ব্লাস্ট মুচকি হেসে বললেন–আমি তেমন গুরুত্বের কিছু দেখতে পাচ্ছি না, মঁসিয়ে পোয়ারো।
এরকুল পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন–ঠিক আছে আপনার কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন কিছু নিশ্চয়ই ভালো লাগে না। আমি আমার জুতোটা হাতে নিয়ে দেখি। নিখুঁতভাবে দেখলাম। দেখলাম বকলসটা হাতে সেলাই করা হয়েছে। তখনই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল। তাহলে কি সকালে আমি ভুল দেখিছি। পুরোনো জুতো পরা ছিলেন। মিস সীল। রোদের আলোয় যেটা চকচক করছিল। আর নতুন বলে মনে হয়েছিল।
মি. ব্লাস্ট সকৌতুক বললেন–হয়তো এটাই আসল ব্যাখ্যা।
পোয়ারো তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন–না, না, এটা হতে পারে না। আমার চোখ আমাকে ধোঁকা দেবে না। আর একবার লাশটা পরীক্ষা করলাম। যা দেখলাম তা আমাকে খুশি করতে পারল না। বার বার ভাবলাম মুখটা ওইভাবে বিকৃত করার কারণ কি? যাতে চেনা না যায় সেই জন্য? নাকি প্রমাণ লোপাট করার জন্য?
মি. ব্লাস্ট অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন–নতুন করে এসব নিয়ে আলোচনার কি খুব দরকার আছে?
পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ঝরে পড়ছে। তিনি বললেন–আছে বইকি। একে একে যেভাবে সত্য উদঘাটন করছি সেটা আপনার জানা উচিত। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি, এখানে কি কিছু গলদ আছে। মৃতদেহে মিস সেইনসবারি সীলের পোশাক রয়েছে। রয়েছে একজোড়া জুতো ও ব্যাগ। এত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন মুখ বিকৃত করা হল? তবে কি পুলিশকে ধাঁধায় ফেলার জন্য করা হয়েছে। অথবা এটা মিস সীলের দেহ নয়? এমন সময় মাথায় বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিল একটা ভাবনা। তবে কি এটি মিসেস চ্যাপম্যানের দেহ? তাদের মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে। চুল ও আকৃতিতে দুজনেই সমবয়সি। তবে একটা মিল হল তাদের দুজনের পায়ের মাপ দু’ধরনের। মিস সীল দু’নম্বর জুতো পরতেন। আর অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান পরনে পাঁচ নম্বর জুতো। অর্থাৎ মিস সীলের পা মিসেস চ্যাপম্যানের চেয়ে বড়। আমি ভাবলাম মিস সীলের পায়ে যদি খুঁত থাকে তবে জুতো ঢিলে হবে অথচ তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এই ব্যাপারটা আমার সবকিছু গোলমাল করে দিচ্ছিল। অনেক খুঁজে খুঁজে মিসেস চ্যাপম্যানের লেখা একটি ডায়েরিক আমি পাই। যার মধ্যে তিনি তার পরিচিত লোকেদের ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখেছিলেন। তাতে মি. হেনরি মর্লেরও ঠিকানা লেখা ছিল। তিনি ছিলেন মিসেস চ্যাপম্যানের দাঁতের ডাক্তার। এরপরের ঘটনা আপনার অজানা নয় মি. ব্লাস্ট। করোনারের আদালতে দেহটা মিসেস চ্যাপম্যানের বলে সনাক্তকরণ করেছিলেন হেনরি মর্লের উত্তরাধিকারী।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট চঞ্চল হয়ে উঠলেন। পোয়াারোর তা দৃষ্টিগোচর হয়নি। তিনি আপনমনে বলে বললেন–আবার আমি ভাবতে শুরু করলাম, মিস ম্যাবেল সেইনসবারি সীলের প্রকৃতি কীরূপ? উত্তর পেলাম–তিনি ভারতে ছিলেন। মিশনারীদের হয়ে কাজ করেছেন। তাই তাকে আপাতদৃষ্টিতে ভালো মানুষই বলে মনে হয়। তবে দেখে মনে হয় তেমন চালাক চতুর নয়।
তাহলে সেইনসবারি সীল নামে অন্য কোনো মহিলা আছেন কি? ভাবলাম থাকতেও পারে। আপনি একজন স্ত্রীলোকের কথা বলেছিলেন। যিনি নিজেকে বিদেশী চর বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। আর আপনার স্ত্রীকেও চেনেন বলেছিলেন। তিনিই কি খুন করে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছেন? আমার বিশ্বাস তিনি জানতে পেরেছেন যে তাকে ইংল্যান্ডের পুলিশ খুঁজছে? তবে কি ধরে নিতে হবে যে তিনি পরিকল্পিতভাবে এই খুনটা করেছেন? অথবা খুনিকে সহযোগিতা করেছেন? আবার এই সঙ্গে এমনও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কেউ তাঁর চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন। মিস সীল অতীতে একজন নামকরা অভিনেত্রী ছিলেন। তাই তাঁর কাজে চতুর অভিনয়ের ছাপ রেখে গেছেন।
এই ব্যাপারে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন ইলিং-এর মি. বার্নেস। তিনি মি. হেনরি মর্লের একজন রোগী। তাঁর স্থির বিশ্বাস কাকতালীয়ভাবে দুটি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মর্লের ও অ্যামবেরিওটিসের অস্বাভাবিক মৃত্যু। আমি তাঁর মতে একমত হতে পরিনি। আমার মতে দুষ্কৃতিদের আসল টার্গেট ছিলেন মি. ব্লাস্ট অর্থাৎ আপনি।
ব্লাস্ট হাসতে হাসতে বললেন–এটা অমূলক ধারণা নয় কি?
–মন থেকে বলছেন তো কথাটা মি. ব্লাস্ট? আপনি নিশ্চিত জানেন অনেকেই আপনাকে পথের কাঁটা মনে করে। তাই সরিয়ে দিতে তারা তৎপর হয়েছে।
–হ্যাঁ, মানছি আপনার যুক্তির যথার্থতা আছে। তবে এর সঙ্গে মি. মর্লের মৃত্যুর কি সম্পর্ক আছে?
–এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমিতব্যয়ী হঠকারি এক মানুষের জীবন। অর্থাৎ বড় মাপের এক অপরাধ।
–আপনার বক্তব্য কি প্রমাণ করে দিচ্ছে, ভুল হয়েছে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মি. মর্লে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন?
একথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। মলে আত্মহত্যা করেননি তাঁকে খুন করা হয়েছে। এমনকি অ্যামবেরিওটিসকেও সনাক্ত করা যায়নি যে, তাকেও খুন করা হয়েছে। কিন্তু কি তার উদ্দেশ্য? কেন এতবড় বিপদের ঝুঁকি নেওয়া হয়েছিল? বার্নেস জেরায় কুবল করেছেন আপনার নাম পৃথিবী থেকে মুছে দেবার জন্য লোক লাগানো হয়েছিল। আর সে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল হেনরি মর্শে বা তার অংশীদারকে। তাদের মোটা টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল।
ব্লাস্ট চিৎকার করে বললেন–অবাস্তব সব কথাবার্তা বলছেন আপনি?