মাস্তুল দুটো। টান লেগে জাহাজের মুখ ঘুরে গেল বাতাসের দিকে, ঢেউয়ের মুখোমুখি। ফলে বাতাসের চাপ যেমন কমল অনেকখানি, ঢেউয়ের আঘাতও। দুপাশ দিয়ে কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাতাস আর ঢেউ দুটোই।
আরও একটি ঘন্টা ঝড়ের সঙ্গে প্রাণপণে ঝুঝলো ছোট্ট জাহাজটা। কোনমতে ভেসে রইল পানির ওপরে।
তারপর যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি গর্জন করতে করতে পেছনে সরে গেল ঝড়।
আবার দেখা দিল নীল আকাশ। বেরিয়ে এল সূর্য। বারো নট গতিতে পশ্চিমে সরে যাচ্ছে বাতাসের প্রচণ্ড ঘূর্ণি।
ঝড় সরে যাওয়ার পর আরও ফুসে উঠল সাগর, বাতাসের চাপ হঠাৎ কমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া। তারপর শান্ত হয়ে এল আস্তে আস্তে। ঢেউ আছে, তবে ছোট, ডেকের ওপরে আর উঠতে পারছে না, পানিও ঢুকছে না আর কোলে। জিততে শুরু করেছে পাম্প। আগেরমত ভেসে উঠছে জাহাজ।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল জাহাজের ছজন মানুষ। মনে মনে ধন্যবাদ দিল ঈশ্বরকে, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী।
ট্যাংকগুলোর অবস্থা দেখতে গেল কিশোর। সব কটার ঢাকনা লাগানো রয়েছে। পানি কানায় কানায় ভরা। ফলে কোন ক্ষতি হয়নি ভেতরের অধিবাসীদের। আনন্দেই আছে, এতবড় একটা ঝড় যে গেল যেন বুঝতেই পারেনি।
মাস্তুলগুলোর কি হবে? ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। ফেলে দিয়ে যাব?
না। পোনাপতে গিয়ে ঠিকঠাক করে আবার লাগাব।
কাজ চালানোর মত মেরামত হল হালটা। কিন্তু পাল আর তোলা গেল না। ছোট্ট ইঞ্জিনের ক্ষমতা নিঙড়ে, ভারি দুটো মাস্তুল পেছনে টানতে টানতে, ধুকে ধুকে পোনাপের দিকে এগিয়ে চলল শুকতারা।
৯
প্রায় অচেনা-সাগরে এসে পড়েছে এখন জাহাজ। ক্যাপ্টেন কলিগও এখানে আসেনি কখনও। কোন জাহাজ চোখে পড়ল না, জাহাজপথ এখান থেকে অনেক দূরে, উত্তরে এবং দক্ষিণে।
দুটো বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়টা এই অঞ্চল জাপানের দখলে ছিল। অন্য কোন দেশের জাহাজকে ঢুকতে দিত না এখানে। জাপান ছাড়া বাইরের দুনিয়ার আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না এখানকার আড়াই হাজার অধিবাসীর। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে আসত অন্য দেশের অভিযাত্রীরা।
অবস্থা এখনও প্রায় সেই একই রকম রয়েছে, কর্তৃত্ব হাতবদল হয়েছে মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, ইউনাইটেড নেশনসের হয়ে দ্বীপগুলো শাসন করছে এখন ইউনাইটেড স্টেটস।
আমেরিকান নৌবাহিনীর যেসব লোক কর্মরত রয়েছে এখানে, তাদের মনে হয়, পৃথিবীতে নয়, অন্য কোন গ্রহে বন্দি জীবনযাপন করছে। জীবনে কোন উত্তেজনা নেই, নতুনত্ব নেই, কাজেই ভাঙাচোরা শুকতারা আর এর অধিবাসীদের দেখে স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনা সৃষ্টি হল তাদের মাঝে। পোনাপেতে অতিথির আগমন!
অতিথিরাও উত্তেজিত, বিস্মিত। ভাঙা জাহাজ থেকে মাটিতে পা রাখার জন্যে যেন আর তর সইছে না। এত সুন্দর দ্বীপ আর দেখেনি ওরা।
আরিব্বাবা, এত সুন্দর! মুগ্ধ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। সাদা সৈকত, নীল ল্যাগুন, আর সবুজে ছাওয়া আকাশচুম্বী পর্বত। মনে হয় ছবি। পর্বতের ঢালে – সাজিয়ে রাখা হয়েছে যেন নারকেলগুচ্ছ, ডালা ছড়ানো আমগাছ, বিশাল বট আর অন্যান্য শত শত জাতের গাছপালা, ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে, ছেয়ে আছে ফুলে ফুলে। ঠিকই নাম রেখেছিল প্রাচীন স্পেনের নাবিকেরা–বাগানদ্বীপ।
দক্ষিণ সাগরের নিচু প্রবাল অ্যাটলগুলোতে বৃষ্টিপাত প্রায় হয়ই না, অথচ পোনাপের আবহাওয়া এর উল্টো। প্রচুর বৃষ্টি হয়। ঝড়বাদলকে স্বাগত জানিয়ে ডেকে আনে পর্বতের উঁচু উঁচু চূড়াগুলো। এই যে এখন, চারপাশে ঝকঝকে রোদ, এই এখনও টটল নামের চূড়াটার ওপর জমে রয়েছে কালো মেঘ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে।
খাইছে! ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার চোখ।
খালি যে তাহিতি আর সামোয়ার কথা বলে লোকে, রবিন বলল। এর চেয়ে ভাল?
ধারেকাছে আসতে পারবে না, ক্যাপ্টেন বলল। ওই দুটো দ্বীপ দেখেছে সে।
তাহলে এটার কথা বেশি শোনা যায় না কেন?
লোকে বেশি আসতে পারে না বলে।
আরি, একেবারে দেখি জিবরালটার! বলে উঠল মুসা।
হ্যাঁ, একেবারে জিবরালটারের মতই। চার্ট বলছে, ওটার নাম রক অভ চোকাচ। বন্দরের ওপরে নশো ফুট উচু হয়ে আছে। ব্যাসল্টের পাহাড়, ঢল এত খাড়া, দুঃসাহসী পর্বতারোহীও ওঠার আগে দশবার দ্বিধা করবে।
প্রবাল প্রাচীরের একটা ফাঁকের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল শুকতারা। দ্বীপের সৌন্দর্য যেন চুইয়ে এসে পড়েছে ল্যাগুনেও। তীরের খুব বেশি কাছে যাওয়া গেল না, বিপজ্জনক চড়ার জন্যে। দশ ফ্যাদম পানিতে নোঙর ফেলল ক্যাপ্টেন।…
কিছু মাছধরা নৌকা আর নেভির বিশেষ জলযান ছাড়া কোন জাহাজ নেই বন্দরে। বিমান একটা দেখা গেল, ক্যাটালিনা বিমান, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে যেন।
দ্বীপের একাংশে গড়ে উঠেছে শহর। সেদিক থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এল একটা লঞ্চ। শুকতারার পাশে এসে থামল। লঞ্চ থেকে জাহাজের ডেকে নামল একজন সুদর্শন তরুণ নেভাল অফিসার। পরিচয় দিল, কমাণ্ডার ফেলিক্স ম্যাকগয়ার, পোনাপের ডেপুটি মিলিটারি গভর্নর।
হারিক্যানের স্বাদ তাহলে ভালই পেয়েছেন, বলল অফিসার।
শেষ করে দিয়েছে একেবারে, স্বীকার করল ক্যাপ্টেন। আপনাদের ওপর দিয়েই গেছে নাকি?
না, ভাগ্য ভাল, উত্তর দিয়ে সরে গেছে। কিন্তু আমাদের একটা সাপ্লাই শিপ পড়েছিল ওটার পথে।
তারপর?
ডুবে গেছে। পুরো পাঁচ হাজার টন। আপনাদের এই বাদামের খোসাটা বাঁচল কিভাবে? আশ্চর্য!
গর্বিত ভঙ্গিতে শুকতারার ওপর চোখ বোলাল ক্যাপ্টেন। ছোট জাহাজ তো, তাই। তবে খুব মজবুত। এখানে মেরামত করানোর জায়গা আছে?
আছে। শিপইয়ার্ড।
নিশ্চয় কাগজপত্র দেখতে চাইবেন, বলতে বলতে বের করল কলিগ। পোর্ট চার্জ কত?
হেসে উঠল কমাণ্ডার। লাগবে না। লোকজন খুব একটা আসে না আমাদের এখানে, তাই পোর্ট চার্জ নিয়েও ভাবি না। ছমাসের মধ্যে বাইরের লোক এই আপনারাই এলেন। তা থাকবেন কদ্দিন?।
ও বলতে পারবে, কিশোরকে দেখিয়ে দিল কলিগ। কিশোর পাশা। এই অভিযানের লীডার।
বেশি দিন না, কিশোর বলল। মিস্টার কলিগ তাঁর জাহাজ মেরামত করুন। আমরা শুধু শুধু বসে থেকে আর কি করব? একটা মোটর-বোট ভাড়া করে আশেপাশের যে কটা দ্বীপ পারি, ঘুরে দেখে আসব।
এক মুহূর্ত নীরবতা। আরও বিস্তারিত শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। ম্যাকগয়ার। কিন্তু প্রফেসরের মুক্তাদ্বীপের কথা সবার সামনে কমাণ্ডারকে বলার ইচ্ছে নেই কিশোরের।
বেশ, ম্যাকগয়ার বলল। বোট একটা ঠিক করে দেব। এখন নিশ্চয় তীরে যেতে চাও। উঠে পড়ো আমার লঞ্চে, কে কে যাবে।
ক্যাপ্টেন, রবিন, মুসা আর কুমালো উঠল লঞ্চে। কিশোর উঠতে যাবে, এই সময় কলিগ বলে উঠল, জামবু কই?
