এরকুল পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
মি. মর্লে অসন্তোষের ভঙ্গিতে আবার বলতে শুরু করলেন–সকাল থেকেই রোগীদের ভিড় হয়। তখন সাহায্য করার কেউ না থাকলে বলুন তো কত অসুবিধা হয়। কি আর করা যাবে। কর্মচারীদের দুটি তো দিতে হবে। তাই আমি আজ ভীষণ ব্যস্ত। তার ওপর বাড়তি একজন রোগী এসেছে। সে দাঁতের যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। তাকে দেখতে হল। ওখানে কিছুটা সময় গেল। তবুও তড়িৎ গতিতে সব কাজ করতে হচ্ছে আমাকে।
মি. মর্লে খল নুড়িতে কিছু গুঁড়ো করতে বললেন–খ্যাতনামা কিছু ব্যক্তি আছেন। তাঁরা সময়ের দাম দিতে জানেন। তাঁরা ঠিক সময়েই আসেন। যেমন ধরুন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট, বিরাট মাপের মানুষ তিনি। তিনি কথা দিয়েছেন ঠিক বারোটার সময় এখানে আসবেন।
মুখের মধ্যে বেশ কিছুটা তুলো আর কাঁচের টিউব থাকায় স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না মি. পোয়ারো। তবুও দুর্বোধ্য কিছু শব্দ তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট খুবই চমকপ্রদ নাম। এই নামটা উচ্চপদস্থ অফিসার এবং ধনী ব্যক্তিদের মুখে মুখে ঘোরে। কখনো কখনো খবরের কাগজের পাতায় তাঁর সম্পর্কে দু চার কথা লেখা হয়। কিন্তু তিনি ডিউক, প্রধানমন্ত্রী বা জমিদার নন। পরিচয় দেবার মতো চটকদার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই তাঁর। তাঁকে সাধারণ কোনো মানুষ চেনেন না। তবুও মি. ব্লাস্ট অসাধারণ একজন মানুষ, যাঁর হাতে রয়েছে সর্বাধিক ক্ষমতার উৎস মুখ।
হতদরিদ্র এক ইংরেজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বিপুল অর্থের মালিক। এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি সরকারকে ইচ্ছেমতো উঠ-বোস করাতে পারেন। তিনি কোনো দিন মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেননি। একেবারে সাদামাটা জীবনযাপন করেন। মি. ব্লাস্টের স্বনামধন্য হওয়ার গোপন রহস্য হল, তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত এক ব্যাঙ্কেরকর্ণধার। যাঁর অঙ্গুলিহেলনে সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়।
মি. মর্লে গর্বের সঙ্গে বলতে লাগলেন–চিরদিনই সময় ধরে তিনি সব কাজ করে আসছেন। মাঝেমধ্যে পায়ে হেঁটে অফিসে যান। গল্ফ তার প্রিয় খেলা আর বাগান পরিচর্যা করা তাঁর একটা সখ। ইচ্ছে করলে তিনি সারা ইউরোপ মহাদেশকে হাতের মুঠোয় আনতে পারেন। ভাবলে অবাক লাগে এই মানুষটার মধ্যে কোনো অহংকার নেই।
এইসব মন্তব্য শুনে এরকুল পোয়ারোর মন বিতৃষ্ণায় ভরে যায়। মি. মর্লে দন্তচিকিৎসক হিসেবে জানিয়েছেন একথা যতটা সত্যি ঠিক ততটাই সত্যি তার থেকেও নামকরা দন্ত বিশেষঙ্গ এই লন্ডন শহরে আছেন। কিন্তু এরকুল পোয়ারো সেখানে এখন এক এবং অদ্বিতীয়।
মি. মর্লে বললেন–মুখ কুলকুচো করুন। এবার তিনি দ্বিতীয় দাঁতটিতে ড্রিল রেখে বললেন, হিটলার, মুসেলিনীর সঙ্গে এসব মানুষের তুলনা চলে, কি বলেন মশাই! আমি বাবা রেখে ঢেকে কথা বলতে পারি না। অবশ্য এসব কথা আপনাকে বলে কি লাভ, আপনি তো ফরাসি, আপনি রিপাবলিকান মতবাদে বিশ্বাসী?
পোয়ারো অস্পষ্ট স্বরে বলতে চেষ্টা করলেন–আ আমি ফ-ফরাসি নই, আ–আমি বেলজি–। সঙ্গে সঙ্গে মি. মর্লে তাঁর মুখে হাত চাপা দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।
কুণ্ঠিত মুখে তিনি বললেন–দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না, দাঁতের গর্তটা ঠিকমতো শুকোতে দিতে হবে। তিনি মুখের ভেতর গরম বাতাস দিতে লাগলেন।
নিঃস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে কিছুটা সময় কেটে গেল।
মি. মর্লে আবার বলতে লাগলেন–আমি ভাবতেই পারিনি যে আপনি বেলজিয়াম। ভারি অদ্ভুত তো। রাজা লিও পোন্ডের কথা কে না জানে। রাজকন্যের শাসনব্যবস্থা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও কম প্রশংসনীয় নয়। কি সুন্দরভাবে তাঁরা সব কিছু মনে রাখে। এত তাদের প্রখর স্মৃতিশক্তি। সহজে কারও নাম ভোলে না। তবে এই সহজাত ক্ষমতা অনেকের ক্ষেত্রে ভগবান প্রদত্ত হয়। এই আমাকেই ধরুন না, কোনো লোকের নামে আমি চিনব না, কিন্তু তাকে একবার দেখলে জীবনেও ভুলব না। কারণ সেই ব্যক্তির নাম আমার মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তার মুখটা স্মৃতির অতলে গেঁথে থাকে। নিন আর একবার মুখটা ধুয়ে ফেলুন।
মুখ ধোওয়া হলে মি. মর্লে দাঁতগুলো আবার ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করলেন। নিখুঁত তাঁর কার্যধারা, কোনো গাফিলতি নেই, নেই ক্লান্তিভাব।
সব ঠিকঠাক হয়েছে, ভয়ের কারণ নেই। আস্তে আস্তে মুখটা বন্ধ করুন তো, আবার খুলুন। লাগছে বুঝি? গর্তটা বুজে গেছে বুঝতে পারছেন না? আগের মতো একবার মুখ খুলুন ও বন্ধ করুন তো। না না, চিন্তা নেই খুব ভালো ভাবেই ভরাট হয়েছে।
সশব্দে চেয়ার টেবিল সরালেন মি. মর্লে।
মুক্ত বিহঙ্গের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এরকুল পোয়ারো।
মি মর্লে কৌতুক করে বললেন আমার বাড়িতে কোনো অপরাধীর সন্ধান না পাওয়ায় আপনি নিশ্চয় হতাশ হয়েছেন মি. পোয়ারা।
পোয়ারো হেসে বললেন–এখানে আসার আগে প্রত্যেককেই অপরাধী বলে মনে হয়েছিল আমার। এবার অন্যরকম মনে হবে হয়তো।
তা ঠিক। আগে পরের মধ্যে অনেকটা পার্থক্য আছে। যে যাইহোক, আমাদের অর্থাৎ দন্তচিকিৎসকদের আপনার নিশ্চয়ই খারাপ মনে হয় না। এলিভেটরে পৌঁছে দেবার জন্যে কারো সাহায্য লাগবে আপনার?
না, না, ব্যস্ত হবেন না আপনি, আমি একাই যেতে পারব।
যা খুশি আপনার, সিঁড়ির পাশেই এলিভেটর। তাহলে বিদায়–মঁসিয়ে পোয়ারো।