–সত্যিই কি তাই, মি. ব্লাস্ট? পথের কাঁটা উপরে ফেলতে যে কোনো গোবেচারা নিরীহ লোকই উপযুক্ত। কেউ তাকে সহজে সন্দেহ করবে না। এক্ষেত্রে মর্লের চাকরটাই তো সবচেয়ে কম সন্দেহজনক। সেই কারণে ওকে কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়াও সহজ উপায়।
–হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। এটা তো আগে ভাবিনি।
কথাটা যখন আমার ভাবনায় এল তখনই সত্যের প্রথম কিরণ আমি দেখতে পেলাম।
–আর তাই মি. বার্নেসের মত গ্রহণ করলেন?
–না। আমি নীতিগত দিকটাই গ্রহণ করেছি।
–মানে? ঠিক বুঝলাম না।
–প্রথম থেকেই ভুল তথ্য দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কখনো উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে, আবার কখনো অনিচ্ছায়। কারণ আমি যাতে মনে করি এটা কোনো একজন ব্যক্তির হিংসার ফল নয়, এটা সমগ্র জনগণের অপরাধ, অর্থাৎ আপনিই ওদের মূল টার্গেট। যেহেতু আপনি ব্যাঙ্কার, অর্থনীতি নিয়ামক, রক্ষণশীলতার ধারক।
কিন্তু প্রত্যেক জনমানসের একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকে। এখানেই আমি ভুল করি। আমি ব্যক্তিগত জীবনের কথা কখনো ভাবিনি। আপনাকে খুন করার ব্যক্তিগত কারণ ছিল, অনেকেই আপনাকে চেনেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভালোবাসেন। আবার অনেকে ঘৃণাও করেন। আপনার ওপর ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের ওই আক্রমণ ছিল রাজনৈতিক অপরাধ। এর অন্য কোনো যুক্তি আছে কি? আমার বিশ্বাস ঝোঁপের আড়ালে আর একজন লুকিয়ে ছিল। তার পক্ষে আপনাকে গুলি করা সহজ ছিল, তারপর বিপদ বুঝে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা। আর পিস্তলটা ফ্র্যাঙ্কের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। তারপর স্বাভাবিকভাবেই সেটা ফ্র্যাঙ্ক কার্টার তুলে নেবে।
আর একটা কথা আমার মাথায় এল। ফ্রাঙ্ক কার্টারের কাছাকাছি আপনি আমি ছাড়াও আর একজন ছিল। সে হল হাওয়ার্ড রেইকস। মর্লের মৃত্যুর দিনও সে কুইন শার্লট স্ট্রিটে ছিল। সে আপনার নীতির ঘোরতর বিরোধী। সে আপনার ভাইঝিকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে। আপনার মৃত্যুর পর আপনার ভাইঝিই হবে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।
তবে কি অপরাধটা ব্যক্তিগত? ব্যক্তিগত লাভ চরিতার্থ করার জন্যই কি এই হত্যালীলা? আমি কেন এটাকে জনগণের অপরাধ বলে ভেবেছি? কারণ জোর করে এই ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেদিন গির্জায় স্তোত্র শুনে আমার চোখ খুলে যায়। আমি সত্যকে উপলব্ধি করি।
আমি নিশ্চিত একটা ফাঁদ পাতা হয়েছিল। কিন্তু এর পেছনে কার হাত আছে? একজনের দ্বারাই সম্ভব। প্রথমে আমি ভুল পথে চালিত হয়েছিলাম। কারণ এতে বিশাল ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। অপরাধী জীবনের মায়া ত্যাগ করে এই কঠিন কাজটা করতে উদ্যোগী হয়েছিল? আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে সবই মিলে যাবে। এতে মিস সেইনসবারি সীল মস্ত বড় ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিলেন। তবে এখন প্রশ্ন, তিনি কোথায়?
অর্থাৎ দু’জন সেইনসবারি সীল ছিলেন। একজন বুদ্ধিহীনা, সৎ স্ত্রীলোক, অন্যজন দুটো খুনের সঙ্গে জড়িত আর রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দিষ্ট। স্ত্রীলোক দুটি হওয়া সম্ভব। এখন আমরা ধরে নিতে পারি মিস সেইনসবারি সীল এই গল্পের মুখ্য চরিত্র।
পোর্টার মিস সীল সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছিল, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, মি. ব্লাস্ট? সে বলেছিল, মিস সীল বহুবার কিং লিওপোল্ড ম্যানসনে গিয়েছিলেন। ঘটনার দিনও তিনি, সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু ওই বাড়ি থেকে বেরোতে তাকে কেউ দেখেনি। ঘটনা পরম্পরায় দেখা গেল সেই স্থান পূরণ করেছে দ্বিতীয় সেইনসবারি সীল। তিনি আসায় মিস সীলকে নকল করেন, তাঁর মতো পোশাক ও বকলস লাগানো জুতো পরেন। তারপর রাখেল স্কোয়ার হোটেলে যান। তার জামা কাপড় গুছিয়ে একটি ব্যাগে ভরেন। এরপর সেই হোটেলের বিল মিটিয়ে চলে আসেন গ্লেনগাউরি হোটেলে। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। প্রথমজনের ছদ্মবেশের আড়ালে দ্বিতীয়জন অভিনয় করেন। তাকে শেষ দেখা গেছে লিওপোল্ড ম্যানসনে ঢুকতে। মর্লের মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায়।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট জানতে চাইলেন–আপনার মতে সিন্দুকের মৃতদেহটা ম্যাবেল সেইনসবারি সীলেরই।
–অবশ্যই, তা না-হলে মৃতার মুখ কেন ওইভাবে ক্ষতবিক্ষত করবে? আমাদের বোকা বানানোর কৌশল এটা।
–কিন্তু দাঁত?
সেই ব্যাপারটা এখনও স্পষ্ট হয়নি আমার কাছে। দন্তচিকিৎসকই এটা প্রমাণ করতে পারে। মর্লে স্বয়ং আজ মৃত। তিনি জীবিত থাকলে একটা সুরাহা হত। মৃতার পরিচয় জানতে সুবিধা হত। আসল কাগজপত্র সব লোপাট করা হয়েছে। চার্টে আগের নামের ওপর নতুন লেবেল লাগানো হয়েছে।
এরকুল পোয়ারো একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন। তাই আপনি যখন প্রশ্ন করলেন মিস সেইনসবারি সীল আজও বেঁচে আছেন কিনা, আমি উত্তর দিয়েছিলাম সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। কারণ তখনও আমি বুঝতে পারিনি কোন সেইনসবারি সীলের কথা জানতে চাইছিলেন? আসল না নকল?
ব্লাস্ট বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার নাম যশ আছে। আমার অজানা নয় তা। তাই আপনি যা যুক্তি দেখাচ্ছেন তাই অকাট্য বলে মানতে হবে। তবে একজন নারী অন্য একজন নারীকে খুন করতে পারে? বিশেষ করে সৎ সরল বোকা একজনকে।
—হ্যাঁ, এটা আপনি খাঁটি কথা বলেছেন। এর উত্তরও আমি ভেবে রেখেছি, শুনবেন? আমার বিশ্বাস ম্যাবেল সেইনসবারি সীলের মানুষের মুখ স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা ছিল। তাই তাঁকে খুন হতে হয়।