দেখি, ডেকে আনি।
ফোরক্যাসলে তাকে পেল না কিশোর। স্টোররুম খুঁজতে গেল। সেখানেও দেখল না। খসখস শব্দ কানে আসতে গিয়ে একটানে খুলল কেবিনের দরজা, যেটাতে ওরা তিনজন থাকে।
ওই তো জামবু। কিশোরের নোটবুক আর ফাইলপত্রের পাতা ওল্টাচ্ছে। এই, কি করছ? তীক্ষ্ণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, কিছু না, ভোঁতা গলায় জবাব দিয়ে, কিশোরকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে। কেবিন থেকে বেরোলো জামবু। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ডেকে। একটা কথা বলল না। চুপচাপ গিয়ে উঠল লঞ্চে।
চিন্তিত হয়ে পড়েছে কিশোর। নিশ্চয় মুক্তাদ্বীপের কথা জানে লোকটা, তার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে চাইছিল কোন তথ্য আছে কিনা। তারমানে প্রফেসর ইস্টউডের প্রাণনাশের হুমকি যারা দিয়েছে, তাদেরই চর জামবু। শুকতারায় উঠেছে
তথ্য জোগাড়ের উদ্দেশ্যে।
যা হবার হয়ে গেছে, লঞ্চে আর কিছু বলল না কিশোর। তবে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে, মুক্তাদ্বীপে তাদের সঙ্গে আর যে-ই যাক, জামবু অন্তত যাচ্ছে না। এমনকি শুকতারা, যখন আবার পাল তুলবে দেশে ফেরার জন্যে, তাতেও মান্না হিসেবে আর নেয়া হবে না লোকটাকে।
দ্বীপটাতে তিরিশ বছর রাজত্বের স্বাক্ষর ভালমতই রেখে গেছে জাপানীরা। পোনাপের বেশিরভাগ স্টোর আর বাড়িঘর তৈরি হয়েছে জাপানী কায়দায়, ওরাই তৈরি করে রেখে গিয়েছে। শহরের বাইরে পাতা দিয়েঙ্কুঁড়ে তুলেছে স্থানীয় অধিবাসীরা।
একটা টিলার মাথায় চমৎকার একটা জাপানী বাংলোতে অভিযাত্রীদের নিয়ে এল কমাণ্ডার। টিলাটার এক ধার খাড়া নেমে গেছে সাগরে। বন্দর চোখে পড়ে ওখান থেকে, দেখা যায় বন্দরের ওপাশের বিশাল উঁচু রক অভ চোকাচ।
এটা তোমাদের বাড়ি,ম্যাকগয়ার বলল। যতদিন মন চায় থাক।
হলুদ মাদুরে এতে খুব আরাম। শুয়ে শুয়েই চোখে পড়ে নীল ল্যাগুনের এখানে ওখানে খুদে খুদে দ্বীপ, সাদা পালতোলা মাছ ধরা নৌকা। দেখা যায়, কয়েক হাজার ফুট উঁচু পর্বতের ওপর থেকে ঝরে পড়া রূপালি জলপ্রপাত।
বেহেশতই এটা, কি বল, কিশোর? মুসা বলল।
কিন্তু তার কথা কিশোরের কানে ঢুকল কিনা বোঝা গেল না। না বলে আবার কোথায় গায়েব হয়ে গেছে জামবু।
১০
শহরে মাত্র একটা বিজনেস স্ট্রীট। কাজেই পোস্ট এক্সচেঞ্জটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না জামবুর।
ভেতরে ঢুকে এমন ভাব করল, যেন এখানে তার সঙ্গে কারও দেখা করার কথা। বিশালদহেী এক লোক এগিয়ে এল, পিঠটা সামান্য কুঁজো। হাসল না। হাত বাড়িয়ে দিল না। রূঢ়কণ্ঠে বলল, এতক্ষণে এলে? জাহাজটা সেই কখন ঢুকতে দেখলাম। আধ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি: এখানে। চোখে সন্দেহ নিয়ে আড়চোখে তাকাল একবার ক্লার্কের দিকে। বেরোও। এখানে কথা বলা যাবে না।
মেইন রোড ধরে এগোল ওরা। পয়লা মোড়টাতেই ঘুরে নেমে পড়ল একটা গলিতে। এঁকেবেঁকে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে পথটা, পাতার কুঁড়েগুলোর মাঝখান দিয়ে। প্রতিটি বাড়িতেই বাগান আছে। বাতাসে ফুলের সুবাস, জ্যাসমিন, ফ্র্যাঙ্গিপ্যানি, সিন্যামোন, আর আল্পও নানা জাতের ফুল। বিশাল একটা রুটিফল গাছের নিচ দিয়ে চলল দুজনে, ফুটবলের সমান বড় বড় ফল ধরে আছে গাছটাতে। পথে ওরকম আরও ডজন খানেক গাছ পড়ল। আরও নানারকম উদ্ভিদ। একটা বোটানিকেল গার্ডেনে এসে হাজির হয়েছে যেন।
গাছপালার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ে এখানকার মানুষগুলো। পুরুষেরা ছয় ফুটের বেশি লম্বা, পেশিবহুল শরীর, বাদামি চামড়া। মেয়েরাও কম লম্বা নয়। খোঁপায় সাদা ফুল গোঁজা, কিংবা মালা জড়ানো। হাসিখুশি মোটাসোটা শিশু তাদের কোলে। রাস্তার ওপর বসে আছে একটা সুন্দর বাচ্চা। বিশালদেহী লোকটার দিকে চেয়ে ফোকলা হাসি হাসল।
পা দিয়ে ঠেলে, প্রায় লাথি মেরেই বাচ্চাটাকে পাশের ঝোপে ফেলে দিল লোকটা। চিৎকার করে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।
অস্বস্তি বোধ করছে জামবু। লোকটা ভীষণ বদমেজাজী। ভয়ই পাচ্ছে এখন। যা বলতে এসেছে, সেটা শুনে মোটেই খুশি হবে না ও। কারণ খুশি করার মত কোন তথ্য জানতে পারেনি সে।
ইউরোপিয়ান স্টাইলে তৈরি একটা বাড়ির বাগানে ঢুকল ওরা। লেবু, কমলা, ডালিম, ম্যাংগোস্টীন আর পিকক পাম নামে একজাতের তাল জাতীয় গাছ প্রচুর জন্মে আছে।
ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলল লোকটা। জামবুকে নিয়ে এল একটা ঘরে। ছাতা পড়া দেয়াল। তাড়াহুড়ো করে এসে ঢুকল দুজন পোনাপিয়ান চাকর। চেয়ার সাজিয়ে দিল মেয়েটা। পুরুষটা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, প্রভু কি খেতে ইচ্ছে করেন।
বেরো এখান থেকে! গর্জে উঠল লোকটা। দুজনেই যা! বলেই ঘাড় ধরে ধাক্কা মারল মেয়েটাকে। হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল সে তার সঙ্গীর, পিঠে। পেছন ফিরেও তাকাল না আর ওরা। দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল লোকটা।
নোঙরা ছুঁচোর দল! খেপা কুকুরের মত দাঁত খিচাল সে। বাদামী চামড়ার নিকুচি করি! আমাকে দায়িত্ব দিলে কবে দ্বীপ থেকে ঝেটিয়ে খেদাতাম ব্যাটাদের!
একটা চেয়ারে জামুবকে বসার ইঙ্গিত করে তার মুখখামুখি আরেক চেয়ারে। বসল লোকটা। সামনে ঝুঁকল। দুজনের চোখের দূরত্ব এখন মাত্র দুই ফুট। তার বাঁকা পিঠ দেখে মনে হয়, শিকারের ওপর ঝাঁপ দিতে তৈরি হচ্ছে সিংহ।
অল রাইট। বলে ফেলো এবার! ঘেঁকিয়ে উঠল লোকটা। অবস্থান জানতে পেরেছ?
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে যেন জামবুর। যত দেরি করে বলা যায়, ততই ভাল। বড় শক্ত কাজ দিয়েছেন আমাকে। কত চেষ্টা করলাম। যখনি ওরা কথা বলেছে, আড়ি পেতেছি। দ্বীপটা সম্পর্কে একটা কথা বলেনি। ওদের জিনিসপত্র…
অতো কথা শুনতে চাই না। দ্বীপটা কোথায় জেনেছ? জেনেছি বলব না, তবে…।
কথা শেষ করতে পারল না জামবু। বিশাল মুঠোর এক ঘুসি এসে লাগল মুখে। ঝটকা দিয়ে ঘুরে গেল মাথা, চেয়ার উন্টে ধুড়ুম করে মেঝেতে পড়ল সে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল, রক্তাক্ত নাক চেপে ধরেছে।
এর জন্যে….এর জন্যে ভুগতে হবে তোমাকে ডেংগু…
ভয় দেখাচ্ছিস? কাছে এসে দাঁড়াল ডেংগু ! জামবুর মনে হল বিশাল এক পাহাড় এসে দাঁড়িয়েছে তার মাথার ওপর। পাহাড়টার হাত রিভলভারের বাঁটে।
আমি…আমি কিছু ভেবে বলিনি, মিস্টার পারভি!
খটাস করে জামবুর কানে পিস্তলের বাটের বাড়ি পড়ল। চুপ, ব্যাটা! খবরদার, আর কখনও আমার নাম মুখে আনবি না। আমি চাই না, এখানে কেউ আমাকে চিনে ফেলুক।
চিনবে না? সবাই তো জানে আপনি অনেক বড় মুক্তা ব্যবসায়ী, সুলু সাগরের থারসডে আইল্যাণ্ড থেকে এসেছেন।
ওখানে জানে, এখানে না। মুক্তার কথা ভাবেই না কেউ এখানে।
বেশ, ডেংগু পারভি নন আপনি। বিষুব অঞ্চলের দক্ষিণ থেকে আসেননি, মুক্তা ব্যবসায়ী নন। তাহলে কে আপনি?
