- বইয়ের নামঃ ওয়ান টু বাকল মাই স্যু
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর, গোয়েন্দা কাহিনী
ওয়ান টু বাকল মাই স্যু
০১. এক দুই বকলস ছুঁই
হেনরি মর্লের মেজাজ সকাল থেকেই সপ্তমে চড়ে আছে। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল প্রাতরাশের টেবিলে। বেকনে কামড় দিতেই তাঁর মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল। মনে হচ্ছিল তিনি যেন খানিকটা কাদার ডেলা খেয়ে ফেলেছেন। কড়াইশুটি সেদ্ধ নিয়েও দিদি জর্জিনার ওপর একটু রাগ দেখালেন।
জর্জিনা ভাইয়ের দিকে তাকালেন। শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন–কি হয়েছে এত রাগ করছ কেন? স্নানের জল কি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল?
মি. মর্লে বিরক্তভাবে বলল–না, জল গরম ছিল।
দিদি ও ভাইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক, যেমন শারীরিক গঠনে তেমনি স্বভাবে। ভাই বাঁকানো চিবুক খর্বাকৃতির মানুষ। সবসময় তিরিক্ষি মেজাজে থাকেন আর বোন মিস মর্লে দীর্ঘকায়, শান্ত মিষ্টি স্বভাবের। ভাইবোন ছাড়া এদের আর কোনো আত্মীয়-পরিজন নেই। বোন জর্জিনা ভাইয়ের দেখাশোনা করতেন।
মি. মর্লে এবার সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেন একটি খবরের দুলাইন পড়েই তিনি মন্তব্য করলেন–সরকারি অপদার্থতা এবার চরমে উঠেছে।
ভাইয়ের কথা মিস মর্লের কানে গেল। তিনি বললেন–ভীষণ লজ্জার ব্যাপার। তিনি বিশ্বাস করতেন, যে সরকার গঠন করবে সেই-ই কাজ করবে। তাই ভাইয়ের মন্তব্য তার পাগলের প্রলাপ বলে মনে হল। তিনি জানতে চাইলেন, সরকারি নীতির ওপর আস্থা হারানোর কারণ কি?
মি. মর্লে দিদিকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। তেঁতো ওষুধ খাওয়ার মতো আর এক কাপ কফি গিলে ফেললেন এক চুমুকে। এবার রাগের আসল কারণটা বললেন–আজকালকার মেয়েরা সব আত্মকেন্দ্রিক। ওদের বিশ্বাস করা যায় না।
মিস মর্লে হেসে বললেন–কাকে বিশ্বাস করতে পারছ না? গ্ল্যাডিসকে?
মি. মর্লে মনের ক্ষোভ আর চেপে রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন–গ্ল্যাডিস খবর পাঠিয়েছে সে সমারসেটে গেছে তার অসুস্থ দিদিমাকে দেখতে। তাই সে আজ চেম্বারে আসতে পারবে না। এক মুহূর্ত থেমে আবার বলতে লাগলেন–কথাটা সত্যি বলছ, দিদিমা অসুস্থ জানতে পারলো কার কাছে, যে ছেলেটা আমার চেম্বারে কাজ করে তার সঙ্গে ওর খুব ভাব। ওরা দু’জনে ষড়যন্ত্র করে এমন একটা গল্প তৈরি করেছে। দুজনে কোথাও বেড়াতে গিয়ে সারাটা দিন কাটাবার জন্যে এই ফন্দি করেছে। ছেলেটাকে প্রথম থেকেই আমার খুব সুবিধার বলে মনে হয়নি। ভীষণ বাঁচাল ও ধড়িবাজ। সবসময় গ্ল্যাডিসের পেছনে ঘুর ঘুর করে।
না না, এটা তোমার ভুল ধারণা, গ্ল্যাডিস খুব কাজের মেয়ে, মিস মর্লে বললেন।
ঠিক বলেছ তুমি জর্জিনা–তবে ওই ছেলেটাই যত নষ্টের গোড়া, ও কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে গ্ল্যাডিস পাল্টে গেছে। কাজে একেবারে মন নেই, সব কিছুতে ভুল করছে।
মিস মর্লে স্মিত হেসে বললেন–রাগ কোরো না, মেয়েরা প্রেমে পড়লে এরকমই হয়।
হেনরি মর্লে ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে বললেন–তবু আমি বলব ও আমার সেক্রেটারি, এটা ওর মনে রাখা উচিত। কাজে অবহেলা করা ঠিক নয়। বিশেষত আমাদের দিনটা ও জানে আমার প্রচুর কাজ। আজ অনেক রোগী দেখার কথা। আজকে কাজে না এসে গ্ল্যাডিস ভারী অন্যায় করেছে।
মিস মর্লে ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল–ঠিক কথাটা বলেছো, হেনরি। নতুন ছেলেটা কি কোনো কাজ করছে না?
অসন্তোষের ভঙ্গিতে মি. মর্লে বললেন–অসহ্য কিছু পারে না। সকলের সঙ্গে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করে, এমনকি নামগুলি ভালো ভাবে উচ্চারণ করতেও পারে না। ভাবছি অন্য একজনকে রাখব। বুঝতে পারছো জর্জিনা, শিক্ষার কত অবনতি হয়েছে। শিক্ষিত ভদ্র জটিল হওয়ার পরিবর্তে মুখ তৈরি হচ্ছে।
ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই হেনরি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, বললেন না, আর বসা হবে না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকতে হবে। একটুও অবসর পাবো না। সে সময় বারির সীল নামে এক মহিলা কিছুদিন আগে এসেছিলেন আমার চেম্বারে। তার দাঁতটা তাঁকে খুব ভোগাচ্ছে। এখনও কমেনি। একবার ড. রেইলিকে দেখিয়ে নিতে বললাম, কিন্তু তাতে তিনি রাজি নন।
মিস মর্লে বললেন–কেন তাঁর কাছে যাবে? তুমি কি পারবে না, হেনরি?
আরে না না, সেটা নয়, ড. রেইলি এ বিষয়ে খুব নাম করেছেন। অভিজ্ঞ ডাক্তার। প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি আছে তাঁর। ডাক্তার হিসাবে তার হাতযশ আছে হেনরি বললেন।
জর্জিনা গম্ভীর ভাবে বললেন–হতে পারে রেইলি খুব বড় ডাক্তার, তবুও পেশেন্ট দেখার সময় তার হাত কাঁপে। তাছাড়া তিনি সর্বদা মদ গিলে থাকেন।
মি. মর্লে সশব্দে হেসে বললেন–আর একটা স্যান্ড উইচ হবে। আমার আসতে আসতে দেড়টা বেজে যাবে। ভাইয়ের কথার ধরন দেখে দিদি বুঝতে পারলেন যে তার মেজাজ ঠান্ডা হয়েছে।
দক্ষিণ কেনসিংটনের গ্লেনগাউরি কোর্ট হোটেল। এখানে ডাইনিং রুমে পাশাপাশি বসে আছেন মিস সেইনবারি সীল ও মিসেস বোলিথো, তাদের দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। তাঁরা প্রাতরাশ শেষ করে গল্প করছিলেন।
মিস সীল হালকা হাসি ছড়িয়ে বললেন–জানো তো বোলিথো, আমার ব্যথাটা একেবারে কমে গেছে। ভাবছি ডঃ মর্লেকে টেলিফোন করে জানিয়ে দেবো।
মিসেস বোলিথো গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–না, না, এমন বোকামি করো না। ডাক্তারকে বলে দাঁতটা তুলেই ফেলল।
মিসেস বোলিথো দীর্ঘকায়া, মোটাসোটা চেহারার মহিলা। বয়স চল্লিশের একটু ওপরেই হবে। মিস সেইনসবারি সীলের এক মাথা কোকড়ানো চুল ছাড়া আকর্ষণ করার মত কিছু নেই চেহারার মধ্যে। বয়সেও মিসেস বোলিযথার সমসাময়িক। চশমাটা চোখ থেকে নেমে আসে নাকের ডগায়। অত্যধিক কথা বলেন, যা বিরক্তকর।
মিস সীল আবার বললেন, সত্যি বলছি, ব্যথাটা কমেছে। আর ব্যথাই যখন নেই তখন মিছিমিছি ডাক্তারের কাছে যাব কেন?
মিসেস বোলিথো বাধা দিয়ে বললেন–এই যে বললে গত রাতে ব্যথায় ঘুমোতে পারোনি। তাই তো বলছি এখনই দাঁতটা তুলে ফেলা উচিত। তাছাড়া তুমি নিশ্চয়ই ভীতু নও। মন স্থির করো, ভয় পেও না।
মিস সেমসবারি মনে মনে ভাবলেন–কথাটাতো মন্দ বলোনি, খুব বাহাদুরি দেখাচ্ছ, কিন্তু দাঁত তো আমার, তোমার নয়। মুখে বললেন আপনার কথাই ঠিক, ডঃ মর্লে খুব সাবধানে দাঁত তোলেন। তোলার সময় একটুও ব্যথা লাগে না।
ডিরেক্টর বোর্ডের সভা শেষ। কোনো তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। রিপোর্টও খুব ভাল। তবুও স্পর্শকাতর মি. স্যামুয়েল রোদারস্টিন। চেয়ারম্যান মি: অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের হাবভাবে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। (চয়ারম্যানের দু-একটা কথার মধ্যে কিসের যেন একটা ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু ভদ্র, মার্জিত, বান মি. ব্লাস্টকে সন্দেহ করতেও মি. রোদারস্টিনের বিবেকে বাঁধছে। অতি সাধারণ একন মানুষ। খাঁটি ইংরেজদের মতো আচরণ করেন। আবেগহীন ভদ্রলোক, তার স্বাস্থ্যও যথেষ্ট ভালো, অর্থকরীর দিক দিয়েও কোনো সমস্যা নেই।
হঠাৎ মি. রোদারস্টিলেন একটা কথা মনে পড়ল তবে কি আমার যকৃতের অসুখটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে? কিন্তু আমি তো কখনো বলিনি, তবুও আশ্চর্য কিছু ঘটেছে যার জন্য মি. অ্যালিস্টেয়ার এত চিন্তিত;তিনি বারবার আমাকে দেখছিলেন। মাঝেমধ্যে অনমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন; যাই হোক মি. রোদারস্টিন মন থেকে এই গোপন দুশ্চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে বোর্ডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন, সঙ্গে রয়েছেন চেয়ারম্যান অ্যালিস্টেয়ার।
তাঁরা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে পথে নেমে এলেন।
স্যামুয়েল রোদারস্টিন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে পৌঁছে দিতে চাইলেন।
মি. ব্লাস্ট সামান্য হেসে মাথা নাড়লেন। বললেন-ধন্যবাদ, আমার গাড়ি রয়েছে। আমি শহরে যাব। একবার দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের চেম্বারে যেতে হবে। তিনি ঘড়ি দেখে গাড়িতে উঠে বসলেন।
স্যাভয় হোটেল। মি. অ্যামবেরিওটিস প্রাতরাশ সেরে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন খড়কে কাঠি দিয়ে। তাঁর মুখে জয়ের হাসি। ভাবছিলেন ওই বোকা মেয়েটিকে বোকা বানানো গেছে, দুটো মিষ্টি কথায় মেয়েটি একেবারে গলে গেছে। আমার পাওনাটা বেশ ভালই হবে। তিনি উদারও বটে দুটো পয়সা ছাড়তে কসুর করেননি। অ্যামবেরিওটিসের চোখের সামনে ভেসে ওঠা দৃশ্যটিতে তিনি মজা পেলে, ছোট মেয়ে ডিমিট্রিও কমস্টাস্টোপোপেশাস হোটেলের খদ্দেরদের নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে; এমন সময় খড়কেটা মি. অ্যামবেরিওটিসের দাঁতে খোঁচা লাগতে তিনি ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠলেন। ভবিষ্যতের রঙীন ছবি ফানুসের মতো উড়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। এবার তিনি কঠিন বাস্তবে ফিরে এলেন। পকেট থেকে একটা নোটবই বের করলেন। পাতা ওল্টালেন। একটা পাতায় তার চোখ থমকে গেল। লেখা আছে বেলা বারোটা, ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিট। তিনি বারবার এই লাইন দুটি উচ্চারণ করলেন। কিছুতেই তিনি আগের ভাবনাটায় মনোসংযোগ করতে পারছেন না।
৫৮ কুইন শার্লট টি। একটি ট্যাক্সি এসে থামল বাড়িটির কাছে। নেমে এলেন এরকুল পোয়ারো। বাড়িটির বেল বাজালেন।
কিছুটা সময় কেটে গেল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক চাকর। ছেলেটির বয়স কম, মাথায় চুল, ব্যবহার ভদ্রজনোচিত, অমায়িক হাসি ঠোঁটের কোণে।
এরকুল পোয়ারো মি. মর্লের খোঁজ করলেন। ছোকরা চাকরটি নির্দ্বিধায় তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
এবার ছেলেটি মি. পোয়ারোর নাম জানতে চাইল। মি. পোয়ারো তার নাম বললেন। চাকরটি তাকে ডান দিকের একটা হলঘরে নিয়ে গেল। ঘরটি রোগীদের ওয়েটিং রুম।
এরকুল পোয়ারো চেয়ারে বসে ঘরের চারদিকে চোখ রাখলেন। ঘরটি বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো। উন্নতমানের রুচির পরিচয় রয়েছে সেখানে। ঘরের মাঝখানে পালিশ করা চকচকে একটা টেবিল। তার ওপর কিছু পত্রিকা সাজানো। পাশে রয়েছে একটি বাতিদান। ম্যান্টলপীসের ওপর রাখা আছে একটি টেবিল ঘড়ি ও ব্রোঞ্জের ফুলদানি। দরজা জানলায় ঝুলছে নীল মখমলের পুরু পর্দা। লাল রঙের ফুল আর পাখির নকশা করা কয়েকটি চেয়ার রয়েছে। একটি চেয়ারে বসেছিলেন এক ভদ্রলোক তার ঠোঁটের ওপর একজোড়া মোটা গোঁফ, গায়ের রঙ পীতাভ! তিনি পোয়ারোর দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন তিনি কখনো মানুষ দেখেননি। জঘন্য সেই দৃষ্টি। মি. পোয়ারো এসবই লক্ষ্য করেছেন। তিনি অবজ্ঞা ভরে বললেন–এমনকিছু ইংরেজ আছে যারা যতটা কদর্য ঠিক ততটাই হাসির উদ্রেক করে।
ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ পোয়ারোকে লক্ষ্য করলেন। তারপর চেয়ারটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসলেন। চোখের সামনে তুলে ধরলেন টাইমস পত্রিকাটি। ভাবখানা এমন মি. পোয়ারের সঙ্গে চোখাচোখি হলে তাঁর মর্যাদাহানি হবে।
মি. পোয়ারো একটা বাঞ্চ পত্রিকা হাতে তুলে নিলেন। পড়ায় মন দিলেন। পাতার পর পাতা ওল্টালেন; কিন্তু লেখাগুলোর মধ্যে হাসির কোনো খোরাক খুঁজে পেলেন না।
মি. মর্লের ছোকরা চাকরটা ফিরে এল আবার, সে ভদ্রলোকটিকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভদ্রলোকটির নাম কর্নেল অ্যাবারোক্ৰম্বি। এমন অদ্ভুত নাম পোয়ারো কোনোদিন শোনেননি। তিনি ভাবছিলেন এমন নাম মানুষের হয়। এমন সময় একটি ত্রিশ বছরের যুবক ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল।
যুবকটি টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাতে লাগল। তার ভাবভঙ্গিতে অসহিষ্ণুতা ঝরে পড়ছিল। পোয়ারো আড়চোখে তা জরিপ করছিলেন। তার চেহারার মধ্যে ঔদ্ধতা ও দুর্বিনীত ভাব ফুটে উঠেছে তবে সাংঘাতিক কোনো খুনি বা চক্রান্তকারী বলে মনে হল না মি. পোয়ারোর। তিনি তার কর্মজীবনে অনেক খুনীদের গ্রেপ্তার করেছেন। তিনি ঝানু গোয়েন্দার চোখ দিয়ে যুবকটিকে জরিপ করতে চাইলেন।
ছোকরা চাকর আবার ফিরে এসে বলল–মি. পোয়ারা দয়া করে আসুন। ডাক পেয়েই পোয়ারো উঠে বাইরে বেরিয়ে এলেন। চাকরটি পথ দেখিয়ে নিয়ে এল হলঘরের পেছনে। সেখানে একটা এলিভেটর ছিল। তাতে করে দু’জনে তিনতলায় এসে বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে এসে থামলেন, ছোকরা দরজায় টোকা দিল। উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা খুলে দিল। ইশারায় পোয়ারোকে ভেতরে যেতে বলল।
ছোট্ট ঘর। পোয়ারো ঘরে ঢুকলেন। কল থেকে জল পড়ার শব্দ তার কানে এল। তার চোখ গেল দেয়ালের সামনে থাকা একটা বেসিনের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে মি. মর্লে হাত ধুচ্ছেন। মি. মর্লের চেম্বারে আসার আগে এরকুল পোয়ারো নিজেকে শ্রেষ্ঠ মানুষ, অকুতোভয় বীরপুরুষ বলেই মনে করনে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে নিজেকে আর শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে চাইছিলেন না, বসে ভয়ে তিনি কাঁপছিলেন। নিজেকে তখন অতি সাধারণ, ভীরু, হতভাগ্যদের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করছিল।
ইতিমধ্যে মি. মর্লে তার পেশাদারি কাজকর্ম শেষ করেছেন। অভ্যাসবশত রোগীর মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন। নানা গল্পগুজবে পোয়ারোকে আনমনা করে রাখলেন।
কথা বলতে বলতে রোগীকে নির্দিষ্ট আসনের দিকে নিয়ে এলেন। আসনে বসতে সাহায্য করলেন। বললেন–মি. পোয়ারো আরাম করে বসুন। কোনো ভয় নেই। অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন।
জোরে শ্বাস নিলেন এরকুল পোয়ারো। বাধ্য হয়েই ডঃ মর্লের হাতে নিজেকে সমর্পন করলেন তিনি। মনে সাহস এনে বললেন–ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
তৎপরতার সঙ্গে মি. মর্লে পেশাদারি কর্মকান্ড শুরু করলেন। টেবিলটা সামনে টেনে আনলেন। এক হাতে একটা আয়না আর এক হাতে একটি যন্ত্র তুলে নিলেন।
এরকুল পোয়ারো শক্ত মুঠিতে চেয়ারের হাতল ধরে আছেন। দুচোখ বন্ধ করে হাঁ করে রইলেন।
মি. মর্লে জিজ্ঞাসা করলেন, দাঁতে কি খুব যন্ত্রণা হয়?
হাঁ করা অবস্থায় কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন মি. পোয়ারো, না তেমন খুব যন্ত্রণা নেই। কষের দাঁতের পিছনে যে দাঁতটি উঠেছে সেটিই মি. পোয়ারোকে চিন্তায় ফেলেছে। এমনও হতে পারে সেটা মি. মর্লের চোখে পড়েছে। অথবা যন্ত্র ব্যবহার করার মতো তেমন কিছু জটিলতা নেই তার দাঁতের ভেতর। তাই এক্ষেত্রে মি. মর্লের করণীয় কিছু নেই। কিন্তু এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয় যে মি. মর্লের মতো বিশিষ্ট দন্তচিকিৎসকের এমন ভুল হবে।
মি. মর্লে একটার পর একটা দাঁত ঠুকে দেখতে লাগলেন। কোনোটার সম্পর্কে কিছু কিছু মন্তব্যও করছিলেন। ভরাট দাঁতটা ঠুকে বললেন–এটা একটু খয়ে এসেছে দেখছি। অবশ্য মাড়ি বেশ ভালো আছে, চিন্তা করবেন না।
এবার তিনি নিজের পাটির দাঁতগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এক দুই তিন চতুর্থটায় এসে হাত থামালেন। হয়তো খারাপ কোনো দাঁতের সন্ধান পেয়েছেন।
চিন্তিত মুখে মি. মর্লে বললেন–এটাতে একটু গন্ডগোল আছে বলে মনে হচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই খুব ভোগাচ্ছে? ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়?
সব দাঁত দেখা শেষ করে মি. মর্লে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মুখে বিজ্ঞের হাসি। যেন মনে হয় সমাধান সূত্র পেয়ে গেছেন।
মি. মর্লে অভয় দিয়ে বললেন–ঘাবড়াবার কিছু নেই। দু-একটা দাঁত সীল করে দিতে হবে। উপরের পাটির দাঁত ক্ষয়ে গেছে। কিছু ভাববেন না আজকেই সব ঠিক করে দেবো।
মি. মর্লে একটা সুইচ টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু একটা শব্দ করে দেয়ালের একটি দিকের আলমারির পাল্লা খুলে গেল। সেখান থেকে একটা ড্রিল মেশিন বের করে আনলেন, তিনি তাতে একটা সুঁচ পড়ালেন।
কাজ শুরু করছি ব্যথা পেলে বলবেন–কথা শেষ করেই মি. মর্লে ড্রিল চালাতে লাগলেন, মি. পোয়ারো বাধা দেবার সুযোগ পেলেন না। বাধ্য ছেলের মতো ওই ভীতিকর কাজ দেখতে লাগলেন। এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। যন্ত্রণায় কুঁকরে যাওয়া বা আর্তনাদ করার কোনো অবকাশই ছিল না। যথা সময়ে ড্রিম চালানো বন্ধ করলেন মি. মর্লে। এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বললেন–কুলকুচো করে নিন। তারপর দাঁতের ফাঁকে কিছুটা তুলো গুঁজে দিলেন।
মি. মর্লে ড্রিলে নতুন একটা সুঁচ পরালেন। আবার চালানোর জন্যে তৈরি হলেন। ড্রিল চালানো ব্যাপারটা মি. পোয়ারোর কাছে যত না যন্ত্রণাদায়ক তার থেকে ভীতিকর বেশি। মি. মর্লে ড্রিল চালাতে চালাতে বললেন জানেন তো আজকে আমাকে সব কাজ সামলাতে হচ্ছে। আমার সেক্রেটারি মিস নেভিল আজ আসেননি। তার এক আত্মীয়ার স্ট্রোক হয়েছে। সেই খবর পেয়ে তাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আপনি নিশ্চয়ই মিস নেভিলকে ভোলেননি।
এরকুল পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
মি. মর্লে অসন্তোষের ভঙ্গিতে আবার বলতে শুরু করলেন–সকাল থেকেই রোগীদের ভিড় হয়। তখন সাহায্য করার কেউ না থাকলে বলুন তো কত অসুবিধা হয়। কি আর করা যাবে। কর্মচারীদের দুটি তো দিতে হবে। তাই আমি আজ ভীষণ ব্যস্ত। তার ওপর বাড়তি একজন রোগী এসেছে। সে দাঁতের যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। তাকে দেখতে হল। ওখানে কিছুটা সময় গেল। তবুও তড়িৎ গতিতে সব কাজ করতে হচ্ছে আমাকে।
মি. মর্লে খল নুড়িতে কিছু গুঁড়ো করতে বললেন–খ্যাতনামা কিছু ব্যক্তি আছেন। তাঁরা সময়ের দাম দিতে জানেন। তাঁরা ঠিক সময়েই আসেন। যেমন ধরুন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট, বিরাট মাপের মানুষ তিনি। তিনি কথা দিয়েছেন ঠিক বারোটার সময় এখানে আসবেন।
মুখের মধ্যে বেশ কিছুটা তুলো আর কাঁচের টিউব থাকায় স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না মি. পোয়ারো। তবুও দুর্বোধ্য কিছু শব্দ তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট খুবই চমকপ্রদ নাম। এই নামটা উচ্চপদস্থ অফিসার এবং ধনী ব্যক্তিদের মুখে মুখে ঘোরে। কখনো কখনো খবরের কাগজের পাতায় তাঁর সম্পর্কে দু চার কথা লেখা হয়। কিন্তু তিনি ডিউক, প্রধানমন্ত্রী বা জমিদার নন। পরিচয় দেবার মতো চটকদার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই তাঁর। তাঁকে সাধারণ কোনো মানুষ চেনেন না। তবুও মি. ব্লাস্ট অসাধারণ একজন মানুষ, যাঁর হাতে রয়েছে সর্বাধিক ক্ষমতার উৎস মুখ।
হতদরিদ্র এক ইংরেজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বিপুল অর্থের মালিক। এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি সরকারকে ইচ্ছেমতো উঠ-বোস করাতে পারেন। তিনি কোনো দিন মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেননি। একেবারে সাদামাটা জীবনযাপন করেন। মি. ব্লাস্টের স্বনামধন্য হওয়ার গোপন রহস্য হল, তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত এক ব্যাঙ্কেরকর্ণধার। যাঁর অঙ্গুলিহেলনে সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়।
মি. মর্লে গর্বের সঙ্গে বলতে লাগলেন–চিরদিনই সময় ধরে তিনি সব কাজ করে আসছেন। মাঝেমধ্যে পায়ে হেঁটে অফিসে যান। গল্ফ তার প্রিয় খেলা আর বাগান পরিচর্যা করা তাঁর একটা সখ। ইচ্ছে করলে তিনি সারা ইউরোপ মহাদেশকে হাতের মুঠোয় আনতে পারেন। ভাবলে অবাক লাগে এই মানুষটার মধ্যে কোনো অহংকার নেই।
এইসব মন্তব্য শুনে এরকুল পোয়ারোর মন বিতৃষ্ণায় ভরে যায়। মি. মর্লে দন্তচিকিৎসক হিসেবে জানিয়েছেন একথা যতটা সত্যি ঠিক ততটাই সত্যি তার থেকেও নামকরা দন্ত বিশেষঙ্গ এই লন্ডন শহরে আছেন। কিন্তু এরকুল পোয়ারো সেখানে এখন এক এবং অদ্বিতীয়।
মি. মর্লে বললেন–মুখ কুলকুচো করুন। এবার তিনি দ্বিতীয় দাঁতটিতে ড্রিল রেখে বললেন, হিটলার, মুসেলিনীর সঙ্গে এসব মানুষের তুলনা চলে, কি বলেন মশাই! আমি বাবা রেখে ঢেকে কথা বলতে পারি না। অবশ্য এসব কথা আপনাকে বলে কি লাভ, আপনি তো ফরাসি, আপনি রিপাবলিকান মতবাদে বিশ্বাসী?
পোয়ারো অস্পষ্ট স্বরে বলতে চেষ্টা করলেন–আ আমি ফ-ফরাসি নই, আ–আমি বেলজি–। সঙ্গে সঙ্গে মি. মর্লে তাঁর মুখে হাত চাপা দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।
কুণ্ঠিত মুখে তিনি বললেন–দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না, দাঁতের গর্তটা ঠিকমতো শুকোতে দিতে হবে। তিনি মুখের ভেতর গরম বাতাস দিতে লাগলেন।
নিঃস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে কিছুটা সময় কেটে গেল।
মি. মর্লে আবার বলতে লাগলেন–আমি ভাবতেই পারিনি যে আপনি বেলজিয়াম। ভারি অদ্ভুত তো। রাজা লিও পোন্ডের কথা কে না জানে। রাজকন্যের শাসনব্যবস্থা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও কম প্রশংসনীয় নয়। কি সুন্দরভাবে তাঁরা সব কিছু মনে রাখে। এত তাদের প্রখর স্মৃতিশক্তি। সহজে কারও নাম ভোলে না। তবে এই সহজাত ক্ষমতা অনেকের ক্ষেত্রে ভগবান প্রদত্ত হয়। এই আমাকেই ধরুন না, কোনো লোকের নামে আমি চিনব না, কিন্তু তাকে একবার দেখলে জীবনেও ভুলব না। কারণ সেই ব্যক্তির নাম আমার মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তার মুখটা স্মৃতির অতলে গেঁথে থাকে। নিন আর একবার মুখটা ধুয়ে ফেলুন।
মুখ ধোওয়া হলে মি. মর্লে দাঁতগুলো আবার ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করলেন। নিখুঁত তাঁর কার্যধারা, কোনো গাফিলতি নেই, নেই ক্লান্তিভাব।
সব ঠিকঠাক হয়েছে, ভয়ের কারণ নেই। আস্তে আস্তে মুখটা বন্ধ করুন তো, আবার খুলুন। লাগছে বুঝি? গর্তটা বুজে গেছে বুঝতে পারছেন না? আগের মতো একবার মুখ খুলুন ও বন্ধ করুন তো। না না, চিন্তা নেই খুব ভালো ভাবেই ভরাট হয়েছে।
সশব্দে চেয়ার টেবিল সরালেন মি. মর্লে।
মুক্ত বিহঙ্গের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এরকুল পোয়ারো।
মি মর্লে কৌতুক করে বললেন আমার বাড়িতে কোনো অপরাধীর সন্ধান না পাওয়ায় আপনি নিশ্চয় হতাশ হয়েছেন মি. পোয়ারা।
পোয়ারো হেসে বললেন–এখানে আসার আগে প্রত্যেককেই অপরাধী বলে মনে হয়েছিল আমার। এবার অন্যরকম মনে হবে হয়তো।
তা ঠিক। আগে পরের মধ্যে অনেকটা পার্থক্য আছে। যে যাইহোক, আমাদের অর্থাৎ দন্তচিকিৎসকদের আপনার নিশ্চয়ই খারাপ মনে হয় না। এলিভেটরে পৌঁছে দেবার জন্যে কারো সাহায্য লাগবে আপনার?
না, না, ব্যস্ত হবেন না আপনি, আমি একাই যেতে পারব।
যা খুশি আপনার, সিঁড়ির পাশেই এলিভেটর। তাহলে বিদায়–মঁসিয়ে পোয়ারো।
ধন্যবাদ জানিয়ে এরকুল পোয়ারো বাইরে বেরিয়ে এলেন। জল পড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। পিছনের দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল।
পোয়ারো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। শেষ ধাপে দেখা হল সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কর্নেলের সঙ্গে। পোয়ারোর মতে লোকটি দেখতে সুশ্রী, উঁচুমানের শিকারী সম্ভবত অনেক বাঘও শিকার করেছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি স্তম্ভও বটে।
কাল বিলম্ব না করে মি. পোয়ারো ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি তাঁর টুপি ও ছড়িখানা রেখে গিয়েছিলেন। যেই অস্থির হলেন আর একজনের ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল সেই রোগীটি একটি ফিল্ড পত্রিকা পড়ছিলেন।
এরকুল পোয়ারো গোয়েন্দাসুলভ দৃষ্টিতে তাকে পরখ করতে লাগলেন। তিনি ভাবলেন যুবকটি কোনো খুন করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, হয়তো বা ইতিমধ্যে কোনো জঘন্যতম অপকর্ম করে ফেলেছে। নয়তো ছেলেটি আদৌ কোনো খুন করেনি। এতটা হিংস্র সে হতে পারবে না। হয়তো তার যন্ত্রণা উপশম হলেই হাসিমুখে বেরিয়ে যাবে।
সেই ছোকরা চাকরটা আবার ঘরে এল স্পষ্ট উচ্চারণে মি. ব্লাস্টকে ডাকলো।
এবার ফিল্ড পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে থাকা ব্যক্তিটি উঠে দাঁড়ালেন। মাঝারি গড়নের মধ্যম উচ্চতা বিশিষ্ট, মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। মেদ বর্জিত দেহ, তবে রোগাও বলা যাবে না। সাজসজ্জায় রুচির ছোঁয়া আছে। ধীর-স্থির ভাবভঙ্গি।
ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী ও ক্ষমতাবান পুরুষ হয়েও তাঁকে দাঁতের রোগের কাছে হার মানতে হয়েছে। তাই ছুটে এসেছেন দন্তচিকিৎসকের কাছে আর তার মনের অবস্থাও অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই।
এরকুল পোয়ারো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে টুপি ও ছড়ি নিয়ে দরজার কে এগিয়ে গেলেন। দরজা অতিক্রম করার আগের মুহূর্তে তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন, আর তখনই তাঁর মনের ভেতর একটা সন্দেহ উঁকি মারল, অসহ্য দাঁতের ব্যথা এই যুবকটিকেও কাবু করেছে।
পোয়ারো হলঘরে এসে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইচ্ছে ছিল গোঁফ জোড়াটি স্বস্থানে আছে কিনা তা দেখা। কেননা মি. মর্লের দাঁত পরিচর্যার সময় একটু অবিন্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
গোঁফ জোড়া ঠিকঠাক করলেন। মনমতো হওয়ায় এলিভেটরে করে একেবারে নীচে নেমে এলেন। ছোরা চাকরটিকে দেখতে পেলেন। সে শিস দিতে দিতে এগিয়ে আসছিল। পোয়ারোকে দেখে ছেলেটি থমকে দাঁড়াল কিছুক্ষণ তারপর দ্রুততার সঙ্গে দরজাটি খুলে ধরল।
সেই সময় বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সির দরজা খুলতেই একটি পা মি. পোয়ারোর নজর কাড়ল। কৌতূহলবশত মি. পোয়ারো পার্টিকে জরিপ করতে লাগলেন।
সেই পায়ে অত্যন্ত দামি মোজা। তবে জুতো দেখে পোয়ারো নাক শিটকোলেন, অবশ্য জুতোটা নতুন, তাতে নড়লেন পোয়ারো। যতটা সুন্দর ধারণা করেছিলেন তা ঠিক নয়। বরং গ্রাম্য মিশ্রণ।
ততক্ষণ পায়ের মালিক ট্যাক্সি ছেড়ে মাটিতে পা রেখেছেন। অন্য পার্টি বের করার সময় ট্যাক্সির দরজায় ধাক্কা খেল। আর সঙ্গে সঙ্গে বকলসটি খুলে ছিটকে পড়ল। ফুটপাতে টুং করে একটা শব্দ উঠল–পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে আনলেন এবং মহিলার দিকে এগিয়ে ধরলেন।
বেচারা পোয়ারো! তিনি ভেবেছিলেন পায়ের মালিক কম বয়সি কোনো যুবতী হবে। কিন্তু হল তার উল্টো। বছর পঞ্চান্নর এক মহিলা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। এলোমেলো ধূসর চুল। পরনের পোশাকটিও বেমানান। সবুজের অধিক্য রয়েছে। হঠাৎ মহিলার চোখ থেকে চশমাটা খুলে পড়ল, ওটা তুলতে গিয়ে তিনি হাতব্যাগটিও ফেলে দিলেন। পোয়ারো ভদ্রতার খাতিরে সে দুটো তুলে দিলেন ওই মহিলার হাতে।
মহিলা পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানিয়ে ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিটের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
পোয়ারো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলায় সে বেজায় চটে গেল। বলল মহিলা ভীষণ কিপটে, কোনো বকশিস দিলেন না।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, ট্যাক্সি কি খালি? তাহলে আমি যেতে পারি।
ট্যাক্সি ড্রাইভার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে এরকুল পোয়ারো গাড়িতে উঠে বসলেন।
ভালভাবে বসতে বসতে বললেন–এখন আমিও যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেয়েছি।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে। সে কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে পোয়রোকে দেখছে।
তার চাহনি দেখে পোয়ারো হেসে বললেন আরে না, না–তুমি যা ভাবছ আমি তা নই, আমি মাতাল নই। প্রকৃত কথা হল আমি দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের চেম্বারে এসেছিলাম।
তিনি বলেছেন আগামী দু’মাসের মধ্যে আর আসতে হবে না। সেই আনন্দেই আমি আত্মহারা।
০২. তিন চার আটকাও দ্বার
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন পৌনে দুটো। দিবা নিদ্রার সময়। এরকুল পোয়ারো দ্বিপ্রহরিক আহার সেরে সবেমাত্র আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। ঠিক তখনই ঝনঝন শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠল। টেলিফোনটা প্রথমে মি. পোয়ারো ধরলেন না। তিনি জর্জের ধরার অপেক্ষায় রইলেন।
জর্জের রিসিভার তুলে কথা বলার ভঙ্গি দেখে মি. পোয়ারো জানতে চাইলেন কার ফোন? কি বলছেন?
জর্জ রিসিভারের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল–চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ, স্যার।
পোয়ারো চিন্তিত মুখে রিসিভারটা হাতে নিয়ে বললেন–হ্যাঁল্লে জ্যাপ। ব্যাপার কি?
–পোয়ারো বলছেন? ও প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল। হ্যাঁ বলছি।
–আপনি আজ সকালে দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের কাছে গিয়েছিলেন নাকি? খবরটা কি সত্যি?
-হ্যাঁ গিয়েছিলাম, কিন্তু এধরনের প্রশ্ন করার কারণ কী?
–আশা করি এই যাওয়ার পেছনে কোনো গোপন রহস্য নেই? নিছকই সৌজন্যের খাতিরে গিয়েছিলেন?
–অবশ্যই নেই। যদি সন্দেহ হয় তবে শুনুন আমি গিয়েছিলাম দাঁতের অসহনীয় যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে।
তার কোনো আচরণ কি আপনাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল? তার হাবভাব কি আর পাঁচটি দিনের মতো স্বাভাবিক ছিল?
না, ঠিকই ছিল। কেন বলুন তো?
জ্যাপ কর্কশ স্বরে জবাব দিলেন–কারণ আপনি চলে আসার কিছুক্ষণ পরেই তিনি আত্মঘাতী হন, নিজের গুলিতেই তিনি মারা যান।
পোয়ারো আশ্চর্য হয়ে বললেন–না, এ হতে পারে না।
জ্যাপ কঠিন স্বরে বললেন–কথাটা শুনে আপনি বোধহয় আকাশ থেকে পড়লেন।
–সেটাই তো স্বাভাবিক।
আমিও একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা করতে চাই। একবার এলে ভালো হয়।
–আপনি এখন কোথায়?
কুইন শার্লট স্ট্রিট।
–আমি এখনই যাচ্ছি বলে পোয়ারো রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
এরকুল পোয়ারো নিমেষের মধ্যে পৌঁছে গেলেন ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিটের ওই বাড়িতে। যেখানে মি. মর্লে আত্মহত্যা করেছেন। একজন পুলিশ কনস্টেবল দরজা খুলে সসম্ভ্রমে বলল–আপনি কি মঁসিয়ে পোয়ারো?
–হ্যাঁ আমি, মাথা নেড়ে জানালেন মি. পোয়ারো।
চিফ ইন্সপেক্টর ওপরে দোতলার ঘরে আছেন। ঘরটা আপনার অচেনা নয় নিশ্চয়ই।
না, না, আমি চিনি–আজ সকালেই এখানে এসেছিলাম।
ঘরে তিনজন লোক ছিলেন। পোয়ারো ঘরে গিয়ে হাজির হলেন। তাকে দেখে জ্যাপ বললেন–আপনি আসায় আমার খুব উপকার হল মি. পোয়ারো। এখনও মৃতদেহটা এখানেই আছে সরানো হয়নি। আপনি আগে দেখুন।
ক্যামেরাম্যানও হাজির। তিনি মৃতদেহের পাশে বসে ফটো তুলছিলেন। পোয়ারোকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।
পোয়ারো এগিয়ে গেলেন চুল্লির দিকে। সেখানেই মি. মর্লের মৃতদেহটি পড়েছিল।
মি. পোয়ারো ঘুরে ঘুরে মৃতদেহটি জরিপ করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন মৃত্যুর পরও মি. মর্লের শরীরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আগের মতোই আছেন তিনি, যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর ডানদিকের রগের পাশে সামান্য ছোট একটা গর্ত। তার ডান হাতে একটা ছোট পিস্তল। পোয়ারো বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন ঠিক আছে, দেহটা এবার সরানোর ব্যবস্থা করুন।
কাছেই পুলিশের লোক দাঁড়িয়েছিল। তারা এগিয়ে এসে মি. মর্লের দেহ তুলে নিয়ে গেল।
চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ ও গোয়েন্দা প্রবর পোয়ারো ছাড়া বাকি সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
জ্যাপ বললেন–রুটিনমাফিক সব কাজ করা হয়েছে। পোয়ারো বললেন–এবার ঘটনাটা খুলে বলুন তো।
জ্যাপ ঢোক গিলে বলতে লাগলেন আমার ধারণা মি. মর্লে নিজের গুলিতেই মারা গেছেন। মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা পিস্তলটাতে ওরই হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না।
আপনি কি সন্দেহ করছেন?
আপাত দৃষ্টিতে ওনার আত্মহত্যা করার কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। উনি চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী। অর্থকড়ির অভাব নেই। কারো সঙ্গে শত্রুতা নেই। বিশেষ করে কোনো মেয়েমানুষঘটিত কিছু ছিল না বলেই শুনলাম। অথবা কোনো কিছু নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতেও কেউ দেখেনি তাঁকে। যেহেতু আপনি তাঁকে চেনেন তাই আপনার কাছে তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম। আপনি কি আজ সকালে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন বা বেতাল কিছু লক্ষ্য করেছিলেন।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন–না, তেমন কিছুই না। সুস্থ স্বাভাবিক ছিলেন।
তাহালেই ভাবুন কাজ করতে করতে কেউ এভাবে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে কি না? ব্যাপারটার মধ্যে কোনো একটা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, যেটা আমাকে ভাবাচ্ছে।
পোয়ারো বললেন বুঝতে পারছি, আপনার সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক। আচ্ছা বলুন তো ঘটনাটা কখন ঘটেছিল।
ঠিক সময়টা বলতে পারব না। কেন না গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ কারো কানে যায়নি। যাওয়া সম্ভবও নয়। এই ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার জন্যে মাঝে বারান্দা ও দুটো দরজা আছে।
দরজায় মোটা পরদা দেওয়া এমনকি একসঙ্গে অনেক রোগী কথা বললেও কেউ শুনতে পায় না বাইরে থেকে।
পোয়ারো স্বীকার করলেন কথাটা। ঠিক তাই। তাছাড়া বাইরে গাড়ি ঘোড়াও চলছে, তাই কোনো কিছু শুনতে পাওয়া কঠিন। মৃত্যুর কথা কে কখন প্রথম জানতে পারে?
প্রায় দুপুর দেড়টা নাগাদ–ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেড বিগম প্রথম জানতে পারে। ওর কাছেই শুনলাম সাড়ে বারোটায় একজন রোগী দেখার কথা। মি. মর্লের সেই রোগীটি পৌনে এক ঘণ্টা ধরে বসেছিলেন। শেষে বিরক্ত হয়ে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। তাই অ্যালফ্রেড বিগম ডাক্তারের দরজায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে কোনো উত্তর আসে না। আবার দরজা ঠেলে ঢোকার সাহসও তাঁর নেই। এর আগে না বলে ভেতরে ঢোকার জন্যে তাকে হেনরি মর্লে বকুনি দিয়েছিল। তাই দ্বিতীয় বার সে আর ভুল করতে চায়নি। ছোকরা চাকরটি নীচে নেমে যায়। পরে সেই মহিলা রোগী ক্রুদ্ধ হয়ে চলে যায়। তখন সওয়া একটা তাছাড়া ওই মহিলার দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল।
মহিলাটির নাম কি?
জ্যাপ মুচকে হেসে বললেন–ছোকরা ওই মহিলাটিকে মিস মার্টি নামেই চেনে তবে ডাক্তারের খাতায় লেখা আছে ডার্বি।
পোয়ারো জানতে চাইলেন–রোগীদের ওপরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কিরকম ব্যবস্থা চালু ছিল?
মর্লে পরের রোগীদের ডাকার জন্যে বেল বাজাতেন।
এরপর ওই চাকরটা পরের জনকে ওপরে নিয়ে যেত।
মর্লে কখন শেষ বেল বাজিয়েছিলেন?
বারোটা পাঁচে। সেই রোগীর নাম মি, অ্যামবেরিওটিস, স্যাভয় হোটেল। ডাক্তারের নথি থেকে জানা গেছে।
ওই ছেলেটা নামটা শুনে কিভাবে উচ্চারণ করল, ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছে।
একটা আস্ত গবেট ওকে নানা প্রশ্ন করে আমরা হাসির খোরাক জোগাতে পারি।
ওই রোগীটি অর্থাৎ মি. অ্যামবেরিওটিস কখন চলে গিয়েছিলেন?
মি. অ্যামবেরিওটিস একা বাইরে বেরিয়ে এলিভেটরে উঠেছিলেন। তাই ছেলেটি জানে না। এমন অনেক রোগী আছেন যারা কারো সাহায্য নিতে পছন্দ করেন না। ইতিমধ্যে আমি একটা কাজ করেছি। স্যাভয় হোটেলে ফোন করেছি। মি. অ্যামবেরিওটিসের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি খুবই সপ্রতিভ, সব কথাই বলেছেন। কোনো কিছু গোপন করেননি। তিনি যখন বেরিয়ে এসেছিলেন তখন ঘড়িতে বারোটা পঁচিশ হয়েছিল।
আমাদের কাজে লাগতে পারে এমন কোনো কথা কি তাঁর কাছে জানতে পেরেছেন?
তিনি বলেছেন–মি. মর্লের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেননি তিনি।
তাহলে ঘটনাটা ঘটতে পারে বারোটা পাঁচ থেকে বিশ মিনিট আর দেড়টার মধ্যে। নীচের সময়টার সম্ভাবনা বেশি।
অবশ্যই কারণ তা যদি না হত……….। পোয়ারো তাকে নামিয়ে দিয়ে বললেন তাহলে তিনি পরবর্তী রোগীকে বেল টিপে ডাকতেন।
এটাই ঠিক। ডিভিশানাল সার্জনের মতও তাই। তিনি দুটো কুড়িতে মৃতদেহ পরীক্ষা করে কিছু বলেননি? তাঁর বয়ান অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে মি. মর্লে একটার পরে নিজেকে গুলি করে থাকতে পারেন, নয়তো সামান্য আগেও হতে পারে। তবে এই ঘটনার সঙ্গে সন্দেহজনক কিছু জড়িয়ে আছে।
পোয়ারো চিন্তিতি মুখে বললেন মি. মর্লে বারোটা পঁচিশেও অত্যন্ত স্বাভাবিক, হাসিখুশি, দক্ষ দন্তচিকিৎসকই ছিলেন। এরপর এমন কি ঘটল? হতাশা–অবসাদ-আর তাই তিনি এপথ বেছে নিলেন। নিজের গুলিতে শেষ হলেন।
ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত না, মি. পোয়ারো?
পোয়ারো জানতে চাইলেন বন্দুকটা কি মি. মর্লের ছিল?
না, না আমি যতটা জানি তার কোনো বন্দুক ছিল না। তার বোন মিস মর্লেও সেকথা স্বীকার করেছেন। অবশ্য এটা ঠিক, কেউ যদি মনে করেন নিজেকে শেষ করবেন, তাহলে একটা বন্দুক কিনতেই পারেন। আর যদি তাই হয় তাহলে খবরটা আমরা জানতে পারব। আর একটা বিষয় আমাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে, সেটা হল মি. মর্লের পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখে আমি একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে কেউ ওভাবে পড়তে পারে না। তবুও ভঙ্গিটা একটু অন্য ধরনের।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন–আপনি কি ওই ছোরাকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছেন?
না, তেমন কিছু নয়–এটা আমার অনুমান মাত্র, আমার ধারণা ছোকরাটা মি. মর্লেকে ও ভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়েছিল। তাই সরিয়ে দেখতে চেয়েছিল। সে অবশ্য একথা স্বীকার করেনি।
পোয়ারো ঘরের চারপাশটা ভালো ভাবে লক্ষ্য করলেন। একে একে তিনি চোখ বুলিয়ে গেলেন দেয়ালের কোণে থাকা হাত ধোয়ার বেসিন, দরজার পাশে থাকা ফাইল ক্যাবিনেট, চুল্লি, রোগীর বসার চেয়ারের ওপর দিয়ে। শেষে তিনি দৃষ্টি রাখলেন যেখানে মর্লের দেহটা শায়িত ছিল সেদিকে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল চুল্লি কাছে আরও একটি দরজার দিকে।
পোয়ারোকে অনুসরণ করে জ্যাপের দৃষ্টিও ঘুরে গেল চারদিকে।
দরজাটার দিকে জ্যাপ এগিয়ে গেলেন। দরজাটা খুলে বললেন–এটা ছোট একটা অফিস ঘর। এখানে মর্লের সেক্রেটারি মিস নেভিল কাজ করত। ছোকরা চাকরটার বক্তব্য থেকে বুঝলাম তিনি আজ অনুপস্থিত।
হ্যাঁ মনে পড়ছে, মর্লের কাছে শুনেছিলাম। এই বক্তব্য আত্মহত্যার বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
মিস নেভিলের বসার ঘরটিতে ছোট একটি ডেস্ক, একটা স্পিরিট ল্যাম্প, চায়ের সরঞ্জাম আর কয়েকটা চেয়ার রয়েছে। এখানে প্রবেশের দ্বিতীয় কোনো দরজা নেই।
জ্যাপ নাক চুলকে বললেন আপনি বলতে চাইছেন কৌশলে মেয়েটাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে? এটা আত্মহত্যা নয়, খুন? কিন্তু খুনের মোটিভ কি? কে-ই বা তাকে খুন করবে? এমন শান্ত নস্ত্র মানুষটির ওপর কার আক্রোশ ছিল?
পোয়ারো বললেন আপনি ভেবে বলুন তো? কে হতে পারে?
যে কেউই হতে পারে। ওপরের কোনো ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী কিংবা বাড়ির চাকরের কেউ এসেও গুলি করে পালিয়ে যেতে পারে। তার কিছু কাজ পার্টনার রেইনিকেও সন্দেহের তালিকায় রাখা যায়। এমনকি ওই ছোকরারও কাজ হতে পারে। তাছাড়া আজ সকালে আসা রোগীরাই বা বাদ যাবে কেন? তাদের মধ্যে কেউ একজন গুলি করে থাকতে পারে। মি. অ্যামবেরিওটিসও সন্দেহমুক্ত নন। তার পক্ষে একাজ করা সম্ভব।
পোয়ারো মাথা নেড়ে স্বীকার করলেন। তাহলে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।
জ্যাপ বললেন–অবশ্যই, তাহলে আপনিও বলছেন আমার ধারণাটা সঠিক, কিন্তু মি. অ্যামবেরিওটিসের মতো একজন সম্ভ্রান্তধর্মী গ্রিক কেন নিরীহ দন্তচিকিৎসককে খুন করবেন। স্যাভয় হোটেল থেকে এখানে এসে? উদ্দেশ্য কি? এটাই আমাদের কাছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে পোয়ারো বললেন–খুব কাঁচা হাতের কাজ। পেশাদারি কোনো খুনি নয়। ভুল লোককে গুলি করেছে। এ যদি কোনো কোটিপতি বা ঝানু গোয়েন্দা হত তাহলে ঠিক ছিল, এদের খুন করলে খুনির লাভ হত। কোটিপতিকে খুন করলে অনেক টাকা–পেত আর গোয়েন্দাকে মারলে দোষীদের সাজা লাঘব হত।
আহা বেচারা মর্লে, যে নাকি কারো কাছেই বিপজ্জনক নয়। অথচ তাঁকেও মরতে হল অপঘাতে। বিষাদের সুর জ্যাপের গলায়। হয়েছে।
পোয়ারো বললেন–সত্যিই আমি বিস্মিত।
জ্যাপ সরাসরি পোয়ারোর মত জানতে চাইলেন।
মর্লের সঙ্গে আজ সকালের কথোপকথন সম্পর্কে জ্যাপকে জানালেন পোয়ারা। মর্লের মুখে শোনা একজন রোগীর নামও বললেন।
জ্যাপ প্রশ্ন করলেন আপনি আজ সকালে মি. মর্লের কাছে আসা অন্যান্য রোগীদের ভালো করে দেখেছিলেন?
পোয়ারো সতর্কভঙ্গিতে বললেন–আজ সকালে আমি ওয়েটিং রুমে একজন যুবককে দেখেছিলাম, যাকে দেখতে অনেকটা খুনিদের মতো।
জ্যাপ সচকিত হয়ে বললেন–কেসটা কি মশাই? পোয়ারো হেসে বললেন না, না সেরকম কিছু না। যুবকটিকে আমার খুব অদ্ভুত লাগছিল। তার ভাবভঙ্গি অপরাধসুলভ।
জ্যাপ বললেন–বুঝতে পারছি, আপনার খুনি যুবকটি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আত্মহত্যা কিংবা খুন যাই হয়ে থাকুক তদন্ত করে আমরা দেখব। এখন চলুন মিস মর্লের কাছে। ওর সঙ্গে আর একবার কথা বলা দরকার, ভাইয়ের মৃত্যু তাঁর পক্ষে খুব শোকের। যদিও তিনি কঠিন মনের মানুষ তাই সহজে মুষড়ে পড়বেন না।
জর্জিনা, মর্লে, জ্যাপও পোয়ারোর কথা শুনলেন।শান্তভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন–এটা অবিশ্বাস অবাস্তব ঘটনা, আমার ভাই আত্মহত্যা করতে পারে না। আমি তাকে ভালোভাবে জানি এমন মানসিকতার মানুষ নয় সে।
পোয়ারো বললেন–এর উল্টোটা কি হতে পারে, আপনি ভাবতে পারেন, মাদামোয়াজেল।
মিস মর্লে একটু ভেবে বললেন–এটা তবে ঠিক আত্মহত্যা না হলে খুন, এই সত্যটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
সেটা অসম্ভব নয়?
না–প্রথম সম্ভাবনার ব্যাপার যদি ধরেন তাহলে আমি আবার বলব, তার আত্মহত্যা করার মতো কোনো কারণ নেই। সে নিজের জীবন শেষ করে দেবার পাত্র নয়।
আজ সকালে আপনার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ, প্রাতরাশের সময়।
সে সময় সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ ছিলেন বলে আপনার মনে হয়েছিল? তার মধ্যে কোনো চঞ্চলতা প্রকাশ পায়নি?
হ্যাঁ, সেটাও আমি লক্ষ্য করেছি। সে সামান্য উত্তেজিত ছিল। তবে যা ভাবছেন তা নয়। তার সেক্রেটারি ও সহকারীর ওপর বিরক্ত হয়েছিল এই যা।
কেন তারা কি করেছিল?
আজ সকালে তাঁর ঢের ব্যস্ততা ছিল, আর ওর সেক্রেটারি গ্ল্যাডিস নেভিল ও সহকারী তরুণটি ছুটি নিয়েছিল।
মিস নেভিল মি. মর্লের চেম্বারে কি কাজ করতেন?
