প্রকৃতপক্ষে কোনো সমাধানেই আমি পৌঁছতে পারলাম না। হঠাৎ ঝোঁপের পাশে একটা শব্দে চটকা ভাঙে। পোয়ারোর কথা অনুযায়ী নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে রেখে ঝোঁপের আড়াল থেকে লক্ষ্য করলাম। ডঃ ফ্রাঙ্কলিন হেঁটে যাচ্ছে। দুহাত অ্যাপ্রনের পকেটে। চোখ মাটির দিকে। বিষাদগ্রস্ত চেহারা।
ফ্রাঙ্কলিনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে মিস কেলি কখন পিছন থেকে এসেছে বুঝতে পারিনি।
টের পেতেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম, আমার কথায় উনি তেমন আমল দিলেন না। পুরোনো বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, যেন ভিক্টোরিয়া আমলের স্থাপত্য শৈলী। কি সুন্দর!
তাকে ভালো করে জানার জন্য বললাম, বসুন না। বসে পড়ে বললেন, কী সুন্দর! কিন্তু যত্ন না নিলে যা হয়।
হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এত কি ভাবছিলেন যে আমি এলাম টেরই পেলেন না? বললাম। মিঃ ফ্রাঙ্কলিনকে দেখছিলুম।
আমিও তাই ভেবেছি–কেন বলুন তো অত বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল?
ঠিকই দেখেছেন।
না–মানে থতমত খেয়ে বললুম, হাজার হলেও কাজের মানুষ তো, তার এমন বিষণ্ণতা ঠিক যেন মানায় না।
হতে পারে। নিস্পৃহ কণ্ঠস্বর শোনা গেল মিস কেলির।
অর্থাৎ আপনিও বলছেন উনি অসুখী। যে যা চায় তা করতে না পারলে অসুখী হয়।
ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা।
গত হেমন্তে মিঃ ফ্রাঙ্কলিন একটা গবেষণার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু স্ত্রীর জন্য তা করতে পারেননি। অসুস্থ স্ত্রী, স্বামী ছেড়ে থাকতে পারবে না। আর যদি যানও তবে এই সামান্য মাইনেয় তাদের চলবে না।
বুঝলুম, অসুস্থ অবস্থায় একা ফেলে যেতে পারেন না ডক্টর।
অসুস্থ! তার অসুস্থতা সম্পর্কে কতটুকু জানেন আপনি?
সবটা জানি না। তবে দেখে মনে হয় তো তিনি অসুস্থ।
অদ্ভুত এক হেসে বললেন, এই অসুখ নিয়েই তিনি সুখী। চমকে উঠলাম, বুঝতে অসুবিধা হল না ডাক্তারের প্রতি তার সহানুভূতি রয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ আমরা নীরব। তারপর নিরবতা ভঙ্গ করে বললাম, মনে হয় দুর্বল, অসুস্থ স্ত্রীরা স্বাভাবিক কারণেই স্বার্থপর হয়ে পড়েন।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।
এটা কি মিসেস ফ্রাঙ্কলিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য?
আসলে ব্যাপারটা কি জানেন, মিসেস ফ্রাঙ্কলিন সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকার মহিলা নন। তিনি নিজের খেয়ালখুশিতে চলতে ভালোবাসেন।
গম্ভীর ভাবে মিস কেলির কথায় ভাববার চেষ্টা করলুম ফ্রাঙ্কলিনদের পরিবারে জটিলতা আছে।
আপনি নিশ্চয় ডঃ ফ্রাঙ্কলিনকে ভালোবাসেন? কৌতূহলের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম।
মোটেই না। এর আগে দু-একবার মাত্র দেখা হয়েছে ওদের সঙ্গে।
তখন নিশ্চয়ই মিঃ ফ্রাঙ্কলিন তার দুঃখের কথা বলেছেন?
