সেই মুহূর্তেই বয়েডের আবির্ভাব ঘটল।
আমি প্রস্তুত আছি। বারবার বলে উঠল।
বয়েড তৎক্ষণাৎ বললেন, আশাকরি তোমার কোনো কষ্ট হবে না।
মোটেই না। বরং অন্যদিনের চেয়ে আমি অনেক বেশি সুস্থ। তারপর দুজনে চলে গেলেন। পোয়রো গভীরভাবে বললেন, তাহলে ফ্রাঙ্কলিন আমাদের আধুনিক সন্ন্যাসী, কী বল বন্ধু?
একটু ভেবে বললাম, তাই দেখছি। কিন্তু আমার মনে হয় ভদ্রমহিলা এই রকম—
কোনোরকম?
নাটকীয় চরিত্র বলতে যেরকম, সেরকম। একদিন প্রত্যাখ্যাতা স্ত্রীর চরিত্র, কখনও ভুল বোঝাবুঝির জন্য ক্ষিপ্ত, অন্য সময় আত্মপ্রত্যয়ের চরম পরকাষ্ঠার প্রতীক। আজ দেখলাম,বীর পূজায় আত্মাহুতি পর্যন্ত দিতে পারে এমন এক মহীয়সী নারীর জমিদার। তবে কী, সব কিছুতেই নাটকীয়তা থেকে যাচ্ছে।
তোমার কি মনে হয় না হেস্টিংস আসলে উনি যেভাবে নিজেকে জাহির করতে চান, বরং সেরকম নয়, একটু নির্বোধ প্রকৃতির মহিলা।
নির্বোধ কিনা বলতে পারি না, তবে চালাক নয়–
আমার মত? সে আবার কী?
আহ! চোখ বুজে দেখবেন আকাশের পরীরা এসে কানে কানে গান শুনিয়ে যাচ্ছে।
আমি বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠতে গিয়েছিলাম। কিন্তু নার্স ক্লাভেন আসতে থামতে হল। আমাদের দেখে হেসে ল্যাবরেটরিতে ঢুকেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা হাত ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দস্তানা নিয়ে গেছেন। হঠাৎ মনে পড়েছে হাত ব্যাগটা ফেলে গেছেন। যাই ওরা অপেক্ষা করছেন।
হঠাৎ ক্লাভেনের চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হল, হয়তো এভাবে জীবন কাটাতে কাটাতে উনি ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তাই মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের এদিকে একটু নজর রাখা ভালো।
হুম। চোখ বুজিয়েই পোয়ারো বলল, তার আবার সোনালী সুন্দর কেশদাম–
আমি একুট অবাক হয়েই তাকালাম। কেনই বা এই মুহূর্তে ওর কেবল চুলের কথা মনে পড়ল বুঝলাম না। তাই উত্তর খুঁজে না পাওয়াতে চুপ করেই রইলাম।
.
১১.
