মিস কেলি নড়েচড়ে বসে বললেন, তখন নিশ্চয়ই সবাই সুখী ছিল, সুন্দর পরিবেশ ছিল?
যদিও এক এক সময় তাই মনে হয়। তবে মনে হয় কখনও কোনো অবস্থাতেই আমরা সুখী নই। এখন মনে হয় তখনও অনেকে অসুখী ছিলেন এখানে।
জুডিথ বোধহয় অসুখী নয়। ভালোই আছে–
কি জানি? উদাসীন ভাবে বলি, ক্যারিংটনের কথাই ধরুন না, কি একাকীত্মভাবে দিন কাটান।
মোটেই তা নয়। ফোঁস করে ওঠেন। তিনি অন্য জগতের মানুষ। বিত্তের মধ্যে মানুষ হয়েছেন। তিনি জীবনে অসুখী হতে পারেন না
আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।
একটু ঝাজের সঙ্গে বললেন, জীবনে সুখ কাকে বলে জানি না। আমার দিকে দেখুন
বুঝতে পারছি, আপনার কোথাও একটা ব্যথা আছে।
কোনো কথা না বলে আমার দিকে মিস কেলি তাকিয়ে রইলেন, তারপর চোয়াল চেপে বললেন, আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
না, মানে, আপনার নাম শুনেছি—
কেলি আমার পদবী নয়। তা কী জানেন? ওটা আমার মায়ের পদবী। আমি এখন এটাই ব্যবহার করি।
হকচকিয়ে উঠি, তাহলে এর আগে?
আমার আসল পদবী হচ্ছে লিচফিল্ড।
লিচফিল্ড! চট করে ঘুরে বললুম, ম্যাথিউ লিচফিল্ড!
বিচলিত না হয়ে বললেন, জানেন দেখছি। আমার বাবা ছিলেন ভয়ঙ্কর স্বার্থপর। বহু অত্যাচার করতেন। সামান্যতম স্বাধীনতাও আমাদের ছিল না। বন্দীজীবন কাটিয়েছি, তারপর আমার বোন-কথা শেষ করতে পারলেন না। বেদনায় কণ্ঠ রুদ্ধ হল ওর।
বললুম, কষ্ট হচ্ছে আপনার, থাক ওসব কথা।
সকরুণ ধরা গলায় বলল, আমার বোন ম্যাগীকে যদি দেখতেন। কী যে হল তার। পুলিশের কাছে হঠাৎ ধরা দিল। আমি জানি একাজ ও করতে পারে না–ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল মিস কেলি।
ওর কাঁধে আলতো হাতের চাপ দিয়ে বললুম, শান্ত হোন মিস কেলি। আমি তো জানি, ও একাজ করেনি।
.
০৯.
তখন প্রায় ছ-টা। ঝোঁপের ওপাশ দিয়ে কর্নেল লাটরেল ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন। একহাতে বন্দুক ও অন্য হাতে দুটি গুলিবিদ্ধ বুনো পায়রা।
ডাক শুনে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা দুজনে এখানে কি করছেন? এই পোড়ো বাড়ির সামনে আমরা কখন আসি না। কি জানি কখন ভেঙে পড়ে। এলিজাবেথ–আরে তোমার জামা কাপড় নোংরা হয়ে যাবে যে।
এলিজাবেথ কেলি হেসে বললেন, মিঃ হেস্টিংস এর জন্য ওনার রুমালটা নোংরা করেছেন।
খুব ভালো, খুব ভালো। বলেই চলতে আরম্ভ করলেন। আমরাও ওনার সঙ্গী হলাম। আপন মনে বলতে লাগলেন, এই বুনো পায়রাগুলো এমন নোংরা করে যে ঘর দোর, কী বলব।
আপনার বন্দুকের হাত বেশ ভালো বুঝলুম।
কে বললে? বয়েড বুঝি।
চোখে কেমন দেখছেন আজকাল। কথার পিঠে কথা। যেন কিছু বলতেই হবে।
চোখে? মন্দ নয়। দূরের জিনিস ভালো দেখি কাছের জিনিস দেখতে চোখে চশমা লাগে। আজকের সন্ধ্যাটা বেশ ভালো লাগছে বলুন?
সত্যিই সুন্দর উত্তর করল মিস কেলি?