সোজা হল লোকটা। ধুর্ত এক চিলতে হাসি ঠোঁটে ফুটেই মিলিয়ে গেল। আমি? কিছু যদি মনে না কর, তাহলে আমি রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন। আমেরিকায় গো-ইয়ে-ফোর্থ গির্জার পাদ্রী ছিলাম। এখন মিশনারি। সুদুর এই দ্বীপে উড়ে এসেছি এখানকার অসভ্য মানুষগুলোর মনে ঈশ্বরের আলো জ্বালাতে।
গুঙিয়ে উঠল জামবু। আপনার যা ভাবসাব, কি করে বিশ্বাস করাবেন আপনি মিশনারি? দুদুটো খুনের অপরাধে আপনাকে খুঁজছে পুলিশ। ধরতে পারলেই
আবার নিয়ে গিয়ে জেলে ঢোকাবে।
ধরতে পারলে তবে তো। আর বিশ্বাস কিভাবে করাব বলছ? শুনলে অবাক হবে, দোস্ত, আমার বাবা সত্যিই পাদ্রী-ছিল। সানডে ইস্কুলে পড়ালেখা করতে বাধ্য করা হয়েছে আমাকে। বাইবেল আমার মুখস্থ, গড়গড় করে বলে যেতে পারি। মাঝে মাঝে উচ্চারণে গোলমাল করে ফেলি বটে, কিন্তু এখানে কে সেটা বুঝবে? জেলখানার পাদ্রীই ধরতে পারেনি।
কিন্তু এই ছদ্মবেশ কেন?,
ডেংগুর হাসি দূর হয়ে গেল। কেন সেটা আবার জিজ্ঞেস করছ? গর্জে উঠল সে। গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ ছিল, তোমাকে দিয়ে হবে না এই কাজ। মনে মনে তৈরিই ছিলাম, কি করতে হবে।
ছেলেগুলোকে ফাঁকি দেবেন?
নিশ্চয়ই। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে, আমার মত একজন ভদ্রলোককে পেলে খুশিই হবে। ভুলিয়ে ভালিয়ে কথা ঠিকই আদায় করে ফেলব। ইতিমধ্যেই অবশ্য অনেক কিছু জেনে গেছি। বাগ লুকিয়ে রেখেছিলাম প্রফেসরের ল্যাবরেটরিতে। প্রত্যেকটা কথা শুনেছি। প্রফেসর ব্যাটা খুব চালাক। দ্বীপটার অবস্থানের কথা মুখে কিছু বলেনি। ছেলেগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর ওদের পিছু নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডটাও চিনে এসেছি। তবে তাতে তেমন কোন কাজ হয়নি। এক মুহূর্ত থামল সে। কাজ করতে পারার কথা ছিল তোমার। এত পথ একসঙ্গে এসেছ। কিন্তু বুদ্ধ তো, পারবে কি করে।
রিভলভারটা আবার শোল্ডার হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল ডেংগু। জামবুকে দরজা দেখিয়ে বলল, যেতে পার এবার। আমার অনেক সময় নষ্ট করেছ।
কিন্তু জামবু নড়ল না। কথা ভুলে যাচ্ছেন না আপনি?
কথা? কিসের কথা?
আমার টাকা?
কুকুরের মত ঠোঁট ভেঙুচাল ডেংগু। আবার টাকা! কাজটা কি করেছ শুনি? কিছুই জানতে পারোনি, উল্টো ছেলেগুলোর সন্দেহ জাগিয়ে দিয়ে এসেছ। তোমার বরং এখন আমাকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা। যাও ভাগো। নইলে ঘাড় মটকে দেব।
যাচ্ছি, নাকী সুরে বলে দরজার দিকে এগোল জামবু। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকটা নিরাপদ বোধ করল, বলল, এর জন্যে ভুগতে হবে তোমাকে, ডেংগু, কপালে দুঃখ আছে। তোমার সমস্ত জারিজুরি ফাঁস না করে দিয়েছি তো আমার নাম জামবু নয়। এখুনি আমি ছেলেগুলোকে গিয়ে সব বলে দেব।
কালো হয়ে গেল ডেংগুর মুখ। হাত চলে গেল রিভলভারের বাটে। কিন্তু বের করতে গিয়েও করল না। দ্রুত ভাবনা চলেছে মাথায়। জামবু ঠিকই বলেছে, তার সমস্ত জারিজুরি খতম করে দিতে পারে। ওকে থামাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? এই দিনের বেলা খুন্ন করা চলবে না। গুলির শব্দ অনেকের কানে যাবে এখানে গুলি করলে। টাকা দিয়ে দেবে? তাহলেও শয়তানটার মুখ বন্ধ করা যাবে কিনা সন্দেহ। আরও টাকার জন্যে চাপ দেবে, শুরু করবে ব্ল্যাকমেইল। না, অন্য কোন ভাল ব্যবস্থা করতে হবে।
চেহারাটা স্বাভাবিক রাখল ডেংগু। শোনো, এদিকে এস। বুঝতে পেরেছি, দুর্ব্যবহার করে ফেলেছি তোমার সঙ্গে। তোমার সাধ্যমত করেছ, ছেলেগুলো মুখ না খুললে তুমি কি করবে? এরচে বেশি অন্য কেউ হলেও করতে পারত না। ঠিক আছে, টাকা আমি তোমাকে দেব। গলাটা শুকিয়ে গেছে। চল, কোথাও বসে ভিজিয়ে নেয়া যাক।
ডেংগুর এই হঠাৎ পবিবর্তনে সন্দেহ হল জামবুর। কিন্তু টাকা আর মদের লোভও সামলাতে পারল না। লোকটার সঙ্গে চলল সে।
আবার মেইন স্ট্রীটে ফিরে এল ওরা। টিলাটার দিকে এগোচ্ছে ডেংগু, যেটাতে ছেলেরা উঠেছে। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জামবু।
কিন্তু বাংলো পর্যন্ত গেল না ডেংগু। তার আগেই রাস্তা পেরিয়ে ছোট একটা লিকার শপের দিকে এগোল।
একটা গাছের নিচে জটলা করছে কয়েকজন পোনাপিয়ান জেলে, মাছ ধরে ক্লান্ত হয়ে এখন বিশ্রাম নিতে এসেছে। তাদের ঠেলে সরিয়ে দোকানের দরজার দিকে এগোল ডেংগু। জামবুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। রোগাটে একজন শ্বেতাঙ্গ বসে আছে কাউন্টারের ওপাশে।
তাকে বলল ডেংগু, বিল, ও আমার বন্ধু, জামরুকে দেখাল সে। এইমাত্র এল। গলা ভেজানো দরকার। বেশি করে দিতে হবে।
নিশ্চয়, বিল বলল। হতচ্ছাড়া এই দেশে তো কেউ আসে না। বন্ধু এসেছে, তোমার কেমন খুশি লাগছে, বুঝতেই পারছি। দেব, যত চাও।
আনন্দ করতে চাই আজ, জানালার বাইরে তাকাল ডেংগু। মন খুলে। আর পার্টি ছাড়া আনন্দ হয় না। লোক আর পাব কোথায়? জামবু, ওই ব্যাটাদেরই গিয়ে ডেকে আনে।
না না, ওদের নয়, তাড়াতাড়ি বাধা দিল বিল। বাদামিদের মদ খাওয়া এখানে বেআইনী।
আরে রাখ তোমার আইন! পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করে বিলের নাকের কাছে নাড়ল। এই যে আইন। জামবু, যাও, ডেকে আনো।
কানাকাগুলোকে মদ খাওয়ানোর কোন ইচ্ছেই নেই জামবুর। কিন্তু ডেংগুর যদি পয়সা বেশি হয়ে যায় তার কি? দরজায় বেরিয়ে হাত তুলে ডাকল লোকগুলোকে। অদৃশ্য গেলাস ঠোঁটের কাছে নিয়ে মদ খাওয়ার ভঙ্গি করল।
একবারই যথেষ্ট। হুল্লোড় করে ছুটে এল জেলেরা।
মদ তো নয়, পোনাপিয়ানদের জন্যে ডিনামাইট। ওসব ছাড়াই ওদের শান্ত রাখা মুশকিল, যোদ্ধার রক্ত ওদের শরীরে, পূর্বপুরুষেরা ছিল দারুণ লডুয়ে, কথায় কথায় লেগে যেত। মদ পেটে পড়লে যেন উন্মাদ হয়ে যায়। এই জন্যেই ওদের কাছে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
একটা কাজ করতে পারি আমি, বিল বলল। মদ তোমার কাছে বিক্রি করব। তোমার জিনিস তুমি কাকে দেবে, সেটা তোমার ব্যাপার।
ঠিক আছে। খুব কড়া দেখে দাও।…জামবু, এই নাও টাকা, বিশ ডলার তার হাতে গুঁজে দিল ডেংগু। যত খুশি মদ কিনে খাওয়াও বন্ধুদের। টাকা লাগে আরও দেব।
টাকাটা বিলকে দিল জামবু।
ও-কে। এই রসিদটা সই কতো, মেমোবুকটা ঠেলে দিল বিল।
কেন?
