যাক সে কথা
কাগজে একদিন বিজ্ঞাপন দেখলাম। মনটা কেমন করে উঠল। হাজার হোক পুরনো স্মৃতি তো। কেবল পিছু টানে। এলাম বলে, মারো লাগাম চালাও ঘোড়া। ঠিক তাই না? এখানে এসেই দেখি রাজ্যের সব চেনা মানুষের ভীড়। তোমার মেয়ে আছে। আছে ওর মনিবের বন্ধু। যদিও খুব মাধার শুরের ব্যারন। তার পর ফ্রঙ্কলিন দম্পতি আসছে গরমের ছুটি কাটাতে। দেখে শুনে মনটা তোমার জন্য আনচান করে উঠল। তুমিই বা বাদ থাকবে কেন? একা একা কোথায় ঘুরে মরবে। তাই এই আমন্ত্রণ! সবাই মিলেমিশে খুব হৈ হৈ করে কটা দিন কাটানো যাবে।
কাজেই, চিঠি পাওয়া মাত্র চলে আসবে। কোনো বাধা না মেনে। পিছু সব টান ফেলে। হ্যাঁ ভয় পেও না। তোমার উপযুক্ত একটা ঘরও ঠিক করে ফেলেছি। বাথরুম টাথরুম সহ চমৎকার একঘর। (মনে করো দেখি সেই পুরনো স্টাইলসকে। এতসব আড়ম্বর কী তখন ছিল।) মিসেস কর্নেল লাটরেল অবশ্য এত কম ভাড়ায় ঘর দিতে চায়নি। কিন্তু আমি যে নাছোড়বান্দা। শুনছে কে। সব প্রস্তুত, অতএব হে রথী, চলে এসো মহারণে।
তোমার চিরকালের
এরকুল পোয়ারো
এই দুরন্ত আহ্বান অতিক্রম করা অসাধ্য। রাঁধাবাড়ার জন্য কেউ নেই। মেয়ে-ছেলেদের মধ্যে একছেলে নৌবাহিনীতে, একছেলে আর্জেনটিনায় গরুমোষের খাটাল করে আছে, একমেয়ে গ্রেস সৈন্যবাহিনীর একজনকে বিয়ে করে ভারতবর্ষে ঘর বেঁধেছে। অবশ্য ছোট মেয়ে জুডিথকে নিয়ে মনে একটা অশান্তি আছে। বড় জেদী ও একগুঁয়ে মেয়ে। সব সন্তানদের থেকে ওকে একটু বেশি ভালোবাসারই ফল এটি। সব ছেলে মেয়েদের মধ্যে বেশি সুন্দর হওয়ায় হয় তো বেশিই আদর করে ফেলেছি ওকে। কিন্তু ফলটা হয়েছে এইরূপ কারো কথা শোনে না, কারো যুক্তি নেয় না। নিজের খেয়ালে চলে। অস্বস্তি বোধ হয়েছে; ভেবেছি এই জেদী স্বভাব কোথা থেকে পেল ও। আমি ও জুডিথের মা দুজনেই ছিলাম সরল প্রকৃতির, কিন্তু ও ঠিক উল্টোটা। হয়তো ওর প্রখর বুদ্ধি ও সব কিছু জানার স্পৃহা থেকে এই রকম হয়েছে। ওর পড়াশোনায় আমি বাধা দিইনি, ফলে বিজ্ঞানে ডিগ্রী পেয়েছে অবলীলায়, কিন্তু, তারপর যে কাজ সে নির্বাচন করল তার জন্য একজন আমার মতন বিপত্নীক ভদ্রলোকের দুশ্চিন্তার কারণ। ওর সহজাত জেদী স্বভাবই এর জন্য দায়ী। শুনেছি এক গ্রীষ্মপ্রধান দেশের এক দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কারের নেশায় পাগল হয়ে রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছেন এক ডাক্তার ভদ্রলোক। জুডিথ তারই সেক্রেটারী। এটা মাথাব্যথার কারণ না হলেও ব্যাপারটা হল ওঁর পঙ্গু শয্যাশায়ী স্ত্রীকে নিয়ে। পিতা হিসাবে কর্তব্যের খাতিরে, ওঁর সঙ্গে জুডিথের কোনো বাজে সম্পর্ক আছে কিনা খোঁজ নিয়েছিলুম। কিন্তু তেমন কোনো সংবাদও পাইনি, অথবা তাদের মধ্যে মালিক কর্মচারী ভিন্ন কোনো সম্পর্কও লক্ষ্য করিনি।
জুডিথ আমায় শ্রদ্ধাভক্তি করলেও মাঝে মাঝে ওর ব্যবহারে আমি নার্ভাস হয়ে পড়ি যখন ও আমার কোনো পরামর্শ, স্থিতধী চিন্তাকে সেকেলে বলে উড়িয়ে দেয়।
