সে আঘাত এসে গেলেও সৌভাগ্য ক্রমে তা মারাত্মক হয়নি। মনে পড়ে ক্যারিংটনের উচ্ছ্বাসের বসে বলে ফেলা একটি ঘটনার কথা। এলারটনেরও স্ত্রী বর্তমান। বয়েড খোঁজ খবর রাখেন। হয়তো জুডিথের জন্যই এলারটনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চুলচেরা বিচার করতে শুরু করেছি।
বয়েডের কাছে জেনেছি এলারটনের স্ত্রী একজন খোঁড়া রোমান ক্যাথলিক। তাই ওদের ডিভোর্স হয়নি। একজন অসূয়া কন্যার পিতার কাছে এ সুখবর বটে।….।
পরের কয়েকটি দিনে সেরকম কিছু ঘটেনি। কর্নেলও বেশিরভাগ সময় তার স্ত্রীর পাশেই কাটান। তার জন্য এখন নতুন নার্স নিয়োগ করার ফলে ক্লাভেন তার নিজের জায়গায় ফিরে গেছে।
এর মধ্যে একদিনের কথা বলা যাক–
পোয়ারোকে মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের ঘরে পেলাম। ওর নির্দেশ মতই কারটিস মাঝেমাঝে পোয়ারোকে ওখানে নিয়ে যায়। ওদের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
পোয়ারোকে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন তার সুখ-দুঃখের কথা শোনাচ্ছিলেন। তিনি কাতর ভাবে বলছিলেন, নিজের শরীর নিয়ে আমি ভীষণ বিব্রত, সেজন্য নিজেরই ভীষণ লজ্জা হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এইরকম ভাবে অন্যের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকাটা অপরাধ। এর চেয়ে পৃথিবীর থেকে বিদায় নেওয়া ভালো।
উঁহু ম্যাডাম, এ আপনার ভুল ধারণা, একটা সুন্দর ফুলকে বাঁচাতে হলে আচ্ছাদনের প্রয়োজন কিন্তু বনফুলের বেলায় তার প্রয়োজন হয় না। আমার বলতে গেলে কারোর কাছেই মূল্য নেই, অথচ বেছে থাকার কী অপরিসীম আগ্রহ।
মিসেস ফ্রাঙ্কলিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার কথা আলাদা। কারোর জন্য আপনাকে দুশ্চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু আমার জনের জন্য চিন্তা হয়। একটা বোঝা হয়ে আছি।
তিনি কি হাবভাবে সেরকম কিছু প্রকাশ করেছেন?
না-না। মুখেও নয়, হাবভাবেও নয়। কিন্তু ওর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি ও কত অসুখী। আরো ভয়ের কারণ হচ্ছে ও ভীষণ বেপরোয়া।
বেপরোয়া? না ম্যাডাম এ ব্যাপারে আপনার সাথে একমত হতে পারছি না।
না পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ আমি যতটা ওকে চিনি, আপনি ততটা নয়। বুঝি যে আমি না থাকলে ওর জীবন আরো স্বচ্ছন্দময় হয়ে উঠবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মাঝে মাঝে মনে হয় আমার চলে যাওয়াই ভালো।
এ আপনার অসুস্থ মনের চিন্তা, একদম এ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। পোয়ারো কথাগুলো মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে বলে উঠলেন। মিসেস ফ্রাঙ্কলিন কিন্তু গম্ভীর হতাশার সঙ্গে বলে চললেন, এ সংসারে আমি কার উপকারে লাগব? কার জন্য বেঁচে থাকব?
সেদিন ক্লাভেনের সঙ্গে কথা বলার সময় সে বলছিল, জানেন মিঃ হেস্টিংস, যারা বলে আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাই, জানবেন সেটা ওদের মনের কথা নয়।
হায় সংসার, কী বিচিত্র তার গতি প্রকৃতি!…
এই মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে একদিন অন্য চেহারায় দেখলাম।
সেদিন ভোরে কারটিস ভোরের মুক্ত বাতাস সেবনের জন্য পোয়ারোকে বাগানে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আমি সেখানে পৌঁছলাম। সদ্য ফোঁটা ফুলের মত হাসতে হাসতে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ওনার স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। এমনটি আর কখন চোখে পড়েনি।
আহ! মঁসিয়ে পোয়ারো! সাদা ঝকঝকে দাঁতে হাসি ছড়িয়ে বললেন, বয়েডের সঙ্গে ও বাড়ি যাচ্ছি। জানালা দরজায় পর্দা পছন্দ করে সাজিয়ে দিয়ে আসব।
তারপর পোয়ারোর পাশে একচেয়ারে বসে বললেন, গতকাল জনের ল্যাবে দস্তানাটা ফেলে গিয়েছিলাম। শুনলাম ও আর জুডিথ ল্যাবরেটরির জন্য কি কেমিকেল কিনতে বেরিয়েছে। তারপর একটা হাওয়া ফুসফুস ভর্তি করে নিয়ে বললেন, ভাগ্যিস বিজ্ঞানী হইনি, নইলে ভোরের এই মুক্ত বাতাস সেবন করতে পারতাম না।
পোয়ারো রসিকতা করে বললেন, দেখবেন ম্যাডাম সব বিজ্ঞানীরা যেন আপনার কথা না শুনে ফেলে।
নিশ্চয়ই না। আপনি ভাববেন না যে আমার স্বামীর প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই। ওর মত এমন সাধনা কজনের থাকে বলুন তো?
হঠাৎ নার্স ক্লাভেনের কথা মনে পড়তে মনে হল মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের পতিভক্তি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে পড়ছে না?
মিসেস ফ্রাঙ্কলিন পোয়ারোকে বললেন, জানেন জর্জ আসলে এত ভালো মানুষ তার জন্যই ওকে নিয়ে বেশি ভয়। মানুষের উপকারে লাগবার জন্য যে কোনো কাজের ঝুঁকি নিতে উনি প্রস্তুত।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, সে কথা বলতে
কিন্তু এসব কথা কেউ বোঝেন না জানেন। কোনোদিন না নিজের উপরে গবেষণা করে বসেন।
বললুম। তখন নিশ্চয়ই নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি সজাগ থাকবেন।
ম্লান হেসে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বললেন, একবার এক বিষাক্ত গ্যাস নিয়ে কি কাণ্ডটাই না বাঁধিয়ে দিলেন কী বলব।
তাই নাকি?
তবে আর বলছি কী। দুঃখের সঙ্গে মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বললেন। ওকে একটা ট্যাঙ্কের মধ্যে বসিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা ধরে মানুষের দেহে ঐ গ্যাসের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তার পরীক্ষা করেছিলেন। উনি তো মারাও যেতে পারতেন। একজন প্রফেসরের মুখে আমি এসব কথা শুনেছি। সাহস থাকা ভালো কিন্তু বেপরোয়া হওয়া ভালো নয়। আমি হলে তোত পারতামই না।
পোয়ারো ধীর স্থির গলায় বললেন, এর জন্য প্রয়োজন অত্যাধিক সাহস ও মনসংযোগ যা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে কল্পনা করাই অসম্ভব।
তাহলেই বলুন আমার ভয় থাকবে না। ঐ গিনিপিগ, ইঁদুর ওদের উপর পরীক্ষা চালাবার একটা সীমা আছে। যার পর আর কাজ হয় না। তখন প্রয়োজন হয় মানুষের দেহে তার প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা। জন হয়তো নিজেরই উপরই কোনোদিন সে পরীক্ষা করে বসবে।