নিয়ম। এখানে মদ কিনলে সই করতে হয়। কার কাছে বিক্রি করলাম পুলিশ জানতে চাইবে।
মদ খাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে গেছে জামবু। কিছুই না ভেবে সই করে দিল।
ফিরে চেয়ে দেখল, ডেংগু নেই, কোন্ ফাঁকে চলে গেছে।
ঘন্টা দুয়েক পর তুমুল হই-হট্টগোল কানে এল তিন গোয়েন্দার। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখায় ব্যাঘাত ঘটল ওদের।
ক্যাপ্টেন কলিগ জাহাজে ফিরে গেছে। কুমালো রান্নাঘরে ব্যস্ত।
কুমালো, ডেকে বলল কিশোর। বাইরে গিয়ে দেখ তো কি হয়েছে।
বেরিয়ে গেল কুমালো। খানিক পরেই হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল। দাঙ্গা লেগেছে…-জামবুকে পুলিসে ধরেছে…।
হুড়াহুড়ি করে রাস্তায় বেরোল তিন গোয়েন্দা।
এদিক ওদিক দৌড় দিয়েছে জনাবারো পোনাপিয়ান, মাতাল বোঝাই যায়। ছুরি মারামারি করেছে দুজনে, শরীর জখম, রক্ত ঝরছে। রাস্তার অনেক নিচে জামবুকে ধরেছে দুজন নেভাল পুলিশ।
পথের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা এক লোক, পিঠ সামান্য কুঁজো। হাতে কাল একটা বই।
ছেলেরা এগোল। তাদেরকে দেখে এগিয়ে এল লোকটা। দুর্ভাগ্য, বলল সে। ভারি দুর্ভাগ্য ওদের। করুণার দৃষ্টিতে তাকাল মাতালগুলোর দিকে।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওই জাহাজীটা মদ খাইয়েছে ওদের। বেআইনী, ভীষণ বেআইনী! ঈশ্বর তো নিষিদ্ধ করেছেনই, মানুষও করেছে এখানে। বাইরে থেকে আসে শয়তান, এখানকার নিস্পাপ সরল লোকগুলোর সর্বনাশ করে।
জামবুর দিকে তাকাল কিশোর। পুলিশে খবর দিল কে?
আমি দিয়েছি। এখানকার নাগরিক এবং মিশনারি হিসেবে এটাকে আমার কর্তব্য মনে করেছি।
কিশোর লক্ষ্য করল, লোকটার হাতের ছোট বইটা বাইবেল। ভাবল, পোনাপিয়ানদের সৌভাগ্য, এরকম একজন মানুষ পেয়েছে তাদের মাঝে।
কি শাস্তি হবে?
বেশি না, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মিশনারি। এই বড় জোর মাস দুই জেল। তারপর বের করে দেবে দ্বীপ থেকে। দেশে পাঠিয়ে দেবে।
জামবুর জন্যে সুপারিশ করতে যাবে কিনা ভাবল কিশোর। শেষে ভাবল, থাক, এই ভাল হয়েছে। শয়তানির শাস্তি হয়েছে, তার পথের কাঁটাও দূর হয়েছে। জাহাজে তুললে আবার লাগত ওর বিরুদ্ধে, প্রফেসরের গোপন দ্বীপের খবর জানার চেষ্টা চালাত। আরও কি কি করত কে জানে! জেনেশুনে বিপদ সঙ্গে নেয়ার কোন মানে হয় না। জেলে আটকে থাকলে তার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সৌভাগ্যই বলতে হবে।
জেলটা কি খুব খারাপ?
মোটেই না। খাবে আর ঘুমাবে, ব্যস। ওরকম একটা শয়তানের জন্যে বরং বেশি ভাল।
হাত বাড়িয়ে দিল কিশোর। আমি কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড। আজই এলাম, একটা জাহাজ নিয়ে। শুকমর্নিং স্টার। হারিক্যান একেবারে গুড়িয়ে দিয়েছে জাহাজটাকে।
তাই! আহা! আফসোস করল আগন্তুক। ধরল কিশোরের হাত। আমি হেনরি। রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন। রবিন আর মুসার সঙ্গেও হাত মেলাল সে।
পোনাপেতে কোন গির্জায় আছেন?
না। আমিও এসেছি এই কদিন আগে। এসে দেখি-গির্জা, পাদ্রী সবই আছে এখানে। ছোট এলাকা। কত আর পাদ্রী লাগে? ভাবছি, আশেপাশের অন্যান্য দ্বীপগুলোতে ঘুরব। ঈশ্বরের নাম যারা শোনেনি, সেইসব হতভাগ্যদের শোনাব তার কথা। যাব কিভাবে সেটা ভাবছি এখন।
বোট ভাড়া করবেন?
না। অত টাকা নেই আমার কাছে। দেখি, ওদিকে কোন বোট যায় কিনা। যাত্রী হয়ে যাব। আশা করি আমার অনুরোধ ফেলতে পারবে না কোন দ্রলোকের
ছেলে।
কোন দিকে যাওয়ার ইচ্ছে?
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, যেদিকে খুশি। দ্বীপ আর তাতে মানুষ থাকলেই হল, যারা ঈশ্বরের নাম শোনেনি।…ও, আমার কথাই তো শুধু বকবক করে যাচ্ছি। তোমাদের কথা বল। পোনাপেতেই থাকবে?
না, বলল কিশোর। আশেপাশের দ্বীপ দেখার ইচ্ছে আমারও আছে। সুযোগ যখন পেয়েছি, ঘুরে দেখব। আবার কখন সুযোগ হয় না হয়, আদৌ হবে কিনা তাই বা কে জানে। মিশনারিকে যাত্রী হিসেরে নেয়ার আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েও জানাল না সে, থেমে গেল ঠিক মুহূর্তে। সাবধান করল তার খুঁতখুঁতে সতর্ক মন। অচেনা একজন লোক…ভাবল, দেখাই যাক না লোকটা নিজে থেকে কিছু বলে কিনা?
কিন্তু বলল না মিশনারি। বরং চুড়ান্ত ভদ্রতা আর সৌজন্য বোধেরই পরিচয় দিল। ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন। দোয়া করি, ভালভাবে, সুস্থ শরীরে ফিরে আস আবার পোনাপেতে। ওহহহ, আমার দেরি হয়ে গেল। অসহায় একটা লোককে বিনায় ফেলে এসেছি। বড় গরিব বেচারা। কঠিন অসুখ হয়েছে। একে একে তিনজনের সঙ্গে হাত মেলাল সে। ঘুরে রওনা হয়ে গেল।
নাহ, লোকটা ভালই, ভাবল কিশোর। আমরা সেদিকেই যাব শুনেও কিছু বললেন না, ইনিয়ে বিনিয়েও একবার জানালেন না তিনি যেতে আগ্রহী। আর কথাবার্তায় বেশ শিক্ষিত লোক মনে হল। সত্যিকার মিশনারিদের মতই কথা বলেন, অভিনয় বলে মনে হল না। যথেষ্ট স্মার্ট। তবে মানুষটার চোখ দুটো পছন্দ হয়নি তার, মনে হয় কি যেন গোপন করতে চায় ওই চোখ! তবে সেটা তেমন অস্বাভাবিক নয়। কত লোকের সঙ্গে মিশতে হয় মিশনারিদের, কত রকম জায়গায় যেতে হয়, বুদ্ধিমান না হলে চলবে কেন? সে শুনেছে, অনেক মিশনারিই ঘর তৈরি করতে জানে, চাষ করে ফসল ফলাতে পারে, ভাল ব্যবসা-বাণিজ্য জানে, ইঞ্জিন আর চিকিৎসাবিদ্যায়ও গভীর জ্ঞান আছে। এই ভদ্রলোককে দেখে মনে হল, ওসব –তো জানেনই, আরও বেশি কিছু জানেন। এমন একজন মানুষকে সঙ্গে নিতে পারলে খুশিই হত সে। দেখা যাক, সময় তো আছে। দ্রলোক সম্পর্কে আরও ভালমত খোঁজখবর নিতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে ডেংগু ভাবছে, ছেলেটা সাংঘাতিক চালাক। ওকে টোপ গেলানো কঠিন হবে। ওর মনে সামান্যতম সন্দেহ জাগালেই ভেস্তে যাবে সব। জামবু নয় ও। জামবুকে তো সহজেই জায়গা মত পাঠিয়ে দেয়া গেছে, আর কোন গোলমাল করতে পারবে না। এক সমস্যা তো গেছে, দেখা দিয়েছে আরেক
সমস্যা, কিশোর ছেলেটাকে কি করে পটানো যায়?
ডেংগু ভাবছে, ওই, ছেলের কাছ থেকে মুক্তাদ্বীপের অবস্থান জানতে পারবে।। পেটে বোমা মারলেও মুখ খুলবে না সে। জানতে হলে তার সঙ্গে ওই দ্বীপে যেতে হবে। তারপর কোনভাবে ছেলেগুলোকেও সরিয়ে দিতে হবে পথ থেকে। কিছু একটা ঘটাতে হবে ওদের। পুলিশ যাতে সন্দেহ করতে না পারে, ভাবে নিছক দুর্ঘটনা। তারপর মুক্তা তোলার একটা জাহাজ নিয়ে মুক্তাদ্বীপে চলে যাবে সে, তুলে আনবে সমস্ত ঝিনুক, মুক্তাগুলো বিক্রি করবে নিউ ইয়র্ক আর লণ্ডনের মুক্তা ব্যবসায়ীদের কাছে। ওই দুই শহরের অনেক জুয়েলারকে সে চেনে। দক্ষিণ সাগর থেকে মুক্তা এনে ওদের কাছেই বিক্রি করত,যখন মুক্তার ব্যবসা করত সে। অনেক আগেই প্রফেসর ইস্টউডের মুক্তার খামারের কথা কানে এসেছে তার, যখন সে সেলিবিসে ছিল। তখন পোনাপে যাবার পথে রসদ জোগাড়ের জন্যে ওখানে থেমেছিল প্রফেসরের জাহাজ। তাতে পারশিয়ান গালফ থেকে আনা নমুনাগুলো ছিল। সবুই জানা আছে তার, শুধু একটা কথা ছাড়া, একটা তথ্য–পার্ল ল্যাগুনের অবস্থান।
সেটাও জানতে পারবে, যদি কিশোর পাশা তাকে সঙ্গে নিতে রাজি হয়। জোর করে কিছু করা যাবে না। তাকে কি সহায়তা করবে ছেলেটা? না করার কোন কারণ নেই। শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত একজন মিশনারিকে সঙ্গে নিতে অরাজি হবে কেন?