স্টাইলস সেন্ট মেরী স্টেশনে গাড়ি ঢুকতেই আমি তটস্থ হয়ে উঠি। পুরানো স্মৃতি অন্য খাতে বয়ে চলে। স্টেশনের দিকে মনসংযোগ করতেই বুঝতে পারি সময় চলে গেলেও পুরানো পরিবেশ, সেই ঘর বাড়ি, সে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, গাছের সমারোহ সবই এখনও আছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই ধাক্কা খেলাম, অনেক কিছু বদলে গেছে। একটা পেট্রল পাম্প, একটা সিনেমা হল, গুটিকয় সুদৃশ্য সরাইখানা, কয়েকটি বৃহৎ অট্টালিকা চোখে পড়ল, যা আগে ছিল না।
কিন্তু স্টাইলস-এ এসে মনে হল, এখানে আধুনিকতা প্রবেশ করেনি। সবই এক আছে। বৃদ্ধ বটগাছের মত আমার লীলাভূমি দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে লন ধরে হেঁটে অদুরে চোখে পড়ল এক মহিলা জীর্ণ ফুলচারায় জল দিচ্ছেন। ট্যাক্সির গেট খোলার শব্দেই হয়তো ঘুরে আমার দিকে দাঁড়ালেন।
তাকে দেখে মনে হয়েছিল এভিলিন হাওয়ার্ড। কিন্তু জরাজীর্ণ চেহারা, গালবসা, বাদামী ছোপ হনুর উপর সাদা চুল, গর্তে বসা দুটো নীল চোখ দেখে মনে হল এ এভিলিন নয়। আমাকে দেখে উনি হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।
আহ! যদি ভুল না হয়ে থাকে নিশ্চয়ই মিঃ হেস্টিংস। কী সৌভাগ্য। এতক্ষণ আপনার আলোচনাই হচ্ছিল। ইস! দেখুন আমার দুটো হাতেই কী জঞ্জাল। একটু অভ্যর্থনা করব, উপায় নেই। কিছু মনে করলেন না তো? আমি, আমি মিসেস লাটরেল। আপনি জিজ্ঞেস না করতেই পরিচয় দিলাম। জানেন মিঃ হেস্টিংস, আমি আর আমার স্বামীর কী যে ভুত চাপল কিনে ফেললাম এই নোংরা বাড়িটা। কিন্তু মশাই, আমি একটু গাঁট কাটা বলতে পারেন। পয়সার খোঁজ পেলে ছাড়ি না। কিছু একটা করতে হবে তো। করে দিলাম সারইখানা। দু পয়সা আসবে। বৃদ্ধ বয়সের সংস্থান চাই তো। হিঃ হিঃ
নিজেকে জাহির করছে বুঝতে পারলেও হাসতে হল ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু বুঝতে পারলুম আক্ষরিক অর্থে তিনি ব্যবসায়ী, বাইরে চপলতা প্রকাশ করলেও ভিতরে ভিতরে তিনি ঘাঘু মাল।
জানতে চাইলাম, আমার বন্ধু পোয়ারোর খবর কী? দারুণ দুশ্চিন্তার সঙ্গে উত্তর দিলেন, কী মানুষ হয়ে গেছেন, কেবল আপনার কথাই বলছেন। রোগটাও যন্ত্রণা দিচ্ছে, মনে হচ্ছে বুঝি আপনার সঙ্গে দেখা হলেই পৃথিবীর মায়া কাটাবেন। ততক্ষণে আমরা এগোতে শুরু করেছি। তারপর মিঃ হেস্টিংস, কিসেস লাটরেল শোনাচ্ছিলেন, আপনার মেয়ে জুডিথের কথা কী বলব। এমন সুন্দরী সুশ্রী মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। ওর ব্যবহারে আমরা সবাই মুগ্ধ। তবে কি জানেন, আমরা পুরনো দিনের মানুষ। আজকালকার মেয়েদের ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। এই তো কচি বয়স। কোথায় হৈ হুল্লোড় করে বেড়াবে তা নয় আদ্যি কালের বদ্যি বুড়ীর মত চোখে মাইক্রোসকোপ এঁটে বসে আছে।