কোনোদিন না। এসব কথা আমি আপনার মেয়ে জুডিথের কাছেই শুনেছি।
শুনেই বেদনায় ভরে ওঠে মনটা। ওর সব কথা অন্যের সঙ্গে, তবু পিতার সঙ্গে নয়। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবার মত বলে গেলেন, আপনার মেয়ের তার মনিবের উপর যথেষ্ট আস্থা, বলতে গেলে উনি হাত। ও একদম মিসেস ফ্রাঙ্কলিনকে সহ্য করতে পারে না।
গভীর বেদনায় বলি, তাহলে আপনার মতে জুডিথ স্বার্থপর।
হুঁ, সে কথা বলতে পারেন। প্রকৃত অর্থে জুডিথ একজন দক্ষ বৈজ্ঞানিক। কাজেই মিসেস ফ্রাঙ্কলিন ওদের পথে বাধা স্বরূপ।
খারাপ বলেননি, আমি জুডিথকে জানি ভারী একগুঁয়ে। ভীষণ ঘর কুনো এই বয়সে। আমাদের যৌবনে আমরা অনেক হৈ হুল্লোড় করেছি তাই নয়?
ও সম্বন্ধে আমার কোনো সম্যকজ্ঞান নেই ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল।
একটু অবাক হয়ে তাকালাম। হয়তো কোনো ক্ষত স্থানে আঘাত দিয়েছি। ও দশ বছরের ছোট হবে। আমরা সমসাময়িক নই। তাই আমার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলুম।
না, না, আপনি লজ্জিত বা কুণ্ঠিত হবেন না। আসলে আমার জীবনে কোনোদিন সে সময় আসেনি
দুঃখিত-মিস কেলি–আপনি বড্ড বেশি ছেলে মানুষ। ছাড়ুন তো ওসব কথা।
অন্যান্যদের সম্পর্কে একটু কিছু বলবেন। আসলে এখানকার কাউকে তো সেভাবে আমি চিনি না।
তা বটে। যদি লাটরেল পরিবারের কথা বলেন, তাহলে ওদের বহুদিন ধরে জানি, সদবংশ। সপরিবার। দুঃখের বিষয় শেষ পর্যন্ত ওদের অতিথিশালা খুলে বসতে হল। কর্নেল গোবেচারা নিরীহ লোক। সাংসারিক বিপর্যয়ে হয় তো মিসেস লাটরেল স্বামীকে পীড়ন করেন, এইরকম হয় বিপর্যয়ে পড়লে মেয়েদের।
মিঃ নরটন সম্পর্কে কিছু জানেন?
বেশি কিছু না। লাজুক স্বভাবের চমৎকার মানুষ। বেশিরভাগ সময় কেটেছে মায়ের হেফাজতে, তাই বোধহয় এমনটি হয়েছেন। সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস ওনার।
আপনি বোধহয় ঐ ফিল্ড গ্লাস থাকার জন্য একথা বলছেন।
না ঠিক সে কথা ভেবে বলিনি, যারা শান্ত প্রকৃতির, সংসার থেকে দূরে থাকতে চান, তারা মনে হয় এই ভাবেই নিজেদের ব্যস্ত রাখেন।
বুঝেছি।
এই হচ্ছে আমাদের জীবন ও ছোট জায়গার ইতিবৃত্ত। যেখানে অতি ভদ্র প্রকৃতির মানুষ অতিথিশালা চালায় সেখানে বোধহয় যত পঙ্গু, বৃদ্ধ এসে ভিড় করে। নতুন করে সে জায়গা সম্বন্ধে তার কী বলার আছে?
ওর কথায় শ্লেষ থাকলেও সত্য। পোয়ারোর, যার উপস্থিতি একদিন চাঞ্চল্যের ছিল, আজ তার আর কোনো মূল্য নেই, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
মিস কেলি অবাক হয়ে বললেন, আপনার আবার কি হল?
বললাম, কিছু না, আপনার কথাগুলো ভাবছিলাম। শুনেছেন নিশ্চয় যৌবনে একবার এখানে এসেছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে এখনকার কোনো মিল নেই।