একমাত্র ভারতবর্ষেই এমন সন্ধ্যা দেখেছি, তারপর এই স্টাইলসে। চাকরার শেষে অবসর যাপনের জন্য এই রকম জায়গা বেশ ভালো। কি বলুন মিঃ হেস্টিংস।
উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়লুম। বাড়ির কাছাকাছি এসে বয়েড ও ক্যারিংটনকে দেখতে পেলাম বারান্দায়। মিস কেলি পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
বারান্দায় বসে গল্প চলল বেশ কিছুক্ষণ। নরটন একসময় প্রস্তাব করল, যা গরম, একটু ঠান্ডা পানীয় পেলে মন্দ হত না।
এ আর বেশি কি আর, ব্যবস্থা করছি। সহানুভূতির সঙ্গে কর্নেল বলল।
আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে গেলাম।
বারান্দার পাশেই ড্রয়িংরুমের ভেতর থেকে আলমারি খোলার শব্দ পেলাম। তার পরেই এক মেয়েলী কণ্ঠ, চিৎকার করে উঠল, এখানে কী করছ?
শুধু এটুকু শুনতে পেলাম, বা-বাইরে ওরা একটু ঠান্ডা পানীয়…।
মামার বাড়ি? এজন্য বলেছি তোমাকে দিয়ে এসব কাজ চলবে না।
না।
চোপ। এখানে দানছত্র খুলে বসেছি? হবে না। বোতলটা দাও বলছি।
কর্নেল নিচু গলায় কি বোঝাতে চাইল।
মিসেস লাটরেল ধমকানি দিল, পোয় থাকবে, না পোষায় চলে যাবে। সখের আবদার
আলমারিতে তেমনি আটকাবার শব্দ এল, তখন মিসেস লাটরেলের সোচ্চার উচ্ছ্বাস, যেমন কুকুর তেমনি মুগুর।
কর্নেলের সামান্য জোরালো প্রতিবাদ শোনা গেল, এ তোমার ভীষণ বাড়াবাড়ি ডেইজি, এতটা ভালো নয়।
বাড়াবাড়ি? এবাড়ি কে চালায়? তারপর আবার নিস্তব্ধতা। কিছু পরেই স্খলিত পায়ে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। সামান্য সময়ের মধ্যে কী পরিবর্তন।
আমরা এমনভাবে তাকালুম যেন কিছুই শুনিনি।
কর্নেল অপ্রতিভের হাসি হেসে বলল, দেখলাম বোতলে আর তেমন হুইস্কি নেই।
বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন আর হুইস্কিতে প্রয়োজন নেই।
মিসেস লাটরেল হনহন করে ওপাশের দরজা দিয়ে বাগানে নেমে গেলেন। ওকে দেখে ঘেন্নায় ভেতরটা রিরি করে উঠল। এমন নিষ্ঠুর মহিলা আর দ্বিতীয় নেই।
কর্নেলের ঐ অস্বস্তিকর অবস্থাটা হাল্কা করার জন্য নরটন কথার ফুলঝুরি ফোঁটালো। নিজের কৈশোর। কর্নেলের বুনো পায়রা…ইত্যাদি অনেক কথা বলে গেল। মৃত্যু তার কাছে। বিশ্রী ব্যাপার তাই, লিকারে তার কোনো স্পৃহা নেই।
কর্নেলের বুকের ভার নামাতে ক্যারিংটনও যোগ দিল। তিনি বললেন, আমার এক আইরিশ বন্ধু ছিল। বেশ বেপরোয়া। একবার ছুটিতে আয়ারল্যাণ্ডে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাকে কেমন ছুটি কাটল জানতে চাইলে যে ঘটনা সে বলল, শুনবেন নাকি সেই ঘটনাটা?
আমরা সবাই বললাম, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, বয়েড বলল এটা ঠিক গল্প নয়, এক নিষ্ঠুর সত্য ঘটনা। অনেকে আছে যারা নির্দয়তার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। আমার বন্ধুটি তাদেরই একজন। শিকারে পারদর্শী। বন্দুকের হাত চমৎকার। তার এক ভাইও সে শিকারে গিয়েছিল। তার ভাই তার আগে আগে পথ পরিষ্কার করে চলে। হঠাৎ বন্ধুটি বলে যখন এগোতে এগোতে অনেকদূর চলে গেছে, তখন মনে হল জন্তু জানোয়ারের আর কী প্রয়োজন? সামনেই তো শিকার রয়েছে। যেই ভাবা অমনি কাজ। শুনেই হৃদকম্প হল। কিন্তু বন্ধুটি অমায়িকভাবে হেসে বলল কোনো বন্য প্রাণীর চেয়ে মানুষ শিকার অনেক আনন্দের। সে নিষ্কম্প চিত্তে গুলি চালাল। তাই তার প্রাণ নিয়ে পালাবার সময় পেল না। হঠাৎ থেমে গিয়ে লাফিয়ে উঠে বলল, কিছু মনে করবেন না, আমার কাজ আছে, এখন চলি বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।