সে হেনরির চিঠিপত্র দেখত, অ্যাপয়েন্টমেন্ট বই রাখত, সব চার্ট ভর্তি করত। যন্ত্রপাতি নির্বীজ করত। আর দাঁত ভরাট করার মতো জিনিস তৈরি করে হেনরিকে সহযোগিতা করত।
সে এখানে কতদিন কাজ করছে?
তিন বছর। সে খুব নির্ভরযোগ্য মেয়ে এবং বিশ্বাসী। ওকে আমরা দুজনেই খুব। ভালোবাসতাম।
আপনার ভাই কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন মিস নেভিল কোনো এক আত্মীয়ার শরীর খারাপের খবর পেয়ে চলে গেছে।
হ্যাঁ–ওর দিদিমার স্ট্রোকের খবর দিয়ে কে একজন ওকে টেলিফোন করেছিল। তাই খুব ভোরের ট্রেনে সে সমারমেটে রওনা দেয়।
এই কারণে তার প্রতি আপনার ভাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
মিস মর্লে বললেন–হ্যাঁ, ঠিক তাই। তা বলে আপনি আমার ভাইকে নিষ্ঠুর ভাববেন না। সে ভেবেছিল, পোয়ারো মিস মর্লের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বললেন হ্যাঁ বলুন, মি. মর্লে কি ভেবেছিলেন?
জর্জিনা মর্লে ইতস্তত করে বললেন–হেনরি ভেবেছিল গ্ল্যাডিস তাকে মিথ্যে বলেছিল। ও ইচ্ছে করে ছুটি নিয়ে ওই যুবকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল। যদিও আমি জানি গ্ল্যাডিস সে ধরনের মেয়ে নয়। হেনরিকে আমি সে কথা বলেছিলাম। তবে কথাটা হল অযোগ্য এক যুবকের সঙ্গে সে ঘোরাফেরা করে সেটা হেনরির পছন্দ নয়। তাই হেনরি ভেবেছিল মিস নেভিল ওই যুবকের পরামর্শে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। দিদিমার অসুস্থতার খবরটা নিছকই বাহানা। ওরা একদিন ছুটি নেওয়ার জন্যে এই মতলব ফেঁদেছিল। তবে আমি নিশ্চিত ও এমন অন্যায় কাজ করতে পারে না। ও কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, ওর বিবেচনা বোধ অত্যন্ত প্রখর।
তবে ওই যুবকের পক্ষে এরকম প্রস্তাব করা সম্ভব?
হ্যাঁ–সে সব পারে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি একথা বাধ্য হয়েই বলছি।
পোয়ারো বললেন ওই যুবকের নামটা জানা হল না। তাছাড়া ও আপনার ভাইয়ের কাছে কি কাজ করে?
মিস মর্লে জবাব দিলেন ওর নাম কার্টার! ফ্র্যাঙ্ক কার্টার। হেনরির বক্তব্য অনুযায়ী ও একটি বখাটে ছেলে। ওর সঙ্গে হেনরির আলাপ বীমা করার সূত্রে, ছেলেটি আগে বীমা কোম্পানিতে কেরানির কাজ করত। কোনো কারণে তার চাকরি যায়। সেই থেকে হেনরির চেম্বারে এসে বসত। রোগীদের নাম লিখতো। গ্ল্যাডিসকে বিয়ে করতে চায়। তাই গ্ল্যাডিস জমানো টাকা থেকে কিছুটা কার্টারকে দেয়। সেই কারণে হেনরি খুবই ক্ষুব্ধ।
এতক্ষণ জ্যাপ চুপচাপ বসে ওদের কথা শুনছিলেন। এবার তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন–আপনার ভাই কি মিস নেভিলকে বলেছিলেন কার্টারকে বিয়ে না করতে?
হ্যাঁ–হেনরি এই বিয়েতে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল।
তাহলে আপনার ভাইয়ের ওপরে ফ্রাঙ্ক কার্টারের রাগ, বিদ্বেষ থাকতেই পারে? মিস : মলে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন–একথা সত্যি নয়। আপনি কি বলতে চান কার্টার হেনরিকে গুলি করে হত্যা করেছে। যদিও আমার ভাই গ্ল্যাডিসকে পরামর্শ দিয়েছিল কার্টারকে এড়িয়ে চলার কিন্তু মেয়েটা সেই পরামর্শ কানে তোলেনি, সে কার্টারকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছিল।
জ্যাপ আবার বললেন–আপনি কি জানেন আপনার ভাইয়ের আর কোনো শত্রু আছে কিনা?
মিস মর্লে মাথা নেড়ে না বললেন।
মি. মর্লের অংশীদার মি. রেইলি সম্পর্কে আপনি কি জানেন?
মিস মর্লে তিক্তস্বরে বললেন–ওর সম্পর্কে হেনরি যা বলত তা হল, ও একজন আইরিশ। রুক্ষ মেজাজ। সব সময় ঝগড়া করতে পছন্দ করে। আর রাজনীতি নিয়ে তর্ক শুরু করলে তো কথাই নেই। নাওয়া খাওয়া ভুলে যাবে। বিরক্তিকর ব্যক্তিত্ব। তবে তার প্রশংসা করে হেনরি বলত, তার কাজে গাফিলতি নেই। দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নাম আছে। দাঁতের যে কোনো জটিল অসুখ সে অতি সহজেই সারিয়ে তুলতে পারত।
আপনি যে বললেন–বিরক্তিকর ব্যক্তিত্ব, সেটা কোনদিক থেকে?
মিস মর্লে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন–সে প্রচন্ড নেশাগ্রস্ত। সবসময় মদ পান করত। বদ্ধ মাতাল–তবে দয়া করে একথাটা খবরের কাগজে ছাপিয়ে দেবেন না।
এ নিয়ে তার সঙ্গে আপনার ভাইয়ের কি কোনো ঝামেলা হয়েছিল?
হেনরি তাকে দু-একবার সাবধান করেছিল। বলেছিল–দাঁতের চিকিৎসা, সূক্ষ্ম কাজ, খুব সতর্ক হয়ে করতে হয়। তাছাড়া মদের গন্ধ যে কোনো রোগী অপছন্দ করবে।
জ্যাপ সায় দিয়ে বললেন–আপনার ভাইয়ের টাকা পয়সার ব্যাপারটা একটু বলুন।
হেনরি খারাপ আয় করত না। সে সঞ্চয়ীও ছিল। বেশকিছু টাকা জমিয়েছিল সে। তাছাড়া আমাদের বাবার কাজ থেকে পাওয়া কিছু টাকাও আছে দুজনের নামে।
মি. মর্লে কি কোনো উইল করেছিলেন?
হ্যাঁ–সে উইল করেছিল। তাতে যা লেখা আছে তা হল গ্ল্যাডিস নেভিল পাবে একশো পাউন্ড, বাকিটা আমার।
হুম বলে জ্যাপ চুপ করে গেলেন।
এমন সময় দরজায় একটা শব্দ হল। দরজার পাল্লা খুলে যে মুখ বের করল সে আর কেউ নয় ওই ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেড। পোয়ারো আর জ্যাপকে দেখে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ঢোক গিলে সে বলল–মিস নেভিল এসেছেন। তিনি শোকে বিহ্বল। তিনি জানতে চাইলেন এখানে আসতে পারেন কি না।
জ্যাপ ইঙ্গিত করতেই মিস মর্লে বললেন–যাও অ্যালফ্রেড, ওকে এখানে নিয়ে এসো।
ঠিক আছে বলে অ্যালফ্রেড বিদায় নিল।
মিস মর্লে জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন।
মিনিট কয়েক পরে বছর আঠাশের একটি তরুণী ঘরে এসে ঢুকলেন। ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, দীর্ঘাকায় বুদ্ধিমতী মহিলা। দেখে মনে হবে সত্যিই সে ভেঙে পড়েছে মি. মর্লের আত্মহত্যার খবর শুনে। তবে চটজলদি সামলে নিতে সে সক্ষম হয়েছে।
জ্যাপের ইচ্ছে ছিল না মিস নেভিল, মিস মর্লের মুখোমুখি হয়। তাই তিনি মি. মর্লের কাগজপত্র দেখার অজুহাতে গ্ল্যাডিসকে নিয়ে পাশের ছোট ঘরে গেলেন।
সেখানে যাওয়ার পর মিস নেভিল বারবার বলতে লাগলে–আমি কিছুতেই মানতে পারছি না, মি. মর্লে এমন একটা অবিশ্বাস্য কাজ করতে পারেন। গতকালও সে তার সঙ্গে কাজ করেছে। তার মধ্যে অপ্রত্যাশিত কোনো লক্ষণ দেখেনি সে।
জ্যাপ এই সুযোগে বলে ফেললেন মিস. নেভিল আপনাকে কেউ খবর পাঠিয়ে ডেকেছিল?
গ্ল্যাডিস বলল–আর বলবেন না, পুরোটাই তামাশা, কেউ যে এমন বিশ্রী খবর কাউকে পাঠাতে পারে তা আমার জানা ছিল না। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি।
জ্যাপ বললেন–আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না। একটু খোলাখুলি বলুন।
গ্ল্যাডিস বলে চলল, আমার দিদিমার অসুস্থতার খবর দিয়ে আমাকে কেউ টেলিগ্রাম করেছিল। আমিও তাকে দেখতে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি আসলে দিদিমার কিছুই হয়নি। তিনি সুস্থ আছেন। দিদিমাও আমাকে দেখে হতবাক, মিথ্যে খবর দিয়ে টেলিগ্রাম করায় তখন আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল। আবার সত্যি কথা বলতে কি ভালো লেগেছিল দিদিমাকে দেখে। তবে যেই করে থাকুক কাজ হয়েছে। আমি অকারণে স্যারের কাছে খারাপ হলাম।
মিস নেভিল, টেলিগ্রামটা দেখাতে পারেন?
দুঃখিত, স্টেশনে পৌঁছনোর পর ওটা আমি ফেলে দিয়েছি। ওটায় লেখা ছিল, গত রাতে তোমার দিদিমার স্ট্রোক হয়েছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো এসো।
আপনি কি নিশ্চিত করে বলতে পারেন এই টেলিগ্রামটা আপনার বন্ধু ফ্র্যাঙ্ক কার্টার পাঠাননি?
মিস নেভিল অবাক হয়ে বলল—-অসম্ভব! ফ্র্যাঙ্ক এটা করতেই পারে না। আর করবেই বা কেন? ওই! বুঝতে পারছি, আপনি বোধহয় ভেবেছেন আমরা দুজনে পরামর্শ করে এমন কাজ করেছি? আপনার ভাবনা ভুল ইন্সপেক্টর। এমন কাজ আমরা স্বপ্নেও ভাবি না।
মিস নেভিল বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। তাকে সামলাতে জ্যাপের যথেষ্ট বেগ পেতে হল। কোনো রকমে তাকে শান্ত করে জ্যাপ আবার প্রশ্ন করলেন–সকালের রোগীদের নাম, কে, কখন এসেছিল সেগুলি কিছু মনে আছে?
গ্ল্যাডিস নিজেকে ধাতস্থ করে বলতে শুরু করল–তাদের নাম ঠিকানা সবই খাতায় নথিভুক্ত করা হয়েছে। নিশ্চয় এতক্ষণে তা দেখে নিয়েছেন। তবুও আমি বলছি বেলা দশটায় মিসেস সেমিসকে সময় দেওয়া হয়েছে। তার নতুন দাঁতের প্লেট বসানো হবে। সাড়ে দশটায় আসার কথা লেডি গ্রাটের। মধ্যবয়সি মহিলা। তিনি থাকেন লোন্ডস স্কোয়ারে। এগারোটায় আসবেন এরকুল পোয়ারো, তিনি এখানে প্রায়ই আসেন। ওহ! আপনি যে এখানে আছেন আগে খেয়াল করিনি। দুঃখিত মি. পোয়ারো, দয়া করে কিছু মনে করবেন না। এত গোলমালে মাথাটা ঠিক রাখতে পারছি না। সাড়ে এগারোটায় মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্ল্যাস্ট-ইনিই সেই বিখ্যাত ব্যাঙ্কার।
তারপর আসার কথা মিস সেইনসবারি সীলের। তিনি দাঁতের যন্ত্রণায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাই ফোনের মাধ্যমে নাম লিখিয়েছিলেন। ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের মহিলা। আর বড় বাজে বকেন। কথা শুরু করলে আর থামতে চান না। বেলা বারোটায় মি. অ্যামবেরিওটিস। তিনি থাকেন স্যাভয় হোটেলে। তিনি এই প্রথম এখানে দাঁত দেখাতে আসবেন। তারপর সাড়ে বারোটায় মিস গার্বির পালা। তার ঠিকানা ওয়াদিং। এছাড়া বন্ধু, বিদেশী আমেরিকান রোগীও আসেন মি. মর্লের কাছে।
পোয়ারো এবার মুখ খুললেন। তিনি বললেন আমি যখন এসেছিলাম তখন বিশাল চেহারার একজন সৈনিক পুরুষকে দেখেছিলাম। তিনি কে?
মি. রেইলির কোনো রোগী হবে হয়তো। লিস্টটা একবার দেখতে হবে। বলেই মিস নেভিল ভেতরের ঘরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এল সে। হাতে একটা নোটবই দেখতে অনেকটা মি. মর্লের নোট বইয়ের মতো।
মিস নেভিল পড়তে লাগল দশটায় ন’বছরের মেয়ে বেটি হিথ, এগারোটায় কর্নেল অ্যাবারক্রমবি।
পোয়ারো নামটা শুনে চমকে উঠলেন। বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলেন, অ্যাবারক্রমবি! সাড়ে এগারোটায় মি. হাওয়ার্ড রেইকস। বারোটায় মি. বার্নেস। এরা সবাই আজ সকালেরই রোগী। মি. রেইলির রোগী সংখ্যা এর থেকে বেশি হয়।
মি. রেইলির রোগীদের আপনি কি চেনেন?
হ্যাঁ, মোটামুটি সকলকে চিনি। এই ধরুন না মি. অ্যাবারক্ৰমবির কথা। তিনি মি. রেইলির পেশেন্ট ছিলেন। বহুদিন তাঁকে দেখিয়েছেন। আর মিসেস হিথ তাঁর ছেলেমেয়েদের দাঁতের কোনো সমস্যা দেখা দিলে আগে মি. রেইলির কাছে যেতেন। মি. রেইকস ও মি. বার্নেসের সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তবে মি. মর্লের মুখে তাদের নাম শুনেছিলাম।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা মি. রেইলির সঙ্গে দেখা করতে যাব। মিস নেভিল, এবার আপনি আসতে পারেন। আমাদের সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ।
জ্যাপ পোয়ারাকে বললেন–একমাত্র অ্যামবেরিওটিস মি. মর্লের নতুন রোগী। এছাড়া সবাই পুরোনো। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় তার সঙ্গে আমাদের দেখা করা উচিত। হয়তো চমকপ্রদ কোনো কু পেতে পারি তাঁর কাছে। তাঁকে আমরা প্রধান সাক্ষী হিসেবেও ধরতে পারি। কেননা একমাত্র তিনিই মি. মর্লেকে শেষ জীবিত দেখেছিলেন। তিনি বিদায় নেবার সময় দন্তচিকিৎসকের ভাবগতিক কেমন ছিল।
পোয়ারো বললেন তাহলে আপনি এই মৃত্যুর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে তার স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন।
হ্যাঁ–তা জানি। কথা শেষ করে তিনি পোয়াবরার দিকে তাকালেন। দেখলেন তিনি চিন্তামগ্ন। বললেন–কি ব্যাপার? এত গম্ভীর হয়ে কি ভাবছেন মি. পোয়ারো?
স্মিত হেসে পোয়ারো বললেন–ব্যাপারটা হল, এত পুলিশ অফিসার থাকতে চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপের ডাক পড়ল কেন? এই ধরণের আত্মহত্যার তদন্ত তাকে ডাকা হয় না।
চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন–আমি সেই সময় কুইন শার্লট স্ট্রিটের কাছেই উইগমো স্ট্রিটের ল্যাভেন হ্যাঁমে ছিলাম। সেখানে একটা জালিয়াতি কেসের তদন্তে গিয়েছিলাম। এখান থেকেই আমাকে ফোন করা হয় এবং তদন্তের ভার দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়।
পোয়ারো সন্দিহান কণ্ঠে বললেন কিন্তু আপনিই বা কেন?
এটার উত্তরও খুব সহজ। এটার কৃতিত্ব দেবো আমি অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে। ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর যখন জানলেন মি. ব্লাস্ট এখানে এসেছিলেন তাই তখন তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বুঝতেই পারছেন মি. ব্লাস্টের মতো ব্যক্তিত্ব। তাকে উপেক্ষা করা কারও সাধ্য নয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন ব্লাস্ট আর তার অনুগামীরা পাহাড়ের মতো বর্তমান সরকারকে আগলে রেখেছে। নিরাপদ, নিশ্চিন্ত রক্ষণশীল এক অর্থনীতি আর তাই অনেকেই চাইবেন তাকে সরিয়ে দিতে। আজ সকালে এখানে যদি তেমন কোন ঘটনা ঘটে থাকে তা দেখার জন্যে অনুসন্ধান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে।
পোয়ারো জ্যাপের কথায় সমর্থন করে বললেন–এ রকমই কিছু একটা আশঙ্কা ছিল আমার। আমার মনে হয় আসল শিকার ছিলেন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট। অন্তত সেটাই হওয়া উচিত। হয়তো মনেরও অবতরণের প্রথম ধাপ। আমার স্থির বিশ্বাস, এর মধ্যে বিশাল অঙ্কের অর্থের গন্ধ আছে।
আমার মনে হচ্ছে এর মধ্যে আপনি অনেক দূর এগিয়েছেন।
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। বেচারি মর্লে এই ঘটনার নিমিত্ত মাত্র। তিনি কিছু জানতে পেরেছিলেন। তিনি ব্লাস্টকে সব বলে ফেলবেন এই ভয়টা কারও ছিল। তাই তাকে…..ঠিক তখনই মিস নেভিলকে ঘরে ঢুকতে দেখে পোয়ারো কথা থামালেন।
সে ঘরে এসে বলল–মি. রেইলি এখন দাঁত তোলায় ব্যস্ত। দশ মিনিটের মধ্যে তার কাজ শেষ হবে। তখন আপনারা এই ব্যাপারে আলোচনা করতে পারেন।
জ্যাপ বললেন ঠিক আছে, আপনাকে এখন এক ফাঁকে ছোকরা চাকর আলফ্রেডের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।
এ দিকে অ্যালফ্রেডের মনে বদ্ধ ধারণা, যে এ সবের জন্য তাকেই দায়ী করা হবে। সে পনেরো দিন আগে মি. মর্লের কাজে যোগ দিয়েছিল। যেদিন থেকে সে কাজে এসেছিল সেদিন থেকেই তার সবকিছু ভুল হচ্ছিল। সব কিছুই ওলোটপালোট করে ফেলছিল। তাই মি. মর্লের কাছে বকুনিও শুনতে হয়েছে অনেক। এর ফলে নিজের প্রতি বিশ্বাসই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অ্যালফ্রেডের।
পোয়ারো এবং জ্যাপ অ্যালফ্রেডের সঙ্গে দেখা করলেন। তাকে পোয়ারো বললেন–আজ সকালে যা যা ঘটেছে সব কথা পরিষ্কার করে বলো। তুমি একজন অন্যতম সাক্ষী। তোমার থেকে সব কিছু জানতে পারলে আমাদের খুব সুবিধা হবে।
এ কথায় অ্যালফ্রেড যেমন আনন্দ পেল তেমনি ভয়ও পেল। সে এর আগে চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপকে সব বলেছিল। তবুও সে বলার জন্য প্রস্তুত হল। সে মুখে কষ্টের ভাব এনে বলতে শুরু করল আজ সকালে আস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। অন্যান্য দিনের মতো আজও সকালে কাজ শুরু করেছিলেন মি. মর্লে।
বাড়িতে অচেনা কেউ এসেছিল?
না–স্যার।
রোগী সেজেও কেউ আসেনি?
আগে থেকে নাম না লিখিয়ে কাউকে দেখেন না মি. মর্লে। তাই সকলকেই নাম লেখাতে হয়।
পোয়ারো আবার প্রশ্ন করলেন বাইরে থেকে কেউ বাড়িতে ঢুকতে পারে?
না–স্যার, তার জন্য চাবির প্রয়োজন হয়। বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল অ্যালফ্রেড।
তবে কি বাড়ি থেকে বের হবার অন্য কোনো দরজা আছে?
না স্যার। কিন্তু হাতল টেনে দরজা খুলে বাইরে আসা যায়। তার জন্য চাবি লাগে না।
বুঝলাম, এবার বলো তো সকালে প্রথমে কোন রোগী এসেছিল? পরে কে কে। এসেছিল?
অ্যালফ্রেড একটু ভেবে বলল–একজন মহিলা তার বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে প্রথমে এসেছিলেন। তিনি মি. রেইলিকে দেখাতে এসেছিলেন। আর মি. মর্লেকে দেখাতে আসেন মিসেস সোপ।
পোয়ারো বললেন–এরপর।
এরপর আসেন একজন বয়স্ক মহিলা। গোলগাল চেহারা তার। তিনি একটা ডেমলারে চড়ে এসেছিলেন। তিনি চলে যেতেই এলেন একজন সৈনিক ভদ্রলোক। তারপরে এলেন আপনি, পোয়ারোকে দেখিয়ে অ্যালফ্রেড বলল।
ঠিক আছে। বলে যাও।
তারপর আসেন এক আমেরিকান যুবক…
জ্যাপ হাত তুলে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–আমেরিকান। তুমি বুঝলে কি করে?
হ্যাঁ–স্যার তিনি যে আমেরিকান তা ওর কথা শুনে আপনিও বুঝতে পারতেন। তাকে আসতে বলা হয়েছিল সাড়ে এগারোটার পর। সবচেয়ে আশ্চর্য হল তিনি এসেছিলেন আগে কিন্তু না দেখিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি অতক্ষণ অপেক্ষা করেননি।
পোয়ারো বললেন তাহলে উনি আমার চলে যাওয়ার পরে চলে গেছেন। কেন না আমি যতক্ষণ এখানে ছিলাম ততক্ষণ তিনি এখানে ছিলেন।
ঠিক বলেছেন স্যার। আমি পরের জনকে ওপরে পৌঁছে দেবার আগে আপনি বেরিয়ে যান। তিনি হলেন মি. ব্লাস্ট। মস্ত ধনী চমৎকার একটা দামি গাড়ি চড়ে এসেছিলেন তিনি। রোলস গাড়ি। আপনি চলে যাবার পর একজন মহিলাকে ভেতরে নিয়ে আসি। নাম তার বারি সীল মনে হয়। এরপর আমার খাবারের সময় হয়েছিল। তাই আমি খেতে রান্না ঘরে চলে যাই। খেয়ে নিচে আসতেই বেল বাজার শব্দ পাই। সেটা ছিল মি. রেইলির বেল। আমি তড়িৎগতিতে উপরে উঠে আসি। কিন্তু আমেরিকান ভদ্রলোককে খুঁজে পাইনি। ততক্ষণে তিনি চলে গেছেন। হয়তো রাগ করেই তিনি চলে গিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি মি. রেইলিকে জানালাম। তিনি রাগে বক বক করতে লাগলেন। এটাই তার স্বভাব, একজন পেশেন্টকেও তিনি হাত ছাড়া করতে চান না। অমনি মেজাজ তাঁর গরম হয়ে যাবে।
পোয়ারো বিরক্ত হয়ে বললেন–অত ব্যাখ্যা করতে হবে না। তুমি বলে যাও। অ্যালফ্রেড মাথা চুলকে বলল–স্যার একটু ভেবে নিই। এরপর কি হয়েছিল ঠিক মনে পড়ছে না। কিছুক্ষণ পর আবার সে বলতে শুরু করল। া হা মনে পড়েছে। মি. মর্লের বেল বাজতেই আমি মিস সীলকে ডাকতে গেলাম। তখনই দেখতে পেলাম সেই ভদ্রলোক যিনি রোলস চড়ে এসেছিলেন, তিনি চলে যাচ্ছেন। তারপর আমি মিস সীলকে মি. মর্লের ঘরে পৌঁছে দিলাম। এরপর দু’জন ভদ্রলোক এসেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন বেঁটে। চির্চি করে কথা বলছিলেন। নামটা এখন আর মনে নেই। তিনি মি. রেইলির পেশেন্ট। আর একজন স্থুলকায়, তিনি এসেছিলেন মি. মর্লেকে দেখাতে।
মিস সীল অবশ্য বেশি সময় নষ্ট করেননি। কিছুক্ষণ পরেই তিনি মি. মর্লের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাকে বাইরের দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে আমি চলে আসি। সেই বিদেশী ভদ্রলোককে মি. মর্লের কাছে এবং দ্বিতীয় জনকে মি. রেইলির ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম যথা সময়।
জ্যাপ প্রশ্ন করলেন–তুমি সেই বিদেশী ভদ্রলোক অর্থাৎ মি. অ্যামবেরিওটিসকে চলে যেতে দেখোনি?
না স্যার, আমি ওই দুজনের কাউকেই বেরিয়ে যেতে দেখিনি। মনে হয় তারা নিজেই চলে গিয়েছিলেন।
বেলা বারোটার পর তুমি কোথায় ছিলে?
না স্যার, আমি কোথাও যায়নি। যতক্ষণ না দু’জায়গার কোথাও বেল বাজা বন্ধ হয় ততক্ষণ আমি এলিভেটরেই বসে থাকি।
পোয়ারো রসিকতা করে বললেন আমার মনে হয় তুমি সেই সময় বই পড়ছিলে, ঠিক না?
এ কথায় অ্যালফ্রেডের মুখ লাল হয়ে উঠল। সে বলল–হ্যাঁ, স্যার, কোনো কাজ না থাকলে আমি বই পড়ি। কেন স্যার, কোনো অন্যায় হয়েছে?
না, না–তুমি কোনো অন্যায় করোনি, যে বই পড়ছিলে তার নাম কি?
অদ্ভুত মজার নাম স্যার ‘পৌনে বারোটায় খুন’। একটা আমেরিকান গোয়েন্দার গল্প। ভালো গল্প স্যার, শুধু বন্দুকের লড়াই। একেবারে বন্দুকবাজদের গল্প।
পোয়ারোর ঠোঁটের কোণে হাসি। তিনি বললেন–তুমি যেখানে বসেছিলে সেখান থেকে বাইরের দরজার বেলের শব্দ শুনতে পাও?
না–স্যার শুনতে পেতাম না। কারণ এলিভেটরটা হল ঘরের পেছনে।
এবার জ্যাপ প্রশ্ন করলেন আর কে ডাক্তার দেখাতে বাকি ছিলেন?
অ্যালফ্রেডের ভ্রু-যুগল কুঁচকালো। মিনিট কয়েক ভাবল। তারপর মনে পড়ে যেতে বলল, ওহ, মনে পড়েছে। মিস সার্ডিই শেষে মর্লের ঘণ্টা ধ্বনির অপেক্ষায় আছি। কিন্তু তিনি ঘন্টা বাজাননি। মিস সার্ডি অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। তিনি অধৈর্য হয়ে গজ গজ করছিলেন।
মি. মর্লে পরের রোগীর জন্য প্রস্তুত কিনা তা জানার আগ্রহ তোমার হয়নি? দেরি হচ্ছে বলে তুমিও একবার দেখে আসতে পারতে।
অ্যালফ্রেড জোরে জোরে মাথা নাড়ল। না–তা কখনোই সম্ভব নয়, স্যার আমি মনে করেছিলাম শেষ যিনি গেছেন তার কাজ তখনও শেষ হয়নি তাই ঘণ্টাও বাজেনি। তবে এটা সত্যি আমি আগে যদি বুঝতে পারতাম যে মি. মর্লে নিজেকে ওভাবে শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাহলে তার সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা, এর আগে কখনো রোগী নেমে আসার আগেই ঘণ্টা বেজেছিল? অ্যালফ্রেড জবাব দিল–এ্যা, স্যার এরকম মাঝেমধ্যে হয়। বেশিরভাগ সময় রোগী নেমে আসার কয়েক মিনিট পরেই স্যার ঘন্টা বাজাতেন। যদি তার তাড়া থাকে তাহলে তিনি রোগীরা তার ঘর ছাড়ামাত্রই ঘন্টা বাজাতেন।
বুঝতে পারছি, অ্যালফ্রেড আর একটি প্রশ্নের উত্তর দাও তো তুমি কি মি. মর্লের আত্মহত্যার পিছনে আশ্চর্য কিছু দেখতে পাচ্ছ?
অ্যালফ্রেড চোখ বড়ো বড়ো করে বলল–মি. মর্লে কারো হাতে খুন হননি তো স্যার?
ধর, তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি কি খুব অবাক হবে? তা আমি বলতে পারব, না স্যার। কে যে মি. মর্লেকে মারতে চাইবে? কি তার উদ্দেশ্য? আমার যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তার মতো একজন ভদ্র অমায়িক মানুষ কার শত্রু হতে পারেন?
পোয়ারো ভারিক্কি গলায় বললেন–প্রতিটি সম্ভাবনাই আমরা অনুসন্ধান করব। তুমি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। তোমার ওপর নির্ভর করছে এই কেসটা। তুমি মনে করে দেখো সকাল থেকে যা যা ঘটেছে তা সবটাই বলেছ, কিছু বাদ পড়েনি।
না–স্যার, আর কিছু মনে পড়ছে না। কোনো কথা গোপন করিনি স্যার।
বুঝলাম, তোমার কথার সূত্র ধরেই বলছি–বাড়িতে রোগীরা ছাড়া আর কেউই আসেনি আজ সকালে?
কোনো অচেনা লোক আসেনি স্যার। হা একজন যুবক এসেছিল। সে মিস নেভিলের প্রেমিক। আজ নেভিল এখানে আসেনি, তা জানতে পেরে সে খুব রাগারাগি করছিল।
জ্যাপ বললেন–যুবকটি কখন এসেছিলেন?
অ্যালফ্রেড ভ্রু-কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করল। বলল–বারোটার কিছু পরে হবে। মিস নেভিলকে না পেয়ে মি. মর্লের অপেক্ষায় ছিল। আমি তাকে ব্যাজার মুখে পায়চারি করতে দেখে বললাম স্যার খুব ব্যস্ত, লাঞ্চের আগে তাকে পাওয়া যাবে না। শুনে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, এতে কিছু যায় আসে না, তাঁর সঙ্গে দেখা আমাকে করতেই হবে।
পোয়ারো জানতে চাইলেন সে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল?
অ্যালফ্রেড ভয়ার্ত স্বরে বলল–ওই, সেটা তো ভুলে গেছি। পরে ওয়েটিং রুমে তাকে আমি দেখিনি। হয়তো অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে সে চলে গিয়েছিল। ভেবেছিল পরে আরেকদিন আসবে।
অ্যালফ্রেডকে বিদায় দিয়ে জ্যাপ তীক্ষ্ণস্বরে বললেন ছেলেটাকে খুনের কথা বলা আমাদের কি উচিত হয়েছে? ও বাইরের লোকের কাছে এই কাহিনি প্রচার করে দেবে।
পোয়ারো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–প্রিয় জ্যাপ, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার ধারণা ছেলেটি তা করবে না। ও গোয়েন্দা কাহিনি পড়ে, সে অপরাধ নিয়ে ভাবে ওর যা মনে পড়বে না এবার সেই সব অপরাধমূলক বিষয়গুলি স্মৃতির ভান্ডার থেকে বের করে আনবে।
হুঁ, মনে হচ্ছে আপনিই ঠিক পথে এগোচ্ছেন। এবার যাওয়া যাক রেইলির চেম্বারে। মি. রেইলির চেম্বার দোতলায়, পাশেই সার্জারি রুম, এই ঘরদুটি মি. মর্লের ঘরের তুলনায় বড়ো। তবে আলো খুবই কম। আর আসবাবপত্রের আধিক্য নেই বললেই চলে।
মি. রেইলির রঙ কিছুটা কালো, মি. মর্লের চেয়ে বয়সে ছোটো, ঘন এক মাথা কালো চুল অবিন্যস্ত হয়ে কপালে এসে পড়েছে। সুমধুর কণ্ঠস্বর, দুচোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
পোয়ারো ও জ্যাপ মি. রেইলিকে নিজেদের পরিচয় দিলেন। এবার জ্যাপ বললেন মি. রেইলি, আপনি নিশ্চয় আপনার অংশীদারের আত্মহত্যার ঘটনাটা শুনেছেন। আর আমরা আশা করি, এ বিষয়ে আপনি আমাদের আশার আলো দেখাতে পারতেন।
মি. রেইলি জবাব দিলেন–দুঃখিত, আপনারা ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি আপনাদের এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারব না। শুধু একটা কথা বলতে পারি, হেনরি মর্লে কখনোই এমন অবিবেচকের মতো কাজ করতে পারে না। কাজটা করা আমার ক্ষেত্রে যতটা বিশ্বাস যোগ্যের, তারপক্ষে তা নয়। কারণ নিজের জীবন শেষ করে দেবার মানসিকতাই তাঁর ছিল না।
পোয়ারো জানতে চাইলেন, কেন আপনি একথা বলছেন, মি. রেইলি? কারণ আমার পাহাড় প্রমাণ দেনা, নানা সমস্যায় আমি জর্জরিত। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমি একেবারেই চলতে পারি না, কিন্তু মলে সর্বদা সতর্ক থাকনে। অনুসন্ধান করলে দেখবেন তার কোনো ঋণ নেই বা কোনো সমস্যাও ছিল না। এটা আমি হলপ করে বলতে পারি, মি. রেইলি দৃঢ়তার সঙ্গে বলে গেলেন।
জ্যাপ বললেন, প্রণয় ঘটিত কোনো সমস্যা ছিল না?
এই কথার উত্তরে মি. রেইলি দরাজ গলায় হেসে বললেন, মি. মর্লে করবে প্রেম? পাগল নাকি? ওর জীবনে আনন্দ বলে কিছু ছিল নাকি কখনো। ও তো ওর দিদির হাতের পুতুল। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মতো তার মনই ছিল না।
এরপর জ্যাপ আজ সকালে দেখা রোগীদের সম্বন্ধে জানতে চাইলেন, মি. রেইলির কাছে।
প্রথমেই আসে ভারী মিষ্টি দেখতে একটি ছোট্ট মেয়ে। নাম বেটি হিথ। ওর পরিবারের লোকেরা আমার বহুদিনের পরিচিত। ওদের চিকিৎসা আমি করে থাকি, এরপর আসেন সৈনিক পুরুষটি। কর্নেল অ্যাবারোক্রম্ব। তিনিও আমার বহুদিনের পুরোনো রোগী। এরপর একে একে আসেন মি. হাওয়ার্ড রেইকম ও বার্নেস।
জ্যাপ প্রশ্ন করলেন, মি. হাওয়ার্ড কে?
মি. হাওয়ার্ড সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তিনি এর আগে কখনোও আমার কাছে আসেননি। তিনি আজ সকালে টেলিফোন করেছিলেন। আমাকে দেখানোর জন্য আসতে চেয়েছিলেন।
তার ঠিকানা?
হাবনি প্যালেস হোটেল। তার কথা শুনে বুঝলাম তিনি আমেরিকার অধিবাসী। হ্যাঁ, অ্যালফ্রেডও তাই বলেছিল।
অ্যালফ্রেড ভালো জানতে পারে, কেননা ও ভীষণ সিনেমা দেখে।
বার্নেস? উনি কোথায় থাকেন? বেঁটেখাটো একজন মানুষ, মজার মজার কথা বলে লোককে হাসাতে পারে তিনি আগে সরকারি কর্মচারী ছিলেন। ইদানীং অবসর নিয়েছেন। ইলিং-এ থাকেন।
আর মিস নেভিল? তার সম্পর্কে আপনার মত কি? জ্যাপের মুখে হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল।
গোল গোল চোখ করে মি. রেইলি বললেন মি. মর্লের সুন্দরী সেক্রেটারির কথা বলছেন? যার সোনালি রঙের একগুচ্ছ চুল। না, না, ওকে নিয়ে হেনরির কোনো দুর্বলতা নেই। সেদিক দিয়ে হেনরির মন পরিষ্কার ও পবিত্র। একজন মালিক কর্মচারীর নির্ভেজাল সম্পর্ক ওদের। এ বিষয়ে আমি একশো ভাগ নিশ্চিত।
জ্যাপ এই ধরণের রসিকতা একদম বরদাস্ত করতে পারলেন না। তিনি বললেন–আমি এভাবে বলতে চাইনি মি. রেইলি।
রেইলি বললেন–পরে হয়তো, আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে। ক্ষমা চাইছি। আমি ভেবেছিলাম প্রেমঘটিত ব্যাপারে টাকাকড়ির বিষয়টা বেশি থাকে। সেটাই জানার উদ্দেশ্য ছিল আপনার। আপনাদের ভাষাতে কথা বলার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত, মি. জ্যাপ।
জ্যাপ বা পোয়ারো কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না। মিনিট কয়েক পরে জ্যাপ প্রশ্ন করলেন মিস নেভিল যে ছেলেটিকে বিয়ে করার অঙ্গীকার করেছিলেন তার সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?
ছেলেটির নাম ফ্রাঙ্ক কার্টার। মর্লে ওকে ভালো চোখে দেখত না। ও মিস নেভিলকে ওই তরুণের সংস্রব ত্যাগ করতে বলেছিল। এতে কার্টারের প্রতিক্রিয়া কিরূপ ছিল? স্বাভাবিক কারণেই বিরূপ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। একটু থামলেন রেইলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জ্যাপ ও পোয়ারোকে নিরীক্ষণ করলেন তিনি। আবার বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করেছে ধরে নিয়ে তদন্তে এগোচ্ছেন, খুন নয় তো?
জ্যাপ বললেন, যদি মি. মর্লেকে খুন করা হয়, তাহলে সাহায্য করতে আপনি রাজি আছেন? রেইলি তীব্র স্বরে বললেন, না, আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। জর্জিনা পারবে আপনাকে সাহায্য করতে ও বুদ্ধিমতী, শান্ত স্বভাবের মানুষ। তবে সুযোগ পেলে নীতিকথা শুনিয়েও দেয় ও। তবে আমি সবার অলক্ষ্যে দোতলায় গিয়ে হেনরিকে গুলি করে খুন করতে পারতাম। আসলে কে এই গোবেচারাকে খুন করতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে। তবে সে যে নিজে গুলি করে আত্মঘাতী হবে তাও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। ওর এইরকম আচরণে আমি সত্যিই দুঃখ পেয়েছি। আমার কথায় অন্য মানে করবেন না দয়া করে। আসলে আমাদের দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ওর অভাব আমি কোনোদিনই পূরণ করতে পারব না। রেইলির শেষের কথাগুলোতে বিষাদের সুর ছিল।
স্যাভয় হোটেলে মি. অ্যামবেরিওটিসের রুমের টেলিফোনটা বেজে উঠল। তিনি রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল আমি চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ বলছি। আপনি কি মি. অ্যামবেরিওটিস?
মি. অ্যামবেরিওটিস সন্দিহান হয়ে বললেন, কি ব্যাপার?
জ্যাপ বললেন, মি. মর্লের মৃত্যু বিষয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই?
দুঃখিত মি. জ্যাপ আজ আমার শরীর খারাপ আজ কারো সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে নেই আমার। কথাটা শেষ করেই গম্ভীর মুখে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন তিনি।
এদিকে জ্যাপের মুখে কালো মেঘের আনাগোনা। তিনি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, আমার সঙ্গে দেখা করতেই হবে তাকে। তাকে আমি কিছুতেই পালাতে দেবো না। যে করেই হোক তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মি. পোয়ারো আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ও আমাদের জালে ধরা পড়বেই। আমার একজন অনুচর আছে স্যাভয় হোটেলে। তাকে সব নির্দেশ দেওয়া আছে। সে সর্বদা তাকে অনুসরণ করবে।
পোয়ারো স্মিত হেসে বললেন, আপনি মি. অ্যামবেরিওটিসকে মি. মর্লের খুনি ভাবছেন কি? তিনি মর্লেকে গুলি করে পালিয়েছেন।
তা নয়। তবে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখতে পারছি না। কেন না তিনিই মর্লেকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখেছিলেন। তাছাড়া তিনি সেদিনই প্রথম তাকে দেখাতে এসেছিলেন। ওর কথা অনুযায়ী তিনি মর্লের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বারোটা পঁচিশে। তিনি তখন মর্লের হাবভাবে সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করেননি। আর তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিলেন। কথাটা যদি সত্যি হয় তাহলে অন্য কথা ভাবতে হবে আমাদের। ঘটনার স্রোত কোন দিকে গেছে তার খোঁজখবর নিতে হবে। পরবর্তী রোগীর জন্যে তখন তার হাতে পাঁচ মিনিট সময় ছিল। তাহলে ওই পাঁচ মিনিটের ফাঁকে কেউ কি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল? কে হতে পারে? রেইলি না কার্টার? এইটুকু সময়ের মধ্যে নিশ্চয় জীবিত ছিলেন না–তাহলে পরের রোগীদের জন্যে বেল বাজাতেন তিনি। অথবা আর রোগী দেখবেন না বলে মেসেজ পাঠাতেন। হয় তিনি তখন খুন হয়েছিলেন, কিংবা কেউ তাকে কিছু কথা বলে উত্তেজিত করেছিল। যার ফলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজেকে শেষ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একনিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে জ্যাপ দম নেবার জন্য থামলেন।
দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে কাটালেন। আবার জ্যাপ বলতে শুরু করলেন, ঘটনার গতি প্রকৃতি কোন দিকে গড়িয়েছে তা জানার জন্য আমি মর্লের সব রোগীদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। আমার স্থির বিশ্বাস কেউ না কেউ সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারবে। হয়তো মলে তাদের কাউকে কিছু বলে থাকতে পারেন।
জ্যাপ ঘড়ি দেখলেন। বললেন–মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট সওয়া চারটের সময় দেখা করতে বলেছেন। চলুন আমরা প্রথমেই তার কাছে যাই। তারপর সাক্ষাৎ করব সেমস বারি সীল-এর সাথে। এরপর যাব গ্রীক বন্ধু অ্যামবোরিওটিসের কাছে। ওর কাছে যাবার আগে আমাদের খুঁটিনাটি সবকিছু জানতে হবে। সবশেষে আপনার ভাষায় খুনির মতো চেহারা ওই আমেরিকানের সাক্ষাৎ প্রার্থী হবো।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
জ্যাপ আবার বললেন–তাছাড়া আমার মিস নেভিল ও তার তরুণ বন্ধুর সম্পর্কেও আরও ভালোভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিশ্চয়ই আমরা একটা সমাধান সূত্রে পৌঁছতে পারব।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট, যিনি কখনোই প্রচারের আলোয় আসেননি। তিনি অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ। তিনি একাকী জীবন কাটাতে অভ্যস্ত। তাই তিনি রাজা না হয়েও রাজপরিবারের সদস্য হিসেবেই জীবন কাটিয়েছেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের স্ত্রী রেবেল ম্যানসেভেরেটো। তাকে লোকে আর্মহোল্ট নামেও চেনে। তিনি লন্ডনে প্রথম আসেন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে। অর্থের অভাব নেই। প্রচুর সম্পত্তি, টাকাপয়সা পেয়েছিলেন তিনি বাবা ও মায়ের থেকে। রেবেলের মা ইউরোপীয়ান। তিনি রোদারস্টাইন পরিবারে জন্মান। তাঁর বাবা আমেরিকার সুপ্রসিদ্ধ ব্যাঙ্কার। আমেরিকার সন্তান রোবেল আর্নহোল্টের দুই ভাই। তারা বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর ওই পরিবারের বিপুল সম্পত্তির একচ্ছত্র দাবিদার হন তিনি। ইউরোপের এক বিখ্যাত ব্যক্তি দ্য ম্যানসেভেরেটোর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, অবশ্য সে বিয়ে স্থায়ী হয়নি। তিন বছর পরে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। একমাত্র মেয়ে ও বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া অর্থ নিয়ে তিনি চলে আসেন, এক শয়তানের প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়েন তিনি। লোকটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দু’বছর পর চলে আসতে বাধ্য হন তিনি। কয়েক বছর পর তিনি মেয়েটিকেও হারালেন। সে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করলেন। তার সমস্ত অর্থ ও মস্তিষ্ক পিতার ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় লাগালেন।
ইত্যবসরে রোবেলের পিতার মৃত্যু হয়। তিনি অর্থনৈতিক জগতে এক ধনী মহিলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তার প্রতিভা ও ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। লন্ডনে আসার পর আলাপ হয় অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের সঙ্গে। তখন মি. ব্লাস্ট লন্ডন হাউসের একজন জুনিয়ার অংশীদার ছিলেন। তিনি কিছু কাগজপত্রসহ দেখা করতে এসেছিলেন রোবেলের সঙ্গে। ইতিমধ্যে দুছ-ছটি মাস কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন সারা লন্ডনের মানুষ জানতে পারল রেবেল ম্যামসেভেরেটো অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে বিয়ে করছেন। আরও বেশি মুগ্ধ হন সবাই এই কথা শুড় ব্লাস্টের থেকে তিনি প্রায় কুড়ি বছরের বড়।
যথারীতি এ খবর সকলের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। রোবেলের বন্ধুরা বলাবলি করতে লাগল, রোবেল অত্যন্ত মুখ, সে এখনও পুরুষ চিনতে শেখেনি। ব্লাস্ট ওকে টাকার লোভে বিয়ে করেছে। আবার একটা চরম আঘাত না পেলে ওর শিক্ষা হবে না।
আবার অনেকের অনুমান ব্লাস্ট রোবেলের টাকাপয়সা অন্য নারীর পেছনে খরচ করবে। সকলের ভবিষ্যৎ বাণী বৃথা হয়েছিল। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখেই কেটেছিল। ব্লাস্ট স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। স্ত্রীর প্রতি অনুরাগের ঘাটতি ছিল না। রেবেলের মৃত্যুর পর তার বিপুল ঐশ্চর্য সযত্নে রক্ষা করে চলেছেন। কোনো ভাবেই নষ্ট হতে দেননি। অথবা তিনি রোবেলকে ভুলে আরেকজনকে বিয়েও করেননি। এত অর্থকড়ি হাতে পেয়েও তিনি উচ্চুঙ্খল জীবন যাপন করেননি। অর্থনৈতিক বিষয়টা তিনি ভালোই বুঝতেন। বিচারবুদ্ধি ও কার্য ক্ষমতায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্লাস্ট আমহোস্ট ও রোদারস্টাই নের বিশাল সম্পদ দক্ষতা ও নিপুন হাতে বজায় রেখেছেন। তাই তিনি এত সুনাম অর্জন করেছেন।
ভেল্টে ও নরফোকে বাড়ি ছিল। সেখানে তিনি ছুটির দিনগুলি কাটাতেন। তিনি হৈ চৈ বেশি পছন্দ করতেন না। কারো সঙ্গে বেশি মেলামেশাও করনে না। তার গুটিকয়েক বন্ধু ছিল। তিনি অল্প খেলতে ভালোবাসতেন। এছাড়া বাগান পরিচর্যার কাজেও তিনি সমান দক্ষা ছিলেন। এমনই একজন ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চলেছেন দু’জনে চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ এরকুল পোয়ারো।
তারা একটি ট্যাক্সিতে চড়ে এসে হাজির হলেন বেলমির সাগরবেলায়। তীরবর্তী বিশাল প্রাসাদটি সত্যিই মনোরম নয়নাভিরাম। এর ভেতর সহজসরল হলে কি হবে প্রাচুর্যের অভাব নেই এখানে। হয়তো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি কিন্তু খুবই আরামপ্রদ খুবই জনপ্রিয় এই প্রাসাদটি।
তারা প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই মি. ব্লাস্ট এসে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করলেন।
জ্যাপ ও পোয়ারোর পরিচয় পর্ব শেষ হলে ব্লাস্ট বললেন, মি. পোয়ারো, আপনার নামের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছে। তবে কোথায় যেন আপনাকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছি, ঠিক মনে পড়ছে না। পোয়ারো হেসে উত্তর দিলেন, আজ সকালেই আমাকে দেখেছেন, মঁসিয়ে। দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের ওয়েটিং রুমে। এবার মনে পড়ছে? ব্লাস্টের মুখেও হাসি ফুটেছে। তিনি বললেন, তাইতো, আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। দেখেছি দেখেছি মনে করতে পারছিলাম না। জ্যাপের দিকে নজর পড়ল তার। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি মি. জ্যাপ। মর্লের ব্যাপারে আমি শোকাতুর।
জ্যাপ বললেন, আপনি কি এরকম দুঃসংবাদ আশা করেননি? মি. ব্লাস্ট?
একদম না, অবশ্য ড. মর্লের সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। আহাম্মকের মতো নিজের গুলিতে শেষ হবার মানুষতো তিনি নন। অন্তত যেটুকু সময় আমি তাকে দেখেছি তাতে ভাবা যায় না; যমন ঘটনাও ঘটাতে পারেন তিনি। আজ সকালে তাকে কেমন দেখেছিলেন? বেশ হাসিখুশি, খোলা মেজাজেই ছিলেন, অবশ্য ডাক্তারের চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গেই আমার শরীরে কাঁপন জেগেছিল। তাছাড়া ওই বিশ্রী ড্রিল চালানো। ওটা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই পারিপাশ্বিক কিছু লক্ষ্য করিনি। তবে কাজ শেষ হবার পর তার বেশ স্বচ্ছন্দ্য বোধ হয়েছিল।
আপনি এর আগেও কি মর্লের কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তিন-চারবার গিয়েছিলাম। আসলে গত বছর থেকে আমি দাঁতের যন্ত্রণায় ভুগছি। কার মারফত আপনি তার কাছে গিয়েছিলেন, পোয়ারো প্রশ্ন করলেন। ভাববার জন্য সময় নিলেন মি. ব্লাস্ট। বিড় বিড় করে বললেন, আমার দাঁত ভেঙে যাওয়ায় আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। তখন কে যেন কুইন শার্ট স্ট্রিটের ঠিকানা দিয়েছিল? কে বলেছিল মি. মর্লের কাছে যেতে? দুঃখিত, আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
পোয়ারো তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, বেশ, মনে পড়লে আমাদের জানাতে দ্বিধা করবেন না। অবশ্যই। এটা কি গুরুত্বপূর্ণ কোনো সূত্র? ব্লাস্ট অবাক হয়ে বললেন। হলেও হতে পারে। আমরা সবকিছু গুরুত্ব সহকারে দেখছি, পোয়ারো বললেন। কোথায় কি লুকিয়ে আছে বলা মুশকিল। ব্লাস্টের কাছে বিদায় নিয়ে জ্যাপ ও পোয়ারো প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রাসাদের সামনে দাঁড়ানো একটি গাড়ি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অদ্ভুত ধরনের স্পোর্টিং গাড়ি।
একটি অল্প বয়সি তরুণী সেই গাড়ি থেকে নেমে এল। সে চোখ তুলতেই তিন জোড়া চোখের দৃষ্টি বিনিময় হল। তারপরেই মেয়েটি চেঁচিয়ে বলল–এই যে শুনছেন? একটু শুনুন না? দুজনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাদের দুজনের চোখে জিজ্ঞাসা, মেয়েটি এগিয়ে এল। মেয়েটি কৃশকায়, দীর্ঘাঙ্গী। হাত-পায়ে একটা অবিনত্ব আছে। গায়ের ত্বক কিছুটা তাকাটে। জীবনী শক্তিতে ভরপুর। তাই কুশ্রী চেহারা চাপা পড়ে গেছে। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, আপনাকে আমি চিনি–আপনি সেই রহস্য সন্ধানী এরকুল পোয়ারো। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হল।
পোয়ারো বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আপনি ঠিক ধরেছেন, মাদামোয়াজেল। আমিই সেই অধম। আর ইনি চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ। পোয়ারো জ্যাপের পরিচয় দিলেন। তরুণীর নেত্রযুগল ভয়ে বিস্ফারিত হল। সে রুদ্ধশ্বাসে বলল, আপনারা এখানে? আমার কাকার কি কিছু হয়েছে? মেয়েটির কথায় মার্কিনী টান আছে। পোয়ারো আবার প্রশ্ন করলেন, আপনার একথা মনে হওয়ার কারণ কি, মাদামোয়াজেল? মেয়েটি পোয়ারোর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ওঃ বাঁচা গেল। কাকা সুস্থই আছেন। জ্যাপ পোয়ারোর প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করলেন। আপনি কি আশা করেছিলেন, মি. ব্লাস্টের কোনো অঘটন হবে? মেয়েটি এবার নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি জেন অলিভেরা। এটা আমার কাকার বাড়ি। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট আমার কাকা হন। বাড়িতে গোয়েন্দার উপস্থিতি মনে তো ভয়ের উদ্বেক করবেই স্যার। মি. ব্লাস্টার সম্পূর্ণ সুস্থ ও বহাল তবিয়তে আছেন। আমরা এসেছিলাম অন্য কাজে। আজ সকালে কুইন শার্ট স্ট্রিটে একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সে ব্যাপারে মি. ব্লাস্ট কিছু জানেন কিনা জানতে, মিস অলিভেরা।
জেন চিৎকার করে জানতে চাইল, কে করেছে আত্মহত্যা? কেন করেছে? মি. মর্লে নামে এক দন্তচিকিৎসক। কেন করেছেন সেটা এখন বলা যাবে না। জেন অলিভেরা চিন্তাক্লিষ্ট কণ্ঠে বলল, ওহ! জ্যাপ বললেন, অদ্ভুত মহিলা তো। বাদ দিন ওসব কথা, এবার যাওয়া হবে সেইনসবারি সীলের আস্তানায় তারপর আমাদের গন্তব্য হবে স্যাভয় হোটেল। প্লেনগেরি কোর্ট হোটেল। স্বপ্নলোকিত লাউঞ্জ। কথা ছিল মিস সেইনসবারি সীল এখানে থাকবেন। জ্যাপ ও পোয়ারা হোটেলের ভেতরে ঢুকতেই দৃষ্টি গোচরে হলেন। চেয়ারে বসে চা পান করছিলেন। তাদের দুজনকে মিস সীল আগে থেকেই চিনতেন। তাই সাদা পোশাকে ওদের দুজনকে আসতে দেখে তিনি একটু সচকিত হলেন। জ্যাপ ও পোয়ারো তার সামনে যেতে তিনি বললেন, অফিসার, কথা বলার মতো নিরাপদ জায়গা এটা নয়। আপনারা কি চা পান করবেন? জ্যাপ হাত তুলে বললেন, আমি নই, মাদাম, ধন্যবাদ।
মিস সীল বললেন, ঠিক আছে। চলুন ড্রয়িংরুমে। একটা কোণ দেখে বসা যাবে। কথাটা শেষ করেই মিস সীল ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। জ্যাপ ও পোয়ারো তাকে অনুসরণ করলেন। কোণের দিকে দুটি সোফা তাদের নজরে পড়ল তারা সেখানে গিয়ে বসলেন। মিস সীল বলতে লাগলেন, তাহলে ইন্সপেক্টর-না, না চিফ ইন্সপেক্টর ঘটনাটা খুবই মনস্তিক তাই না? বেচারা মি. মর্লে। তিনি কি অবসাদগ্রস্ত মানসিক রোগী ছিলেন? আপনি কি তার মধ্যে কোনোরকম পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন, মিস সীল? মিস সীল চুল ঠিক করতে করতে বললেন, মানে–আমি ঠিক লক্ষ্য করিনি, তবে দেখে মনে হয়েছিল ভালই আছেন তিনি। তাছাড়া আমি ভীষণ ভীতু।
আপনি একটু মনে করে বলুন তো, সে সময় ওয়েটিং রুমে কাকে কাকে দেখেছিলেন? আমাকে একটু ভাবতে দিন–আমার যাওয়ার আগে এক তরুণ সেখানে বসেছিল। বসে থাকতে থাকতে সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। তারপর হঠাৎ সে লাফ দিয়ে চলে গেল। তখন আমার মনে হয়েছিল সে দাঁতের যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পাচ্ছিল।
সে যে ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল সেটা কি জানেন? না, সেটা জানি না। তবে আমার অনুমান ডাক্তার দেখতে না পেয়েই ও চলে যায়। তখন মি. মর্লের ওকে ডাকার কথা নয়। সে সময়টা আমাকে দেওয়া হয়েছিল। তাই তার চাকর আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার দেখিয়ে বেরিয়ে আসার সময় কি আপনি আবার ওয়েটিং রুমে গিয়েছিলেন মিস সীল?