১১
একটা বোট জোগাড় করেছি তোমাদের জন্যে।
পরদিন সকালে দেখা করতে এসে ছেলেদেরকে সুসংবাদটা জানাল কমাণ্ডার ম্যাকগয়ার। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে আরও দুজন তরুণ অফিসারকে। পরিচয় করিয়ে দিল, লেফটেন্যান্ট ওলসেন আর লেফটেন্যান্ট ফিশার।
বোটটা বেশি বড় না, কমাণ্ডার বলল। তিরিশ ফুট।
যথেষ্ট বড়, কিশোর বলল। চলবে। কি ইঞ্জিন?
ইঞ্জিন খুব ভাল। হ্যাকাটা মোটর, জাপানী। অনেক পুরানো জিনিস যদিও, তবে খুব নির্ভরশীল। জাপানীরা এনেছিল বোটটা, বোনিটো মাছ ধরার জন্যে। এখন আমেরিকান নেভির দখলে। অনেক বছর ধরে পড়ে আছে। খুব অল্প দামেই পেয়ে যাবে।
জায়গাটায়গা কেমন আছে?
চার বাংকের কেবিন আছে একটা। গ্যালি আছে। আর আছে প্রচুর বোটকা গন্ধ।
হাসল কিশোর। নেব ওটা।
ক্যাপ্টেন হয়ে কে যাচ্ছে? কলিগকে জিজ্ঞেস করল ম্যাকগয়ার। আপনিই নিশ্চয়?
।না, আমাকে এখানে থাকতে হবে। সামনে না থাকলে ঠিকমত ঠিক হবে না। শুকতারা। কিশোর ভাল নাবিক হয়ে গেছে, একাই যেতে পারবে।
নতুন দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল ম্যাকগয়ার। অভিযাত্রী…জীববিজ্ঞানী এখন নাবিক। এই বয়েসেই এত কিছু শিখে ফেলেছ…হবে, তোমার উন্নতি হবে জীবনে।
লাল হয়ে গেল কিশোর। খোলাখুলি প্রশংসায় খুশিও হয়, অস্বস্তিও বোধ করে। বলল, আপনার যা বয়েস, স্যার, কমাণ্ডার হয়ে বসে আছেন। নিশ্চয় আমার চেয়ে কম বয়েসেই সাগরে ভেসেছিলেন?
হাহ হাহ করে হাসল কমাণ্ডার। ধরেছ ঠিকই। বারো বছর বয়েসেই নৌকা নিয়ে পাড়ি দিয়েছি পাঁচশো মাইল, একা।
সেই তুলনায় আমি তো অনেক বড়। ক্যাপ্টেন কলিগ আমার ওস্তাদ, নেভিগেশন ভালই শিখিয়েছেন। সুযোগ যখন পাওয়া গেল, দেখি একবার বেরিয়ে, একা কতটা কি করতে পারি।
পারবে পারবে, সাহস দিল কমাণ্ডার। কাজটা মোটেই কঠিন না। কেবল সাহস দরকার। আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। থুতনি চুলকালো সে। পুলিশ তোমার একটা ক্ষতিই করে দিল। একজন মাল্লা কমিয়ে দিল।
কিশোর বুঝল, জামবুর কথা বলছে ম্যাকগয়ার। বলল, না, না, তাতে কিছু। এমনিতেও ওকে আমি নিতাম না। ওকে দিয়ে কোন কাজ হয় না।
আমিও আর নেব না, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল কলিগ। কেন যে ব্যাটাকে নিয়েছিলাম, সেটাই বুঝতে পারছি না এখন। জোরাল সুপারিশ নিয়ে হাজির হল। পরে বুঝলাম ব্যাটা একটা আস্ত শয়তান। কাজকর্ম কিছু করতে চায় না, মহা ফাঁকিবাজ। আর খালি থাকে গোলমাল পাকানোর তালে।
তাই? ম্যাকগয়ার বলল, শোধরানোর ভাল জায়গায়ই গিয়েছে তাহলে। এখানে নেমেই শুরু করেছিল গোলমাল। নেটিভদের ডেকে মদ খাইয়েছে। মারামারি বাধিয়েছে। মদের ব্যাপারে এখানে খুব কড়াকড়ি আইন মিশনারি যখন আমাদেরকে ব্যাপারটা জানালেন…
রহস্যময় পাদ্রীর ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করল না কিশোর। মিস্টার ভিশনের কথা বলছেন? পাদ্রী বললেন, অল্পদিন হল এসেছেন পোনাপেতে। আপনারা কতখানি জানেন তাঁর সম্পর্কে?
খুব বেশি কিছু না। আমেরিকা থেকে প্লেনে করে এসেছে এই হপ্তাখানেক আগে। ক্যালিফোর্নিয়ার কি এক সংস্থার প্রতিনিধি দুক্ষিণ সাগরের অনেক অঞ্চলই খুব ভাল চেনেন। পোনাপের আশেপাশের দ্বীপগুলোতে যাওয়ার জন্যে এটা বোট খুঁজছেন। ভাড়া নেয়ার সামর্থ্য নেই, যাত্রী হিসেবে যেতে চান, আই মীন, ফ্রি রাইড। মানুষকে খুব ভালবাসেন। স্থানীয় অধিবাসীদের ভালর জন্যে জীবন দিতে রাজি।
একমত হল কলিগ। ঠিকই বলেছেন। কাল যা করেছেন, সেটাই তো এর প্রমাণ। নইলে কোন কানাকা কোথায় মদ খেয়ে মরছে, তার বলার কি দরকার?
ইচ্ছে করলে পোনাপেতেই থাকতে পারতেন, ওলসেন বলল। ভাল জায়গা। তবু থাকতে চাইছেন না। তিনি যেতে চান এমন সব দ্বীপে, যেখানে খুব কষ্টে আছে লোকে। তাদের ভাল করতে চান। না, এমন যার মন, তিনি খারাপ হতেই পারেন না। খুব ভাল মানুষ।
ওরকম লোক আমাদের এখানেও দরকার, ফিশার বলল।
ভাবল কিশোর, যদি বানিয়েই থাকেন, শুধু তাকেই বোকা বানাননি রেভারেন্ট হেনরি রাইডার ভিশন, বানিয়েছেন আরও তিনজন বুদ্ধিমান লোককে। মিশনারি হয় অসাধারণ ধূর্ত, তাদের চারজনের চেয়ে বুদ্ধিমান, নয়ত সত্যিই তিনি পাদ্রী–অভিনয় করেননি। লোকটাকে সন্দেহ করছে বলে খারাপই লাগছে তার।
ম্যাকগয়ার বলল, নেটিভদের ওলসেন আর ফিশারও খুব ভালবাসে। সাধারণ লোক নয় ওরা, সরাসরি নেভিতে চলে আসেনি। ওলসেন ছিল স্কুল টিচার, ফিশার ডাক্তার। ওরা এসেছেই এখানে নেটিভদের সাহায্য করতে। যাতে শিক্ষিত, স্বাস্থ্যবান হয়ে গড়ে ওঠে পোনাপিয়ানদের পরের জেনারেশনটা।
রাক্ষসের মত গিলছে ওরা, ওলসেন বলল। লেখাপড়ার কথা বলছি। শেখার জন্যে যেন হাঁ করে আছে।
রোগশোক কেমন এখানে? ফিশারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আছে মন্দ না। আগে অত ছিল না। বিদেশীরা, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গরা এনে ছড়িয়েছে।
হুঁ, বহুদেশে গিয়েই এই সর্বনাশ করেছে শ্বেতাঙ্গরা, কিশোর বলল।
মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার। হ্যাঁ, আমিও শ্বেতাঙ্গ, কিন্তু সত্যি কথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই। প্রায় দেড়শো বছর আগে এখানে যক্ষ্মার জীবাণু নিয়ে এসেছিল স্প্যানিশরা। আশি বছর আগে ইয়্যাপে কুষ্ঠ আমদানী করেছিল এক জার্মান রেডিও অপারেটর। পালাউতে আমাশার বীজ নিয়ে গিয়েছিল ইংরেজ বণিকেরা। আমেরিকানরা এনেছে হাম, বসন্ত আর আরও মারাত্মক কিছু রোগ। এসব রোগে ভোগেনি কখনও এখানকার অধিবাসীরা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই শরীরের। ফলে মশামাছির মত মরতে লাগল। দেখতে দেখতে ইয়্যাপের জনসংখ্যা তেরো থেকে চার হাজারে নেমে গেল। কুসাই দ্বীপে ছিল দুজাহার লোক। এল আমেরিকান তিমি শিকারিরা, দিল রোগ ছড়িয়ে। লোকসংখ্যা দুহাজার থেকে নামিয়ে দিল দুশোতে। ম্যারিনা দ্বীপপুঞ্জে ছিল এক লাখ, হয়ে গেল তিন হাজার।
এখনও মরছে?
