জুডিথ গম্ভীরভাবে বলল, কোনোদিন আমার স্বামীটামী হবে না। বিয়েটা কী? সংসারে মেয়েদের কী আর কিছু করার নেই?
পোয়ারো কড়া অভিভাবকের মত বলল, বিয়েটা সবার আগে। সংসারে তাই হয়ে আসছে
জুডিথ পোয়ারোর সব কথা মেনে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।
পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন নয় বুড়ো বয়সে বুঝবে। এর মধ্যে ডঃ ফ্রাঙ্কলিন এলেন এবং তার সঙ্গে পরিচয় হল। বলিষ্ঠ, বছর পঁয়ত্রিশের যুবক। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল অন্যমনস্ক ধরনের।
ঘরে ঢুকেই পোয়ারোর চেয়ার একপাক ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, আমায় ক্ষমা করবেন।
ওর ছেলেমানুষী দেখে অবাক হবেন।
জুডিথ বলল, আমার বাবাকে নিশ্চয়ই চেনেন?
ফ্রাঙ্কলিন প্রথমে একটু লজ্জা পেয়ে তার পর আমার সঙ্গে করমর্দন করে বলে উঠল, শুনেছিলাম আপনি আসবেন। উত্তরের প্রত্যাশা না করেই জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলল, জুডিথ তাহলে
জুডিথ বলল, এখন সময় দিতে পারছি না, বাবার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
ফ্রাঙ্কলিন সলজ্জ দৃষ্টিতে বলল, সত্যি মাঝে মাঝে আমি ভীষণ স্বার্থপর হয়ে পড়ি। ক্ষমা করবেন। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ হতেই বলে উঠল, বারবারাকে কথা দিয়ে দিলুম ডিনারের আগে উঠে কিছু পড়ে শোনাব, এখন চলি, বলে বেরিয়ে গেল।
জুডিথকে বললাম, মিসেস ফ্রাঙ্কলিন এখন কেমন আছেন? আগের মত নেই। স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছে।
বললাম, এ বয়সে অথর্ব হয়ে পড়া যে কি বেদনাদায়ক।
হঠাৎ জুডিথ ডাক্তারের পক্ষ হয়ে বলল, এ যে কী ভীষণ অবস্থা একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে। যারা রিসার্চ করেন তারা সবসময়ই চান একজন স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীকে পাশে।
আমি উম্মা প্রকাশ করে বললাম তোমরা, এই আজকালের ছেলেমেয়েরা বড় বেশি স্বার্থপর। কোনো দ্বিরুক্তি না করে জুডিথ বলল, আমি শুধু ওঁর প্রকৃত অবস্থার কথা বলেছি।
শুধু পোয়ারো বলল, এই সদাশিব ডাক্তারটির কর্তব্য বোধ আছে বলতে হয়, কেমন তাড়াতাড়ি চলে গেলেন স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু জুডিথ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ডাক্তার যেমন বোকা তেমন তার স্ত্রী। নার্স রাখা হয়েছে, দরকার হলে সে-ই পড়ে শোনাবে। আমি হলে এইসব ছেলেমানুষী বরদাস্ত করতাম না।
যার যেমন ইচ্ছে, বললুম আমি। পোয়ারোও বলল, খুকুমণি, তোমার সঙ্গে আমিও একমত হতে পারছি না। ফ্রাঙ্কলিনের স্ত্রী হয়তো সব সময় স্বামীকে চোখের সামনে রাখতে চান। জুডিথ নিজের মনে বলে গেল…. ভদ্রমহিলাটি কাণ্ডজ্ঞানহীন। না হলে ঐ সব বস্তাপচা উপন্যাস পড়ে শুনবে, ভালো জিনিস শুনবে না। আর দেখা হলেই নিজের স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য। উহঃ। অসহ্য, বড় একগুঁয়ে মহিলাটি। কেবল বেড়ালের মতন মিউমিউ করবে। আমি এইসব ঘ্যান ঘ্যানানি পছন্দ করি না, আর যে করে করুক না কেন।
আমি বলে উঠলুম, জুডিথ তোমার এই খুড়ো মশায় কিন্তু জাঁদরেল মেয়েদের বেশি পছন্দ করেন।
অমনি পোয়ারো ফেঁড়ন কেটে বলল, তোমার বাবা আবার সোনালী নরম চুলের টুসটুসে মেয়েদের বেশি পছন্দ করে। এর জন্য কম বিপাকে পড়তে হয়নি ওকে। জুডিথ হেসে বলল, তোমরা দুজনে কেউই কম যাও না।
জুডিথ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠে পড়লুম, চানটানও সারা হয়নি।
পোয়ারো হুইলচেয়ারে আঁটা বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গেই এক নতুন ভৃত্য এল। ভর্জে কোথায়? বললাম, সে তো বহুকাল তোমার সঙ্গী ছিল।
ও দেশে গেছে, শরীর অসুস্থ। সবদিক দেখে শুনে শীঘ্রই ফিরবে। নতুন গৃহভৃত্যের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল, কারটিস এরপর আমারও ব্যবস্থা করো।
কারটিস হাসল। ওর চেহারাটা গোবেচারা ধরনের হলেও জবরদস্ত। ও চলে যাওয়ার পর পোয়ারো সেই কাগজগুলো বাক্সে তালা দিয়ে রাখল এবং আমিও ঘর ছাড়লাম।
.
