ফ্ল্যাটে পাওয়া নিহত মহিলার পরিচয়ের চাঞ্চল্যকর বর্ণনা শোনার পর মিসেস অ্যাডমস বললেন, খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারলাম দেহটা মিস সেইনসবারি সীলের নয়, মিসেস চ্যাপমান নামে এক মহিলার। খবরটা পড়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে এটা ভেবে দুঃখ হচ্ছে আপনারা এখনও তার খোঁজ পেলেন না। আর সে কেন যে এভাবে অদৃশ্য হয়ে রয়েছে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, মি. পোয়ারো, আমার বান্ধবীর কি স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে?
পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন–এটা হওয়া সম্ভব। এরকম ঘটনার কথা এর আগে আমি শুনেছি। ডাক্তারি শাস্ত্রে একে বলে অ্যামনেসিয়া। মিসেস অ্যাডামস বললেন, হ্যাঁ, আমার এক বন্ধুর এরকম রোগ হয়েছিল।
পোয়ারো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–মাদাম, মিস সীলের মুখে কখনো মিসেস অ্যালবার্টের নাম শুনেছেন?
না। মিসেস অ্যাডামস আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলেন, পুলিশ কি বুঝতে পেরেছে। মিসেস চ্যাপম্যানকে কে খুন করেছে?
–এটা তদন্ত সাপেক্ষ। এবার পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আপনি কি মিস সীলকে দন্ত–চিকিৎসক মি. মর্লের কাছে যেতে বলেছেন?
-না, আমি হার্লে স্ট্রিটের মি. ফ্রেস্কের কাছে যাই। আমি যদি জানতাম সেইনসবারি দাঁতের অসুখে কষ্ট পাচ্ছে তাহলে সেখানেই পাঠাতাম। মি. মর্লের কাছে নয়।
পোয়ারো বললেন মিস সীল, মর্লের নাম শুনেছেন মিসেস চ্যাপম্যানের থেকে।
মিসেস অ্যাডামস বললেন–হতে পারে।
পোয়ারো এবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন মিস সেইনসবারি সীলের সাথে প্রথম দেখা হয় কোথায়?
তিনি জবাব দিলেন মিস সীলকে প্রথম দেখি ভারতে। সেখানেই তার সাথে আমার পরিচয় হয়।
–মিস সীলের সঙ্গে মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের প্রথম দেখা হয় কি ভারতেই?
–ওহ্, আমি বলতে পারব না। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট! সেই বিখ্যাত ব্যাঙ্কার। ওরা ভাইসরায়ের কাছে গিয়েছিলেন। মনে হয় না আমার বান্ধবী কখনো মি. ব্লাস্টকে দেখেছে। এত উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হলে সে অবশ্যই আমাকে বলত।
ব্লাস্ট পরিবারের অন্য কাউকে তিনি চিনতেন কি?
–ওহ, হ্যাঁ। ও তাদের চিনত মনে হয় না। আমাদের সব বান্ধবীরা একরকম সাধারণ মানুষ।
মিসেস অ্যাডামস বান্ধবীর প্রশংসা করতে লাগলেন। তিনি বলে চললেন, ওর মতো বান্ধবী খুব কম পাওয়া যায়। ওর মন খুব নরম। সকলের দুঃখে ও দুঃখী। ও সবার উপকার করত প্রাণ দিয়ে। ওর প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। এছাড়া কলকাতার মিশনারীদের জন্য ও চাঁদা তুলত। এই টাকা জোগারের জন্য আমার বান্ধবী অপরাধ করতেও কুণ্ঠা বোধ করত না। এবার বুঝতে পারছেন তো ও কতটা উদারমনস্ক মানুষ ছিল, মঁসিয়ে পোয়ারো।
সত্যিই, তাই। পোয়ারো ভাবলেন, মিস সীলের গুণের কথা মি. বার্নেসও বলেছিলেন। তাঁর মতে মিস সীল দয়ালু, সম্ভ্রান্ত, ভদ্র একজন মহিলা। এরকম মানুষের মধ্যে অপরাধ বোধের বাসনা সুপ্ত থাকে। নিপুণভাবে পরখ করলে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
মি. অ্যামবেরিওটিস ও মিস সীল একই জাহাজে ভারত থেকে ফিরেছিলেন। তারা একসঙ্গে স্যাভয় হোটেলে লাঞ্চ সেরেছেন, এই প্রমাণও পাওয়া গেছে। তিনি কিং লিওগোল্ড ম্যানসনে দু’দিন গিয়েছিলেন। যে ফ্ল্যাটে তিনি গিয়েছিলেন সেই ফ্ল্যাটে একটি মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। তার পরনে ছিল মিস সীলের পোশাক। এমনকি তার হাত ব্যাগটিও ওই মৃতদেহের পাশে পাওয়া গিয়েছিল।
তিনি পুলিশের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তারপর হঠাৎ একদিন গ্রেনগাউরি কোর্ট হোটেল থেকে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন।
এরকুল পোয়ারোর থিয়োরির সঙ্গে মিলিয়ে এর কোনো ব্যাখ্যা কি আছে?
তিনি ভাবলেন, অবশ্যই আছে।
একরকম ঘোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন এরকুল পোয়ারো। ট্যাক্সি ধরতে হবে। তিনি এসে হাজির হলেন রিজেন্ট পার্কে।
গ্রীষ্মকালীন একটা বিকেল। ফুরফুরে বাতাস বইছে। কিছু বাচ্চা আয়াদের সঙ্গে পার্কে বেড়াতে এসেছে। তারা প্যারামবুলেটারে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে। হাসছে, খেলছে। কোনো কোনো বাচ্চা কাগজের নৌকো তৈরি করে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। গাছের নিচে প্রেমিক প্রেমিকা বসে আলাপচারিতায় মত্ত রয়েছে।
এইসব দেখে তার মনে পুলক জাগল। তার অতীতের কথা মনে পড়ল। কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব সুখের দিনগুলো।
তাঁর মনের পরদায় ভেসে উঠল এক রহস্যময়ী নারীর চেহারা। এক ভেনাস যেন স্বর্গের এক পরী। সে রাশিয়ান বংশোদ্ভুত কাউন্টেস ভেরা। অপূর্ব সুন্দরী তন্বীর কাউন্টেসের সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো মেয়েই নেই এই দেশে। পোয়ারোর এও মনে পড়ল কত বড় তস্কর কাউন্টেস।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে চললেন খুশি মনে। আচমকা তার চোখে ধরা পড়ল এক রোমান্টিক দৃশ্য।
একটি গাছের আড়ালে একটি তরুণ ও তরুণী বসে আছে। তরুণটি মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে বলে পোয়ারোর মনে হল। তিনি ওই দুটি মূর্তিকে চিনতে পারলেন।
জেন অলিভেরা ও তার আমেরিকান বন্ধু হাওয়ার্ড রেইকস। এরাও তাহলে রিজেন্ট পার্কে আসে বেড়াতে? তার মুখে কাঠিন্যের ভাব।
মিনিট কয়েক চিন্তা করলেন। তারপর তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বিচিত্র কায়দায় মাথার টুপি খুলে তাদের সামনে তিনি দাঁড়ালেন।
তাকে দেখে জেন অলিভেরার চোখ মুখ খুশিতে ভরে গেল। কিন্তু হাওয়ার্ড রেইকস তার অযাচিত আবির্ভাবে খুব রেগে গেল।