অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট হেসে উঠলেন। তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, আপনি বুদ্ধিমান। ব্যাপারটা সহজেই বুঝতে পারবেন। আপনি গার্ডার নাম শুনেছেন। ও এক সময় থিয়েটারে অভিনয় করত। ব্যাপারটা আমরা গোপন রেখেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ম্যাবেল সেইনসবারি সীল। তিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত। তিনি কিছুদিনের জন্য একটা ভ্রাম্যমান সংস্থার সঙ্গে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। গার্ডা নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ক্রমে ক্রমে তার চিঠি লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে জানতে পেরেছি তিনি একটি ছেলের প্রেমে পড়েছেন। বরাবরই তিনি বুদ্ধিহীনা ছিলেন।
এরপর আলাপ হয় রেবেকার সঙ্গে। পরে প্রেম। এবং ধীরে ধীরে তা বিয়েতে রূপ পায়। এ যেন রাজসিক ব্যাপার। বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক রেবেকাকে বিয়ে করে আমি রাজার চালে চলতে লাগলাম। কিন্তু গার্ডাকে আমি ছাড়তে পারিনি। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। তাই ওকে আমি রেবেকার সম্পর্কে সব জানাই। ব্যাপারটাকে ও উদার মনে মেনে নিয়েছিল। এদিকে রেবেকাকেও ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতে পারতাম না। ওকেও আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করতাম। একে অপরকে খুব ভালো বুঝতাম। তাছাড়া অর্থনীতিতে সে পারদর্শী ছিল। হঠাৎ একদিন সে মারা গেল। এতে আমি দারুণ শোক পেয়েছিলাম।
রেবেকার দুঃখ ভুলতে আমি গার্ডার কাছে আবার যেতে লাগলাম। আমাদের গোপন দেখাশোনায় দারুণ উত্তেজনা বোধ করতাম। সে নামকরা অভিনেত্রী ছিল। অভিনয়টা–সে খুব চমৎকার করত। একই অঙ্গে বহু রূপের মতো সে একসঙ্গে সাত-আটটা চরিত্রে অভিনয় করতে পারত। বহু নাম ধারণ করত। এক এক অঞ্চলে গিয়ে। যেমন ইংল্যান্ডে মিসেস অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান। আবার পারীতে আমেরিকান বিধবা বলেও নিজের পরিচয় দিতেন। আমি ব্যবসার কাজে প্যারীতে যেতাম। সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতাম।
মাঝেমধ্যে আমাকে নরওয়েতে যেতে হত। অবসর মুহূর্তে মাছ ধরতাম। সেখানেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হত। সে যেত ছবি আঁকার কাজে। তারপর ওকে নিয়ে এলাম আমার গ্রামের বাড়ি ক্রমহ্যামে। তার পরিচয় দিলাম দূর সম্পর্কের বোন হিসেবে। নাম রাখলাম হেলেন মসের। এটা আমাদের কাছে মজার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা আমাদের রোমান্সের কথা কাউকে লজ্জায় বলতে পারতাম না। অবশ্য আমি গার্ডাকে পুনর্বিবাহ করতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। কারণ অতীত স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। তাছাড়া গার্ডা আমার জীবনধারার পক্ষে বড্ড বেমানান। সে আমার সরকারি কাজকর্ম একদম সহ্য করতে পারত ন। আসল কথা হল, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করাতে আমরা দুজনেই আনন্দ পেয়েছিলাম।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট একটু থেমে দম নিলেন। আবার তিনি বলতে শুরু করলেন। সেই মুহূর্তে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। গলার স্বর তীব্র। মিস সীলের ওপর যত রাগ ছিল উগরে দিলেন।
তিনি বললেন–ওই মূর্খ স্ত্রীলোক সব নষ্টের গোড়া। সব ওলট-পালট করে দিল। বহু বছর আমাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ছিল না। হঠাৎ সেদিন চার্চে তার সঙ্গে দেখা হল। এত বছর পরেও চিনতে পারল আমাকে। অ্যামবেরিওটিসের সঙ্গে আমার সম্পর্কে আলোচনা করেছিল। এসব কথা আমি জানতে পারি। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিই দ্রুত কিছু একটা করার। আমি স্বার্থপর নই। তাই আমার নিজের জন্য চিন্তা ছিল না। আমার ভাবনা ছিল সমস্ত দেশবাসীর জন্য। আমি বিপদে পড়লে অথবা আমার জীবনহানি হলে সমস্ত দেশেরই ক্ষতি হবে। ইংল্যান্ডে যা কিছু হয়েছে তার অনেকটাই আমি করেছি। দেশের প্রতি আমার অবদানও কম নয়। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, দলতন্ত্রে নয়। আমরা মুক্ত স্বাধীন দেশ গড়তে চেয়েছিলাম। তবে অত্যাচার করে নয়। আর সেইসব নষ্ট করতে চেয়েছিল এক হতভাগ্য শয়তান লালমুখো গ্রীক। মঁসিয়ে পোয়ারো, এদেশ আমায় ছাড়া চলবে না। গার্ডাও সেটা অনুভব করেছিল। তাকে ব্যবহার করলাম। মিস সেইনসবারি সীলকে সরিয়ে দিতে হবে। তার মুখ বন্ধ করতে হবে। মিস সেইনসবারি সীলের জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
একদিন গার্ডাকে পাঠালাম ওর কাছে। সে তার সঙ্গে দেখা করে বলল, আমি মিসেস চ্যাপম্যানের পেয়িংগেস্ট হয়ে রয়েছি। তুমি একদিন এসো সেখানে। তোমায় চায়ের নিমন্ত্রণ রইল। সেইনসবারি সীলের মনে পাপ ছিল না। সে এসেছিল মিসেস চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটে। আগে থেকেই গার্ডা প্রস্তুত ছিল। আমার পরিকল্পনা মতো চায়ের মধ্যে মেডিসিন মিশিয়ে দিয়েছিল সে। ম্যাবেল সন্দেহ না করেই সেটা পান করেছিল এবং চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল। এবার মিসেস চ্যাপম্যানের গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজন। আমরা দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, এবার অ্যামবেরিওটিসকে সরাতে হবে। সেইমতো ব্যবস্থা নিলাম। আমি রোগীর ছদ্মবেশে দন্তচিকিৎসক মর্লের চেম্বারে গেলাম। তাকে খুন করলাম। এবার পালা অ্যামবেরিওটিসের। তিনি আমাকে চিনতেন না। তাই ডাক্তারের পোশাকে আমাকে দেখে তার কোনো সন্দেহ হয়নি।
এবার পোয়ারো তাঁকে হাত নেড়ে থামালেন। তিনি জানতে চাইলেন–মর্লেকে মারলেন কেন?
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট শান্ত স্বরে বললেন–বাধ্য হয়ে একাজ করতে হয়েছে আমাকে। সত্যিই মর্লেকে মারার জন্য আমি দুঃখিত।