.
০২.
ঘরে ঢুকে আমার মনে হল দিন-মাস বছরের সঙ্গে মানুষের চেহারার কী আশ্চর্য বিবর্তনই না ঘটে যায়! আমার সেই হতভাগ্য বন্ধু যার কাহিনী আমি এতকাল বিমূর্ত করেছি, শুনিয়েছি তার কীর্তি গাঁথা। আজ এভাবে তাকে দেখব ভাবতে পারিনি। সেই অস্বাভাবিক প্রাণোচ্ছল মানুষটির ছায়ামাত্র। একটা চাকা লাগানো চেয়ারে জড় অথর্বের মত বসেছিল। রোগে চামড়া কুঁচকে গেছে। কিন্তু বিখ্যাত কালো গোঁফ জোড়া এখনও আছে। একসময় বিখ্যাত কোম্পানির কলপ ব্যবহার করত, যদি এখনও সেই কলপ ব্যবহার করে তবে সেই নাটকের কুশীলব সেজে থাকার ইচ্ছেটা মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। কিন্তু আশ্চর্য চর্চকে সেই উজ্জ্বল তীক্ষ্ণচোখ দুটো এখনও আছে। কতক্ষণ নিঃস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না, জ্ঞান ফিরল যখন পোয়ারো পুরানো দিনের মতন আহ! প্রিয় বন্ধু আমার। এসো, কাছে এসো-বলে আহ্বান করল।
আমার বুকের মধ্যে তখন এক ঝড় বইছিল। তবুও তাকে অভ্যাসবশতঃ সম্ভাষণ জানালুম। কাছে যেতেই আগের মতন পরম আশ্বাসে বলতে লাগল, আহ। আমার প্রিয় হেস্টিংস। আমার বন্ধু। ঠিক, ঠিক সেইরকম। সেই ঋজু দেহ। সেই চওড়া কাঁধ। সেই উজ্জ্বল প্রশস্ত ললাট। বন্ধু হেস্টিংস যা শুধু তোমাকেই মানায়। তোমারই বিশেষ গুণবলী। হ্যাঁ পরিবর্তন তো হয়েছেই, তবু বলব মেয়েরা এখনও তোমায় দেখে আকৃষ্ট হবে। উত্তরে বললাম এই বয়সেও? শুধু সে বলল, বন্ধুবর সেটা তোমার পা ফেলার উপর নির্ভর করছে। হাসতে হাসতে ওর কথা জানতে চাইলাম। একটা শ্বাসকে দীর্ঘায়িত করে পোয়ারো বলল, আর আমার কথা দেখতেই পাচ্ছ, একটি ভঙ্গুর, একটি অতীত স্মৃতির ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। সূর্যাস্ত নেমেছে জীবনে। এখন আমি চলচ্ছক্তিহীন পঙ্গু অথর্ব জীবমাত্র। মনের জোরে যা হোক একটু নড়াচড়া করি। একেবারে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তবে কি জানো বন্ধু, এখনও মনের গহনে সেই অন্তঃসলিলা নদীটি তিরতির করে বইছে।
মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, তোমার হার্ট এখনও বেশ মজবুত। মাথানেড়ে বলল, হার্টের কথা বলিনি, আমার এই মস্তিষ্কটি এখনও আগের মত কাজ করে চলেছে। তার এই শারীরিক কষ্ট অথচ বিনষ, অমায়িক ব্যবহার দেখে বললাম, কেমন আছো?
সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মন্দ নয়। তুমি যদি রিৎজ হোটেলের স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে তুলনা করো তবে নিশ্চয়ই হতাশ হবে। খাবার দাবারের কোনো জৌলুষ নেই। রান্না একেবারে যাচ্ছেতাই। আলু সেদ্ধ দেয়, বটে তবে তাতে যে নুন দিতে হবে তা খেয়াল থাকে না। সবকিছুই পানসে। ইংরেজ খানাপিনার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না।
সহানুভূতির সঙ্গে বললাম, তাহলে ভালো কোথায় আছো? থাক, খাওয়ার কষ্ট। কিন্তু আমায় থামিয়ে বললেন, এ কষ্ট আমি ইচ্ছে করেই বয়ে চলেছি। কেউ আমার এখানে এসে দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে বলেনি–ওর কথার মর্মার্থ না বুঝেই বললাম, বুঝেছি। যুদ্ধের পর যে হারে জিনিষপত্রের দাম বেড়েছে এবং তোমার আয়ের পথ
কিন্তু আমায় থামিয়ে বলল, একদিকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে আছি। আমার আর্থিক কোনো কষ্ট নেই বা আর্থিক অনটনের জন্য আমি এখানে থাকছি না। খুশী হয়েই তখন বললাম ভালো লাগল সে সব কিছুই তোমার দুঃখকষ্টের কারণ নয়। ওর পাশে বসে বলতে লাগলাম, পুরনো স্টাইলের একটা মোহ আমার মধ্যে আছে। কতকাল পরে আমরা আবার মিলেছি। সেই পুরনো স্থান, স্মৃতি মনকে ভারাক্রান্ত করবে জেনেও এখানে ফিরে এসে আনন্দ পাচ্ছি, তোমারও নিশ্চয়ই হচ্ছে?
কিন্তু উদাসীনতার সঙ্গে সে বলল, তার তেমন কিছু হচ্ছে না। পুরনো স্মৃতি আমায় তাড়া করে না। ভুলে যেও না আমি বেলজিয়াম ছেড়ে ইংল্যাণ্ডে এসেছিলাম অর্থকষ্টের তাড়নায়, বাঁচার তাগিদে, উদ্বাস্তু হয়ে, ভাবিনি ইংল্যাণ্ড কোনোদিন আমার বাসভূমি হবে। তোমার সুখ আর আমার সুখ হল নদীর এপার ওপার। তোমার সুখ তুমি আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাও-অপ্রতিভ হয়ে বললুম–মোটেই তা নয়। কিন্তু পোয়ারো মুচকি হেসে বলল যে সেই যে আমি একসঙ্গে দুটো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম, সেই স্মৃতিও আমি ওর উপর বহাল করব কিনা? ও ভোলেনি। আরো বলল, তখন তোমার দুটি মেয়েকে ভালোবেসে কী বিড়ম্বনায় পড়েছিলে তা তোমার চেখে মুখে ফুটে উঠেছিল। বিগলিত হয়ে পোয়রোর হাতদুটো ধরে বলি, সেদিন তুমি আমায় না বাঁচালে কে উদ্ধার করত। তোমার ভালোবাসা, তোমায় পেয়ে আমার এ জীবন ধন্য হয়ে গেছে।
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বলল, পিছনে তাকাবে না। সামনে তাকাও পিছনে যেমন দুঃখ আছে, তেমন সুখও আছে। এখনও হয়তো কিছু আছে।
কিন্তু আমি সেইসব সুখস্মৃতি শেষ করে দিতে চাই না বলে বিরক্তির সঙ্গেই বললাম, কী আছে সামনে? এই তো জীবন শেষ করে আনলুম। পোয়ারো হুইল চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, এখনও আমাদের সব কাজ শেষ হয়ে যায়নি, পোয়ারোকে দমিয়ে দেবার জন্য বললুম, দুজনেই বুড়ো হয়েছি। নতুন করে আর কী চাওয়ার বা পাওয়ার থাকতে পারে?
রহস্যময় এক হাসি হেসে বলল, আছে, আছে। বিভ্রান্ত হয়ে যাই, বলি কোথায়? পোয়ারো তখন এই বাড়ির দিকেই আঙুল দেখিয়ে বলল, এখানে।
অবাক হয়ে ভাবি, সত্যিই এখানে কোনো রহস্যময় ঘটনা তো চোখে পড়েনি, তবে কি থাকতে পারে এখানে?