না-আসলে অন্য কথা ভাবছিলাম।
কারটিসের সঙ্গে পোয়ারো এসে উপস্থিত হল। আমার থমথমে মুখ দেখে উদগ্রীব হয়ে বললেন, কী ব্যাপার সবাই এত গম্ভীর, কোনো অঘটন ঘটেনি তো?
আমি কিছু বলার পূর্বেই বারবারা বলে উঠল, না, ওসব কিছু নয়। হয়তো ঝড়ের পূর্বাভাস।
ভালো–ভালো, বলেই চলে গেল।
বারবারা আমাকে একটু সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। ওপরে ওনার পিছন পিছন আসতেই ঘরের দরজা খুলে দেখি ঘরের এক প্রান্তে বয়েড ক্যারিংটন ও তার পাশে দাঁড়িয়ে নার্স ক্লাভেন।
ক্যারিংটন মুখ তুলে বললেন, নার্স ক্লাভেন হাত দেখতে জানেন।
তাই নাকি?–একটা বাঁকা হাসি হেসে বললেন, এখন হাত দেখা ছেড়ে এই জিনিসপত্রগুলোয় একটু হাত লাগান।
ক্লাভেন দ্রুত কাজ করতে চলে গেল।
বয়েড বলে উঠল, সত্যি তোমাকে দিয়ে বড় বেশি পরিশ্রম করিয়ে নিলাম, আমার উচিৎ হয়নি হয়তো।
অত ভেবো না বয়েড।
খুব ভালো, বিশ্রাম কর। অনুতাপের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলল যে, আমার বারবারার শরীরের দিকে নজর রাখা উচিত ছিল।
বললাম, ও কিছু নয়, বিশ্রাম পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
পোয়ারোর ঘরে যাওয়ার পথেই এলারটনের ঘর, অজান্তেই কখন ওর ঘরের সামনে থেমে পড়ি, ভেতর থেকে কথোপকথন ভেসে আসছিল। হঠাৎ জুডিথ বেরিয়ে এসে আমাকে ভূত দেখার মতন লাফিয়ে ওঠে। ওকে কোনো বাধা না দিয়েই আমার ঘরে একেবারে টেনে আনি।
ঘরে ঢুকেই ও চেঁচিয়ে ওঠে। ওর সঙ্গে এত মাখামাখি কেন? অনেক সহ্য করেছি, আর নয়।
জুডিথ আমায় ঠান্ডা গলায় বলে, তোমার মন এতটা নোংরা জানা ছিল না।
আচ্ছা আমি বাজে, নোংরা, পাজি। কিন্তু আমাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য আছে তো।
ও-এই কথা!
হা-এই আমার বক্তব্য, তুমি কি অস্বীকার করতে পারো যে তুমি লোকটির প্রেমে পড়োনি?
না।
ওর অতীত ইতিহাস জানিয়ে দিয়ে বলি, বুঝেছ লোকটা কত ধুরন্ধর, শয়তান?
