এবার তোমার মনে হবে অনেক সময় আমার সৎ যুক্তি পরামর্শ তোমার পছন্দ হয়নি। হ্যাঁ, বন্ধু! এটা শুনতে বিসদৃশ লাগলো, হাস্যকর মনে হচ্ছে, শুধু তাই নয় একটি দণ্ডই অপরাধ করতে যাচ্ছে কে না এরকুল পোয়ারো, যে কিনা চিরকাল মানুষের হত্যার বিরুদ্ধে লড়েছে, মনুষ্য জীবনকে স্বর্গীয় আশীর্বাদ বলে মনে করেছে–সেই আমি শেষ জীবন পর্যন্ত এই জীবন শেষ করলাম একটা নিটোল হত্যা করে! হয়তো নিজের ওপর অত্যাধিক বিশ্বাস, ন্যায়পরায়ণতাই অবশেষে আমার অন্তিম লগ্নে এমন একটি সমস্যার মুখোমুখি অমায় দাঁড় করালো। এর দুটো কারণ। এক আমার চিরকালের সাধনা নিরীহ মানুষকে রক্ষা করা, দুই যে করেই হোক হত্যা ঘটতে না দেওয়া। হয়তো দ্বিতীয় কারণটাই আমাকে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করালো। যখন ভাবছি করব, না করব না, ঠিক তখনই মিসেস লাটরেলের ঘটনাটা ঘটল….।
তখন তুমি নরটনকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছিলে। আর তোমার এ সন্দেহ মোটেই অসঙ্গত হয়নি। আমি নরটনের অতীত জীবন থেকে জানতে পেরেছি ও এক জবরদস্ত মহিলার পুত্র ছিল। ফলে হুকুম পেলে কাজ করতে ও দ্বিধা করবে না। তাছাড়া বাল্যাবস্থায় পা খোঁড়া থাকায় কোনো খেলায়ও যোগ দিতে পারেনি। বড় হয়ে একটা বীরের মতন কাজ করব–এ জিনিসটা সকলের মধ্যেই কাজ করে। কেউ কাপুরুষের বদনাম মাথায় নিতে ভালোবাসে না। যখন ছোট বেলা মৃত খরগোস দেখে নরটন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এবং ছেলেদের ঠাট্টা তামাসার পাত্র হয়েছিল, তখনও প্রতিজ্ঞা করেছিল ও এমন নির্দয়তার কাজ করে দেখাবে যাতে প্রমাণ হয় ও-কতটা নিষ্ঠুরও হতে পারে। এটা ও সারা জীবনের দ্বারা বুঝতে পেরেছিল ঠিক সময় মতো। পরিবেশ অনুযায়ী উপযুক্ত কথা যদি কারোর মনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাকে দিয়ে অনেক কিছু করানো যায়। এই ভদ্রলোকটি ধর্মকামী হওয়ায় মনের মধ্যে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা পাওয়ার একটা অতৃপ্তি ছিলই। তাই মাদকদ্রব্যের নেশার মত শিকারের সন্ধানে ঘুরে থাকেন।
যে পাঁচটি খুনের ঘটনা তোমায় পড়িয়েছি তার প্রত্যেকটিতে তিনি একই ধরনের অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি এথারিটনকে চিনতেন, এক গ্রীষ্মে তিনি রিগনের সঙ্গে থেকেছেন এবং প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন। জাহাজে ভ্রমণ করতে গিয়ে ফ্রেডা ক্লে-এর সঙ্গে সখ্যতায় আবদ্ধ হন। তিনি ফ্রেডাকে খুড়ীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলেন এবং খুড়ীর মৃত্যুতে যে তার অগাধ সুখ তাও বুঝিয়ে দেন। তারপর লিচফিল্ড পরিবারের বন্ধু হন।
