ধন্যবাদ জানিয়ে এরকুল পোয়ারো বাইরে বেরিয়ে এলেন। জল পড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। পিছনের দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল।
পোয়ারো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। শেষ ধাপে দেখা হল সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কর্নেলের সঙ্গে। পোয়ারোর মতে লোকটি দেখতে সুশ্রী, উঁচুমানের শিকারী সম্ভবত অনেক বাঘও শিকার করেছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি স্তম্ভও বটে।
কাল বিলম্ব না করে মি. পোয়ারো ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি তাঁর টুপি ও ছড়িখানা রেখে গিয়েছিলেন। যেই অস্থির হলেন আর একজনের ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল সেই রোগীটি একটি ফিল্ড পত্রিকা পড়ছিলেন।
এরকুল পোয়ারো গোয়েন্দাসুলভ দৃষ্টিতে তাকে পরখ করতে লাগলেন। তিনি ভাবলেন যুবকটি কোনো খুন করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, হয়তো বা ইতিমধ্যে কোনো জঘন্যতম অপকর্ম করে ফেলেছে। নয়তো ছেলেটি আদৌ কোনো খুন করেনি। এতটা হিংস্র সে হতে পারবে না। হয়তো তার যন্ত্রণা উপশম হলেই হাসিমুখে বেরিয়ে যাবে।
সেই ছোকরা চাকরটা আবার ঘরে এল স্পষ্ট উচ্চারণে মি. ব্লাস্টকে ডাকলো।
এবার ফিল্ড পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে থাকা ব্যক্তিটি উঠে দাঁড়ালেন। মাঝারি গড়নের মধ্যম উচ্চতা বিশিষ্ট, মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। মেদ বর্জিত দেহ, তবে রোগাও বলা যাবে না। সাজসজ্জায় রুচির ছোঁয়া আছে। ধীর-স্থির ভাবভঙ্গি।
ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী ও ক্ষমতাবান পুরুষ হয়েও তাঁকে দাঁতের রোগের কাছে হার মানতে হয়েছে। তাই ছুটে এসেছেন দন্তচিকিৎসকের কাছে আর তার মনের অবস্থাও অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই।
এরকুল পোয়ারো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে টুপি ও ছড়ি নিয়ে দরজার কে এগিয়ে গেলেন। দরজা অতিক্রম করার আগের মুহূর্তে তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন, আর তখনই তাঁর মনের ভেতর একটা সন্দেহ উঁকি মারল, অসহ্য দাঁতের ব্যথা এই যুবকটিকেও কাবু করেছে।
পোয়ারো হলঘরে এসে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইচ্ছে ছিল গোঁফ জোড়াটি স্বস্থানে আছে কিনা তা দেখা। কেননা মি. মর্লের দাঁত পরিচর্যার সময় একটু অবিন্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
গোঁফ জোড়া ঠিকঠাক করলেন। মনমতো হওয়ায় এলিভেটরে করে একেবারে নীচে নেমে এলেন। ছোরা চাকরটিকে দেখতে পেলেন। সে শিস দিতে দিতে এগিয়ে আসছিল। পোয়ারোকে দেখে ছেলেটি থমকে দাঁড়াল কিছুক্ষণ তারপর দ্রুততার সঙ্গে দরজাটি খুলে ধরল।
সেই সময় বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সির দরজা খুলতেই একটি পা মি. পোয়ারোর নজর কাড়ল। কৌতূহলবশত মি. পোয়ারো পার্টিকে জরিপ করতে লাগলেন।
সেই পায়ে অত্যন্ত দামি মোজা। তবে জুতো দেখে পোয়ারো নাক শিটকোলেন, অবশ্য জুতোটা নতুন, তাতে নড়লেন পোয়ারো। যতটা সুন্দর ধারণা করেছিলেন তা ঠিক নয়। বরং গ্রাম্য মিশ্রণ।
ততক্ষণ পায়ের মালিক ট্যাক্সি ছেড়ে মাটিতে পা রেখেছেন। অন্য পার্টি বের করার সময় ট্যাক্সির দরজায় ধাক্কা খেল। আর সঙ্গে সঙ্গে বকলসটি খুলে ছিটকে পড়ল। ফুটপাতে টুং করে একটা শব্দ উঠল–পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে আনলেন এবং মহিলার দিকে এগিয়ে ধরলেন।
বেচারা পোয়ারো! তিনি ভেবেছিলেন পায়ের মালিক কম বয়সি কোনো যুবতী হবে। কিন্তু হল তার উল্টো। বছর পঞ্চান্নর এক মহিলা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। এলোমেলো ধূসর চুল। পরনের পোশাকটিও বেমানান। সবুজের অধিক্য রয়েছে। হঠাৎ মহিলার চোখ থেকে চশমাটা খুলে পড়ল, ওটা তুলতে গিয়ে তিনি হাতব্যাগটিও ফেলে দিলেন। পোয়ারো ভদ্রতার খাতিরে সে দুটো তুলে দিলেন ওই মহিলার হাতে।
মহিলা পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানিয়ে ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিটের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
পোয়ারো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলায় সে বেজায় চটে গেল। বলল মহিলা ভীষণ কিপটে, কোনো বকশিস দিলেন না।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, ট্যাক্সি কি খালি? তাহলে আমি যেতে পারি।
ট্যাক্সি ড্রাইভার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে এরকুল পোয়ারো গাড়িতে উঠে বসলেন।
ভালভাবে বসতে বসতে বললেন–এখন আমিও যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেয়েছি।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে। সে কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে পোয়রোকে দেখছে।
তার চাহনি দেখে পোয়ারো হেসে বললেন আরে না, না–তুমি যা ভাবছ আমি তা নই, আমি মাতাল নই। প্রকৃত কথা হল আমি দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের চেম্বারে এসেছিলাম।
তিনি বলেছেন আগামী দু’মাসের মধ্যে আর আসতে হবে না। সেই আনন্দেই আমি আত্মহারা।
০২. তিন চার আটকাও দ্বার
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন পৌনে দুটো। দিবা নিদ্রার সময়। এরকুল পোয়ারো দ্বিপ্রহরিক আহার সেরে সবেমাত্র আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। ঠিক তখনই ঝনঝন শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠল। টেলিফোনটা প্রথমে মি. পোয়ারো ধরলেন না। তিনি জর্জের ধরার অপেক্ষায় রইলেন।
জর্জের রিসিভার তুলে কথা বলার ভঙ্গি দেখে মি. পোয়ারো জানতে চাইলেন কার ফোন? কি বলছেন?
জর্জ রিসিভারের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল–চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ, স্যার।
পোয়ারো চিন্তিত মুখে রিসিভারটা হাতে নিয়ে বললেন–হ্যাঁল্লে জ্যাপ। ব্যাপার কি?
–পোয়ারো বলছেন? ও প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল। হ্যাঁ বলছি।