না। আমার টুপি ব্যাগ সঙ্গে নিয়েই মি. মূর্লের ঘরে গিয়েছিলাম। এইরকম একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল আমার বন্ধুর যে বেচারার নতুন টুপির ওপর একটা বাচ্চা বসে পড়েছিল। আর তাতেই টুপিটা চ্যাপ্টা হয়ে গিয়ে বিশ্রী দেখতে হয়েছিল। সেই থেকে আমি কখনো টুপি হাতছাড়া করি না।
পোয়ারো নরম সুরে বললেন, খুবই দুঃখের। মিস সীল আবার বললেন, এর জন্য কিন্তু ওই বাচ্চাটির মা দায়ী। কারণ বাচ্চাকে নজরে রাখা তার কর্তব্য। জ্যাপ বললেন, তাহলে আপনি বলছেন, ওই ঘরে একমাত্র ওই যুবকই ছিলেন? না, না, আর একজনকে দেখেছিলাম। মি. মর্লের ঘরে যখন আমার ডাক পড়েনি তখন এক বিদেশী ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে পোয়ারো বলে উঠলেন, ওই ভদ্রলোকটি আমি, মাদাম। ওহ মাপ করবেন, সেই সময় আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি। ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি। ড. মলের মুখে অ্যামবেরিওটিস নামে কোনো রোগীর কথা শুনেছিলেন কি? না, না, দাঁতের ডাক্তারেরা যে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলে থাকেন তিনিও তাই বলেছিলেন। পোয়ারোর স্মরণ এল কতগুলো কথা যা মি.মর্লে বলে থাকেন। মুখ খুলুন…………কুলকুচো করুন……..এবার আস্তে আস্তে মুখ বন্ধ করুন বেশি কথা বলবেন না……..।
জ্যাপ মিস সীলকে ইনকোয়েস্ট সাক্ষ্য দেবার কথা বলতেই তিনি দেখে বললেন। তার আপনিও দেখে বললেন। তার আপত্তি দেখে জ্যাপ নানাভাবে বোঝালেন। শেষে অনেক কষ্টে তাকে রাজি করাতে সক্ষম হলেন তিনি। জ্যাপ দেখলে মিস সীলের জীবনের নানা কথা জেনে নিলেন। মিস সীল আগে ভারতের বাসিন্দা ছিলেন। মাত্র ছ’মাস আগে ইংল্যান্ডে এসেছেন। নানা হোটেল বদল করে করে শেষে এসে উঠেছেন প্লেনগোরি কোর্টে এখানকার জলহাওয়া তার খুব পছন্দ। ভারতে বেশির ভাগই তিনি কলকাতায় কাটিয়েছেন। সেখানে মিশনের হয়ে কাজকর্ম করতেন। ছোটবেলায় অভিনয় শিখেছিলেন। শেকসপীয়ার বানডি শ র লেখা কাহিনিচিত্রে ছোট ছোট রোলে মঞ্চে অভিনয়ও করেছেন। অনর্গল ইংরাজি লিখতে ও বলতে পারতেন। অপেশাদার নাট্যদল গঠন করেছেন কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছেন। প্রেম করে বিয়ে করেছেন। আবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। একবন্ধুর কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে একটা আবৃত্তির স্কুল তৈরি করেছেন। তিনি তার কিছু কাগজপত্র জ্যাপ ও পোয়ারোকে দেখালেন। মিস সীল উৎসাহিত হয়ে বললেন, যদি সাক্ষ্য দিই তাহলে আমার নাম নিশ্চয়ই সংবাদপত্রে ছাপা হবে? তবে দয়া করে দেখবেন নামের বানানটা যেন ঠিক লেখা হয়। আমার পুরো নাম ম্যাবেল সেইনসবারি সীল। আমি যে কোন এক সময় শেক্সপীয়ারের অ্যাজ ইউ লাইফ ইট-এ অভিনয় করেছি, তা যেন ওরা লেখে। তাহলে আমি ভীষণ খুশি হব………….। ।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, তাই হবে–বলতে বলতে জ্যাপ কোনো রকমে সেখান থেকে পালিয়ে এলেন, এর বিপজ্জনক দিকটাও তার অজানা নয়। জ্যাপ সোজা এসে ট্যাক্সিতে উঠলেন। কপালের ঘাম মুছলেন। তারপর বললেন–ওই মহিলা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া মনে হয় কষ্টের হবে না। যদি সত্যি কথা বলে থাকেন। পোয়ারো মাথা ঝাঁকালেন। চিফ ইন্সপেক্টর আবার বলতে লাগলেন আমার আশঙ্কা ছিল ইনকোয়েস্টের কথায় উনি ভয় পাবেন। সব বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়ে থাকে। উনি অভিনেত্রী বলেই প্রচারের আলোয় আসতে চেয়েছেন। তাই আমাদের কথায় সম্মতি জানিয়েছেন। পোয়ারো বললেন আপনি কি সত্যিই ওকে সন্দেহের তালিকায় রাখলেন? সম্ভবত না। তবে আমি নিশ্চিত এটা আত্মহত্যা নয়, খুন।
যদি তাই হয়, তাহলে মোটিভ কি বুঝতে পারছেন? না, এখনও আন্দাজ করতে পারিনি। নানা কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে একটা হল, কোনো এক সময় মর্লে অ্যামবেরিওটিসের মেয়েকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন? পোয়ারোর মুখে কথা নেই। তিনি কল্পনার মধ্যে প্রত্যক্ষ করলেন মি. মর্লে মদিরক্ষি এক গ্রীক সুন্দরীকে তার প্রেম স্বরে জর্জরিত করছেন। পরমুহূর্তের তার ঘোর কাটল। তিনি জ্যাপকে বললেন, আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন মর্লের অংশীদারের কথা। তিনি বলেছেন মলের জীবনে আনন্দ বলে কিছু ছিল না। জ্যাপ বললেন, দেখি অ্যামবেরিওটিস কোনো আলোর দিশা দিতে পারেন কিনা? ট্যাক্সি এসে থামল স্যাভয় হোটেলের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দুজনে প্রবেশ করলেন হোটেলের ভেতরে। কাছাকাছি। কাউকেই দেখতে পেলেন না তারা। তারা রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলেন। কেরানি গোছের একজন ভদ্রলোককে সেখানে দেখতে পেলেন। তিনি আপন মনে নিজের কাজ করছেন।
জ্যাপ তাকে জিজ্ঞেস করলেন মি. অ্যামবেরিওটিস কত নম্বর ঘরে আছেন? আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। সেই ভদ্রলোক উদাস চোখে তাকিয়ে বললেন, মি. অ্যামবেরিওটিস? দুঃখিত স্যার। তার সঙ্গে দেখা হবে না। জ্যাপ রাগত স্বরে বললেন, কেন হবে না, নিশ্চয়ই হবে। এই বলে তিনি নিজের পরিচয়পত্র দেখালেন। কেরানি ভদ্রলোক বলল, আমার কথার ভুল মনে করেছেন আপনি স্যার। তিনি আর ইহ জগতে নেই। আধ ঘন্টা আগে মারা গেছেন। জ্যাপ হতাশ হয়ে বসে পড়লেন আর পোয়ারোর চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল।
০৩. পাঁচ ছয় কাঠি গোটাকয়
অ্যামবেরিওটিসের মৃত্যুর একদিন পর পোয়ারো জ্যাপের কাছ থেকে ফোন পেলেন জ্যাপ কর্কশ স্বরে বললেন–
মি. পোয়ারো সব ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করুন।
আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মি. জ্যাপ।
আমি বলছি, হেনরি আত্মহত্যাই করেছেন। খুন হননি, মোটিভ খুঁজে পেয়েছি।
-যেমন?
–অ্যামবেরিওটিসের মৃত্যুর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আমার হাতে এসে গেছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত অ্যাড্রিনালিন ও কোকেনের প্রয়োগে তার মৃত্যু হয়েছে। এটা তার হার্টে প্রতিক্রিয়া করেছে। আর তাতেই তিনি মারা যান। গতকাল তিনি তার শরীর খারাপের কথা বলেছিলেন আমাকে। তখন আমি তা আমলই দিইনি। ভেবেছিলাম আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। আপনি জানেন অ্যাড্রিনালিন ও কোকেনের মিশ্রণে ইঞ্জেকশান তৈরি হয়। তাঁর সেই ইঞ্জেকশান দাঁতের ডাক্তাররা মাড়ীতে দিয়ে থাকেন ফলে ওই জায়গাটা অবশ হয়ে যায়। এতে দাঁতের যে কোনো রোগের চিকিৎসা করার সুবিধা হয়। মর্লে ভুল করেছিলেন এবং সেই ভুলটাও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই, বাস্তবের মুখোমুখি যাতে দাঁড়াতে না হয় তিনি নিজেকে গুলি করে শেষে করে দিয়েছেন।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন যে পিস্তল তার নিজের নয় সেটা দিয়ে?
–হয়তো ওটা তার নিজেরই। তার পরিচিত জনদের কাছে তিনি গোপন করেছিলেন। এমন তো কত কথাই অজানা থাকে। পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন–হ্যাঁ, এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। জ্যাপ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন–এই যুক্তিটা আপনি মেনে নিয়েছেন নিশ্চয়ই?
পোয়ারো বললেন–বন্ধু, এটা আমার মনঃপূত হল না। এই ইঞ্জেকশান অনেক রোগীর সহ্য হয় না। অ্যাড্রিনালিনে অনেক প্রতিক্রিয়া হয়। কোকেনের মিশ্রণে তা আরও মারাত্মক হয়। তবে ডাক্তার বা দাঁতের ডাক্তাররা সেজন্য আত্মহত্যা করে না!
অবশ্যই নয়, তবে আপনি যা অকাট্য যুক্তি দেখাচ্ছন তা সাধারণ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে সকলকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় না। রোগীদের শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে মি. মর্লে ওষুধের পরিমাণ বেশি দিয়েছিলেন। অতএব মর্লে নিশ্চিত ভুল করেছিলেন। তবুও বলব এটা ভুলই। এটা অপরাধ নয়।
-না, তা বলছি না। কিন্তু এতে তার পশার কমে যেত। কোনো রোগীই আর তার কাছে ভয়ে আসবে না। হেনরি খুব অনুভূতিপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তাই ভুলটা বুঝতে পেরে নিজেকেই দায়ী করেছেন। বাঁচার অন্য কোনো পথ নেই ভেবেই এহেন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
তবুও পোয়ারো বাধা দিয়ে বললেন–মর্লে কি তাহলে এ সম্পর্কে কিছু লিখে রেখে যেতেন না? অন্তত তার বোনের উদ্দেশ্যে কিছু লিখতে পারনে? জ্যাপ হেসে বললেন, বুঝতে পারছি। আপনি কোনো খুনের ঘটনাকে খুন বলেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। আর এই সন্দেহ আমিই আপনার মাথায় ঢুকিয়েছি, স্বীকার করছি। মনে রাখবেন, এর । অন্য কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে।
–হুঁ, তা থাকতে পারে। আমিও ভেবেছি এ বিষয়ে, তবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপাতদৃষ্টিতে ধরলে মর্লেকে অ্যামবেরিওটিস গুলি করে খুন করেছেন। তারপর তিনি হোটেলে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন অ্যাড্রিনালিন ও কোকেন মিশ্রিত ওষুধ দিয়ে। যা তিনি মর্শের ঘর থেকে চুরি করেছিলেন। যদি আপনি এটা ভেবে থাকেন, তাহলে আমি বলব এ একেবারে অন্যায়। আমি ইয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, গ্রীসে তার একটি ছোট হোটেল ছিল কোনো একসময়। তারপর তিনি রাজনীতিতে আসেন। জার্মানি ও ফ্রান্সে গুপ্তচরবৃত্তি করে বেশ কিছু টাকা কামিয়েছেন। লোককে ব্ল্যাকমেল করতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। গত বছর ভারতে গিয়ে সেখানকার ধনী লোকেদের টাকাপয়সা সম্পত্তি বেদখল করেছিলেন। তিনি একজন দুষ্কৃতি জেনেও প্রমাণের অভাবে তাকে বেশিদিন জেলবন্দী করা যায়নি। এক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটতে পারে। কোনো বিষয় নিয়ে মর্লেকে ব্ল্যাকমেল করতেন। মলেও সুযোগ পেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় তার মাড়িতে ওষুধ দিয়েছিলেন এতে লোকটার কিছু না হলেও মর্শে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তাই অনুশোচনায় নিজেই নিজেকে দায়ী করেছিলেন এই জঘন্য কাজের জন্য। এবং নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে সরে গেছেন। তবে মর্লেকে আমি খুনি বলছি না। ভুলের বশবর্তী হয়ে তিনি এই কাজ করেছেন। আমার মতের সঙ্গে একমত হয়েছে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারও।
পোয়ারো নরম সুরে বললেন–বুঝতে পারছি।
জ্যাপ বললেন–হয়তো আমি আপনাকে হতাশ করেছি। তবুও এবারের মতো আপনি ক্ষমা করে দেবেন, বন্ধু। জ্যাপ ফোন ছেড়ে দিতে পোয়ারো তার প্রিয় টেবিলের সামনে গিয়ে বসলেন। তিনি আধুনিক ডিজাইনের আসবাবপত্র বেশি পছন্দ করতেন। তার টেবিলটিও চমৎকার সাজানো। সেই টেবিলের ওপর একটা চার কোনা কাগজ রাখা ছিল। তাতে মর্লের সব রোগীদের নাম ঠিকানা লেখা ছিল। যেমন–
হাওয়ার্ড রেইকস? এই নামটার পাশে শুধু জিজ্ঞাসা চিহ্ন। নিচে উদ্ধৃতি দেওয়া একটি লাইন। কিন্তু এসে অসম্ভব!??
একটু গ্যাপ রেখে আবার লেখাঃ
অ্যামবেরিওটিস। গুপ্তচরবৃত্তি পেশা। সেই কারণে গতবছর ভারতে যান এবং ইংল্যাণ্ডে এখন এসেছেন। দাঙ্গা বাধাতে ওস্তাদ। এজেন্ট হিসেবে কমিউনিস্টে যোগ দিয়েছিলেন। একটু খালি জায়গার পর লেখাঃ
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার। মর্লের অপছন্দের পাত্র। সম্প্রতি তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু কেন? এরকুল পোয়ারোর মাথার মধ্যে এইসব প্রশ্নের উত্তর পাক খাচ্ছিল। বাইরে জানালার সামনে একটি কাঠ ঠোকরা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করছিল। তিনি ওই কাগজে আরও কিছু লিখলেন : হেনরি মর্লের দন্ত চিকিৎসালয়। অফিস ঘর। কার্পেটের ওপর একটা দাগ। সম্ভাবনাময়।
শেষ লেখাটা নিয়ে তিনি অনেক ভাবনা চিন্তা করলেন। অবশেষে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন এবং টুপি ও ছড়ি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। এরকুল পোয়ারো মেট্রেরেলে চড়ে এলেন ইলিং ব্রডওয়ে স্টেশনে। সেখান থেকে পাড়ি দিলেন তার গন্তব্যে। এসে পৌঁছলেন ৮৮ ক্যাসলগার্ডেনস রোডে। ইতিমধ্যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় পার হয়েছে। বাড়িটা ছোট। সামনে সুদৃশ্য বাগান। পোয়ারো গতোক্তি করলেন, চমৎকার পরিকল্পনা, তারিফ করতেই হবে!
এই চমকপ্রদ বাড়ির মালিক মি. বার্নেস, তিনি তাকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসালেন।
মি. বার্নেস ঘরের ভেতর এলেন, পোয়ারো সন্ধানী চোখে জরিপ করলেন তাঁকে। ছোটখাটো চেহারার মানুষ। কেশবিহীন মাথা। চোখে চশমা। চশমার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে দুটি চোখের তারা। ভদ্রলোকের হাতে রয়েছে তার দেওয়া কার্ডটি।
মি. বার্নেস হাসি মুখে বললেন–আপনিই মঁসিয়ে পোয়ারো? আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
পোয়ারো লজ্জিত হয়ে বললেন–না জানিয়ে হঠাৎ এসে পড়ার জন্য আমি লজ্জিত ও দুঃখিত, মি. বানেস।
না, না, এভাবে বলবেন না। এখন পৌনে সাতটা বাজে। কাউকে বাড়িতে পাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। দয়া করে আপনি বসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। বোধ হয় আপনি ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিট সম্পর্কিত কিছু উত্তর খুঁজতে এখানে এসেছেন? আমি আপনাকে অনেক তথ্য দিতে পারব আশা করি।
পোয়ারো বললেন–আপনার অনুমান সঠিক। তবে আমি যে মি. মর্লের মৃত্যুর কথা বলতে এসেছি তা আপনি বুঝলেন কি করে?
বার্নেস হেসে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি স্বরাষ্ট্র দপ্তরে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলাম। যদিও অতি সম্প্রতি আমি অবসর গ্রহণ করেছি–তবুও আমার বুদ্ধি এখনও ভোতা হয়ে যায়নি। কোনো গোপনীয়তা থাকলে পুলিশের কাছে না গিয়ে গোয়েন্দাদের কাছেই যাওয়া উচিত, ঠিক বলিনি?
পোয়ারা বললেন–এতে গোপনীয়তার কি আছে? ভদ্রলোক চশমা খুলে হাতে রাখলেন। সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বসলেন। বললেন–সিক্রেট সার্ভিসে কেউ চুনো পুঁটির খোঁজ করে না, তাদের খোঁজ নিতে অনেক সময় পুঁটিমাছের দ্বারস্থ হতে হয়।
দেখছি আমার চেয়ে আপনার পারিপার্শ্বিক জ্ঞান অনেক বেশি, মি. বার্নেস। আসলে আমি কিছু জানি না। কেবল দুয়ে দুয়ে চার করার চেষ্টা চালাচ্ছি।
সেই দুইটা কি?
মি. বার্নেস তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিলেন অ্যামবেরিওটিস। আপনি নিশ্চয়ই ভোলেন–নি, মিনিট কয়েকের জন্যে হলেও আমাকে তার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি আমাকে কোনো দিন দেখেননি এবং চেনেন না। কিন্তু আমি ওর সম্পর্কে সবই জানি। তিনি এদেশে কেন এসেছিলেন তাও বলতে পারি।
-কেন? পোয়ারোর ছোট্ট প্রশ্ন।
–এদেশে আমাদের মানুষ হিসেবে অনেকে পছন্দ করেন না। রক্ষণশীলতাই আমাদের ধর্ম। আমরা যতই আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারের সমালোচনা করি না কেন নতুন কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সাহস পাই না। বিদেশীদের এখানেই গাত্রদাহ। তাদের কষ্ট। তারা মনে মনে ভাবে ইংল্যাণ্ডের মতো ধনী দেশ ইউরোপের আর কোথাও নেই। তাই আমাদের দেশকে বিপদে ফেলতে পারলে তাদের আনন্দ হবে। তার জন্য প্রয়োজন ইংল্যাণ্ডের ভিত ধরে নাড়া ও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। কিন্তু কাজটা খুবই কঠিন। কেন না এর শীর্ষ নেতৃত্বে আছেন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের মতো মানুষ।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন মি. বার্নেস। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের চরিত্র এমন যিনি সর্বদা নিজের সীমার মধ্যে বিচরণ করেন। তা তার কাছে যত টাকা থাকুক কেন। অকারণ ব্যয় তিনি পছন্দ করেন না। তাই তার ধারণা দেশের সব মানুষের উচিত তার মতো জীবন যাপন করা। আর সেই কারণেই কেউ কেউ চাইছে মি. ব্লাস্টকে সরিয়ে দিতে।
–আশ্চর্য!
মাথা নেড়ে মি. বার্নেস বললেন–আশ্চর্যই বটে। একদল মানুষ নতুন পৃথিবী গড়ার রঙিন স্বপ্ন দেখছে। কুৎসিত চেহারার, কদাকার মনের একদল মানুষ আছে যারা বিদেশী ভাষায় তর্ক করতে ভালোবাসে। তৃতীয় আরেকদল আছে যারা কেবল কথা বলতে পটু। তবে এদের মধ্যে একটা মতের মিল তা হল ব্লাস্টকে সরে যেতে হবেই।
পোয়ারো মনযোগ সহকারে বার্নেসের কথা শুনছেন। বার্নেস থামতেই বলে উঠলেন, তারপর। বার্নেস পাবার শুরু করলেন–পুরানো নিয়মকানুন ভেঙে ফেলার মূলে আছে টোরি, রক্ষণশীল, পোড় খাওয়া মানুষ ও লোভী ব্যবসাদাররা। হয়তো এরা সবাই ঠিক। আমরাও স্থির বিশ্বাস পুরনো নীতি পাল্টে এমন কিছু করতে হবে–যেটা মানুষের উপকারে লাগবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে বাড়িটা ধ্বংস হয়ে যায়। আর ওই বাড়ির ভিত হচ্ছেন ব্লাস্ট। তাই ওরা চাইছে ব্লাস্টের ক্ষতি করতে। আমি নিশ্চিত জানি গতকাল সকালে ওরা তাকে খতম করার চেষ্টায় ছিল। এ চেষ্টা ওরা এর আগেও করেছিল, পারেনি।
বার্নেস একটু থেমে দম নিলেন। তারপর আবার শুরু করলেন। আমি তিন জনের কথা বলছি। একজন খ্যাতিমান চ্যান্সেলর আর এক্সরে করে দ্বিতীয়জন দূরদশী উৎপাদক এবং তৃতীয়জন উৎসাহী তরুণ রাজনীতিক। অবশ্য আজ এরা কেউই নেই। সবাই মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর পেছনে যাদের হাত ছিল তারা হলেন একজন সার্জন ও অন্যজন ডাক্তার, সার্জেনের ভুল চিকিৎসার জন্য প্রথমজন অপারেশন টেবিলে মারা যান। দ্বিতীয়জন মারা যান ডাক্তারের নির্বুদ্ধিতার কারণে। তৃতীয় জন মারা যান গাড়ি চাপা পড়ে। সেই দোষী সার্জন বর্তমানে একটি গবেষণাগারের মালিক। ডাক্তার অবসর গ্রহণ করে একটি চমৎকার হয়টর গড়ে তুলেছেন। আমরা সবাই জানি প্রত্যেক জীবিকায় লোভের হাতছানি আছে, বেশির ভাগ মানুষ তাতে সাড়া দেয়। তবে মর্শে সে ধরনের লোভী ছিলেন না। এটা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ।
আপনি কি ভাবছেন ঘটনাটা এই রকমই কিছু? পোয়ারো জানতে চাইলেন।
মি. বার্নেস চশমা মুছতে মুছতে বললেন–হ্যাঁ, তাই। এইসব মানুষদের ধরা কঠিন। এদের বাঁচানোর মতো বড় বড় চাই আছে। এটা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন, দাঁতের ডাক্তারের চেয়ারে বসলে সব মানুষই নিজেকে অসহায় বোধ করেন। এই অভিজ্ঞতা আপনার এর আগে অবশ্যই হয়েছে। তারা মর্লেকে একটা কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। মর্লে সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। এছাড়া মর্লে তাদের বিষয়ে অনেক কিছু জেনে ফেলেছিলেন। সেই কারণে মর্লেকে তাদের হাতে মরতে হল।
–পোয়ারোর চোখে প্রশ্ন ঝিলিক দিল–তা হবে, তারা কারা?
তারা হল সেই দল যারা এসবের পিছনে আছে। অবশ্য এদের একজন নেতা আছে। সেই আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ছে।
কে সে? আপনি কি তাকে চেনেন?
–আন্দাজ করতে পারি। তবে আমার আন্দাজ ভুলও হতে পারে।
–আপনি কি রেইলির কথা ভাবছেন?
–আপনি ঠিক ধরেছেন। আমার মনে হয় মর্লেকে দিয়ে ওরা কাজটা করাতো না। কাজটা করতে রেইলি। মলে শুধু রোগীকে রেইলির হাতে তুলে দিতেন। আর ওই দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার হতেন বিখ্যাত ব্যাঙ্কার অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট। হতভাগ্য দাঁতের ডাক্তার মর্লে নিজের দোষ কবুল করতেন আদালতে এবং দুঃখ প্রকাশ করতেন। যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। পরে পেশা থেকে অবসর নিয়ে অন্যত্র কোনো ব্যবসা ফেঁদে বসতেন। হাজার হাজার পাউণ্ড আয় করে সম্পত্তির পরিমাণ বাড়াতেন। এটা কোনো গল্প কথা নয়, এটাই বাস্তবচিত্র।
–আপনার মত যদি মেনে নিই তাহলেও অ্যামবেরিওটিস যে এই খুনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, তার প্রমাণ কি?
–তা আমি বলতে পারব না। তবে দলের হয়ে কাজ করত এতে আমি নিশ্চিত। আর মর্লেকে ফাঁসানো হয়েছে।
–আপনার সন্দেহ ঠিক হলে এরপরের ঘটনা কি হতে পারে তাও আপনি জানেন?
মি. বার্নেস শান্ত ধীর স্থির হয়ে বললেন–ওরা আর একবার চেষ্টা করবে। ওদের হাতে সময় কম। এ ব্যাপারে পুলিশকে সন্দেহের বাইরের মানুষদের ওপরও নজর রাখতে বলুন। তার নিজের পরিজনরা, পুরোনোদিনের চাকররা, ডাক্তারখানায় যে ওষুধ বানায় তাকে, যে মদের জোগান দেয় তাকেও সন্দেহের তালিকায় রাখুন। ব্লাস্টকে খুন করার বিনিময়ে বহু কোটি টাকা পাওয়া যাবে। যা দিয়ে সারা জীবন স্বচ্ছন্দে কাটানো যাবে।
–এতটা হবে আশা করেন?
–এর থেকে বেশি কিছুও হতে পারে। প্রথম থেকেই রেইলির কথা আমার মাথায় ছিল। আইরিশ বিপ্লববাদী ব্যক্তিত্ব বলে?–না, তা নয়। মর্লের ঘরের কার্পেটের একটা দাগ আমাকে প্রথম দিন থেকেই ভাবচ্ছে। মনে হয় সেটা মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ। কোনো রোগীর মলেকে গুলি করার ইচ্ছে থাকলে তাহলে সে সেটা সার্জারিতে করতে পারত, টেনে নেবার দরকার হত না। আর এর থেকে আমার সন্দেহ তীব্র হয় যে সার্জারিতে না করে অফিস ঘরেই তাকে গুলি করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় খুনি বাইরের কেউ নয়, তার বাড়িরই কেউ।
মি. বার্নেস উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন–নিখুঁত আপনার কল্পনাশক্তি।
এরকুল পোয়ারোর যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বার্নেসের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন আমার সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ। তদন্তের খাতিরে প্রয়োজন পড়লে আপনাকে ডেকে পাঠাব। এরকুল পোয়ারো এবার এলেন প্লেনগাউরি কোর্ট হোটেলে। সেখানে মিস সেইনসবারি সীলের সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। পরদিন। সকাল বেলা। চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপকে পোয়ারো ফোন করলেন।–গুড মর্নিং বন্ধু। আজই তো ইনকোয়েস্ট, তাই না?
-হ্যাঁ, আপনি আসছেন নিশ্চয়?
–ইচ্ছে নেই, প্রয়োজনে লাগবে না বলে? আপনারা মিস সেইনসবারি সীলকে ডেকে পাঠিয়েছেন, আশা করি?
না, ডাকছি না। তিনি আমাদের কোনো উপকারে লাগছেন না।
–কেন? তার কাছ থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি, তাই?
–না, আর তা পেতে আমরা আগ্রহী নই।
–আমি অবাক করা একটা খবর জানাই আপনাকে, মিস সীল নৈশভোজের আগে প্লেনগাউরি হোটেল ছেড়ে চলে যায়। আর ফিরে আসেননি।
তবে কি তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন?
অকাট্যে ব্যাখ্যা চাই।
মি. জ্যাপের কণ্ঠস্বরে চিন্তার ছাপ। তিনি বললেন–কেন তিনি গা ঢাকা দেবেন? আমরা তাকে সন্দেহ করিনি। তাঁকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করিনি। কলকাতায় আমরা টেলিগ্রাম করেছিলাম। তার উত্তরও পেয়েছি। গত তিন বছর ধরে তিনি ওখানে বাস করছেন। উনি আমাদের যেসব কথা বলেছেন তা সব সত্যি। বিয়ে নিয়ে একটু বিভ্রাট ঘটেছিল। তিনি একটি হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন। দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। তাই কয়েক বছরের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মিশনারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এমন একজন মহিলার দ্বারা খুন করা সম্ভব নয় বলেই আমি ভেবেছি। আর এটাও হতে পারে হোটেলটা ওর ভাল লাগেনি, তাই তিনি চলে গেছেন।
তার সব মালপত্র হোটেলের ঘরে রয়ে গেছে। কিছুই তিনি নিয়ে যাননি, পোয়ারো জানালেন।
–তিনি কখন বেরিয়েছেন?
–পৌনে সাতটা নাগাদ। হোটেলের কর্মচারীরা এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করতে পেরেছে?
–তারা খুব উদ্বিগ্ন। ম্যানেজার মহিলা ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছেন। ওরা পুলিশে খবর দিয়েছে।
না, কোনো মহিলা এক রাত বাইরে কাটাতে পারেন। আবার ফিরে আসতেও পারেন। এসে যদি দেখেন তার অনুপস্থিতির জন্য পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন না। তিনি ক্ষুদ্ধই হবেন। ম্যানেজার মিসেস হ্যারিসন খুব করিৎকর্মা মহিলা। তিনি সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছেন তাকে খুঁজতে;এমনকি হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছেন। যদি কোন দুর্ঘটনার কারণে মিস সীল হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি পুলিশ ডাকবেন বলে মনস্থির করেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি ওখানে গিয়ে উপস্থিত হই। আমাকে সামনে দেখে তিনি খুশি হলেন। আমাকে যা যা ঘটেছে সব খুলে বললেন। আমি তাকে পরামর্শ দিই একজন পুলিশ অফিসারকে জানানোর জন্য।
–হুম। জ্যাপের গলায় উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ছে। তিনি বললেন, দেখছি কি করা যায়। সকালটা ইনকোয়েস্টের জন্য ব্যস্ত থাকব। পরে প্লেনগোরি কোর্ট হোটেলে যাব আমি।
চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ ও এরকুল পোয়ারো প্লেনগোরি হোটেলে হাজির। তারা ড্রইং রুমে ম্যানেজার মিসেস হ্যারিসনের জন্য অপেক্ষারত। হঠাৎ জ্যাপ প্রশ্ন করলেন–কী অদ্ভুত ব্যাপার? মহিলা কেন পালাতে গেলেন বলুন তো?
পোয়ারো হেসে বললেন–তাহলে ব্যাপারটা অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে তো, বন্ধু?
ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন মিসেস হ্যারিসন। তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি সজল নয়নে বলতে লাগলেন, কেন যে মিস সীল অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেটা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না আমরা। কি যে হল তার। কোনো দুর্ঘটনা? এদিক ওদিক লোক পাঠিয়েছি খবরের জন্যে কিন্তু কেউ তার সন্ধান আনতে পারেনি। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আরামপ্রিয়ও বটে।
জ্যাপ অনুরোধের সুরে বললেন–দয়া করে আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা মিস সীলের ঘরটি দেখতে পারি, মিসেস হ্যারিসন। ম্যানেজার ভদ্রমহিলা ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন স্বচ্ছন্দ্যে যেতে পারেন।
জ্যাপ ও পোয়ারো এলেন যে ঘরে মিস সীল থাকতেন। তাদের দুজোড়া চোখ লাটুর মতো ঘরের চারদিকে ঘুরে গেল। ঘরের এককোণে দুটো সুটকেস রয়েছে। রয়েছে একটি দেয়াল আলমারী। তাতে রাখা আছে বেশ কিছু চটকদার। পোশাক বিছানার ওপর পড়েছিল রাত পোশাক। ড্রেসিংটেবিলের তলায় দেখা যাচ্ছে কয়েক জোড়া জুতো। একজোড়া অক্সফোর্ডের, দুজোড়া ভেড়ার চামড়ার তৈরি, মার্টিনের একজোড়া নতুন জুতো রয়েছে। এসব দেখতে দেখতে পোয়ারো ভাবছিলেন ভদ্রমহিলা বেরোনোর আগে জুতোর ছেঁড়া বকলেসটা সেলাই করিয়েছেন কিনা।
জ্যাপ ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার টেনে খুললেন। তার মধ্যে কিছু চিঠিপত্র ছিল। তিনি সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। এরকুল পোয়ারো কয়েকটা ড্রয়ার খুলে দেখার চেষ্টা করলেন। তার একটিতে ভর্তি কিছু পশমী অন্তর্বাস আর একটিতে রয়েছে এক জোড়া পুরনোমোজা।
জ্যাপ প্রশ্ন করলেন–কিছু কি পেলেন? না বৃথাই পরিশ্রম হল?
পোয়ারো ওই মোজা জোড়া হাতে নিয়ে বললেন–সস্তা রেশমী জিনিস, দাম হবে জোর দুশিলিং। লম্বায় ন’ ইঞ্চির মতো।
জ্যাপ বললেন আমার অবস্থাও ওই একইরকম। এই ড্রয়ার থেকে পাওয়া গেল ভারত থেকে আসা দুটি চিঠি, দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানের দুখানা রসিদ। মহিলার চরিত্রে কোনো কলঙ্ক নেই। সবই স্বচ্ছ নির্মল।
পোয়ারো বিমর্ষভাবে মন্তব্য করলেন কিন্তু পোশাকের ক্ষেত্রে কুরুচির পরিচয় দিয়েছেন।
জ্যাপ বললেন–সম্ভবতঃ পোশাককে ভোগের উপকরণ হিসেবেই দেখেন তিনি। জ্যাপ তাঁর নোটবইতে দুটো ঠিকানা লিখে নিলেন। হ্যাঁম্পস্টেডের ঠিকানা। শুনেছি এদের সঙ্গে মিস সীলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এদের কাছ থেকে কিছু খবর পাওয়ার আশা আছে।
প্লেনগোরি কোর্ট হোটেল থেকে তেমন কিছু উত্তেজক তথ্য পেলেন না জ্যাপ ও পোয়ারো। কেবল তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার বন্ধু মিসেস বোলিথোর সঙ্গে দেখা করে গেছেন। বলে গেছেন, ডিনারের আগেই তিনি ফিরবেন। প্লেনগেরি কোর্টে একটি প্রথা চালু আছে। সেটি হল কেউ বাইরে খাবার খেলে তা আগে জানাতে হবে। মিস সীল কিন্তু তা করেননি। এর থেকে প্রমাণিত হয়, তাঁর ফিরে আসার কথা মাথায় ছিল। অথচ তিনি ক্রনওয়েল স্ট্রীটে গিয়ে আত্মগোপন করেন।
জ্যাপ ও পোয়ারো ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছলেন ওয়েস্ট হ্যামস্টেডেঠিকানাটা মিস সেইনসবারি সীলের ঘর থেকে পাওয়া গিয়েছিল। একটি চিঠিতে ঠিকানাটি উল্লিখিত ছিল। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। বাড়িটিও বেশ মনোরম গথিকে তৈরি। এই বাড়ির বাসিন্দারা হলেন অ্যাডমস পরিবারের সদস্যরা। এদের মার্জিত ভদ্র ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করে। যৌথ পরিবার। বহু বছর ভারতে বসবাস করেছিলেন। মিস সীলের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল। তবে কোনো উপকার করার আশ্বাস পাওয়া গেল না তাদের থেকে।
কিছু দিন ধরেই সেইসবরি সীল ওয়েস্ট হ্যামস্টেডে যান নি। ইস্টারের ছুটিতেও যাননি। অন্তত এক মাস তাদের সঙ্গে মিস সীলের যোগাযোগ বন্ধ। তারা জানতে পেরেছেন ওই সময়ে তিনি রাসেল স্ট্রীটের একটি হোটেলে থাকতেন। মিসেস অ্যাডামস সেখানকার ঠিকানা দিলেন। এছাড়া তার কয়েকজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ার বন্ধুরও ঠিকানা পাওয়া গেল অ্যাডামস পরিবার থেকে। তারা থাকেন ট্ৰীথ্যাসে।
পোয়ারো ও জ্যাপ এবার চললেন ট্ৰীথ্যাসের পথে। দেখা করলেন মিস সীলের পরিচিতজনদের সঙ্গে। কিন্তু তাদের কাছ থেকেও মিস সীলের কোন হদিশ পেলেন না তারা। অন্তত এমন একটা কু যেটা তাদের কাজে সাহায্য করতে পারে। জ্যাপ হতাশা হয়ে বললেন–আর একটাই জায়গা আছে মিস সীলের যাবার মতো। পোয়ারো আশ্চর্য হয়ে বললেন–সেটা কোথায়?
–হাসপাতালে চলুন সেখানে একবার যাওয়া যাক। সেখানে গিয়েও তাদের নিরাশ হতে হল। কারণ সেদিন হাসপাতালে সেরকম কোন মানুষকে আনা হয়নি। এ যেন কর্পূরের মতো উড়ে যাওয়া, কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে বসে আছেন তিনিই জানেন!
পরদিন সকাল। এরকুল পোয়ারো হাজির হলেন হাবোর্ন প্যালেস হোটেলে, মি. হাওয়ার্ডের আস্তানা। তিনি ভাবলেন ইনিও না অদৃশ্য হয়ে যান। পোয়ারো জানতে পারলেন মি. হাওয়ার্ড হোটেলেই আছেন এবং তিনি প্রাতরাশে ব্যস্ত।
অনাহূতের মতো এরকুল পোয়ারোকে দেখে হাওয়ার্ড রেইকস অস্তুষ্ট হলেন। আগেকার সেই খুনীসুলভ ভাবটা ছিল না। তবুও তিনি বিরক্তি সহকারে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? আমার এখানে?
এরকুল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বললেন–বসতে পারি?
রেইকস সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন অবশ্যই বসবেন। ভালো করে বসুন। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। পোয়ারো চেয়ারে বসার পর মি. হাওয়ার্ড প্রশ্ন করলেন আমার কাছে আপনার কি দরকার? আশা করি আপনি আমায় ভোলেন নি, মি. রেইকস?
–কোনো দিন আপনাকে দেখেছি বলে আমার মনে পড়েছে না, মঁসিয়ে পোয়ারা।
–এত ভুলো মন আপনার তা আমি বিশ্বাস করি না। তিনদিন আগে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমরা পাঁচ মিনিটের মতো একসঙ্গে ছিলাম। দন্ত চিকিৎসক হেনরী মর্লের ওয়েটিং রুমে।
দ্রুত যেন কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল ভদ্রলোকের চোখে মুখে। অবশ্য তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তাঁর কথাতেও আবেগ ফুটে উঠল। নিজেকে সংযত করে বললেন–বলুন, আপনার কি বলার আছে?
পোয়ারো এতক্ষণ রেইকসকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছিলেন। তিনি নিশ্চিত এতক্ষণে লোকটিকে হাতের মুঠোয় আনা গেছে। বোঝা যাচ্ছে তিনি বিপদে পড়েছেন। উদ্ধত চোয়াল রক্তিম দুটি চোখ দেখে মনে হল ঠিক যেন প্রতিহিংসাপরায়ণ এক জন্তু। রেইকস গম্ভীর স্বরে বললেন–আমাকে এসব বাজে কথা বলে কি প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি? আমি এসেছি এখানে বলে আপনি ক্ষুণ্ণ হয়েছেন দেখছি।
–আপনার পরিচয় এখনও দেননি মশাই।
দুঃখিত। বলে পোয়ারো তাঁর নাম ঠিকানা লেখা একটি কার্ড রেইকসের হাতে দিলেন। রেইকস কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখলেন তারপর কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন–ও! আপনিই তাহলে এরকুল পোয়ারো। বেসরকারী সখের গোয়েন্দা। এই পেশায় আপনার সুখ্যাতি আছে। তবে যাদের প্রচুর টাকা আছে তারাই আপনাকে ডেকে পাঠান। নিজেদের কুকীর্তি চাপা দেবার জন্য আপনাকে ব্যবহার করে।
পোয়ারো স্বর নরম করে বললেন–আপনার কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি পান করুন।
মি. রেইকস ঈষৎ ঝুঁকে বসে বললেন–আপনার মতলব কি বলুন তো মশাই? কোনো মতলবই নেই, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।
ব্যাঙ্গের সুরে রেইকস বললেন–ওহ, তাই বুঝি? তাহলে বলবো আপনি মুখের স্বর্গে বাস করেন। যারা আপনাকে অর্থ দিয়ে নিযুক্ত করেছেন তাদের কাছেই যাওয়া উচিত আপনার। আপনাকে টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ আমার নেই, মঁসিয়ে পোয়ারো। পোয়ারো বিমর্ষ সুরে বললেন–টাকা দিয়ে কেউ আমাকে কাজে লাগান নি। রেইকস অবাক হয়ে বললেন–সে কি মশাই, একথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, বিশ্বাস করা অথবা না করা আপনার ব্যাপার। তবে এটাই সত্যি আমাকে কেউ টাকা দেয়নি এখনও। নিছক কৌতূহল মেটাতে এখানে আসা। তাহলে সেদিন দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন কেন? সেও কি কৌতূহল মেটাতে যাওয়া?
পোয়ারা হেসে বললেন মি. রেইকস, আপনি এত জানেন আর এটা জানেন না দন্ত চিকিৎসকের কাছে মানুষ কেন যায়?
–তাহলে দাঁত দেখাতে গিয়েছিলেন?
নিশ্চয়ই।
–মাপ করবেন, কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হল না।
ঠিক আছে, তাহলে আপনিই বলুন কেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন?
–আপনার কথাতে সায় দিয়ে বলি আমিও দাঁত দেখাতে গিয়েছিলাম।
–আপনি দাঁতের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন? অথচ আপনাকে মি. মর্লের ঘরে যেতে দেখলাম না। দাঁত না দেখিয়েই ফিরে এসেছিলেন মি. রেইকস।
মি. রেইকস এবার উত্তেজিত হলেন তিনি কর্কশ স্বরে জবাব দিলেন। যদি চলে আসি তত আপনার কি? আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই চলে এসেছিলাম। আসলে আপনি গিয়েছিলেন প্রখ্যাত সুপ্রতিষ্ঠিত ধনী মানুষটিকে পাহারা দেবার জন্যে। আপনাদের প্রিয় অ্যালস্টেয়ার ব্লাস্ট আশা করি সুস্থ আছেন। আমাকে জালবন্দী করার মতো কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ আপনাদের হাতে নেই।
পোয়ারো কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন–সেদিন আপনি চলে আসার পরই ওই বাড়ির কর্তা মারা যান, হয়তো সেটা মনে আছে। রেইকস অবজ্ঞা ভরে বললেন–ওঃ সেই দন্ত চিকিৎসক হেনরী মলে না কি যেন নাম তার!
গম্ভীর স্বরে পোয়ারো বললেন–বাঃ মনে আছে তো। হেনরী মর্লে।
অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন মি. রেইকস। তারপর মাথা চুলকে বললেন–এর জন্যে আপনি আমাকে দায়ী করছেন। এবার আপনার আসল মুখোশটা খুলে গেল। আপনার জারিজুরি এখানে চলবে না। আমি ইনকোয়েস্টের রিপোর্ট দেখেছি। বেচারা নিজেকে নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, ভদ্রলোক ভুলবশত একজনকে অবশ করার ওষুধ অতিমাত্রায় দিয়েছিলেন। ফলে রোগীটি মারা যায়।
পোয়ারো অসহিষ্ণু হয়ে বললেন–আপনি প্রমাণ দিতে পারেন বাড়ি ছেড়ে আপনি যখন বেরিয়ে আসেন তখন আপনাকে কেউ দেখেছে? এমন কেউ কি আছে যে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে পারে বারোটা থেকে একটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?
রেইকস ঘাবড়ে গিয়ে বললেন–একেবারে পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। আপনার মতে আমি খুন করেছি। আচ্ছা এতে ব্লাস্টের কাছ থেকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছেন আপনি, তাই না?
পোয়ারো ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেন–আপনাকে আমি প্রথমেই বলেছি মি. ব্লাস্ট আমাকে নিযুক্ত করেননি। আমি তার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি।
এদিক ওদিক মাথা নেড়ে রেইকস বললেন–আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না। আপনি ব্লাস্টের নিয়োগ করা গোয়েন্দা। তাকে আপনি বাঁচাতে সাহায্য করবেন। কিন্তু অকৃতকার্য হবেন। তাকে আমরা বাঁচতে দেবো না কিছুতেই। ওকে মরতেই হবে। এই পচা ঘূণ ধরা অর্থনীতির অবসান হবে, নতুন সূর্য উঠবে। মাকড়সার জালের মতো চারদিক ঘিরে রয়েছে ধনী ব্যাঙ্কাররা। এদেরই মতো একজন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট। সেই আমাদের সামনে বাঁধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোনো সব নিয়ম নীতি বিসর্জন দিতে হবে। কেউ আটকাতে পারবে না। কি কিছু বুঝেছেন?
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–বুঝতে পারছি আপনি একজন আদর্শবাদী, যাকে কোনো মৃত্যু বিচলিত করতে পারে না।
–রেইকস বললেন–কে এক দাঁতের ডাক্তার তার মৃত্যুতে আমার কি আসে যায়? পোয়ারো করুণ সুরে বললেন–এতে আপনার কিছু আসে যায় না, তবে আমার অবশ্যই যায়। আর এখানেই আমাদের দুজনের মধ্যে পার্থক্য।
পোয়ারো বাড়ি ফিরে এলেন। সেখানে তার জন্য একটা চমক অপেক্ষা করছিল।
পোয়ারোকে দেখে তার পরিচারক জর্জ বলল–স্যার, এক ভদ্ৰমিহলা এসেছেন। তাকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখেছি। দেখে মনে হল উনি কোনো কারণে ভীত সন্ত্রস্ত। পোয়ারো আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন কে হতে পারে? মিস সীল কি? না, তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। তিনি বসার ঘরে ঢুকে চমকে উঠলেন। মিস গ্ল্যাডিস নেভিল। যে একদা মৃত মি. মর্লের সেক্রেটারী ছিল।
মিস নেভিলের চোখ গেল পোয়ারের দিকে। সে উঠে দাঁড়াল। তারপর বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল–ওহ, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আপনার মহামূল্যবান সময়ের কিছুটা আমাকে দিতে হবে। জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ, তবুও অনুরোধ করছি, একটু সময় যদি দিতে পারেন।
ইংরেজদের সম্পর্কে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই পোয়ারো জানতে চাইলেন আপনাকে কি এক কাপ চা দিতে বলবো, মিস নেভিল?
উচ্ছ্বসিত হয়ে গ্ল্যাডিস বলল–হ্যাঁ, দিলে ভালোই হয়। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, মঁসিয়ে পোয়ারো।
এরকুল পোয়ারো জর্জকে চা আনতে হুকুম করলেন। জর্জ চা দিয়ে গেল। মিস নেভিল চায়ে চুমুক দিলেন, সে যেন আগের সত্ত্বায় ফিরে এল। এবার বলল গতকালের ইনকোয়েস্ট আমাকে ভীষণ দুর্ভাবনায় ফেলেছে স্যার।
পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে বললেন সেটাই স্বাভাবিক।
আমাকে সাক্ষ্য দেবার জন্য ডাকা হয়নি তবুও আমি বাধ্য হয়েই মিস মর্লের সঙ্গে গিয়েছিলাম। কেননা মিস মর্লে, মি রেইলির সঙ্গে যেতে রাজী ছিলেন না, তাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পোয়ারো বললেন–আপনার কর্তব্য আপনি করেছিলেন।
হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আমার কর্তব্য। বেশ কয়েক বছর মি. মর্লের কাছে চাকুরিরতা ছিলাম আমি। এই দুর্ঘটনা আমাকে আঘাত দিয়েছে। আমার মন এমনিতেই ভেঙে পড়েছে, তার ওপর এই ইনকোয়েস্ট আরও খারাপ করে দিয়েছে।
–তা বটে।
মিস নেভিল পোয়ারোর আরও কাছে এগিয়ে এল। তারপর নিচু গলায় বলল–ওই ইনকোয়েস্টে যেসব যুক্তি দেখানো হয়েছে সেটা পুরোটাই মিথ্যে মঁসিয়ে পোয়ারো। এর মধ্যে গভীর একটা ষড়যন্ত্র আছে।
–আপনার কি মনে হয়, মাদামোয়াজেল?
–আমার মনে হয় ওরা যা বলছে তা ঠিক নয়। চিকিৎসায় গাফিলতি কখনও মি. মর্লে করেননি। ভুলবশতঃ কোনো ওষুধ প্রয়োগ করে রোগীর ক্ষতি করা তার পক্ষে অসম্ভব। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, হয়তো কোনো কোনো রোগী কড়া ইনজেকশন সহ্য করতে পারে না। তবে তা ঘটে যাদের হার্ট দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে। তবে আমি নিশ্চিত মাত্রা বেশি হওয়া অবাস্তব কথা। ডাক্তারেরা কখনও এ ধরনের ভুল করতে পারেন না।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন–আমিও বিশ্বাস করি না। আপনি কী এসব কথা ইনকোয়েস্টে বলেছেন?
মাথা নেড়ে মিস নেভিল বললেন–না, আমি বলিনি, কারণ আমি ইচ্ছে করেই কেসটাকে জটিল করতে চাই নি। তবে আমার স্থির বিশ্বাস মি. মর্লে কখনও ভুল করে বা ইচ্ছে করে এমন জঘন্যতম কাজ করতে পারেন না। সে একটু থামলো। পোয়ারোর মুখভঙ্গী জরিপ করে আবার বলতে শুরু করলো, তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি, মঁসিয়ে পোয়ারো। কেননা আপনি সরকারি পক্ষের কেউ না। বেসরকারি রহস্য সন্ধানী আমার মনে হল কাউকে কিছু বলতে হলে আপনাকেই কেন বলবো না। আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন। ফুঙ্কারে উড়িয়ে দেবেন না। পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন, আপনাকে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ডাকা হয় সে ব্যাপারে কিছু কথা কিছু বলুন।
সচকিত হয়ে মিস নেভিল বললেন–আসলে আমি ওই টেলিগ্রাম নিয়ে ভাবছি না। কারণ যে এটা পাঠিয়েছে তিনি আমার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এমনকি আমার দিদিমা কোথায় থাকেন তাও তিনি জানেন।
হ্যাঁ, আপনার ঘনিষ্ঠ কেউ। হয়তো বন্ধু বা ওই বাড়িতে বসবাসকারী এমন কেউ।
আমার কোন বন্ধু নেই যিনি এতবড় রসিকতা করতে পারেন। তবে আমি এটাও ভাবছি মি. মর্লে কি ওই টেলিগ্রম পাঠিয়েছিলেন? কেন এই কথা ভাবছেন? ফ্রাঙ্ক কার্টারকে বিয়ে করতে তিনি আমাকে নিষেধ করেছিলেন। তার পরামর্শ আমি গ্রাহ্য করিনি। আমি ফ্র্যাঙ্কের বাগদত্তা। তাই তিনি চেয়েছিলেন আমাকে ফ্রাঙ্কের থেকে দূরে রাখতে। তাঁর আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমাকে টেলিগ্রাম করবেন তা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমি সমারসেট গিয়েছিলাম। সেকথা শুনে ফ্রাঙ্ক রেগে গিয়েছিল। তার ধারণা আমি অন্য কারোর সঙ্গে বেড়াতে যাব বলে আমি নিজেই একাজ করেছি।
–সত্যিই কি কেউ আছে?
লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেল গ্লাডিসের সমস্ত মুখ। সে মুখ নিচু করে বলল না, না, আসলে বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে তার চাকরি নেই সে বেকার তাই সে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। যত উদ্ভট চিন্তা ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খেত।
পোয়ারো হেসে বললেন–তাই সেদিন আপনাকে না পেয়ে সে অস্থির, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।
হ্যাঁ, সে একটা নতুন চাকরি পেয়েছিল। সপ্তাহে দশ পাউণ্ড করে বেতন পাবে। সেই আনন্দের খবর আমাকে জানানোর জন্য ছুটে এসেছিল। ও জানতো আমি সে সময় মি. মর্লের দন্ত চিকিৎসালয়ে থাকি তাই সেখানে গিয়েছিল। তাছাড়া খবরটা মি. মর্লেকে শোনানোর আগ্রহ ছিল তার কিছুদিন আগে তিনি ফ্র্যাঙ্ককে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছিলেন। সেই আঘাত ও ভুলতে পারেনি। এমনটা ওর সম্পর্কে আমাকে নানা কথা বলে আমার মন বিষিয়ে দিয়েছিলেন।
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–আপনার বন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিন; তাকে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে মিস নেভিল।
-ঠিক আছে আঁসিয়ে পোয়ারো। তবে রবিবার ছাড়া তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। তার রবিবার ছুটি থাকে। সে দিনই সে এখানে আসে। আর সপ্তাহের দু’দিন বাইরে বাইরে ঘুরে কাজ করে। তবে ফ্র্যাঙ্ক লন্ডনের একটা ঠিকানা দিয়েছে আমাকে। আমার প্রয়োজন হলে সেই ঠিকানায় আমি চিঠি পাঠাই। ওরা সেটা ফ্র্যাঙ্কের হাতে পৌঁছে দেয়।
–ওহ, সেই নতুন চাকরি? আচ্ছা কাজটা কি?
মিস নেভিল আমতা আমতা করে বলল–মানে, আমি ঠিক জানি না। হবে হয়তো কোনো কেরানি বা সেক্রেটারির চাকরি।
পোয়ারো আর কথা না বাড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মিনিট কয়েক কেটে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে বললেন–তাই না। আসুন না আপনারা দু’জনে, মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ রইল। খাওয়ার ফাঁকে আপনাদের দু’জনের সঙ্গে হেনরি মর্লের মৃত্যু রহস্য নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাবে।
গ্ল্যাডিস সম্মত্তি জানিয়ে বলল–ঠিক আছে, আমরা যাচ্ছি, আমার মনে হয় ফ্রাঙ্কেরও আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগবে।
পরদিন রবিবার। দুপুর বারোটা। লোগানস কর্নার হাউস। এরকুল পোয়ারো আগেই সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারপর এল মিস গ্ল্যাডিস নেভিল। সঙ্গে ফ্রাঙ্ক কার্টার। পোয়ারো তাকে দেখেই চিনতে পারলেন।
মাঝারি চেহারার এক তরুণ। হাবভাবে প্রগলভতা ফুটে উঠেছে। কোনো কারণে বিব্রত বোধ করলে চোখ দুটো তার অস্বস্তিকরভাবে চঞ্চল হয়ে ওঠে। তারা পোয়ারোর পাশাপাশি দুটি চেয়ারে এসে বসল। গ্ল্যাডিস দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিল। গোড়াতেই তার মন সন্দিহান হয়ে উঠেছিল। তাই অসহিষ্ণু স্বরে বলল–আপনার আমন্ত্রণ আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। তবে আশ্চর্যও কম হইনি। গ্ল্যাডিস আমাকে কোনো কথাই বলেনি।
পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন–গতকাল ঠিক করা হয়। মিস নেভিল, মি. মর্লের মৃত্যুতে অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। তাই ভাবলাম এ বিষয়ে আমরা একসঙ্গে যদি কিছু কথা বলি।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার তীক্ষ্ণ স্বরে বাধা দিয়ে বলল–কি! মি. মর্লের মৃত্যু? শুনে শুনে কান পচে গিয়েছে। আমি তোমাকে কত বার বলেছি ওকে ভুলে যেতে গ্ল্যাডিস।
বিরক্ত হয়ে গ্ল্যাডিস বলল–আঃ ফ্র্যাঙ্ক, এভাবে বলছ কেন? জানো তো উনি আমাকে একশো পাউণ্ড দিয়ে গেছেন। কাল রাতে মিসেস মর্লের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।
ফ্র্যাঙ্ক দমে গিয়ে বলল–তা অস্বীকার করছি না। এর বিনিময়ে তোমাকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হত। আর উনি হয়েছেন লাভবান।
–তা করেছেন, তবে আমার উপযুক্ত বেতন দিতে উনি কার্পণ্য করেননি কখনও।
–আমি বিশ্বাস করি না। তুমি সরল বলে ওকে চিনতে পারোনি। তা নাহলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে তোমাকে চাপ দিতেন না উনি।
–তিনি ভুল করেছিলেন।
-না, না তিনি জেনে বুঝেই করেছিলেন। উনি মারা গেলেন, না-লে আমি সেদিন যা খুশি দু-চার কথা শুনিয়ে আসতাম।
এতক্ষণ এরকুল পোয়ারো ওদের দুজনের কথা চুপচাপ শুনছিলেন। এবার তিনি জেরা শুরু করলেন মি. মর্লের মৃত্যুর দিন সকালে আপনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন?
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কর্কশ স্বরে বলল–হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। এর থেকে আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন? তাছাড়া আমি গিয়েছিলাম গ্ল্যাডিসের সঙ্গে দেখা করতে।
–আপনার সঙ্গে কি মিস নেভিলের দেখা হয়েছিল?
না, ওই ছোকরা চাকরটা জানায়, সে আসেনি।
–তারপর আপনি কি করলেন? চলে এসেছিলেন?
–না, বসেছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল মি. মর্লের সঙ্গে দেখা করার। তাকে বলতাম, আপনি জঘন্য খারাপ লোক। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে কথা বলে গ্ল্যাডিসকে প্ররোচিত করেছেন। আমি ভাল একটা চাকরি পেয়েছি। সুতরাং ও আপনার এখানে আর কাজ করবে না। আজই চাকরি ছাড়ার নোটিশ দেবে।
–সত্যিই আপনি তার সাথে দেখা করে এসব কথা বলেছিলেন?
–না, ওই ঘরটায় বসে থেকে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তাই তাঁর সঙ্গে দেখা না করে চলে এসেছিলাম।
কখন গিয়েছিলেন এবং কখন চলে এসেছিলেন, ঠিক সময়টা বলুন তো মি. কার্টার।
–ঠিক সময়টা আমার এখন আর মনে নেই। তবে মনে হয় যখন গিয়েছিলাম তখন বারোটা বেজে গিয়েছিল। কখন বেরিয়ে এসেছিলাম সেটা মনে নেই।
–আপনি যখন ওয়েটিং রুমে বসেছিলেন তখন সেখানে আর কে কে ছিলেন?
–একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি চলে যেতে আমি একাই ছিলাম।
সাড়ে বারোটায় একজন ভদ্রমহিলা সেখানে গিয়েছিলেন। তাকে কি আপনি দেখেছিলেন?
-না। সংক্ষেপে জবাব দিল ফ্র্যাঙ্ক কার্টার।
–তাহলে আপনি সাড়ে বারোটার আগেই চলে এসেছিলেন, তাই না?
হবে হয়তো। ঘড়ি দেখা আমার অভ্যেস নেই। তাই সময়টা বলতে পারব না।
পোয়ারো ফ্র্যাঙ্ককে অপলক দৃষ্টিতে পরখ করছিলেন। ওর অস্থিরতা তাঁর দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি বুঝতে পারলেন ও একটা কথাও সত্যি বলছে না। তাই ও মনে মনে ভয় পেয়েছে।
পোয়ারো নরম সুরে বললেন মিস নেভিলের কাছে জানতে পারলাম আপনি একটা ভাল চাকরি পেয়েছেন। মাইনেও বেশ ভাল।
-হ্যাঁ, সপ্তাহে দশ পাউণ্ড, খারাপ নয় নিশ্চয়ই? আমারও যে ভাল কাজ জোগাড় করার যোগ্যতা আছে, সেটা জানাতে পারলাম না মি. মর্লেকে, এই দুঃখটা আমার রয়ে গেল।
–তা ঠিক। আশা করি পরিশ্রম করতে হয় না খুব বেশি?
–তেমন নয়।
কাজটা ভাল?
–খুব ভাল নিঃসন্দেহে। ব্যঙ্গের সুরে বলল, আমার অদম্য কৌতূহল ছিল বেসরকারি গোয়েন্দারা কিভাবে তদন্তের কাজ করে তা প্রত্যক্ষ করার। শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দা এখন আর দেখা যায় না। সব গোয়েন্দাই এখন বিবাহবিচ্ছেদের কাজ করেই খুশি।
এরকুল পোয়ারো বিরক্তির সুরে বললেন আমি বিবাহ বিচ্ছেদের তদন্ত করি না।
–অবিশ্বাস্য! আপনার সংসার খরচ জোগানের উৎস কি?
–আছে কোনো রহস্য।
গ্ল্যাডিস নেভিল বলল–কেন? মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি তো রাজা মহারাজা, স্বরাষ্ট্র দপ্তর আর ডাচেসদের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। একথা মি. মর্লের মুখেই শুনেছি আমি।
হাসি মুখে পোয়ারো বললেন অসংখ্য ধন্যবাদ, মাদামোয়াজেল।
একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন এরকুল পোয়ারো। চিফ ইন্সপেক্টরকে ফোন করলেন। বললেন–বন্ধু, প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি বিরক্ত করা জন্য গ্ল্যাডিস নেভিলের পাওয়া টেলিগ্রামটার খোঁজ নিয়েছিলেন? কে করেছে? কোথা থেকে এসেছে?
জ্যাপ বললেন–খুনের চিন্তা এখনও মাথা থেকে বের হয়নি দেখছি। হ্যাঁ, খোঁজ পেয়েছি। বুদ্ধি খাঁটিয়ে এই টেলিগ্রামটা করা হয়েছিল। মিস নেভিলের দিদিমা থাকেন সমারসেটের রিচবোর্নে। টেলিগ্রামটা পাঠানো হয়েছিল লণ্ডনের শহরতলি রিচবোর্ন থেকে। এরকুল পোয়ারো উৎসাহিত হয়ে বললেন–হুঁ, খুবই পাকা বুদ্ধির কাজ। তাড়াহুড়োয় দেখলে রচবার্নকে রিচবোর্ন ভাবা খুবই স্বাভাবিক। আচ্ছা এই টেলিগ্রাম সম্পর্কে আপনার যুক্তি কি?
–কিছুই না। নিছক তামাশা। একাজ কে করতে পারে বলে আপনি ভাবেন?
–কে আবার? মানসিক বিকারগ্রস্ত কেউ। লোক ঠকাতেই যে আনন্দ পায়।
–আর কাজটা সেদিনেই করতে হল যেদিন মি. মর্লে ইঞ্জেকশান দিতে ভুল করলেন।
আপনি যেহেতু ঘটনাটাকে খুন বলে ভেবেছেন তাই রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন। তা না হলে এত সাধারণ ব্যাপার, সেদিন মিস নেভিল অনুপস্থিত। তাই মর্লেকে একা হাতেই সব রোগীকে দেখতে হয়েছে। ব্যস্ত হাতে কাজ সারতে হয়েছে। তাই তার ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
-আপনার ব্যাখ্যা আমার মনঃপুত হল না।
–আমি বেশ বুঝতে পারছি, আপনার এই সন্দেহ ঘটনার মোড়কে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মি. মর্লেই মিস নেভিলকে ছলনা করে বাইরে পাঠিয়েছিলেন। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যামবেরিওটিসকে অতিমাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করেছিলেন। এতে তার মৃত্যু হয়। সুতরাং এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। যুক্তিটা এবার বোধগম্য হল আপনার?
না, মানতে পারলাম না। অ্যামবেরিওটিসের মৃত্যুর কারণ অন্য হতে পারে।
-না, আপনার ধারণা ভুল। আমি যেটুকু জেনেছি, তা হল তিনি স্যাভয় হোটেল থেকে বের হননি। তার কাছে কেউ আসেননি। নিজের ঘরে বসে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন। আর পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেও এটাই উল্লেখ আছে, তার পেটে কোনো ওষুধ ছিল না। তাকে ইঞ্জেকশান করেই হত্যা করা হয়েছে। অতএব এটাই প্রকৃত ঘটনা। এই যুক্তি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারও মেনে নিয়েছেন।
–আর যে মহিলা বেপাত্তা তার সম্পর্কে তিনি কি মত প্রকাশ করেছেন?
–মিস সীল? না, এখনও তার খোঁজ-খবর চলছে। পোয়ারো বিদ্রুপের সুরে বললেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের কি স্থির বিশ্বাস ওই ভদ্রমহিলা নিরুদ্দেশ হয়েছেন?
-হ্যাঁ, তারও ওই একমত। তবে জীবিত অথবা মৃত যে অবস্থাতেই হোক তাকে আমরা খুঁজে বের করব। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মৃতের তালিকায় তাকে রাখেনি।
-কেন?
কারণ তার দেহ কোথাও না কোথাও পাওয়া যেত।
জ্যাপ, তাহলে কি বুঝব, আপনারা সব সমস্যার সমাধান সহজেই করতে পারেন?
বুঝতে পারছি, আপনার অনুমান যে খুন হয়েছে।
–আপনি কি জোর দিয়ে বলতে পারেন বেশির ভাগ নিরুদ্দিষ্ট মানুষকে খুঁজে পেয়েছেন আপনারা?
–চেষ্টা করি, মেয়েদের ক্ষেত্রে বলতে পারি, অন্তত দশজনের মধ্যে আটজনের খোঁজ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে তিনি হয়তো কোনো পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গেছেন।
তাহলে সত্যিই মিস সীলকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে?
–আমরা তার ছবি পাঠিয়ে দিয়েছি বিভিন্ন সংবাদ পত্রে, তার বর্ণনা দিয়ে ছবি ছাপা হবে। বি.বি.সি.র-ও সাহায্য চেয়েছি আমরা। ঠিক খুঁজে বের করব।
–এতে কাজ হলেও হতে পারে। ঠিক আছে বন্ধু। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ফোন রেখে দিলেন পোয়ারো। গম্ভীর মুখে সোফায় গিয়ে বসলেন।
নিঃশব্দে ঘরে এসে ঢুকল জর্জ। তার হাতের ট্রে-তে এক কাপ গরম চকোলেট ও কিছু বিস্কুট রয়েছে।
চকোলেটের কাপ ও প্লেট টেবিলে রেখে বলল–স্যার, আর কিছু লাগবে আপনার?
পোয়ারো কাপের চকোলেট নাড়তে নাড়তে বললেন–মনটা বড়ই বিচলিত লাগছে, জর্জ।
তার এই ভাবভঙ্গী জর্জের পরিচিত। তাই সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। মন যখন অস্থির হয়ে ওঠে, মাথা কাজ করে না তখন তদন্ত সম্পর্কে জর্জের সঙ্গে তিনি আলোচনা করে থাকেন। তিনি বলেন জর্জের বিচার বুদ্ধি অনেক জটিল কেসের সমাধান সূত্র বের করে দিয়েছে।
হঠাৎ পোয়ারো জানতে চাইলেন–আমার দন্তচিকিৎসক হেনরি মর্লের মৃত্যুর খবর তুমি কি শুনেছ, জর্জ?
-হ্যাঁ, স্যার শুনেছি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। তিনি নাকি স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করেছেন? হ্যাঁ, আমিও সেরকমই শুনেছি। আসলে তিনি খুন হয়েছেন।
হুঁ, স্যার। –
-এখন কথা হচ্ছে তিনি যদি খুন হয়ে থাকেন, কে খুন করল কে?
–ঠিক কথা, স্যার।
–যাদের ওপর আমার সন্দেহ হচ্ছে তারা হল, রাঁধুনি, পরিচারিকা, মৃতের বোন জর্জিনা মর্লে, মৃতের অংশীদার মি. রেইলি, মৃতের ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেড আর হলেন এক গ্রীক ভদ্রলোক। প্রথম ও দ্বিতীয় জনকে আমি ধরছি না। তারা খুব ভাল ও নিরীহ মানুষ। তাদের দ্বারা একাজ সম্ভব নয়। তৃতীয় জন অর্থাৎ মিস মর্লে, যদিও ভাইয়ের সব সম্পত্তির অধিকারী। তবুও অর্থের লোভ বিপদ ডেকে আনে। মি. রেইলির উদ্দেশ্য এখনও বোঝা যাচ্ছে না। ছোকরা চাকরটিকেও সন্দেহ মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। তবে বেশি বিপজ্জনক ওই গ্রীক ভদ্রলোকটি।
জর্জ একটু কেশে বলল–এইসব বিদেশীরা, স্যার
এরকুল পোয়ারো তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, তুমি ঠিক বলেছ জর্জ, তবে কি জানো, সেই ভদ্রলোক আর বেঁচে নেই। আপাতদৃষ্টিতে মি. মর্লেই তার এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। তবে এটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত ভুল তা এখনও জানা যায়নি।
আচ্ছা স্যার, এটা হয় না, তারা দুজন দুজনকে খুন করেছেন।
হ্যাঁ, সেটা অসম্ভব নয়। দাঁতের ডাক্তার চেয়ারে বসা রোগীকে মারার পরিকল্পনা করছেন আর এদিকে ওই রোগী ভদ্রলোক তাকে মারার জন্য বন্দুক বের করেছেন। অথচ কেউ তা জানেন না কি ঘটতে চলেছে। এটা একটা বুদ্ধির খেলা। তবে আমার নামের তালিকায় আরও দু’জনের নাম আছে। তাদের মধ্যে একজন এক আমেরিকান ভদ্রলোক অন্যজন ফ্র্যাঙ্ক কার্টার, যদিও সে রোগী হিসেবে আসেনি। সে বারোটার পর ওই বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু তাকে কেউ বেরিয়ে যেতে দেখেনি। আমার বক্তব্য তুমি শুনলে, এবার বলো এর থেকে তুমি কি বুঝতে পারলে?
–স্যার, খুনের সময় আপনি জানতে পেরেছেন?
অ্যামবেরিওটিস যদি খুন করে থাকেন তাহলে তা হবে বারোটা থেকে বারোটা কুড়ির মধ্যে। আর যদি অন্য কেউ করে থাকে তাহলে তারপরেই হবে। তা না হলে মর্লের মৃত্যুদেহ অ্যামবেরিওটিসের চোখে পড়ত। এছাড়া বারোটা পঁচিশের পর মি. মর্লে আর কোনো রোগীকে ডাকেননি। তা আমি ওই ছোকরা চাকরের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।
জর্জ মাথা চুলকে বলল–স্যার আমি একটা কথা বলব?
হ্যাঁ বলো।
স্যার, কথাটা হল, এবার আপনাকে আর একজন ডাক্তারের সন্ধান করতে হবে।
এরকুল পোয়ারো বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে বললেন–তোমার তারিফ করতেই হবে জর্জ। এই ভাবনাটা আমার মাথায় ছিল না।
জর্জ হাসি মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পোয়ারো গম্ভীর মুখে একাকী বসে আছেন। মর্লের মৃত্যু রহস্যের জট কিছুতেই খুলতে পারছেন না তিনি। কাকে তিনি চিহ্নিত করবেন খুনি বলে। হঠাৎ মনে পড়ল একটা নাম তালিকা থেকে বাদ গেছে। সেটি হল মি. বার্নেস।
ঠিক সেই মুহূর্তে টেলিফোনটা ঝন ঝন করে বেজে উঠল। জর্জ ছুটে গিয়ে ফোনটা ধরল। তারপর বলল–স্যার আপনাকে একজন মহিলা চাইছেন।
পোয়ারো রিসিভার কানে ধরতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।
ও প্রান্ত থেকে মহিলা কণ্ঠ–মি. এরকুল পোয়ারো, আমি জেন অলিভেরা, মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের ভাইঝি বলছি। চিনতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে না?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ চিনতে পারছি বলুন, মিস অলিভেরা।
দয়া করে একবার গথিক হাউসে আসুন। আপনার সঙ্গে ভীষণ জরুরি কথা বলার আছে।
–অবশ্যই যাব। কিন্তু কখন যাব?
সাড়ে ছটায় আসুন।
–বেশ তাই হবে।
জেন অলিভেরা নিচু স্বরে বলল–আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো, মঁসিয়ে পোয়ারো?
–একদম না, এটাই আমি মনে মনে চাইছিলাম।
পোয়ারো ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। এবার গথিক হাউসে যেতে হবে। তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা। গথিক হাউসে এসে পৌঁছলেন গোয়েন্দা প্রবর এরকুল পোয়ারো। তাকে একটা বিরাট হলঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একটা লেখার টেবিলের সামনে বসেছিলেন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট তাঁর হাতে একটি ছুরি। তিনি আনমনে ছুরিটা নিয়ে খেলা করছিলেন। তাকে খুব অস্থির চঞ্চল মনে হচ্ছিল।
সে ঘরে আরও দুজন মহিলা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজনকে পোয়ারো চিনতে পারলেন, সে জেন অলিভেরা। জেন একটি ম্যান্টলপীসের সামনে দাঁড়িয়েছিল। অন্য মহিলাকে তিনি চিনতে পারলেন না। তবে যে কথা চিৎকার করে বলছিলেন তা পোয়ারোর কর্ণগোচর হল। তিনি বলছিলেন–এই ব্যাপারে আমার মতামতও জানতে চাওয়া উচিত ছিল, অ্যালিস্টেয়ার।
–অবশ্যই, জুলিয়া অবশ্যই, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন অ্যালিস্টেয়ার। তিনি পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে বললেন।
–তোমরা যদি ওই নোংরা ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলো তাহলে আমি এঘরে আর থাকব না।
–আমারও একমত মা, জেন অলিভেরা বলল।
মিসেস অলিভেরা এরকুল পোয়ারোকে না দেখার ভান করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
মি. ব্লাস্ট হাসতে হাসতে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি আসায় আমি আনন্দিত হয়েছি। আপনাকে আমার ভাইঝি জেন আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ওর সঙ্গে আপনার আগেই পরিচয় হয়েছে।
সেই মুহূর্তে জেন বলল–কাগজে নিরুদ্দেশ কলামে যে মহিলার নাম বেরিয়েছে তার সম্বন্ধে কিছু বলার ছিল। মিস সীল নাকি কি যেন নাম ওই মহিলার?
পোয়ারো বললেন–সেইনসবারি সীল।
মিস অলিভেরা নাক কুঁচকে বলল–কি বিচ্ছিরি নামরে বাবা, তাই মনে রাখতে পারছি না। কাকা তুমি বলবে না আমি বলব?
–ওই গল্পটা তুমি ভাল রপ্ত করেছে, মামনি। তাই তুমিই বলো।
জেন একবার পোয়ারোর দিকে তাকাল। তারপর বলতে শুরু করল–ব্যাপারটার মধ্যে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই হয়তো। তবুও আপনাকে ডেকে এনেছি। কারণ আপনার এ কাহিনি জেনে রাখা উচিত।
–হুঁ বলুন, আমি শুনতে আগ্রহী।
–আমি তিন মাস আগে ঘটা একটা ঘটনার কথা বলছি। আমি কাকার সঙ্গে সেদিন বেরিয়েছিলাম রোলসে চড়ে। কথা ছিল তিনি ৫৮ কুইন শার্লট স্ট্রিটে নামবেন আর আমি যাব রিজেন্ট পার্কে। সেখানে আমার এক বন্ধু থাকে। গাড়ি গিয়ে থামল ৫৮ কুইন শার্লট স্ট্রিটে। কাকা গাড়ি থেকে নামলেন। আর সেই মুহূর্তে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা, মধ্যবয়স্কা ওই মহিলার পরনে ছিল ডবল ছাঁটের পোশাক। তিনি কাকার দিকে ছুটে এসে বললেন, ওহ, মি. ব্লাস্ট, আমাকে চিনতে পারছেন? কাকার ভাবভঙ্গী দেখে আমি বুঝতে পারলাম তিনি ওই মহিলাকে চিনতে পারছিলেন না।
মি. ব্লাস্ট বললেন, সত্যিই আমি সব কথা ভুলে যাই। জেন আবার বলতে শুরু করল, কাকা যেন চিনতে পেরেছেন এমন ভাব করে। বলল, ওহ ঘঁ, অবশ্যই। মহিলা আবার বললেন, আপনার স্ত্রীকে আমি বহুদিন থেকে চিনি। সে আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল।
মি. ব্লাস্ট বিষণ্ণ সুরে বললেন–চাঁদা নেওয়ার জন্য সবাই ওরকম কথা বলে থাকে। সেদিনও পাঁচ পাউণ্ড চাঁদা দিয়ে রেহাই পেয়েছিলাম।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন–ওই ভদ্রমহিলার কথা সত্যি? উনি কি আপনার স্ত্রীকে চিনতেন?
চিনতেও পারেন। তবে বন্ধু বলতে পারব না। মিশনের কাজে তাকে দেশের বাইরেও যেতে হয়। সেখানে কোনো অনষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল হয়তো।
জেন অলিভার দ্রুত বলে উঠল–রেবেকা কাকিমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল তা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা তোমার সাথে কথা বলার একটা অজুহাত মাত্র। মি. ব্লাস্ট সায় দিয়ে বললেন–তা হবে হয়তো। পোয়ারো জানতে চাইলেন–ওই মহিলার সঙ্গে আর কোনোদিন আপনার দেখা হয়েছিল?
মাথা ঝাঁকিয়ে ব্লাস্ট বললেন–ওকথা কবেই আমি ভুলে গিয়েছি। ইদানীং পেপারে তার খবর ছাপা হয়েছে তা শুনেছি।
জেন ধীরে ধীরে বলল–মঁসিয়ে পোয়ারোর ব্যাপারটা জানা দরকার ভেবেই আমি ফোন করেছিলাম।
পোয়ারো হাসি মুখে বললেন–ধন্যবাদ মাদামোয়াজেল, এরপর ব্লাস্টকে উদ্দেশ্য করে বললেন মি. ব্লাস্ট আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ, আপনার অনেকটা সময় অপচয় করেছি, আর নয়। এবার আমি উঠব।
জেন বলল–চলুন আমি আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।
পোয়ারোর মুখে মুচকি হাসি। তারা দুজনে নিচে নেমে এলেন। জেন একটা ঘর দেখিয়ে বলল–এই ঘরে একবার আসুন।
পোয়ারো জেনের পেছন পেছন ঘরটিতে গিয়ে প্রবেশ করলেন। ঘরটি খুবই ছোট্ট।
জেন এবার পোয়ারোকে সরাসরি প্রশ্ন করল–তখন ফোনে বললেন আপনি আমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন? কিন্তু কেন?
পোয়ারো দ্রুত বললেন–ওটা কথার কথা ছিল, মাদামোয়াজেল।
–মানে হল এই, ওই মহিলার বিষয়ে আমি কিছু জানাতে চাইব তা আপনি আগেই ভেবে রেখেছিলেন।
তাহলে বলুন সেইনসবারি সীল সম্বন্ধে ওই তুচ্ছ খবর আমাকে দিলেন কেন? কেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডকে জানালেন না? আছে আপনার কোনো ব্যাখ্যা এই বিষয়ে?
–ঠিক আছে, মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি আর কি জানতে পেরেছেন?
আমি জানি আপনি আমার ব্যাপারে কৌতূহলী। আর যখন জানতে পারেন আমি হর্বোন প্যালেস হোটেলে গিয়েছিলাম তখন থেকেই ছুতো খুঁজছিলাম কিভাবে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায়। একথা শুনে জেনের চোখ মুখ রক্তহীন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। পোয়ারো তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন মি. হাওয়ার্ড রেইকস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে আপনি আগ্রহী ছিলেন।
জেন অবাক হবার ভাব করে বলল–লোকটা কে জানতে পারি কি?
পোয়ারো জেনের ছলনা ধরতে পারলেন। তিনি বললেন আমাকে উত্তেজিত করে লাভ নেই। আমি যা জানি সব বলব। তবে তা অনুমানসাপেক্ষ। সেদিনের কথা আপনার মনে আছে নিশ্চয়। যেদিন আমি ও আমার বন্ধু চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ প্রথম এখানে। এসেছিলাম। আপনি আমাদের দেখে চমকে উঠেছিলেন। আপনার অনুমান আপনার কাকার কিছু হয়েছিল। কেন, এরকম ধারণা হয়েছিল আপনার সেদিন?
কারণ তিনি একজন বিখ্যাত মানুষ। তাই ঈর্ষা করেই হোক বা রাগেই হোক তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায় অনেকে। হার্জো স্লোভাকিয়ার ঋণের পর কাকাকে কত রকম ভয় দেখানো চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি তাকে মেরে ফেলার জন্য ডাকে বোমা পাঠানো হয়েছিল।
এরকুল পোয়ারো বললেন–দন্ত চিকিৎসক মি. মর্লেকে, কে বা কারা গুলি করে, সেকথা চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ আপনাকে বলেছিলেন। আপনি গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, এ অসম্ভব। মনে কি পড়ে আপনার মাদামোয়াজেল?
জেন ঠোঁট কামড়ে বলল–আশ্চর্যজনক ঘটনা কিনা তাই হয়তো…..।
–এতে বোঝা যায় আপনি মি. মর্লের কথা আগেই জানতেন, আপনি আশা করেছিলেন ওর বাড়িতে কিছু একটা অঘটন ঘটবে। তবে মি. মর্লের নয়, আপনার কাকার কোনো ক্ষতি হতে পারে। এমন একটা আশঙ্কা আপনার ছিল। তাই এমন কিছু আপনি জানেন যা আমরা এখনও জানি না। সেদিন মি. মর্লের চেম্বারে যারা ছিলেন তাদের সবার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। কথাও বলেছি। সেদিন যারা ওখানে ছিলেন তাদের কোনো একজনের সঙ্গে আপনার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আমার ধারণা তিনি হলেন আমেরিকান ভদ্রলোক হাওয়ার্ড রেইকস। পোয়ারো একটু থেমে আবার বললেন আমি তার সঙ্গে দেখা করেছি। সাংঘাতিক মানুষ তিনি এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
জেন বিষণ্ণ সুরে বলল–ঠিক আছে, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার কাছে আমি হার মানলাম। আপনি সঠিক পথে এগোচ্ছেন।
জেন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসল। তারপর নিচু স্বরে বলতে থাকল–আমি সব বলছি। আমি হাওয়ার্ড রেইকসকে পাগলের মতো ভালবাসি। আমার মা সব জানতেন। তাই তিনি পছন্দ করতেন না যে আমি ওর সঙ্গে মেলামেশা করি। আমাকে এখানে আনার পিছনে মায়ের দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হল রেইকসের কাছ থেকে আমাকে দূরে রাখা। অন্যটি হল অ্যালিস্টেয়ার কাকা মারা যাবার পর তার সব সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা, আমার কাকিমা রেবেকা আর্নহোস্টের বোন হলেন আমার মায়ের মা। অ্যালিস্টেয়ার কাকা নিঃসন্তান। এছাড়া তাদের আমরা ছাড়া কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তাই মায়ের দাবি একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে আমাকে তার সম্পত্তি দিতে হবে। তবে পদমর্যাদায় কোনো দিনই আমরা কাকার সমকক্ষ হতে পারব না।
জেন কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে চলল–আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। এতদিনের সব পরিকল্পনা হাওয়ার্ড ভেস্তে দিতে চায়। সব ও ঘৃণা করে। আমি অ্যালিস্টেয়ার কাকাকে ভালোবাসি, তবে মাঝে মধ্যে তার আচরণ আমাকে দ্বিধা বিভক্ত করে তোলে। তখন ভাবি হাওয়ার্ডের কথাই ঠিক। তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়াই উচিত। তা–হলে আমরা উন্নতির মুখ দেখতে পাব না। উন্নতির পথের কাঁটা হয়ে রয়েছেন তিনি।
–মি. রেইকসের মৃত্যুদশী হয়েই কি আপনার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে?
–হয়তো তাই, আবার হয়তো না। হাওয়ার্ড উগ্র প্রকৃতির মানুষ। অ্যালিস্টেয়ার কাকার কথা শুনলে হয়তো ওকে পাল্টানো যেত। ওরা বিশ্বাস করে পুরোনো ধ্যান ধারণায় চললে আমাদের দেশ আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই পিছনে না তাকিয়ে এগিয়ে চলতে হবে আমাদের। সেই কারণে প্রথমেই সরতে হবে অ্যালিস্টেয়ার কাকাকে।
–খুবই চিত্তাকর্ষক মতবাদ। –আপনিও আমাকে ভুল বুঝছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
হয়তো আমার বয়স হয়েছে, তাই ওদের কাছে আমার মতো বুড়োদের স্বপ্ন অতীত ইতিহাস হয়ে যায়।
পোয়ারো মাথা চুলকে বললেন–সেদিন মি. রেইকস কেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন? দাঁতের কোনো সমস্যা?
না, সেটা নয়। আমার ইচ্ছে ছিল তার সঙ্গে কাকার আলাপ করিয়ে দেওয়া। আলাপ হলে ও বুঝতে তিনি কত ভালো মানুষ, তিনি ঘৃণার পাত্র নন। এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না আমার কাছে। কেন না মা জানতে পারলে সব পণ্ড করে দিতেন।
তারপর আপনার ভয় পাবার কারণ কি ছিল?
জেন চোখ দুটো বন্ধ করল। কোনোরকমে বলল–কারণ হল, মাঝেমধ্যে হাওয়ার্ড বড় নিষ্ঠুর হয়ে যায়। সে তখন বদ্ধপরিকর
–একেবারে শেষ করে দেবার।
জেন আর্তনাদ করে উঠল
না, না।
০৪. সাত, আট, সাজানোর পাট
মিঃ মর্লের মৃত্যুর পর একমাস কেটে গেছে। আর মিস সেইনসবরি সীল? সে আজও পলাতক। তার খোঁজ এখনও চলছে।
চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন! একদিন তিনি বিরক্ত হয়ে এরকুল পোয়ারোকে বললেন–মহিলাটি যদি জীবিত থাকেন, তাহলে কোথায় থাকতে পারেন বলে আপনার মনে হয়। আর যদি মারা যায় তাহলে তার লাশ কে গায়েব করল? আর যদি আত্মহত্যা করে থাকেন তাহলে?
পোয়ারো তার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন–আবার একটা আত্মহত্যার কেস সাজাচ্ছেন, বন্ধু।
–এটা ঠিক বললেন না। আপনার বিশ্বাস মর্লেকে হত্যা করা হয়েছে। আর আমি প্রমাণ করেছি তিনি আত্মহত্যাই করেছেন।
–আপনারা পিস্তলটার মালিকের খোঁজ পেয়েছেন?
–না, ওটা বিদেশী জিনিস।
তা আমি অস্বীকার করছি না। আমার বক্তব্য ওটা এল কোথা থেকে? ওটার মালিক কে?
–ওটার মালিক মর্লে নিজে। তিনি ওটা বিদেশ থেকে কিনেছিলেন হয়তো। জাহাজে চড়ে তিনি ও তার বোন বহুবার বিদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বিদেশে গেলে বহু লোকই এরকম পিস্তল কেনেন। বিদেশী জিনিস কেনা মর্লের একটা নেশাও হতে পারে।
জ্যাপ দম নেবার জন্যে থামলেন। আবার বলা শুরু করলেন–আমি নিশ্চতভাবে কিছু বলিনি। আমি যদির ওপর জোড় দিয়ে বলছি। ধরুন যদি মিস সীল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে থাকেন অথবা কেউ তাকে নদীতে ফেলে দিয়ে খুন করে থাকেন তাহলে তার দেহ জলে ভেসে উঠবে।
পোয়ারো তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন–যদি না তার দেহে ভারী কিছু বেঁধে টেমসের জলে ফেলে দেওয়া হয়।
জ্যাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–আপনি এটাও বলবেন, কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীরা খুন করেছে নিশ্চয়ই?
পোয়ারো বললেন–এরকম কিছু ঘটনা খবরের কাগজে ছাপাও হয়। লোকমুখে তা প্রচারও পায়।
কার কাছে আপনি শুনেছেন?
–মি-রেজিনাল্ড বার্নেসের মুখে শুনেছি। ক্যানেল গার্ডেন রোড, ইলিংসে তার বাড়ি।
জ্যাপ সন্দিগ্ধ মনে বললেন তিনি জানাতে পারেন। যখন তিনি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ছিলেন, তখন তিনি এদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
–আপনি মানতে পারছেন না।
এসব আমার ডিপার্টমেন্টের আওতায় পড়ে না। এসব থাকতে পারে। কিন্তু তারা সব ক্ষেত্রে সফল হতে পারে না।
পোয়ারো একথার কোনো জবাব দিলেন না। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। হঠাৎ জ্যাপ বললেন–আমাদের হাতে আরও কিছু তথ্য এসেছে। ওই মহিলার সঙ্গে আগে থেকেই মি. অ্যামবেরিওটিসের পরিচয় ছিল। তারা দুজনে একই দিনে একই জাহাজে ভারত থেকে এসেছিলেন। তবে অ্যামবেরিওটিস ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী ছিলেন। আর উনি ছিলেন সেকেণ্ড ক্লাসের। এতে সন্দেহ করার মতো কিছু নেই। তবে ওই মহিলার সঙ্গে লোকটির দেখা হয়েছিল তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগে। এক মধ্যাহ্নভোজের আসরে। সম্ভবত সেটাই ছিল তাদের শেষ দেখা।
–তাহলে বলছেন দু’জনের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিল?
–হয়তো ছিল–তবে আমার ধারণা অন্য। কোনো মিশনারী এরকম জঘন্য ব্যাপারে জড়িত থাকতে পারেন না।
আপনার মতে অ্যামবেরিওটিস ওই ব্যাপারে জড়িত?
— হ্যাঁ, ঠিক তাই। মধ্য ইউরোপে তার কিছু বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ভুলে যাবেন না গুপ্তচর বৃত্তি তার পেশা ছিল।
–এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিত?
–অবশ্যই। তিনি নিজে কোনো নোংরা কাজে লিপ্ত ছিলেন না। তার কাজ ছিল খবর দেওয়া নেওয়া। কিন্তু তাকে প্রমাণের অভাবে ধরা যেত না। কিন্তু এই চক্রের সঙ্গে মিস সীল যুক্ত ছিলেন না।
পোয়ারো তীব্রস্বরে বললেন ভুলে যাবেন না, মিস সীল বহু বছর ভারতে বসবাস করেছিলেন।
জ্যাপ বললেন–আমি ভাবতে পারছি না অ্যামবেরিওটিস ও মিস সীল একসঙ্গে থাকতে পারেন?
পোয়ারো বললেন–আপনি নিশ্চয় জানেন না, মিস সীল ও মৃতা মিসেস অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারা দুজনে খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।
জ্যাপ বললেন–আমি বিশ্বাস করি না তারা দুজনে দুই মেরুর বাসিন্দা। আপনি বিশ্বাস না করতে পারেন। তবে মি. ব্লাস্ট নিজের মুখে একথা বলেছেন আমাকে।
জ্যাপ বললেন–ওহ, মি. ব্লাস্ট বলেছেন? তা উনি এসব জানতে পারেন। সত্যিই যদি মিস সীল মারা যান অথবা জীবিত থাকেন তাহলে কোথায় আছেন তিনি? গত মাসে কাগজে ছাপা হয়েছে তার ছবি ও বিবরণ।
–আপনার লোকেরাও তার সন্ধান করতে পারেনি? অনেক জায়গায় খোঁজ করেছে। ইংল্যাণ্ডের প্রতিটি লোককে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, মাঝবয়সি জলপাই রঙের কার্ডিগান পরা কোনো মহিলাকে দেখলে ছুটে গেছে তার কাছে। ছবির সঙ্গে ওই মহিলার মিল খোঁজার চেষ্টা করেছে। যেখানে যেখানে মিস সীলের যাওয়ার সম্ভাবনা সেখানে সেখানে আমার লোক গেছে। ইয়র্কসায়ার থেকে লিভারপুল, কোথাও বাদ রাখেনি। ওই মহিলার বিবরণ অনুযায়ী কেউ কোনো খবর দিলেই আমার লোকেরা সেখানে গিয়ে হাজির। তল্লাসি চালিয়েছে কিন্তু সব পরিশ্রম বিফল হয়েছে।
পোয়ারো সহানুভূতি জানালেন। জ্যাপ আবার বলতে শুরু করলেন ভদ্রমহিলা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমার কাছে খবর আছে তার অতীত জীবনেও কোনো কলঙ্ক ছিল না। অথচ তিনি বেপাত্তা।
পোয়ারো বললেন–অবশ্যই এর পেছনে কোন চাল আছে।
জ্যাপ বললেন–আপনি বলতে চাইছেন উনি মি. মর্লেকে গুলি ক. পাকতে পারেন। অথচ আপনি জানেন উনি চলে যাওয়ার পরেও অ্যামবেরিওটিস মর্লেকে জীবিত দেখেছেন।
পোয়ারো তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন–আমি একথা বলিনি।
জ্যাপ বললেন–তাহলে আপনি বলতে চাইছেন মর্লের ব্যাপারে অ্যামবেরিওটিস মিস সীলকে কিছু বলেছেন। সে যাতে বাইরের কাউকে জানাতে না পারে তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হল। পোয়ারো বললেন–এসব কোনো পাকা খেলোয়ারের কাজ। আর এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত আছে। তা না-হলে এক নিরীহ সহজ সরল দাঁতের ডাক্তারকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হত না।
জ্যাপ বললেন–রেজিনান্ড বার্নেসকে একদম পাত্তা দেবেন না। উনি আজেবাজে খবর সংগ্রহ করেন। উনি লোককে ঠকিয়ে আনন্দ পান। গুপ্তচরগিরি ও রাজনীতির বুলি আওড়ানো ছাড়া ওনার কাছে আর কিছু পাবেন না। জ্যাপ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–চলি বন্ধু, ও নিয়ে আর বৃথা চিন্তা করবেন না। যথাসময়ে সব জানতে পারবেন। জ্যাপ বিদায় নিলেন। পোয়ারোর চোখ গেল সামনের টেবিলের দিকে। ভ্রু কুঁচকে তিনি সেদিকেই তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি ভাবছেন, অনেকগুলো নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বহু তথ্যও এসেছে হাতের মুঠোয়। তবুও বার বার মনে হচ্ছে কি যেন একটা বাদ যাচ্ছে। ঠিক মতো সাজাতে পারছেন না কেসটা। এরপরের কাজটাইবা কি হবে? কিছুই বুঝতে পারছেন না। চিন্তারা সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে তাঁর মাথার ভেতর।
সন্ধ্যার একটু পরেই পোয়ারো একটি দুঃসংবাদ পেলেন। জ্যাপ টেলিফোনে সেই সংবাদ দিয়েছেন। মিস সেইনসবারি সীলের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে তিনি মৃত। এখুনি তাকে কিং লিওপোল্ড ম্যানসনস, ব্যটারসি পার্ক, পঁয়তাল্লিশ নম্বর ফ্ল্যাটে হাজির হতে হবে। মিনিট পনেরোর মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন এরকুল পোয়ারো। কিং লিওগোল্ড ম্যানসানসের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
বহুতল বাড়িটিতে অনেকগুলো ফ্ল্যাট। তিনতলায় রয়েছে পঁয়তাল্লিশ নম্বর ফ্ল্যাটটি। ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাতেই জ্যাপ দরজাটা খুলে দিলেন। তার মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। তিনি বললেন–আসুন পোয়ারো। যেটা দেখাবার জন্য আপনাকে ডেকে এনেছি সেটা ঠিক আশা করিনি আমি। তবে আপনার একবার দেখা উচিত। পোয়ারো গম্ভীর মুখে বললেন–কিরকম অবস্থায় আছেন?
-একদম মরে কাঠ। মনে হয় একমাস আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
পোরারো তার ডানদিকে পরিচিত একটা শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে চোখ রাখলেন।
জ্যাপ বললেন–এখানকার পোর্টার। সে অসুস্থ। রান্নাঘরের পাশের ঘরে সে শুয়েছিল। মৃতদেহ সনাক্তকরণের কাজটা ওকে দিয়েই সারলাম।
তারা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চললেন। পোয়ারোর নাকে একটা দুর্গন্ধ এল। তিনি রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরলেন।
তাঁরা ছোট একটা ঘরে এসে ঢুকলেন। সেই ঘরে রয়েছে ডালা খোলা একটি সিন্দুক।
জ্যাপের ইশারায় পোয়ারো সিন্দুকের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার ভেতরে চোখ রাখলেন। প্রথমেই তার চোখে পড়ল পা ও ছাতার বকলস। তখন সেদিনের কথা তার মনে পড়ে গেল। যেদিন মি. মর্লে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। সেদিনও তিনি মিস সেইনসবারি সীলের এই বকলসই দেখেছিলেন। একে একে তার নজরে এল সবুজ পশমি কোর্ট, স্কার্ট ও মাথা। দৃশ্যটা দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হল।
মৃতার মুখ শক্ত ও ভারী কোনো বস্তুর আঘাতে থেতলে গিয়েছিল। তাতে পচন ধরায় আরও বীভৎস রূপ নিয়েছিল। দুজনেই ওই দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
জ্যাপ বললেন, আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম এই নিয়ে। আমরা এসবে অভ্যস্ত। বেশ বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই দৃশ্যটা বেদনাদায়ক। পাশের ঘরে বসবেন চলুন। ওঘরে ব্র্যান্ডি রাখা আছে। একটু খেয়ে নেবেন।
পাশের ঘরটা বসবার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঘরটা সুন্দরভাবে সাজানো, বড় বড় কয়েকটি সোফা ও জ্যামিতিক আকারের আসবাবপত্রে ঠাসা ঘরটি।
পোয়ারো বোতল থেকে কিছুটা ব্র্যান্ডি একটি গ্লাসে ঢাললেন। খানিকটা গলায় ঢেলে তিনি বললেন, এবার বলুন বন্ধু, আমি প্রস্তুত।
জ্যাপ বলতে শুরু করলেন, এই ফ্ল্যাটের মালিক মিসেস অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান। বছর চল্লিশের মহিলা। মাথা ভর্তি সোনালি চুল। উদার হাতে টাকা খরচ করেন। ব্রিজ খেলতে ভালোবাসেন, তিনি নিঃসন্তান। তাই একাকীত্ব তার সয়ে গেছে। তিনি একজন বানিজ্যিক পর্যটক। যেদিন আমরা মিস সীলের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছিলাম, সেই দিন সন্ধ্যায় তিনি এখানে এসেছিলেন। পোর্টার তাকে পথ দেখিয়ে ওই ফ্ল্যট নিয়ে গিয়েছিল, তখনই পোর্টারের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, তার সময়টা মনে আছে তো?
তার অসুখ করেছিল। তাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। মাত্র এক সপ্তাহ আগের কথা। সে একটি কাগজের নিরুদ্দেশ কলামে বিজ্ঞাপন দেখে। নিরুদ্দিষ্টার ছবি দেখে ও বিবরণ পড়ে সে মিস সীলকে চিনতে পারে। সে তার স্ত্রীকে বলেছিল, যে মহিলা দোতলায় মিসেস চ্যাপমানের ফ্ল্যাটে রয়েছেন ইনিই সে। এই কাগজের বর্ণনার সঙ্গে ওই মহিলার ছবি, পোশাক একেবারে মিলে যাচ্ছে। এমনকি ওই জুতোর বকলসটা হুবহু এক। মহিলার নামও তখন তার মনে পড়েছিল।
জ্যাপ জোরে শ্বাস নিলেন। আবার শুরু করলেন বলা, পোর্টার লোকটি প্রথমে বুঝতে পারেনি কি করবে? পুলিশে খরব দেবে না গোপন রাখবে। শেষে মনস্থির করে সে পুলিশে জানায়। সত্যিই এখানে একটা চমক লুকিয়ে আছে তা আমি ভাবিনি। আমারতো কর্তব্যে অবহেলা করলে হবে না। তাই সেই লোকটির কথামতো আমি বেড়োর্জকে এখানে পাঠাই। সে খুব ভালো মানুষ। কাজে কর্মে মন আছে। বেডোর্জও অনুমান করেছিল এবার নিশ্চয় কোনো সূত্র পাওয়া যাবে। কেন না আমরা জানতে পেরেছি মিসেস চ্যাপম্যান একমাস ধরে ওই ফ্ল্যাটে আসছেন না। তিনি কোনো ঠিকানাও রেখে যাননি, তার দরজার সামনে বড় বড় করে লেখা : নেমি, একটা বিশেষ কাজে আমাকে হঠাৎ যেতে হচ্ছে। তুমি গোয়ালাকে বলে দিও আর দুধ লাগবে না। আশ্চর্য বিষয় হল তিনি মালপত্র বয়ে দেওয়ার জন্য পোর্টারকে ডাকেননি অথবা ট্যাক্সি ডাকার কথাও বলেননি।
এদিকে মিস সেইনসবারি সীলকে কেউ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেনি। তবে কি তিনি সকলের চোখের আড়ালে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছেন? এটাও অবান্তর প্রশ্ন নয়।
নেমি মিসেস চ্যাপম্যানের পরিচারিকা। সে রোজকার মতো সেদিনও এসেছিল। সে নোটিশ বোর্ডটা দেখেছিল। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। সে জানত মিসেস চ্যাপম্যাম এভাবে বহুবার চলে গেছেন। তাই সে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। সার্জেন্ট বেডোর্জের ইচ্ছে ছিল ফ্ল্যাটে ঢুকে তল্লাশি করার। আমরা একটা সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ম্যানেজারকে দেখাই এবং ডুপ্লিকেট চাবি চাই। চাবি দিয়ে ঘর খুলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের এক কোণে একটা সিন্দুক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। তবে বাথরুমে লিনোলিয়ামের উপর সামান্য রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। তখন আমাদের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। বেডোর্জ বলল, স্যার, আমি নিশ্চিত দেহটা এখানেই আছে। দেহ খোঁজার পালা এবার। বেডোর্জ সিন্দুকের চাবি আবিষ্কার করল। সেই চাবি দিয়ে তালা খোলা হয়। তালা খুলতেই হারিয়ে যাওয়া মিস সীলের দেহ সকলের দৃষ্টিগোচর হল।
পোয়ারো জানতে চাইলেন, মিসেস চ্যাপম্যান কোথায় যেতে পারেন বলে আপনার মনে হয়, বন্ধু? হয়তো এই মৃতদেহ মিসেস চ্যাপম্যানের। তাকে কেউ খুন করে বাক্সে ঢুকিয়ে রেখেছে। আর আমরা মিস সীল বলে মনে করছি।
পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে বললেন–মুখ বিকৃত করার অর্থ কি?
–সঠিক বলতে পারব না। তবে অনুমানের ভিত্তিতে বলতে পারি, নিছক বিকৃত ঈর্ষা বা লালসা মেটানোর জন্য। আর একটি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না, সেটা হল মহিলার পরিচয় গোপন রাখার জন্যই এরকম করা হয়েছে। এতে তার পরিচয় গোপন রয়েছে কি?
–না, কারণ আমরা জেনেছি মিস ম্যাবেল সেইনসবারি সীল কি পোশাক পড়ে বাইরে বেরিয়েছিলেন। তার হাতে একটি ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগ থেকে একটি পুরোনো চিঠি পাওয়া গেছে। যেটা রাসেল স্কোয়ার থেকে পাঠানো হয়েছিল।
–এর থেকে কি প্রমাণিত হয়?
–কিছুই না। হয়তো এটাও মস্তবড় একটা ভুল। পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন, বললেন ভুল? হয়তো তাই। আপনারা ফ্ল্যাটের সব কিছু নিখুঁত ভাবে দেখেছেন? হ্যাঁ, বন্ধু, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। আমি মিসেস চ্যাপম্যানের শোবার ঘরটা দেখব।
জ্যাপ ও পোয়ারো শোবার ঘরে এলেন। ঘরটি নিপুণ হাতে সাজানো। পরিপাটি করে বিছানা পাতা। বোঝা যাচ্ছে এখানে অনেকদিন কেউ ঘুমোননি। চারদিকে শুধু ধুলো আর ধুলো।
জ্যাপ বললেন–আমরা খুব ভালোভাবে দেখেছি। কোথাও হাতের ছাপের চিহ্নমাত্র নেই। বাসনপত্রের গায়ে কিছু হাতের ছাপ রয়েছে। তবে তা হয়তো ওই পরিচারিকা নেমির হবে।
অর্থাৎ খুনের পর সব প্রমাণ মুছে লোপাট করে দিয়েছে। হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
পোয়ারো মিসেস চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন, বসার ঘর সাজানোতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে। আসবাবপত্রের দাম খুব কম হলেও দেখতে খুব সুন্দর, একটা দেয়াল আলমারি রয়েছে। সেটা কম দামি পোশাকে ভরা। তবে প্রত্যেকটি অতি মনোরম। সুর্যাকে কয়েকজোড়া জুতো রয়েছে। পোয়ারো একটা জুতো তুলে নিয়ে দেখলেন। সেটির নম্বর পাঁচ। দেয়ালের এককোণে একটি লোমের কোটের ওপর তার নজর আটকে গেল। এছাড়া ড্রেসিং টেবিলে বেশ কিছু দামি প্রসাধনী রয়েছে। রুজ, পাউডার, ভ্যানিসিং ক্রিম, শ্যাম্পু, লিপস্টিক, নেলপালিশ সবই আছে।
পোয়ারো মজার সুরে বললেন–ভদ্রমহিলা চল্লিশটি বসন্ত পাড় করেছেন। চুলে রূপালির আভাস। তবুও তিনি প্রকৃতির নিয়ম মানতে রাজি নন। জ্যাপ প্রশ্ন করলেন, আপনি কি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন? না, না, কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। কথা বলতে বলতে তিনি এগিয়ে গেলেন সিন্দুকটার দিকে। মৃতার পায়ের জুতো খুলে নিলেন। বকলসটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। বকলসটা খুলে গিয়েছিল, আবার সেটাকে সেলাই করা হয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছে হাতে সেলাই করা হয়েছে।
পোয়ারো জোরে শ্বাস ফেললেন। পরে বললেন আমার কাছে এসব ধাঁধাঁর মতো লাগছে। জ্যাপ বিরক্ত হয়ে বললেন–আপনার মতলব কি বলুন তো? সামান্য একটা বকলস নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করতে চাইছেন? পোয়ারো হেসে বললেন, ঠিক তাই। জ্যাপ বললেন–এতে গণ্ডগোলের কি আছে? পোয়ারো বললেন–সেটাই আমি বোঝার চেষ্টা করছি।
এরকুল পোয়ারো পোর্টারের কাছে জেনেছেন মিসেস চ্যাপম্যানের প্রিয় বান্ধবী হলেন মিসেস মারটন। তিনি থাকেন ৮২, কিং লিওপোল্ড ম্যানসনসে। জ্যাপ ও পোয়ারো সেখানে উপস্থিত হলেন।
মিসেস মারটন কথা বলায় পটু। কালো দুটি গভীর চোখ। সুবিন্যস্ত এক মাথা চুল। তার মুখ দিয়ে কথা বার করার জন্য কোনো কসরতের প্রয়োজন হল না। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই জ্যাপ সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলেন মিসেস সিলভিয়া চ্যাপম্যান কি আপনার পরিচিত?
