বহুক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারিনি। কে যেন আবার আমায় স্টাইলসের সেই ঘরে পোয়ারোর কাছে টেনে নিয়ে এল। বললাম এ হতে পারে না, যেমন করে থোক এ রুখতেই হবে।
অপার্থিব এক জ্যোতিতে পোয়ারোর মুখ উদ্ভাসিত হল। প্রথমে সস্নেহে পরে গভীর মমতায় বলল, হে আমার প্রিয় সুহৃদ। কী বলে তোমায় শ্রদ্ধা জানাব। এত নির্ভরতা তোমার আমার উপর। যদি তার সামান্যতমও দেখাতে পারতাম। হায় বন্ধু
পোয়ারোকে আমার চেয়ে কেউ বেশি জানে না। বললাম, তুমি পারো না এমন কোনো কাজ নেই। ও বলল, তোমার এই নির্ভরতার মর্যাদা যদি দিতে পারতাম তাহলে আমার চেয়ে কে বেশি সুখী হত? একটু ভেবে দেখ, একজন হত্যাকারীকে ফাঁদে ফেলা যায় কিন্তু হত্যাকে থামানো যায় কী ভাবে? এ কী কখনও সম্ভব?
পোয়ারোর হাত ধরে বললুম, তুমি পারো যদি তুমি আগে থেকে জেনে থাক কে সেই এক্স।
গভীর খেদের সঙ্গে বলল, যতটা ভাবছ, বাস্তবে ততটা স্বচ্ছ নয়। হয়তো তিনরকমভাবে আমরা কিছু একটা করলেও করতে পারতাম। প্রথমতঃ যার উপর আঘাত আসবে তাকে আগে থেকে সাবধান করে। তাকে বলতে পারি হত্যাকারীর অদৃশ্য খাড়া নেমে আসছে তোমার উপর। ভেবে দেখ বন্ধু এভাবে কোনো মানুষকে তুমি বুঝিয়ে উঠতে পারবে না, তোমার জীবন বিপন্ন। যদি বলা যায় হত্যাকারী আপনার খুব পরিচিত তবে সে হেসে উঠবে। ভাববে হয় রসিকতা, নয় তার উপর ঈর্ষান্বিত হয়েছে। তুমিই বল এ কাজ কি সম্ভব?
দ্বিতীয় পথ হল হত্যাকারীকে সতর্ক করে দেওয়া, সাবধান। যদি অমুক সময়ে খুন হয় তবে তুমিই খুনী এবং তখন তোমার জন্য ফাঁসির দড়ি অপেক্ষা করবে। এ তো খুব ছেলেমানুষী ব্যাপার। খুনীরা খুব চালাকচতুর, তখন সে অন্য পথ বেছে নেবে যা শত চেষ্টায় ধরতে পারবে না।
ও সামান্য থামতেই জিজ্ঞেস করলাম, তৃতীয় পথটি কি?
হা। বলল, এই পথটি মোটেই কুসুমাকীর্ণ নয়। তা হবে যেমন বুদ্ধিতে ক্ষুরধার তেমন চিন্তায় থাকবে নব নব উন্মেষণা। দৃষ্টি থাকবে জাগ্রত প্রহরীর মত, মন থাকবে বাতাসের মত গতিময়। প্রতিটি মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যুক্তি তর্ক দ্বারা আততায়ীর গতি প্রকৃতি বুঝতে হবে। তার মানসিক স্থিতিশীলতা বুঝতে হবে। যখনই চরম মুহূর্ত উদিত হবে ঝাঁপিয়ে পড়বে আততায়ীর উপর। যদি সবার প্রত্যক্ষ উপলব্ধির সামনে তার মনের বাসনাকে উন্মুক্ত করে দেখা যায় তবে যে দুটি প্রথমোক্ত কাজ আমরা করতে পারিনি, তা এবার করলেও করতে পারি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এসব ঘটনা ঘটানো মুস্কিল। খুনী তার ইচ্ছেটাকে সবার থেকে গোপন রাখবে, ফলে বাস্তবে কোনো প্রস্তুতি নিতে পারব না। যেহেতু তুমি ভদ্রলোক সেহেতু যিনি ঘটনা ঘটাতে পারেন তার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে পারবে না। তাই তৃতীয় পথ সম্বন্ধে আলোচনা করব কিনা ভাবছিলাম। নিজের সম্পর্কে গর্ববোধ করলেও আমি গর্দভ বনতে রাজী নই।
তাহলে আশু কর্তব্য কী?
