কোথায় ও জিজ্ঞেস করলাম, উত্তরে তিনি বললেন, হয় ল্যাবরেটরি বা স্টুডিও ঘরে মুখ থুবড়ে বসে আছে। ডঃ ফ্রাঙ্কলিন ঘর ভাড়া নিয়ে এসব করছেন আমি বাধা দেবার কে? ঐ নিরীহ অবলা গিনিপিগ, ইঁদুরগুলোকে নিয়ে কাটাছেঁড়া নৃশংস কাণ্ডকারখানা দেখলে গা জ্বলে ওঠে। তারপর বললেন আসুন মিঃ হেস্টিংস, আমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
দাঁড়কাকের মত, ছিপছিপে লম্বা, মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোঁফ, কোটরাগত নীলচোখ, গোঁফে অনবরত তা দিচ্ছে, চলাফেরায় অসংবৃত এক বৃদ্ধ সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ওহ-জর্জ, মুখিয়ে উঠলেন লাটরেল, তুমি যেন দিনকে দিন হাঁদাভোঁদা হয়ে যাচ্ছো। বললাম তো ইনিই ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। পাগলের ন্যায় এদিক-ওদিক তাকিয়ে করমর্দন করে বললেন –মানে–পাঁচটা চল্লিশের গাড়িতেই এলেন বুঝি? একটু চড়া গলায়, শাসনের সুরে বললেন, ওই ছাড়া আর কী গাড়ি আছে? আর গাড়ি নিয়ে কী হবে ওঁকে উপরে নিয়ে যাও। পারলে তোমার মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘরটাও বুঝিয়ে দিও। তারপর সুর পাল্টে আমি চা খাব কিনা জিজ্ঞেস করলেন।
করুণ হেসে ঘাড় নাড়লুম। না এখনই আমার চা খাবার প্রয়োজন নেই।
গেটের কাছে আমার নামানো জিনিসপত্রগুলো দেখে মিনমিনে গলায় কর্নেল লাটরেল স্ত্রীকে বললেন- ডেই লি ক্যাপ্টেনের জিনিসপত্রগুলো–সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ওটা কী মেয়েদের কাজ। তাছাড়া চোখের মাথা কী খেয়ে বসে আছো? দেখছো না–কথা শেষ না করে তিনি জোড়া হাত দেখালেন। থতমত খেয়ে মিঃ কর্নেল বললেন, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
ওঁকে দেখে মায়া হল, তাই তাড়াতাড়ি ওঁনাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। ভিতরে ঢুকতে গিয়েই একজন হন্তদন্ত হয়ে আগত–ভদ্রলোকের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিলাম। লোকটির কুঁজো, তোতলা, রোগ, সাদা চুল, হাতে একজোড়া কিন্তু গ্লাভস–তাতেই চলছিল বলে হয়তো দেখতে পায়নি। কর্নেলকে বললেন–ওই যে ডুমুর গা-গাছ, ওটাতে একজোড়া শ্যামা বাসা বাঁধছে, কী সু-সুন্দর। বলেই কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল পরিচয় দিলে-মিঃ নরটন। পাখি দেখলেই পাগল হয়ে যায়। এমনিতে সাধাসিধে।
মস্ত এক হলঘরের ভিতরে মোটাসোটা এক চেহারার ভদ্রলোক টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে হল এই মাত্র কোনো কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে আছেন এবং ঘুরেই তাকালেন। যতদোষ যেন মিঃ লাটরেলের এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিলেন, সব ব্যাটা শয়তান। বুঝেছেন মিঃ লাটরেল। ওই হাড়হাভাতে কনট্রাক্টর আর আর্কিটেক্টরদের টিকির দেখা নেই, ব্যাটারা সব ভেবেছ কী। তাদের ছাড়াব ভেবেছেন––শূন্যে-ওঁনার হাত চালানো দেখে আমরা হেসে উঠলাম। ভদ্রলোকের ঋজু, সুপুরুষ, চেহারা যেমন সমীহ জাগায় তেমনি আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।
