হয়তো আমার দীর্ঘশ্বাস ফেলা দেখে নরটন বুঝেছেন আমি কতটা আঘাত পেয়েছি। আমাকে বললেন, অত কাতর হবেন না, আসলে ওগুলো জুডিথের মনের কথাই নয়। যৌবনের ধর্ম।
নরটনের কথা জুডিথের কানে যেতেই ও কটাক্ষপাত করে চলে গেল। নরটন গলার স্বর নিচু করে বললেন, স্যার এই এলারটন সম্পর্কে আপনার ধারণা কতটুকু?
এলারটন? চমকে উঠলাম।
কিছু মনে করবেন না স্যার। ওর সাথে জুডিথের মেলামেশা দেখলে ভয় হয়। একটা মেয়ের কথা বলি, শেষ পর্যন্ত তার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথই তার ছিল না।
শিউরে উঠলাম। একজন অনূঢ়া কন্যার পিতার কাছে এযে কী দুঃসংবাদ তা কী আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয়। লাঞ্চে বসেও সুখ পেলাম না।
.
১২.
সেদিন বিকালে পোয়ারো আমায় জিজ্ঞেস করল, প্রিয় বন্ধু কোনো কিছু কি তোমার মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে?
কোনো উত্তর না দিয়ে সরে গিয়েছিলাম। এই দুঃখ আমাকেই বহন করে চলতে হবে। কিন্তু আমার কন্যা সে ব্যথা বুঝল না…।
সেই স্টাইলস, সেই পুরনো স্মৃতি, কিন্তু কেন যেন ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে। কোনো এক অশরীরী আত্মা যেন এখানকার আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার রূপ একজন হত্যাকারীর। অবয়ব একটা নিষ্ঠুর ঘাতকের। আর যখন জুডিথের জন্য মন পীড়িত হয়, তখন মনে হয়, সেই ঘাতক বা হত্যাকারীর রূপ, এলারটনের রূপ ধারণ করছে। এ যেন মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়ে বেশি।
সেদিন ক্যারিংটনের এত নিদানের কথাটা মনে পড়ল, কিন্তু জুডিথের মত একটা মেয়ে থাকলে, এই যন্ত্রণা বুঝতে পারতেন, আমি আমার মেয়ের অধঃপতন চোখের সামনে দেখছি। যদি ওর মা বেঁচে থাকত? কিন্তু না–
একটা কিছু তো করতেই হবে। কিন্তু যখন আমার প্রতি মেয়ের চোখে ঘৃণা দেখি, তখনই যেন কেমন অসাড় হয়ে পড়ি।
ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বাগানে এসে উপস্থিত হয়েছি বুঝতে পারিনি। সম্বিত ফিরতে দেখি, মেয়েটা আমার মনমরা হয়ে বসে আছে। সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে?
জুডিথ সোজা হয়ে বসে বলে, কখন এলে? এই মাতৃহীনা কন্যার বিষণ্ণতায় ভেতরটা যেন টনটন করে ওঠে। বেদনাঘন কণ্ঠে বলি, এই ভদ্রলোক তোমার উপযুক্ত নয়। আমার উপর ভরসা, বিশ্বাস রাখো।
অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল চেপে বলল, তুমি কী তা ঠিক জানেনা বাবা
জানি, আমি তোর পিতা। আমি কি তোর দুঃখের কথা বুঝতে পারব না?