০৪.
পোয়ারো আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই খাবার টেবিলে একটু উন্মনা ছিলাম। চিন্তা ভাবনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সারাজীবন রহস্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে শারীরিক অপটুতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বৈকল্য ঘটাটাও ওর পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই রহস্যের ভৌতিক কল্পনা করাটা স্বাভাবিক। হয়তো এথারটিনের স্বামীকে খুন, শ্রমিকের তার স্ত্রীকে খুন… ঐগুলো সবই ঘটেছে, কিন্তু এর মধ্যে নতুনত্ব কোথায়? এসব তো আকছার ঘটে চলেছে। কিন্তু পোয়ারো সেই অদৃশ্য আততায়ীকে মনশ্চক্ষে দেখছে। কে সেই ভদ্রলোক?
পোয়ারোর চিন্তাধারাকে আমি ছোট করে দেখতে চাই না। হয়তো সত্যিই কোনো খুন হবে, আবার হয়তো নয়। ও আমার সাহায্য চাইছে অথছ খুনীর পরিচয় আমাকে জানাতে চায় না। অদ্ভুত! আমার উপর যদি ওর আস্থাই না থাকে তাহলে আমাকে কেন ওর চোখ-কান হতে বলবে? ওর ছেলেমানুষী দেখলে হাসি পায়। আমার মুখ দেখে নাকি সবাই বুঝে ফেলবে আমি কি ভাবছি। এর থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে।
ডিনারের ঘন্টা বাজল। হাসি মুখ নিয়েই ওখানে গেলাম। শুধু কে খুনী তো বোঝার চেষ্টা করব মনে মনে ভাবলাম। অনেক ভেবে মনে করলাম পোয়ারোর চিন্তা ভাবনাকে মর্যাদা দিতে হবে। মনে করে নিই এই একই ছাদের নিচে খুনীও আছে। কিন্তু। কে সে? এটা কি খুব সহজ কাজ?
মিস কেলি এবং মেজর এলারটনের সঙ্গে ডাইনিং রুমে যাওয়ার আগে পরিচয় হল। মিস কেলি দীর্ঘাঙ্গী, সুশ্রী, বয়স চৌত্রিশ হবে। এলারটনের দীর্ঘ দেহ এবং মেয়েদের আকৃষ্ট করার চেহারা দেখেই হয়তো একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। অথবা তার কথাবার্তার ধরন দেখে। যতই ওর পরিচয় আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ততই আমি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছি। হয়তো এর কারণ জুডিথের সঙ্গে ওর অন্তরঙ্গতা। কেন যে মেয়েরা এই সব লোকগুলোকে এত পছন্দ করে ভেবে পাই না। লোকটির বয়স চল্লিশ হবে। মনে হয় মদ্যপান করেন বা রাত জেগে জুয়োটুয়ো খেলেন। কর্নেল লাটরেল, বয়েড ক্যারিংটন সবাই ওকে সমীহ করেন। শুধু এর প্রতিপত্তির জন্য?