এরপর আমি ওর পিছু নিই। যখন উনি নরটন পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন, তখন বিপদের গন্ধ পাই, ফ্রাঙ্কলিন পরিবারও নরটনের পরিণত কূটবুদ্ধির শিকার হন। আবার জুডিথ যখন দেখল ফ্রাঙ্কলিন নয়, এলারটনকে নিয়ে তুমি ভাবছ, তখন ও তোমাকে আরো বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিল, কারণ জুডিথ সহানুভূতি বা অনুকম্পা সহ্য করতে পারে না। তখন সুযোগ বুঝে নরটন ফ্রাঙ্কলিনকে টোপ গেলাবার চেষ্টা করল, কিন্তু সেদিকে পা না দিয়ে ফ্রাঙ্কলিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকল। তাই সুবিধে হবে না বুঝতে পেরে ও জুডিথের পঙ্গু অথর্ব মানুষের পৃথিবীতে থাকবার অধিকার নেই মতটাকে কাজে লাগিয়ে দিল। যদি বারবারা বেঁচে না থাকে তাহলে ওর আর ফ্রাঙ্কলিনের মিলনের কোনো বাধা থাকবে না।
তোমার মনে থাকবে একবার ও উচ্চস্বরে এমন কোনো কথা বলেছিল যাতে তুমি মনে করেছিলে হয়তো কর্নেল লাটরেল শুনতে পাবেন। কিন্তু ওটাকেই নরটন কাজে লাগিয়েছিল। আর বয়েড রসিয়ে যে গল্প লাটরেলকে বলেছিল ওটা আসলে নরটনের কাহিনী। এখানে নরটন বয়েডকে তার পাতা ফাঁদে জড়িয়ে দিলেন। ঐ যে গুলিটা মিসেস লাটরেলকে বিদ্ধ করল তাতে তিনি ওনাকে আহত করতেই চেয়ে ছিলেন। কারণ উনি ওনার মিসেসকে খুবই ভালোবাসতেন। তাই নরটন এখানে বিশেষ সাফল্য লাভ করল না।
এরপর তুমি ওর শিকার। তুমি এক স্নেহময়, শোকে মুহ্যমান, বিবেকবান পিতা তাই জুডিথের ব্যাপারে তোমাকে এলারটনের উপর রাগিয়ে দিয়ে একটা নিটোল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নিতে চেয়েছিল। ও এলারটনের অতীত জীবন সম্পর্কে বলে তোমাকে বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছিল ও সব মানুষের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তাই সেদিন ঢিবির পাশে মেয়েদের জামা দেখে তুমি ভেবেছিলে জুডিথ আর এলারটন। তুমি রাগের মাথায় জানতেই পারলে না যে সেদিন লণ্ডনে যাবার কথা ছিল নার্স ক্লাভেন ও এলারটনের। কারণ এলারটনের মতন পুরুষের পক্ষে একটা মেয়ে নিয়ে চলে না। সেখানে জুডিথও খেলার পুতুল মাত্র। কিন্তু জুডিথের পরের দিনের সকালের কথা শুনেই মনে করেছিলে, ও ওর মত পরিবর্তন করেছে। এটাও নরটনের একটা কূট চাল।
সেদিন তুমি ক্ষিপ্ত থাকায় এলারটনের সঙ্গে মিলিত হতে দেখে ভেবেছিলে জুডিথ কিন্তু ও ছিল নার্স ক্লাভেন। তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে টেনে এনে ও তোমাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। আর তুমি তখনই সঙ্কল্প করলে যে এলারটনকে মারা ছাড়া তোমার পক্ষে জুডিথকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
গভীরভাবে ভাবলে তুমিও বুঝতে পারবে কেন আমি জর্জকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি? কেন আমি একজন ভালো ডাক্তার ডেকে শরীর পরীক্ষা করাচ্ছি না? আসলে আমি চেয়েছিলাম এমন একজনকে পাশে রাখতে যে আমার সব কথা বিশ্বাস করবে। তুমি বিশ্বাস করেছিলে ঈজিপ্ট থেকে আসার পর আমার শরীর আরো খারাপ হয়েছে। আসলে তা নয়। ঐ পঙ্গু, অথর্ব আমার ভান মাত্র। খুঁড়িয়ে হলেও আমি দিব্যি চলাফেরা করতে পারতাম।