না। উপকারটা জাপানীরাই করেছে, মৃত্যু রোধ করেছে। ওদেরকে ধন্যবাদ জানাতে কার্পণ্য করব না আমি। ভাল ভাল ডাক্তার নিয়ে এসে হাসপাতাল গড়েছিল। তবে এখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক ভাল, অনেক উন্নতি করেছি আমরা। প্রতিটি দ্বীপেই এখন আস্তে আস্তে লোকসংখ্যা বাড়ছে।
দ্বীপের মানুষগুলোর জন্যে দুঃখ হল কিশোরের। ওদের জন্যে কিছু করতে ইচ্ছে হল। কিন্তু কি করতে পারবে সে? কি ক্ষমতা আছে? আছে, অতি সামান্য হলেও আছে, পরোক্ষভাবে। মিশনারি ভদ্রলোককে তার বোটে যাত্রী হিসেরে নিতে পারে, নামিয়ে দিতে পারে তিনি যে দ্বীপে নামতে চান। মনস্থির করে ফেলল গোয়েন্দাপ্রধান, সঙ্গে নেবে পাদ্রী সাহেবকে।
১২
অনেক পেছনে পড়ে থাকল পোনাপে। মেঘে ঘেরা উঁচু টটলম চুড়াটাও চোখে পড়ছে না আর এখন।
যেদিকেই তাকানো যায়, আকাশ নীল। সাগর শান্ত। ভাল এগোচ্ছে মোটরবোট। আশেপাশে খেলে বেড়াচ্ছে ডলফিন। উড়ুক্কু মাছের ছড়ানো ডানায় রোদের চমক।
এই বোটটার নাম রেখেছে কিশোর মেঘনা। আগে জাপানী নাম ছিল কিকু, জাপানী এই শব্দটার মানে ক্রিসেনথিমাম। কেনার পর নামটা বদলে ফেলেছে সে।
জন্মের সময় নিশ্চয় ফুলের মতই সুন্দর ছিল বোটটা, এখনও তার কিছুটা অবশিষ্ট রয়েছে। তবে নতুনের সেই সুগন্ধ আর নেই। এখন আছে বোঁটকা গন্ধ, সামুদ্রিক মাছের তীব্র আঁশটে গন্ধ যা কখনও কোন কিছুতেই দূর হবার নয়। এর ডেক আর কিনারে অসংখ্য বোনিটোর কাটার দাগ। আর রয়েছে তলোয়ার মাছের তলোয়ার, ব্যারাকুড়ার দাঁত আর হাঙরের সিরিশ কাগজের মত খসখসে চামড়ার স্বাক্ষর।
বোটের সবাই সুখী। গ্যালিতে দাঁড়িয়ে পলিনেশিয়ান গানের সুর গুন গুন করছে কুমালো। গলুইয়ের কাছে খালি হাতে উড়ুক্কু মাছ ধরার চেষ্টা করছে মুসা। রেলিঙের কাছে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে সাগর দেখছে রনি- নই ধরেছে কিশোর। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের কড়া রোদ অনেকখানি মোলায়েম হয়েছে। সাগরের শীতল বাতাসের পরশে।
বোটে সব চেয়ে সুখী ব্যক্তি এখন রেবারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন। কোন কারণ ছাড়াই একটু পর পর হেসে উঠছেন দরাজ গলায়।
ভালই আছেন, স্যার, আপনি, কিশোর বলল। চিন্তা নাই ভাবনা নাই…
কি সাংঘাতিক এক রসিকতা যেন করে ফেলেছে কিশোর। হাসতে আরম্ভ করল মিশনারি। হাসতে হাসতে পানি চলে এল চোখে। হাসব না…হাসব না বলছ…কল্পনা করতে পার? যেখানে যেতে চাই ঠিক সেখানে নিয়ে চলেছ… থেমে গেল সময়মত। তোমার জন্যেই পারলাম…
না না, এ-আর এমন কি? বাধা দিয়ে বলল কিশোর।
এমন কি মানে! তুমি বুঝতে পারছ না ইয়াং ম্যান, আমার জন্যে এটা কতখানি। কোন ধারণাই নেই তোমার, হাহ, হাহ। অবশেষে যাচ্ছি সেখানে, বাদামি ভেড়াদের এলাকায়…খুশি হব না? এর চেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার আছে ঈশ্বরের কাছে?
লোকটার কথাবার্তা অদ্ভুত লাগল কিশোরের। কোথায় যেন একটা অমিল রয়ে গেছে! পাদ্রীর হাসিটাও যেন কেমন! ভাল লাগে না।
না লাগুক। ভাবনাটা দূর করে দিতে চাইল কিশোর। সবার হাসিই যে সবার ভাল লাগতে হবে এমন কোন কথা নেই।
পাদ্রী সাহেব কি করে-হাসেন, কথা বলেন, সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই তার। ওর কাজ, তাঁকে এমন কোন দ্বীপে নামিয়ে দেয়া, যেখানে তিনি দ্বীপবাসীদের সাহায্য করতে পারবেন। চার্টে দেখা যাচ্ছে ওরকম দুটো দ্বীপ, পার্ল ল্যাগুনে যাবার পথেই পড়ে।
দুপুর। চারপাশে ফথাও ডাঙার চিহ্ন চোখে পড়ছে না। পাল নেই, জাহাজ নেই, এমনকি স্টীমারের ধোঁয়াও নেই কোনখানে। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। সূর্য ঠিক মাথার ওপরে। কোন দিক থেকে এসেছে ওরা, কোন দিকে চলেছে, কিছুই বোেঝার উপায় নেই এখন কম্পাস ছাড়া।
ভোমার হিসেবে ভূল না হলেই বাঁচি, কিশোরকে বলল মুসা। একটু এদিক
ওদিক হলেই এখন সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।
সেটা কিশোরও বুঝতে পারছে। সেক্সট্যান্ট আর ক্রোনোমিটার বের করল। লগবুকের রীডিং দেখল, উত্তর-পশ্চিমে চলেছে। এখন যেভাবে চলেছে, সেরকম চলতে পারলে সহজেই পার্ল ল্যাগুনে পৌঁছানো যাবে।
কিন্তু কিশোর জানে, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। পথভ্রষ্ট করে দিতে পারে বাতাস। তাছাড়া উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের কাছাকাছি হচ্ছে এখন ওরা। আগে থেকে বোঝার উপায় নেই ওই স্রোতের শক্তি কতখানি। কোন দিকে যে বইছে, সেটাও
সঠিক বলা যায় না। মোটামুটি জানা আছে, ঝোঁকটা পশ্চিমমুখী।
বিশাল এই জলরাশির মাঝে খুদে একটা দ্বীপ খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার চেয়েও কঠিন মনে হচ্ছে এখন কিশোরের কাছে। মহাসাগর আর আকাশের অসীমতার মাঝে নিজেদেরকে বড় ক্ষুদ্র আর নগণ্য লাগছে। চার্ট বলছে, পানির গভীরতা ওখানে তিন মাইল। সাগরের তলায় ওখানে রয়েছে অসংখ্য ডুবো-পাহাড় আর উপত্যকা।
লগবুক দেখে বারবার হিসেব মিলাল কিশোর। দেখল, কোথাও ভুল হল কিনা।
রাতের বেলা সেদিন ভালই থাকল আবহাওয়া। আকাশ পরিষ্কার। তারা দেখা যায়, কাজেই যাত্রাপথ ঠিক করতে অসুবিধে হল না। কিশোর, মুসা আর কুমালো পালা করে হুইল ধরছে। রবিন বোট চালাতে জানে না, কাজেই তার হাতে হুইল ছাড়তে ভরসা পেল না কেউ। অনেকক্ষণ ডেকে বসে থেকে, গল্প করে মাঝরাতের দিকে ঘুমাতে গেল সে। মিশনারি বলল, নৌ-বিদ্যার কিছুই জানে না। বসে থেকে আর কি করবে? সারাটা রাত কেবিনের বাংকে কাটাল সে।
পরদিন সূর্য ওঠার পর কিছুটা অশান্ত হল সাগর। বোটও স্থির থাকতে পারল স্বাভাবিকভাবেই, দুলছে, গড়াচ্ছে। নাস্তা তেরি করে আনল কুমালো। ডেকে খেতে বসল সবাই। মিস্টার ভিশন জানাল, শরীর খারাপ লাগছে তার, সীসিকনেস। কাজেই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে আবার গিয়ে ঢুকল কেবিনে।
কিছুক্ষণ পর লগবুকটা নিতে কেবিনে এল কিশোর। দেখে, বইটা খুলে তার ওপর ঝুঁকে রয়েছে মিশনারি। রীডিং টুকে নিচ্ছে একটা কাগজে।
এদিকে পেছন করে আছে লোকটা। পিঠটা বেঁকে রয়েছে, যেন একটা পিপা। হঠাৎ টের পেল, ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। তাড়াতাড়ি পিঠটাকে আরও কুঁজো করে আড়াল করতে চাইল তার কাজ, কাগজের টুকরোটা রেখে দিল পকেটে।
ফিরে চেয়ে হাসল লোকুটা। লগবুকটা দেখছিলাম। ভারি ইনটারেসটিং। না বলেই হাত দিলাম, কিছু মনে করেছ?
না না, মনে করার কি আছে, বলল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে বাঁকা পিঠটার দিকে। কি যেন লুকিয়ে রেখেছে ওই কুঁজ! কোথায় দেখেছে ওই পিঠ?