যতদূর মনে পড়ল পরের দিন কিন্তু আলোচনা আমার মনের প্রশান্তি নষ্ট করছিল।
আমি, জুডিথ, বয়েড ও নরটন চারজনে ছিলাম। বিষয় বস্তু ছিল অদ্ভুত। রোগে ভুগে ভুগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে যে মানুষ, তার যন্ত্রণাবিহীন উপশমের ব্যবস্থা করার ডাক্তারি শাস্ত্রের নাম উইথ্যানেজিয়া। কেন এরকম বিষয়বস্তু এসে পড়েছিল বলতে পারি না। তবে আমরা দুজন পক্ষে ও দুজন বিপক্ষে যুক্তি দিচ্ছিলাম। বয়েড ক্যারিংটন বক্তা, নরটন আগ্রহী শ্রোতা, জুডিথ নির্ভর যোগ্যহীনভাবে ভীষণ মনোযোগী।
আমি এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারলেও, এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারছিলাম না। তখন ভাবপ্রবণতার বশে রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা যেমন খুশী তেমন ব্যবহার করবেন।
আমার যুক্তিতে নরটনেরও সায় ছিল। শুধু সে বলল, যদি অবশ্য রুগীর মত থাকে তবেই এরকম কিছু করা যেতে পারে।
ক্যারিংটন বলে উঠল, কেউ তো আর স্বইচ্ছায় জীবন ত্যাগ করতে চায় না। এরপর তিনি শোনালেন যে একজন ক্যান্সার রোগী ভীষণ ভাবে ভুগলেও শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন ত্যাগ করতে পারেনি। তিনি শুধু ডাক্তারকে ডেকে বলেছিলেন এমন কোনো ব্যবস্থা কি করা যায় না, যাতে পৃথিবী থেকে নীরবে চলে যাওয়া যায়? ডাক্তার বলেছিলেন তা সম্ভব নয়। ডাক্তারও জানতো তার বাঁচার থেকে মরে যাওয়াই ভালো। তাই তিনি কৌশল করে টেবিলে মরফিন বেশি করে রেখে দিয়ে বলেছিলেন, খুব কষ্ট হলে খেতে। তাহলে প্রকারান্তরে ডাক্তার তাকে মারণাস্ত্র দিয়ে গেছেন। কিন্তু রোগী সব জেনে তো নিজের মৃত্যুর ব্যবস্থা নিজে করতে পারেনি।
তাই বয়েড বলছিলেন কেউ নিজেকে মারতে পারে না।
এবার জুডিথ বলে উঠল, তিনি অসুস্থ বলে রোগীর ভালোমন্দ ভাববার দায়িত্ব অন্যদের। এ সিদ্ধান্তের ভার রোগীর ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। আসলে এই সব রোগীদের তাদেরই নিতে হবে, যারা এর মঙ্গল চায়। কাউকে চিরকালের জন্য শাস্তি দিতে গেলে একাজ তো কাউকে না কাউকেই করতে হবে।
বয়েড বললেন, যদি এর জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তবেও?
তা কেন? আমি যদি ভালবেসে কারোর জন্য একাজ করি, তাহলে এ ঝুঁকি নিতে নিশ্চয়ই পিছপা হব না।
বয়েড বলল, অত সহজ নয় যেখানে বাঁচা মরার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে, আইন সেখানে হাতে নেওয়া কঠিন।
নরটন বলে, ছেলেমানুষ বলে হয়তো জুডিথ একথা বলছে।
মোটেই নয়। আসলে আপনারা ভাবছেন ওভাবে কাউকে মেরে ফেলা যায় না, কিন্তু আমি বলছি তা নয়, আমি তার মঙ্গল চাই, আমি তো হত্যা করার উদ্দেশ্যে কাউকে মুক্তি দিতে চাইছি না।
কিন্তু আসল ঘটনার সময় দেখবে কেউ তোমাকে ছাড়ছে না। নরটন তর্ক করে চলতে লাগল।
কে বলল? আমি জীবনে আপনাদের মত মহত্ত্বর বা অপরিহার্য ভাবিনি যার জন্য একজন অসুস্থ, পঙ্গু মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করব। এতে আমার কিছু মাত্র হাত কাপবে না।
সত্যি একথা যে, যারা সমাজকে কিছু দিতে পারবে তাদেরই বেঁচে থাকা উচিৎ।
তাহলে আপনারা সমাজের জন্য এ ঝুঁকি নেবেন না কেন?
হয়তো পারবো, প্রয়োজন হলে, বয়েড উত্তর করলেন।
কিন্তু নরটন বললেন, যা খাতার পাতায় লেখা তা কখন হাতে কলমে করা যায় না।
বয়েড বলে উঠলেন, ভুল করছেন নরটন। জুডিথ আসলে ততটা দুর্বল নয়, ওরকম পরীক্ষা ওকে কখনই দিতে হবে না।
বাড়ির ভেতর থেকে ঘণ্টার আওয়াজ আসতেই জুডিথ দাঁড়িয়ে নরটনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সম্বন্ধে আসলে কোনো ধারণাই আপনাদের নেই। প্রয়োজন হলে আমি ভীষণ কঠোরও হতে পারি। বয়েড বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে যাব, দাঁড়াও, বলেই দুজনে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।