পোয়ারোর সায় পেয়ে হাওয়ার্ড রেইকস ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন।
পোয়ারোর ভীত সন্ত্রস্ত মুখ দেখে তিনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন আমাকে দেখে চমকে উঠেছেন মনে হয়। সারা সন্ধ্যা আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করেছেন। আপনার সন্ধিহান চোখের দৃষ্টিতে আমি চিন্তার কালো মেঘ দেখতে পেয়েছিলাম।
–তাতে আপনার উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
–আমি জানি আপনার মনে আমার সম্বন্ধে কৌতূহল আছে। হয়তো ইতিমধ্যে অনেক কিছু জেনেছেন। তাই একটু উৎকণ্ঠা তো হতেই পারে।
–তা যদি হয় আপনার অসুবিধা কোথায়?
–আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে সব কথা বলব। সেদিনের ঘটনাটা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো হয়েছে। সেদিন যখন মি. ব্লাস্ট ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তখন আমি সেখানে ছিলাম। আর সেই মুহূর্তে লোকটি তার দিকে গুলি ছোঁড়ে। সেটা আমার নজরে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমি লোকটির ওপর লাফিয়ে পড়ি ও ধরে ফেলি। লোকটি আমার জানা। তার নাম রাখলাম। সে খুব ভালো ছেলে। দোষের মধ্যে সে অল্পতেই রেগে যায়। আর রাগলে তার জ্ঞান থাকে না। সে ভারতীয়। ভারতের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে সে তা অনুধাবন করেছে। যাই হোক ওই দুজন সম্মানীয় ব্যক্তির সেদিন কোনো ক্ষতি হয়নি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই গুলি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আমি ওই ভারতীয় ছাত্রটিকে পালানোর সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলাম। তাই ময়লা জামা কাপড় পরা একটি তরুণকে জাপটে ধরে নাটক করেছিলাম। কিন্তু আশা ফলবতী হয়নি। আপনাদের পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পারিনি। তারা আমার থেকে বেশি চালাক। সুতরাং রামলালকে ধরতে বেশি কসরৎ করতে হয়নি ওদের। এটাই প্রকৃত ঘটনা। বুঝেছেন গোয়েন্দা মশাই?
এরকুল পোয়ারো বললেন–আর আজকের ঘটনার কি জবাবদিহি করবেন?
মি. রেইক গ্রীবা ফুলিয়ে বললেন–আজকের ঘটনা অন্য রকমের। এখানে রামলাল নেই। আছে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার। সেইই গুলি ছুঁড়েছিল। বন্দুকসহ ওকে আমি পাকড়াও করেছি। ও দ্বিতীয়বার গুলি ছোঁড়ায় সচেষ্ট হয়েছিল। আমি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করি।
পোয়ারো বললেন মি. ব্লাস্টের নিরাপত্তার জন্য আপনি খুব ভাবেন?
রেইকস দরাজ হাসি হাসলেন।
–আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? মানছি আমি মি. ব্লাস্টের নীতির পক্ষপাতী নই। ওনার বেঁচে থাকা সকলের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। মানুষের উন্নতির জন্য ওনাকে মেরে ফেলা উচিত। তবে আপনি ভাববেন না ওনার ওপর আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে। উনি ইংরেজ হলেও চমৎকার মানুষ। এসব কথা ভেবেই আমি ওনাকে দু-দুবার রক্ষা করেছি।
নীতি ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য অনেক।
–সেকথা আমি অস্বীকার করছি না। আমার মনে হল আপনাকে সব কথা বলা উচিত। তাই বললাম, মন ভোলানো হাসি হেসে হাওয়ার্ড রেইকস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
গ্রামের গির্জা। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট সকালের প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে এসেছেন। নিমন্ত্রণ কর্তার আহ্বানে এরকুল পোয়ারোও এসেছেন গির্জায়। মিসেস অলিভেরা ও তার মেয়ে জেন কৌশলে তাদের সঙ্গী হয়েছেন। হাওয়ার্ডও বাদ যায়নি। সেও এসেছে।
হাওয়ার্ড রেইকস অবিশ্বাসের সুরে বলল–মি. ব্লাস্ট, আপনিও তাহলে নিয়ম করে গির্জায় আসেন?
অ্যালিস্টেয়ার মিষ্টি হেসে বললেন–আমি গ্রামের মানুষ। তাই এখানকার মানুষদের মতামতকে মর্যাদা দিই। কথাটা শুনে পোয়ারো মাথা নেড়ে বিজ্ঞের হাসি হাসলেন।
মিসেস অলিভেরা ভরাট গলায় আবৃত্তির সুরে প্রার্থনা করছেন–হে পরমপিতা, আমাকে শয়তান মানুষ থেকে রক্ষা করুন, বদ মানুষ থেকে উদ্ধার করুন।
মিসেস অলিভেরার বক্তব্য পোয়ারো অনুধাবন করতে পারলেন। তিনি ভাবলেন, এক্ষেত্রে হাওয়ার্ডকে শয়তান ও বদ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিশ্চয়ই।
গির্জায় কয়ার বয়রা প্রার্থনা সংগীত গাইছে, হিংস্র সাপের মতো তাদের জিভ লকলক করছে, অ্যানাকোণ্ডার বিষ তাদের ওষ্ঠে।
সেই সঙ্গে জুলিয়ার তীক্ষ্ণস্বর আরও তীব্র হয়ে উঠল–সে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের, বিশ্বাসঘাতকদের সংস্রব থেকে আমাকে দূরে রাখো। দুষ্টকে দমন করার সহাস দাও আমাকে…।
এরকুল পোয়ারো তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন–হে প্রভু, আমাকে সকল প্রলোভন থেকে দূরে রাখো, আমাকে শক্তি দাও চক্রান্তকারীদের পাতা ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার…।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখ গেল একটা গর্তের দিকে। সেই গর্তটা তার পায়ের কাছেই রয়েছে। একটু অসাবধান হলেই তাতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। খুব কৌশলে গতটা খোঁড়া হয়েছে। তাঁকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা একেবারে পাকা।
তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন বাহ্যিক জ্ঞান শূন্য হয়ে। কে যেন সম্মোহনি শক্তিতে সম্মোহিত করেছে। ইত্যবসরে প্রার্থণা গীত সঙ্গে হয়েছে। প্রার্থনাকারীরা সবাই আসন গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পোয়ারো মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। জেন অলিভেরা ওই দৃশ্য দেখে তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। এরকুল পোয়ারো সম্মোহিতের মতো বসে পড়লেন।
একজন বৃদ্ধ যাজক পাঠ শুরু করলেন বাইবেল থেকে। তিনি বললেন, স্যামুয়েলের প্রথম বইয়ের পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ থেকে আজ পড়ব।
বৃদ্ধ যাজকের কোনো কথাই এরকুল পোয়ারোর কানে ঢুকছিল না। তিনি গভীর আচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে গিয়েছেন। যার মধ্যে কিছু টুকরো ঘটনা ঘূর্ণির একে অপরের সঙ্গে জড়িত।