একটু মদ নিয়ে পোয়ারো বলল, কেন আমি আবার সেই পুরনো স্টাইলস সেন্ট মেরীতে এসে উঠলাম জানো– এখানে একটি হত্যাকারীকে ফাঁদে ফেলব বলে ফাঁদ পেতে বসে আছি।
বৃদ্ধ, অথর্ব পঙ্গু হলেও এখনও রসিকতা আছে ওর মধ্যে। রহস্য জাল গুটিয়ে গুটিয়ে খুনীকে ফাঁদে ফেলার সময় তো অনেককাল আগে চলে গেছে। এ নিশ্চয়ই এর ছলনা মনে হল। আমার উৎসাহে ভাটা পড়তে দিতে চায় না বলে।
মরিয়া হয়ে আসল কথাটা জানতে চাইলুম। গলায় জোর এনে বলল, কাঠ খড় পুড়িয়ে এ বয়সে ছেলেমানুষী করে তোমাকে এখানে ডেকে আনার কোনো সাধ নেই। আমার দেহ পঙ্গু, অথর্ব হলেও মস্তিষ্ক সূর্যের ন্যায় দীপ্যমান। এখনও মস্তিষ্ক আমার আগ্নেয়গিরির মত অগ্ন্যুৎপাতে অভ্যস্ত, প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছে আমার দেহ। এখন তুমি, আমার প্রিয় বন্ধু। আমার হাত-পায়ের কাজটা সারবে।
মনে হল ঠাট্টা করছে। কিন্তু ও বলল ঠাট্টা নয়, আমরা একবার শিকারে নেমে পড়তে চাই
মনশ্চক্ষে পোয়ারোকে আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলুম। তার মধ্যে কোনো ছলনা বা চপলতা নেই। তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল–শেষ পর্যন্ত তুমি আশ্বস্ত হয়েছে। আমাকে ভেবেছিলে হয়তো মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। বললাম-কী এমন গভীর রহস্য আছে এখানে, যেখানে তুমি সেই আগের পোয়ারো হয়ে উঠতে পারো? আমার এখনও এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ পরিচিত হয়ে ওঠেনি।
একটু গম্ভীর হয়ে পোয়ারো জিজ্ঞেস করল, কজনকে এ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছো? উত্তরে বললাম–লাস্টরেল দম্পতি, নরটন এবং বয়েড ক্যারিংটন।
হুম একটা গম্ভীর শব্দ করে, ভেবে পোয়ারো বলল, কিছু কিছু দেখেছো, সবটা নয়, সব দেখলে তখন তোমার মনে হবে চিন্তাভাবনাগুলো সোজা রেল লাইনের মতন। একটু অনুসন্ধিৎসু হয়ে বললাম, আর কে কে আছেন এখানে?
পোয়ারো বলল–ফ্রাঙ্কলিন দম্পতি, ফ্রাঙ্কলিন ডক্টর, তার রুগ্ন স্ত্রী, ডাক্তারের রুগ্ন স্ত্রীকে দেখাশোনার জন্য হাসপাতালের নার্স, তেমার মেয়ে জুডিথ, এক অ্যামারটন নামে ভদ্রলোক। সুন্দর, সুপুরুষ, মেয়েরা সহজেই মজে যাবে তার চেহারা দেখে। আর আছে মিস কেলি।
এবং এদের মধ্যেই একজন হত্যাকারী? –আলতো করে ছুঁড়ে দিলাম আমি।
পোয়ারো মন্তব্য করল, হা, এদের মধ্যে একজন হত্যাকারী।
পোয়ারো বললেন, একটু বিভ্রান্ত হয়েই, তোমার এমন মনে হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। ও শুধু বলল, এককথায় সব শেষ করে দেওয়া যাবে না। তবে প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। একটা ছোট্ট বাক্স ও নিয়ে এল, চাবিটা আমাকে দিল- মনে হল পোয়ারো সেই পুরনো দিনে ফিরে এল। রহস্যের ঝাপি খুলবে। কোনো প্রতিবাদ না করে ঘরের কোণে রাখা বাক্সটার চাবি খুলে পোয়ারোর কোলের কাছে রেখে বসে উদগ্র আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম।