সিলভিয়া চ্যাপম্যান? ভদ্রমহিলা একটু ভাবলেন। তারপর বললেন হ্যাঁ, তাকে চিনি। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যেবেলায় ব্রিজ খেলতাম আমরা, একসঙ্গে আমরা দু’জনে ছবিও দেখেছি কতবার, কেনাকাটাও করেছি দু’জনে। কিন্তু, বলুন তো কি হয়েছে? তার কোনো অঘটন ঘটেনি তো? জ্যাপ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, না, না ওসব কিছু হয়নি। আপনি বিচলিত হবেন না।–যাক শুনে আশ্বস্ত হলাম। সত্যি কথা বলতে কি, কিছুক্ষণ আগে একটা খবর আমার কানে এল। এক ডাকপিওন বলছিল কোনো ফ্ল্যাট থেকে একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তবে নোকমুখে শুনেছি তাই বিশ্বাস করতে পারছি না। জ্যাপ বললেন মিসেস চ্যাপম্যান সম্পর্কে আপনি কি জানেন? বিশেষ কিছুই না। তিনি চলে যাবার পরও কিছু শুনিনি। তিনি হঠাৎ চলে যান, তাই বোধহয় আমাকে বলার সুযোগ পাননি। এছাড়া আমাদের রোজার্সে যাবার কথা ছিল। মিসেস চ্যাপম্যান মিস সেইনসবারি সীল সম্পর্কিত কোন কথা আপনাদের কাছে বলেছেন?
-নামটা যেন চেনা চেনা লাগছে। কোথায় মনে হয় শুনেছি। জ্যাপ রুক্ষস্বরে বললেন কাগজে দেখতে পারেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই খবরটি কাগজে ছাপা হচ্ছে। হা, হা মনে পড়েছে। নিরুদ্দেশের কলামে দেখেছি। তবে আপনি বলছেন চ্যাপম্যান ওই মহিলাকে চেনেন। অসম্ভব কথা, সিলভিয়া কখনো ওই নাম আমাদের কাছে বলেননি, অফিসার। মিসেস মারটন, মি. চ্যাপম্যান সম্পর্কে কিছু জানেন? মিসেস মারটনের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। কোনোরকমে ঢোক গিলে তিনি বললেন, মিসেস চ্যাপম্যান একবার বলেছিলেন তার স্বামীকে ব্যবসার খাতিরে দেশের বাইরে প্রায়ই যেতে হয়। তিনি যে সংস্থায় চাকরি করতেন, সেই সংস্থার তৈরি অস্ত্র সারা ইউরোপের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হত। তাই মি. চ্যাপম্যানকে বেশির ভাগ সময় ইউরোপে থাকতে হত।
তার সঙ্গে আপনার আলাপ আছে? না, কখনো না। বাড়িতে তিনি খুব কম আসতেন। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই প্রতিবেশীদের নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। মিসেস চ্যাপম্যানের অন্তরঙ্গ কেউ আছে কি? অন্তরঙ্গ বলতে কোনো বন্ধু বান্ধব বা নিকট আত্মীয় কেউ ছিলেন?–না। অন্তত সিলভিয়া কখনো বলেননি।
সিলভিয়া কখনো এদের সম্পর্কে কিছু বলেনি। সুতরাং আমিও জানি না।
-উনি কি কখনো ভারতে গিয়েছিলেন?
দুঃখিত, আমি এতসব জানি না। মিসেস মারটনের চোখ মুখের ভাব বদলে গেল। তিনি সন্ধিগ্ধ স্বরে বললেন আপনারা কে? আপনারা কি স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে এসেছেন। আর আমাকেই বা এত জেরা করছেন কেন? নিশ্চয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে?
জ্যাপ বললেন, হ্যাঁ আপনার অনুমানই ঠিক, মিসেস মারটন। চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটে একটি মৃতদেহ পেয়েছি আমরা।
মিসেস মারটন বিস্ফারিত নেত্রে বললেন–ওহ গড! মৃতদেহ! কার হতে পারে? কোনো পুরুষের কি? জ্যাপ বললেন–না, এটি একটি স্ত্রীলোকের দেহ, পুরুষের নয়!
মিসেস মারটন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–আশ্চর্য, স্ত্রীলোক?
এবার পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–দেহটা কোনো পুরুষের হবে ভাবলেন কেন?
–সেটাই স্বাভাবিক।
-কিন্তু কেন? মিসেস চ্যাপম্যান কি কোনো পুরুষ ভদ্রলোকদের তার ফ্ল্যাটে আপ্যায়ন করতেন?
মিসেস মারটন রুষ্ট হয়ে বললেন–আপনি ভুল করছেন। আমি এমন কথা বলিনি। সিলভিয়া নোংরা চরিত্রের মহিলা নয়। পোয়ারো বললেন মিসেস মারটন, আপনি আমাদের অনেক কিছুই গোপন করছেন।
মিসেস মারটন একটু অসন্তুষ্ট হলেন। কি করব বলুন তো। যে আমাকে বিশ্বাস করে তার অমর্যাদা করা উচিত হবে কি। তার কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ঘনিষ্ঠ দু-একজন ছাড়া অন্যদের বলা নিষেধ।
জ্যাপ বললেন–কি এমন কথা তিনি আপনাকে বলেছেন যা আমাদের বলতে দ্বিধা করছেন মিসেস মারটন?
মিসেস মারটন নিচু স্বরে বলতে লাগলেন–একদিন কথা প্রসঙ্গে তার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে যে তার স্বামী মি. চ্যাপম্যান সিক্রেট সার্ভিসে রয়েছেন। এইজন্য তাকে বিদেশে থাকতে হত বেশি। তিনি মিথ্যে করে বলতেন অস্ত্র বিক্রি করেন। এই কাজটা মিসেস চ্যাপম্যানের পছন্দ নয়। সরাসরি স্বামীকে চিঠি লিখতে পারতেন না বলে তিনি রাগ করতেন। মি. চ্যাপম্যানের কাজটা নাকি খুব বিপজ্জনক। তাই তিনি আমাকে শপথ করিয়ে নেন কথাটা কাউকে না বলার জন্য।
এরকুল পোয়ারা ও চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ বেরিয়ে এলেন মিসেস মারটনের ফ্ল্যাট থেকে। মিসেস মারটনের জবাবদিহি জ্যাপকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন নাঃ কোনো সুরাহা হল না। এবার আমার মাথাটাই খারাপ হবে দেখছি। তারা দু’জনে মিসেস চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেখানে তরুণ অফিসার বেডোর্জ অপেক্ষা করছিল। সে সম্ভ্রমে বলল–স্যার, নেমি স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। মিসেস চ্যাপম্যান কাজের লোককে বেশিদিন রাখতে পছন্দ করতেন না। ঘন ঘন বদলাতেন। দুতিন মাস ধরে মেয়েটি কাজ করছে এখানে। ওর বয়ান অনুযায়ী মিসেস চ্যাপম্যান সরল সাদাসিধে মানুষ। সর্বক্ষণ রেডিও শুনে কাটিয়ে দিতেন। ওর স্বামী ধাপ্পাবাজ লোক। অহরহ মিথ্যে বলতেন। কিন্তু তিনি রাগ বা অভিমান করতেন না। জার্মানি, রাশিয়া, আমেরিকা থেকে প্রচুর চিঠি আসত তার কাছে।
মিসেস চ্যাপম্যানের চিঠিপত্রের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে। সাধারণ কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে। তার মধ্যে কয়েকটা বিল; কিছু রসিদ, পুরোনো নাটকের বিজ্ঞাপন জেনানা মিশনের হ্যাঁণ্ডবিল। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি।
সেগুলো কার মারফত আসছে কিংবা নিজেই আনছেন, তা কিছু বোঝা গেল? অচেনা কোনো লোককে আশে পাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে?
না, স্যার, পোর্টার কিছু বলতে পারেনি বলাও সম্ভব না, বাড়িটা এত বড় আর এত লোক যাতায়াত করছে, বোঝা মুশকিল কে কোন মতলবে আসছে বা যাচ্ছে।
অন্যান্য ফ্ল্যাটের কেউ কিছু বলেছে?
–না, স্যার। এমন সময় ডিভিশনাল সার্জেন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তার নাক চাপা রুমালে। তিনি তিক্ত স্বরে বললেন,
–কি বিশ্রী গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠছে। তাড়াতাড়ি দেহটা মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
মৃত্যুর কারণ বোঝা গেল, ডাক্তার?
আগে ময়না তদন্ত হোক, তারপর যা বলার বলব। তবে এই মুহূর্তে বলতে পারি, খুনের পর মুখে আঘাত করা হয়েছে। শরীরের অন্য কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা দেখতে হবে। নিরুদ্দিষ্ট এক মহিলার কথা শুনেছি। ইনিই যে তিনি সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ। ডাক্তার চলে গেলেন।
পোয়ারো ডেস্কের কাছে গেলেন। তাতে কিছু কাগজ-পত্র ছিল। তার মধ্যে থেকে তিনি একটি ছোট্ট বই তুলে নিলেন। বইটিতে বাদামী রঙের মলাট দেওয়া। বইটির ওপর একটা ঠিকানা লেখা ছিল। বেডোর্জ হেসে বলল, ওটা কোনো উপকারে লাগবে না। ওতে কয়েকটি দর্জির দোকানের নাম ও ঠিকানা আছে।
পোয়ারো ইংরেজি ডি নম্বর দেওয়া পাতাটি খুললেন।
তিনি পড়তে শুরু করলেন–ডঃ ডেভিস, ১৭ প্রিন্স অ্যালবার্ট রোড, ড্রেক ও পমপনেটি, মাছ বিক্রেতা। তার নিচে দু’লাইন ছেড়ে লেখা দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লে, ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিট।
পোয়ারেরে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি বললেন-মৃতদেহ সনাক্ত করতে কোনো বেগ পেতে হবে না। জ্যাপ ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন পোয়ারের দিকে। বললেন–আপনি সত্যিই কিছু ভাবছেন?
পোয়ারো তীব্র স্বরে বললেন–অবশ্যই। আমি নিশ্চিত লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইছি।
মিস জর্জিনা মর্লে ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর গ্রাম হার্টকোর্ডে ফিরে যান। সেখানে তার একটি ছোট্ট কুঁড়ে আছে।
একদিন এরকুল পোয়ারো তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি পোয়ারোকে খুশি মনে স্বাগত জানালেন। তার চেহারার মধ্যে রুক্ষতা ফুটে উঠেছে। আগের থেকে তিনি আরও কঠিন হয়েছেন। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জেগেছে তাঁর। ভাইয়ের পেশাদারি জীবনে কলঙ্ক লাগায় তিনি খুবই দুঃখ পেয়েছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন বিচারকের রায় অসত্য। তিনি এও মনে করেন পোয়ারোও এই বিচারের রায়ে খুশি হননি। তাই তিনি পোয়ারোর প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিলেন হাসি মুখে। পোয়ারো প্রশ্ন করলেন মি. মর্লের কাগজপত্র কি আপনার কাছে আছে?
না, ওগুলো সব গ্ল্যাডিসের হেফাজতে আছে। সে যত্ন করে সেগুলি গুছিয়ে রেখেছে।
–মি. মর্লের রোগীদের খরব রাখেন?
না, তেমনভাবে না, গোড়াতে শুনেছিলাম কিছু রোগী মি. রেইলিকে দেখান। আবার কেউ কেউ অন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন।
আপনি নিশ্চয় জানেন, মিস সেইনসবারি সীল কিছুদিন ধরে নিরুদ্দেশ। তার খোঁজ আমরা পেয়েছি।
–শেষ পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করলেন আপনারা। সে এখন কি অবস্থায় আছে?
–তাকে খুন করা হয়েছে?
–তাকেও খুন করা হয়েছে! তাকেও কথাটার ওপর বেশ জোর দিলেন তিনি। পোয়ারো বললেন মি. মর্লে তার কথা আলাদাভাবে কিছু বলেছে আপনাকে?
আমি মনে করতে পারছি না। নিশ্চয় সে শান্তশিষ্ট ভদ্র রোগী ছিল, তা না-হলে আমায় বলত।-আচ্ছা, আপনার কি মনে আছে, মি. মর্লের মুখে চ্যাপম্যান নামে কোনো রোগীর কথা শুনেছেন?–চ্যাপম্যান? না, না, এমন নাম তার কাছে কখনো শুনিনি। এ বিষয়ে আপনি গ্ল্যাডিসকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। হয়তো ও আপনাকে সাহায্য করতে পারে।
তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে আমার আছে। তাকে এখন কোথায় পাব?–সে একটা চাকরি জোগাড় করেছে। র্যামসগেটে এক দন্তচিকিৎসকের চেম্বারে।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে?
–না, আমার মনে হয় না সে তাকে কোনোদিন বিয়ে করবে। ওই ছোকরাকে কেউ পছন্দ করে না। একটা লম্পট। ও ন্যায়নীতির ধার ধারে না। ও নিশ্চয় কোনো দুষ্ট চক্রের হাতে পড়েছে।
–আপনি কি ভাবছেন সে আপনার ভাইকে গুলি করেছে?
মিস মর্লে তিক্ত স্বরে বললেন আমার ভাইয়ের ওপর একাজ করলেও করতে পারে। তবে এটা আসল কারণ নয়। হেনরি ওদের আসল কারণ নয়। হেনরি ওদের মধ্যে বিচ্ছেদ চাইলেও গ্ল্যাডিস ওকে ভীষণ ভালোবাসত। ফ্র্যাঙ্ককে কেউ প্ররোচিত করতে পারে। অথবা মোটা অঙ্কের টাকা পাবার লোভ দেখাতে পারে?
টাকার লোভ? তার মানে আপনি বলছেন ঘুষ নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক আমার ভাইকে খুন করেছে? অবাস্তব চিন্তা-ধারা! ও একাজ করতে পারে না। এমন সময় সুন্দরী একটি মেয়ে ঘরে এসে ঢুকল। তার হাতে একটি ট্রে, সে ট্রে নামিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। পোয়ারো জানতে চাইলেন, এই মেয়েটিকে আপনার লন্ডনের বাড়িতে দেখেছি মনে হয়?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ও অ্যাগনেস। আমার কাছেই থাকে। আমার সব কাজ করে, খুব ভালো রাঁধুনি। তাই আসার সময় সঙ্গে এনেছি।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। তখন তার মানসপটে ভেসে উঠেছে মি. মর্লের ৫৮ কুইন শার্লট স্ট্রিটের বাড়ির ছবি। দুই ভাই-বোন দোতলায় বাস করনে। একতলার ঘরগুলি বন্ধ থাকত। বাড়িতে ঢোকার একমাত্র পথে পাহারায় থাকত অ্যালফ্রেড। তাই তার অলক্ষ্যে ওই বাড়িতে প্রবেশ করা কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না।
রাঁধুনি ও পরিচারিকা বহুদিনের পুরোনো কাজের লোক। এবং বিশ্বস্তও বটে। তারা পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাহায্য করেছে। কোনোরকম বিরক্ত বোধ করেনি।
পোয়ারো বিদায় নিয়ে ঘরের বাইরে এলেন। অ্যাগনেস পোয়ারোর টুপি ও ছড়ি এগিয়ে দিল। সে ভীত সন্ত্রস্ত ভঙ্গীতে জানতে চাইল, স্যার, কর্তার মৃত্যুর কারণ জানতে পেরেছেন?
পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,নতুন কিছু জানা যায়নি।
কর্তা তাহলে ভুল করে ওষুধ দিয়েছিলেন। এবং তার গুরুত্ব বুঝতে পেরে নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন, তাই না, স্যার?
–হ্যাঁ। এসব জেনে তোমার কি লাভ হবে?
অ্যাগনেস নিচু স্বরে বলল–আমার কত্ৰী এই যুক্তি মানতে রাজি নন। পোয়ারো উদগ্রীব হয়ে বললেন–তোমারও একমত?–আমি! না, না, আমি আর কি বলব। আমি শুধু নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলাম। এরকুল পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–আত্মহত্যা শুনলে তুমি কি চিন্তামুক্ত হতে? অ্যাগনেস চটপট উত্তর দিল–হ্যাঁ, স্যার।
এরকুল পোয়ারো ওর চোখে চোখ রাখলেন। দেখলেন, চোখ দুটো আনন্দে চিক চিক করছে। এরকুল পোয়ারো আর প্রশ্ন না করে রাস্তায় নেমে এলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি ভাবলেন, অ্যাগনেসের করা ওই প্রশ্নের আড়ালে কোনো গুঢ়ই তথ্য আছে কি? তিনি নিশ্চিত, এই প্রশ্নের একটা উত্তর আছে। তবে সেটা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন। তবে এটা ভেবে তিনি আশ্বস্ত হলেন যে মি. মর্লের খুনের একটা ধাপ এগোতে পেরেছেন।
পোয়ারো বাড়ি ফিরে এলেন। তার জন্য চমক অপেক্ষায় আছে, যা তিনি কল্পনাও করেননি। তিনি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। দেখতে পেলেন বিরল কেশ ছোটোখাটো চেহারার এক ভদ্রলোককে। তার সঙ্গে পোয়োজরার আগেই আলাপ হয়েছিল। তিনি হলেন মি. বার্নেস। বার্নেসও পোয়ারোকে দেখে সসম্ভ্রমে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখে মিষ্টি হাসির ইশারা। তিনি বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি আমার বাড়ি গিয়েছিলেন তাই আমি কৃতজ্ঞতাবশত এসেছি।
পোয়ারো বললেন মি. বার্নেস, আপনার পদার্পণে আমি ভীষণ আনন্দিত। তিনি এবার জর্জকে হুকুম করলেন, দুকাপ কফি দিয়ে যেতে। কিন্তু বার্নেস কফির থেকে চা হুইস্কি ও সোডা বেশি পছন্দ করেন।
ইতিমধ্যে জর্জ কফি দিয়ে গেছে। কফি পান করার ফাঁকে মি. বার্নেস বললেন আপনার কাছে আমার কিছু জানবার আছে, মঁসিয়ে পোয়ারো এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখেন আপনি, কাগজে বেরিয়েছে নিরুদ্দিষ্ট, মিস সেইনসবারি সীলকে খুঁজে পাওয়া গেছে। অবশ্য এই কৃতিত্ব পুলিশের। তাই আরও প্রমাণের আশায় বিচার থমকে রয়েছে। অতিরিক্ত মাত্রায় মেডিনাল প্রয়োগের ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। পোয়ারো বললেন হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, মি. বার্নেস, আপনি অ্যালবার্ট চ্যাপম্যানকে চেনেন?
–ওহ, যে মহিলার ফ্ল্যাটে মিস সীলের লাশ পাওয়া গেছে। সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মানুষ তিনি। তিনি কে, মি. বার্নেস? ইনকোয়েস্টে এর উত্তর কেউ দিতে পারবে না। হয়তো তারা জানেন না। তারা ওই অস্ত্র কোম্পানির বিক্রেতার গল্প শোনাবে।
–তাহলে সত্যিই তিনি সিক্রেট সার্ভিসে ছিলেন?
–অবশ্যই। তবে মিসেস চ্যাপম্যানকে সত্যি কথা না বললেই ভালো করতেন তিনি। আসলে বিয়ের পর কাউকে এ কাজে রাখা হয় না। তাহলে অ্যালবার্ট চ্যাপমান ছিলেন, পোয়ারোর কথাটা লুফে নিয়ে মি. বার্নেস বললেন–কিউ. এক্স ৯১২। এটাই তার চিহ্নিতকরণ নম্বর। নাম ব্যবহার করার বিষয় নেই। সে বার্তাবাহকের কাজ করতো। ইউরোপের নানা রাষ্ট্রে পাঠানো হত। অনুল্লেখ্য চেহারা হওয়ায় তাকে নিয়ে বিপদের সম্ভাবনা ছিল না। সুবিধাই হতো বেশি। তবে আজ তার অস্তিত্ব আর নেই। তাহলে তিনি প্রচুর গোপণ খবর রাখতেন?
একদম না!
–আপনি বলছেন তিনি বেঁচে নেই?–তাই তো জানি। তবে এ সবই গুজব। বার্নেসের চোখে চোখ রেখে পোয়ারো বললেন তার স্ত্রী এখন কোথায় জানেন? মি. বার্নেস হেসে বললেন আমার ধারণার অতীত। তবে আশা করেছিলাম ওই মহিলার খবর আপনার মুখেই শুনব। পোয়ারো বললেন–আমার ধারণা ছিল । কথা শেষ না করে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। মি. বার্নেস সহানুভূতির সুরে বললেন–বিশেষ কিছু ভাবিয়ে তুলেছে বোধহয় আপনাকে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ। আমার চোখের সামনে জীবন্ত প্রমাণ হাজির। ইতিমধ্যে জ্যাপ পোয়ারোর বসবার ঘরে ঢুকে পড়েছেন। টুপিটা তিনি সজোরে ছুঁড়ে ফেললেন টেবিলের ওপরে। তিনি রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন–এটা কিভাবে বুঝলেন বলুন তো? পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন আপনার একথা বলার অর্থ কি বন্ধু? জ্যাপ চিৎকার করে বললেন–কিসের ভিত্তিতে দেহটা মিস সীলের নয় বলে সনাক্ত করলেন?
প্রশ্নটা পোয়ারোকে চিন্তায় ফেলেছে।–মুখটাই আমার সব গোলমাল করে দিয়েছিল। একজন মৃত মহিলার মুখ এভাবে বিকৃত করার কারণ কি?
জ্যাপ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন আমার বিশ্বাস সাক্ষ্য প্রমাণ লোপাটের জন্য তাকে খুন করা হয়েছে। হেনরি মর্লে বেঁচে থাকলে তিনিই রহস্য ভেদ করতে পারতেন।
লেদারেণ মি. মর্লের উত্তরাধিকারী। যথেষ্ট যোগ্য লোকও বটে সে। তার সাক্ষ্য আমাদের পথের সন্ধান দিতে পারত।
সংবাদপত্রগুলোর সান্ধ্য সংস্করণে উত্তেজক খবর প্রকাশিত হল। কিং লিওগোল্ড ম্যানসনসের ৪৫ নম্বর ফ্ল্যাটে যে মহিলার মৃতদেহ পাওয়া যায় সেটা মিস সেইনসবারি সীলের নয়। যদিও পুলিশ ভেবেছিল ইনিই মিস সীল যাকে একমাস ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ময়না তদন্তে প্রমাণিত হয় ওই দেহটি মিসেস অ্যালবার্ট চ্যাপম্যানের।
০৫. নয়, দশ, রামপাখি বশ
ইনকোয়েস্ট শেয। দুই বন্ধু বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন। জ্যাপের মনে আনন্দের উচ্ছ্বাস। জোরে হেসে উঠে তিনি বললেন–ফাটিয়ে দিয়েছেন মশাই। শিহরণ জাগছে শরীরে।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন পোয়ারো।
জ্যাপ অবার বলতে লাগলেন প্রথম থেকেই আপনি সঠিক পথে এগোচ্ছিলেন। তবে আমারও সন্দেহ ছিল না তা নয়। এমন নৃশংস হত্যালীলা কেউ যে করতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কারণ ছাড়া মৃতদেহের মুখ বিকৃত করা যায় না। সনাক্তকরণে বিঘ্ন ঘটানোই এর প্রকৃত কারণ। মৃতদেহটা মিস সীলের না হয়ে অন্য মহিলার হতে পারে এটা বোঝা উচিত ছিল আমার। বিচক্ষণতার অভাব ঘটেছে।
পোয়ারো স্মিত হেসে বললেন–ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। মিস সেইনসবারি সীল অতি সাধারণ, সাজ পোশাকে শৌখিনতার আধিক্য নেই। সাদামাটা প্রসাধন। সেই তুলনায় মিসেস চ্যাপম্যান সুন্দরী, ধনী, করিৎকর্মা মহিলা। তবে তাদের দুজনের বিশেষত্ব হল, দু’জনেই চল্লিশ বছর পার করেছেন। উচ্চতা প্রায় এক, শুভ্র কেশ দু’জনেরই।
জ্যাপ বললেন–হ্যাঁ, তা সত্যি। ম্যাকেল আমাদের বোকা বানিয়েছে। আমি নিশ্চিত তিনিই নাটের গুরু।
নিশ্চয়ই। তার অতীত জীবন আমাদের অজানা নয়।
তবে খুন করতেও তার হাত কাঁপে না সেটা আজ প্রত্যক্ষ করলাম। এখন মনে হচ্ছে ম্যাকেলই সিলভিয়াকে খুন করেছে। নাকি সিলভিয়ার খুনি ম্যাকেল।
এরকুল পোয়ারো তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে বললেন–আমি আপনার কথা মানতে পারছি না। আমি কিছুতেই মিসেস সীলকে খুনির আসনে বসাতে পারছি না।
জ্যাপ উত্তেজিত হয়ে বললেন–আমি এই মামলার শেষ দেখে ছাড়ব, বন্ধু আমি ওই মহিলাকে হার মানতে বাধ্য করবই।
পরদিন ফোন পেলেন পোয়ারো। জ্যাপ করেছেন। তার গলার স্বর ভারী। তিনি বললেন একটা খবর দিই আপনাকে, বন্ধু। আমাদের সব পরিশ্রম বৃথা গেল।
–ঠিক বুঝলাম না। উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ছে পোয়ারোর গলার স্বরে।
–আমাদের দায়িত্ব শেষ। কাজকর্ম বন্ধ। এখন আমরা ছুটি কাটাব ইচ্ছেমতো।
পোয়ারো চমকে উঠে বললেন–পাগলের মতো কি সব বলছেন?
তিক্ত স্বরে জ্যাপ বললেন–তদন্তের কাজ সব নষ্ট হয়ে গেল। এত প্রচার, হৈ চৈ, জেরা, জবাবদিহি সব কৌশলে চাপা দেওয়া হল।
কিছুই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তাহলে শুনুন। এতদিন ধরে আমরা যে তল্লাশি চালিয়েছি তা মনে আছে তো? কোন মাছ ধরতে সারা দেশে জাল ফেলেছি সেটাও মনে আছে?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারপর?
–সেটা গুটিয়ে ফেলতে হবে। বলতে পারেন চাপা দেওয়া হল ব্যাপারটাকে।
–কিন্তু কার নির্দেশে? বিদেশ দপ্তরের নির্দেশে। এটা অকল্পনীয় নয় কি? হতে পার তবে এরকম ঘটনা বিরল নয়। ওই মাছ নিয়ে তাদের এত আগ্রহ কেন?
–তাকে নিয়ে তারা অত মাথা ঘামায় না। প্রচারে তাদের আপত্তি। অভিযুক্তকে আদালতে তুলতে হবে। জেরাতে মিসেস চ্যাপম্যানের মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠবে। সুতরাং এখানেই ইতি টানো। জ্যাপ চিন্তিত স্বরে বললেন কিন্তু মি. চ্যাপম্যানের অবস্থা কি হবে?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
–তিনি বিদেশে কোনো বিপজ্জনক জায়গায় থাকলে এই ঘাঁটাঘাঁটিতে ব্যাপারটা কোথায় এসে দাঁড়াবে বুঝতে পারছেন?
-ওঃ বুঝলাম। ভীষণ বিরক্তিকর ব্যাপার।
জ্যাপ কর্কশ সুরে বললেন–ওই মহিলাকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিতে হবে। এটা মনে পড়লেই সারা শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে, বন্ধু।
পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন কিছু ভাববেন না, দোস্ত, সে হাতছাড়া হবে না।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জ্যাপ বললেন কিন্তু কিভাবে, আমরা ওপরতলার কড়া নিয়মে বাঁধা পড়েছি।
–আরে মশাই, আমি তো রয়েছি। আমি আপনাদের মতো নিয়মের বেড়াজালে আটকে নেই।
জ্যাপ দারুন খুশি। বললেন–বাঃ চমৎকার। আপনি এগিয়ে যান। আমার শুভেচ্ছা রইল।
–অবশ্যই আমৃত্যু লড়ে যাব।
–তা ভাল। তবে দেখবেন, প্রথম থেকেই ঘটনার যা ঘনঘটা দেখলাম, আপনাকে না কেউ শেষ করে ফেলে।
পোয়ারো ফোন ছেড়ে দিলেন। মনে মনে বললেন–এরকম অতিরঞ্জিত কথা না বলাই ভালো ছিল। ভারি অদ্ভুত একটা মন্তব্য করলাম–আমৃত্যু।
সন্ধ্যার ডাকে এরকুল পোয়ারোর নামে একটি চিঠি। টাইপ করা চিঠির বয়ান আর সইটা হাতে লেখা।
পোয়ারো চিঠিটা খুললেন। তাতে লেখা আছেঃ
আমি আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী। আমার বাড়ি বেলসিতে যদি একবার আসেন তাহলে আমি খুব খুশি হব। আগামীকাল সাড়ে বারোটায়। আপনাকে একটা কাজ দেব। যদি আসতে না পারেন তাহলে দয়া করে আমার সেক্রেটারিকে টেলিফোনে জানিয়ে দেবেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অন্য কোনো সময় ঠিক করতেও পারেন। তবে মনে রাখবেন আগামীকালই এলে উপকৃত হব। কম সময় দেওয়ার জন্যে ক্ষমা চাইছি।
—আপনার বিশ্বস্ত,
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট।
চিঠিখানা মন দিয়ে পড়লেন। বার বার পড়লেন। চিঠির বক্তব্যেই গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করলেন। ঠিক সেই সময় তাঁর টেলিফোন বেজে উঠল।
এরকুল পোয়ারো নিজের সম্পর্কে আস্থাবান যে টেলিফোনের শব্দ শুনে ধরতে পারেন কি ধরনের খবর পেতে চলেছেন।
এ ক্ষেত্রে তিনি বুঝলেন, বার্তাটা জরুরি। এটা রঙ নাম্বার অথবা কোনো বন্ধুর ফোন হতে পারে না।
তিনি রিসিভার কানে ধরলেন। তিনি স্বভাবসুলভ স্বরে বললেন–হ্যালো?
নেতিবাচক এক মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন–এটা কত নম্বর?
–এটা হোয়াইট হল ৭২৭২।
একটু থেমে ওই মহিলার কণ্ঠস্বর পোয়ারোর কানে এল–মঁসিয়ে পোয়ারো বলছেন?
–হ্যাঁ, বলছি।
–মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো?
–হ্যাঁ।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, ইতিমধ্যে আপনি একটা চিঠি পেয়েছেন অথবা পাবেন।
–কে বলছেন? আমি কি জানতে পারি?
–আপনার জানার প্রয়োজন নেই।
–বেশ। জানতে চাই না। তবে, একটা কথা জানাই মাদাম, এর মধ্যে আমি আটটি চিঠি ও তিনটে বিল পেয়েছি।
কোন চিঠির কথা বলছি তা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। যে কাজের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হবে তা গ্রহণ না করলেই মঙ্গল হবে, মঁসিয়ে পোয়ারো।
–এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন, মাদাম।
হিমশীতল স্বরে জবাব এল–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে সাবধান করছি। আপনি এর মধ্যে মাথা গলাবেন না। আপনার এই ঔদ্ধত্য আমরা বরদাস্ত করব না।
যদি আপনাদের সাবধানবাণী না শুনি?
–তাহলে আপনি বিপদে পড়বেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমরা সেই ব্যবস্থাই করব।
–এটা হুমকি দেওয়া হচ্ছে, মাদাম।
–আমরা আপনাকে সচেতন করতে চাইছি। এতে আপনার মঙ্গল হবে।
–আপনার মহত্ত্বের পরিচয় পেয়ে কৃতার্থ হলাম, মাদাম।
–যা বলছি সেটা মেনে চলুন। যে বিষয়ে আপনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলছেন সেটা থেকে সরে আসুন।
ওহ, হ্যাঁ। তবে মি. মর্লের মৃত্যু নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ওটা নিছক দুর্ঘটনা একটা মাত্র। সে আমাদের কাজে বাধার সৃষ্টি করছিল।
–তিনি মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাই অকালে মরতে হল।
–সে অবিবেচকের মতো কাজ করেছিল। তাই সে যোগ্য শাস্তি পেয়েছে।
–আমিও বিবেচক হতে রাজি নই।
–তাহলে আপনি বোকামি করবেন।
বলেই অন্যদিক থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
পোয়ারো বারকয়েক হ্যালো বললেন, কিন্তু ও প্রান্ত থেকে কোনো শব্দ শুনতে পেলেন না। রিসিভার নামিয়ে রেখে ভাবলেন, ফোনটা কোথা থেকে করা হয়েছে ইচ্ছে করলে জানা যাবে। কিন্তু লাভ হবে না কারণ ফোনটা এসেছে কোনো পাবলিক বুথ থেকে।
ধীরে ধীরে তিনি মনে করতে লাগলেন ওই মহিলার কণ্ঠস্বর তার ভীষণ চেনা লাগছে। আগে কোথাও শুনেছিলেন। ম্যাকেল সেইনসবারি সীলের কণ্ঠস্বর নয়তো? তবে মিস সীল একটু চড়া সুরে কথা বলে থাকেন। এটাও আশ্চর্যের নয় যে তিনি অন্যের গলা অনুকরণ করে ফোন করতে পারেন না। কারণ তিনি একজন অভিনেত্রী এটা ভুললে হবে না।
কিন্তু এই যুক্তি তাঁর মনঃপূত হল না। তিনি অন্য একজনের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিল খুঁজতে চাইছেন।
সকালে সংবাদপত্রে এক দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ সংবাদ প্রকাশিত হল। প্রধানমন্ত্রীকে কে বা কারা গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছে। তিনি সেই সময় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। সঙ্গে এক বন্ধু ছিলেন। তবে ভাগ্য ভাল, গুলিটা তাঁর শরীরে লাগেনি। কিছুটা দূর থেকে চলে গেছে। এজন্য একজন ভারতীয়কে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। খবরটা পোয়ারো মন দিয়ে পড়লেন। তারপর সোজা গিয়ে হাজির হলেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে জ্যাপের অফিস ঘরে। জ্যাপ তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন।
বাঃ আপনারও চোখে পড়েছে খবরটা। আর পড়বেই না কেন এমন মুখরোচক খবর। তা বন্ধুটি কে তা লিখেছে খবরের কাগজে?
না, তিনি কে আপনি জানেন?
–অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট।
–-সত্যি? পোয়ারো অবাক হয়ে বললেন?
-হ্যাঁ, বন্ধু। আমি নিশ্চিত মি. ব্লাস্টকে গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাদের লক্ষ্য নয়। লোকটার লক্ষ্যভেদ ভুল হওয়ায় মি. ব্লাস্ট বেঁচে গেলেন।
–লোকটা কে জানতে পেরেছেন?
–এক হিন্দু ছাত্র। ওর সাথে মি. ব্লাস্ট-এর কোনো শত্রুতা নেই এটা জানা গেছে। ওকে টাকার বিনিময়ে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু সে কার হুকুমে একাজ করেছে, তা এখনও স্বীকার করেনি। ছাত্রটিকে গ্রেপ্তার করার কৃতিত্ব কিন্তু আমাদের নয়। এতে সাহায্য করেছেন এক আমেরিকান ভদ্রলোক। তিনি সে সময় ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি গুলি ছোঁড়া দেখেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটিকে ধরে ফেলেন। সে পালাবার চেষ্টা করলে লোকটি চিৎকার করে পুলিশ ডাকেন। এরপর আমাদের লোক গিয়ে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করে।
পোয়ারো বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন–আমেরিকান? দেখেছেন আপনি? দাড়ি আছে?
–এক তরুণ, নাম তার হাওয়ার্ড রেইকস। পোয়ারোর মুখের দিকে দৃষ্টি পড়তে থমকে গেলেন জ্যাপ। তারপর কোনরকমে বললেন–কি হল, বন্ধু? আপনি চেনেন?
পোয়ারো বিষণ্ণ সুরে বললেন–হাওয়ার্ড রেইকস। থাকেন হাবোর্ন প্যালেস হোটেলে।
–হ্যাঁ। ওহ মনে পড়েছে। তাই ভাবছিলাম নামটা কেন চেনা লাগছে। আরে সেই ভদ্রলোক যে নাকি মর্লের মৃত্যুর দিন তার কাছে এসেছিল। অথচ ডাক্তার না দেখিয়ে চলে গিয়েছিল। কি আশ্চর্য। তাই না। একই জিনিস বার বার আমাদের সামনে আসছে। এখনও আপনার মাথাতে সেই পুরোনো পোকাটা রয়েছে?
পোয়ারো তীব্রস্বরে বললেন–হ্যাঁ, এটা আমার প্রত্যাশা পূরণ না হলে বেরোবে না।
ঠিক সাড়ে বারোটায় পোয়ারো গথিক হাউসে এলেন। তাকে অভ্যর্থনা করলেন একজন সেক্রেটারি। মার্জিত; শিক্ষিত তরুণ যুবা।
তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি দুঃখিত মি. ব্লাস্টও দুঃখপ্রকাশ করেছেন আপনাকে এখানে ডেকে আমার জন্যে, তিনি এখন নেই। তাঁর ডাক এসেছে ১০ ডাউনিং স্টিট থেকে। কারণ, গতকালের সেই অযাচিত ঘটনাটা। আমি আপনার ফ্ল্যাটে যোগাযোগ করেছিলাম। আপনার পরিচারক বলল, আপনি বেরিয়ে পড়েছেন। থেকে কোনো মন্তব্য না পেয়ে তরুণটি আবার বলতে লাগলেন–কেন্টের এমহ্যাসে মি. ব্লাস্টের একটি বাগানবাড়ি আছে। যদি সম্ভব হয় আপনাকে সেখানে যেতে বলেছেন। সপ্তাহের শেষের দিনটি আপনার সঙ্গে কাটানোর ইচ্ছে তার। আপনি যদি রাজি থাকেন বলুন। আমি তাকে জানিয়ে দেব। ফলে তিনি গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন সেখানে।
পোয়ারো ভাবছিলেন কি জবাব দেবেন।
যুবকটি আবার বলতে শুরু করলেন মি. ব্লাস্ট আপনার সাথে দেখা করার জন্য খুবই ব্যাকুল হয়েছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো এবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন বেশ, আমি আমন্ত্রণ গ্রহণ করছি।
ধন্যবাদ, আপনি যেতে রাজি হয়েছে শুনলে মি. ব্লাস্ট খুশি হবেন। একটা কথা, তিনি যদি ছটা নাগাদ যান তাহলে তার চোখ পড়ল মিসেস অলিভেরা জেনের দিকে। ইনি মিস অলিভেরার মা। তিনি সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করেছেন। তিনি সুন্দর সাজে সজ্জিত। মাথায় দামি টুপি। সেই টুপিটি চোখের ভু পর্যন্ত নামানো ছিল।
তিনি তীব্রস্বরে বললেন–ওহঃ! মি. সেলবি, মি. ব্লাস্ট কি বাগানের চেয়ারের বিষয়ে আপনাকে কিছু বলেছেন? আমি গত সপ্তাহে তাকে বলেছিলাম। শুনেছি উনি সপ্তাহের শেষে বাইরে বেড়াতে যাবেন তাহলে তো কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন পোয়ারোকে দেখে।
সেক্রেটারি ছেলেটি জানতে চাইলেন মিসেস অলিভেরার সঙ্গে আপনার এর আগে আলাপ হয়েছিল, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
মিসেস অলিভেরা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন,
–ওহ! মি. পোয়ারো? ভালো আছেন? হ্যাঁ, মি. সেলবি, যা বলছিলাম, মি. ব্লাস্ট খুবই ব্যস্ত মানুষ জানি তাই এইসব ছোটোখাটো বিষয়ে তিনি মাথা ঘামান না–
মি. সেলবি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন ঠিক আছে, মিসেস অলিভেরা। এই প্রসঙ্গে স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি মেসার্স ভিডার্সকে ডেকে পাঠিয়েছি। তিনি আজ আসবেন।
মিসেস অলিভেরা বললেন–ধন্যবাদ, আমি নিশ্চিন্ত হলাম মি. সেলবি, আর একটা কথা, সপ্তাহের শেষে আমরাই কি কেবল ক্রমহ্যামে যাব নাকি আর…..।
মি. সেলবি শান্ত স্বরে বললেন–হা, মিসেস অলিভেরা, আপনার অনুমানই ঠিক। আমাদের সঙ্গে মি. পোয়ারোও যাচ্ছেন।
-সত্যি?
পোয়ারো হাসি মুখে বললেন মি. ব্লাস্টের মতো মানুষের আমন্ত্রণ আমি উপেক্ষা করতে পারি না। তাই তাঁর আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করলাম।
মিসেস অলিভেরা ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন–মানে, আলিস্টেয়ার আমাকে বলেছিলেন সপ্তাহটা আমাদের সঙ্গেই কাটাবেন। অন্য কোনো অতিথি সেখানে থাকবে না।
মি. সেলবি গলায় দৃঢ়তা এনে বললেন–মাপ করবেন, মিসেস অলিভেরা, মি. পোয়ারোর সঙ্গে মি. ব্লাস্টের জরুরি আলোচনা আছে। তাই তিনি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
–তাহলে উনি আমাকে কথাটা জানাননি কেন?
এমন সময় সেখানে হাজির হল মিস জেন অলিভেরা। সে তার মাকে বলল–গলার স্বরে বিরক্তির প্রকাশ।, তুমি এখনও রেডি হওনি। মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে গেছে।
আর একটু অপেক্ষা করো জেন, আসছি। হঠাৎ দেখতে পাওয়ার ভান করে পোয়ারোকে বলল–ওহ মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কখন এলেন?
মিসেস অলিভেরা তিক্ত স্বরে বললেন–মসিয়ো পোয়ারো, সপ্তাহের শেষ কাটাতে যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে ক্রমহ্যামে।–
ওহ, বেশ মজা হবে। মিসেস অলিভেরা চলে গেলেন। এবার জেন পোয়ারোর সামনে একটু এগিয়ে এল। খুব নিচু গলায় বলল, কেউ যাতে শুনতে না পায়–মঁসিয়ে পোয়ারো, সত্যি আপনি ক্রমহ্যামে আসছেন? কিন্তু কেন? ‘
কাঁধ ঝাঁকিয়ে পোয়ারো বললেন–এটা আপনার কাকার সিদ্ধান্ত, মিস অলিভেরা।
জেন অসহিষ্ণু হয়ে বলল–তিনি কখন বলেছেন আপনাকে? কাকা তো কিছুই জানেন না–সম্ভবত না জানার কথা। আপনার সেখানে কি প্রয়োজন?
জেনের মা হলঘর থেকে চিৎকার করে ডাকলেন–জেন, একটা বাজে, দেরি হয়ে যাবে চলে এসো।
জেন চলে যেতে যেতে হিস হিস করে বলে গেল প্লীজ, আপনি আসবেন না।
জেন চলে যেতে পোয়ারো মিসেস অলিভেরার চীৎকার শুনতে পেলেন। তিনি উচ্চস্বরে বলছেন, জেন, তুমি ভীষণ অবাধ্য হয়েছ। আমাকে একটা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আমার কথার বিরুদ্ধাচরণ না করো।
তরুণ সেক্রেটারি মি. সেলবি বলে উঠলেন–তাহলে মঁসিয়ে পোয়ারো, আগামীকাল ঠিক পৌনে ছ’টার সময়। ভুলবেন না যেন।
পোয়ারো পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। কোনোরকমে জবাব দিলেন অবশ্যই।
মুহূর্ত কয়েক আগে তাঁর কানে যে কথাগুলো এল সেই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে গতরাত্রে টেলিফোনে শোনা কণ্ঠস্বরের মিল খুঁজতে চাইছিলেন তিনি। তাই গতকাল গলাটা তার চেনা বলে মনে হয়েছিল।
তিনি গথিক হাউস থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
পথ চলতে চলতে ভাবছেন, তাহলে মিসেস অলিভেরা টেলিফোনে ভয় দেখাচ্ছেন? কি করে সম্ভব? স্বার্থপর, বুদ্ধিহীনা, যুক্তির ধার ধারেন না, আত্মগরিমায় বিভোর, মুরগির মতো নাদুসনুদুস মহিলার পক্ষে এমনটা করা অসম্ভব। তিনি মনে মনে হাসলেন, ভাবলেন তার কানই তাঁর সঙ্গে বিট্রে করেছে।
সকাল পৌনে ছ’টায় একটা রোলস গাড়ি এসে দাঁড়ালো এরকুল পোয়ারোর বাড়ির সামনে। গাড়িতে দুজন আরোহী। একজন গাড়ির মালিক অ্যালিস্টোর ব্লাস্ট, অন্যজন তার সেক্রেটারি মি. সেলবি।
পোয়ারো গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। ব্লাস্ট তাঁর বাগান ও পুষ্প প্রদর্শনী নিয়ে কিছু কথা বললেন।
পোয়ারো বললেন–অভিনন্দন মি. ব্লাস্ট। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন বলে সত্যিই আনন্দিত হয়েছি।
মি. ব্লাস্ট পোয়ারোর কথা শুনতে পেলেন না। তিনি বলে চললেন–সেদিন ছেলেটি আমাকে মারার চেষ্টা করেনি। ও চেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করতে। একাজে ছেলেটির কোনো অভিজ্ঞতা নেই। পেশাদার খুনি নয় সে। তাই প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছোঁড়ে সে। বেচারা টিপ কিভাবে করতে হয় তাই জানে না। ভেবেছিল প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিলেই অর্থনীতির পালাবদল ঘটবে। মূর্খ সব।
এরকুল পোয়ারো বিমর্ষ সুরে বললেন আপনার জীবনের ওপর দিয়েও এরকম কতবার বিপদ গেছে, তাই না?
মি. ব্লাস্ট হেসে বললেন–এতে ওরা আমায় দমিয়ে দিতে পারেনি। অনেকদিন আগে একবার কে বা কারা ডাকে বোমা পাঠিয়েছিল। আমাকে মারার জন্য। কিন্তু সেই বোমা ছিল নিষ্ক্রিয়। তাই আমার কোনো ক্ষতি ওরা করতে পারেনি। যারা বিশ্বের কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় নিতে চাইছে তারা কিভাবে একটি বোমাকে কার্যকরী করতে হয় সেটাই জানে না। এতটাই মূর্খ তারা, ভাবুন একবার?
পোয়ারো মাথা ঝাঁকালেন।
মি. ব্লাস্ট আবার বলতে শুরু করলেন, আমি উচ্চ পদাধিকারী হলেও চালাক চতুর নই। চিরকালই সরল সাধারণ বুদ্ধিতে চলি। তবে অঙ্ক ও ইংরাজিতে আমার অসাধারণ জ্ঞান আছে। ইংরাজি কোনো লেখা যদি আমি পড়ি তার অর্থ সহজেই বুঝতে পারি। একটু হেসে বললেন, ছাড়ন ওসব কথা, তবে আমি বড় বড় কথা বলতে পছন্দ করি না। নিজের প্রশংসা নিজেই করা খুব খারাপ অভ্যেস। কাজের সব ব্যাপার আমি অফিসেই রেখে আসি। বেড়াতে বেরিয়ে ওসব কথা আলোচনা করে বেড়ানোর মজাটা নষ্ট করার পক্ষপাতী আমি নই। অনেক দিন ধরে আপনার রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা করে আছি। আমি অনেক রহস্য কাহিনি ও থ্রিলার পড়েছি। মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি বিশ্বাস করেন বাস্তব জীবনেও এরকম ঘটনা ঘটতে পারে?
এরপরের যাত্রাপথে পোয়ারো নিজের কিছু চমকপ্রদ সাফল্যের কাহিনি শোনালেন। মি. ব্লাস্টও বাচ্চা ছেলের মতো মন দিয়ে শুনছিলেন। কখনো হো হো করে হেসে উঠছিলেন, আবার কখনো ভয়ে শিউরে উঠছিলেন।
শেষপর্যন্ত তাঁরা তাঁদের গন্তব্যে এসে পৌঁছলেন। ক্রমহ্যামের বাগান বাড়ি। সেখানে আগেই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন জেন অলিভেরা ও তার মা মিসেস অলিভেরা।
মিসেস অলিভেরা পোয়ারোকে দেখে নিজের রাগ আর চেপে রাখতে পারলেন না। তাঁর আচরণে অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তিনি পোয়ারোকে গ্রাহ্যই করলেন না। মি. ব্লাস্ট ও মি. সেলবিকে সমাদরে বাড়ির ভেতর ডেকে নিয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত আগের আনন্দমুখর পরিবেশটা নিমেষে বিষাদে পরিণত হল।
জেন এগিয়ে এসে এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে গেলেন বাড়ির ভেতরে। দেখিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট ঘরটিকে।
চমৎকার বাড়ি। তবে ছোট্ট। ঘরগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো। গৃহকর্তা শৌখিন মানুষ। তাই রুচিবোধও উচ্চমানের। লণ্ডনের বাড়ি যেভাবে সাজানো ঠিক সেই ভাবেই এই ঘরগুলি সুসজ্জিত। প্রতিটি জিনিসই মহামূল্যবান। এখানকার মানুষগুলোর কাজকর্ম পরিপাটি ও পরিষ্কার। ইংরাজসুলভ খাবার এবং ইউরোপীয় বয়। উৎকৃষ্ট স্যুপ, মটরশুটি সিদ্ধ, স্ট্রবেরি ও ক্রিম দিয়ে নৈশভোজ সারলেন পোয়ারো। নৈশভোজে প্রদত্ত সুরা পোয়ারোকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। তিনি আহারে এতই মগ্ন ও তৃপ্ত ছিলেন যে মিসেস অলিভেরার বিসদৃশ আচরণ ও জেনের রুক্ষ ব্যবহার মনেই রাখলেন না। আহারের শেষে এরকুল পোয়ারো ভাবলেন যে কোনো কারণেই হোক জেন তার প্রতি ক্ষুব্ধ। তাই সে বিরূপ আচরণ করছে তাঁর সাথে কিন্তু কি সেই কারণ?
মি. ব্লাস্ট মিসেস অলিভেরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন–হেলেন আমাদের সঙ্গে খেতে বসল না কেন?
জুলিয়া অলিভেরা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল–ওঁর বড্ড পরিশ্রম হয়েছে আজ। তাই ওকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আমি ওকে বলেছি পোশাক পাল্টে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে।
ব্লাস্ট হতাশ হয়ে বললেন–ভেবেছিলাম সপ্তাহের শেষ দিনটি সবাই মিলে মজা করে কাটাব।
মিসেস অলিভেরা নিজের দোষ চাপা দেওয়ার জন্যে বললেন–হেলেন খুব ভালো মেয়ে। তাছাড়া ওর বেশি রাত পর্যন্ত জাগার অভ্যেস নেই।
এরকুল পোয়ারো খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন, তিনি ড্রয়িং রুমে এলেন, অ্যালিস্টেয়ার ও তার সেক্রেটারি সেখানে বসে রইলেন।
পোয়ারো ড্রয়িং রুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তার কানে গেল জেনের রুক্ষ গলা। সে তার মাকে বলছে, মা, হেলেন মসেরকে তুমি অ্যালিস্টেয়ার কাকার চোখের আড়াল করলে কেন? তিনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন এতে।
মিসেস অলিভেরা কর্তৃত্বের সুরে বললেন–বেশ করেছি। অ্যালিস্টেয়ার অতি সজ্জন মানুষ। সে খুব উদার প্রকৃতিরও বটে। তাই কোনো গরিব আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়। তেমনি হেলেনও একজন। তাকে বিনা ভাড়ায় এখানে থাকতে দিয়েছেন। সেটাই কি যথেষ্ট নয়। তা নয়, প্রতিবার আমরা সপ্তাহের শেষে এখানে আনন্দ করতে আসব, আর ওকেও তখন ডাকতে হবে, এর কোনো যুক্তি আছে। হতে পারে সে বোন বুও নিজের তো নয়। আলিস্টেয়ার ওর সব দায় দায়িত্ব নেবে তা আমি একেবারে বরদাস্ত করব না।
জেন বলল–বাগান পরিচর্যার কাজ ও খুব দক্ষ হাতে করে। তাই ও ভীষণ অহংকারী।
মিসেস অলিভেরা বললেন সেটাই তো স্বাভাবিক। স্কচরা কারও দাসত্ব গ্রহণ করে না, তাই তাদের সবাই সম্মান করে।
এমন সময় ব্লাস্ট সেখানে এলেন। তিনি পোয়ারোকে সহাস্যে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো আমার ঘরে চলুন।
পোয়ারো তাকে অনুসরণ করে ঘরে এলেন। খুবই আরামদায়ক ঘরটি। তবে একটু নীচু। বাগানমুখী দুটি জানালা। বেশ কিছু সোফা ও চেয়ারে ঘরটি সাজানো।
মি. ব্লাস্ট পোয়ারোর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিলেন। নিজে একটি পাইপ ধরিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন।
কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। এরপর মি. ব্লাস্ট বললেন এবার কাজের কথায় আসা যাক, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি মিস সেইনসবারি সীলের কথা আপনার কাছ থেকে জানতে চাইছি। পুলিশ প্রশাসন তার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে আর রাজি নয়। এর পিছনে কি কারণ আছে আমার জানা নেই। তাছাড়া অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান কে, তার অভিসন্ধি কি সে বিষয়েও আমি ওয়াকিবহাল নই। ভিতরের ব্যাপার আমার জানা নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এটা খুশি মনে নিচ্ছেন না। তিনি প্রচার বন্ধ করতে বলেছেন। যাতে জনসাধারণের মনে এই ঘটনাটা রেখাপাত করতে না পারে, সেইজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছেন। এসবই হল সরকারি নিয়মকানুন। সেই মেনে পুলিশও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। মি. ব্লাস্ট পোয়ারোর সামনে এগিয়ে এসে বললেন, সে যাইহোক, আমি প্রকৃত সত্য জানতে চাই। তাই এই কাজটার দায়িত্ব আপনার হাতেই সঁপে দিলাম, মঁসিয়ে পোয়ারো। সরকারি নিয়মকানুনে আপনার হাত বাঁধা পড়েনি। তাই আপনি স্বাধীনভাবে এই কাজটি করতে পারবেন।আমি কি করতে পারি মি.-ব্লাস্ট? আপনি মিস সেইসনবারি সীলের খোঁজ করুন। মৃত অথবা জীবিত যে অবস্থায় পান তাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসুন। দু-এক মিনিট নীরব রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন। আমি নিশ্চিত মিস সীল মারা গেছেন। মি. ব্লাস্ট গম্ভীর গলায় বললেন–আপনি কি করে জানলেন মিস সীল মারা গেছেন। এর কোনো প্রমাণ রয়েছে আপনার হাতে। পোয়ারো হেসে বললেন–আপনাকে এখন বোঝাতে পারবনা। তবে বলি মিসেস চ্যাপম্যানের ঘর থেকে একজোড়া নতুন মোজা পাওয়া গেছে। এটাই আসল কারণ, মি. ব্লাস্ট।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মি. ব্লাস্ট। পরে বললেন–আপনি ভারি মজার মানুষ, মঁসিয়ে পোয়ারো।
মৃদু হেসে পোয়ারো বললেন–সত্যি কথা হল, আমার একটা আদর্শ আছে, নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয় যা কিছু সব যুক্তি দিয়ে বিচার করি। এছাড়া কোনো কিছুর ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়াও আমি পছন্দ করি না।
ব্লাস্ট বললেন–ঘটনার গতি প্রকৃতি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। সব কেমন অদ্ভুত লাগছে। প্রথমে ওই দন্তচিকিৎসকের আত্মহত্যা, তারপর ওই মিসেস চ্যাপম্যানের দেহ সিন্দুক থেকে উদ্ধার, মুখ বিকৃত হওয়া। সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা এই কুৎসিত জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।
পোয়ারো মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়লেন।
ব্লাস্ট বললেন আমার যতদূর মনে পড়ছে ওই স্ত্রীলোকটিকে কখনোই আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখিনি। কোনোদিনই তার সঙ্গে আমার স্ত্রীর আলাপ পরিচয় হয়নি। আমার সঙ্গে দেখা করার একটা ছল মাত্র। কিন্তু কেন? এতে তার কি লাভ? অতিরিক্ত টাকার লোভ? বাড়ির সামনে ওইভাবে দেখা করাটা আমার সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে পরিকল্পনা করে ওই সময়টা উনি বেছে নিয়েছেন। তাই বার বার আমার মনে আশঙ্কা জাগছে, এর কারণ কি হতে পারে?
