মিঃ লাটরেলকে দেখে বললাম, মিসেস লাটরেল এখন বেশ সুস্থ, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
ওঃ, ডেইজি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়? মায়ের ডাক শুনে শিশু যেভাবে উৎফুল্ল হয়, সেভাবে কর্নেল আনন্দে বললেন, নিশ্চয়ই যাব। যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। আপন মনে কি বলতে বলতে ছুটে গেলেন, ফলে মাঝে হোঁচট খেলেন। হাত বাড়িয়ে না ধরলেই পড়েই যেতেন। ডঃ ফ্রাঙ্কলিন ঠিকই বলেছেন, আঘাতটা শেলের মত বিঁধেছে। এতে সন্দেহ নেই।
কর্নেলকে একেবারে টেনেই আনতে হল আমাকে। ক্লাভেন সাদর আহবান জানাল, ভেতরে আসুন।
আমরা দুজনে খাটের পাশে এলুম পর্দা সরিয়ে। মিসেস লাটরেল সম্পূর্ণ সুস্থ নন, তবু স্বামীকে দেখে বিচলিত হলেন। এক হাতে ব্যাণ্ডেজ অন্য হাত বাড়িয়ে জর্জ–জর্জ?
ডেইজি, ডেইজি, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, যে তুমি সুস্থ হয়ে উঠেছে। আমায় ক্ষমা করো ডেইজি।
কর্নেলের আবেগ জড়ানো চোখের জল দেখে মনে হল এই নিরীহ মানুষটাকে সন্দেহ করতে যাচ্ছিলাম। কি অন্যায়! স্বস্তিতে বুক ভরে গেল, যেন বুকের ওপর থেকে বোঝাটা নেমে গেল।
বাইরের ঘড়ির ঢং ঢং শব্দে চমকে উঠলাম। পাঁচক ঠাকুর খাবারের ডাক দিল। কত সময় হু হু করে বেরিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।
যে যেমনভাবে ছিলাম ডাইনিং রুমে সেই পোষাকে দেখা হল। পোষাক পাল্টাবার কথা অবশ্য তেমন নেই। প্রথমবার দেখলাম মিসেস ফ্রাঙ্কলিন বেশ সেজেগুজে এসেছেন আজ। বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। কর্নেল আসেননি, স্বাভাবিক।
খেতে খেতে কেউ আজ বিশেষ কথা বলেনি। পরিস্থিতিটা পরিবেশের সঙ্গে বেশ পরিপাটি, মানানসই।
লনে এসে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। শুধু জুডিথ ও এলারটনের জল খাওয়াটা আমাকে পীড়া দিল। অবাধ্য ছেলেমেয়েদের শাসনের হাতিয়ার এখনকার পিতা-মাতাদের নেই, হায় পিতা!