মনে পড়ল। ঠিক এই রকম একটা পিঠ দেখেছে, প্রফেসরের বাড়ি থেকে সেদিন বেরিয়ে আসার সময়। কালো গাড়িতে চড়েছিল যে লোকটা। তারপর ট্রাকের পিছে পিছে আসতে দেখেছে, লোকটাকে স্পষ্ট দেখেনি, তবে গাড়িটা দেখেছে।
এরকম কুঁজ আরও মানুষের থাকতে পারে। শুধু এই একটা কারণ নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নেই, করতও না কিশোর, কাকতলীয় বলেই ধরে নিত। কিন্তু চুরি করে লগবুকের রীডিং দেখা, নকল করা, কাগজের টুকরো লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা, সন্দেহ বাড়িয়ে দিল তার। প্রফেসরের ভয় ছিল তাঁর ঘরে বাগ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের কথা কেউ আড়িপেতে শুনে ফেলছে। আশঙ্কা অমূলক ছিল না তার। সত্যি শুনেছে। সব শুনেছে, শুধু জানতে পারেনি মুক্তাদ্বীপের অবস্থান। তার পর সেই লোক, কিংবা তার কোন সহকারী মিশনারির ছদ্মবেশে উড়ে এসেছে পোনাপেতে। চালাকি করে উঠে পড়েছে বোটে, তাদের সঙ্গে চলেছে এখন। লগ দেখে জেনে নেবে, দ্বীপটা কোথায়। তারপর যখন খুশি চলে আসতে পারবে এখানে।
ডেকে ফিরে এল কিশোর। মুসাকে সরিয়ে দিয়ে হুইল ধরল। এত সহজে মিশনারির ফাঁদে পড়ল বলে লাথি মারতে ইচ্ছে করছে নিজেকে। মিশনারি! নেটিভদের সাহায্য করতে যাচ্ছে! শয়তান কোথাকার! ভুল যা করার তো করে ফেলেছে, এখন এটাকে শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে।
বুঝতে পারছে, পাকা অপরাধীর কবলে পড়েছে। বলা যায় না, স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে খুন করতেও হয়ত দ্বিধা করবে না লোকটা। এসেছে যখন, মুক্তাদ্বীপের
অবস্থান জানার চেষ্টা করবেই, যেভাবেই হোক।
কি হয়েছে, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করল। ঘামছ কেন? গরম তো তেমন নেই।
ঠাণ্ডা রয়েছে রবিন আর মুসা, ঠাণ্ডাই থাক, ভাবল কিশোর। এখন সব বলে ওদেরকেও দুশ্চিন্তায় ফেলে লাভ নেই। এমনও হতে পারে; মিশনারি সত্যি মিশনারি। কৌতূহলের বশেই দেখেছে লগবুকটা।
যদিও সেটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে জানাজানি হয়ে গেলে আরও খারাপ হবে। লোকটা যদি বুঝে ফেলে তাকে সন্দেহ করা হয়েছে, তাহলে আরও সতর্ক হয়ে যাবে। হয়ত নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চূড়ান্ত কিছু করে বসবে। তাতে ক্ষতি ছাড়া ভাল হবে না। তার চেয়ে বরং ওকে ভাবতে দেয়া উচিত, তার কাজ পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছে। কুমালো, মুসা আর রবিনকে জানালে ওরা কিশোরের মত শান্ত থাকতে পারবে না। এমন কিছু করে বসবে, যাতে মিশনারি টের পেয়ে যাবে, তার ছদ্মবেশ ফাঁস হয়ে গেছে।
আমাকেই ওর ওপর চোখ রাখতে হবে, ভাবল কিশোর। কিছুতেই ভাবতে দেয়া চলবে না যে আমি ওকে সন্দেহ করেছি। আর ওকে ফাঁকি দেয়ার একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
ঘন্টার পর ঘন্টা সমস্যাটা নিয়ে ভাবল আর ঘামল কিশোর। তারপর, পরের নতুন রীডিংটা ঠিক করার আগেই চট করে সমাধানটা এসে গেল মাথায়।
বোটের পজিশন ঠিক করল একরকম, লগে লিখল আরেক রকম। দশ মিনিট করে বাদ দিয়ে দিল।
পরের বার রীডিং ঠিক করার সময় বাদ দিল বিশ মিনিট, তার পরের বার তিদিশ মিনিট, এবং তার পরের বার চল্লিশ মিনিট। এভাবেই বাদ দিতে থাকল, যতবার পজিশন ঠিক করল নতুন করে। লগবুকে বাড়তেই থাকল ভুলের মাত্রা। কিন্তু কিশোরের জানা আছে, কতটা বাদ দিয়েছে, কাজেই সঠিক পথ নির্ণয় করতে তার কোন অসুবিধে হল না।
কেবিনেই ফেলে রাখল লগবুক। দেখে দেখে রীডিং নকল করার প্রচুর সুযোগ এবং সময় দিল ভিশনকে।
এক মিনিট ল্যাটিচিউড সমান এক সামুদ্রিক মাইল ধরা হয়। দশ মিনিট মানে দশ মাইল। কিশোর যতটা সরিয়েছে, তাতে করে আবার এসে ওই রীডিং দিয়ে দ্বীপটা কিছুতেই খুঁজে পাবে না মিশনারি।
লোকটা যদি মুক্তাচোরই হয়ে থাকে, কোন সন্দেহ নেই, ফিরে গিয়ে মুক্তা তোলার জন্যে বড়সড় জাহাজ আর ডুবুরি নিয়ে ফিরে আসবে। তখন যেন কিছুতেই দ্বীপটা খুঁজে না পায়, সেই ব্যবস্থাই করেছে কিশোর। আসল রীডিং দিয়েই দ্বীপটা খুঁজে পাওয়া কঠিন, আর এত বড় ভুল দিয়ে তো অসম্ভব।
পরদিন দিগন্তে কয়েকটা নারকেল গাছের মাথা চোখে পড়ল। ধীরে ধীরে ফুটে উঠল একটা দ্বীপের অবয়ব। কিশোর জানে, ওটা মুক্তাদ্বীপ নয়। কাজেই শান্ত রইল সে। কিন্তু বড় বড় হয়ে উঠল নকল মিশনারির চোখ।
এখানেই নামবে? জিজ্ঞেস করল মিশনারি।
না, কিশোর বলল। আপনি নামবেন নিশ্চয়? অনেক নৌকা দেখছি। নিশ্চয় অনেক মানুষ আছে এখানে, ঈশ্বরের বাণী শোনাতে পারবেন।
কিন্তু আগ্রহী হল না মিশনারি। বলল, না, আরও সামনে যেতে চাই। পোনাপে থেকে এ-জায়গা বেশি দূরে নয়, হয়ত ওখানকার মিশনারিরাই চলে আসে এখানে। আমি যেতে চাই এমন জায়গায়, সভ্য মানুষের নামও শোনেনি যারা।
বিকেলে আরেকটা দ্বীপ দেখা গেল। মিশনারি যখন শুনল, কিশোররা এখানেও থামবে না, নামতে রাজি হল না সে। আরও সামনে যেতে চায়।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল কিশোর, পোনাপে থেকে যতই দূরে সরে আসছে, চার্ট ততই গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই মিলছে না। কোন কোন দ্বীপের চিহ্নের পাশে লেখা রয়েছে পি. ডি. অর্থাৎ, পজিশন ডাউটফুল (অবস্থান সন্দেহজনক)। খুদে খুদে অনেক দ্বীপ দেখা গেল, যেগুলো দেখানই হয়নি চার্টে। কিংবা চার্টে আছে, এমন অনেক দ্বীপ খুঁজে পাওয়া গেল না। বোঝা গেল, অনেকটা আন্দাজের ওপরই তৈরি হয়েছে চার্টটা। যে করেছে তার কাছেও প্রশান্ত মহাসাগরের এই অচেনা অঞ্চল অচেনাই থেকে গেছে। এ-যেন এক হারানো পৃথিবী।
নানারকম সমস্যায় না ভুগলে এখানে কিছুদিনের জন্যে হারিয়ে যেতে আপত্তি ছিল না কিশোরের। তার মাথা জুড়ে রয়েছে এখন জটিল সব অঙ্ক। মিশনারির ভয়ে কাগজ-কলমের সাহায্য নিতে পারছে না। একটু ভুলচুক হয়ে গেলে কি সর্বনাশ হয়ে যাবে আন্দাজ করতে পারছে। কঠিন হিসেব আর জ্যামিতির বোঝায় এখন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে তার মগজ। এইভাবে মনে মনে হিসেব করে কতটা কি করতে পারবে? ভুল ইতিমধ্যেই হয়ে যায়নি তো? পারবে ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে? তার মনে হল, পারলে, সেটা অলৌকিক ব্যাপার হয়ে যাবে।
সারাক্ষণ মনে বাজছে একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট পুব, এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট উত্তর। তার ভয় হচ্ছে, ঘুমের ঘোরে না জোরে জোরে বলে ফেলে। মাত্র চারফুট দূরে বাংকে ঘুমায় ভিশন। তার কানে কথাগুলো চলে যাবেই। তাহলেই সব শেষ, এত কষ্টের কোন মানে থাকবে না আর।
উজ্জ্বল তারার আলোয় আরেকটা রাত বোট চালানো হল। পরদিন সকালে সূর্য উঠল। হুইল ধরে আছে মুসা। গলুইয়ের কাছ থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, রবিন, ডাঙাআ, ডাঙা দেখা যাচ্ছে!
হয়েছে,কেবিনে থেকে ভাবল কিশোর। দেখে ফেলেছে! তাড়াতাড়ি বাংক থেকে নেমে ডেকে বেরিয়ে এল সে। তার পিছে পিছেই বেরোল মিশনারি।
সামনে, সাগরের মাঝে যেন শুয়ে রয়েছে প্রবাল প্রাচীরের একটা আঙটি। একটা সবুজ ল্যাগুনকে ঘিরে রেখেছে। দুটো জায়গায় চওড়া হয়ে গিয়ে বীপ সৃষ্টি করেছে প্রাচীরটা, তবে ওগুলোতে উদ্ভিদ প্রায় নেই। ছিল, এখন নেই। এরকম দৃশ্য আসার সময় আরও কয়েকটা দ্বীপে দেখে এসেছে ওরা। এর জন্যে দায়ী হারিক্যান। নষ্ট করে দিয়েছে সব। আর এই দ্বীপ দুটোকে যেন একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে নারকেল গাছের মাথা, গোড়া থেকে আটদশ ফুট উঁচু কাণ্ডগুলো শুধু রেখে গেছে।
উত্তেজনায় কাঁপছে কিশোরের বুক। ঠিক জায়গাতেই এসেছে? ভুল করেনি তো? যন্ত্রপাতি নিয়ে বসল। ভালমত দেখেটেখে হিসেব বের করল। না, ঠিকই তো আছে। মগজে যা লেখা হয়ে আছে সেই একই রীডিং, একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট পুব, এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট উত্তর।
তাহলে এটাই সেই পার্ল ল্যাগুন! মুক্তাদ্বীপ!