পোয়ারো বললেন–দুঃখিত মি. ব্লাস্ট আমিও এই মুহূর্তে আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না।
–এই ব্যাপারে আপনার ধারণা কি? মঁসিয়ে পোয়ারো–আমার ধারণাকে হাস্যকর বলে মনে হতে পারে যাকে এই কাজে নিয়োগ করা হয়েছে, সে চাইছিল আপনার ওপর অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। যেহেতু আপনি দেশের একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। ব্লাস্ট অধৈর্য হয়ে বললেন–এতে তাদের কি আসে যায়?–অবশ্যই তাদের আসে যায়। যেদিন মি. মর্লে আত্মহত্যা করেন সেদিনের কথা ভাবুন। সেদিন মর্লের ব্যবহার আপনাকে কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ করেছিল? এমন কিছু অসংলগ্ন কথা যার থেকে কোনো সূত্র পাওয়া যায়? ব্লাস্ট মনে করার চেষ্টা করলেন। বললেন–না মঁসিয়ে পোয়ারো, কিছুই মনে করতে পারছি না। তার মুখ থেকে মিস সেইনসবারি সীলের নামও শোনেন কি? অথবা মিসেস চ্যাপম্যানের নাম? তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন–না, না, মঁসিয়ে পোয়ারো, উনি কারো নাম বলেননি। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল খেলাধুলা, বাগান, বৃষ্টি–এইসব।আপনারা যখন কথা বলছিলেন তখন অন্য কেউ ছিলেন? আলিস্টেয়ার ব্লাস্ট ভাবার জন্য সময় নিলেন। মিনিট কয়েক পর বললেন–না, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। গতবার একজন সুন্দরী মহিলাকে দেখেছিলাম। এবার সে আসেনি–কিন্তু মর্লের সেই অংশীদার মি. রেইলি একবার এসেছিলেন, যিনি আইরিশদের মতো কথা বলেন। তার সঙ্গে মলে কি কথা বলেছিলেন? হা, মি. রেইলি মাত্র মিনিট দুয়েক ছিলেন। সামান্য কিছু কথা বলেছিলেন তারা দু’জনে। তারপর মি. রেইলি চলে গিয়েছিলেন। এরপরও তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন।
পোয়ারো চিন্তিতভাবে বললেন–আমিও তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক দেখেছিলাম। ঘরে পিন পতন নীরবতা। অনেকক্ষণ পরে নীরবতা ভঙ্গ করে এরকুল পোয়ারো প্রশ্ন করলেন–ভুলে যদি না যান তবে বলুন তো মি. ব্লাস্ট, সেদিন সকালে ওয়েটিং রুমে একজন তরুণকে অপেক্ষায় থাকতে দেখেছিলেন?
ভ্রু কুঁচকে ভেবে নিয়ে মি. ব্লাস্ট বললেন–না, না, ভুলিনি–একজন তরুণকে দেখেছিলাম। সে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল। তবে তার প্রতি বিশেষ কোনো মনোযোগ ছিল না আমার। কিন্তু কেন বলুন তো?
–তাকে আবার দেখলে চিনতে ভুল করবেন না তো?
মাথা নেড়ে না বললেন তিনি।
–সেকি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব ছিল? ব্লাস্ট উৎসাহিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কি? আমি কি ওই তরুণকে চিনি? ওর নাম কি?
পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ব্লাস্টের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। শেষে তিনি বললেন–আপনি তাকে চেনেন কিনা আমি বলতে পারব না। তবে আপনার ভাইঝি জেন তাকে ভালোভাবেই চেনে। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। নাম হাওয়ার্ড রেইকস।
–ওহ, জেনের বন্ধু। আমি তো শুনেছি ওর মা ওদের সম্পর্ক মেনে নেননি। মি. ব্লাস্ট আনমনা হয়ে বললেন–তাতে জেনের কোনো ক্ষতি হবে না।
তিনি এতটাই রুষ্ট হয়েছেন যে আমেরিকা থেকে মেয়েকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তাঁর ধারণা এতে মেয়েকে ওই তরুণটির কবল থেকে মুক্ত করা যাবে।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের মুখে চিন্তার কালো মেঘ। তিনি বললেন–এবার তাকে চিনতে পারছি। শুনেছি ছেলেটা খুব খারাপ। তার নামে নানা কুৎসা রটেছে। সে সন্ত্রাসমূলক কাজে লিপ্ত।
মিস অলিভেরা আমাকে বলেছে সে সেদিন সকালে মর্লের চেম্বারে গিয়েছিল। ছেলেটির উদ্দেশ্য ছিল আপনার মুখোমুখি হওয়া।
লাভ? তাকে কি আমার কাজে যোগ দিতে বলব?না, না, তা নয়, যাতে আপনাদের দুজনের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ঘৃণায় ব্লাস্টের মুখ বিকৃত হল। তিনি বললেন–একটা অপদার্থ।
পোয়ারো হাসি চেপে বললেন আপনার কিছু কিছু মতবাদ ওর অপছন্দের।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট নাক কুঁচকে বললেন–ওর মতো নোংরা চরিত্রের ছেলেকে আমি কখনো মেনে নেব না। অশিক্ষিত, অপদার্থ, আদর্শবাদের ধ্বজাধারী। দুষ্কর্ম ছাড়া ভদ্রজনোচিত কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয়।
পোয়ারো কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইলেন। দুই জনেই চুপচাপ। তারপর এক সময় পোয়ারো মাথা তুলে জানতে চাইলেন–আপনাকে যদি কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি তাহলে অনধিকার চর্চা বলে এড়িয়ে যাবেন না তো?
না, করুন। মি. ব্লাস্ট সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।
–আপনার মৃত্যুর পর আপনার সম্পত্তি কে কে পাবে?
মি. ব্লাস্ট উষ্মার সুরে বললেন–এরকম প্রশ্ন করার মানে কি?
–মানে–এই ঘটনার সঙ্গে এই উত্তরটা ও তপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।
বাজে কথা। কেউ আমাকে খুনের চেষ্টা করতে পারে না।
ধরুন, আপনার জন্মদিনে ফুলের মধ্যে টাইম বোমা ভরে উপহার দিল কেউ হয়তো। কোনো সভায় আপনি গিয়েছেন সেখানে আপনাকে লক্ষ্য করে কেউ গুলি ছোঁড়ে তাহলে?
–ওহ এই ব্যাপার। পৃথিবীতে যে ব্যক্তি অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে তার জীবনে এমন ঘটনা তো ঘটতেই পারে।
না, এমন হালকা ভাবে নেবেন না মি. ব্লাস্ট। এতে আপনার প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। ব্লাস্ট বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বিহ্বল ভাব কাটিয়ে তিনি বললেন আমি বুঝতে পারলাম না। আমি জানতে চাইছি, আপনার অবর্তমানে কে বেশি লাভবান হবে?
ব্লাস্ট হেসে বললেন আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বেশিটাই দান করেছি ক্যানসার হাসপাতালে, অন্ধদের রয়্যাল ইনস্টিটিউটকে এবং এডওয়ার্ডস হাসপাতালকে। বাকি অর্থ দিয়েছি আমার বিবাহ সূত্রের ভগ্নী। মিসেস জুলিয়া অলিভেরা, তার কন্যা জেন অলিভেরাকে সম পরিমান অর্থ বেশ কিছু অর্থ দিয়েছি আমার এক দূর সম্পর্কের বোন হেলেন মন্ট্রেসরকে। সে আমার একমাত্র জীবিত আত্মীয়। তাকে দেখার মতো কেউ নেই। এবং আর্থিক দিক দিয়েও সে দুর্বল। তাই তাকে আমার এই কটেজে থাকতে দিয়েছি।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন ব্লাস্ট, আপনাকে বিশ্বাস করে এসব কথা বললাম দেখবেন আবার প্রচার না হয়।
–আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি বিশ্বাসহানি করব না।
ব্লাস্ট মজা করে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, এবার হয়তো বলবেন, যে জুলিয়া বা জেন কিংবা হেলেন মসের আমাকে খুন করার ষড়যন্ত্র করছে।
–আমি এখন কিছুই বলব না, মি. ব্লাস্ট।
–তাহলে নার কাজটা আপনি করছেন?
মিস সেইনসবারি সীলকে খুঁজে বের করা? হ্যাঁ, আমি করব।
মি. ব্লাস্ট তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন–ধন্যবাদ, মঁসিয়ে পোয়ারো। সত্যিই আপনি খাঁটি ইংরেজ এবং কাজের মানুষ।
পোয়ারো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, দরজায় দাঁড়ানো ছিল দীর্ঘাঙ্গী জেন অলিভেরা। প্রায় তার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আর কি। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন তিনি ক্ষমা করবেন, মাদামোয়াজেল।
মিস অলিভেরা একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল–আপনার সম্পর্কে আমার কি ধারণা জানেন, মঁসিয়ে পোয়ারো?
–কি, মাদামোয়াজেল?
–আমার ধারণা আপনি গুপ্তচর বৃত্তিতে পাকা, নীচ, আপনার ওই নোংরা বিশ্রী নাকটা সব ব্যাপারে গলিয়ে গণ্ডগোল সৃষ্টি করায় ওস্তাদ।
–আপনি শান্ত থাকুন, মাদামোয়াজেল।
জেন অলিভেরা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলল–আমি জানি আপনি কি করতে পারেন আর না পারেন। আপনি কাকাকে মিথ্যে স্তোকবাক্য শুনিয়েছেন। আপনার কিছু করার ক্ষমতা নেই। আপনি কিছুই খুঁজে পাবেন না। কিছুতেই না! আমার প্রিয় কাকার ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদে আছেন। আপনাকে দেখলে আমার শরীর জ্বলে যায়। আপনি একজন সখের গোয়েন্দা ছাড়া আর কিছুই না। যাকে বলে বুর্জোয়া গোয়েন্দা।
পোয়ারো হতবাক, চোখ দুটি বিস্ফারিত, ভ্রুযুগল কুঞ্চিত। একবার তিনি গোঁফে হাত বুলিয়ে নিলেন।
বুর্জোয়া শব্দটি তাঁর খারাপ লাগেনি। জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বুর্জোয়া সুলভই বটে, তাই এই কথাতে তিনি অপমানিত বোধ করেননি। কিন্তু জেন অলিভেরার অন্যান্য কটুক্তি তাঁকে আঘাত করেছে। সেসব ভাবতে ভাবতে তিনি ড্রয়িংরূমে এলেন।
সেখানে মিসেস অলিভেরা পেসেন্স খেলছিলেন।
পোয়ারোর পায়ের শব্দে মহিলা মুখ তুলে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে ছিল তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা। ওই নিষ্ঠুর চাহনি দেখে পোয়ারো চমকে উঠলেন। তিনি কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি ভাবলেন এখানে তিনি অবাঞ্ছিত।
তিনি বাগানে এলেন। বাতাসে সন্ধ্যামালতীর মিষ্টি সুবাস। খুশি মনে কেয়ারী করা পথ ধরে এগিয়ে চললেন তিনি।
বাগানের কোণে যেতেই তিনি দুটি ছায়া মূর্তি দেখতে পেলেন। তারা তাকে দেখে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মনে হয় একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত। তিদি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে এগিয়ে গেলেন। তিনি মি. ব্লাস্টের খোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন মি. ব্লাস্ট ও তার সেক্রেটারি কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন।
শেষ পর্যন্ত এরকুল পোয়ারো নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরটিতে প্রবেশ করলেন। এই ঘরটিতেই তাঁর রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিছানায় বসে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন। সমস্ত ঘটনার অদ্ভুত পরম্পরার কথা তার মনে পড়ল।
সত্যিই কি টেলিফোনে মিসেস অলিভেরার কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন? না কি অন্য কারোর?
তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠল সেই রহস্যময় মি. কিউ. এক্স ৯১২ ওরফে চ্যাপম্যানের কথা। মনে পড়ল সেই পরিচারিকা জ্যাগরোসের উদ্বিগ্ন দুটি চোখের চাহনি। মি. বার্নেসের সেই বৈচিত্র্যময় খোলাখুলি বলা কথাগুলি ভাবলেন।
সব ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সকলেই ইচ্ছে করে কিছু না কিছু গোপন করেছে। সেই সঙ্গে আর একটি সমস্যা হচ্ছে মিস সীলের অন্তর্ধান সূত্র পাওয়ার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে তাকে।
০৬. এগারো, বারো, খোঁড়া চাই আরও
এরকুল পোয়ারো সারা রাত জেগে কাটিয়েছেন। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন তিনি। তাই ভোর হতেই তিনি বিছানা ছাড়লেন। ভোরের আলোয় বাইরের পরিবেশ চমৎকার লাগছে। তিনি পায়ে পায়ে বাগানে গিয়ে হাজির হলেন।
গোলাপের ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন। নিখুঁত জ্যামিতিক পদ্ধতি দেখে তিনি অভিভূত। মাঝে মাঝে রাখা পাথরের খণ্ডগুলি বাগানের শোভা বর্ধন করেছে। বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইংরেজদের বলল তৈরির ইচ্ছা তিনি অনুভব করলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বাগানের একপাশে চলে এলেন।
সেখানে একজন মহিলা ও একজন মালি গোছের লোককে দেখতে পেলেন। মহিলার পরনে টুইডের কোট ও স্কার্ট। সম্ভবত তিনি ওই মালিকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন। মালির মুখ দেখে মনে হচ্ছে সেই কথাগুলো তাকে খুশি করতে পারেনি। পোয়ারো ভাবলেন মালিটি বোধহয় কোদাল রেখে বিশ্রাম নিচ্ছিল।
মালিটি আবার কোদাল চালাতে লাগলেন। পোয়ারো নিঃশব্দে মালির কাছে এগিয়ে গেলেন। সে পেছন ফিরে মাটি কাটছিল। তাই সে পোয়ারোকে লক্ষ্য করেনি। এই সুযোগে তিনি মালীকে ভালো করে জরিপ করতে চাইলেন।
পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–সুপ্রভাত।
সে কোদাল না থামিয়ে কর্কশ গলায় বলল–সুপ্রভাত, স্যার।
পোয়ারো লোকটির আচরণে অবাক হলেন। তিনি এর আগে এমন অনেক মালির সঙ্গে কথা বলেছেন তারা সবাই হাতের কাজ বন্ধ করে কথা বলতেই বেশি উৎসাহিত হয়। কিন্তু এ অন্য ধরনের। তাঁর মনে সন্দেহ জাগলো। তিনি দাঁড়িয়ে লোকটির কাজ দেখতে লাগলেন। মালির হাত ওঠা নামার মধ্যে তিনি চেনা কিছু যেন খুঁজতে চাইলেন। নাকি তিনি রহস্য সন্ধানী বলে সবার মধ্যে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন? অথবা তিনি কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। দৃষ্টিশক্তি কমে এসেছে।
ভাবতে ভাবতে তিনি আবার চলা শুরু করলেন। এবার এসে দাঁড়ালেন দেয়ালের ধারে বড় একটা ঝোঁপের পাশে। সেই মালিকে লক্ষ্য করলেন, তার মুখ পরিশ্রমে ক্লান্ত ও ঘামে ভেজা, মনে মনে ভাবলেন, কি অদ্ভুত?
পোয়ারো ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলেন। পোশাকে লেগে থাকা দু-একটা শুকনো পাতা ফেলে দিলেন। এরপর আপন মনে সামনের দিকে এগিয়ে চললেন।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। এভাবে এখানে ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকে মালির ভূমিকায় দেখবেন তা পোয়ারো ভাবেননি। এই যুবকটি মিস নেভিলকে বলেছিলেন যে সেক্রেটারির কাজ করে। শেষপর্যন্ত ও কিনা অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের মালি হল।
চিন্তাক্লিষ্ট মনে তিনি বাড়ির দিকে এগোলেন। তখন একটা ঘন্টাবাজার শব্দ তিনি শুনতে পেলেন। পথে মি. ব্লাস্ট ও হেলেনের সঙ্গে তার দেখা হল। তাঁরা দুজনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।
হেলেনের আইরিশ ঘেঁষা কিছু কথা পোয়ারোর কানে গেল। তিনি বলছেন–অ্যালিস্টেয়ার, তুমি মহৎ। তাই তুমি দয়া করে আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছ। কিন্তু তোমার ওই আমেরিকান আত্মীয়রা আমাকে পছন্দ করেন না। আমি তাদের কাছে অনাহুত। সেইজন্য এই সপ্তাহে তোমার নিমন্ত্রণ আমি রাখছি না।
ব্লাস্ট বললেন জুলিয়ার কথাবার্তার ধরনই ওরকম। তবে কখনো অন্তর থেকে বলে না।
হেলেন মস্ট্রেসর ধীরে ধীরে জবাব দিলেন–ওর ব্যবহারে আমি অপমানিত বোধ করি। আমি এসব সহ্য করব না। একজন আমেরিকান মহিলার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আমি আশা করিনি।
হেলেন আর কথা না বাড়িয়ে বিদায় নিলেন। এরকুল পোয়ারো এগিয়ে গেলেন মি. ব্লাস্টের সামনে। তিনি অত্যন্ত বিব্রত হয়েছেন। কোনো মহিলাকে নিয়ে যেমন হয়ে থাকে।
তিনি বিমর্ষ চিত্তে বললেন–মেয়েরা সত্যিই ঈর্ষাপরায়ণ হন। তাইনা মঁসিয়ে পোয়োররা। সুপ্রভাত। ভারী চমৎকার আবহাওয়া, বাগানটা ঘুরে দেখলেন?
কথা বলতে বলতে দু’জনে বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন। ক্লান্ত স্বরে ব্লাস্ট বললেন আজ স্ত্রীর কথা বড় বেশি মনে পড়ছে।
ডাইনিং রুমে এসে তাঁরা বসলেন। সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন মিসেস অলিভেরা।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট রাগত কণ্ঠে বললেন–জুলিয়া তোমার ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি কেন হেলেনকে আঘাত করেছ?
মিসেস অলিভেরা গম্ভীর স্বরে বললেন–হেলেন মিথ্যে কথা বলেছে।
মি. ব্লাস্ট তাঁর কথায় ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন।
এবার পোয়ারো বললেন–আপনার একজন তরুণ মালিকে দেখলাম, মনে হয় সে নতুন। কাজে যোগ দিয়েছে সম্প্রতি।
–হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। ওই তরুণকে তিন সপ্তাহ আগে নিয়োগ করা হয়েছে। আমার তিন জন মালি ছিল। তার মধ্যে একজন বার্টন। সে চলে যাওয়ায় এই ছেলেটিকে রেখেছি।
আপনি কি বলতে পারবেন ও আগে কোথায় থাকত?
–না, আমি বলতে পারব না। ম্যাক অ্যালিস্টার ওকে বহাল করেছে। তবে ম্যাক ওর কাজে সন্তুষ্ট নয়। সে ওকে তাড়াতে চায়।
–ওর নাম শুনেছেন?
–শুনেছি, তবে ঠিক মনে নেই।
–ওকে কত টাকা পারিশ্রমিক দেন?
–যতদূর মনে হয় দু’পাউণ্ড পনেরো শিলিং হবে।
পোয়ারো চিন্তিত মুখে বললেন–হুঁ।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট অবাক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু প্রশ্ন করার জন্য উদ্যত হয়েছেন, এমন সময় কাগজ হাতে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করল মিস অলিভেরা। কথায় ইতি টেনে তাঁরা দুজনেই তাঁর দিকে তাকালেন।
জেন তীব্র স্বরে বলে উঠল–মনে হচ্ছে তোমাকে খতম না করে ওরা শান্তি পাচ্ছে । তোমার রক্তপাত ঘটানোর জন্য কিছু লোক উন্মুখ হয়ে আছে।
অ্যালিস্টেয়ার হেসে বললেন–আজও ওই ভদ্রলোকের বিতর্কের খবর বেরিয়েছে। তুমি তা পড়ে বিচলিত হয়েছ। উনি ঠিক করছেন। আচরিটনের অর্থনীতি সম্বন্ধে ওঁর অগাধ জ্ঞান। ওঁকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে ইংল্যাণ্ডকে কপর্দকশূন্য করতে বেশিদিন সময় লাগবে না।
জেন বিরক্ত হয়ে বলল–তোমার চিন্তাধারা বড় সেকেলে। নতুন কিছু ভাবো, কাকা।
–পুরোনোকে বজায় রেখে যদি কিছু করা যায় তাহলে আমার সমর্থন আছে।
–তা যে সম্ভব সেকথা তুমি কখনো ভাবোনি। তোমার ধারণা এতে ভালো কিছু। হতে পারে না। চেষ্টা করে দেখে না।
–যারা পরীক্ষায় বিশ্বাসী তারা কখনো দেশের উপকার করতে পারে না।
কিন্তু গতানুগতিক জিনিস নিয়ে তুমি কি করে সুখী থাকতে পারো, অ্যালিস্টেয়ার কাকা?
এ দেহে যা আছে তাতেই আমি সুখী, সোনা।
জেন আবেগতাড়িত হয়ে বলল–আসলে, আমাদের মতো তরুণ প্রজন্মের দরকার নতুন পৃথিবী। আর তুমি ইচ্ছে করলেই সেটা গড়া যায়।
অ্যালিস্টেয়ারকে অপ্রস্তুতে ফেলে জেন বিদায় নিল। তিনি বিস্ময়ের সুরে বললেন–দিনে দিনে জেন কেমন পাল্টে যাচ্ছে। এসব ভাবনা ওর মাথায় কে ঢোকাচ্ছে?
জুলিয়া অলিভেরা অপ্রতিভ হয়ে বললেন–জেনের কথায় কিছু মনে করো না। ওর ছেলেমানুষি বুদ্ধি এখনও যায়নি।
বুঝলাম, তবে ওকে আমি বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী বলেই জানতাম।
তাঁকে কিছুটা বিভ্রান্ত বলে মনে হল এরকুল পোয়ায়োর।
জুলিয়া অলিভেরা উঠে দাঁড়ালেন। পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। তিনি অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট বলে উঠলেন–এদের কথাবার্তা আমার সব গোলমাল করে দিচ্ছে। এসব কথার অর্থ আমার বোধগম্য হচ্ছে না মঁসিয়ে পোয়ারো।
সব সময় ওরা আমার বিরুদ্ধচারণ করে চলেছে। ওরা নিজেরাও জানে না নতুন স্বর্গ ও নতুন পৃথিবী আসলে কি? তাই ওরা আমাকে বোঝাতে পারে না। কেবল ফাঁকা বুলি।
তিনি একটু হেসে বলেলেন, ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে, এই পৃথিবীতে আমিই শেষ প্রাচীন স্তম্ভ।
পোয়ারো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন–আপনাকে যদি মেরে ফেলে, তাহলে?
–মেরে ফেলবে! অতই সহজ কাজ নাকি! তাহলে একদল মূক বার বার পরীক্ষা চালাবে আর তাতেই স্থায়িত্ব ধ্বংস হবে, পচন ধরবে অর্থনীতির, তার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে আমাদের দেশ ইংল্যাণ্ডের সামাজিক ব্যবস্থা।
পোয়ারো বললেন আমি আপনার মতে একমত, মি. ব্লাস্ট আমিও চাই স্থায়িত্ব। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের বক্তব্য তিনি উপলব্ধি করলেন এবং মনে মনে শঙ্কিত হলেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট ও এরকুল পোয়ারো বেলা বাড়তে বেরিয়ে পড়লেন বাগান দেখতে। দু’জনে কেয়ারি করা পথ ধরে হাঁটছেন। মাঝে-মধ্যে ব্লাস্ট সোৎসাহে নিজের বাগান করার শখ সম্পর্কিত কিছু কথা বলছেন। নানা ধরনের গাছ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। পোয়ারাও আগ্রহের সঙ্গে তা শুনছিলেন। তবে কড়া রোদ তাঁকে সোয়াস্তি দিচ্ছিল না। শান্ত, নিস্তেজ দুপুর।
ব্লাস্ট বাগানের এক পাশ দেখিয়ে বললেন–ওদিকের উইলিয়ামগুলো কি চমৎকার ফুটেছে দেখুন। এত সুন্দর রঙের ফুল এর আগে আমি দেখিনি।
দুম! দুপুরের শান্ত পরিবেশ গুলির শব্দে খানখান হয়ে গেল। হাওয়ার বেগে কি যেন ছুটে গেল।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট পেছনে ঘুরলেন। গাছের মধ্যে দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
হঠাৎ কে যেন চিৎকার করে উঠলেন। সেই শব্দ অনুসরণ করে ঝোঁপের দিকে তাকাতে তাদের নজরে এল দু’জন মানুষ। একজন আমেরিকান উচ্চস্বরে বলছেন–হতভাগা, শয়তান, তোকে ধরে ফেলেছি। বন্দুকটা ফেলে দে বলছি।
একজন অন্যজনকে দুহাতে জাপটে ধরে ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। সকালের দেখা সেই তরুণ মালি একজন দীর্ঘকায় আমেরিকানের হাত থেকে পালাবার চেষ্টা করছিল।
এরকুল পোয়ারো ওই আমেরিকান ভদ্রলোকের গলার স্বর শুনেই চিনতে পেরেছিলেন, তার অনুমান বৃথা যায়নি। ওই গলার স্বর হাওয়ার্ড রেইকসের। ফ্রাঙ্ক কার্টার তীব্র কণ্ঠে বলল–ছেড়ে দাও বলছি। আমি গুলি করিনি।
হাওয়ার্ড রেইকস ব্যঙ্গ করে বললেন–তাহলে তুমি কি পাখি মারতে গুলি ছুঁড়েছ? নাকি মজা করছিলে?
হাওয়ার্ড এবার অ্যালিস্টেয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল, মি. ব্লাস্ট, এই লোকটা আপনাকে গুলি ছুঁড়তে সচেষ্ট হয়েছিল। সেই মুহূর্তে আমি দেখি এবং ওকে জাপটে ধরে ফেলি।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য চিৎকার করে বলল, উনি মিথ্যে কথা বলছেন। আমি ঝোপ ছাঁটছিলাম। তখন একটা গুলির শব্দ শুনতে পাই। আর দেখি বন্দুটা আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। আমি স্বভাববশত সেটাকে তুলে নিই। সঙ্গে সঙ্গে উনি আমায় পাকড়াও করেন।
হাওয়ার্ড রেইকসও নাছোড়বান্দা। লোকটিকে ছেড়ে দেবেন না সহজে। তিনিও সমস্বরে বললেন–আমি মিথ্যে বলছি না তুমি বলছ? আমি দেখেছি তোমার হাতে বন্দুক। এটা থেকেই গুলি ছুঁড়েছ তুমি। তিনি এরকুল পোয়ারোকে বন্দুকটা দিয়ে বললেন, আপনি বন্দুকটা পরীক্ষা করে দেখুন তো। মনে হয় ওটার মধ্যে আরও কিছু কার্তুজ এখনও আছে।
পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ, আপনার অনুমানই ঠিক।
অ্যালিস্টেয়ার ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন–তোমার নামটা যেন কি?
পোয়ারো বলে উঠলেন–আমি বলছি। এর নাম ফ্র্যাঙ্ক কার্টার।
সে তিরিক্ষি মেজাজে বলল–প্রথম থেকেই আপনি আমাকে অনুসরণ করছেন। গত রবিবারও নানারকম প্রশ্ন করে আমাকে বিরক্ত করেছিলেন। কেন মিথ্যে আমাকে দোষারোপ করছেন? আমি ওঁকে গুলি ছুঁড়িনি।
পোয়ারো বললেন তাহলে কে গুলি ছুঁড়েছে বলে তোমার মনে হচ্ছে? এখানে আমরা ছাড়া আর কে আছে?
গুলির শব্দ জেন অলিভেরার কানে গিয়েছিল। সে ছুটে এল। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ, সে হাওয়ার্ডকে দেখে বলল–তুমি? এখানে?
হাওয়ার্ড শান্তস্বরে বলল–হ্যাল্লো জেন, এক্ষুনি তোমার কাকাকে এই ছেলেটি গুলি ছুঁড়েছিল। আমি বাঁচালাম।
জেন থতমত খেয়ে বলল–তুমি বাঁচালে?
মি. ব্লাস্ট ইতস্তত করে বললেন–আমার ত্রাণকর্তা হিসেবে আপনি সর্বদা ঠিক সময়েই এসে হাজির হন, তাই না। আপনার পরিচয়?
জেন তাড়াতাড়ি বলে উঠল–ওর নাম হাওয়ার্ড রেইকস। ও আমার বন্ধু।
ওহ। আপনিই জেনের বন্ধু। ধন্যবাদ, আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য।
সেই মুহূর্তে সেখানে এসে হাজির হলেন জুলিয়া অলিভেরা। তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন একটা গুলির শব্দ শুনলাম। অ্যালিস্টেয়ার তুমিও নিশ্চয়ই শুনেছ? ভ্রু কুঁচকে হাওয়ার্ড রেইকসের দিকে তাকিয়ে বললেন–তুমি? তুমি এখানে কেন? তোমার সাহস তো কম না।
জেন আমতা আমতা করে বলল–ও এখানে এসে না পড়লে অ্যালিস্টেয়ার কাকাকে রক্ষা করা যেত না, না।
মিসেস অলিভেরা বিকট চিৎকার করে বললেন–কি? কে এমন দুঃসাহস দেখিয়েছে? আমি–আমি তাকে…….।
জেন ফ্র্যাঙ্ককে দেখিয়ে বলল–এই লোকটা।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের প্রচণ্ড রাগ হল। সে দাঁত খিঁচিয়ে বলল–মিথ্যে কথা। আপনারা কেন আমাকে বিশ্বাস করছেন না বলুন তো?
মিসেস অলিভেরার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর অপলক দৃষ্টিতে সবাইকে দেখে নিলেন। এবার বললেন প্রিয় অ্যালিস্টেয়ার, এসব কি হচ্ছে? ভগবানের অশেষ দয়া তোমাকে জীবিত রেখেছেন। আমার শরীর কেমন করছে, মাথা ঘুরছে। একটু ব্রাণ্ডি খাওয়াতে পারেন?
ব্লাস্ট তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন–অবশ্যই। বাড়ির ভেতরে যাওয়া যাক। ব্লাস্ট তাঁর হাত ধরে এগিয়ে গেলেন। যেতে যেতে পোয়ারোকে বললেন আপনারা ওকে নিয়ে বাড়িতে আসুন। আমি পুলিশে খরব দিচ্ছি। পুলিশ এলে ওকে তাদের হাতে তুলে দেব।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তার গলা দিয়ে একটিও শব্দ বেরোল না। তাছাড়া তার হাত-পা থর থর করে কাঁপছিল।
হাওয়ার্ড রেইকসের চোখে নিষ্ঠুর হাসির ঝিলিক। তিনি তাকে টানতে টানতে নিয়ে চললেন।
হাওয়ার্ড রেইকস এবার পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বললেন–কি গোয়েন্দা মশাই, আপনার কি কিছু বলার আছে? আপনাকে এবার চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন মি. ব্লাস্ট। তিনি যে বেঁচে আছেন তাতে আপনার কৃতিত্ব নেই।
এরকুল পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–এই নিয়ে দুবার আপনি মি. ব্লাস্টকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালেন, তাই না। মি. রেইকস?
–কি বলতে চাইছেন?
–আমি বলতে চাইছি, কিছুদিন আগেও আপনি এভাবে একটি লোককে পাকড়াও করেছিলেন। সে মি. ব্লাস্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল, তাই তো?
হাওয়ার্ড ঢোক গিলে বললেন–ইয়ে হ্যাঁ–মানুষের উপকার করা আমার স্বভাব।
পোয়ারো তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তবে এটা অন্যরকম। সেদিন যে লোকটিকে গুলি ছুঁড়তে দেখেছিলেন সে গুলি ছোঁড়েনি। আপনি ভুল করেছিলেন।
ফ্র্যাঙ্ক কর্কশ স্বরে বলল, এখনও উনি ভুল করেছেন।
রেইকস তাকে ধমকে থামিয়ে দিলেন।
পোয়ারো নিজের মনে বললেন–কি আশ্চর্য কাণ্ড, আমি ভাবতে পারছি না।
এরকুল পোয়ারো নৈশ ভোজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। পোশাকে সজ্জিত হয়ে তিনি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। টাই ঠিক করতে করতে ভাবলেন, ব্যাপারটা কিছুতেই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি স্বচ্ছ। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকেও বিশ্বাস করা যায় না। ও গ্ল্যাডিসকে যা বলেছে তা সবই মিথ্যে। ও বলেছিল সে সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেই কাহিনির মধ্যে সত্যতা নেই। ফ্র্যাঙ্ক যে স্বভাবের মানুষ তার পক্ষেই এইরকম মিথ্যাচার করা সম্ভব। তাই হাতে হাতে ধরা পরার পর বার বার একটা কথা বলছে, সে গুলি করেনি, তাকে ইচ্ছে করে ফঁসানো হচ্ছে। এছাড়া বলার মতো তেমন জোড়ালো কোনো যুক্তি নেই তার কাছে।
এদিকে হাওয়ার্ড রেইকস? অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে দু-দুবার গুলি করার মুহূর্তে তার হাজির হওয়া। ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক বোধ হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে সে বলতে পারে, এখানে সে এসেছিল তার প্রেমিকা জেনের সঙ্গে দেখা করতে। আর এই গল্পের মধ্যে কোনো অযৌক্তিকতা নেই।
আর এটাও সত্যি কেউ গৃহকর্তার প্রাণরক্ষা করলে তাকে তো সমাদর করতেই হয়। তাই তাকে বাড়িতে থাকতে দিতে আপত্তি করা উচিত নয়। সেইরকম মি. ব্লাস্ট কৃতজ্ঞতা বশত তাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আর এতেই মিসেস অলিভেরার আপত্তি। এমনিতেই রেইকস তাঁর অপছন্দের পাত্র। তাই অসন্তোষ প্রকাশ করলেও মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
এরকুল পোয়ারো সন্ধ্যে থেকেই হাওয়ার্ড রেইকসকে লক্ষ্য করেছেন। সে বন্ধুসুলভ আচরণ করেছে। তার মধ্যে কোনো ধবংসাত্মক মনোভাব প্রকাশ পায়নি। রাজনীতি নিয়েও সরব হয়নি। তার ব্যবহার কাউকে রুষ্ট করেনি। সে সারাক্ষণ ভদ্র মানুষের মুখোশ পরে থেকেছে।
রাতে পোয়ারো বিশ্রামের জন্য ব্যবস্থা করছিলেন। এমন সময় দরজায় ঠুক চুক শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। তিনি সচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–কে ওখানে? ভিতরে আসুন।
পোয়ারোর সায় পেয়ে হাওয়ার্ড রেইকস ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন।
পোয়ারোর ভীত সন্ত্রস্ত মুখ দেখে তিনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন আমাকে দেখে চমকে উঠেছেন মনে হয়। সারা সন্ধ্যা আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করেছেন। আপনার সন্ধিহান চোখের দৃষ্টিতে আমি চিন্তার কালো মেঘ দেখতে পেয়েছিলাম।
–তাতে আপনার উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
–আমি জানি আপনার মনে আমার সম্বন্ধে কৌতূহল আছে। হয়তো ইতিমধ্যে অনেক কিছু জেনেছেন। তাই একটু উৎকণ্ঠা তো হতেই পারে।
–তা যদি হয় আপনার অসুবিধা কোথায়?
–আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে সব কথা বলব। সেদিনের ঘটনাটা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো হয়েছে। সেদিন যখন মি. ব্লাস্ট ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তখন আমি সেখানে ছিলাম। আর সেই মুহূর্তে লোকটি তার দিকে গুলি ছোঁড়ে। সেটা আমার নজরে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমি লোকটির ওপর লাফিয়ে পড়ি ও ধরে ফেলি। লোকটি আমার জানা। তার নাম রাখলাম। সে খুব ভালো ছেলে। দোষের মধ্যে সে অল্পতেই রেগে যায়। আর রাগলে তার জ্ঞান থাকে না। সে ভারতীয়। ভারতের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে সে তা অনুধাবন করেছে। যাই হোক ওই দুজন সম্মানীয় ব্যক্তির সেদিন কোনো ক্ষতি হয়নি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই গুলি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আমি ওই ভারতীয় ছাত্রটিকে পালানোর সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলাম। তাই ময়লা জামা কাপড় পরা একটি তরুণকে জাপটে ধরে নাটক করেছিলাম। কিন্তু আশা ফলবতী হয়নি। আপনাদের পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পারিনি। তারা আমার থেকে বেশি চালাক। সুতরাং রামলালকে ধরতে বেশি কসরৎ করতে হয়নি ওদের। এটাই প্রকৃত ঘটনা। বুঝেছেন গোয়েন্দা মশাই?
এরকুল পোয়ারো বললেন–আর আজকের ঘটনার কি জবাবদিহি করবেন?
মি. রেইক গ্রীবা ফুলিয়ে বললেন–আজকের ঘটনা অন্য রকমের। এখানে রামলাল নেই। আছে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার। সেইই গুলি ছুঁড়েছিল। বন্দুকসহ ওকে আমি পাকড়াও করেছি। ও দ্বিতীয়বার গুলি ছোঁড়ায় সচেষ্ট হয়েছিল। আমি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করি।
পোয়ারো বললেন মি. ব্লাস্টের নিরাপত্তার জন্য আপনি খুব ভাবেন?
রেইকস দরাজ হাসি হাসলেন।
–আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? মানছি আমি মি. ব্লাস্টের নীতির পক্ষপাতী নই। ওনার বেঁচে থাকা সকলের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। মানুষের উন্নতির জন্য ওনাকে মেরে ফেলা উচিত। তবে আপনি ভাববেন না ওনার ওপর আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে। উনি ইংরেজ হলেও চমৎকার মানুষ। এসব কথা ভেবেই আমি ওনাকে দু-দুবার রক্ষা করেছি।
নীতি ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য অনেক।
–সেকথা আমি অস্বীকার করছি না। আমার মনে হল আপনাকে সব কথা বলা উচিত। তাই বললাম, মন ভোলানো হাসি হেসে হাওয়ার্ড রেইকস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
গ্রামের গির্জা। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট সকালের প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে এসেছেন। নিমন্ত্রণ কর্তার আহ্বানে এরকুল পোয়ারোও এসেছেন গির্জায়। মিসেস অলিভেরা ও তার মেয়ে জেন কৌশলে তাদের সঙ্গী হয়েছেন। হাওয়ার্ডও বাদ যায়নি। সেও এসেছে।
হাওয়ার্ড রেইকস অবিশ্বাসের সুরে বলল–মি. ব্লাস্ট, আপনিও তাহলে নিয়ম করে গির্জায় আসেন?
অ্যালিস্টেয়ার মিষ্টি হেসে বললেন–আমি গ্রামের মানুষ। তাই এখানকার মানুষদের মতামতকে মর্যাদা দিই। কথাটা শুনে পোয়ারো মাথা নেড়ে বিজ্ঞের হাসি হাসলেন।
মিসেস অলিভেরা ভরাট গলায় আবৃত্তির সুরে প্রার্থনা করছেন–হে পরমপিতা, আমাকে শয়তান মানুষ থেকে রক্ষা করুন, বদ মানুষ থেকে উদ্ধার করুন।
মিসেস অলিভেরার বক্তব্য পোয়ারো অনুধাবন করতে পারলেন। তিনি ভাবলেন, এক্ষেত্রে হাওয়ার্ডকে শয়তান ও বদ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিশ্চয়ই।
গির্জায় কয়ার বয়রা প্রার্থনা সংগীত গাইছে, হিংস্র সাপের মতো তাদের জিভ লকলক করছে, অ্যানাকোণ্ডার বিষ তাদের ওষ্ঠে।
সেই সঙ্গে জুলিয়ার তীক্ষ্ণস্বর আরও তীব্র হয়ে উঠল–সে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের, বিশ্বাসঘাতকদের সংস্রব থেকে আমাকে দূরে রাখো। দুষ্টকে দমন করার সহাস দাও আমাকে…।
এরকুল পোয়ারো তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন–হে প্রভু, আমাকে সকল প্রলোভন থেকে দূরে রাখো, আমাকে শক্তি দাও চক্রান্তকারীদের পাতা ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার…।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখ গেল একটা গর্তের দিকে। সেই গর্তটা তার পায়ের কাছেই রয়েছে। একটু অসাবধান হলেই তাতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। খুব কৌশলে গতটা খোঁড়া হয়েছে। তাঁকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা একেবারে পাকা।
তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন বাহ্যিক জ্ঞান শূন্য হয়ে। কে যেন সম্মোহনি শক্তিতে সম্মোহিত করেছে। ইত্যবসরে প্রার্থণা গীত সঙ্গে হয়েছে। প্রার্থনাকারীরা সবাই আসন গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পোয়ারো মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। জেন অলিভেরা ওই দৃশ্য দেখে তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। এরকুল পোয়ারো সম্মোহিতের মতো বসে পড়লেন।
একজন বৃদ্ধ যাজক পাঠ শুরু করলেন বাইবেল থেকে। তিনি বললেন, স্যামুয়েলের প্রথম বইয়ের পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ থেকে আজ পড়ব।
বৃদ্ধ যাজকের কোনো কথাই এরকুল পোয়ারোর কানে ঢুকছিল না। তিনি গভীর আচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে গিয়েছেন। যার মধ্যে কিছু টুকরো ঘটনা ঘূর্ণির একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
একটা জুতোর বকলস, ননম্বর সাইজের মোজা, ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেডের গোয়েন্দা কাহিনি, মি. মর্লের অভিনীত অংশ, মি. অ্যামবেরিওটিসের চালচলন এবং সব শেষে বিকৃত একটা মুখ–এ সব যেন স্বপ্নের মতো তার চোখের পর্দায় ভেসে উঠেছে।
এই প্রথম পোয়ারো ঘটনাটা সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করতে পারলেন।
যাজকের গম্ভীর কণ্ঠস্বর তার চমক ভাঙলো। তিনি শুনতে পেলেন, তুমি প্রভুর আদেশ অমান্য করেছ তাই তিনি তোমাকে রাজা হিসেবে পরিত্যাগ করলেন….।
০৭. তেরো, চোদ্দ, প্রেমে মজে সদ্য
জাহাজ কোম্পানির টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রেইলি। দূর থেকে তাকে দেখে এরকুল পোয়ারো এগিয়ে এলেন। বললেন–মি. রেইলি বোধ হয়?
গলা শুনে পাশ ফিরে তাকালেন রেইলি। বিশাল গোঁফ আর ডিম্বাকৃতি মাথার ছোটো খাটো একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
পোয়ারো আবার বলে উঠলেন–আমাকে চিনতে পারলেন না, মনে হচ্ছে,?
রেইলি হেসে জবাব দিলেন–আপনার মতো স্বনামধন্য মানুষকে একবার দেখলে সহজে ভোলা যায় না, মঁসিয়ে পোয়ারো।
-কোথায় চলেছেন এ দেশ ছেড়ে?
–আমি চলেছি সুদূর আমেরিকায়। আপনি নিশ্চয় ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন। মঁসিয়ে?
পোয়ারো বললেন নিজের দেশ বেলজিয়ামে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে ওখানে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসি।
রেইলি বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন–তাহলে আপনি আবার ফিরছেন। কিন্তু আমার ফেরার আশা নেই। কুইন শার্ট স্ট্রিটে আমাকে আর ডাক্তারি করতে দেওয়া হবে না, মঁসিয়ে পোয়ারো।
সত্যিই খুব দুঃখের কথা, মি. রেইলি!
–এতে আমি একটুও দুঃখ পাইনি। অনেক টাকা ঋণ করেছি এখানে। রেইলি হেসে আবার বললেন–তবে ভাবলে খুব আনন্দ পাই। একথা সত্যি ধার রেখে যাচ্ছি বলে গুলি করে আত্মঘাতী হব, এমন মানসিকতা আমার নেই। আমার মত হল, যা হয়ে গেছে তা পিছনে ফেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আমি উচ্চশিক্ষিত। তাই কাজ পেতে আমার খুব একটা অসুবিধা হবে না।
সেদিন মিস জর্জিনা মলের সাথে দেখা হয়েছিল।
–তাতে কি আপনি খুব খুশি হয়েছিলেন? মনে হয় না। মেয়ে সৈনিকের মতো দশাসই চেহারা, গোমড়া মুখো, বদ মেজাজী মহিলা আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই।
পোয়ারো এবার প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে বললেন মি. মর্লের মৃত্যু সম্পর্কে কানোর আদালত যে রায় ঘোষণা করেছে সেটা আপনি শুনেছেন? এ বিষয়ে আপনার কি মত?
রেইলি ধীরে ধীরে বললেন–আদালতে প্রমাণিত হয়েছে মি. মর্লে গ্রীক ভদ্রলোকটিকে ভুল ইঞ্জেকশান দিয়েছিলেন। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সে মাতাল অবস্থায় ছিল। নতুবা সে তাকে খুন করার জন্যই এই ভুল করেছিল। আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারি হেনরি কখনো মদ ছোঁয়নি।
আপনার বয়ান অনুযায়ী বলতে হবে এটা তার ইচ্ছাকৃত গাফিলতি।
–আপনি ভুল করছেন। আমি একথা বলিনি। এমন দোষারোপ অত্যন্ত অন্যায়। আসলে তার দ্বারা এরকম ভুল হওয়া আদৌ সম্ভব না। আর আমিও বিশ্বাস করি না।
–এর নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
–অবশ্য আছে। তবে এনিয়ে এখনও আমি ভাবনা চিন্তা করিনি।
পোয়ারো জানতে চাইলেন–খুনের দিন মি. মর্লেকে শেষে কখন জীবিত দেখেছিলেন আপনি? মনে আছে?
মাথা নেড়ে রেইলি বললেন–হ্যাঁ, মনে আছে। তবে খুনের দিন হেনরির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল ঘটনার আগের দিন। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ।
পোয়ারো গলার স্বরে তীব্রতা এনে বললেন–উঁহু, আপনি ঠিক বলছেন না। আমার যতদূর মনে পড়ে, আপনি ঘটনার দিন তার ঘরে গিয়েছিলেন। এই ধরুন সাড়ে এগারোটা হবে তখন।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমি গিয়েছিলাম। সেই সময় সে একজন রোগী দেখছিল। আমার কিছু যন্ত্রপাতি কেনার ছিল। তাই ওই বিষয়ে ওর কাছে পরামর্শ নিতে গিয়েছিলাম।
সায় দিয়ে পোয়ারো বললেন আপনার এক রোগী মি. রেইকস এসেছিলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি চলে গিয়েছিলেন। আপনি ওই আধঘন্টা কি করছিলেন?
সুযোগ পেলে যা করে থাকি। গ্লাসে কিছু পানীয় ঢেলে পান করি। মর্লেকে টেলিফোন করি। তারপর এক মিনিট সেখানে থেকে চলে আসি।
পোয়ারো জেরার ভঙ্গীতে বললেন–সাড়ে বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত মি. বার্নেস আপনার ঘরে ছিলেন। তারপর আর কোনো রোগী আপনার ছিল না। আপনি কটার সময় ওখান থেকে বেরিয়ে আসেন?
–সাড়ে বারোটার পর।
–তারপর কি করেন?
–ঠিক আগে যা করেছি। আপনি তো জানেন আমার মদ্য পানে অরুচি নেই।
আবার মর্লের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?
–আপনি বলতে চাইছেন আমি তাকে গুলি করেছি। এর আগেও আমি বলেছি, ওটা আমার কাজ নয়। অবশ্য আপনার ওপর নির্ভর করছে বিশ্বাস করা না করা।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন–বাড়ির পরিচারিকা অ্যাগনেস সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?
বিস্ময়ের সুরে রেইলি বললেন, ভারী অদ্ভুত প্রশ্ন। তবুও বলছি, ওর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কাজের মেয়েদের ভার জর্জিনার ওপর। ও সব কিছুর তদারকি করে থাকে। মেয়েটা আমাকে ভীষণ ভয় পায়। চোখ তুলে দেখেনি কোনোদিন।
মেয়েটিকে দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল ও বোধহয় কিছু বলার চেষ্টা করেছিল।
রেইলি হেসে মাথা নাড়লেন। তারপর টিকিট নিয়ে চলে গেলেন।
পোয়ারো যাবেন কিনা এখনও স্থির করতে পারেননি। তাই কাউন্টারের সামনে থেকে সরে এলেন।
এরকুল পোয়ারো একদিন এলেন হ্যামস্টেডে। মিসেস অ্যাডামসের সাথে সাক্ষাৎ করতে। তাকে দেখে মিসেস অ্যাডামস অবাক হয়েছিলেন। পোয়ারো স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপের প্রতিভূ হয়ে গিয়েছিলেন। মিসেস অ্যাডামসের কাছে তাঁর পরিচয় বিদেশী হিসেবে।
ফ্ল্যাটে পাওয়া নিহত মহিলার পরিচয়ের চাঞ্চল্যকর বর্ণনা শোনার পর মিসেস অ্যাডমস বললেন, খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারলাম দেহটা মিস সেইনসবারি সীলের নয়, মিসেস চ্যাপমান নামে এক মহিলার। খবরটা পড়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে এটা ভেবে দুঃখ হচ্ছে আপনারা এখনও তার খোঁজ পেলেন না। আর সে কেন যে এভাবে অদৃশ্য হয়ে রয়েছে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, মি. পোয়ারো, আমার বান্ধবীর কি স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে?
পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন–এটা হওয়া সম্ভব। এরকম ঘটনার কথা এর আগে আমি শুনেছি। ডাক্তারি শাস্ত্রে একে বলে অ্যামনেসিয়া। মিসেস অ্যাডামস বললেন, হ্যাঁ, আমার এক বন্ধুর এরকম রোগ হয়েছিল।
পোয়ারো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–মাদাম, মিস সীলের মুখে কখনো মিসেস অ্যালবার্টের নাম শুনেছেন?
না। মিসেস অ্যাডামস আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলেন, পুলিশ কি বুঝতে পেরেছে। মিসেস চ্যাপম্যানকে কে খুন করেছে?
–এটা তদন্ত সাপেক্ষ। এবার পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আপনি কি মিস সীলকে দন্ত–চিকিৎসক মি. মর্লের কাছে যেতে বলেছেন?
-না, আমি হার্লে স্ট্রিটের মি. ফ্রেস্কের কাছে যাই। আমি যদি জানতাম সেইনসবারি দাঁতের অসুখে কষ্ট পাচ্ছে তাহলে সেখানেই পাঠাতাম। মি. মর্লের কাছে নয়।
পোয়ারো বললেন মিস সীল, মর্লের নাম শুনেছেন মিসেস চ্যাপম্যানের থেকে।
মিসেস অ্যাডামস বললেন–হতে পারে।
পোয়ারো এবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন মিস সেইনসবারি সীলের সাথে প্রথম দেখা হয় কোথায়?
তিনি জবাব দিলেন মিস সীলকে প্রথম দেখি ভারতে। সেখানেই তার সাথে আমার পরিচয় হয়।
–মিস সীলের সঙ্গে মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের প্রথম দেখা হয় কি ভারতেই?