ফ্রাঙ্কলিন ও নটনের মধ্যে গ্রীষ্ম প্রধান দেশের রোগের ব্যাধি নিয়ে কথা হচ্ছিল। মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ও বয়েড পাশাপাশি কিন্তু একটু দূরে।
এলিজাবেথ একটা বই-এর মাঝে এমনভাবে নিবিড় হয়েছিল যে কথা বলার সাহস পেলাম না।
একা তো আর বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। অবশেষে পোয়ারোর কাছেই গেলাম। দেখা গেল পোয়ারো একা নয়, কর্নেলও আছে। কর্নেলের চেহারার কোনো উন্নতি হয়নি। এখনও বিবর্ণ, অনুতাপে দগ্ধ।
গভীর বেদনার সঙ্গে বলে গেল, ওকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। যেমন সুন্দর দেখতে ছিল, স্বভাবটিও মিষ্টি মধুর। কী বলব মঁসিয়ে পোয়ারো। ওকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন মনে হয়েছিল, এই সেই মেয়ে যাকে আমি দীর্ঘকাল খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পোয়ারো ইশারায় বসতে বলল। কর্নেলের বক্তব্যের সঙ্গে আমার মনশ্চক্ষে যুবতী ডেইজি ও প্রৌঢ়া ডেইজির ছবি ভেসে উঠল। সত্যি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কত পরিবর্তন হয়। কত ফারাক।
কর্নেল আমার অনেক আগে এসেছিল, মনে হয়, তাই আমার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্থান করল।
পোয়ারো আমার কাছে আবার সব পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চাইল, বললাম। কিন্তু কোনো মন্তব্য করল না। ওর মুখের ভাব আমি কোনো কালই বুঝতে পারিনি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে পোয়ারো বলল, তাহলে তুমিও ভেবেছিলে, গুলি ছোঁড়াটা ইচ্ছাকৃত।
অকপটে স্বীকার করলুম, হ্যাঁ, সেজন্য ক্ষমা চাইতে আমার কোনো লজ্জা নেই।
এটাকি তোমার নিজের ধারণা না কেউ তোমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে? জিজ্ঞেস করল পোয়ারো।
সে রকম কিছু নয়। তবে এলারটনও এই রকমই বলছিল। অবশ্য ওর মতন অসভ্য লোকের একথাটা বলা কিছু বিচিত্র নয়।
আর কেউ, পোয়ারোর টুকরো জেরা চলছে।
বয়েড ক্যারিংটন। তিনিও এইরকম কিছু বলেছিলেন।
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ওহ, বয়েড ক্যারিংটন।
হাজার হলেও ভদ্রলোক অভিজ্ঞ। মানুষের চরিত্র সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান। অনেক জানেন।
স্বাভাবিক। পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঘটনার সময় যদিও তিনি উপস্থিত ছিলেন না।
হুঁ। শুধু ওরাই নন, আমারও যেন মনে হয়েছিল। অবশ্য এখন
ঠিক আছে। বারবার ক্ষমা চাইতে হবে না। এটা একটা ধারণা মাত্র, ওরকম পরিস্থিতিতে যে কেউ তাই করে থাকে।
মাঝে মাঝে গিয়ে তারিয়ে তারিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। ঠিক বুঝতে পারি না ওর মনের কথা।
ইতস্ততঃ করে বললাম, হয়তো ঠিকই বলেছ, ও সব দেখে শুনে—
ঠিক। তোমার কোনো দোষ নেই। এরকম পরিস্থিতিতে ওরকম মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।
পোয়ারোর ঘর থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম হায় বিবাহিত জীবন! কিন্তু পোয়ারো কী বলতে চায়? কিছুই তো বলল না। হঠাৎ মনে হল যদি মিসেস লাটরেল মারা যেতেন! তাহলে? কেঁপে উঠলাম পোয়ারোর সেই টুকরো খবরগুলোর মধ্যে এ ঘটনাটি অন্য রকম কিছু? বাইরে থেকে মনে হত মিঃ লাটরেল ওনার স্ত্রীকে খুন করেছেন, কিন্তু ইচ্ছাকৃত নয় বলে বিচারে শাস্তি হল না। নিছকই দুর্ঘটনা, ঘটনা প্রবাহই তার প্রমাণ দিত। তাহলে এটা পোয়ারোর বিচিত্র খুনের ঘটনাগুলোর মধ্যে নবসংযোজন হত।
সত্যিই তো, একটু বুদ্ধি খরচ করলে এরও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ হত্যার নায়ক কর্নেল লাটরেল হলেও, আড়াল থেকে পোয়ারোর সেই এক্সই এই কাজ করেছে।
নাঃ কিন্তু যখন কর্নেল গুলি ছুঁড়েছেন আমি তো কাছেই ছিলাম। যদি না-নাঃ, তাহলে মিঃ লাটরেলের সঙ্গে সঙ্গেই কেউ তাক করে গুলি ছুঁড়েছে? প্রতিধ্বনি হ্যাঁ, এখন যেন মনে হচ্ছে একটি প্রতিধ্বনি শুনেছি আমি–