হ্যাঁ। আমি ওকে সাধু বলে ভাবিনি, এটা জেনে রাখো।
এভাবে তুমি তোমার নিজের সম্মান নষ্ট কোরো না।
আমি কখনও অত তলিয়ে দেখিনি।
আমার ব্যাপারে তুমি নাক গলিয়ো না।–শান্ত ভাবে বলেই ঘর থেকে ও বেরিয়ে গেল।
কীভাবে এই অবাধ্য সন্তানকে রক্ষা করব ভেবে পেলাম না।
আমি যথা সম্ভব আমার ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্ট, পারিবারিক হীনতা লুকিয়ে রেখে আমার মনের মধ্যে, সর্ব সম্মুখে এমন মুখের ভাব দেখালাম যাতে ভদ্র মহোদয়গণই শুধু নয়, জুডিথও অবাক হয়ে গেল। কিভাবে এতটা আমি সহজ হলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি জুডিথের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম।
এর পরেই একটা ঘটনা ঘটল। রাতে খাওয়ার পরই আমরা সবাই বাগানে জটলা হই বা পায়চারি করি। হঠাৎ বাগানে সেদিন জুডিথ, যেদিকটা গোলাপ ফুলের ঝাড়, সেদিকে চলে গেল। এলারটনও তার পিছু পিছু গেল। ওদের সাহস দেখে আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম।
হয়তো আমার অবস্থা আঁচ করতে পেরে নরটন আমাকে বললেন, উত্তেজিত হবেন না, বাধা দেবেন না, ওদের নিজের পথে চলতে দিন। বাধা দিলেই বাঁধ ভাঙবে। সত্যকে মেনে নিলে শান্তি পাবেন।
কোথায় শান্তি। সে বহুকাল আগে স্টাইলস ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। নরটনকে ফেলেই আমি ঝোঁপের দিকে উন্মাদের মত ছুটে গেলাম। আড়াল থেকে যা দেখলাম তাতে লজ্জায়, ক্ষোভে আমার মুখ লাল হয়ে উঠল।
উহঃ, কি দুঃসাহস, কপোত-কপোতির মত ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে গাছের লতার মত। বাধা দেবার শক্তি হারিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। এলারটনের উত্তেজিত কথা কানে আসতেই সম্বিত পেলাম।
তাহলে ও কথাই ঠিক রইল প্রিয়তমা। দুজনে কাল লণ্ডনে মিলিত হচ্ছি। লাঞ্চ সারছি আমার বাসায়। দেখবে কেউ যেন জানতে না পারে। যাহোক কোনো অজুহাতে এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে।
হঠাৎ পেছন থেকে কোনো কথা না বলে নরটন আমায় টেনে নিয়ে গেলেন।
যেতে যেতে বিকারগ্রস্ত রোগীর মত বললাম, ভয় নেই নরটন। এই আমাদের জীবন। জন্মদাতা পিতারও অধিকার নেই নিজের সন্তানের উপর। এবার আমার কী কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছি।
চুপিচুপি এলারটনের ঘরে চোরের মতন থামলাম। কাছাকাছি কেউ আছে কিনা দেখে নিলাম। এতকাল পোয়ারোর সঙ্গে থেকে কোথায় কী সাবধনতা অবলম্বন করতে হবে জেনেছি। এখন আমার কাজ হল এলারটনকে কিছুতেই বেরিয়ে যেতে না দেওয়া এবং কাজটা যে পারব তা ভাবতে পারিনি।
বেশ কিছু অ্যাসপিরিন বড়ি সঙ্গে এনেছি। আমি জানি ওর ক্লান্তি হয় সেই স্লাম্বারিনের শিশি কোথায় থাকে। টেবিলের ওপর থেকে বোতলটা তুলে দেখি লেখা আছে। নির্দেশিত মাত্রার বেশি সেবন নিষিদ্ধ। আঙুলের ছাপ যাতে না থাকে, তাই রুমাল দিয়ে চেপে শিশির মুখটা খুললাম, আটটা বড়ি তুলে নিয়ে সমপরিমাণ অ্যাসপিরিনের বড়ি শিশির মধ্যে ফেলে দিলাম। তারপর শিশি রেখে চটপট করে নিজের ঘরে চলে এলাম।
এরপর ঠিক করলাম ঘুমাতে যাওয়ার আগে হুইস্কির প্রস্তাব দেব এলারটনকে, ও অরাজি না হয়ে খেলেই আর ঘুম ভাঙবে না।
এখন শুধু অপেক্ষা। হঠাৎ কারটিস ঘরে ঢুকল। চমকে উঠলাম। কি ব্যাপার সারাদিনে একবারও বন্ধুর কথা মনে পড়েনি–ওর কথায় লজ্জিত হলাম। ছুটে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে।
কৃত্রিম অভিমানে পোয়ারো আমাকে বলল, এই তোমার বন্ধু প্রীতি? তোমার সাহচর্য পাওয়ার জন্য ডেকে আনলাম আর আমায়ই ভুলে গেলে