সে যেন আপন মনেই বলল, তুমি যেমন তাকে জানো, বোধহয় আমিও ততটাই জানি
কিছুতেই তুমি সব জানো না। তুমি সংসারের কিছুই দেখনি। জানো, এলারটন বিবাহিত? ওর স্ত্রী বর্তমান, এইরকম কোনো ভদ্রলোককে বিয়ে করে কোনো মেয়ে সুখী হতে পারে? একে বিয়ে করে ভবিষ্যতে দুদিনে সব রঙ ফিকে হয়ে যাবে।
হঠাৎ হেসে বলল, দেখছি তুমি সব জেনে বসে আছে।
নিশ্চয়ই
না।
ছেলেমানুষী কোরো না, এখনও সময় আছে।
আবার আগের মতন ভয়ঙ্করী, প্রলয়ংকরী হয়ে জুডিথ বলল, তুমি আমার ব্যাপারে নাক গলিয়ো না। আমি কায়মনবাক্যে ওকে প্রার্থনা করি। ও আমার হৃদয়ের কামনাবাসনা। তুমি এখান থেকে চলে যাও, তোমার এই বিচ্ছিরি ঘটনাকে আমি ঘৃণা করি–আমায় উঠতে হল না, জুডিথই চলে গেল।
কতক্ষণ পাথরের মত বসে ছিলাম জানি না। নরটন ও এলিজাবেথ কেলি এসে আমার সম্বিত ফিরিয়ে আনল। হয়তো জুডিথকে দেখে বা আমাদের কোনো কথা শুনেই আমার দুঃখের কারণ বুঝতে পেরেছে। তাই শালীনতা বজায় রেখে হৈ হৈ করে প্রসঙ্গ বদল করতে চাইল।
ওদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আমি কিছুটা হাল্কা বোধ করছিলাম। হঠাৎ একটা দূরবীন নাকের খাঁজে আটকে আমাদের দিকে তাকিয়ে করুণস্বরে বললেন, ভেবেছিলাম বুঝি কাঠ-ঠোকরা পাখি-না, তা নয়।
তার ব্যবহার দেখে বুঝতে পারলাম কিছু একটা তিনি লুকোতে চাইছেন। কেন তিনি এরকম আচরণ করলেন? হঠাৎ জেদের বশে বললাম, দেখি, দূরবীনটা আমায় দিন।
নরটন একলাফে দূরে সরে গিয়ে বললেন, না কিছু নয়। তার এই একগুয়েমী দেখে মনে হল সে যা দেখছে তা আমাকে দেখাতে চায় না। তিনি অন্য কিছু দেখেছেন। তিনি ঐ ঘন ঝোঁপটার দিকে নিশানা করেছিলেন। সেজন্য আরো উৎকণ্ঠিত হলাম।
তাকে বাধা দেবার সুযোগ না করে দিয়েই দূরবীনটা কেড়ে নিলাম। কিন্তু নরটন হাত পা ছুঁড়ে বললেন, পাখি উড়ে গেছে, মিছে চেষ্টা করছেন।
সত্যিই পাখি উড়ে গেছে। প্রখর আলোয় ওড়নার মত মেয়েদের স্কার্টের অংশ বিশেষ দেখতে আমার ভুল হয়নি।
দুজনকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল ভেবে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
যখন বাড়ির কাছাকাছি এলাম তখন বারবারা ও ফ্রাঙ্কলিনরাও এসে পড়লেন। শুনলাম জিনিসপত্র কিনতে টেড কাস্টার পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।
যখন গাড়ি থেকে সমস্ত জিনিসপত্র নামানো হচ্ছিল তখন মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের চোখে মুখে উত্তেজিত আনন্দ লক্ষ্য করলাম। বয়েডের হাতে একটা শৌখিন প্যাকেট দিয়ে ওপরে পাঠিয়ে দিলেন। আমরাও জিনিসপত্র নামাতে ওদের সাহায্য করলাম।
উত্তেজনা বজায় রেখে ক্লান্ত ভাবে বারবারা বললে, উফ কী গরম! একপশলা বৃষ্টি হয়তো স্বস্তি আনতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মিস কেলিকে পাকড়াও করে বললেন, জনের কি খবর? শুনলাম ওর মাথা যন্ত্রণা হচ্ছিল? সারা দিনরাত মাথাগুঁজে বসে থাকলে হবে না, তার পরেই নরটনকে বললেন, কী ব্যাপার ভূতটুত দেখেছেন নাকি? অমন পাচার মতন মুখ করে বসে আছেন?