–ওহ্, আমি বলতে পারব না। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট! সেই বিখ্যাত ব্যাঙ্কার। ওরা ভাইসরায়ের কাছে গিয়েছিলেন। মনে হয় না আমার বান্ধবী কখনো মি. ব্লাস্টকে দেখেছে। এত উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হলে সে অবশ্যই আমাকে বলত।
ব্লাস্ট পরিবারের অন্য কাউকে তিনি চিনতেন কি?
–ওহ, হ্যাঁ। ও তাদের চিনত মনে হয় না। আমাদের সব বান্ধবীরা একরকম সাধারণ মানুষ।
মিসেস অ্যাডামস বান্ধবীর প্রশংসা করতে লাগলেন। তিনি বলে চললেন, ওর মতো বান্ধবী খুব কম পাওয়া যায়। ওর মন খুব নরম। সকলের দুঃখে ও দুঃখী। ও সবার উপকার করত প্রাণ দিয়ে। ওর প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। এছাড়া কলকাতার মিশনারীদের জন্য ও চাঁদা তুলত। এই টাকা জোগারের জন্য আমার বান্ধবী অপরাধ করতেও কুণ্ঠা বোধ করত না। এবার বুঝতে পারছেন তো ও কতটা উদারমনস্ক মানুষ ছিল, মঁসিয়ে পোয়ারো।
সত্যিই, তাই। পোয়ারো ভাবলেন, মিস সীলের গুণের কথা মি. বার্নেসও বলেছিলেন। তাঁর মতে মিস সীল দয়ালু, সম্ভ্রান্ত, ভদ্র একজন মহিলা। এরকম মানুষের মধ্যে অপরাধ বোধের বাসনা সুপ্ত থাকে। নিপুণভাবে পরখ করলে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
মি. অ্যামবেরিওটিস ও মিস সীল একই জাহাজে ভারত থেকে ফিরেছিলেন। তারা একসঙ্গে স্যাভয় হোটেলে লাঞ্চ সেরেছেন, এই প্রমাণও পাওয়া গেছে। তিনি কিং লিওগোল্ড ম্যানসনে দু’দিন গিয়েছিলেন। যে ফ্ল্যাটে তিনি গিয়েছিলেন সেই ফ্ল্যাটে একটি মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। তার পরনে ছিল মিস সীলের পোশাক। এমনকি তার হাত ব্যাগটিও ওই মৃতদেহের পাশে পাওয়া গিয়েছিল।
তিনি পুলিশের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তারপর হঠাৎ একদিন গ্রেনগাউরি কোর্ট হোটেল থেকে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন।
এরকুল পোয়ারোর থিয়োরির সঙ্গে মিলিয়ে এর কোনো ব্যাখ্যা কি আছে?
তিনি ভাবলেন, অবশ্যই আছে।
একরকম ঘোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন এরকুল পোয়ারো। ট্যাক্সি ধরতে হবে। তিনি এসে হাজির হলেন রিজেন্ট পার্কে।
গ্রীষ্মকালীন একটা বিকেল। ফুরফুরে বাতাস বইছে। কিছু বাচ্চা আয়াদের সঙ্গে পার্কে বেড়াতে এসেছে। তারা প্যারামবুলেটারে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে। হাসছে, খেলছে। কোনো কোনো বাচ্চা কাগজের নৌকো তৈরি করে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। গাছের নিচে প্রেমিক প্রেমিকা বসে আলাপচারিতায় মত্ত রয়েছে।
এইসব দেখে তার মনে পুলক জাগল। তার অতীতের কথা মনে পড়ল। কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব সুখের দিনগুলো।
তাঁর মনের পরদায় ভেসে উঠল এক রহস্যময়ী নারীর চেহারা। এক ভেনাস যেন স্বর্গের এক পরী। সে রাশিয়ান বংশোদ্ভুত কাউন্টেস ভেরা। অপূর্ব সুন্দরী তন্বীর কাউন্টেসের সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো মেয়েই নেই এই দেশে। পোয়ারোর এও মনে পড়ল কত বড় তস্কর কাউন্টেস।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে চললেন খুশি মনে। আচমকা তার চোখে ধরা পড়ল এক রোমান্টিক দৃশ্য।
একটি গাছের আড়ালে একটি তরুণ ও তরুণী বসে আছে। তরুণটি মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে বলে পোয়ারোর মনে হল। তিনি ওই দুটি মূর্তিকে চিনতে পারলেন।
জেন অলিভেরা ও তার আমেরিকান বন্ধু হাওয়ার্ড রেইকস। এরাও তাহলে রিজেন্ট পার্কে আসে বেড়াতে? তার মুখে কাঠিন্যের ভাব।
মিনিট কয়েক চিন্তা করলেন। তারপর তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বিচিত্র কায়দায় মাথার টুপি খুলে তাদের সামনে তিনি দাঁড়ালেন।
তাকে দেখে জেন অলিভেরার চোখ মুখ খুশিতে ভরে গেল। কিন্তু হাওয়ার্ড রেইকস তার অযাচিত আবির্ভাবে খুব রেগে গেল।
সে বিরক্ত হয়ে বলল–ওহ, এখানেও আপনাকে আসতে হল। আপনি কি আমাদের পেছন ছাড়বেন না?
জেন শান্ত স্বরে বলল–কি অদ্ভুতভাবে আপনি সব জায়গায় হাজির হন তাই না, মঁসিয়ে পোয়ারো?
রেইকস ঠাণ্ডা গলায় বলল–সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা।
পোয়ারো মিষ্টি হেসে বলল–অনধিকার প্রবেশ করিনি তো?
মিস অলিভেরা সহজভাবে বলল একদম না। রেইকস মুখে কিছু বলল না। তবে মনে মনে গর্জে উঠতে চাইল।
–বেশ খোশ-মেজাজে আছেন তো?
–আগে ছিলাম, এই মুহূর্তে আর নেই। রেইকস গর্জে উঠে বলল।
জেন ধমক দিয়ে বলল–চুপ কর, হাওয়ার্ড। তুমি শালীনতা হারিয়ে ফেলছ।
রেইকস বলল–হুম, শালীনতা বজায় রাখব কার জন্য?
জেন বলল–ভবিষ্যতে মি. পোয়ারোকে তোমারই উপকারে লাগবে। উনি আমার কোনো প্রয়োজনে আসবেন না। আমি সুন্দরী, অঢেল প্রতিপত্তি আছে। এছাড়া কিছু প্রভাবশালী বন্ধু বান্ধব আছে। তাই অভদ্র ব্যবহার করলেও আমার কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
রেইকস বলল–এইসব নিম্নমানের কথাবার্তা আমার পছন্দ নয়। তাই এখানে থাকা আমার উচিত হবে না। আমি চলে যাচ্ছি, জেন। সে উঠে দাঁড়াল এবং পোয়ারোর দিকে মাথা নুইয়ে বিদায় নিল।
জেন তার গমনপথের দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল।
এরকুল পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু ইতস্তত করে বললেন–একটা প্রবাদ আছে, জানেন মিস অলিভেরা। যখন প্রেম করবেন তখন দু’জনই শ্রেয়, তৃতীয় ব্যক্তি এলেই সব গোলমাল হয়ে যায়।
–আপনি খুব মজার কথা বলতে পারেন, জেন হেসে জবাব দিল।
-তেরো, চোদ্দতে প্রেম জমে সদ্য। দেখুন চারপাশের লোকগুলোকে। তারা সবাই প্রেমাস্পদের হাত ধরে বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছেন। আপনারাও তো সেইরকম বিবাহ ইচ্ছুক জোড়।
জেন ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে পোয়ারোকে লক্ষ্য করল। পরে বলল, আপনি আমায় ক্ষমা করুন মঁসিয়ে পোয়ারো। সেদিন আমি ভুল বুঝেছিলাম। আমার ধারণা ছিল আপনি হাওয়ার্ডের ওপর নজরদারি করার জন্য এসেছেন ক্রমহ্যামে কিন্তু অ্যালিস্টেয়ারো কাকার কাছে শুনলাম তিনিই আপ-কে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি ওই নিরুদ্দিষ্ট মহিলা মিস সেইনসবারি সীলের অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত ভার দিয়েছেন আপনাকে। কথাটা ঠিক বলছি তো?
পোয়ারো সহাস্যে বললেন–একশোভাগ ঠিক।
–সেদিন আপনাকে কটু কথা বলার জন্যে আমি লজ্জিত ও দুঃখিত, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার সন্দেহ হয়েছিল, আমার ও হাওয়ার্ডের মধ্যেকার সম্পর্ককে নষ্ট করতে চাইছিলেন। হাওয়ার্ডের প্রতি কাকার মনে বিতৃষ্ণা পোষণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
যদি কথাটা সত্যি হত, মাদামোয়াজেল। আমি সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। মি. রেইস যদি সাহস করে কার্টারের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়নে তাহলে কি হত বলুন তো? তিনি আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করেছিলেন বলেই সে আর গুলি ছুঁড়তে পারেনি। এর ফলেই মি. ব্লাস্টের প্রাণ রক্ষা পেল।
আপনি খুব সহজ করে কথাগুলো বলতে পারলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি বুঝতে পারি না আপনি রসিকতা করছেন কিনা?
পোয়ারো বললেন–না, না মাদামোয়াজেল, আমি রসিকতা করছি না, আমি সত্যি কথা বলছি।
জেন বলল–এভাবে তাকিয়ে আপনি কি দেখছেন? মনে হয় আপনি আমার দুঃখে কষ্ট পাচ্ছেন। আপনি ঠিক ধরেছেন, মিস অলিভেরা, অতি সত্বর আমি একটি দুঃখজনক কাজ করব, তার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
–তাহলে সেটা না করাই মঙ্গলের।
না, না মাদামোয়াজেল, কাজটা আমাকে করতেই হবে।
জেন অলিভেরা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পোয়ারোকে দেখল। তারপর বলল মিস সীল না কি যেন নাম মহিলার, তাকে কি খুঁজে পেয়েছেন?
পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–না খুঁজে পাইনি। তবে কোথায় আছে জানতে পেরেছি।
–সে কি এখনও বেঁচে আছেন?
–আমি কি সেকথা বলেছি?
জেন অসন্তুষ্ট হয়ে বলল–আশ্চর্য তোলয় জীবিত আর নয় মৃত, একটা হবেই।
খুব সহজ ব্যাপার নয়, মিস অলিভেরা।
–গোয়েন্দাদের এই একটা মস্ত দোষ। সব কিছুতেই গলদ দেখেন।
সাধারণ লোকেরা আমাদের সম্বন্ধে এইরকম ধারণাই করে থাকেন।
জেন উঠে দাঁড়াল। বলল–ব্যাপারটাকে এত মজার ভাববেন না। সে একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, হাওয়ার্ড বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ওর ধারণা আমি খুব দুর্বল মনের মানুষ। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আমি ওকে এখনও সম্মতি জানায়নি। আপনি একটা বুদ্ধি বের করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। কথা বলতে বলতে সে পোয়ারোর একটা হাত উত্তেজনার বশে চেপে ধরলেন।
পোয়ারো স্মিত হেসে বললেন আমার কাছে পরামর্শ চাইছেন? আপনার অনেক প্রিয়জন আছেন বুদ্ধি দেবার জন্য।
আমার প্রিয়জন বলতে মা আর অ্যালিস্টেয়ার কাকা। কথাটা শুনে মা ভীষণ রাগারাগি করবেন। আর রইলেন কাকা। তিনি খুব সাবধানী মানুষ। বলবেন, আমি এখনও ছোট আছি। তোমার বন্ধুকে ভালো করে চেনো। একটু ভাবনা চিন্তা করো। তারপর না হয় বিয়ের জন্য প্রস্তুত হবে। এত তাড়াহুড়ো করার দরকার কি…..।
–আপনার বন্ধুরা?
আমার কোনো বন্ধু নেই। একদল বোকা আছে যাদের সঙ্গে আমি মাঝেমধ্যে কথা বলে থাকি। একমাত্র হাওয়ার্ডকেই সত্যিকারের মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। তাই ওকে এত ভালবাসি।
তবুও আমি আপনার আপনজন নই। আমার থেকে পরামর্শ নেওয়ার কারণ কি, মিস অলিভেরা?
জেন বলল–কারণ আপনার মুখের অদ্ভুত ভাবটা আমাকে বিচলিত করেছে। আমি বুঝতে পারছি আপনি কোনো বিপদের আশঙ্কা করছেন। এমন কিছু ঘটতে চলেছে যা আপনি বুঝতে পারছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে জেন একটু থামল। আবার বলল–বলুন, আমি ঠিক বলেছি কিনা?
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
এরকুল পোয়ারোর বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। তিনি বাড়িতে ঢুকতেই জর্জের মুখে জানতে পারলেন চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ এসেছেন।
পোয়ারো দ্রুতবেগে ঘরে ঢুকলেন। জ্যাপের মুখের ওপর তার চোখ পড়ল। সেখানে বিষণ্ণতার পরশ রয়েছে।
পোয়ারোকে দেখে জ্যাপ বললেন–আমি এসে গেছি বন্ধু। সত্যিই আপনার তুলনা নেই! দারুণ খেল দেখালেন মশাই! আপানার মাথায় এসব আসে কোথা থেকে?
আগে বলুন কি নেবেন? কফি না হুইস্কি?
হুইস্কি হলে ভালই হবে।
ঠিক আছে। পোয়ারো জর্জকে হুইস্কি আনার নির্দেশ দিলেন। জর্জ মনিবের হুকুম তামিল করল। দুজনে গ্লাস তুলে নিলেন।
পোয়ারো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে জ্যাপকে দেখছেন। তিনি প্রশ্ন করলেন–কি ব্যাপার, এত প্রশংসার কারণ কি?
জ্যাপ বললেন–এরকুল পোয়ারো যেটা বলেন সেটা ঠিক হয়।
–কি রকম, বন্ধু।
–একটা অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটল। আমরা অর্থাৎ পুলিশের ভাষায় সেটা আত্মহত্যা আর পোয়ারোর মতে সেটা খুন হল। অতএব তিনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সেটা সত্যিই খুন বলে প্রমাণিত হল।
–তাহলে আপনি আমার সঙ্গে এক মত?
–আমি কি খুব বোকা? সাক্ষ্য প্রমাণ এড়িয়ে চলব কি করে। সমস্যা হল এর আগে কোনো প্রমাণ আমার হাতে ছিল না। সম্প্রতি আমি পেয়েছি। তাই আপনার কাছে চলে এলাম। আপনাকে সব জানাব বলে। সেই সঙ্গে নিজের ভুলও শুধরে নেওয়ার ইচ্ছে আছে।
–আমার আর দেরি সইছে না, দয়া করে তাড়াতাড়ি বলুন বন্ধু।
–একটু ধৈর্য ধরুন, বলছি। যে পিস্তল দিয়ে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার অ্যালিস্টেয়ারকে গুলি করার চেষ্টা করেছিল সেইরকম একটা পিস্তল দিয়ে মি. মর্লেকে গুলি করা হয়েছিল। অর্থাৎ মর্লের মৃতদেহের পাশে যে পিস্তলটি পাওয়া গেছে সেটি এরই জোড়া।
পোয়ারো বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–এ কি করে সম্ভব?
-হ্যাঁ, ফ্র্যাঙ্কের পক্ষে এটা সম্ভব।
–এটাই কি আপনার প্রকৃত সূত্র।
-না, তা, নয়, দুটো বন্দুকই বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। এছাড়া এগুলো সচরাচর ব্যবহার করা হয়নি।
এরকুল পোয়ারো বিস্ময়ে বিহ্বল। তিনি সুযুগল বাঁকিয়ে বললেন–ফ্রাঙ্ক কার্টার? না, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
জ্যাপ বিরক্ত হয়ে বললেন–বন্ধু, আপনার হাবভাব আমার ঠিক ভালো লাগছে না। এতদিন আপনি বলে এসেছেন হেনরি মর্লে আত্মহত্যা করেনি, তাকে খুন করা হয়েছে। এখন সেই আমি বললাম আপনার মতকেই আমরা সানন্দে গ্রহণ করেছি, এখন আপনি সেটা মানতে রাজি নন।
–আপনার স্থির বিশ্বাস মলের খুনি ফ্র্যাঙ্ক কার্টার?
–সাক্ষ্য প্রমাণ তো সেটাই বলছে। আপনি জানেন মর্লে কার্টারকে পছন্দ করত না। তাই তার ওপর কার্টারের রাগ থাকা স্বাভাবিক। তার বক্তব্য থেকে জানা যায়, সে সেদিন কুইন শার্ল স্ট্রিটে গিয়েছিল। তার বান্ধবী গ্ল্যাডিসকে নতুন চাকরির কথা জানাতে। তবে আমাদের কাছে খরব আছে সে তখনও চাকরিটা পায়নি। পরে অবশ্য সে কাজটা পেয়েছিল। এছাড়া বারোটার পরে সে কোথায় ছিল তাও সঠিক বলতে পারেনি, সে বলেছে ওই সময় সে মেরিলিকোশ রোড ধরে হাঁটছিল। তবে একটার সময় সে একটা বারে বসে মদ খাচ্ছিল। একথা সে সত্যি বলেছে। আমাদের কাছে তার প্রমাণ আছে। সেখানকার বারম্যানকে চাপ দিয়ে জানতে পেরেছি। তাকে সে সময় খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
এরকুল পোয়োরো হতাশ হয়ে বললেন, আমার মন কিন্তু একথা বলছে না, বন্ধু।
ঠিক বুঝলাম না। একটু স্পষ্ট করে বলুন।
আপনার কথা আমায় চিন্তায় ফেলল। আমি যা অনুমান করেছিলাম তার সঙ্গে একটুও. মিল খুঁজে পাচ্ছি না। আর যদি আপনার কথাই ঠিক হয় তাহলে….
এমন সময় জর্জ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, সে বলল–দুঃখিত, স্যার।
কথাটা সে শেষ করতে পারল না। তার আগেই ঝড়ের গতিতে এসে প্রবেশ করল গ্ল্যাডিস নেভিল। তার চোখে জল। সে বলল–ওহ, মঁসিয়ে পোয়ারা।
–এখানে আমি অবাঞ্ছনীয়, বলেই জ্যাপ বিদায় নিলেন।
পলায়নরত জ্যাপের দিকে মিস নেভিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
সে চিৎকার করে বলল–এই লোকটা–স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের এই অফিসার বেচারা ফ্র্যাঙ্ককে ফাঁসিয়েছেন। ওর বিরুদ্ধে নানা মিথ্যে অভিযোগ এনেছেন।
–ঠিক আছে, আপনি বসুন মিস নেভিল। আপনার সব কথা শুনব আপনি। অত উত্তেজিত হবেন না। পোয়ারো তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
প্রথমে উনি বললেন–ফ্র্যাঙ্ক মি. ব্লাস্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে, আর এখন মি. মর্লের খুনের জন্যে ওকে দোষী সাব্যস্ত করছেন।
একটু হেসে পোয়ারো বললেন যেদিন মি. ব্লাস্টকে গুলি করা হয় সেদিন আমি তাঁর সাথে ছিলাম। আর তখনই বন্দুক সহ ফ্র্যাঙ্ককে ধরা হয়। প্রত্যক্ষদশী হিসেবে এটা অস্বীকার করতে পারি না আমি।
এ কথায় গ্ল্যাডিস নিজের রাগ সংবরণ করে বলল আমি বিশ্বাস করি না ফ্র্যাঙ্ক একাজ করতে পারে। যদিও করে থাকে তাহলে বলতে হবে তার বুদ্ধির অভাব ঘটেছে। ও দেশকে খুব ভালোবাসে, ওর খারাপ মতলব ছিল না, বিশ্বাস করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
–তাহলে ধরে নেব, মি. কার্টারের আত্মপক্ষ সমর্থনের এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা?
–ওহ না। যদিও পুলিশ ওর সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেয়নি। আমি কথা বলার সুযোগ পাইনি। তবুও ওর উকিলের কাছে জেনেছি, ফ্র্যাঙ্ক একাজ করেনি, বন্দুকটাও কখনো দেখেনি। ফ্র্যাঙ্ককে ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র এটা।
মি. কার্টারের উকিল ওই একটি যুক্তিতে সন্তুষ্ট নন। তিনি বলছেন, তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হলে আরও কয়েকটি মোক্ষম যুক্তি দেখাতে হবে।
উকিলরা সবাই একরকম হয়। তারা যুক্তি ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না। আমি নিশ্চিত মি. হেনরি মর্লেকে ও খুন করতে পারে না। এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণও নেই। আমি চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপের অভিযোগ মানতে পারছি না।
–যেদিন মি. মর্লে খুন হন সেদিনও কি মি. কার্টার বেকার ছিলেন? অর্থাৎ তখনও তিনি চাকরি পাননি?
–হ্যাঁ, ও তখনও বেকার ছিল। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, এতে কি যায় আসে?
–সে জবানবন্দি দিয়েছে, সে সেদিন গিয়েছিল নতুন চাকরি পাওয়ার সংবাদ জানাতে। কিন্তু সেটা সত্যি ছিল না। তবে সত্যিটা কি? কেন গিয়েছিল?
–ওহ মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না। আমাকে নিয়ে মি. মর্লে ও ফ্র্যাঙ্কের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। ও জানত মি. মর্লে ওকে পছন্দ করেন না। ওকে যাতে আমি বিয়ে না করি সেই চেষ্টা করতেন তিনি। এতে ও খুব দুঃখ পেয়েছিল। তাই মি. মর্লেকে বোঝাবার জন্যে সেদিন সে কুইন শার্লট স্ট্রিটে গিয়েছিল। বেচারা, কি ভুলই না সেদিন করেছিল সে
–আমার মনে হয় সে বোঝাতে যায়নি, সে গিয়েছিল মি. মর্লেকে খুনের হুমকি দিতে।
না, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি না আমি। গ্ল্যাডিস কাঁদতে কাঁদতে বলল।
এরকুল পোয়ারো তার সজল চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন মি. কার্টারের কোনো বন্দুক ছিল কিনা আপনি জানেন?
–ওহ, না, আমার জানা নেই। ওর মুখে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।
পোয়ারো দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
গ্ল্যাডিস বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল–মঁসিয়ে পোয়ারো, দয়া করে আমাদের বাঁচান, আমাদের সাহায্য না করলে….।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন–অবশ্যই, আমাকে সত্য উদঘাটন করতেই হবে।
পোয়ারোর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে গ্ল্যাডিস বিদায় নিল।
গ্ল্যাডিস চলে যেতে এরকুল পোয়ারো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করলেন। ফোন ধরলেন সার্জেন্ট বেডোর্জ।
পোয়ারো জানতে চাইলেন–চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ আছেন?
ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল না, তিনি এখনও ফেরেননি।
পোয়ারো বললেন আমার কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল, আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?
মি. বেডোর্জ বললেন–হ্যাঁ, বলুন।
ক্রমহ্যামে যে বন্দুক থেকে মি. ব্লাস্টকে গুলি করা হয়েছিল সেটা কি মি. কার্টারের নিজের?
না, স্যার, সেটা এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ।
কার্টারকে জেরা করে আর কিছু জানতে পেরেছেন?
-হ্যাঁ, সে তার চাকরি সংক্রান্ত কিছু খবর জানিয়েছে। সে বলেছে, সিক্রেট সার্ভিস থেকেই তাকে ক্রমহ্যামে পাঠানো হয়েছে। মালি হিসেবে। এর জন্য তাকে অগ্রিম প্রচুর টাকা দেওয়া হয়েছে। মালির কাজের প্রশংসাপত্রও সে পায়। মি. ব্লাস্টের প্রধান মালি ম্যাকের কাছে প্রথমে ফ্র্যাঙ্ক যায়। ম্যাক মি. ব্লাস্টকে আবেদন জানাতে বলে। এছাড়া বলা হয় সে যেন নিজেকে একজন কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দেয়। এজন্য তাকে একজন মহিলার অধীনে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। যিনি কিউ. এইচ. ৫০ নামে খ্যাত। তার কাছে তালিম নিতে হয়েছিল। শিক্ষানবাস সময়ে মহিলাকে সে ভালোভাবে দেখতে পেত না। কেবল তার কণ্ঠস্বরকে অনুসরণ করতে হত। যেখানে তালিম দেওয়া হত সেখানে আলোর ব্যবস্থা ক্ষীণ ছিল। তাই সে দ্বিতীয়বার দেখলে চিনতে পারবে না ওই মহিলাকে।
পোয়ারোর মুখ থেকে অস্ফুষ্ট একটা শব্দ বের হল। তিনি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। সেই একই নকশা। তবে এই প্রমাণটা কার্টারের পক্ষে যাবে। তিনি ভাবলেন, মি.বার্নেসের সঙ্গে পরামর্শ করলে কেমন হয়।
সন্ধ্যার ডাকে তার নামে একটি চিঠি এল। সস্তা দামের একখানা খাম। হাতে লেখা চিঠি। অশিক্ষিত হস্তাক্ষর। হার্টফোর্ড সায়রের ডাকঘরের স্ট্যাম্প দেওয়া। তিনি চিঠিটা খুলে ফেললেন। তাতে লেখা আছে।
শ্রদ্ধেয় মহাশয়,
আপনাকে চিঠি লিখে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আগেই আপনাকে সব কথা জানানো উচিত ছিল আমার। আমি ভেবেছিলাম মি. মর্লে আত্মহত্যা করেছেন। তাই কোনো গোলমাল হবে না। এছাড়া আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই। সেই কারণে পুলিশ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। আমি মিস নেভিলের তরুণ বন্ধুকে চিনি। তাই তাকে ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। এমনকি আমি ভাবিনি তার দ্বারা একাজ সম্ভব হবে। এখন দেখছি ফ্র্যাঙ্ক সব পারে। খবরের কাগজ পড়ে জানলাম ক্রমহ্যামে কোনো একটি বাড়িতে মালির কাজ করত সে। সেই বাড়ির মালিককে সে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছিল। খবরটা পড়ে শিউরে উঠেছিলাম। মারাত্মক একটা খুনে। আপনি আমার মালকিনের বন্ধু। তাই আপনাকে বলাই শ্রেয় মনে করলাম। আপনাকে সব জানাব যা এতদিন গোপন রেখেছিলাম।
—আপনার বিশ্বস্ত
অ্যাগনেস ফ্লেচার।
এরকুল পোয়ারো চিঠিটা পড়ে বিচলিত হলেন। ভাবলেন, একজন এত কান্ডের মূল পাণ্ডা সেটা ঠিক বুঝতে পেরেছি। কিন্তু যাকে ধরে ছিলাম সে নয়। এখানেই মস্ত বড় ভুল করেছি।
০৮. পনেরো, ষোলো, হেঁসেলেতে চলো
পোয়ারো এলেন হার্ট ফোর্ডনায়ারে। সেখানের একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে গিয়ে বসলেন। আগেই সেখানে হাজির ছিলেন অ্যাগনেস ফ্লেচার। কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে তাদের বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল।
অ্যাগনেস তার মা ও বাবার গল্প বললেন পোয়ারোকে। তিনি মন দিয়ে মিস ফ্রেচারের কথা শুনছিলেন।
অ্যাগনেসের বাড়ি ছিল গ্লস্টারসায়ারের লিটল ডারলিংহামে। তারা দু’ভাইবোন। তার বাবা-মা সর্বদা পুলিশি ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। তাদেরও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিতেন। তাই এখন তার চিন্তা তিনি যদি পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। তাহলে তার বাবা-মা নিশ্চয়ই মারা যাবেন। আর তাদের মৃত্যুর দায় তাকেই নিতে হবে।
এরকুল পোয়ারো ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি মিস মর্লেকে কি কিছু জানিয়েছেন?
অ্যাগনেস বলল–না, স্যার, আমি তাকে কিছু জানাইনি। কারণ তিনি শুনলে আমার ওপর রাগ করতেন। কাগজে দেখলাম, কর্তামশাই ভুল করে কাউকে ওষুধ দিয়েছিলেন। পরে ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং অনুতপ্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন।
পরে অন্য ভাবনা এল কখন থেকে?
মিস নেভিলের প্রেমিক ফ্রাঙ্ক কার্টারের সংবাদ যেদিন কাগজে বেরিয়েছিল। আমিও সেই খবরটা পড়েছি। দেখলাম সে একজন ভদ্রলোককে গুলি করে মারার চেষ্টা করেছিল। তখনই ভাবলাম নিশ্চয়ই ওর মাথার গণ্ডগোল আছে। তার ধারণা ছিল চারপাশের সব মানুষই তার শত্রু। তাদের কাউকেই সে বিশ্বাস করত না। এরকম মানসিক রোগে অনেকেই ভোগেন শুনেছি। মি. কার্টারও তাদের মতোই একজন। আমি জানি মি. মর্লের ওপর মি. কার্টারের আক্রোশ আছে। কারণ মি. মর্লে মিস নেভিলকে ফ্র্যাঙ্ককে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মিস নেভিল সে কথা কানে নেননি। তা সত্ত্বেও আমরা ভাবতে পারিনি তিনি আমার মনিবের হত্যাকারী হবেন। তাই ব্যাপারটা কি রকম। অদ্ভুত লাগছে আমার।
পোয়ারো প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য বললেন–কি অদ্ভুত?
–যেদিন আমার মনিব আত্মহত্যা করেন সেদিনের ঘটনা। সকাল বেলার চিঠিগুলো চিঠির বাক্স থেকে বের করে অ্যালফ্রেড। তারপর সেগুলো মি. মর্লের টেবিলের ওপর রাখে। স্যার সময় সুযোগ মতো সেগুলো দেখে নেন। সেদিন অ্যালফ্রেড ব্যস্ত থাকায় চিঠিগুলো বের করতে পারেনি সেইজন্য আমি ভাবছিলাম বের করে আনার কথা। সেই কারণে সিঁড়ির নীচের ধাপে দাঁড়িয়ে। অ্যালফ্রেড কি করছে তা দেখার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় একজনকে দেখে আমি চমকে উঠি। ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কর্তার ঘরের ওপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। ও নীচের দিকে কি যেন খুঁজছিল। তার চোখে মুখে উত্তেজনা ফুঠে উঠেছিল। দৃশ্যটা যতই ভাবি ততই কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছিল।
পোয়ারো জানতে চাইলেন তখন কটা বেজেছিল?
–তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে, স্যার। অ্যাগনেস একটু থামল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, এদিকে সেদিন মিস নেভিল অনুপস্থিত। তাই ভাবলাম একবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম ফ্রাঙ্ক অস্থির পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কর্তার সার্জারির ঘর আছে। আমি ভাবলাম ও মনস্থির করে ফেলেছে কর্তার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার। তাই আমার ভয় হল। কারণ কর্তা ওকে মোটেই পছন্দ করতেন না। বিশেষ করে রোগী দেখার সময়। নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হবে। এমন সময় মিস মর্লে আমাকে ডাকলেন আর আমিও ওপরে চলে যাই। পরে শুনলাম কর্তা নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। খবরটা শুনে প্রথম মুহ্যমান হয়ে পড়ি যে ফ্র্যাঙ্কের কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম।
এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে একটু থামল অ্যাগনেস। দম নিল। মুহূর্ত কয়েক কেটে গেল। আবার বলে উঠল সে, এরপর পুলিশ এলো। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। তারপর কর্তার মৃতদেহ নিয়ে সবাই চলে গেলে আমি এমাকে ফ্রাঙ্কের কথা বলি। কার্টার যে কর্তার ঘরে গিয়েছিল তা পুলিশের কাছে গোপন করেছি। এতে এমা অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু আমরা কেউই চাইনি মিস নেভিলের বন্ধুকে বিপদে ফেলতে। তাই এতদিন মুখ বন্ধ করেছিলাম। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর পুলিশের সিদ্ধান্ত জানতে পারলাম। তাদের মতে কর্তা আত্মহত্যা করেছেন। কেউ তাঁকে খুন করেনি। এতে স্বস্তি পেয়েছিলাম একথা ভেবে ফ্র্যাঙ্ক নির্দোষ। আবার যখন খবরের কাগজে দেখলাম সে একজনকে গুলি করেছে তখন অন্য ভাবনা মাথায় এল। ভাবলাম ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর ওই কর্তাকে খুন করেছে।
পোয়ারো লক্ষ্য করলেন কথা বলার সময় অ্যাগনেসের চোখ ভয়ে বড় হয়ে উঠেছে। সে কাতরভাবে মিনতি করল–আমি যাতে বিপদে না পড়ি দেখবেন, স্যার।
পোয়ারো তাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন–ভয় নেই তোমার অ্যাগনেস। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। নিশ্চিন্ত থাকো। তবে আমাকে বলে তুমি ঠিক কাজই করেছো।
ধন্যবাদ, স্যার। আমার মনটা অনেকখানি হালকা হল। তখন থেকে চিন্তা হচ্ছে মা এটা কিভাবে নেবেন। পুলিশের সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে পড়াটা বোধহয় ভালো হল না।
না, না, কিছু চিন্তা করো না অ্যাগনেস। তুমি আমাদের সহযোগিতা করায় আমাদের খুব সুবিধা হল। সব মায়েরা চান তাদের ছেলে মেয়েরা সর্বদা সুখে থাকুন।
এরকুল পোয়ারো অ্যাগনেসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।
চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ সেই সময় তাঁর অফিস ঘরে বসেছিলেন। তাঁকে পোয়ারো বললেন–আমি একবার কার্টারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করুন।
জ্যাপ কটাক্ষ করে বললেন–ব্যাপার কি, বন্ধু? কোনো খবর আছে কি?
পোয়ারো দ্রুত বললেন–আপনার অনুমতি পাওয়া যাবে কি?
জ্যাপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–ওহ, বন্ধু, এত চটে যাচ্ছেন কেন? আমি কি আপত্তি করেছি। করে কি লাভ হবে? হোম সেক্রেটারির প্রিয়পাত্র স্বয়ং এসেছেন। সমস্ত ক্যাবিনেট যাঁর অঙ্গুলি হেলনে ওঠাবসা করে। তাকে আমি দেব বাধা। এত সাহস আমার নেই।
এরকুল পোয়ারোর চোখের সামনে ভেসে উঠল বহুদিনের পুরোনো একটি ঘটনা, অভিযান স্টেবল সাঙ্গ করার ঘটনা। তিনি বললেন–কত মাথা খাঁটিয়ে বুদ্ধি বের করতে হয়েছে বলুন। এটা অস্বীকার করতে পারবেন না, বন্ধু।
আপনিই একমাত্র সেই মানুষ যিনি এতবড় ঝুঁকি নিতে পারেন। সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন সেদিন। আমার মনে হয় আপনার জীবনের প্রতি মায়া নেই। জ্যাপ পোয়ারোর দিকে তাকালেন। তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে রয়েছে। তিনি আবার বললেন–আপনি কার্টারের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন কেন? শুনতে পারি কি কারণটা?
জ্যাপকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো বললেন–ওকে জিজ্ঞাসা করব সে কি মি. মর্লেকে খুন করেছে?
জ্যাপ হাসতে হাসতে বললেন–আর কার্টারও আপনার কথায় সায় দেবে?
পোয়ারো গম্ভীর স্বরে বললেন–হয়তো বলবে, আবার নাও বলতে পারে।
পোয়ারোর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে জ্যাপ বললেন–আপনাকে আমি বহু বছর ধরে চিনি। তবু আজও আপনাকে ভালোভাবে বুঝতে পারলাম না। আপনি কখন কি উদ্দেশ্যে কাজ করেন তা জানি না। তবে এটা জানি আপনার মনে কোনো রকম সন্দেহ উদয় হলে একাজ করে থাকেন। তবে কি ধরে নেব ফ্র্যাঙ্ক কার্টার সম্পর্কে এমন কোন অভিযোগ পেয়েছেন যা আপনাকে অস্থির করে তুলেছে। আপনি যাচাই করে নিঃসন্দেহ হতে চান সে নির্দোষ কিনা?
পোয়ারো সজোরে মাথা নেড়ে বললেন–না, না, আপনি ভুল করছেন, বন্ধু এর উল্টোও হতে পারে।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আপনি বড় বেশি আবেগপ্রবণ। ফ্র্যাঙ্কের প্রেমিকার জন্যই বুঝি তাকে বাঁচাতে চাইছেন? কথাটা বলে জ্যাপ হেসে উঠলেন।
পোয়ারো উত্তেজিত হয়ে বললেন–আমি আবেগতাড়িত নই। এটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। এটা ইংরেজদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করি। ফ্র্যাঙ্ক কার্টার যদি খুনি প্রমাণিত হয় তাহলে আমি নিশ্চয়ই চাইব না মিস নেভিল তাকে বিয়ে করুক। আবেগের বশবর্তী হয়ে যদি বিয়ে করে তাহলে দু-এক বছরের মধ্যে তাকে বিধবা হতে হবে। কারণ সে ক্ষেত্রে ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের ফাঁসি অবধারিত।
–তাহলে কেন আপনি মানতে পারছেন না যে সে অপরাধী?
–আমি বিশ্বাস করি সে নিরপরাধী।
–আপনি এত জোর দিয়ে বলছেন কি করে? তাহলে কিছু কি আপনি জানতে পেরেছেন? যদি জানেন তাহলে গোপন করছেন কেন আমাকে? আমার পরিষ্কারভাবে জানা উচিত। বলুন, পোয়ারো।
পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–সময় হলে সব জানাব আপনাকে। কিছুদিনের মধ্যেই একজন প্রত্যক্ষদশীকে আপনার কাছে এনে হাজির করব। সে আপনাদের তদন্তের কাজে সহযোগিতা করবে। তার সাক্ষে কার্টারের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ সহজ হয়ে যাবে। আর তদন্তের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাবে।
জ্যাপ বিরক্ত হয়ে বললেন–তাহলে তার সঙ্গে দেখা করার দরকার কি আপনার? আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
পোয়ারো বললেন নিজেকে খুশি করার জন্য।
জ্যাপ আর কথা না বাড়িয়ে পোয়ারোকে নিয়ে গেলেন গারদের কাছে। যেখানে ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকে রাখা হয়েছিল।
বিপর্যস্ত, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল ফ্র্যাঙ্ককে। রুক্ষ মেজাজ। তার সাক্ষাপ্রার্থী এরকুল পোয়ারোকে দেখে সে বেশ অসন্তুষ্ট হল। সে মুখ বিকৃত করে বলল–লালমুখো গোয়েন্দা, এখানেও এসেছেন? কি চাই আপনার? আমাকে গ্রেপ্তার করেও খুশি হননি আপনি?
পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–আপনাকে কিছু বলার আছে।
–বেশ, আমার উত্তর কিন্তু আপনি পাবেন না। অন্তত আমার উকিল না আসা পর্যন্ত। যা বলার আমি তার সামনেই বলতে চাই। আমার অধিকার আছে উকিল নেবার। এর বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেন না আপনি।
–অবশ্যই উকিল নেবার অধিকার আপনার আছে। তাকে আপনি ডাকতে পারেন। তবে আমি পরামর্শ দেব এখন তাকে ডাকার প্রয়োজন নেই। আপনার মঙ্গলের জন্যই বলছি।
ফ্র্যাঙ্ক দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল–কৌশলে আমার থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার মতলব করেছেন বুঝি। নিজেকে খুব চালাক মনে করেন তাই না।
–এটা আপনার ভুল ধরণা। এটা আমাদের গোপন সাক্ষাৎ। আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার বিদ্রূপ করে বলল–সেটাই আশ্চর্য লাগছে। নিশ্চয় আড়ালে অন্য পুলিশরা রয়েছে। তাছাড়া আমি আপনার ফাঁদে পা দিচ্ছি না। বুঝেছেন?
পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন–অ্যাগনেস ফ্রেচার নামে কোনো মহিলাকে আপনি চেনেন?
ফ্র্যাঙ্ক সংক্ষেপে উত্তর দিল না। কখনো নাম শুনিনি।
–সে ৫৮ কুইন শার্লট স্ট্রিটের পার্লার মেইড।
হতে পারে, তাতে আমার কি?
–যেদিন সকালে হেনরি মর্লেকে গুলি করা হয় সেদিন সে আপনাকে ওখানে দেখেছিল। সেদিন সে উপরের তলায় সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নীচের তলায় অ্যালফ্রেডকে সে তখন খুঁজছিল। আর সেই সময় আপনাকে দেখতে পায় মি. মর্লের ঘরের দিকে যেতে। সময়টা বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে হবে।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের শরীর কেঁপে উঠল; সে দরদর করে ঘামতে লাগল। সে অস্থির হয়ে উঠল। সে চিৎকার করে বলল–বাজে কথা! আপনারা ওকে টাকা খাইয়ে মিথ্যে সাক্ষী সাজিয়েছেন। আমাকে ফ্যাসাদে ফেলার জন্য। ও মিথ্যে বলছে। আমি তখন ওখানে ছিলাম না। ও আমাকে দেখতে পারে না।
–আপনি পুলিশকে জানিয়েছেন সেই সময় আপনি মেরিলিবোস রোড দিয়ে হাঁটছিলেন। তাই তো?
–হুঁ, ঠিক তাই। সে আমাকে দেখে থাকলে আগে পুলিশকে জানায়নি কেন?
–সে একটু দোটানায় পড়েছিল। বুঝতে পারছিল না। তার কি করা উচিত। সে তার বন্ধু এমাকে বলেছিল। এমা মি. মর্লের বাড়ির রাঁধুনি। যখন আদালতের সিদ্ধান্ত জানতে পারল তারা তখন নিশ্চিন্ত বোধ করল। ভাবল মি. মর্লে আত্মহত্যা করেছেন। তাই তোমার কথা তারা পুলিশকে জানানো দরকার মনে করল না।
আমি এসব কথা বিশ্বাস করি না। আপনারা ষড়যন্ত্র করে ওদের দিয়ে এইসব কথা বলাচ্ছেন। ফ্র্যাঙ্ক ক্ষিপ্ত হয়ে গাল দিয়ে চলল।
পোয়ারো ও জ্যাপ চুপ করে শুনছেন। ধীরে ধীরে কার্টারের রাগ স্তিমিত হল। সে শান্ত হতে পোয়রো বলতে শুরু করলেন রাগ করলে আর বোকার মতো গালমন্দ করলে আপনার ক্ষতিই হবে। লাভ কিছুই হবে না। ওই দুজন মহিলা এখনও পুলিশকে কিছুই জানায়নি। তবে কোনো একদিন জানাবে নিশ্চয়। অ্যাগনেস ফ্রেচার আপনাকে দেখে চিনতে পেরেছিল। ওই সময় আপনি ছাড়া অন্য কেউ সেখানে ছিল না। আর আপনি সত্যিই মি. মর্লের ঘরে গিয়েছিলেন। তারা সত্যি কথাই বলছে। আর পুলিশও তা বিশ্বাস করবে। কার্টারের ভাব বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। তিনি অপেক্ষায় রইলেন। আবার তিনি বলতে শুরু করলেন, এবার আপনি বলুন এরপর কি হয়েছিল?
ক্রুদ্ধ স্বরে বলল–সব মিথ্যে সব মিথ্যে!
তার বলার ধরন দেখে এরকুল পোয়ারোর ভীষণ খারাপ লাগল। তিনি ভাবলেন, ফ্র্যাঙ্ক কার্টার একজন মিথ্যেবাদী, অসৎ প্রকৃতির মানুষ। তাকে রক্ষা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ না থাকলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না। এ যেভাবে মিথ্যে বলছে তাতে মৃত্যুদণ্ডই তার উপযুক্ত শাস্তি হবে।
তবুও পোয়ারো একবার শেষ চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন–আমি চাই সত্যিটা প্রকাশ পাক।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার বোকা নয়। সে বুঝতে পারল এই মিথ্যে বলাই তার আত্মসমর্থনের শ্রেষ্ঠ অস্ত্র। সে যদি একবার বলে ওই সময় মর্লের ঘরে গিয়েছিল তাহলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। আর তার অন্যান্য কথাও মিথ্যে বলে ধরা হবে।
সুতরাং সে ঠিক করল সে মিথ্যেই বলবে। ক্রমাগত মিথ্যে বলে চললে পোয়ারোর আর কিছু করার থাকবে না।
এরকুল পোয়ারো ভীষণ ক্লান্ত বোধ করলেন। তিনি চলে যেতে উদ্যত হলেন।
সেই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার বলল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।
কিছু সময় কেটে গেল। পোয়ারো চলে গেলেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি অপেক্ষা করলেন।
পোয়ারো এবার ফ্র্যাঙ্কের খুব কাছে ঝুঁকে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে ব্যক্তিত্বের তীব্র প্রকাশ। তিনি বললেন আমি মিথ্যে বলছি না। আমাকে বিশ্বাস করলে ঠকবেন না। আমার আশা আমি আপনাকে বাঁচাতে পারব। নির্দোষ প্রমাণ করব। যদি আপনি সত্যি কথা বলেন। আপনি যদি মর্লেকে হত্যা না করে থাকেন তাহলে সত্যি বলতে আপনার অসুবিধা কোথায়? সেদিন সকালে ঠিক কি ঘটেছিল খুলে বলুন আমাকে।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার চঞ্চল হয়ে উঠল। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। তার চোখের তারা স্থির হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা দুটি চোখে বাস্তবিকই আতঙ্ক ফুটে উঠল। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল সে।
সে রূঢ় স্বরে বলল–ঠিক আছে, আমি সব বলব। আপনাকেই আমি গোপন জবানবন্দী দেব। আর যদি আপনি আমাকে প্রতারণা করেন তাহলে ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করবেন না। আমি স্বীকার করছি আমি সেদিন মি. মর্লের চেম্বারে গিয়েছিলাম। আমার আশা ছিল তখন উনি ঘরে একা থাকবেন। ওই মহিলা সত্যিই আমাকে দেখতে পেয়েছে, ও মিথ্যে বলেনি। আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তখনই মর্লের ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এল। সে নীচে চলে যেতেই আমি ঘরে প্রবেশ করলাম। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। আমি ইতিমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছি যা করার এই সুযোগে করতে হবে। উত্তেজনার বশে কি করব ঠিক করতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম তার সাথে দেখা করে দু-চার কথা শুনিয়ে দেব। আমার বিরুদ্ধে আমার বান্ধবীকে বলে তার মন ভেঙে দেওয়ার উচিত শিক্ষা দেব। কিন্তু ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখলাম
একটু থামল ফ্র্যাঙ্ক। সে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগল।
তারপর অনুনয়ের সুরে বলল-আপনি বিশ্বাস করুন, আমি একটিও কথা মিথ্যে বলছি না। দেখলাম মি. মর্লে মাটিতে পড়ে আছেন। প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম তার নিশ্বাস পড়ছে না। তিনি মারা গেছেন। সারা শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কপালে গুলির গর্ত। আর সেখান থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। দৃশ্যটা মনে পড়ায় ফ্র্যাঙ্ক শিউরে উঠল।
পরক্ষণে বুঝতে পারলাম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চলেছি। সবাই বলবে আমিই তাকে গুলি করেছি। আমি তার হাত ও দরজার হাতল ধরেছিলাম। সেগুলোতে আমার হাতের ছাপ পড়েছিল। তাই রুমাল দিয়ে ভাল করে মুছে ছিলাম। এবং দ্রুতবেগে নীচে নেমে এলাম। একেবারে সোজা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসি আমি। তখন আমার কোনো হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।
আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি এতে এক বর্ণ মিথ্যে নেই। তিনি আমার যাওয়ার আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমাকে বিশ্বাস করুন। ভয়ার্ত চোখে সে পোয়ারার দিকে তাকাল।
এরকুল পোয়ারো করুণ কণ্ঠে বললেন আমি বিশ্বাস করছি।
পোয়ারো যাবার জন্য পা বাড়ালেন। ফ্র্যাঙ্ক কার্টার চিৎকার করে বলল পুলিশ জানতে পারলে আমাকে ফাঁসি দেবে। আপনি আমায় বাঁচান।
পোয়ারো তাকে আশ্বস্ত করে বললেন–সত্য প্রকাশ করে আপনি নিজেকে ফাঁসির দড়ি থেকে রক্ষা করেছেন।
কিন্তু, ওরা বলবে।
পোয়ারো বাধা দিয়ে বললেন–আপনার বক্তব্য আমার অনুমানের সাথে মিলে যাচ্ছে। এখন আমি কি করি তাই দেখুন।
এরকুল পোয়ারো সেখান থেকে চলে এলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
ইলিং-এ মি. বার্নেসের বাড়ি। এরকুল পোয়ারো যখন তাঁর বাড়ি পৌঁছলেন তখন সাতটা বাজে। মি. বার্নেস বাড়িতেই ছিলেন। তিনি পোয়ারোকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।
বসার ঘর। তাঁরা দুজনে পাশাপাশি দুটি সোফায় বসে কথাবার্তা শুরু করলেন।
মি. বার্নেস বললেন–ভীষণ গরম পড়েছে। একটু বৃষ্টির প্রয়োজন। তা নাহলে আমার বাগানের সমস্ত ফুল গাছ নষ্ট হয়ে যাবে।
হঠাৎ পোয়ারোর গম্ভীর মুখের দিকে তার নজর পড়ল। তিনি বললেন–আপনাকে খুব ডিসটার্ব দেখাচ্ছে। কোনো তদন্ত নিয়ে চিন্তায় আছেন?
পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। মাঝে মধ্যে এমন কেস আমার হাতে আসে যা ইচ্ছে না থাকলেও করতে হয়, মি. বার্নেস।
মি. বার্নেস সহানুভূতির সুরে বললেন আমি তা বুঝি, মঁসিয়ে পোয়ারো।
বাড়িতে ঢোকার মুখে পোয়ারো বাগানটি লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি বার্নেসের রুচিবোধের প্রশংসা করে বললেন, বাগানটি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন তো। বাহারি ফুলের গাছ লাগিয়েছেন। প্রত্যেকটি যেমন চমৎকার তেমনি সুগন্ধী। ছোট হলেও বাগানটি সত্যিই মনোরম।
বার্নেস প্রশংসায় কর্ণপাত করলেন না। তিনি শান্ত ও স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বললেন, আশা করি, আপনি অপরাধীর খোঁজ পেয়েছেন?
-কে? ফ্র্যাঙ্ক কার্টার?
–অবশ্যই সে।
–আপনি হয়তো ভাবেননি এটা কোনো ব্যক্তিগত খুন?
–না, আমি তা ভাবিনি। অ্যামবেরিওটিস এবং অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের ব্যাপারে আমি ভেবেছিলাম এটা কোনো গুপ্তচরদের কাজ।
–প্রথমে আপনার এই সন্দেহের কথাটা জানিয়েছিলেন আমাকে, মি. বার্নেস।
–হ্যাঁ, মনে পড়ছে। কারণ আমি তখন এই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম।
–কিন্তু আপনার সন্দেহ ভুল ছিল।
–হ্যাঁ, সে কথা বলে আর লজ্জা দেবেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো। ঝামেলায় পড়লে সকলে পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে। আর তার থেকেই নানা রকম মন্তব্য করে থাকে।
–পোয়ারো মিষ্টি হেসে বললেন আপনি কখনো কোনো ম্যাজিসিয়ানের তাসের জাদু খেলা দেখেছেন? অনেকগুলো তাসের মধ্যে থেকে একটি বেছে নিতে বলে।
–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
–এখানেও ঠিক তাই করা হয়েছে। যখনই কেউ হেনরি মর্লের মৃত্যুর কোনো ব্যক্তিগত কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে তখনই মাথায় এসেছে কয়েকটি শব্দ। তা হল অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট, অ্যামবেরিওটিস, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি। আর সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত করেছেন আপনি, মি.বার্নেস। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন এরকুল পোয়ারো।
মি. বার্নেস বিষণ্ণ সুরে বললেন–দুঃখিত, মঁসিয়ে পোয়ারো আমাকে ক্ষমা করবেন।
–আপনি দেশের অনেক খবর রাখেন। আমি আশা করেছিলাম আপনিই আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারবেন। তাই আপনার কথায় গুরুত্ব দিয়েছিলাম আমি।
–তাহলে আপনি বলছেন মি. মর্লের মৃত্যুর পেছনে কারো ব্যক্তিগত আক্রোশ আছে।
–হ্যাঁ। খুনের মোটিভ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি ইতিমধ্যে অনেক সময় ব্যয় করেছি। যদিও এই ব্যাপারে ভাগ্য আমাকে সহায়তা করেছে।
বার্নেস ভ্রু কুঁচকে বললেন–ঠিক বুঝলাম না।
পোয়ারো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–কথাবার্তার কিছু অংশ আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। যদিও তখন এর তাৎপর্য বুঝতে পারিনি আমি।
বার্নেস বললেন–আপনি কেন হেঁয়ালি করে কথা বলছেন?
–আমাকে বিশ্বাস করে খোলাখুলি ভাবে কোনো কথা বলেননি আপনি। আমি আপনার কথার ভিত্তিতে এগোতে চেয়েছিলাম। তাই আপনার ভুল তথ্যের জন্য আমি দুঃখ পেয়েছিলাম।
বার্নেস অবাক হয়ে বললেন–আমি?
পোয়ারো কণ্ঠে তীব্রতা এনে বললেন–হ্যাঁ, আপনিই।
বার্নেস কাতর স্বরে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি বিশ্বাস করুন ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমি যেটুকু শুনেছি সে মর্লের মৃত্যুর আগেই তাঁর বাড়ি ছেড়ে ছিল। তার কথার সূত্র থেকে আপনি জানতে পেরেছেন আসল তথ্যটা। ফ্র্যাঙ্ক সেসময় সেই বাড়িতেই হাজির ছিল।
পোয়ারো বললেন–ফ্র্যাঙ্ক তখন ওই বাড়িতে ছিল বলেই খুনিকে দেখতে পেয়েছিল।
–তাহলে কার্টার নির্দোষ আর সে কি খুনিকে দেখতে পেয়েছিল, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো মাথা নেড়ে জানালেন সেটা এখনও জানা যায়নি।
০৯. সতেরো, আঠারো অপেক্ষা করো
এরকুল পোয়ারো পরদিন সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে গেলেন পরিচিত একজন এজেন্টের সঙ্গে। তিনি নাট্য জগতের এক স্বনামধন্য ব্যক্তি। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে দিলেন পোয়ারো। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলেন অক্সফোর্ডে।
পোয়ারো মনস্থির করলেন মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের সঙ্গে দেখা করবেন। তার কাছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার আছে। আগে থেকেই সমস্ত আয়োজন করে রাখলেন।
পরদিন ভোরবেলা তিনি বেরিয়ে পড়লেন গ্রামের উদ্দেশ্যে। সাড়ে নটায় গথিক হাউসে এসে উপস্থিত হলেন। সেই সময় মি. ব্লাস্ট লাইব্রেরিতে ছিলেন। ছোকরা একটি চাকর পোয়ারোকে তার কাছে নিয়ে গেলেন।
করমর্দন করে কুশল বিনিময় করলেন দুজনে।
ব্লাস্ট সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তাকে সনাক্ত করতে পেরেছেন কি মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন–হ্যাঁ, তাকে সনাক্ত করা গেছে।
ব্লাস্ট সপ্রশংস কণ্ঠে বললেন–আপনি খুবই ক্লান্ত। আগে বসুন। একটু বিশ্রাম নিন। তারপর সব শুনব।
পোয়ারো দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। তিনি একটি সোফায় বসে পড়লেন। তারপর বলতে শুরু করলেন–ধন্যবাদ, মি. ব্লাস্ট। সত্যিই আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত। তবে বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে কিছু কথা জানানোর জন্য এসেছি কিন্তু তা আপনার ভালো না লাগতেও পারে।
ব্লাস্ট উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন–কেন সে কি আর বেঁচে নেই?