ডালা তুলে বাক্স থেকে ও সংবাদপত্র থেকে বেছে কেটে রাখা একগুচ্ছ কাটিং বার করল। টুকরোগুলো আমার হাতে দিয়ে বলল- ওগুলো তোমার কাছে রাখো। এখন দেখার প্রয়োজন নেই। ওগুলো সময় মত দেখো। ওখানে কখন কখন ঘটে যাওয়া কিছু দুঃখজনক ঘটনার সংবাদ আছে, সব সত্য না হলে, তোমার চিন্তার খোরাক পাওয়া যাবে ওখানে। এবার অন্য কিছু দেখা যাক বলে, একপ্রস্থ কাগজ বাক্স থেকে বার করল যেখানে ওর হাতের লেখা দেখা গেল। বলল, চটপট পড়ে ফেলো। কতকগুলো ঘটনা আমি পর পর সাজিয়েছি। তোমার পড়া হয়ে গেলে আলোচনায় বসব। গভীর উৎসাহের সঙ্গে পড়তে শুরু করলাম। যেভাবে ও সাজিয়েছে ঠিক সেভাবে। ঘটনা ক–এথারিটন।
পৃথিবীর প্রতি অনাসক্ত, মনমরা, বদঅভ্যাসী, মদ ও হাশিসাসক্ত, স্ত্রী-যুবতীর প্রতি আসক্ত। স্বামীকে নিয়ে বড় ঝামেলা। এই মুহূর্তে এথারিটন মারা গেলেন। খাদ্যে বিষক্রিয়া, ডাক্তারেরা খুশী নন, পেটে সেঁকো বিষে মারা গেছে, তদন্তে জানা গেছে। মিসেস এথারিটনকে অ্যারেস্ট করা হল। মামলা রুজু হল হত্যার। কিছুদিন পূর্বে ভারতবর্ষে সিভিলিয়ান ছিলেন। মিসেসের একবন্ধু। চাকরি ছেড়ে ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছেন। মিসেস তার প্রতি আসক্ত এ খবর পাওয়া না গেলেও দুজনের গোপন ভালোবাসার হদিশ মিলল। এই সিভিলিয়ান নাকি ভারতবর্ষ থেকে জাহাজে ফেরার সময় এক মহিলার প্রেমে পড়েন। মিসেস তাতে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। যদিও এ ঘটনা এথারিটনের মৃত্যুর পূর্ব না পরবর্তী ঘটনা তা জানা যায়নি। স্বামীর উচ্চুঙ্খল জীবনযাপন ও স্ত্রীর প্রতি নজর না দেওয়ার অভিযোগে মিসেস এথারিটন ছাড়া পেলেন। এবং খাদ্যে যে মিসেস এথারিটন বিষ মিশিয়েছেন তার প্রমাণও পুলিশ দেখাতে পারেনি। এর ঠিক দু বছর পরে মিসেস তো একদিন ঘুমের মধ্যে মারা যান। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন মৃত্যুর কারণ। ঘটনা খ মিস শার্পলস।
পঙ্গু, বর্ষীয়ান কুমারী। ভাইঝি ফ্রেডা ক্লে দেখাশোনা করে। মিস শার্পলস একদিন মারা গেলেন পেটের যন্ত্রণায়। ময়নাতদন্তে মরফিয়া পাওয়া যায়। তিনি পেটের যন্ত্রণায় প্রায়ই কষ্ট পেতেন। ফ্রেডা ক্লে স্বীকার করে যে অস্বাভাবিক পেটের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পিসি সেদিন বেশিমাত্রায় মরফিয়া নিয়েছিল। পুলিশ বলে এটি ইচ্ছাকৃত ঘটনা নিঃসন্দেহে কিন্তু পিসিকে মেরে ফ্রেডার কি লাভ তা জানতে না পারায় পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।