হয়তো তিনটি চেষ্টাই চালিয়ে যেতে হবে যদিও প্রথমটা দুঃসাধ্য।
কেন, আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ওটাই সহজতর।
পোয়ারো বলল, হয়তো ঠিক। কিন্তু বন্ধু আসলে আমি এখনও ঠিক সেই লোকটিকে চিনে উঠতে পারিনি।
তুমিও জানো না! এবার রাজ্যের সব বিস্ময় আমার চোখ উপচে পড়ে।
পোয়ারো বলল, শতকরা একশভাগ সত্যি কিন্তু যে খুন হতে চলেছে তার পরিচয়টা জানা নেই। তাহলে বুঝতে পারছ কাজটা খুব সহজ নয়।
কিন্তু পোয়ারো খুনীর উদ্দেশ্য কী? সে কী চায়? কেন চায়?
হঠাৎ খুশী হয়ে উঠে বলল, শেষ পর্যন্ত তুমি ভাবতে শিখেছো দেখে আনন্দ হল।
আমি বুঝতে পারছি যে খুন হতে চলেছে তাকে না চিনলেও, এক্স কে চেনো।
মাথা নাচাতে নাচাতে পোয়ারো বলল, প্রাণসখা হে আমার, সেকথাটি এখনই বলছি না।
গোপন কথাটি গোপনেও শুনিয়ে যাও, ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি।
কিন্তু কাজটি তো মোটেই করতে পারছি না প্রিয়। আমি চাই না দিনরাত তুমি খুনীর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকো, এই সেই খুনী যাকে ইচ্ছে করলে যে কোনো সময়ে ধরিয়ে দিতে পারি। তুমি কি ভেবেছো আমায়? এটুকু চেপে রাখতে পারব না? তুমি হাবে ভাবে দেখাবে আমি কিছুই জানি না–এরকম অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না। তাতে খুব সাংঘাতিক ক্ষতি হবে। তার থেকে এখন অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে থাকা যাক, যখন সময় হবে দুজনে আঁপিয়ে পড়ব।
বললাম, তুমি সেই আগের মতন ঘুঘুই আছো এবং হঠাৎ আমার কথার মাঝে দরজায় ঘা পড়ল। থেমে গেলুম।
পোয়ারো ডাকল–এস। দরজা ঠেলে আমার দুহিতা জুডিথ এল।
যদিও বর্ণনায় আমি চিরকাল কাঁচা তবুও আর সাধারণ পাঁচটা মেয়ের মতন বেশ লম্বা। ও প্রকৃত অর্থে সুন্দরী হলেও ওর সৌন্দর্যে উপচে পড়া যে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে সবসময়, তা বাবা হয়ে আমার ব্যথিত করে।
জুডিথের সেই জেদী স্বভাব এখনও বদলায়নি। আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না বা আদর করল না, শুধু হেসে জিজ্ঞেস করল, কখন এলে?
ওদের আধুনিকতার সঙ্গে কথা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, বললাম, এই তো কিছুক্ষণ।
মিষ্টি অনুযোগের সঙ্গে বলল, বেশ চালাক হয়েছে তো, একটুও খবর দাওনি?
পোয়ারো হঠাৎ জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, এখানকার খাওয়া দাওয়া, রান্নাবান্নার কথা সবই শুনিয়ে দিয়েছি পাছে তোমার পিতাঠাকুরের কষ্ট হয়।
জুডিথের এখানকার রান্না কী যাচ্ছেতাই? প্রশ্নের উত্তরে পোয়ারো বলল, কেন বোকা সাজার চেষ্টা করছ? দিনরাত ঐ খাঁচায় বন্দী হয়ে আছে। নিজের ফুলের মতন আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ, নীলছোপ ধরেছে। তোমার বয়সের মেয়েরা শেখে সুন্দর সুন্দর রান্না করে স্বামীর হজমশক্তি কিভাবে বাড়াতে হয়। সে বয়সে তুমি টেস্ট টিউব নাড়াচাড়া ও মাইক্রোস্কোপে পোকামাকড় খুঁজে বেড়াচ্ছ।