নব্বই মিনিট করে বাদ দিয়ে লগবুকে রীডিং লিখল সে: পার্ল ল্যান পাওয়া গেল। একশো ছাপ্পান্ন ডিগ্রি বেয়াল্লিশ মিনিট পুব, দশ ডিগ্রি চার মিনিট উত্তর।
যাও ব্যাটা, এবার লিখে নাও গিয়ে কাগজে, মনে মনে হাসল কিশোর। আবার যদি আস, দেখবে দ্বীপটা নেই। কিংবা যদি কোনটা থাকেও সেটা এই দ্বীপ নয়। পশ্চিমে সরবে নব্বই মাইল, দক্ষিণেও সরবে নব্বই মাইল। তুমি তো তুমি, ব্যাটা, দুনিয়ার অভিজ্ঞতম নাবিকও এই রীডিং দিয়ে পার্ল ল্যাণ্ডন খুঁজে বের করতে পারবে না।
ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল কিশোর, ভিশন যে নাবিক নয় এই জন্যে। ডেকের ওপরে চলাফেরার ভঙ্গিই বুঝিয়ে দেয় লোকটা জাহাজী নয়। সাগরে বড় ঢেউ উঠলে, জাহাজ বেশি দুললে ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যায় তার। ইঞ্জিন চালাতে আর হুইল ধরতে পারে বটে, কয়েকবার দেখলে আনাড়ি লোকও সেটা পারবে। এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। সেক্সট্যান্ট বোজার চেষ্টা করেছিল একবার, উল্টো করে ধরেছিল যন্ত্রটাকে, দেখেছে কিশোর। নটিক্যাল অ্যালমানাকে হাত দেয়নি একবারও। পুরোপুরি নির্ভর করে বসে আছে কিশোরের করা হিসেবের ওপর।
যাও, ভালমত দেখে নাও পার্ল ল্যাগুন, মনে মনে ভিশনকে বলল কিশোর। জীবনে আর দেখার সুযোগ তো পাবে না।
ল্যাগুনটাকে চক্কর দাও, হুইল ধরে থাকা মুসাকে বলল কিশোর। দেয়ালের বেশি কাছে যেয়ো না।
মাইলখানেকের বেশি হবে অ্যাটটার বেড়। পশ্চিম দিক দিয়ে ল্যাগুনে ঢোকার বেশ সুন্দর একটা পথ আছে। পুরো এক চক্কর ঘুরে এসে ওখান দিয়ে ঢুকতে শুরু করল মুসা। বেশ কায়দা করে ঢেউয়ের মাথায় চড়ে চড়ে বোটটাকে ঢুকিয়ে ফেলল ভেতরে। ওখানটায় পানি খুব কম। ছয় থেকে বারো ফুটের মধ্যে। পরিষ্কার সবুজ পানির ভেতর দিয়ে তলা দেখা যাচ্ছে। প্রবালের স্বর্গ যেন জায়গাটা। রামধনুর সাত রঙ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের নানা আকারের প্রবাল-দুর্গ।
পানির নিচে পরীর রাজ্য, প্রাচীরের ওপরে হারিক্যানের ধ্বংসলীলা, একটার সঙ্গে আরেকটার কোন মিল নেই। বড় বেশি চোখে বাজে। খুদে দ্বীপ দুটোর দিকে তাকালেই একটা ধাক্কা খেতে হয়।
খাইছে! এখানে আটকা পড়তে চাই না আমি কিছুতেই! গায়ে কাঁটা দিল মুসার। তুফানে করেছে কি দৈখ! আমার তো মনে হয় ইঁদুরও বাঁচেনি। পার্ল ল্যাগুন, না? মুক্তাদ্বীপ? তার চেয়ে বল মৃত্যু দ্বীপ কিংবা ক্ষুধার দ্বীপ।
কিশোরের নির্দেশে নোঙর ফেল কুমালো। ভালমত দেখে জায়গা নির্বাচন করেছে গোয়েন্দাপ্রধান। উঁচু হয়ে এখানে উঠে গেছে প্রাচীরের কাঁধ, ফলে ল্যাগুনের উত্তর অংশটা চোখে পড়ে না। ভেসে ভেসে দেয়ালের কয়েক ফুটের মধ্যে চলে এল বোট, তারপর শেকলে টান লেগে আটকে গেল, আর সরতে পারবে না, ঘষাও লাগবে না ধারাল প্রবালের গায়ে।
তীরে নামব আমরা, ভিশনকে বলল কিশোর। আপনি নিশ্চয় নামবেন না। মানুষ নেই। ঈশ্বরের বাণী কাকে শোনাবেন? বোটেই থাকুন। নাকি মাছকে শোনানোর ইচ্ছে আছে?
কিশোরের রসিকতায় হাসল মিশনারি। বলল, না না, আমি থাকি। তোমর যাও। এখানে নেমে কোন লাভ নেই এখন আমার।
তার শেষ কথাটা রহস্যময়। কিশোর বুঝলেও, অন্য তিনজন এর মানে বুঝল না।
বোট থেকে আগে নামল কুমালো। ওখানে পানি এক ফুটেরও কম। ছপা ছপাৎ করে পানি ভেঙে শুকনোয় উঠল ওরা। এগিয়ে চলল উত্তরে। খুব তাড়াতাড়িই বোটটাকে ওদের দৃষ্টির আড়াল করে দিল দেয়াল।
পশ্চিমের দেয়াল ধরে ধরে চলে এল ওরা একটা চওড়া জায়গায়, যেখানে সৃষ্টি হয়েছে দুটো দ্বীপের একটা, ল্যাগুনের উত্তর-পশ্চিম কোণ এটা। তারপর বোতলের গলার মত সরু হয়ে গেছে দেয়ালটা, গিয়ে মিশেছে আরেকটা দ্বীপের সঙ্গে। ওটা উত্তর-পূর্ব কোণে।
ওখানেই কোথাও আছে, কিশোর বলল। প্রফেসর বলেছিলেন দ্বীপের উত্তরপূর্ব কোণে।
দ্বিতীয় দ্বীপটা চওড়ায় কয়েকশো গজ। ঝোপঝাড় ছিল, একসময়, ছিঁড়ে, উপড়ে নিয়ে গেছে ঝড়। পুরো দ্বীপটাই বোধহয় পানির নিচে চলে গিয়েছিল। নারকেলের কাণ্ডগুলো দেখে মনে হয় কবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভ। উপড়ানো কিছু কাণ্ড পড়ে আছে এখনও, তবে বেশিরভাগই ভেসে গেছে।
হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে। দেয়ালের ওপর জমে রয়েছে প্রবালের স্তূপ, কোন কোনটা দশ ফুট উঁচু। হোঁচট খেয়ে পড়লে চিরে ফালাফালা হয়ে যাবে হাঁটু আর হাতের চামড়া, এত ধার ওসব প্রবাল।
দ্বীপের পাশে ল্যাগুনে গভীর একটা খাঁড়ি রয়েছে, তিনদিক থেকে এমনভাবে ঘেরা মনে হয় একটা খুদে উপসাগর। তলা অস্পষ্ট, কারণ পানি ওখানে দশ ফ্যাদমের বেশি। চওড়ায় প্রায় একশো গজ। দেখলেই মনে হয় কি যেন এক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে গভীর এই খড়িটা।
ভাগ্যিস কুমালোকে সঙ্গে এনেছিলাম, মুসা বলল। এত নিচে নামতে পারব আমি। কিশোর, তুমি?
কি যে বল না ছাই। তুমি না পারলে আমি পারব?
নামার জন্যে কাপড় খুলতে গেল কুমালো, তাকে থামাল কিশোর, রাখ, কথা আছে। এই, বস এখানে সবাই।
মিশনারিকে সন্দেহ করছে, একথা সঙ্গীদেরকে জানাল কিশোর।
সন্দেহ আমারও হয়েছে,কুমালো বলল। অনেক মিশনারি দেখেছি আমি। কারও স্বভাবই ওর মত ছিল না। লোকটাকে একটুও পছন্দ হয় না আমার।
আমারও না, রবিন বলল। চল, গিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করি। ৫ লিখুলি জিজ্ঞেস করি, আসলে সে কে?
না, উচিত হবে না, কিশোর বলল। পিস্তল-টিস্তল থাকতে। পরে। থাকুক। আমাদেরকে খুন করার সাহস নিশ্চয় হবে না।
কিছুই বলা যায় না। হয়ত অনেক টাকার মুক্তো রয়েছে এই উপ…হ্যাঁ, উপসাগরই বলি, খাড়ি শুনতে ভাল্লাগে না। লক্ষ, হয়ত কোটি টাকারও হতে পারে। এত টাকার জিনিস পাওয়ার জন্যে খুন করতে দ্বিধা করবে না অনেকেই। আর মনে রেখ, এটা রকি বীচ নয়, পথের মোড়ে মোড়ে পুলিশ নেই। বেআইনী কাজ চলছে কিনা দেখতে আসছে না কেউ। এখানে অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়া সহজ। কাজেই, লোকটাকে খেপানো উচিত হবে না। এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। যেমন ভাবে চলছি আমরা, তেমনি চলব। বুঝতে দেব না যে ওকে সন্দেহ করেছি। এমন কোন আচরণ করবে না, যাতে ব্যাপারটা তার কাছে ফাঁস হয়ে যায়। ঠিক আছে?
মাথা ঝাঁকাল তিনজনেই।
গুড। কুমালো, এবার নামতে পার। দেখা যাক, কি আছে উপসাগরের তলায়।
(দ্বিতীয় খণ্ডে সমাপ্য)