করমর্দন করে কুশল বিনিময় করলেন দুজনে।
ব্লাস্ট সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তাকে সনাক্ত করতে পেরেছেন কি মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন–হ্যাঁ, তাকে সনাক্ত করা গেছে।
ব্লাস্ট সপ্রশংস কণ্ঠে বললেন–আপনি খুবই ক্লান্ত। আগে বসুন। একটু বিশ্রাম নিন। তারপর সব শুনব।
পোয়ারো দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। তিনি একটি সোফায় বসে পড়লেন। তারপর বলতে শুরু করলেন–ধন্যবাদ, মি. ব্লাস্ট। সত্যিই আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত। তবে বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে কিছু কথা জানানোর জন্য এসেছি কিন্তু তা আপনার ভালো না লাগতেও পারে।
ব্লাস্ট উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন–কেন সে কি আর বেঁচে নেই?
পোয়ারো নিরাসক্ত স্বরে বললেন–সেটা নির্ভর করছে আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন তার ওপরে।
ব্লাস্ট ভুকুঁচকে বললেন–যে কোনো মানুষই হয় মৃত না হয়, জীবিত হতে পারে। মিস সেইনসবারি সীল এর মধ্যে যে কোনো একটি হবেন।
পোয়ারো কৌতূহলী হয়ে বললেন মিস সেইনসবারি সীল? ইনি কে?
ব্লাস্ট অবাক হয়ে বললেন–সে কি আপনি একে চেনেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো আমতা আমতা করে বললেন–না–তা ঠিক নয়। একজনকে অবশ্যই ওই নামে চিনি। তিনি কলকাতায় থাকতেন, মিশনারীদের হয়ে কাজ করতেন। সম্প্রতি তিনি এখানে এসেছেন। মহারানি নামের একটি জাহাজে চড়ে। সেই জাহাজে মি. অ্যামবেরিটিসও এসেছেন। তবে তারা একই শ্রেণির যাত্রী ছিলেন না। তাঁরা দুজনেই লণ্ডনে নামেন। পথে দুজনের আলাপ হয়। ভদ্রলোক উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি মিস সীলকে মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানান স্যাভয় হোটেলে, মহিলার কাছে সে এক অত্যাশ্চর্য অনুভূতি। ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল তিনিও যেন বিরাট কিছু পেতে চলেছেন। কারণ ওই অতি সাধারণ মধ্যবয়স্কা মহিলা যে তাঁর সামনে এক সোনার খনির দরজা উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে তা তিনি জানতেন না। অথচ মহিলা নিজে এ-বিষয়ে কিছুই অনুমান করতে পারেননি।
মি. ব্লাস্ট চিন্তাক্লিষ্ট স্বরে বললেন–তাহলে আপনি বলছেন ওই মহিলা মিসেস চ্যাপম্যানকে খুন করেননি?
পোয়ারো গম্ভীর সুরে বললেন কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। এটা এক কঠিন সমস্যা। ঠিক আছে যেখান থেকে রহস্যটা আমি প্রত্যক্ষ করেছি সেখান থেকে বলি। সে একটা জুতো কাহিনি।
ব্লাস্ট আশ্চর্য হয়ে বললেন–অভূতপূর্ব ঘটনা। শেষে কিনা একটা জুতো?
পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে বললেন–হ্যাঁ, অভূতপূর্বই বটে! একটা বকলস আঁটা জুতো, দন্তচিকিৎসক হেনরি মর্লের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমি রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি এসে থামল ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিটের দরজায়। গাড়ি থেকে প্রথমেই একটি জুতো পরা পা বেরিয়ে এসেছিল। আমি লক্ষ্য করলাম পায়ের মালিক কোনো এক মহিলা। তার জুতোটি আমার পছন্দ হল না। সস্তা দামের জুতো। তবে নতুন চামড়ার তৈরি। তাতে বড় একটা চকচকে বকলস লাগান।
মন দিয়ে বকলসটা আমি দেখছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ওই মহিলা গাড়ি থেকে নেমে এলেন। চেহারা কিংবা পোশাকে আকর্ষণ করার মতো কিছুই ছিল না। চল্লিশোর্ধ এক মহিলা। পরনের পোশাকটিও কম দামি।
ব্লাস্ট বললেন মিস সেইনসবারি সীলকে আপনি দেখেছেন?
নিশ্চয়ই। তিনি নামতে গিয়ে একটু বিপদে পড়েছিলেন। তার জুতোর বকলস গাড়ির দরজায় আটকে গিয়েছিল। ফলে সেটা ছিঁড়ে যায় এবং ছিটকে এসে পড়ে রাস্তায়। আমি সেটা তুলে তাঁকে দিই। এরপর তিনি মর্লের বাড়ির ভেতর চলে যান। আর আমিও আমার গন্তব্যে রওনা দিই। এখানেই ঘটনার সূত্রপাত এবং শেষ।
আবার সেদিনই ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমার সঙ্গী ছিলেন চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ। মর্লের মৃত্যু রহস্যের জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমরা গিয়েছিলাম। তখনও তিনি তার জুতোর বকলস সেলাই করতে পারেননি। ওই দিনই সন্ধ্যায় তিনি তাঁর হোটেল থেকে অন্তর্ধান হয়েছিলেন। এই গেল প্রথম পর্ব।
এবার দ্বিতীয় পর্বে আসছি। এরপর একদিন জ্যাপ আমাকে ডেকে পাঠান কিং লিওপোল্ড ম্যানসনে। সেখানের একটি ফ্ল্যাটে একটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। মৃতদেহটি ছিল একটি সিন্দুকের মধ্যে। আমার উপস্থিতিতে সিন্দুকটি ভোলা হয়েছিল। তার মধ্যে থাকা একটা বকলস লাগানো পুরোনো জুতো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মি. ব্লাস্ট বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন–এরপর কি হল?
আপনি বোধহয় আমার কথার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেননি? যে জুতোটা লাশের পাশে পাওয়া গেছে সেটি পুরোনো। অর্থাৎ ব্যবহার করা। আমরা স্থানীয় সূত্রে জানতে পারি, মিস সেইনসবারি সীলকে সেদিন সন্ধ্যায় কিং লিওপোন্ড ম্যানসনে দেখা গিয়েছিল। সকালে ছিল নতুন জুতো অথচ সন্ধ্যায় তা হয়ে গেল পুরোনো। কোনো মহিলা কখনোই এক দিনে দু’জোড়া জুতো ব্যবহার করে না। আশা করি আপনিও আমার সঙ্গে একমত হবেন, মি. ব্লাস্ট।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট জানতে চাইলেন তার কি দু’জোড়া জুতো থাকতে পারে না?
–অসম্ভব! কখনোই ছিল না। আমি এটার ওপর জোর দিচ্ছি এই কারণে জ্যাপ ও আমি তাঁর ঘরে গিয়েছিলাম, গ্লেনগাউরি কোর্টে। তার সব জিনিসপত্র আমরা নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম, সেখানে বকলস লাগানো দ্বিতীয় কোনো জুতোর সন্ধান পাওয়া যায়নি, এবার নিশ্চয়ই ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে বুঝবেন?