পোয়ারো নিরাসক্ত স্বরে বললেন–সেটা নির্ভর করছে আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন তার ওপরে।
ব্লাস্ট ভুকুঁচকে বললেন–যে কোনো মানুষই হয় মৃত না হয়, জীবিত হতে পারে। মিস সেইনসবারি সীল এর মধ্যে যে কোনো একটি হবেন।
পোয়ারো কৌতূহলী হয়ে বললেন মিস সেইনসবারি সীল? ইনি কে?
ব্লাস্ট অবাক হয়ে বললেন–সে কি আপনি একে চেনেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো আমতা আমতা করে বললেন–না–তা ঠিক নয়। একজনকে অবশ্যই ওই নামে চিনি। তিনি কলকাতায় থাকতেন, মিশনারীদের হয়ে কাজ করতেন। সম্প্রতি তিনি এখানে এসেছেন। মহারানি নামের একটি জাহাজে চড়ে। সেই জাহাজে মি. অ্যামবেরিটিসও এসেছেন। তবে তারা একই শ্রেণির যাত্রী ছিলেন না। তাঁরা দুজনেই লণ্ডনে নামেন। পথে দুজনের আলাপ হয়। ভদ্রলোক উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি মিস সীলকে মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানান স্যাভয় হোটেলে, মহিলার কাছে সে এক অত্যাশ্চর্য অনুভূতি। ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল তিনিও যেন বিরাট কিছু পেতে চলেছেন। কারণ ওই অতি সাধারণ মধ্যবয়স্কা মহিলা যে তাঁর সামনে এক সোনার খনির দরজা উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে তা তিনি জানতেন না। অথচ মহিলা নিজে এ-বিষয়ে কিছুই অনুমান করতে পারেননি।
মি. ব্লাস্ট চিন্তাক্লিষ্ট স্বরে বললেন–তাহলে আপনি বলছেন ওই মহিলা মিসেস চ্যাপম্যানকে খুন করেননি?
পোয়ারো গম্ভীর সুরে বললেন কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। এটা এক কঠিন সমস্যা। ঠিক আছে যেখান থেকে রহস্যটা আমি প্রত্যক্ষ করেছি সেখান থেকে বলি। সে একটা জুতো কাহিনি।
ব্লাস্ট আশ্চর্য হয়ে বললেন–অভূতপূর্ব ঘটনা। শেষে কিনা একটা জুতো?
পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে বললেন–হ্যাঁ, অভূতপূর্বই বটে! একটা বকলস আঁটা জুতো, দন্তচিকিৎসক হেনরি মর্লের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমি রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি এসে থামল ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিটের দরজায়। গাড়ি থেকে প্রথমেই একটি জুতো পরা পা বেরিয়ে এসেছিল। আমি লক্ষ্য করলাম পায়ের মালিক কোনো এক মহিলা। তার জুতোটি আমার পছন্দ হল না। সস্তা দামের জুতো। তবে নতুন চামড়ার তৈরি। তাতে বড় একটা চকচকে বকলস লাগান।
মন দিয়ে বকলসটা আমি দেখছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ওই মহিলা গাড়ি থেকে নেমে এলেন। চেহারা কিংবা পোশাকে আকর্ষণ করার মতো কিছুই ছিল না। চল্লিশোর্ধ এক মহিলা। পরনের পোশাকটিও কম দামি।
ব্লাস্ট বললেন মিস সেইনসবারি সীলকে আপনি দেখেছেন?
নিশ্চয়ই। তিনি নামতে গিয়ে একটু বিপদে পড়েছিলেন। তার জুতোর বকলস গাড়ির দরজায় আটকে গিয়েছিল। ফলে সেটা ছিঁড়ে যায় এবং ছিটকে এসে পড়ে রাস্তায়। আমি সেটা তুলে তাঁকে দিই। এরপর তিনি মর্লের বাড়ির ভেতর চলে যান। আর আমিও আমার গন্তব্যে রওনা দিই। এখানেই ঘটনার সূত্রপাত এবং শেষ।
আবার সেদিনই ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমার সঙ্গী ছিলেন চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ। মর্লের মৃত্যু রহস্যের জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমরা গিয়েছিলাম। তখনও তিনি তার জুতোর বকলস সেলাই করতে পারেননি। ওই দিনই সন্ধ্যায় তিনি তাঁর হোটেল থেকে অন্তর্ধান হয়েছিলেন। এই গেল প্রথম পর্ব।
এবার দ্বিতীয় পর্বে আসছি। এরপর একদিন জ্যাপ আমাকে ডেকে পাঠান কিং লিওপোল্ড ম্যানসনে। সেখানের একটি ফ্ল্যাটে একটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। মৃতদেহটি ছিল একটি সিন্দুকের মধ্যে। আমার উপস্থিতিতে সিন্দুকটি ভোলা হয়েছিল। তার মধ্যে থাকা একটা বকলস লাগানো পুরোনো জুতো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মি. ব্লাস্ট বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন–এরপর কি হল?
আপনি বোধহয় আমার কথার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেননি? যে জুতোটা লাশের পাশে পাওয়া গেছে সেটি পুরোনো। অর্থাৎ ব্যবহার করা। আমরা স্থানীয় সূত্রে জানতে পারি, মিস সেইনসবারি সীলকে সেদিন সন্ধ্যায় কিং লিওপোন্ড ম্যানসনে দেখা গিয়েছিল। সকালে ছিল নতুন জুতো অথচ সন্ধ্যায় তা হয়ে গেল পুরোনো। কোনো মহিলা কখনোই এক দিনে দু’জোড়া জুতো ব্যবহার করে না। আশা করি আপনিও আমার সঙ্গে একমত হবেন, মি. ব্লাস্ট।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট জানতে চাইলেন তার কি দু’জোড়া জুতো থাকতে পারে না?
–অসম্ভব! কখনোই ছিল না। আমি এটার ওপর জোর দিচ্ছি এই কারণে জ্যাপ ও আমি তাঁর ঘরে গিয়েছিলাম, গ্লেনগাউরি কোর্টে। তার সব জিনিসপত্র আমরা নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম, সেখানে বকলস লাগানো দ্বিতীয় কোনো জুতোর সন্ধান পাওয়া যায়নি, এবার নিশ্চয়ই ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে বুঝবেন?
ব্লাস্ট মুচকি হেসে বললেন–আমি তেমন গুরুত্বের কিছু দেখতে পাচ্ছি না, মঁসিয়ে পোয়ারো।
এরকুল পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন–ঠিক আছে আপনার কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন কিছু নিশ্চয়ই ভালো লাগে না। আমি আমার জুতোটা হাতে নিয়ে দেখি। নিখুঁতভাবে দেখলাম। দেখলাম বকলসটা হাতে সেলাই করা হয়েছে। তখনই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল। তাহলে কি সকালে আমি ভুল দেখিছি। পুরোনো জুতো পরা ছিলেন। মিস সীল। রোদের আলোয় যেটা চকচক করছিল। আর নতুন বলে মনে হয়েছিল।
মি. ব্লাস্ট সকৌতুক বললেন–হয়তো এটাই আসল ব্যাখ্যা।
পোয়ারো তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন–না, না, এটা হতে পারে না। আমার চোখ আমাকে ধোঁকা দেবে না। আর একবার লাশটা পরীক্ষা করলাম। যা দেখলাম তা আমাকে খুশি করতে পারল না। বার বার ভাবলাম মুখটা ওইভাবে বিকৃত করার কারণ কি? যাতে চেনা না যায় সেই জন্য? নাকি প্রমাণ লোপাট করার জন্য?
মি. ব্লাস্ট অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন–নতুন করে এসব নিয়ে আলোচনার কি খুব দরকার আছে?
পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ঝরে পড়ছে। তিনি বললেন–আছে বইকি। একে একে যেভাবে সত্য উদঘাটন করছি সেটা আপনার জানা উচিত। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি, এখানে কি কিছু গলদ আছে। মৃতদেহে মিস সেইনসবারি সীলের পোশাক রয়েছে। রয়েছে একজোড়া জুতো ও ব্যাগ। এত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন মুখ বিকৃত করা হল? তবে কি পুলিশকে ধাঁধায় ফেলার জন্য করা হয়েছে। অথবা এটা মিস সীলের দেহ নয়? এমন সময় মাথায় বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিল একটা ভাবনা। তবে কি এটি মিসেস চ্যাপম্যানের দেহ? তাদের মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে। চুল ও আকৃতিতে দুজনেই সমবয়সি। তবে একটা মিল হল তাদের দুজনের পায়ের মাপ দু’ধরনের। মিস সীল দু’নম্বর জুতো পরতেন। আর অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান পরনে পাঁচ নম্বর জুতো। অর্থাৎ মিস সীলের পা মিসেস চ্যাপম্যানের চেয়ে বড়। আমি ভাবলাম মিস সীলের পায়ে যদি খুঁত থাকে তবে জুতো ঢিলে হবে অথচ তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এই ব্যাপারটা আমার সবকিছু গোলমাল করে দিচ্ছিল। অনেক খুঁজে খুঁজে মিসেস চ্যাপম্যানের লেখা একটি ডায়েরিক আমি পাই। যার মধ্যে তিনি তার পরিচিত লোকেদের ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখেছিলেন। তাতে মি. হেনরি মর্লেরও ঠিকানা লেখা ছিল। তিনি ছিলেন মিসেস চ্যাপম্যানের দাঁতের ডাক্তার। এরপরের ঘটনা আপনার অজানা নয় মি. ব্লাস্ট। করোনারের আদালতে দেহটা মিসেস চ্যাপম্যানের বলে সনাক্তকরণ করেছিলেন হেনরি মর্লের উত্তরাধিকারী।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট চঞ্চল হয়ে উঠলেন। পোয়াারোর তা দৃষ্টিগোচর হয়নি। তিনি আপনমনে বলে বললেন–আবার আমি ভাবতে শুরু করলাম, মিস ম্যাবেল সেইনসবারি সীলের প্রকৃতি কীরূপ? উত্তর পেলাম–তিনি ভারতে ছিলেন। মিশনারীদের হয়ে কাজ করেছেন। তাই তাকে আপাতদৃষ্টিতে ভালো মানুষই বলে মনে হয়। তবে দেখে মনে হয় তেমন চালাক চতুর নয়।
তাহলে সেইনসবারি সীল নামে অন্য কোনো মহিলা আছেন কি? ভাবলাম থাকতেও পারে। আপনি একজন স্ত্রীলোকের কথা বলেছিলেন। যিনি নিজেকে বিদেশী চর বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। আর আপনার স্ত্রীকেও চেনেন বলেছিলেন। তিনিই কি খুন করে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছেন? আমার বিশ্বাস তিনি জানতে পেরেছেন যে তাকে ইংল্যান্ডের পুলিশ খুঁজছে? তবে কি ধরে নিতে হবে যে তিনি পরিকল্পিতভাবে এই খুনটা করেছেন? অথবা খুনিকে সহযোগিতা করেছেন? আবার এই সঙ্গে এমনও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কেউ তাঁর চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন। মিস সীল অতীতে একজন নামকরা অভিনেত্রী ছিলেন। তাই তাঁর কাজে চতুর অভিনয়ের ছাপ রেখে গেছেন।
এই ব্যাপারে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন ইলিং-এর মি. বার্নেস। তিনি মি. হেনরি মর্লের একজন রোগী। তাঁর স্থির বিশ্বাস কাকতালীয়ভাবে দুটি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মর্লের ও অ্যামবেরিওটিসের অস্বাভাবিক মৃত্যু। আমি তাঁর মতে একমত হতে পরিনি। আমার মতে দুষ্কৃতিদের আসল টার্গেট ছিলেন মি. ব্লাস্ট অর্থাৎ আপনি।
ব্লাস্ট হাসতে হাসতে বললেন–এটা অমূলক ধারণা নয় কি?
–মন থেকে বলছেন তো কথাটা মি. ব্লাস্ট? আপনি নিশ্চিত জানেন অনেকেই আপনাকে পথের কাঁটা মনে করে। তাই সরিয়ে দিতে তারা তৎপর হয়েছে।
–হ্যাঁ, মানছি আপনার যুক্তির যথার্থতা আছে। তবে এর সঙ্গে মি. মর্লের মৃত্যুর কি সম্পর্ক আছে?
–এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমিতব্যয়ী হঠকারি এক মানুষের জীবন। অর্থাৎ বড় মাপের এক অপরাধ।
–আপনার বক্তব্য কি প্রমাণ করে দিচ্ছে, ভুল হয়েছে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মি. মর্লে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন?
একথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। মলে আত্মহত্যা করেননি তাঁকে খুন করা হয়েছে। এমনকি অ্যামবেরিওটিসকেও সনাক্ত করা যায়নি যে, তাকেও খুন করা হয়েছে। কিন্তু কি তার উদ্দেশ্য? কেন এতবড় বিপদের ঝুঁকি নেওয়া হয়েছিল? বার্নেস জেরায় কুবল করেছেন আপনার নাম পৃথিবী থেকে মুছে দেবার জন্য লোক লাগানো হয়েছিল। আর সে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল হেনরি মর্শে বা তার অংশীদারকে। তাদের মোটা টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল।
ব্লাস্ট চিৎকার করে বললেন–অবাস্তব সব কথাবার্তা বলছেন আপনি?
–সত্যিই কি তাই, মি. ব্লাস্ট? পথের কাঁটা উপরে ফেলতে যে কোনো গোবেচারা নিরীহ লোকই উপযুক্ত। কেউ তাকে সহজে সন্দেহ করবে না। এক্ষেত্রে মর্লের চাকরটাই তো সবচেয়ে কম সন্দেহজনক। সেই কারণে ওকে কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়াও সহজ উপায়।
–হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। এটা তো আগে ভাবিনি।
কথাটা যখন আমার ভাবনায় এল তখনই সত্যের প্রথম কিরণ আমি দেখতে পেলাম।
–আর তাই মি. বার্নেসের মত গ্রহণ করলেন?
–না। আমি নীতিগত দিকটাই গ্রহণ করেছি।
–মানে? ঠিক বুঝলাম না।
–প্রথম থেকেই ভুল তথ্য দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কখনো উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে, আবার কখনো অনিচ্ছায়। কারণ আমি যাতে মনে করি এটা কোনো একজন ব্যক্তির হিংসার ফল নয়, এটা সমগ্র জনগণের অপরাধ, অর্থাৎ আপনিই ওদের মূল টার্গেট। যেহেতু আপনি ব্যাঙ্কার, অর্থনীতি নিয়ামক, রক্ষণশীলতার ধারক।
কিন্তু প্রত্যেক জনমানসের একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকে। এখানেই আমি ভুল করি। আমি ব্যক্তিগত জীবনের কথা কখনো ভাবিনি। আপনাকে খুন করার ব্যক্তিগত কারণ ছিল, অনেকেই আপনাকে চেনেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভালোবাসেন। আবার অনেকে ঘৃণাও করেন। আপনার ওপর ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের ওই আক্রমণ ছিল রাজনৈতিক অপরাধ। এর অন্য কোনো যুক্তি আছে কি? আমার বিশ্বাস ঝোঁপের আড়ালে আর একজন লুকিয়ে ছিল। তার পক্ষে আপনাকে গুলি করা সহজ ছিল, তারপর বিপদ বুঝে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা। আর পিস্তলটা ফ্র্যাঙ্কের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। তারপর স্বাভাবিকভাবেই সেটা ফ্র্যাঙ্ক কার্টার তুলে নেবে।
আর একটা কথা আমার মাথায় এল। ফ্রাঙ্ক কার্টারের কাছাকাছি আপনি আমি ছাড়াও আর একজন ছিল। সে হল হাওয়ার্ড রেইকস। মর্লের মৃত্যুর দিনও সে কুইন শার্লট স্ট্রিটে ছিল। সে আপনার নীতির ঘোরতর বিরোধী। সে আপনার ভাইঝিকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে। আপনার মৃত্যুর পর আপনার ভাইঝিই হবে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।
তবে কি অপরাধটা ব্যক্তিগত? ব্যক্তিগত লাভ চরিতার্থ করার জন্যই কি এই হত্যালীলা? আমি কেন এটাকে জনগণের অপরাধ বলে ভেবেছি? কারণ জোর করে এই ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেদিন গির্জায় স্তোত্র শুনে আমার চোখ খুলে যায়। আমি সত্যকে উপলব্ধি করি।
আমি নিশ্চিত একটা ফাঁদ পাতা হয়েছিল। কিন্তু এর পেছনে কার হাত আছে? একজনের দ্বারাই সম্ভব। প্রথমে আমি ভুল পথে চালিত হয়েছিলাম। কারণ এতে বিশাল ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। অপরাধী জীবনের মায়া ত্যাগ করে এই কঠিন কাজটা করতে উদ্যোগী হয়েছিল? আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে সবই মিলে যাবে। এতে মিস সেইনসবারি সীল মস্ত বড় ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিলেন। তবে এখন প্রশ্ন, তিনি কোথায়?
অর্থাৎ দু’জন সেইনসবারি সীল ছিলেন। একজন বুদ্ধিহীনা, সৎ স্ত্রীলোক, অন্যজন দুটো খুনের সঙ্গে জড়িত আর রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দিষ্ট। স্ত্রীলোক দুটি হওয়া সম্ভব। এখন আমরা ধরে নিতে পারি মিস সেইনসবারি সীল এই গল্পের মুখ্য চরিত্র।
পোর্টার মিস সীল সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছিল, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, মি. ব্লাস্ট? সে বলেছিল, মিস সীল বহুবার কিং লিওপোল্ড ম্যানসনে গিয়েছিলেন। ঘটনার দিনও তিনি, সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু ওই বাড়ি থেকে বেরোতে তাকে কেউ দেখেনি। ঘটনা পরম্পরায় দেখা গেল সেই স্থান পূরণ করেছে দ্বিতীয় সেইনসবারি সীল। তিনি আসায় মিস সীলকে নকল করেন, তাঁর মতো পোশাক ও বকলস লাগানো জুতো পরেন। তারপর রাখেল স্কোয়ার হোটেলে যান। তার জামা কাপড় গুছিয়ে একটি ব্যাগে ভরেন। এরপর সেই হোটেলের বিল মিটিয়ে চলে আসেন গ্লেনগাউরি হোটেলে। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। প্রথমজনের ছদ্মবেশের আড়ালে দ্বিতীয়জন অভিনয় করেন। তাকে শেষ দেখা গেছে লিওপোল্ড ম্যানসনে ঢুকতে। মর্লের মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায়।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট জানতে চাইলেন–আপনার মতে সিন্দুকের মৃতদেহটা ম্যাবেল সেইনসবারি সীলেরই।
–অবশ্যই, তা না-হলে মৃতার মুখ কেন ওইভাবে ক্ষতবিক্ষত করবে? আমাদের বোকা বানানোর কৌশল এটা।
–কিন্তু দাঁত?
সেই ব্যাপারটা এখনও স্পষ্ট হয়নি আমার কাছে। দন্তচিকিৎসকই এটা প্রমাণ করতে পারে। মর্লে স্বয়ং আজ মৃত। তিনি জীবিত থাকলে একটা সুরাহা হত। মৃতার পরিচয় জানতে সুবিধা হত। আসল কাগজপত্র সব লোপাট করা হয়েছে। চার্টে আগের নামের ওপর নতুন লেবেল লাগানো হয়েছে।
এরকুল পোয়ারো একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন। তাই আপনি যখন প্রশ্ন করলেন মিস সেইনসবারি সীল আজও বেঁচে আছেন কিনা, আমি উত্তর দিয়েছিলাম সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। কারণ তখনও আমি বুঝতে পারিনি কোন সেইনসবারি সীলের কথা জানতে চাইছিলেন? আসল না নকল?
ব্লাস্ট বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার নাম যশ আছে। আমার অজানা নয় তা। তাই আপনি যা যুক্তি দেখাচ্ছেন তাই অকাট্য বলে মানতে হবে। তবে একজন নারী অন্য একজন নারীকে খুন করতে পারে? বিশেষ করে সৎ সরল বোকা একজনকে।
—হ্যাঁ, এটা আপনি খাঁটি কথা বলেছেন। এর উত্তরও আমি ভেবে রেখেছি, শুনবেন? আমার বিশ্বাস ম্যাবেল সেইনসবারি সীলের মানুষের মুখ স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা ছিল। তাই তাঁকে খুন হতে হয়।
মি. ব্লাস্ট শিহরিত হলেন। বললেন, আপনি পাগলের মতো কিসব বলছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো বললেন, আমি দ্বৈত সত্ত্বাকে আবিষ্কার করেছি। একজন নিরীহ, সৎ মহিলা। যিনি ভারত থেকে এখানে এসেছেন। অন্যজন চালাক বুদ্ধিমতী নামকরা এক অভিনেত্রী। এবার আপনাকে বলতে হবে দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারের সামনে কাকে দেখেছিলেন। যিনি আলাপ হওয়ার মুহূর্তেই বলেছিলেন, আপনার স্ত্রী তাঁর প্রিয় বান্ধবী ছিলেন। মিস সীলের বন্ধুদের জেরা করে জেনেছি আসল মিস সীল এত প্রগলভ নন। তাঁর পক্ষে কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে একথা বলা সম্ভব নয়। তাহলে ধরতে হবে যার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে তিনি মিথ্যে। আসল মিস সীল ইনি নন। ইনি জাল, প্রতারক। এর বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল, তাই মিথ্যের আশ্রয় নেন তিনি। আসল মিস সীল এভাবে অবলীলায় মিথ্যে বলতে পারতেন না।
ব্লাস্ট মাথা নেড়ে সায় দিলেন। হ্যাঁ, আপনার এই ব্যাখ্যা যুক্তিসঙ্গত। এ বিষয়ে এখনও অজানা। তবে এর সঙ্গে আর কারা জড়িত আছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে নিশ্চয়ই?
এরকুল পোয়ারো বললেন–অবশ্যই দেখা হচ্ছে। কিন্তু এটা ঠিক আপনার স্ত্রী একজন যশস্বী মহিলা। তাই তার সাথে মিস সেইনসবারি সীলের পরিচয় থাকা অসম্ভব কিছু নয়। তিনি হতে পারেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অথবা একজন মিশনারী, এমনকি অভিনেত্রী ভাবলেও ভুল হবে না। সুতরাং রেবেকা আর্নেস্ট নয়।
মি. ব্লাস্ট, আমি যে ব্যক্তিগত ও জনগণের জীবনের কথাটা বলেছিলাম এখন তা আপনার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আপনি সামান্য একজন জুনিয়র পার্টনার ছিলেন। একজন ধনী স্ত্রীলোককে বিয়ে করে আপনি বিরাট ব্যাঙ্কার হয়েছেন। খবরের কাগজে ছবিসহ আপনার কথা মাঝে-মধ্যে প্রকাশিত হয়। এবার নিশ্চয়ই আপনাকে বোঝাতে পেরেছি, আমি সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ঘটনাটা দেখেছি। আপনার কাছে মানুষের জীবন তুচ্ছ বলে মনে হয়। আপনি একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী। সেভাবেই জীবনযাপন করছেন। অন্যের মূল্য আপনার কাছে কখনো ছিল না।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট গম্ভীর স্বরে বললেন আপনার বক্তব্য বোধগম্য হল না, মঁসিয়ে পেয়ারো?
পোয়ারো শান্তভাবে বললেন–আপনি রেবেকা আর্নেস্টকে বিয়ের আগে অন্য একজনকে বিয়ে করেছিলেন, আপনার প্রথমা স্ত্রী বেঁচেছিলেন তখন, সে কথা গোপন করে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন রেবেকা আর্নেস্টকে। আপনার প্রথমা স্ত্রীর এক্ষেত্রে সম্মতি ছিল। আপনার বিলাসিতা ও ক্ষমতার লোভে আপনি দু’জনকেই প্রতারণা করেছেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট বিরক্ত হয়ে বললেন–কে আমার প্রথমা স্ত্রী?
এরকুল পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন তিনি থাকতেন কিং লিওপোন্ড ম্যানসনে। আপনার বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন মিসেস অ্যালবার্ট, চ্যাপম্যান নামে পরিচিত তিনি। আপনি একজন সিক্রেট এজেন্টকে খুঁজে পান। আপনার পরিকল্পনা মতো কাজ এগোতে থাকে। কারো মনে সন্দেহ জাগেনি। তবে প্রকৃত সত্যটা অন্তরালেই থেকে যায়। আপনি জানেন রেবেকা আর্নেস্টের সঙ্গে আপনার বিয়ে হওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। এতবছর পরে কোনো বিপদের সম্মুখীন হবেন তা আপনার আশাতীত ছিল। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। হঠাৎ সেদিন চার্চে একজন মহিলা আপনাকে চিনতে পারেন। কথা বলতে বলতে আপনার স্ত্রীর প্রসঙ্গ তোলেন। সেসময় আপনার ভাইঝি মিস ব্লাস্ট সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মহিলাটির সব কথা তার কানে যায়। অতএব রহস্য উন্মোচন করা আমার পক্ষে সহজ হয়ে যায়।
ব্লাস্ট কাতর স্বরে বললেন–সেদিন আমাদের দুজনের মধ্যে কি কথা হয়েছিল তা আমি নিজেই আপনাকে বলেছি মঁসিয়ে পোয়ারো।
না, আপনার ভাইঝির চাপে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। যাতে আপনাকে সন্দেহের তলিকার বাইরে রাখা হয়, তারপরও মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটে। ম্যাবেল সেইনসবারি সীলের সঙ্গে অ্যামবেরিওটিসের পরিচয় হয়। তিনি তাঁকে মধ্যাহ্ন ভোজে আমন্ত্রণ জানান, কথা প্রসঙ্গে মিস সীল আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলেন। মিস সীল জানতেন না অর্থনীতির জগতে আপনিই একচ্ছত্র সম্রাট। কিন্তু অ্যামবেরিওটিস সেটা জানতেন। গুপ্তচর বৃত্তি ছাড়াও ব্ল্যাকমেলিং তার স্বভাব ছিল। তিনি বুঝেছিলেন সোনার খনির দরজা খোলার চাবি হাতে পেয়ে গেছেন। তাই তিনি ব্ল্যাকমেল করার জন্য আপনাকে চিঠি লিখেছিলেন অথবা টেলিফোন করেছিলেন। তাই না, মি. ব্লাস্ট?
এরকুল পোয়ারো একটু থামলেন। তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন ব্লাস্টের মনোভাব। তিনি লক্ষ্য করলেন রাস্ট মাথা নীচু করে বসে আছেন, আর তার মুখ থমথম করছে।
পোয়ারো সেসব গ্রাহ্য করলেন না। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
–একজন ব্ল্যাকমেলার মোকাবিলার পথ একটাই। সে যাতে পৃথিবীর আলো আর না দেখতে পারে তার ব্যবস্থা করা। আর সবচেয়ে সহজ উপায় হল কোনো দন্তচিকিৎসকের চেয়ার, যেখানে মানুষ অসতর্ক থাকে।
এই নাটকের আর এক মজাদার চরিত্র হল অ্যালফ্রেড। হেনরি মর্লের ছোকরা চাকর। তার বয়ানে আমি আলোর দিশা দেখতে পাই। সে আমাকে বলেছে সে গোয়েন্দা গল্প পড়তে খুব পছন্দ করে। সেদিন যে গল্পটি পড়ছিল তার নাম পৌনে বারোটার খুন। সমাপতন এটাই, কারণ মলে খুন হন ঠিক সেই সময়েই। আপনি তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে তাকে গুলি করেছিলেন। সেটা চাপা দেওয়ার জন্য মর্লেকে অনুকরণ করে বেল বাজান। বেসিনের কল খুলে দেন এবং বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। আপনি এমন সময় বেছে নেন যে নীচে নামার সময় অ্যালফ্রেড ছদ্মবেশী সেইনসবারি সীলকে উপরে পৌঁছে দিচ্ছিল! আপনি এলিভেটরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরমুহূর্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন তারপর উপরে গিয়ে সোজা সার্জারিতে ঢোকেন।
অ্যালফ্রেড তখন ঘরে ঢোকেনি। তাই মর্লেকেও দেখেনি, সে শুধু জল পড়ার শব্দ শুনেছিল। আপনি ও আপনার সহযোগী নকল মিস সীল এবার মর্লের দেহ টেনে অফিস ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ক্ষিপ্র গতিতে নামের লিস্ট থেকে নামগুলি উল্টেপাল্টে দিয়েছিলেন। এবার একটা সাদা অ্যাপ্রন ও কোর্ট পরে ডাক্তার সেজে বসে রইলেন। আপনি জানতেন এরপর অ্যামবেরিওটিসের পালা। তাই তার অপেক্ষায় রইলেন। মিস সেইনসবারি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। আর অ্যালফ্রেড প্রথা অনুযায়ী তাকে পথ দেখিয়ে দেয়।
মিনিট কয়েক পরে অ্যামবেরিওটিস ঘরে এসেছিলেন। তিনি হেনরি মর্লেকে আগে কখনও দেখেননি। তিনি সেই প্রথম এসেছিলেন। আর আপনাকেও চিনতেন না তিনি। তাই তার মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি। এবার আপনি তাকে সার্জারিতে নিয়ে গেলেন এবং নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতে বলেছিলেন। তিনিও নির্দ্বিধায় বসে পড়েছিলেন আর কোন দাঁতে ব্যথা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর অতি মাত্রায় অ্যাড্রিনালিন ও প্রোচেশ মিশিয়ে ইঞ্জেকশান দিয়েছিলেন। পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
যে দু’জন লোক আপনার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছিল তারা মৃত। তৃতীয় ব্যক্তিকেও আপনি খুন করেছিলেন। যা আপনার ভাষায় নিতান্ত প্রয়োজনীয়। মলের আত্মহত্যার কাহিনিতেও কেউ চিহ্নিত হবে না, কারণ অ্যামবেরিওটিসকে তিনিই ভুল করে হত্যা করেছিলেন বলেই আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে এবং সবাই সেটা বিশ্বাসও করবে।
সবই পরিকল্পনা মাফিক চলছিল। কিন্তু বাদ সাধলাম আমি। আমি মঞ্চে অবতরণ করলাম। এখান থেকেই আপনার দুর্ভাগ্য শুরু হল। আমার সন্দেহ ঘনীভূত হল। আপনিও সেটা বুঝতে পারলেন তাই কিছু একটা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলেন। আবার আপনি আপনার সহযোগীর শরণাপন্ন হলেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করে ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকে ফাসাতে চাইলেন। তাকে ব্যবহার করলেন। তাকে কাজের লোভ দেখিয়ে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলেন। এবং বাগানে মালির কাজে নিযুক্ত করলেন। এমনিতে কেউ তাকে বিশ্বাস করত না। সুতরাং সে যাই বলুক না কেন কেউ কর্ণপাত করবে না। নিজেকে বাঁচাতে পারবেন। এরমধ্যে সিন্দুকের দেহ আবিষ্কৃত হবে। সবাই প্রথমে মিস সীলের দেহ বলে মনে করবে। পরে মিসেস চ্যাপম্যানের দেহ বলে জানাজানি হলে উত্তেজনা চরমে উঠবে। আর তখন পুলিশ মিস সীলকে খুঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এছাড়া আপনি ইচ্ছে করলে মাঝ পথেই তদন্ত বন্ধ করে দিতে পারেন।
আমার অনুমান ঠিক হল। আপনি তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হলেন। আমাকে ডেকে পাঠালেন। নিরুদ্দিষ্ট মহিলাকে খুঁজত বের করার দায়িত্ব নিতে বললেন। আপনার আপ্ত-সহায়ক টেলিফোনে আমাকে হুমকি দিতে লাগলেন। তবে নিজের কণ্ঠস্বর গোপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও তিনি অভিনয়ে পটু। তাই তার পক্ষে এটা করা অসম্ভব নয়। তিনি আপনার প্রথমা স্ত্রী মিসেস অলিভেরার কণ্ঠস্বর নকল করেছিলেন এতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়।
নাটকের শেষ অঙ্কও সাজানো হয়ে গেছে। আমাকে ক্রমহ্যামে আমন্ত্রণ জানানো হল আমিও সাদরে তা গ্রহণ করলাম। ঝোঁপের পাশে গুলিভর্তি একটি বন্দুক ফেলে রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আপনার চাকরকে। আপনি জানেন বন্দুকটি কেউ হাতে নিলে তা থেকে সহজেই গুলি বেরিয়ে আসবে। বেচারা ফ্র্যাঙ্ক কার্টার আপনার মতলব বুঝতে পারেনি। তাই সে পায়ের কাছে বন্দুকটি পড়ে থাকতে দেখে হাতে তুলে নিয়েছিল আর হাতে নাতে ধরাও পড়ে যায়।
আর এসবই আমাকে ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র। সত্যিই আপনার বুদ্ধির তারিফ করা উচিত, মি. ব্লাস্ট।
মি. ব্লাস্ট একটু কেঁপে উঠলেন। তিনি তিনি শান্তভাবে বললেন–মাফ করবেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কস্টা জানতে পেরেছেন? আর কতটাই বা এগিয়েছেন, তা কি জানতে পারি?
পোয়ারো বললেন আমার হাতে একটা বিয়ের সার্টিফিকেট এসেছে। সেটা পেয়েছি অক্সফোর্ডের কাছের এক রেজিস্ট্রি অফিস থেকে অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট ও গার্ডা গ্ল্যান্টের। বারোটা পঁচিশে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কুইন শার্লট স্ট্রিটে মর্লের অফিসে গিয়েছিল। সেই সময় দু’জন লোক মর্লের সার্জারি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তা ফ্র্যাঙ্কের দৃষ্টিগোচর হয়। তার কথায় প্রথম জন একজন মোটা ভদ্রলোক অর্থাৎ অ্যামবেরিওটিস আর দ্বিতীয় জন আপনি, কার্টার আপনাকে চিনতে পারেনি। সে অ্যালফ্রেডকেও কাছে পিঠে দেখতে পায়নি। তাই সে অনুমতির তোয়াক্কা করে না। সে ঢুকে পড়ে মর্লের সার্জারিতে। আর সেই প্রথম মর্লেকে মৃত অবস্থায় দেখে। অর্থাৎ মর্লের আগেই মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং বলা যেতে পারে অ্যামবেরিওটিসের চিকিৎসা যিনি করেছিলেন তিনি মলে না। অন্য কেউ। আর তাকেই মর্লের হত্যাকরী হিসেবে ধরতে হবে।
–আর কিছু বলার আছে মঁসিয়ে পোয়ারো।
-হ্যাঁ, আছে। আপনি শুনলে অবাক হবেন, আজ সন্ধ্যায় হেলেন মন্ট্রেসরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ব্লাস্ট চেয়ারে একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তারপর তীক্ষ্ণস্বরে বললেন–তাহলে আপনার তদন্ত শেষ।
পোয়ারো বললেন না। আসল হেলেন মন্ট্রেসর কানাডায় থাকতেন। তিনি সাত বছর আগে সেখানেই মারা যান। আপনি সেকথা জেনেও আমাদের কাছে গোপন করেছিলেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট হেসে উঠলেন। তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, আপনি বুদ্ধিমান। ব্যাপারটা সহজেই বুঝতে পারবেন। আপনি গার্ডার নাম শুনেছেন। ও এক সময় থিয়েটারে অভিনয় করত। ব্যাপারটা আমরা গোপন রেখেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ম্যাবেল সেইনসবারি সীল। তিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত। তিনি কিছুদিনের জন্য একটা ভ্রাম্যমান সংস্থার সঙ্গে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। গার্ডা নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ক্রমে ক্রমে তার চিঠি লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে জানতে পেরেছি তিনি একটি ছেলের প্রেমে পড়েছেন। বরাবরই তিনি বুদ্ধিহীনা ছিলেন।
এরপর আলাপ হয় রেবেকার সঙ্গে। পরে প্রেম। এবং ধীরে ধীরে তা বিয়েতে রূপ পায়। এ যেন রাজসিক ব্যাপার। বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক রেবেকাকে বিয়ে করে আমি রাজার চালে চলতে লাগলাম। কিন্তু গার্ডাকে আমি ছাড়তে পারিনি। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। তাই ওকে আমি রেবেকার সম্পর্কে সব জানাই। ব্যাপারটাকে ও উদার মনে মেনে নিয়েছিল। এদিকে রেবেকাকেও ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতে পারতাম না। ওকেও আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করতাম। একে অপরকে খুব ভালো বুঝতাম। তাছাড়া অর্থনীতিতে সে পারদর্শী ছিল। হঠাৎ একদিন সে মারা গেল। এতে আমি দারুণ শোক পেয়েছিলাম।
রেবেকার দুঃখ ভুলতে আমি গার্ডার কাছে আবার যেতে লাগলাম। আমাদের গোপন দেখাশোনায় দারুণ উত্তেজনা বোধ করতাম। সে নামকরা অভিনেত্রী ছিল। অভিনয়টা–সে খুব চমৎকার করত। একই অঙ্গে বহু রূপের মতো সে একসঙ্গে সাত-আটটা চরিত্রে অভিনয় করতে পারত। বহু নাম ধারণ করত। এক এক অঞ্চলে গিয়ে। যেমন ইংল্যান্ডে মিসেস অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান। আবার পারীতে আমেরিকান বিধবা বলেও নিজের পরিচয় দিতেন। আমি ব্যবসার কাজে প্যারীতে যেতাম। সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতাম।
মাঝেমধ্যে আমাকে নরওয়েতে যেতে হত। অবসর মুহূর্তে মাছ ধরতাম। সেখানেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হত। সে যেত ছবি আঁকার কাজে। তারপর ওকে নিয়ে এলাম আমার গ্রামের বাড়ি ক্রমহ্যামে। তার পরিচয় দিলাম দূর সম্পর্কের বোন হিসেবে। নাম রাখলাম হেলেন মসের। এটা আমাদের কাছে মজার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা আমাদের রোমান্সের কথা কাউকে লজ্জায় বলতে পারতাম না। অবশ্য আমি গার্ডাকে পুনর্বিবাহ করতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। কারণ অতীত স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। তাছাড়া গার্ডা আমার জীবনধারার পক্ষে বড্ড বেমানান। সে আমার সরকারি কাজকর্ম একদম সহ্য করতে পারত ন। আসল কথা হল, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করাতে আমরা দুজনেই আনন্দ পেয়েছিলাম।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট একটু থেমে দম নিলেন। আবার তিনি বলতে শুরু করলেন। সেই মুহূর্তে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। গলার স্বর তীব্র। মিস সীলের ওপর যত রাগ ছিল উগরে দিলেন।
তিনি বললেন–ওই মূর্খ স্ত্রীলোক সব নষ্টের গোড়া। সব ওলট-পালট করে দিল। বহু বছর আমাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ছিল না। হঠাৎ সেদিন চার্চে তার সঙ্গে দেখা হল। এত বছর পরেও চিনতে পারল আমাকে। অ্যামবেরিওটিসের সঙ্গে আমার সম্পর্কে আলোচনা করেছিল। এসব কথা আমি জানতে পারি। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিই দ্রুত কিছু একটা করার। আমি স্বার্থপর নই। তাই আমার নিজের জন্য চিন্তা ছিল না। আমার ভাবনা ছিল সমস্ত দেশবাসীর জন্য। আমি বিপদে পড়লে অথবা আমার জীবনহানি হলে সমস্ত দেশেরই ক্ষতি হবে। ইংল্যান্ডে যা কিছু হয়েছে তার অনেকটাই আমি করেছি। দেশের প্রতি আমার অবদানও কম নয়। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, দলতন্ত্রে নয়। আমরা মুক্ত স্বাধীন দেশ গড়তে চেয়েছিলাম। তবে অত্যাচার করে নয়। আর সেইসব নষ্ট করতে চেয়েছিল এক হতভাগ্য শয়তান লালমুখো গ্রীক। মঁসিয়ে পোয়ারো, এদেশ আমায় ছাড়া চলবে না। গার্ডাও সেটা অনুভব করেছিল। তাকে ব্যবহার করলাম। মিস সেইনসবারি সীলকে সরিয়ে দিতে হবে। তার মুখ বন্ধ করতে হবে। মিস সেইনসবারি সীলের জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
একদিন গার্ডাকে পাঠালাম ওর কাছে। সে তার সঙ্গে দেখা করে বলল, আমি মিসেস চ্যাপম্যানের পেয়িংগেস্ট হয়ে রয়েছি। তুমি একদিন এসো সেখানে। তোমায় চায়ের নিমন্ত্রণ রইল। সেইনসবারি সীলের মনে পাপ ছিল না। সে এসেছিল মিসেস চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটে। আগে থেকেই গার্ডা প্রস্তুত ছিল। আমার পরিকল্পনা মতো চায়ের মধ্যে মেডিসিন মিশিয়ে দিয়েছিল সে। ম্যাবেল সন্দেহ না করেই সেটা পান করেছিল এবং চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল। এবার মিসেস চ্যাপম্যানের গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজন। আমরা দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, এবার অ্যামবেরিওটিসকে সরাতে হবে। সেইমতো ব্যবস্থা নিলাম। আমি রোগীর ছদ্মবেশে দন্তচিকিৎসক মর্লের চেম্বারে গেলাম। তাকে খুন করলাম। এবার পালা অ্যামবেরিওটিসের। তিনি আমাকে চিনতেন না। তাই ডাক্তারের পোশাকে আমাকে দেখে তার কোনো সন্দেহ হয়নি।
এবার পোয়ারো তাঁকে হাত নেড়ে থামালেন। তিনি জানতে চাইলেন–মর্লেকে মারলেন কেন?
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট শান্ত স্বরে বললেন–বাধ্য হয়ে একাজ করতে হয়েছে আমাকে। সত্যিই মর্লেকে মারার জন্য আমি দুঃখিত।
দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। একসময় ব্লাস্ট বললেন–এবার কি হবে, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো বিমর্ষ সুরে বললেন–এ খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য হেলেন মসেরকে পুলিশ আগেই গ্রেপ্তার করেছে।
ব্লাস্ট সহজ ভঙ্গীতে বললেন এবার আমার পালা, তাই তো, মঁসিয়ে পোয়ারো?
–অবশ্যই, আমার কথার অর্থ তাই হয়।
–কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি এতে খুশি হননি?
–আপনার ধারণা সত্যি, মি. ব্লাস্ট, আমি খুশি হইনি।
–আমি তিনজনের হত্যাকারী। আমি নিশ্চিত, বিচারে আমার ফাঁসি হবে। তবে আপনি আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবেন।
–ঠিক বুঝলাম না। পরিষ্কার করে বলুন।
–আমি এদেশের জন্য অপরিহার্য, এ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। অর্থনীতির স্থায়িত্ব বজায় রাখার জন্য আমাকে দেশের প্রয়োজন। প্রধানত দেশের মঙ্গলের জন্যও আমাকে সবার দরকার।
–হ্যাঁ তা হতে পারে।
–আপনিও স্বীকার করছেন।
–অবশ্যই। দেশের যা কিছু ভাল আপনি তার প্রতিভূ। স্থায়িত্ব, সুস্থতা ও সৎ ভাবনার জন্যও আপনার খ্যাতি আছে।
ব্লাস্ট মাথা নীচু করে কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন–ধন্যবাদ, মঁসিয়ে পোয়ারো। তাহলে এখন আপনার করণীয় কি?
–আপনি চাইছেন এই মামলা থেকে আমি হাত গুটিয়ে নিই, মি. ব্লাস্ট?
–হ্যাঁ, সেটাই আমার ইচ্ছে।
—আর আপনার স্ত্রী গার্ডার কি হবে?
–আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি অবহিত আছেন। আর আমি উচ্চ পর্যায়ের লোকেদের সঙ্গে মিশি। সুতরাং ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। ভুয়ো সাক্ষী দাঁড় করাব। আর রটিয়ে দেব সনাক্তকরণে ভুল হয়েছে।
-আমি যদি তা মেনে না নিই, তাহলে?
–তাহলে আমিও প্রস্তুত। সবই আপনার ওপর নির্ভর করছে। আপনাকে আবারও বলছি, নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমি এইসব ব্যাখ্যা দিচ্ছি না। আমি কেবল দেশের স্বার্থরক্ষা করতে চাইছি। আর কেন তা করেছি আপনার অজানা নয়, মঁসিয়ে পোয়ারো। এতে আমার নিজের কোনো স্বার্থসিদ্ধি হবে না।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তিনি বললেন–এ-সব জায়গাতে সঠিক মানুষ হিসাবে আপনি বিরাজ করছেন। আপনি সৎ, জ্ঞানী, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। তবে এর অন্য একটি দিকও আছে। যে তিনজন মানুষ আজ মৃত, তাদের আপনি হত্যা করেছেন, সেকথা অস্বীকার করবেন কিভাবে, মি. ব্লাস্ট?
–হ্যাঁ, তাদের কথাও আমি ভেবে রেখেছি, মঁসিয়ে পোয়ারো। প্রমাণ করে দেব ম্যাবেল সেইনসবারি সীল বিকৃত মস্তিষ্কের স্ত্রীলোক, অ্যামবেরিওটিস একজন গুপ্তচর ও ব্ল্যাকমেলার। অসৎ মানুষ।
–আর মলের ক্ষেত্রে কি যুক্তি দেবেন?
–মর্শের জন্য আমার দুঃখ হয়। তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। সকলের উপকারে এগিয়ে আসতেন। তবে তিনি না থাকলেও কারো কিছু আসে যায় না। ওরকম অনেক দাঁতের ডাক্তার আছে এদেশে।
–হ্যাঁ, আপনার যুক্তি মেনে নিচ্ছি। তবে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কি দোষ করেছিল? তাকেও কোনো অনুশোচনা ছাড়াই মারতে চাইছিলেন।
–তার প্রতি আমার কোনো দয়া মায়া নেই। সে অভদ্র নীচ প্রকৃতির মানুষ।
পোয়ারো শেষ চেষ্টা করে বললেন–সব কিছুর ওপরে সেও একজন মানুষ।
–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমরা সবাই মানুষ।
–আপনি স্বীকার করছেন আমরা সবাই মানুষ। কিন্তু একথা আপনি মনে রাখেননি, মি. ব্লাস্ট। আপনার মতে ম্যাবেল সেইনসবারি সীল পাগল আর বুদ্ধিহীনা। অ্যামবেরিওটিস অসৎ মানুষ এবং ফ্র্যাঙ্ক কার্টার একজন বাজে লোক। আর মর্লে শুধুমাত্র একজন দন্ত চিকিৎসক, যা নাকি দেশে অনেক আছে। ঠিক এখানেই আমার আর আপনার দৃষ্টিকোণে পার্থক্য। আমার কাছে আপনিও যেমন, ওই চারজনও তাই। আপনার জীবনের যতখানি মূল্য আছে ঠিক ততটাই ওদের জীবনও মূল্যবান।
–আপনি ভুল করছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। ওই চারজন ও আমি এক নই।
–না, আমি ঠিক বলছি। আপাতদৃষ্টিতে আপনি সৎ, গুণী বিশ্বাসযোগ্য, দৃঢ়চেতা ব্যক্তি। কিন্তু অন্তরে আপনি ক্ষমতালোভী। তাই ওই চারজনের জীবন আপনার কাছে মূল্যহীন বলে মনে হয়েছে। ওই চারজনকে বলিদান দিয়ে নিজের স্বার্থ সফল করতে দ্বিধা করেননি আপনি।
আপনি কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো। সমগ্র জাতির ভাল মন্দর দায়িত্ব আমার ওপর অর্পন করা হয়েছে। এটা তো আপনি মানেন?
–আমার ভাবনা চারজনকে নিয়ে। আমি ওই চারজনকে রক্ষা করতে পারলাম না আর সমগ্র জাতির কথা ভাবব কি করে? নিজের লালসা চরিতার্থ করার জন্য যাদের বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন আপনি।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন–এটাই আপনার শেষ কথা, মঁসিয়ে পোয়ারো?
এরকুল পোয়ারো দৃঢ় কণ্ঠে বললেন–হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ কথা। বলেই তিনি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন ঠিক সেই মুহূর্তে দুজন তোক ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল।
এরকুল পোয়ারোর জন্য দু’জন অপেক্ষা করছিল। একজন জেন অলিভেরা এবং অপরজন তার প্রেমিক। নাম হাওয়ার্ড রেইকস।
জেনের মুখ ফ্যাকাশে, ক্লান্ত। সে ম্যাস্টলপিসের সামনে দাঁড়িয়েছিল, পাশে ছিল হাওয়ার্ড।
জেন পোয়ারোকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইল–কি হল, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো বললেন সব শেষ।
হাওয়ার্ড তীক্ষ্ণস্বরে বলল–সব শেষ মানে?
পোয়ারো বললেন মি. অ্যালিস্টেয়ারকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হাওয়ার্ড বিদ্রূপ করে বলল–আমি ভেবেছিলাম আপনি ওই লোকটার অর্থ ও বুদ্ধির কাছে বিকিয়ে যাবেন। আপনি হার মানতে বাধ্য হবেন। আপনার বুদ্ধি বিবেচনা লোপ পাবে। যাক, আপনার এ-উপকারের কথা সমগ্র ইংল্যান্ডবাসী চিরদিন মনে রাখবে।
জেন বলল-না, আমি একবারও তা ভাবিনি। মঁসিয়ে পোয়ারোর ওপর আমার আস্থা ছিল।
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তোমরা এখন মুক্ত। এ পৃথিবী তোমাদের। তোমরা নতুন পৃথিবী রচনা করো। তোমাদের এই নতুন পৃথিবীর মানুষ মমতাময় হয়ে উঠুক। এইটুকুই আমার প্রার্থনা।
১০. উনিশ, বিশ, খালি মোর ডিশ
এরকুল পোয়ারো ক্লান্ত, শ্রান্ত পদক্ষেপে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে সামান্য কয়েকজনকে দেখা গেল, তিনি আপন মনে হেঁটে চলেছেন। এমন সময় একজন তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। পোয়ারো চমকে উঠলেন। কাছে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন।
এরকুল পোয়ারো কাঁধ ঝাঁকিয়ে করমর্দন করলেন।
বার্নেস বললেন–উনি কি তার দোষ স্বীকার করেছেন?
এরকুল পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ, উনি সব স্বীকার করেছেন। এর ন্যায্যতার সমর্থক চাইছিলেন একজন। তিনি বলতে চাইছিলেন, দেশের উপকারে তাঁকে লাগবে।
বার্নেস বললেন–তা লাগতে পারে। আপনিও তো তাই মনে করেন, মঁসিয়ে পোয়ারো?
–হ্যাঁ, মনে করি।
–তাহলে এবার আপনি কি বলবেন?
–আমার বক্তব্য, মানুষ মাত্রই ভুল করে থাকে।
–কথাটা ঠিক বলেছেন আপনি। কিন্তু এ-কথাটা আমার মাথায় আসেনি।
তারা দুজনে নীরবে হেঁটে চললেন। কিছুটা যাওয়ার পর বার্নেস মুখ খুললেন। বললেন আপনাকে চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে। কি ভাবছেন?
পোয়ারো আবৃত্তির সুরে বললেন তুমি যেহেতু প্রভুর আদেশ অবমাননা করেছ, তিনিও তেমনি তোমাকে রাজা হওয়া থেকে বঞ্চিত করলেন।
বার্নেস ভারিক্কি চালে বললেন–ওহ, বুঝেছি। আপনি বাইবেলের বাণী শোনালেন। আর এভাবে ভাবাটা আপনার পক্ষে সম্ভব, মঁসিয়ে পোয়ারো।
দু’জনে আরও কিছুটা এগোলেন। বার্নেস দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন আমি এখান থেকে টিউব রেলে উঠব। শুভরাত্রি পোয়ারো। একটু থেমে আবার বললেন–আপনাকে একটা কথা জানানো হয়নি।
বলুন, কি বলবেন?
–আমি আপনার কাছে ঋণী ও কৃতজ্ঞ। আপনাকে অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল পথে চালিত করেছিলাম। এরজন দুঃখিত ও ক্ষমা চাইছি। প্রকৃত কথা হল, অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান কিউ এক্স ৯১২-কে আমি জানি।
এরকুল পোয়ারো চমকে উঠে প্রশ্ন করলেন–কি বলছেন আপনি? এতদিন কথাটা গোপন করেছিলেন কেন?
–কেন সেটা বলতে পারব না। আসলে আমিই হলাম অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান। এইজন্য ব্যাপারটাতে এত উৎসাহ দেখিয়েছিলাম। আমার কোনো স্ত্রী ছিল না। আর হবেও না। স্ত্রী ভাগ্য আমার নেই।
কথাটা শেষ করেই বার্নেস ওরফে অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান হেসে উঠলেন। তারপর আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালেন না। তিনি দ্রুত চলে গেলেন।
পোয়ারো নিথর নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মিনিট কয়েক কেটে গেল। তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল।
তারপর আপন মনে বলে চললেন–উনিশ, বিশ, খালি মোর ডিশ–
সম্বিৎ ফিরে পেতে তিনি চলতে শুরু করলেন। অবশেষে তিনি বাড়ি এসে পৌঁছলেন।