কর্নেল বিনীত ভঙ্গিতেই বললেন–ইনি বিরাট ব্যক্তি। স্যার উইলিয়াম বয়েড ক্যারিংটন। যিনি এক প্রদেশের গভর্ণর একসময়ে ছিলেন, ভারতবর্ষে এক কিংবদন্তী ব্যক্তি, নামকরা প্রশাসক ও দক্ষ শিকারী বলে খ্যাত, তিনি আমার সামনে, এ রীতিমত অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তাকে দেখে বাক্যরোধ হল, আজ এঁদের আমরা ভুলতে বসলেও একসময় এঁরা দেশের জন্য অনেক করেছেন।
বলিষ্ঠ হাতে করমর্দন করে বললেন, কী সাংঘাতিক, রক্ত মাংসের সেই মিঃ হেস্টিংস! মঁসিয়ে পোয়ারো তো আপনার নামে পাগল, আর তাকেই আমি দেখতে পেলাম। আর হেসে বললেন, উপরি পাওনা হিসেবে পেয়ে গেছি আপনার মেয়ে জুডিথকে। চমৎকার মেয়ে। অপূর্ব।
লজ্জিত হয়ে বললুম, এতটা বোধহয় আমার পাওনা নয়, মিঃ ক্যারিংটন। তাছাড়া আমার মেয়ে নিশ্চয়ই আমার সম্বন্ধে এত প্রগলভ নয়। ক্যারিংটন বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সম্পর্কে উদাসীন। ওদের চোখে বাবা-মা এখন অবাঞ্ছিত বোঝার মতন। তিনি আরো বললেন, আমার দুর্ভাগ্য বলতে পারেন আমার কোনো সন্তান নেই। জুডিথ সুন্দরী, লাবণ্যময়ী। চলাফেরায় একটু অহমিকা জড়িয়ে থাকে। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে মিঃ লাটরেলকে তেতো তেতো মুখ করে বললেন–কিছু মনে করবেন না, মিঃ লাটরেল। আপনার ফোন যথেচ্ছ ব্যবহার করছি বলে। ঘেন্না ধরে গেছে এখানকার এক্সচেঞ্জের উপর। ব্যাটাদের যদি সামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকে। আমার অত ধৈর্য নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনের জন্য বসে থাকব
লাটরেল বললেন, চেষ্টা করে দেখুন। তারপর লাটরেলের সঙ্গে দোতলায় বা-হাতি একটা ঘরের সামনে থামলাম। বহুবছর পূর্বে এখানে উঠেছিলুম। আসার পথে দেখলাম ঘরগুলোর মধ্যে পার্টিশান করে ঘর বানানো হয়েছে, পরিবর্তন সর্বত্র।
ঘরটা সেই পুরনো দিনের মত বলে একটু ঘিন্ন হলুম। পুরনো একটা চেয়ার টেবিল, সামান্য জায়গা নিয়ে বাথরুম। ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে লাগেজ এসে গেছে। মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘর আমার ঘরের উল্টোদিকে। মাঝখানে শুধু করিডোরের বাবধান। আমি মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘরে যেতে প্রস্তুত কিনা একতলা থেকে নারীকণ্ট ভেসে এল জর্জ। ভয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, মিসেস লাটরেল, মি-মিস্টার হেস্টিংস, যদি কিছু প্রয়োজন হয় জানাবেন– নিচ থেকে সেই ভীষণ কণ্ঠ ভেসে এল জর্জ। যাচ্ছি এই যে, আ–আমি আসছি, মিঃ হেস্টিংসকথা শেষ না করেই দ্রুত তিনি নেমে গেলেন ওকে দেখে খুব কষ্ট হল। মিসেস লাটরেল সম্পর্কে এতটুকু অত্যুক্তি করেননি। ধীরে ধীরে পোয়ারোর ঘরের দিকে গেলুম ও দরজায় আলতো করে ঘা দিলুম…